আমারে যত বাঁধা দিতাছে, আমি তত শার্প হইতাছি – আজম খান
আজম খানের (১৯৫০ – ২০১১) এই ইন্টারভিউটা নেয়া হইছিল ২০১১ সালের মার্চ মাসে। উনি মারা যান জুন মাসে। ইন্টারভিউটা দেশ টিভি’তে দেখানো হইছিল। ইউটিউবে কয়েকটা ভার্সন পাওয়া যায় এই ইন্টারভিউটার। আমাদের জন্য ট্রান্সক্রিপ্ট’টা করে দিছেন হুসাইন হানিফ।
…
কবির সুমন: আজম সাহেব, আমি তো কলকাতার লোক।
আজম খান: আরে সাহেব বইলেন না, আহা, ভাই বলেন!
কবির সুমন: আমি তো কলকাতার লোক। কলকাতায় আমরা কিন্তু আপনার নাম শুনেছিলাম, কিন্তু গান শোনার সুযোগ কলকাতায়… আমি বলছি, আমার আজকে তেষট্টি বছর বয়স। আমরা বোধহয় প্রায় সমবয়সী?
আজম খান: হ্যাঁ। আমারও বাষট্টি চলতাছে।
কবির সুমন: কিন্তু সেই সময় এতটা যোগাযোগ ছিল না। ফলে আমরা অনেকেই দুর্ভাগ্যবশত আমরা প্রায় কিছুই জানি না। অথচ আপনি অবিসংবাদিতভাবে রক সম্রাট নামে পরিচিত। বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গেও। আপনি এই যে এই রকসম্রাট নামটা আপনার কেমন লাগে?
আজম খান: আসলে সম্রাট গুরু এইসবের জন্য তো আর আমি সঙ্গীত করি নাই। আমাদের ফ্যামিলির ট্রেডিশনের মধ্যেই সঙ্গীতটা আছে। আমাদের আত্মীয়স্বজন মা বাপ ভাই বোন, সবাই গান বাজনা কম বেশি জানে। তো এইখানে আমার মেজভাই আলম খান, সুরকার, সঙ্গীত জগতের। আর আমি এই লাইনে মানে কিছু না জাইনা আর কি।
তা আমার ইচ্ছা ছিল যে, প্রথমে গণসঙ্গীত করতাম আর কি; স্কুলে লাইফে, শেষের দিকে, তখন নাইন টেনে পড়ি। তখন পাকিস্তান সরকার আইসা আমাদের ঠকায়, তখন বুঝতাম আর কি। এই বিপ্লবী মাইন্ডের একটু ছিলাম। গান বাজনা গণসঙ্গীত গাইতাম। এই করতে করতে যুদ্ধ লাগলো। যুদ্ধে চইলা গেলাম। ওইখানে ক্যাম্প লাইফে, আগরতলায়, মেলাঘর ক্যাম্পে…
কবির সুমন: আপনি মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন?
আজম খান: হ্যাঁ, আমি একজন সেকশন কমান্ডার। আমার ভাইগ্য ভালো আমি ফ্রন্টেও ফাইট করছি সরাসরি—সম্মুখযুদ্ধ, এবং গেরিলা স্টাইলে, ঢাকা, ঢাকার আশেপাশে অঞ্চল—সব জায়গায় ফাইট করছি।
কবির সুমন: অত অল্প বয়সে?
আজম খান: তখন আমার বয়স কত, পঞ্চাশ সালে জন্ম, নাইনটিন ফিফটিতে—সেভেনটি ওয়ান—একুশ পার হয়া বাইশে পড়ছি। তো যাইহোক তখন তো গণসঙ্গীত শালবনের, সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে ডিউটি কিছু থাকত না।
ভাব বুইঝা গ্রেনেড বক্স, থালা বাসন চামচ লয়া আমরা হইচই করতাম। আর ঢাকার ছেলে, একটু ফরোয়ার্ড বেশি ছিল, স্বাভাবিক শহরের। আমরাই প্রাধান্য নিতাম আর কি। ওস্তাদ, টস্তাদ, অনেক—গ্রামের ছেলেরা সব আইসা হাজির হয়া যাইতো। একদম ডেইলি এইটা সন্ধ্যার সময় বান্ধা থিয়েটার ছিল। আর সবাই খুব মজা পাইতো। এই করতে করতে ওইখানে একটা গণসঙ্গীত আসর করলাম। প্রায় পাঁচ ছয়টা লোক। আপনার, তখন ওই, আর্মির অফিসারের ওয়াইফরা শুদ্দা কানতাছে। এত সুন্দর প্রোগ্রাম হইছিল।
তখন ফ্রন্টে চইলা গেলাম। এইখানে ত্রিপুরা রাজ্যের দুইটা মিনিস্টার ছিল, ওনারা রেডিও, তারপরে পেপার, দুধ, চা, চিনি—এইসব সব সেকশন কইরা দিল খুশি হয়া। আমরা খাইতে পারলাম না, আমরা ফ্রন্টে যুদ্ধে চইলা গেলাম। আসলাম, বেতন পাইলাম, ৫০, ৭৫ টাকা। যুদ্ধ টুদ্ধ শেষ হইলো।
তখন ঢাকার মনে করেন যে, মানুষ সংখ্যা খুব কম। ছেলেমেয়েরা শখে শখে গান বাজনা নাটক টাটক করে। তো আমি তখন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, ছেলেমেয়েদের যাতে ডিস্টার্ব না করে একটু দেইখা রাখতাম, শিল্পীগোষ্ঠিটারে—পরিচিত সব। এরা প্রথম তখন টেলিভিশন আমাদের একটাই ছিল, ডিএটি’তে সেভেনটি ওয়ানের শেষের দিকের কথা আরকি। ওরা একটা প্রোগ্রাম করল ছাব্বিশ জন ছেলে মেয়ে মিইলা। খুব খারাপ প্রোগ্রাম হইছে, একদম, মানে এমন ফল করছে এমন— তাদের মুখ কালো একদম। আমার খুব প্রেস্টিজে লাগলো। তো আমি একটু বন্ধুবান্ধব আড্ডায় ইয়েতে গণসঙ্গীত, তারপর বানায়া ছানায়া ফকিরা গান… (উনি হাতে ইশারা করে দোতারা বা গিটারের মতো কিছু বাজানোর ভঙ্গি করলেন)
কবির সুমন: আপনি কি গিটার বাজাতেন?
