ফিকশন: একদিন তোর হইবো রে মরণ – ৬
কিস্তি ১।। কিস্তি ২ ।। কিস্তি ৩ ।। কিস্তি ৪ ।। কিস্তি ৫ ।।
…
পার্ট টু
…
১.০ মেটামরফসিস: গ্রেগর সামসা’র সমস্যা
আবদুল্লাহ আর রূপা রিকশা নিয়া ফুলার রোডের নিরবতায় হালকা বাতাসে যেন আলাদিনের কার্পেটে উড়তেছে। কিন্তু দুইজনের মন-ই কিছুটা ভার। গতকাল রাতে কি ঘটছে – এইটা নিয়া কেউ আর কথা বলতে চাইতেছে না। যা হওয়ার তা তো হয়া-ই গেছে। কিন্তু কেন হইছে, কিভাবে হইছে – এই নিয়া খচখচ করতেছে তাদের মন; যেইভাবে ফুলার রোডের বাতাসে একটু পরে পরে উড়তেছে হেমন্তের কয়েকটা খয়েরি পাতা; অই পাতাদের মতন তাদের মন ঝরে যায় নাই, কিন্তু খচখচানিটা যেন জেগে উঠতেছে। কেন হইলো এমন!
এমন টাইমে প্রফেসর আবদুল্লাহ’র মোবাইল ফোন বাইজা উঠলো। পকেট থিকা বাইর কইরা দেখলো, মজিদের কল। সিরিয়াস কিছু না হইলে মজিদ কখনো কল দেয় না। যদিও সিচুয়েশন ভালো না, তারপরও কনফিউজড হয়াই কলটা রিসিভ করলো প্রফেসর আবদুল্লাহ। মজিদ তার পুরা ঘটনাটা বললো। এই অবস্থায় দুবাইয়ে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক কনফারেন্সে ‘ইসলাম ইন বেঙ্গল: পাস্ট, প্রেজেন্ট এন্ড ফিউচার’ নামে পেপারটা সাবমিট করাটা কি ঠিক হবে? পারসোনাল এক্সপেরিয়েন্সের ট্রমা সে কাটাইতে পারতেছে না। আবদুল্লাহ’র মনে হইলো, পুরুষ মানুশ বইলা সে কানতে পারতেছে না। কিন্তু কারে কি বলবে আবদুল্লাহ! মজিদ জিগাইতেছিলো, গত বিকাল থিকা তারে তারে কল করতেছিল, পাইতেছিল না, কেন? আবদুল্লাহ এড়ায়া গেলো, কারণ টিচার-পলিটিক্সের এক্সপেরিয়েন্স থিকাই সে জানে, নিজের খারাপটা নিজের কখনো বলতে নাই, শুনলে অন্যরা খুশিই হয়, যতো কাছের মানুশই হোক! তো, আবদুল্লাহ কইলো, কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল, আপনার লগে দেখা হইলে বলবো নে! আর অইটারও ডেডলাইন তো আছে আরো এক সপ্তাহ, এর মধ্যে দুইজনে মিইলা ঠিক করবে নে! পরে কথা বলবো নে! বইলা কল কাইটা দিলো সে।
ততক্ষণে রিকশা চইলা আসছে কোয়ার্টারের কাছে। রূপা এখনো উদাস। মুখ ভার না, কিন্তু কি জানি ভাবতেছে, যেন সূর্য ডুবে যাইতেছে পুরান বহ্মপুত্রের পাড়ে, এইরকম একটা বিষাদ; মহাজাগতিক একটা সন্ধ্যা, কোনদিনই ফুরায়া যাবে না। অথচ এখন দুপুর গড়ায়া মাত্র বিকাল।
সকাল হওয়ার পরে আর কোন ঝামেলা হয় নাই, কোর্টে চালান দেয়ার আগেই সব কাগজপত্র রেডি ছিল, এজলাসে উইঠা দাঁড়াইতে হইছে খালি। জজ সাহেবও কিছুটা বিব্রত-ই ছিলেন মনেহয়, এইরকম নামি-দামি বুদ্ধিজীবী’রে বেশি শরম দিতে চান নাই। আবদুল্লাহ অবশ্য শরম পান নাই, কারণ উনি তো কোন অন্যায় করেন নাই! খামাখা এই ফাঁপড়’টা কেন নেয়া লাগলো – সেইটা বুঝতে পারতেছিলেন না। যা-ই হোক… এখন এই চুল খোলা বিকালবেলার বাতাসেই তো সে আছে, রূপাও আছে। এর বেশি কিছু ভাবার তো আর দরকার নাই।
রূপা ভাবতেছিল, বলল-ও আবদুল্লাহ্’রে, অনেক ধকল গেলো তোমার! খিদা লাগছে? বাসায় আছে কিছু? আবদুল্লাহ্ যে খাওয়া-খাদ্য পছন্দ করে – এইটা রূপা জানে; আর শুচিবাই-ও আছে। সবকিছু খাইতে চায় না। আবদুল্লাহ্ বললো, ফ্রিজে তো কিছু থাকার কথা… বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়া তিনতলার দরজার সামনে দাঁড়াইলো অরা। আবদুল্লাহ্ পকেট থিকা চাবি বাইর কইরা তালা খুলতে গেল। কিন্তু কি অবাক কান্ড! দরজা তো ভিতর থিকা লক করা!
