শাহলাল ফকির – জসীম উদ্দীন [১৯৭৭]
[১৯৭৭ সালে বাংলা একাডেমি থিকা ছাপানো কবি জসীম উদ্দীনের “মুর্শিদা গান” বই থিকা নেয়া হইছে, এই লেখাটা।]
…
শাহলালের বাড়ির ধারের এক হিন্দু ভদ্রলোক শাহলাল চরিত নামে একখানা পুস্তক প্রকাশ করেন। সেই পুস্তকের সামনের পাতাগুলি নাই। সুতরাং লেখকের নাম প্রকাশ করিতে পরিলাম না। খুব সম্ভব ১৯২৩ সালে কিংবা ১৯২৪ সালে এই পুস্তক ছাপা হইয়াছিল।
এই পুস্তকের সবগুলি বিবরণ বিশ্বাস করা যায় না। সাধারণ হিন্দু-ভক্তের দৃষ্টি দিয়া তিনি যাহার নিকট যাহা শুনিয়াছেন হয়তো তাহার উপর কিছু রং চড়াইয়া এই পুস্তকের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। সব ঘটনাকে সত্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া লন নাই।
এই পুস্তক অনুসারে শাহলালের পিতার নাম সেখ সিরাজউদ্দিন। পুত্র বড় হইলে তাহার পিতা শাহলালকে একদিন ভূঁইক্ষেতের তদারক করিতে বলিয়া অন্যত্র চলিয়া গেলেন। ইতিমধ্যে অপরের গরু আসিয়া ক্ষেতের সমস্ত ফসল খাইতে লাগিল। শাহলাল ভাবিলেন এই নিরীহ গো-জাতির মুখের গ্রাস যদি কাড়িয়া লই, তবে তাহাদের নিকট চিরঅপরাধী হইব। এই ভাবিয়া তিনি গরুগুলিকে কিছুই বলিলেন না। মুহূর্তমধ্যে সমস্ত ফসল গাভীগুলির পেটে চলিয়া গেল।
ইতিমধ্যে শাহলালের পিতা সিরাজউদ্দিন সাহেব নিজের ক্ষেতের ফসলের অবস্থা দেখিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিলেন। তিনি শাহলালকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, “হতভাগা, এখনি আমার গৃহ হইতে বাহির হইয়া যা।” অভিমানী পুত্র তখনই গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ঘুরিতে ঘুরিতে শাহলাল অপর একটি গ্রামে আসিয়া পৌছিলেন। একটি বৃক্ষতলে দাঁড়াইলেন। এমন সময় একটি গাভী আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল। গাভীর মালিক গাভীটিকে নিজের গৃহে লইয়া যাইতে চাহেন, কিন্তু গাভী একপদও অগ্রসর হয় না। নিরুপায় হইয়া গৃহস্থ শাহলালের সাহায্য চাহিলেন। শাহলাল গাভীর রজ্জু ধরিয়া টানিবামাত্র গাভী চলিতে লাগিল। গৃহস্থ গাভী ও শাহলালকে সঙ্গে লইয়া গৃহে আসিলেন। এই গৃহস্থের নাম দাও সিদ্ধাই। শাহলাল চরিত্রের লেখক তাঁহাকে দাগুরাম সিদ্ধাই নাম দিয়া হিন্দু বলিয়া পরিচয় করাইয়াছেন। কিন্তু আমরা অন্যত্র শুনিয়াছি দাগু সিদ্ধাই জাতিতে মুসলমান ছিলেন। তাঁহার বংশধরেরা এখনও জীবিত আছেন। তাঁহারাও মুসলমান। পূর্বকালে বহু মুসলমানের বাংলা নাম প্রচলিত ছিল।