আজম খান: না, আমি কোনো যন্ত্র বাজাইতে জানি না। এইটা কথা বলতে গিয়া বলতাছি…
কবির সুমন: (সেইদিকে ঈঙ্গিত করে) না, এইটা করছেন দেখে মনে হলো।
আজম খান: না, বলতাছি আর কি … তখন মনে করেন যে সারা পৃথিবীতে বিটেলস, রোলিং স্টোন, শ্যাডোস, পপের একটা হাওয়া বইতাছে—আমাদের ঢাকা শহরেও বেশকিছু শহরকেন্দ্রিক, ঢাকা চিটাগাং এইসব জায়গাও পপের একটা বাতাস বইতাছে। কিছু ইংলিশ গান টান হয়, প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম হয়। তা আমি চিন্তা করলাম, আমাদের বাংলাদেশের গান করে পপ স্টাইলের জার্নিতে। এই গানগুলি আমি গিটার ড্রামসেট এইগুলি দিয়া করব। কিন্তু ওদের বলি নাই, আমি বলছি তোরা একটা প্রোগ্রাম নে, প্রোগ্রাম নিয়া আমাকে একটু জানাইস।
কবির সুমন: আচ্ছা এই গানগুলি কি আপনাদের তৈরি?
আজম খান: আমারই ম্যাক্সিমাম। তৈরি বললে হবে না, আমি কিন্তু কাগজে কলমে লিখি না। স্লিপ অফ টাং বাইর হয়া যায়, ওইটাই পরে টাইনা গান বানায়া ফেলি, সুর-টুর লাগায়।
কবির সুমন: আচ্ছা, কোথাও লিখছেন না?
আজম খান: না। এই যে আজকে গান লিখতে হবে চেয়ার টেবিল নিয়া বসলাম এইটা না। জার্নিতে থাকতে, রিকশায় একটা গান বের হয়া গেল। এইভাবে হইছে আর কি। যেমন গানের ভেতর একটা গানের কথা বলি: আমার একটা গান আছে খুব ফেমাস, বাস্তবধর্মী আর কি। রেললাইনে ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে, হায়রে হায় বাংলাদেশ, হায়রে হায় বাংলাদেশ।
এই গানটা, আমি যুদ্ধের পরে যখন আমাদের এইখানে খুব সময়টা খারাপ যাচ্ছিল, মানে কী বলব আর কি—দুর্ভিক্ষ। খালাম্মারা দুধ আনতে যাইতাছে কাদা পাড়ায়া, চেয়ারম্যান অফিসে, দুধ পায় না ফেডো। এই রাস্তা স্টেশন থাইকা আরামবাগ, নটরডেম পর্যন্ত, কালো হয়া গেছে, গ্রামের মানুষ ঢাকা আইসা গেছে। ঢাকা আসলে বোধহয় আমরা কিছু বাঁচতে পারব। এরকম দুর্ভিক্ষ। কালো ছায়া, মানুষ মইরা যাইতাছে, লাশ দাফন করার মতো মানুষ নাই। মা বাচ্চারে ফালাই থুয়া ভাগতাছে। আমি প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম কইরা আসতাম, বড় বড় বাবরি দাড়ি, বুঝছেন, একটু ভাব আলাদা, তখন আইসা দেখতাম, ছোট ছোট বাচ্চারা মামা মামা করত, আমিও পয়সাগুলি সব বিলায়া দিতাম। তখন আমার কইলজা ফাইটা গান বাইর হইলো, রেললাইনের ওই বস্তিতে জন্মেছিল একটি ছেলে, মা তার কাঁদে, ছেলেটি মরে গেছে। এইভাবে গানগুলি তৈরি হইছে আমার আর কি।
কবির সুমন: সুর এবং কথা কি একই সাথে?
আজম খান: একই সাথে, স্লিপ অফ টাং আর কি। তারপর উইঠা গিয়া ধরেন সম্পূর্ণ গান তৈরি করতাম।
কবির সুমন: ওখানে সঙ্গে যারা বাজাতেন, কারা বাজাতেন সঙ্গীত?
আজম খান: আমার সাথে প্রথম যারা বাজাইছে, নিলু ছিল—পরীবাগের একটা ছেলে, মনসুর ছিল—মগবাজারে, আর সাদেক নামে একটা ছেলে ফিল্মে তবলা টবলা বাজায়, ও ড্রাম বাজাইতো। আমি কিন্তু বেসিকালি কোনো হারমোনিয়াম তবলা গিটার কিবোর্ড এগুলো কিছু বাজাইতে জানি না।
কবির সুমন: না, গান তো গাইতেন। মানে, আপনার যখন পরিবেশ ছিল – গানের।
আজম খান: বাড়িতে পরিবেশ ছিল না। আব্বা একটু গম্ভীর টাইপের লোক ছিল। আব্বা খুব একটা বাড়িতে এলাউ করত না। পড়ালেখা করো। উনি আবার কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে গোল্ডমেডেলিস্ট ছিল—বাংলায় আবার। উনি থাকতো আবার একেবারে লেখাপড়ার উপর। কিন্তু আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারলাম না, যুদ্ধে চইলা গেলাম, আইসা আবার ইয়া পড়তে পারলাম না।
কবির সুমন: গানের উৎসাহ বাড়িতে কেউ দিতেন—মানে আম্মা…?