অবাক হয়া সে রূপা’র দিকে তাকাইলো। কি হইতেছে এইসব! ঘরের চাবি তো রূপা আর তার ছাড়া কারো কাছে নাই। দরজা খুইলা কে ঢুকে পড়ছে ঘরে তার?
লক’টা যেন আবদুল্লাহ্’র মনের কথা শুনতে পাইলো আর মনে হইলো, খুইলা গেছে। আবদুল্লাহ্ চাপ দিয়া দেখলো, আসলেই তো দরজা খুলে গেছে। আবদুল্লাহ্ রূপা’র দিকে তাকাইলো। রূপাও তাকাইলো আবদুল্লাহ্’র দিকে। ডরানোর মতো মানুশ অরা না। ভূতে বিশ্বাস করে না। আস্তে আস্তে পা টিইপা অরা ঘরে ঢুকলো। যেন কেউ ঘুমাইতেছে, তারে ডিস্টার্ব করতে চায় না। যেইভাবে বুদ্ধিজীবী’রা ফেসবুকে পোস্টে দেয়। সাপও মরে (না), লাঠিও ভাঙ্গে না। মানে, প্রতিবাদও করা হইলো, কিন্তু ফেসবুকও আইডি ব্লক কইরা দিলো না। এইরকম সেইফলি ঘরে ঢুইকা অরা অবাক! কিছুই তো নড়চড় হয় নাই। খালি সোফার উপ্রে স্যুট-কোট পইড়া গ্রেগর সামসা বইসা আছে। সারা শরীর মানুশের, মাথাটা খালি তেলাপোকার।
মানুশ-ই সে। মাথাটা বড় খালি। হাত-পা, বডি সব ঠিকঠাক আছে। এমনকি প্যান্ট যেমনে পিনছে মনে হইতেছে, ভিতরে আন্ডারওয়ারও আছে। যেহেতু আবদুল্লাহ্ আর রূপা দুইজনেরই কাফকা পড়া আছে, এমনকি রাতের পর রাত কখনো কফি, কখনো ওয়াইন খাইতে খাইতে এই নিয়া ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যাও করছে, অরা দুইজনেই দেখা মাত্র চিইনা ফেলছে। বরং গ্রেগর সামসা জড়োসড়ো, বিব্রত বোধ করতেছে, তারে হিজড়া ভাবতেছে কিনা!