এইখানে থাকিয়া শাহলালের ধর্মজীবন আরম্ভ হইল। দাগু সিদ্ধাই একজন ভাবুক লোক ছিলেন। সারিন্দা বাজাইয়া ভাবগান করিতেন। সম্ভবত তাঁহার নিকট হইতে শাহলাল গুরুপরম্পরায় প্রাপ্ত এদেশের শাশ্বতকালের ভাববস্তুর উত্তরাধিকারী হন। শাহলাল চরিত লেখকের বর্ণনা অনুসারে দাগু সিদ্ধাইর নিকট হইতে শাহলাল মাসিক যাহা বেতন পাইতেন তাহা দরিদ্র পিতাকে পাঠাইয়া দিতেন। কিছুদিন পরে পিতা শাহলালের বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। খোদার উপাসনায় জীবন কাটাইবেন, এই আদর্শ অন্তরে পোষণ করিয়া শাহলাল বিবাহে অমত প্রকাশ করেন। কিন্তু পিতা-মাতার নানা অনুরোধ-উপরোধে শাহলাল বিবাহে রাজি হইলেন। কাজীকান্দা নিবাসী সেখ রহিমউদ্দিন কাজীর কন্যা মেহেরউন্নিসা বিবির সঙ্গে তাঁহার শুভ বিবাহকার্য সম্পন্ন হইল।
শাহলাল চরিতের লেখকের মতে মেহেরউন্নিসা বিবি শাহলালের ধর্মকার্যে সঙ্গিনী ছিলেন । সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো তিনি অত্যন্ত পতিপরায়ণা ছিলেন। তবু শাহলাল এই মায়াপাশ ছিন্ন করিয়া ধর্মগুরু দাগু সিদ্ধাইয়ের গৃহে যাইয়া বাস করিতে লাগিলেন। তখনকার দিনে দাগু সিদ্ধাইয়ের ধর্মজীবনের খ্যাতি দূর-দূরান্তরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। প্রতিদিন বহুলোক আসিয়া তাঁহার নিকট ধর্মকথা শ্রবণ করিতেন। দাগু সিদ্ধাইয়ের বাড়িতে বছরে বছরে মাঘী পূর্ণিমার দিনে এক বিরাট মেলা বসিত। এই সময় তিনি ধামাইল উৎসব পালন করিতেন। এই ধামাইলের বিষয়ে আমরা পরে বিস্তৃত আলোচনা করিব।
বহুকাল গুরুগৃহে থাকিয়া শাহলাল গুরুর নিকট দীক্ষামন্ত্র চহিলেন। গুরু তাহা কিছুতেই দিতে চাহিলেন না। তখন শাহলাল গুরুপত্নীর শরণাপন্ন হইলেন। গুরুপত্নীর অনুরোধেও দাগু সিদ্ধাইয়ের মন টলিল না। তখন শাহলাল ভাবিলেন যদি জীবনে সত্যের সন্ধান না পাইলাম তবে বাঁচিয়া থাকিয়া কি লাভ হইবে? ইহা ভাবিয়া শাহলাল গলায় দড়ি বাঁধিয়া আত্মহত্যা করিতে গেলেন। দাগু সিদ্ধাইয়ের স্ত্রী ইহা দেখিতে পাইয়া : শাহলালকে এই কার্য হইতে নিরস্ত করেন। তিনি শাহলালকে পরামর্শ দেন : “ওই যে গাছের উপরে একটি লাউলতায় লাউ ধরিয়াছে তুমি ওই লাউটি পাড়িতে যাইয়া ভূমিতে পড়িয়া মড়ার মতো শুইয়া থাক।”
শাহলাল তাহাই করিলেন। গুরুপত্নী তখন দাগু সিদ্ধাইকে যাইয়া বলিলেন, “দেখ, আমি শাহলালকে উচ্চ ডাল হইতে লাউ পাড়িতে বলিয়াছিলাম। সে সেখান হইতে পড়িয়া গিয়া মরণের অপেক্ষা করিতেছে। তাহার এই শেষ মুহূর্তে তাহার কর্ণে সত্য মন্ত্র দিয়া তাহার মুক্তির ব্যবস্থা কর।” গুরু তাঁহাকে ইষ্টমন্ত্র দান করিলেন।