আজম খান: আম্মা একটু উৎসাহ দিত। আম্মা ভালো গান গাইতো।
কবির সুমন: আজম ভাই এই যে আপনি গান গাওয়া শুরু করছেন, এই ধরণের গান তো আগে ঠিক এইভাবে হয় নি।
আজম খান: না, না। যুদ্ধ কইরা আসলাম, আমার চোখের সামনে যখন দেখলাম যে ইয়াং জেনারেশন হতাশায় ভুগতাছে। তখন মনে মনে ভাবলাম যে একটা কিছু করা উচিত। যখন দেখলাম হাইজ্যাক টাইজ্যাক রাহাজানি খারাপ দিকে চইলা যাইতাছে, এদেরকে একখানে করব। তখন দেখলাম যে আমার তো সঙ্গীতের জোর আছে, আমি তো মেলাঘর ক্যাম্পেও করছি। একখানে কইরা ফালাইছি। তখন আমি এই সঙ্গীত দিয়া এইটারে আটকায়া ফেললাম।
ইয়াং তোমরা, ঠিকাছে, এনজয় করো, তোমরা উন্নত মানের বিশ্বে উন্নত মন মানসিকতা নিয়া বাঁইচা থাকো—জাস্ট এইটাই। আধুনিক বিশ্বে আধুনিকভাবে বাঁচো—ঠিকাছে। এই এই করতে করতে করতে করতে দিন রাত খাওয়া নাই দাওয়া নাই, এই নিয়াই থাকি।
কবির সুমন: আপনাকে তো গুরু বলে মানতেন সকলে এখনো মানেন। তো আপনার শিষ্যদের মধ্যে কারা কারা ছিলেন?
আজম খান: আমার কোনো গুরু-শিষ্য নাই আসলে। এইটা আবেগে বলে আর কি।
কবির সুমন: আহা, আপনার পারফরম্যান্স থেকে অনুপ্রাণিত যারা, তাদের মধ্যে কাদের নাম আপনার মনে পড়ছে এই সময়ে?
আজম খান: না, এইভাবে যেমন আমার সাথে এগারো বারো বছর গিটার বাজাইছে, রকেট, এখন কানাডায় আছে। খুব ভালো গিটারিস্ট। ওই প্রথম কথাটা শুরু করে আরকি। এই গুরু গুরু! ধূর এইগুলা কী কও তুমি, ফাইজলামি করো, আজম ভাই কবা, নাইলে আসবাই না তুমি এইখানে।
অনেক বকা মাইরধর করছি। তারপরও সে গুরুই কইবো। এই কইতে কইতে বিরক্ত লাগতো আমার আর কিছু কওয়ার ছিল না। তারপর রাস্তাঘাট শহরঘাটের যেইদিকেই যাই রিকশায় এই গুরু গুরু কইতে কইতে লাস্টে হয়া গেছে আর কি। খুব বিরক্ত লাগতো।
কবির সুমন: আজম ভাই কজন আপনার মিউজিশিয়ান ছিলেন সঙ্গে?
আজম খান: মিউজিশিয়ান আপনার কয়জন বলতে হবে ঢাকা শহরের সবাই আমার সাথে বাজাইছে।
কবির সুমন: আপনি ব্যান্ড নিশ্চয়ই তৈরি করেছিলেন।
আজম খান: আমার ব্যান্ড ছিল উচ্চারণ। কিন্তু উচ্চারণ নাম খুব কম মানুষ জানত। এই উচ্চারণ শিল্পীগোষ্ঠী সেভেনটি থ্রি’ত থাইকা এই পর্যন্ত এখনো আছে, যারা জন্মায় নাই তখন, আমার ফ্রেন্ডের ছেলেরা এখন বাজায়। শো-টো করলে ওদেরকেই নিয়ে যাই।কিন্তু ওই চেইঞ্জ হইতে হইতে এখন মনে করেন যে ভাতিজারা বাজায়।
কবির সুমন: গান বন্ধ করলেন কবে?
আজম খান: বন্ধ আমি করি নাই। আমার যখন, অসুস্থ ক্যান্সার, আমি জানি না, মাউথ ক্যান্সার হইছিল। তখন আমি রেকর্ড করতেছি, স্টেইজ প্রোগ্রাম করতেছি, খুব ভালো পারফরম্যান্স করতেছিলাম। লাস্টে ধরেন, হঠাৎ টেস্ট করতে গেলাম, তখন বলল এই অবস্থা। গেদায় কইলো না আজম ভাই, ক্যান্সার হয়া গেছে, কী করা যায়, সবাই এক হয়া গেল একদম; মানে বাংলাদেশের মিউজিক জগতের যারা আছে, এবং মিডিয়া লাইনে যারা আছে। আমি চিন্তা করতে পারলাম না। আমি পলায়া ছিলাম, যে জানতেই দেই নাই কাউকে। তারপর সবাই বলল কি না, যে যা পারো আজম ভাইয়ের জন্য করো, এবং আজম ভাইয়ের চিকিৎসা ঢাকায় হবে না, একদম সিঙ্গাপুর হবে। এই, এরা আমারে বস্তাবন্দী কইরা পাঠায়া দিল সিঙ্গাপুর। ওইখানে যায়া আবার, সব চেকাপ টেকাপ কইরা, কেমোথেরাপি দিল, একবার হসপিটালাইজ হইলাম, আবার দিল রেডিওথেরাপি, উফ্। কী বলব, কী অবস্থা—ডেঞ্জারাস—মানে চিকিৎসা। আবার হসপিটালে, এইভাবে—কিভাবে বাংলাদেশে আসব এই চিন্তাই করতে পারতাছি না। যা-ই হোক, সবার দোয়ায়, আসছি কোনমতে।
কবির সুমন: আজম ভাই, আপনি প্রথমে বলেছেন আপনি কখনো গান লিখতেন না। পরেও কখনো লিখেন নি?
