পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য – ফররুখ আহমদ [সওগাত, সেপ্টেম্বর – অক্টোবর, ১৯৪৭ ]
[এইরকম কথা-বার্তা তো চালু আছে যে, ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চের পাবলিক মিটিংয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে উর্দু’র ঘোষণা দিলে* রাষ্ট্রভাষা নিয়া তর্ক-বির্তক শুরু হয়। কিন্তু এইটা পুরাপুরি সত্যি কথা না। ১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই থিকা এই আলাপ শুরু হইছিল পত্র-পত্রিকায়। তো, অই সময়ের, শুরুর দিকের একটা লেখা হইতেছে ফররুখ আহমদের। ছাপা হইছিল কলকাতার মাসিক সওগাত পত্রিকার বাংলা ১৩৫৪ সনের আশ্বিন সংখ্যায়।
কাছাকাছি সময়েই ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (জুলাই ও নভেম্বর, ১৯৪৭) এবং তমদ্দুন মজলিসের “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নাকি উর্দু?” বুকলেটে (১৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭) কাজী মোতাহার হোসেন এবং আবুল মনসুর আহমদ এই নিয়া লেখেন। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক এবং মাওলানা আকরাম খাঁ-ও লেখছেন ১৯৪৮ সালের মার্চের এই পাবলিক ঘোষণার আগে। এবং এরপরেও অনেক ঘটনা ঘটছে ১৯৫২ সালের আগ পর্যন্ত। সওগাত পত্রিকা ঢাকা থিকা ছাপানো শুরু হওয়ার পরে উনারে উর্দু-র পক্ষেও ওকালতি করেন, বাংলা’র পক্ষেও লেখা ছাপান।
মানে, হিস্ট্রি’টা একটা দিনের ঘটনা না। কিভাবে অই জায়গাটাতে গিয়া রিচ করছে – অই জায়গাগুলা আমাদের সামনে না-থাকার কারণে ২১ শে ফেব্রুয়ারি’রে খুবই ড্রামাটিক মনে হইতে থাকে। এবং হিস্ট্রিকাল লাইনটা মিসিং থাকে। তো, অই সময়ের কিছু লেখা আমরা বাছবিচারে আপলোড করবো ধীরে ধীরে। এইখানে ফররুখ আহমদের লেখাটা থাকলো। ]
…
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাদানুবাদ চলছে। আর সবচাইতে আশার কথা এই যে, আলোচনা হয়েছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, জনগণ ও ছাত্রসমাজ অকুণ্ঠভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সুতরাং এটা দৃঢ়ভাবেই আশা করা যায় যে, পাকিস্তানের জনগণের বৃহৎ অংশের মতানুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত হবে।
যদি তাই হয়, তাহলে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বাংলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। কেন হবে এ নিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কিন্তু একটা কারণে আমাকে বাধ্য হয়ে দুএকটি কথা প্রসঙ্গত বলতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের, অন্তত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে এ কথা সর্ববাদীসম্মত হলেও আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তি বাংলা ভাষার বিপক্ষে এমন অবাচীন মত প্রকাশ করেছেন যা নিতান্তই লজ্জাজনক। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষায় রূপায়িত করলে ইসলামী ঐতিহ্যের সর্বনাশ হবে এই তাঁদের অভিমত।
কী কুৎসিত পরাজয়ী মনোবৃত্তি এর পিছনে কাজ করছে এ কথা ভেবে আমি বিস্মিত হয়েছি। যে মনোবৃত্তির ফলে প্রায় দুশো বছর বাংলা ভাষায় ইসলামের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ ছিল, সেই অন্ধ মনোবৃত্তি নিয়েই আবার আমরা ইসলামকে গলা টিপে মারার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছি। দুঃখের বিষয় সন্দেহ নাই। কিন্তু আরো দুঃখের কথা এই যে, পূর্ব পাকিস্তানে এমন মানুষ আছেন (সংখ্যায় যত অল্পই হোক না কেন) যাঁরা একমাত্র মানসিক দুর্বলতার জন্যই মাতৃভাষাকে মাতৃভাষার মাধ্যমে অস্বীকার করে ইসলামী ঐতিহ্যের মহান দায়িত্ব অপর একটি প্রাদেশিক ভাষার কিঞ্চিৎ-পরিপুষ্ট ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন।
কারণ : (এক) ঐ প্রাদেশিক ভাষাটি তথাকথিত শরিফদের ভাষা। (দুই) ঐ প্রাদেশিক ভাষায় কয়েকখানি ইসলামী তমদ্দুনমূলক গ্রন্থ রচিত ও অনূদিত হয়েছে।
প্রথম কারণটি হাস্যকর। দ্বিতীয় কারণটি অযৌক্তিক।
অবশ্য ঐ দুটো কারণকেই অঙ্গাঙ্গীভাবে এক কল্পনা করা হয়েছে। আর ঐ কারণটির বিরুদ্ধেই আমার অভিযোগ !