ইহার কিছুদিন পরে মাত্র ৫৬ বৎসর বয়সে দাগু সিদ্ধাই ইহধাম পরিত্যাগ করেন। গুরুগৃহ হইতে শাহলাল নিজ আবাস নুরুল্লাপুরে ফিরিয়া আসিয়া গোপনে ধর্মসাধনা করিতে আরম্ভ করেন।
১৯২৩ সালে আমি একবার শাহলালের জীবনের বিষয়ে নানা ঘটনা সংগ্রহ করি। ১৩৩৩ সালে ‘ভারতী’ প্রত্রিকায় প্রকাশিত মুর্শীদা গান প্রবন্ধে তাহা সন্নিবদ্ধ করি। সেই প্রবন্ধে শাহলালের বিষয়ে যাহা যাহা লিখিয়াছিলাম তাহা নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :
ফরিদপুর জেলায় গোলডাঙ্গী গ্রামের এক বৃদ্ধের মুখে প্রথমে এই কাহিনীগুলি শুনি। শাহলালের অন্যান্য ভক্তের মুখেও এইগুলি শুনিয়াছি। পরে শাহলালের দৌহিত্র সাইজদ্দী ফকিরের সঙ্গেও আলাপ করিয়া প্রবন্ধে লিখিত বিবরণগুলি যাচাই করিয়া লই।
প্রায় তিনশত বংসর পূর্বে খুব সম্ভব ১৭০০ সনের প্রথম অর্ধে শাহলালের জন্ম হয়। তখনও এদেশে ইংরাজের রাজত্ব কায়েম হয় নাই। পঞ্চদশ শতাব্দীতে গৌরাঙ্গ যুগে বাংলার অন্দরে কন্দরে যে ভাববন্যা প্রবাহিত হইয়াছিল তাহার রেশ তখনও থামিয়া যায়। নাই। শাহলাল এই ভাববন্যার গ্রামীয় প্রতিমূর্তি, অথবা বাঙালির অন্তরে শাশ্বত যে ভাববস্তুতে প্লাবন আনিয়া গৌরাঙ্গদেব জগৎ মাতাইয়াছিলেন, শাহলালের ভাবপ্রবাহ সেই শাশ্বতকালের বাঙালির ভাব-জীবনের আর একটি ধারা।
সেই সময়ে শাহলালের বাড়ি হইতে কিছুদূরে পদ্মানদীর ওপারে ঝাউমাহাটি গ্রামে প্রসিদ্ধ ফকির দাও সিদ্ধাইয়ের আবির্ভাব হয়। বাল্যকালে ইঁহার নিকট হইতে শাহলালের ধর্মজীবন আরম্ভ হয়। ছোট ডিঙ্গি নৌকা বাহিয়া প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি নদীর ওপারে ঝাউমাহাটি গুরুর বাড়ি যাইতেন। সারারাত্রি গুরুর কাছে ঈশ্বর আরাধনা করিয়া সকালবেলা গৃহে ফিরিয়া আসিতেন। যেদিন যাইতে পারিতেন না সেদিন পদ্মার তীরে বসিয়া সারিন্দা বাজাইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিতেন :
“ওপার আমার মুর্শিদের বাড়ি,
এপার বইস্যা কাঁন্দি আমি রে।
বিধি যদি দিত রে পাখা,
উইড়া যায়া দিতাম দেখা;
উইড়্যা পড়তাম দাগুশার পায়ে রে।”
এইরূপে বহু বৎসর কাটিয়া গেল ওপারে গুরুর কাছে কি কি শিখিয়াছিলেন তাহা জানিবার উপায় নাই। শাহলাল প্রথম জীবনে সারিন্দা বাজাইয়া কান্নার যে সাধনা করিয়াছিলেন সেই সাধনাই তাঁকে বাংলার নিভৃত পল্লীক্রোড়ে আজও অমর করিয়া রাখিয়াছে।