আজম খান: না।
কবির সুমন: কখনো বসে লিখেন নি?
আজম খান: রাত্রে ঘুমের ঘোরে… হয়তো রাত্রে শুয়া রইছি, দুইটা তিনটার সময় ঘুম ভাঙল, হয়তো একটা কিছু মনে পড়ল, ফট কইরা টুকে রাইখা দিলাম। পরে ওইটা কাজে লাগাইলাম।
কবির সুমন: এরকম কতগুলো গান আপনি তৈরি করেছেন?
আজম খান: আমি গুনি নাই—প্রায়, খুব একটা বেশি না—শ খানেকের কাছাকাছি হবে।
কবির সুমন: এই গান যখন অন্যরা গায়, কেমন লাগে?
আজম খান: অন্যরা—ভালোই লাগে, অনেক বছর হয় তো ফাংশনে ওরাই গাইতেছে।
কবির সুমন: কিন্তু কোনো তফাত দেখতে পাচ্ছেন কী? ধরুন আপনি আপনার সময়ে যেই জায়গা থেকে গান গাইতেন, আর তারপরে ধীরে ধীরে যে গান হলো…
আজম খান: এখন গানের জগতে একটু কমার্শিয়াল। কারণ আগে আমরা যখন গান বাজনা করতাম মার্কেট তো কমার্শিয়াল ছিল না, মার্কেট ছিল না। আমরা শখে গান বাজনা করতাম, দেশের জন্য গাইতাম। মানুষের সুখ দুঃখের জন্য গাইতাম। দেশের আকাশ বাতাস খালবিলের জন্য গাইতাম। মনের আনন্দের জন্য গাইতাম। সবার আনন্দের জন্য গাইতাম। পয়সা টয়সা নাম ধামের চিন্তা করতাম না। এক জায়গায় খুব আনন্দে সৃষ্টি করাটাই ছিল আমাদের কাজ। এইটা আস্তে আস্তে আস্তে, এইটা কমার্শিয়ালি ডেভোলাপ করে। মার্কেট হয়, কোম্পানি হয়, ক্যাসেট কোম্পানি হয়, এই করতে করতে মিডিয়া লাইন বাইড়া যায়। বিভিন্ন রকম যন্ত্রপাতি। আমরা তো ভাঙাচুরা জিনিস দিয়া করতাম। এখন তো যন্ত্রপাতির অভাব নাই, লাইটের অভাব নাই। অনেক কোম্পানি হয়া গেছে, অনেক শিল্পী হয়া গেছে। এখন হইতাছে, সবাই রাতারাতি স্টার হয়া যাইতাছে—এইটাই সমস্যা আর কি। আমরা কিন্তু সিঁড়ি বায়া বায়া ভাঙা সিঁড়ি বায়া উঠছি উপরে, এখন সবাই লিফটে উঠতে চায়।
কবির সুমন: এখন শোনেন? এখন যেসব গান হচ্ছে, শোনেন?
আজম খান: আমি—শোনার সুযোগ হয় না। শুনলেও আমি বুঝতে পারি না, কোনটা কোন শিল্পী, একই ধরণের কথা, একই শিল্পী, একই স্টাইল সুরের। মানে মনে রাখা যায় না।
সাবিনা ইয়াসমিন: আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
কবির সুমন: নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।
সাবিনা ইয়াসমিন: আপনার তো মানে আকাশ পাতাল সব দুনিয়াদারী সব মাতানো যে গান, অনেকেই, তার মধ্যে বাংলাদেশেও তো মানে যত বাঙালি জীবিত আছে সবাই, সেই গান আপনি কখন কীভাবে কী ভেবে তৈরি করলেন, ওরে ছালেকা ওরে মালেকা …
আজম খান: ছালেকা মালেকা গানটা আমি তখন স্বাধীনতার আগের কথা, তখন উঠতি বয়স, আমাদের পাশে একটা হোটেল আছে, টাওয়ার হোটেল আর কি, ওইটা দোতলা হইতাছে। পিলার টিলার লোহা তারপর লোহার গ্রিল বাঁশের খুনতি পানির ট্যাংকি এইগলা সব থাকত, আমরা সব আড্ডা মারতাছি, পাঁচ ছয়জন বন্ধুবান্ধব। তখন এই একটা দেড়টা বাজে আর কি দুপুর, তো ওই নিলুকে বলছিলাম, ও করছে কি ওই পানির ট্যাংকির ঢাকনাটাকে ড্রামসেট বানাইছে, বাঁশের দুইটা খুনতি নিছে, লোহার ইংটি ভিংটি, ড্রামসেট বাজানোর লাইগা, খুব পুংটা টাইপের ছিল এবং খুব মারাত্মক গিটারিস্ট। চিনবেন মনে হয় নিলুকে। ওরা সব ভাইবোন মিলে। তো খুব ড্রাম বাজাইতাছে আর আমরা খুব এনজয় করতাছি। আমার মুখ থাইকা বাইর হয়া গেছে ছালেকা মালেকা ওরে ফুলবানু, পারলি না… এইটা একটানা দেড় দুই ঘণ্টা চলল। যুদ্ধ টুদ্ধ কইরা আসলাম আমরা। পপসঙ্গীত করতে করতে হঠাৎ খেয়াল হইলো, আরে ছালেকা মালেকা গান করছিলাম তো। এইটা যদি কিছু করা যায় তাইলে কাজে লাগবে। এই ছালেকা মালেকা একটা গান বানাইলাম, বুঝছেন।
https://www.youtube.com/watch?v=jpyq49Vs_g4
কবির সুমন: আমি এই গানটা অবশ্য শুনেছি সাবিনার মুখে। আমি মূল রেকর্ডিংটা শুনিনি। আচ্ছা এইটা যখন গানটা তৈরি করছেন, এটা তো একটা পুরোনো গান শুরু করেছেন, এবারে ওটাকে টেনে কিন্তু একটা শরীর দিতে হচ্ছে, সেটা কি ওই মাথা খাটিয়ে খাটিয়ে, নাকি তখন লিখছেন অন্তত?