কই থিকা কথা শুরু করবে, গ্রেগর সামসা ঠিক করতে পারতেছে না। অদের দিকে তাকাইতেও পারতেছে না। কাফকার মতো একটু শাই। কিন্তু অরা দুইজনও কিছু জিগাইতেছে না, কিন্তু একটা কিছু যেন জিগাইতেছে, এইভাবে তাকায়া আছে, তার দিকেই।
গ্রেগর সামসা নিজে নিজেই নিজেরে কইলো, আমি একটু পানি খায়া নেই, ঠিকাছে! রূপা বুঝতে পারতেছিলো না, তারে পানি আগায়া দেয়াটা ঠিক হবে কিনা। হাজার হইলেও বাঙালির ‘অতিথি-পরায়ণ’ ব্যাপারটারে ছোট করা তো ঠিক হবে না। কিন্তু শে নিজেও তো এখন কাফকায়েস্ক সিচুয়েশনে আছে। শে কি দিবে? নাকি কে নিজেই খায়া নিবে? – এই দোনোমনা আবদুল্লাহ্’র কম, কিন্তু সে অবজার্ভ করতে চাইতেছে সিচুয়েশনটা। গ্রেগর সামসা নিজেই টেবিলের জগটা থিকা কাচের গ্লাসে পানিটা নিয়া খাইলো। তারপরে হাঁইটা আইসা বসলো। এইভাবে সে ফ্রি হইতে পারলো। তারপরে আলাপটা শুরু হইলো।
গ্রেগর সামসা কইলো, বসেন না আপনারা!
আমি সরি যে, না জানায়া ঢুকতে হইছে আমার আপনাদের ঘরে। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা এমনই আর্জেন্ট যে, আমি না কইরা পারি নাই। খুব জরুরি একটা সময়ে আমারে ইন্টারভিন করতে হইছে। এ.আই.’র মিডিয়া-রিয়ালিটি আরেকটু হইলেই ফ্যাক্ট-বেইজড রিয়ালিটির দখল নিয়া নিতেছিল।
আবদুল্লাহ’র দিকে তাকায়া কইলো, আপনি তো ফ্যাক্ট-চেকিং রিয়ালিটির সাথে জড়িত, এই কারণে আপনারেও ডিসকানেক্ট কইরা ফেলছিল যাতে কোন ট্রেস না থাকে। অনলাইন, অফলাইনে সব জায়গায় মিথিক্যাল রিয়ালিটি ঢুকায়া দিতে চাইতেছিল। তো, আমার আপনার ল্যাপটপও ইউজ করতে হইছে। বইলা একটা কাশি দিলো। কইলো, কিন্তু আপনার ফ্যাক্ট-চেকিং ফোল্ডার ছাড়া অন্য কোথাও আমি ঢুকি নাই। প্রমিজ!
কিন্তু মুশকিল হইলো, বাগ তো ঠিক করা যায় নাই পুরাপুরি।
রূপা আর আবদুল্লাহ বুঝতে পারে না সবকথা। কিন্তু বুঝে যে, সিরিয়াস একটা কিছু ঘটতেছে, আর এখন ওরাও এইটার পার্ট। তো, কি করতে হবে তাইলে? কেউ কোশ্চেনটা করে না, কিন্তু সবাই যার যার মতো এই কোশ্চেনটা করতে থাকে, নিজেদেরকে।
আবদুল্লাহ-ই বলেন পয়লা, প্রফেসর শঙ্কু’র লগে কথা বইলা দেখবেন?
রূপা সাথে সাথেই বলে, কেন, মিসির আলি কি পারবে না?
কিন্তু গ্রেগর সামসা উইয়ার্ড একটা সমাধান দেন, বলেন যে, না, আমাদের দরকার এখন আন্না কারেনিনা’রে।
গ্রেগর সামসা স্পষ্ট করেন ব্যাপার’টা; বলেন, আপনারা ভাবতেছেন, এইটা একটা আইটি ইস্যু? টেকনিক্যাল পারসন দরকার? অইরকম টেকনিক্যাল লোকের আমাদের কি অভাব আছে! রাশিয়ার হেল্প ছাড়া এইটার সলিউশন করা পসিবল না। আর রাশিয়ায় কে আছেন আমাদের আন্না কারেনিনা ছাড়া!
রূপা তো অবাক! প্রফেসর আবদুল্লাহ্ও অবাক। এইটা কেমন কথা! কমিউনিস্ট বিপ্লব কি ফিরা আসবে নাকি আবার! কিন্তু গ্রেগর সামসা’রে এই কথা বলাটা কি ঠিক হবে?
গ্রেগর সামসা এইটা টের পাইতেছিলেন।
(টু বি কন্টিনিউ…)
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024