ইতিমধ্যে একটি ঘটনা তাঁহাকে লোকসমাজে প্রচার করিয়া দিল। পূর্বে চৈত্র মাসে বৃষ্টি না হইলে কৃষকেরা নানারূপ অনুষ্ঠান করিত। কেহ সিন্নি করিত, কেহ নৈলা গান করিত, আবার কেহ কেহ খোদার নামে নামাজ পড়িত। পূর্ববঙ্গের অনেক স্থানে এখনও বৃষ্টি না নামিলে এইসব অনুষ্ঠান হয়। বলা বাহুল্য যে, এই সময় কৃষকের মেয়েরাও নানারূপ অনুষ্ঠান করিতে কুণ্ঠিত হয় না। কুমারী মেয়েরাও বদনা বিয়ের গান গাহিয়া আড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘাকে ডাকিয়া সারা গ্রাম মুখরিত করিয়া তুলে। সেবার যখন কিছুতেই বৃষ্টি হইল না তখন নুরুল্লাপুর হইতে ১২ মাইল দূরবর্তী গ্রামের কৃষকেরা শাহলালের গুরু দাগু সিদ্ধাইকে আহ্বান করিল। সারাদিন মন্ত্রতন্ত্র পড়িয়াও গুরু যখন বৃষ্টি নামাইতে পারিলেন না তখন অনেকে ফকিরকে নানারূপ ঠাট্টাবিদ্রূপ করিতে লাগিল। কথিত আছে, ধ্যানবলে শাহলাল তাহা জানিতে পারিয়া ১২ ক্রোশ পথ অতি অল্প সময়ের মধ্যে অতিক্রম করিয়া সেখানে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। তারপর সিজদায় বসিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া বুক ভাসাইতে লাগিলেন। তাঁর কান্নার সঙ্গে সঙ্গে মেঘশূন্য আকাশ হইতে অবিরল ধারায় বৃষ্টি পড়িয়া মাঠঘাট ভাসাইয়া লইয়া যাইতে লাগিল। তখন গুরুকে কাঁধে লইয়া শাহলাল বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। এই ঘটনার পর হইতে। তাহার নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল।
আর একবার রাজনগরের জমিদারের একটি ঘোড়া মরিয়া যায়। শোনা যায়, শাহলাল সেই মরা ঘোড়া বাঁচাইয়া দেন। ইহাতে উক্ত জমিদার শাহলালের বাড়ি পাকা। করিয়া দিতে চাহিলে শাহলাল বলিয়াছিলেন, “আমার বাড়ি পাকা করিয়া দিলে কি হইবে, উহা পদ্মায় পাঁচবার ভাঙিবে।” শাহলালের মৃত্যুর পর এ পর্যন্ত তাঁহার বাড়ি পদ্মায় তিনবার ভাঙিয়াছে । শিষ্যদের বিশ্বাস আরও দুইবার ভাঙিবে।
বুদ্ধিমন্ত ঠাকুর নামে একজন ব্রাহ্মণ শাহলালের শিষ্য হইয়া পড়েন। তাঁহার শিষ্য হইবার কাহিনী এইরূপ :
একদিন নদীতে আহ্নিক করিয়া বুদ্ধিমন্ত ঠাকুর কোনো বটগাছের তলায় বসিয়া জলযোগ করিবেন এমন সময় এক মুসলমান ফকির আসিয়া সেইখানে উপস্থিত হইল। তাঁহাকে দেখিয়া ঠাকুর অবজ্ঞাভরে কহিলেন, “তফাত থাক, ছুসনে।” ইহাতে ফকির মৃদুভাবে কহিলেন, “বাবা কে মুসলমান, কে হিন্দু—সবাই তো সেই একজনেরই সৃষ্টি। তুমি যে নদীতে ফুল ভাসাইয়া দিলে, ফুল তো উজান বহিয়া গেল না। দেখ, আমি পূজা করি, ফুল কোনদিকে যায়।” এই বলিয়া ফকির নদীর ধারে আসিয়া খোদার নাম করিয়া একটি ফুল জলে ভাসাইয়া দিলেন। ছোট ফুলটি উজান বহিয়া চলিতে লাগিল। ফকিরের অসীম শক্তি দেখিয়া ঠাকুর তাঁহার পায়ে পড়িয়া গেলেন।