আজম খান: আমি কোনো কোথাও ডায়েরি টায়েরি কিছুই না তো বললাম তো আগেই, অটোমেটিক আইসা যাইতো। একটার পর একটা সেন্স প্রেজেন্ট মাইন্ডেই কাজ করতেছে এইটার পর এইটা হবে, এইটার পর এইটা হবে। আমি তো বাজাইতে জানি না কিছু। কিন্তু যে বাজাইতেছে তা বইলা দিতো, তুমি এই জিনিসটা হইতাছে না—এই জিনিসটা এইভাবে হবে। এইভাবে বাজাইতে ভালো লাগবে।
কবির সুমন: আপনার কাছে এসে কেউ কখনো বলেছেন যে আজম ভাই আপনার কাছে শিখতে চাই?
আজম খান: হ্যাঁ, এরকম তো অনেক বলছে—আমি তো নিজেই জানি না; আমি তো নিজেই শিখতাছি।
কবির সুমন: কিন্তু কাউকে, মানে লাইন দেখিয়ে দেয়া, যেন হয় না যে এই লাইনে এরকম …
আজম খান: আমি কই, ঠিকাছে তোমার শেখার ইচ্ছা থাকে তুমি বাফায় যাও, বা শিশু একাডেমি বা যেকোনো একটা সেন্টারে ভর্তি হও। তুমি আমার সাথে আইসো আলাপ আলোচনায় আমি তোমাকে যতটুকু সাহায্য করতে পারি। হাতে কলমে আমি পারব না।
কবির সুমন: একটা প্রবণতা দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে, আশ্চর্য, এটা কিন্তু উপমহাদেশের অন্য কোথাও এতটা নেই, যে তেমন কিছু না শিখেই কয়েকটি গিটার, একটি ড্রামসেট নিয়ে নেমে পড়লাম এবং—আমি কিন্তু কাউকে ছোট করে বলছি না; কিন্তু এইটা একটা প্রবণতা। কিন্তু পেছনে কিন্তু কোনো শিক্ষা, সঙ্গীত শিক্ষার কোনো বুনিয়াদ নেই। এই ব্যাপারটা আপনি কিভাবে দেখবেন?
আজম খান: এই ব্যাপারটা হইতাছে, আমি যে গান গাবো, আপনি যে শুনলেন, আপনার ভালো না লাগলে আমি গাইবো কেন? সেই চিন্তাটা আগে থাকতে হবে। কিন্তু এরা সেই জিনিসটা করতাছে না। অনেকটা ফ্যাশান হিসাবে নিতাছে। মানে একটা শিল্পীর, কিছু চুল রাখলো, কিছু বালা টালা পড়লো, কানের দুল পড়লো, রঙচঙ শার্ট পড়লো, এই একটা গিটার নিয়া ঘুরতাছে—শো-শা আর কি। ওই যে আমি বললাম না আমরা সিঁড়ি বায়া বায়া উঠছি, কিন্তু এরা লিফটে উঠতে চায়। রাতারাতি স্টার হইতে চায়। কোথায় কীভাবে টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করবে, কীভাবে ক্যাসেট বাইর করবে, এইসব ধান্দা ফিকির নিয়াই ব্যস্ত। কিন্তু মূল যে মানুষকে কিছু দিতে হবে, ভালো জিনিস উপহার, ওই টেন্ডেন্সিই নাই। ওই মানসিকতা নাই। একটা কিছু সৃষ্টি করতে হবে আমাদের আকাশ বাতাসের কথা বলতে হবে, আমাদের খালবিলের কথা বলতে হবে, আমাদের দেশের সুখ দুঃখের কথা বলতে হবে।
কবির সুমন: ঠিক। কিন্তু বাংলার পল্লীগীতিতে তো এইটাই করে থাকে। তাহলে আধুনিক নাগরিক গান, সেটাও কি এটাই করবে নাকি এটাই তার একমাত্র কাজ হবে?
আজম খান: আপনি যেটাই করেন, পল্লীগীতি করেন, লালনগীতি করেন, না নজরুলগীতি করেন, রবীন্দ্র ঠাকুর সঙ্গীত করেন, বা আধুনিক গান করেন, যেইটাই করবেন, সেইটা তো সুন্দরভাবে যত্ন করে করবেন, যাতে মানুষের ভালো লাগে।
কবির সুমন: সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়েছেন কাদের মধ্যে গানবাজনা করে?
আজম খান: না, সব এঙ্গেলেই। কারণ আমার একটা জীবনে, আমি নিজে শিল্পী হবো, টাকা পয়সা কামাবো, নাম হবে এইগুলি চিন্তা ধারা আমার কোনো দিন ছিল না এখনো নাই। হয়তো আমারে কিছুটা দেখলে বুঝতে পারবেন। আমি, সামনে যারা ছিল, তাদেরকে জাগানোটাই ছিল আমার মেইন উদ্দেশ্য। যেহেতু আমি গণসঙ্গীত শিল্পী। এইখানে কে আছে না আছে তখন আমার খেয়াল নাই। বড়লোক আছে না গরিব আছে ধনী আছে না মিডলক্লাস আছে, কালো ধালো কে আছে, জাগো। তখন আমিই হিরো, মাইকের সামনে। আর যেই মাইক থেইকা সরে গেলাম তখন আমি জিরো।
জাগো, মোট কথা জাগতে হবে। এই জন্য আমার লেভেলটা একটা জিনিস, গর্ব ঠিক না, গর্ব করা বা অহংকার করা একটা পাপ বা আহম্মকের কাজ। কিন্তু এইটা বলব যে আমার, আমি যে শিয়াল-কুত্তার মতো চল্লিশ বছর চিল্লাইলাম, চিল্লাইনোই বলব, গান বলবো না, যেহেতু আমি গানের বেসিক জানি না। এইটা আপনার ধনী গরীব নিম্ন শ্রেণি পর্যন্ত মানে চইলা গেছে। গ্রাম গঞ্জ, মফস্বল সব জায়গায় এই সঙ্গীতটা প্রচার হয়।
প্রথম স্টেইজে আমার, খুব বাঁধা পাইছি আমি। কিছু সো-কল্ড ইন্টেলেকচুয়াল আমাকে বাঁধা দিতো—এইটা আমাদের কালচারকে বিকৃত করতাছে। টেলিভিশন দিয়া…
কবির সুমন: কোথাকার? ঢাকার ইন্টেলেকচুয়ালরা?
আজম খান: আমারে যত বাঁধা দিতাছে আমি তত শার্প হইতাছি।
কবির সুমন: তাদের আপত্তিটা কোথায়?
আজম খান: আপত্তি, জেলাপ টাইপ—একটা পপ গান প্রচার হয়া যাইতাছে আমাদের এই ট্রেডিশন গান বাদ দিয়া। একটা নতুন জিনিস ঢুকায়া দিতাছে, স্বাভাবিক সমালোচনা তো হবেই প্রথম প্রথম। কিন্তু আস্তে আস্তে তাদের ভুলটা ভাঙছে। যে এই টাইপটার ভিতরেও বাস্তবতা আছে। এইটা নিয়া টেলিভিশনে অনেক ফাইট হইছে। খান আতাউর রহমান, আমাদের সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব; ফেরদৌসি রহমান সঙ্গীতের, এরা পরে সাপোর্ট দিছে, না আজম যেইটা করতাছে এইটা ঠিকাছে।
কবির সুমন: আজ যদি আপনাকে আবার, এই অবস্থায়, আবার গান গাইতে হয়, আপনি কীভাবে ভাববেন, মানে এখন কি আবার নতুন গান তৈরি করবেন, নাকি পুরোনো গানগুলোকেই তার মধ্যে নতুন কিছু দিয়ে, আপনার এই বিষয়ে কোনো ভাবনা আছে?
আজম খান: না, এখন যদি আমি যদি আবার ফিটনেস ফিইরা পাই, বা মুখের কিছুটা সমস্যা দূর হয়, আবার যদি গাইতেই হয়, গাওয়ার কোন পরিকল্পনা তো নাই বর্তমানে, তাইলে আমার কিছু পুরান গান তো ইউজ করতে হয় যেইগুলিতে মানুষের ডিমান্ড আছে। তার সাথে নতুন কিছু একটা। আমার সব সময় পুরান গান দিয়া শুরু কইরা নতুন কিছু দিতাম আমি।
কবির সুমন: এই মুহূর্তে, আজম ভাই, আপনি তো কাগজ পড়ছেন, এটা পড়ছেন, সেটা পড়ছেন, দুম করে যদি একটা গান আপনাকে বলা হয় একটা গান চার লাইন হলেও বেঁধে দিন। আপনার গান বাঁধতে হবে না। কোন বিষয়টাকে আপনি বেছে নিবেন।
আজম খান: এখন পৃথিবীতে যেইরকম ধরেন, যুদ্ধ চলতাছে, ভূমিকম্প টূমিকম্প, আমাদের এইখানে একটা আতঙ্ক। ঝড় বাদল বৃষ্টি ভূমিকম্প হইতে পারে। মানুষ এই পরিবেশ প্রাকৃতিক থিকা যাতে বিপদে না পড়ে। সেইজন্য সাবধানতার উপ্রে একটা গান করব। বর্তমান সিকোয়েন্সটা এই দেখি। আমি যে পেপার টেপার পড়লে আরো এমনিই অসুখ মন খারাপ, এইগুলি পইড়া পইড়া মনে, তখন হায়রে আমার থেইকাও খারাপ মানুষ পৃথিবীতে আছে।
কবির সুমন: প্রেমের গানের কী হবে?
আজম খান: প্রেমের গান একটা বললেও চলবে না বললেও চলবে। এইটা থামাইতে পারবে না কেউ। এইটা চিরদিন, যতদিন পৃথিবী আছে ততদিন চলবে। আমি তো বাস্তববাদী গানের ভাষা দিয়া গাই, সবাই তো মনে করে আরে আজম ভাই তো খুব ফকিরা গান গায়, বাস্তবধর্মী গান গায়। তো, আমি কিছু গান প্রেমের গানও করছি। অনেক গানের চেয়েও ভালো। নিজেরটা নিজেই বলি।
কবির সুমন: সেগুলি কি প্রেমে পড়ে তবে করেছেন নাকি …
আজম খান: না না, কল্পনা থেইকা আসছে, বা কিছুটা চোখে কিছু দেখছি—সেইগুলার থেইকা আসছে।
কবির সুমন: পশ্চিমবঙ্গে কোনোদিন আপনি অনুষ্ঠান করেছেন?