বলা বাহুল্য এই ফকির শাহলাল ব্যতীত আর কেহ নহেন। তিনি বুদ্ধিমত্তকে নানারূপ উপদেশ দিতে লাগিলেন। পরিশেষে এই বুদ্ধিমন্ত শাহলালের একজন প্রধান
শিষ্য হইয়া পড়েন। ইনি দুইশত বৎসর জীবিত ছিলেন। এইরূপে শাহলালের নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। বহু হিন্দু-মুসলমান তাঁহার শিষ্য হইল। আমরা শাহলালের কোনো বংশধরের নিকট শুনিয়াছি তাহাদের প্রায় একলক্ষেরও উপর হিন্দুশিষ্য আছে। ইহাদের মধ্যে প্রায়ই নমঃশূদ্র। কিছু কিছু অন্য লোকও আছে। তাহারা শাহলালের বংশধরদের পায়ের ধুলা মাথায় লয়। দরগার “সিন্নি’ খায়, তাহাদের মন্ত্রপড়া জল পান করে, কিন্তু তাহাতে ইহাদের জাত যায় না।
শাহলালের ধর্ম জানিতে হইলে তাঁর শিষ্যদের ধর্মমত জানিবার প্রয়োজন। ধর্ম সম্বন্ধে কোনো বিশেষ মত ইহাদের নাই। আল্লা, বরকত, ফাতেমা, শ্মশানকালী ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় হিন্দু-মুসলমান দেবতারই ইহারা ভজনা করিয়া থাকে। হিন্দুকেও আমরা মন্দার, ফাতেমা, ও আল্লাজির চরণ বন্দনা করিতে দেখিয়াছি। মূল কথা, যে গানে ভাব আসে সে গানই তারা গায়। তা সে গান কৃষ্ণেরই হউক আর আল্লাজিরই হউক।
এক কথায় বলিতে গেলে ইহারা ভাবের উপাসক। আর এই ভাবের উপাসকই ছিলেন শাহলাল। লোকসভ্যতার অন্তরালে কাঁদিয়া কাঁদিয়া সারিন্দা বাজাইয়া শাহলাল। আপন মনে মুর্শীদা গান গাহিতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই কান্নার গান তাঁর শিষ্যেরা গাহিয়া থাকেন। এবং আজকালকার মুর্শীদা গায়কেরা অধিকাংশই শাহলালের ভক্ত। তবে গনি ফকির, কুসুমদিয়ার ফকির ও নইমুদ্দি ফকিরের শিষ্যেরাও অনেকে এই গান গাহিয়া থাকেন। ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দির হরিঠাকুরের মেলায় ও পাবনা জেলার চিতৈলার শম্ভুচান ঠাকুরের মেলায়ও মুর্শীদা গান হইয়া থাকে। ঢাকা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলার কৃষকদের মধ্যেই এই গান আজ বিশেষভাবে প্রচলিত। এই গান গাওয়ার প্রধান যন্ত্র সারিন্দা। লম্বা চুলওয়ালা ফকিরেরা সারিন্দা বাজাইয়া এই গান গাহিয়া থাকে।
শাহলাল পীরের বংশধরেরা এইভাবে শিষ্যদিগকে মুরিদ করিয়া থাকেন। শিষ্য অজু করিয়া সাফসাফাইমতো পীর সাহেবের সামনে আসিয়া বসে। পাশে এক গ্লাস পানি। ও কিছু চাউল রাখা হয়। পীর সাহেব কিছু চাউল লইয়া মুখে দেন এবং গ্লাস হইতে পানি পান করেন। তারপর কিছু চাউল শিষ্যের হাতে দিয়া তাঁহাকে গ্লাসের সেই অবশিষ্ট পানি চাউলসহ পান করিতে আদেশ করেন। শিষ্য তাহা করিলে গুরু বলেন, আমি যাহা বলি সেরূপ বল :
আল্লাহ মওলা সালেক নিরাঞ্জন,
দয়া কর মুর্শীদধন।
শিষ্য তাহাই বলে।