আজম খান: না, পশ্চিমবঙ্গে আমি বেড়াইতে গেছি স্বাধীনতার পরে। তারপর গেছিলাম একটা অ্যাডের জন্য গেছিলাম আর কি।
আসাদুজ্জামান নূর: আমি গাড়িতে আসার সময় ভাবছিলাম, আমি যখন ওনার গান প্রথম শুনি, আমার ধারণা হয়েছিল ওনার বাড়ি বোধহয় চানখারপুলে। ওনার একটা গান আছে বিখ্যাত।
আজম খান: আলাল ও দুলাল।
সাবিনা ইয়াসমিন: ছালেকা মালেকা।
আজম খান ও আসাদুজ্জামান নূর: আলাল ও দুলাল।
সাবিনা ইয়াসমিন: ও আলাল দুলাল।
আজম খান: আলাল দুলাল আমার দুই ফ্রেন্ড আছে, শাজাহান আর জাহাঙ্গীর। তো, ওদের, ছেলেটা মারা গেছে—লঞ্চ অ্যাক্সিডেন্টে, আলমগীর নাম, খুব রসিক ছিল। ও ওদের টাইটেল নাম দিছিল আলাল দুলাল। আর ওদের ফাদার ছিল, বুঝছেন, ওই কমলাপুরে, লোহার পুলে, আগে এই ক্লিপ সিস্টেম থাকত না পায়জামায়, ওই প্যাডেল মাইরা এক ইয়েতে চইলা আসত বাড়িতে। তা ওই তখন আমরা চেতাইতাম আর কি। ওর ফাদারের মাথায় টাক টাক ছিল, চুল কম। আলমগীরের ফাদারের নাম, ওই সিনেমা টিনেমা দেখত, ফাইজলামি কইরা দেবানন্দ নাম বলত আর কি। দেবানন্দ নাম সুন্দর হিরোর তো। পরবর্তীতে খেয়াল হইলো, আরে এইটা দিয়া তো গান বানান যায়। পরে দেবানন্দ তো দেয়া যায় না—আলাল দুলাল, হাজীর ছেলে পাজী। হাজীচান্দ দিয়া দিলাম। দেবানন্দের ছন্দটা ঠিক রাইখা, দেবানন্দের জায়গায় হাজীচান্দ কইরা দিলাম। মেজো ভাইকে জিগ্যেস করলাম, আলম খানকে জিগ্যেস করলাম যে মেজো ভাই দেখেন তো এই চানখারপুর, হাতিরপুল, লোহারপুল কতগুলি পুল আছে, ওই পুল দিলে তো আর মানুষ বুঝবো না। আমরা তো ওই পুল দেখায়া দেখায়া চেতাই। কবি জসিমুদ্দীনের বাড়ির পাশে বইসা আড্ডা মারি, আর আমরা মজা করি আর চেতাই; চেতাই—ওর বাপ আসতাছে; ওর বাপ আসতে দেখলেই গানটা শুরু করি। অফিস থাইকা আসত সাইকেল চালায়া। তারপরে, মেজো ভাই কইলো, চানখারপুল নামটা দে ভালো লাগলো। আলম খান কইলো চানখারপুলটা দে, তো চানখারপুলই দিলাম।
তারপরে বিশ্বাস করবেন না এই জায়গায় আবার আরেক নূর ভাই, গানটা যখন হিট করলো, টেলিভিশনতে, বিটিভিতে বেশি যাইতো গানটা, ঠিকি চানখারপুলে হাজীচান্দ আছে একজন।
আসাদুজ্জামান নূর: হুম আছে।
আজম খান: সে দাওয়াত দিয়া বইছে যে …
আসাদুজ্জামান নূর: হুম হুম ডেকোরেটরের…
আজম খান: হ্যাঁ, এখন সে দাওয়াত দিয়া বসছে, আমার সাথে, যেইদিন ওরা মনে করছে আলাল দুলাল তোমগো লয়া গান বানাইছে, আমাদের লয়া গান বানাইছে আজম খান, লয়া আও, আমরা দাওয়াত দেই। পুরা গ্রুপ আমরা গেছি আমরা, বুঝছেন, যন্ত্রপাতি নিয়া অনুষ্ঠান। হে কয়, আপনি যে আমাদের লয়া গান বানাইছেন, মাগার ম্যাজিকটা যে দিছেন না, ঢাকাইয়া মানুষ তো, কয় মাগার ম্যাজিকটা যে দিছেন না, গান গাইতেছি, দেখি মসজিদের মানুষ পর্যন্ত দাঁড়ায়া গেছে—আলাল দুলাল গান শুনতাছে।
সাবিনা ইয়াসমিন: অসুস্থতার পরে গান গেয়েছেন, না?
আজম খান: অসুস্থতার জন্য রেকর্ডিং আর করতে পারি নাই। বিটিভিতে একটা, একুশে ফেব্রুয়ারির উপ্রে একটা গান করছিলাম। ওইটা আগের রেকর্ডিং ছিল। লিপ করছি।
সাবিনা ইয়াসমিন: ইয়ে করেছেন, মানে গান গাওয়া হয় নি আর।
আজম খান: গান গাওয়া হয় নি।
সাবিনা ইয়াসমিন: মানে এখন যদি আপনাকে বলি এক লাইন গাইতে অসুবিধা হবে না…
আজম খান: এক লাইন এখন গাওয়া আর না গাওয়া একি কথা।
সাবিনা ইয়াসমিন: না, মানে আমাদের স্মৃতিতে একটু থাকল, আমরা আলাল দুলাল একটু যদি গাই।
আজম খান: হবে না। এই গান…
সাবিনা ইয়াসমিন: আচ্ছা, আমি একটু গাইছি আপনার সাথে চলেন।
আজম খান: ভেঙানো হবে…
সাবিনা ইয়াসমিন: না না ছিহ, আপনার এত সুন্দর গান কখনো ভেঙানো হয়? আলাল ও দুলালটা একটু চলেন।
আজম খান:
আলাল ও দুলাল
আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখা পুলে প্যাডেল মেরে পৌছে বাড়ী
আলাল ও দুলাল
আলাল যদি ডাইনে যায়
দুলাল যায় বায়ে
তাদের বাবা সারাদিন খুঁজে খুঁজে মরে
আলাল কই রে
দুলাল কই রে
নাইরে নাইরে নাইরে নাই
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল
আলাল যদি ডালে থাকে
দুলাল থাকে চালে
পাড়াটারে জ্বালায় তারা সারা দিন ধরে
আলাল কই রে
দুলাল কই রে
নাইরে নাইরে নাইরে নাই
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল
তাদের বাবা হাজি চান
চানখার পুলে প্যাডেল মেরে পৌছে বাড়ী
আলাল ও দুলাল, আলাল ও দুলাল; আলাল ও দুলাল
কবির সুমন: চমৎকার, চমৎকার। কত কষ্ট করে করলেন।
আজম খান: বয়স ছিল অল্প, বিশ বাইশ, পঁচিশ, আটাইশ, ত্রিশ, বত্রিশ—আর এখন বাষট্টি।
কবির সুমন: হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকাছে। তাতেই বা কম কী।
আজম খান: বয়স ফ্যাক্টটা ছিল না, আমার মুখটা না হইলে, অসুখের আগেও ভালো পারফরম্যান্স করছি।
কবির সুমন ও সাবিন ইয়াসমিন: ঠিক হয়ে যাবে ঠিক হয়ে যাবে।
কবির সুমন: ওটা কিছু না। একটু সময় দরকার।
সাবিনা ইয়াসমিন: আপনি আর আমি তো একই পথের পথিক।
আজম খান: আমার সেলাইটা না পড়লে তো অসুবিধা ছিল না। এইখানকার মাংস নিয়া ওইখানে ইয়া কইরা দিছে।
কিশোর কুমার, লতা মুঙ্গেশকর, মোহম্মদ রফি, শ্যামল মিত্র—এদের গানগুলি শুইনা শুইনাই তো আমরা এতদূর। আমাদের দেশী গানের পাশাপাশি এইগুলাই শুনতাম আমরা।
কবির সুমন: এই যে এইটা করা থাকল আজম ভাই, এইটার খুব দরকার ছিল, জানেন এটা খুব দরকার ছিল। আপনার যে কত ভক্ত আছে, ল্যাপল্যান্ডেও ভক্ত আছে আপনার, আইসল্যান্ডেও ভক্ত আছে। মানে, বাঙালি তো ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, এবং যে যেইখানে ছড়িয়ে পড়েছে, আজম খান সঙ্গেই গেছেন। কাজেই এইটা হলো আমাদের আনন্দ। অনেক দিন পর এইটাই আনন্দ। আমরা শেয়ার করব।
আজম খান: আমার তো খুব ভালো লাগলো। অসুস্থ হবার পর যে বাঙালিরা আমার জন্য এতভাবে চেষ্টা করছে যে বাঁইচা থাকুক। যেইখানে আমি পালায়া গেলাম, যে না আমার অসুস্থতাটা কাউকে জানতে দিমু না। এইটা খুব ভালো লাগছে। তবে আপনার কী বলব মানে খালি টাকা পয়সা দিয়া যে সহযোগিতা তা না, দোয়া করছে, যারা পিছনে গরিব সে দোয়া করতাছে, মসজিদে দোয়া করাইতাছে—মানে কী অবস্থা, হিন্দুরা দোয়া করতাছে, খ্রিস্টানরা দোয়া করতাছে, বৌদ্ধরা দোয়া করতাছে—সব ধর্মই আমার জন্য দোয়া করছে। এই জিনিসটা আমার খুব ভালো লাগছে।
কবির সুমন: আপনি তো ফুটবল খেলতেন।
আজম খান: ফুটবলটাও খুব ভালো খেলতাম। আমি ব্রাদার্সে খেলতে চাইছিলাম। কিন্তু পরে গান নিয়া থাকলাম আর খেলাধুলা হয় নাই। ওরা অনেক হোন্ডা টোন্ডা পাঠায়া দিত, যা আজমরে নিয়া আই।
আসাদুজ্জামান নূর: মাঠে বাচ্চাদের সাথে যাইতেন ….
সাবিনা ইয়াসমিন: হ্যাঁ এখন মাঠে …
আজম খান: আমি টেপ টেনিস খেলতাম কিছুদিন, অসুস্থ ছিলাম, টেপ টেনিস খেলতে খেলতে ঢাকাতে অনেক বড় বড় কাপ নিছি। এখন আমাদের দেশের যে প্লেয়াররা আছে, ক্রিকেট প্লেয়াররা, ফুটবল প্লেয়াররা, বিশেষ কইরা ক্রিকেট প্লেয়াররা খুবি ই করে। আমার বাসায় আসে, দেখা কইরা যায়। আমি ওদের বলি কীভাবে খেলবা না খেলবা।
সাবিনা ইয়াসমিন: মাঝেমাঝে বাইরে যান, টুকটাক বাজার টাজারে একটু যান?
আজম খান: আমি বাজারে এখনো যাই। সবাই কয়, তুমি বাজারে যাও কেন! আমি কই এইটা আমার নেশা। ঈদের দিনেও আমি বাজার থেইকা এক চক্কর মাইরা আইসা তারপর নাস্তা খাই।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024