অসুখ-বিসুখ হইলে গুরু রোগীদিগকে আদা, নুন, ও যোয়ান মন্ত্রপূত করিয়া খাইতে দেন। ইহাতে অধিকাংশ রোগী আরোগ্য লাভ করে। শাহলালের আবির্ভাবকালে গ্রামদেশে ডাক্তার বৈদ্যের তেমন অস্তিত্ব ছিল না। আদা, নুন ও যোয়ানবাটা খাইয়া বহু রোগ প্রশমিত হইত, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই; আর বহু রোগ বিশ্বাসের জন্যই নিরাময় হইত। বাঙালি সহজে ভাবপ্রবণ। ভাববিহ্বল শাহলালের খোদাগত মূর্তি ও রোগ সারাইবার উপরোক্ত ঔষধই হয়তো শাহলালকে লোকসমাজে এত জনপ্রিয় করিয়া তুলিয়াছিল।
প্রায় ১০৫ বৎসর জীবিত থাকিয়া শাহলাল দেহত্যাগ করেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার তিন পুত্র বেচুসা, খোদাজান ও আছিমসা ফকির হন। ইঁহাদের মধ্যে বেচুসা ৮৫ বৎসর, খোদাজান ৯৫ বৎসর ও আছিমসা ৭৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। বেচুসার পুত্রদের মধ্যে বর্তমানে গইজদ্দী সাই জীবিত আছেন। এবং শাহলালের সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছি তাহার অনেক কথাই তাঁহার নিকট শুনিয়াছি। ফেলুসা, আইজদ্দিসা ও আলতাফসা খোদাজানের বংশধর। প্রায় কুড়ি বৎসর ফেলুসা মরিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সম্বন্ধে অনেক অসম্ভব কাহিনী শোনা যায়। আছিমসার কোনো পুত্র ছিল না। তাঁহার চারিটি কন্যা ফকিরি পাইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে, শাহলালের মৃত্যুর পর তাঁর বংশধরেরা তাঁর শিষ্যমণ্ডলীকে ভাগ করিয়া লইয়াছেন। এমনকি কবর হইতে তাঁহার অস্থি উঠাইয়া আনিয়া সিন্দুকে ভরিয়া পৃথক পৃথক স্থানে পুঁতিয়া দরগা করিয়াছেন। নদীতে বাড়ি ভাঙিলে উক্ত সিন্দুক উঠাইয়া লইয়া অন্যত্র পুঁতিয়া রাখা হয়।
গইজদ্দী শাহ গত ১৯৩০ সনে জান্নাতবাসী হন। এই ঘটনা আমি গইজদ্দী ফকিরের নিকট শুনিয়াছিলাম। প্রতি বৎসর মাঘী পূর্ণিমায় প্রত্যেক দরগায় উৎসব হয়।
সেই উৎসবে লক্ষ লক্ষ শিষ্য নানারূপ উপহারসামগ্রী লইয়া দরগায় হাজত দেয় ও সারারাত্রি জাগিয়া মুর্শীদা গান করে। এই সময় প্রত্যেক শিষ্য আপন আপন গুরুদের মাথায় তেল দেয় ও প্রণাম করে। মাঘী পূর্ণিমার দিন শেষরাত্রে ধামাইল হয়। ধামাইল হিন্দুদের যজ্ঞের অনুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রথমে একটি চৌকোনা স্থানকে ভালো করিয়া লেপিয়া রাখা হয়। ধামাইলের পূর্ব পর্যন্ত শিষ্যেরা তাহার চারিদিকে বহু মোমবাতির আলো জ্বালাইয়া রাখে। ধামাইলের সময় প্রধান ফকিরেরা গলায় ফুলের মালা ও মাথায় গাঁদা ফুলের গুচ্ছ জড়াইয়া খাস দরগা হইতে সেই চৌকোনা স্থানের দিকে অগ্রসর হয়। সম্মুখে ধামাইলের বাঁশ লইয়া শিষ্যেরা অসুরের মতো পা ফেলিয়া চলিতে থাকে। সানাইয়ের সুরে সে সময় এক গুরুগম্ভীর আওয়াজ বাজিয়া ওঠে। ঢাকিদের বাদ্য সেই গাম্ভীর্যকে আরও জমাট করিয়া তোলে। বলা বাহুল্য যে, ফকিরেরা প্রত্যেকে দরগা হইতে সামান্য কিছু কাঠ মাথায় করিয়া লইয়া যায়। পরে সেই ধামাইলের স্থানে আনিয়া আগুন জ্বালাইয়া দেয়। ধামইলের বাঁশ লইয়া শিষ্যেরা চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জনতাকে দূরে রাখে। আতপ চাউলের আটার সহিত মাংস মিশাইয়া অনেকগুলি ছোট ছোট পোটলা কলার পাতায় বাঁধিয়া পূর্বেই পোড়ানো হয়। তারপর অনেক প্রকার মন্ত্র পড়ার পর প্রধান ফকির সেই আগুনে পা দিয়া একটু নাড়া দিয়া দিলে শিষ্যেরা ধামাইলের বাঁশ লইয়া তাহার উপর নাচিতে থাকে। এই সময়ে সেই কলার পাতায় বাঁধা সিন্নির জন্য চারিদিক হইতে ভীষণ কাড়াকাড়ি পড়িয়া যায়। ইহাকে সকলেই লুটের সিন্নি বলে। ফকিরেরা পূর্বেই ইহার কিছু সংগ্রহ করিয়া রাখে। শিষ্যেরা চাহিয়া লয় ।
তাহাদের বিশ্বাস, ইহা খাইলে রোগ ভোগ কিছুই থাকে না। এখানে সেই ধামাইলের সাথে হিন্দুদের চৈত্রপূজার বিশেষ সাদৃশ্য দেখা যায়। চৈত্রপূজায় যেমন বেত হাতে সন্ন্যাসীরা নাচিয়া নাচিয়া সমস্ত মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করিয়া তোলে, ধামাইলের মধ্যেও বাঁশ লইয়া শিষ্যেরা সেইরূপ নাচিয়া থাকে।
এইস্থানে ধামাইলের বাঁশ সম্বন্ধে দু’টি কথা বলিতে চাই। জোড়া বাঁশ না হইলে ধামাইলের বাঁশ হইবার জো নাই। সেইজন্য ছোট থাকিতেই দুইটি বাঁশকে একত্র বাঁধিয়া রাখা হয়। তারপর বড় হইলে কাটিয়া ধামাইলের বাঁশ তৈয়ার করা হয়। প্রত্যেক ফকিরেরই ৮/১০টা বাঁশ থাকে, এবং এক একটির নাম মান্দারের বাঁশ, আলির বাঁশ, গাজীর বাঁশ, আল্লার বাঁশ, ইহার মধ্যে মান্দারের বাঁশ সবার চেয়ে বড়। আল্লার বাঁশ সবার চেয়ে ছোট। উৎসবের ১৫/১৬ দিন পূর্ব হইতেই শিষ্যেরা এই বাঁশ লইয়া। নাচিয়া বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া চাউল, তরকারি, পয়সাকড়ি ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া আনে। এই সময় তাহারা বাঁশগুলিকে কখনও মাটিতে ছোঁয়ায় না। যদি রাখিতে হয় তবে। চাউলের ধামার উপর রাখিয়া কোনোকিছুর হেলান দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখে। ধামাইল সারা হইলে শিষ্যেরা আর দুইএকদিন থাকিয়া যে যার বাড়ি চলিয়া যায়। শাহলালের বাড়ি যে ধামাইল হয় তাহাতে সোয়া সের তেঁতুলের চলার বেশি পোড়ানো হয় না। কিন্তু আমরা কোনো কোনো স্থানে দেখিয়াছি বুকসমান আগুনের উপর ফকিরেরা বাঁশ লইয়া নাচে। দুইএকখানা আগুন আমরা হাতে করিয়াও দেখিয়াছি তাহাতে হাত পুড়ে নাই।
শাহলাল বহুদিন হয় মরিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার ভক্তেরা এখনও তাঁহাকে ভুলিতে পারে নাই। শাহলালের শিষ্য হইয়া তাহাদের লাঞ্ছনার সীমা নাই। মুসলমান মৌলবিরা তাহাদের একঘরে করিয়াছে, তাহাদের জট কাটিয়া দিয়াছে, সারিন্দা ভাঙিয়া দিয়াছে ; তবু তাহারা শাহলালকে ছাড়ে নাই। বুকফাটা কান্নায় তাহারা গাহিয়াছে :
“তোর বাজারে আইস্যারে আমার
গেল জাতি কুল রে।”
এই জাতি দিয়া কুল দিয়া তাহারা শাহলালের অশ্রুজলের সাধনা করিয়াছে। তাহারা কতরকমেই না শাহলালকে তালাশ করিয়াছে। অন্তরের দরদের সারিন্দা বাজিয়া বাজিয়া তাহাদিগকে সমাজের বাহির করিয়া সেই চিরবাঞ্ছিতের সন্ধানে প্রবৃত্ত করিয়াছে :
“চল যাইরে আমার শালালের তালাশে রে
মন চল যাই রে।”
পথে হালুয়া ভাইকেও দেখিয়া গলা জড়াইয়া ধরিয়া গাহিয়াছে।
“হাল বাও হালুয়া বাইরে হাতে সোনার নড়ি,
এই পথ দ্যায়ানি দেখছাও যাইতে রে
আমার শানাল চান ব্যাপারীরে।”
হাতে সোনার ডুরি ‘জালুয়া’ ভাইকে দেখিয়া এই একই গান তাহারা গাহিয়াছে। তাহারা উত্তর দিয়াছে :
“দেইখ্যাছি দেইখ্যাছি আমরা শানাল চান ব্যাপারী
ও তার হাতে আশা বোগলে কোরান
গলায় ফুলের মালা রে।”
কি যাদুই শাহলাল জানিতেন! যার বলে কঠোর সমাজশাসন উপেক্ষা করিয়া লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান আজ শাহলালের নাম লইয়া আপনাদের ভক্তি অর্থ নিবেদন করিতেছে।
এ ভক্তি দেবতায় নহে, ভগবানে নহে, কিম্বা সম্মানিত কোনো বিদ্বানের জন্যও নহে–শহর হইতে অনেক দূরে মূর্খ বাঙ্গাল এক বাউল কবির জন্য, যার সম্বলের ভিতর ছিল এক চোখের জল আর কয়েকটি মুর্শীদা গান। হয়তো শাহলালের জীবনের অনেক মাহাত্ম্য ছিল। হয়তো অনেক অশ্রুজলের ইতিহাস তিনি লিখিয়া গিয়াছেন নিজের জীবনটি দিয়া। সেসব না জানা আমাদের নিতান্ত দুর্ভাগ্য। তার ভিতর দিয়া আমরা এমন একজন মহাপুরুষের দেখা পাই, যিনি গড়িয়া উঠিয়াছেন আমাদেরই দেশের মূর্খ গেঁয়ো কৃষকের সুখ-দুঃখের সমব্যথী হইয়া, তাহাদের সহজ সুন্দর কবিত্বের কনকাসনে। তাঁহার নিজের জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি ঘটনাগুলিকে যবনিকার অন্তরালে রাখিয়া বাংলার পল্লীজীবনের যে এক বিরহী হৃদয়ের ছবি তিনি আঁকিয়া গিয়াছেন, তাঁহার মুর্শীদা গানে তাহা চিরদিন থাকিয়া যাইবে।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024