শরাফতি কথাটার প্রকৃত ইসলামী অর্থ ধারা জানেন তাঁরা যে এই জাতীয় কথা উচ্চারণ করেন না, অন্তত করতে পারেন না, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বাংলা ভাষাকে যে ইসলামী ভাবধারার শ্রেষ্ঠ আধারে পরিণত করা যায় এ বিষয়েও আমার কোন সন্দেহ নেই। বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক দীনতা ঘোচাতে হলে শুধু লেখক সম্প্রদায়কে নয়—রাষ্ট্র ও সমাজের বিত্তবান অংশকেও এ দিকে মনোযোগ দিতে হবে; জনসাধারণের কথা আমি ইচ্ছে করেই বাদ দিয়েছি। কারণ, অধিকাংশ লোকের মত জনগণও লুণ্ঠিত সম্প্রদায় (অবশ্য বৃহৎ পরিপ্রেক্ষিতে)।
রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপে বিত্তবানের সহযোগিতা কামনাকে কেউ যদি পুঁজিবাদের সমর্থন মনে করেন, তাহলে ভুল করবেন। কারণ ইসলামী রাষ্ট্রের বা পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ শত্রু বলে সর্বপ্রথম গণ্য হতে পারে কুফরী ও ক্যাপিটালিজম। আর ঐ দুটোর বিরুদ্ধেই বৈরী মনোভাব নিয়ে আমাদের জাতীয় সাহিত্য গড়ে উঠবে বলেই আমার বিশ্বাস ! সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্র, রাষ্ট্রভাষা ও আমাদের জাতীয় সাহিত্য গড়ে তুলতে সহযোগিতা (সাহায্য নয়) করতে পারেন কেবলমাত্র তাঁরাই যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ইসলামী গণতন্ত্রের আলোক-দীপ্ত।
কোন্ প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী এর বিরোধিতা করবেন তাও আমাদের অজানা নেই । সেই শ্রেণীর বিরোধিতা আমরা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অনুভব করেছি। নিরক্ষর জনগণকে সকল দিক দিয়ে বঞ্চিত করার চেষ্টা এঁদের এ পর্যন্ত সফল হলেও, আর সম্ভব হবে না। সময়ের চাকা তার গতি পরিবর্তন করেছে। জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবীকে চেপে রাখা কারুর সাধ্যেই কুলোবে না।
ঐ ন্যায়সঙ্গত দাবীর বলেই পাকিস্তানের জনগণ শুধু আহার্যের নয়– সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার কেড়ে নেবে। গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপায়িত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
আমি আগেই বলেছি যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে। সেই কথাই আবার স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমি আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ করছি।
…
*”About language I have already said, this is in order to create disruption among the Musalmans. Your Prime Minister has righty pointed this out in a recent statement, and I am glad that his government have decided to put down firmly any attempt to disturb the peace of this province by political saboteurs or their agents. Whether Bengali should be the official language of this province is a matter for the elected representatives of the people of this province to decide. I have no doubt that this question should be decided solely in accordance with the wishes of the inhabitants of this province at the appropriate time. Let me tell you in clearest language that there is no truth [in rumors] that your normal life is to be touched or disturbed, so far as your Bengali language is concerned. But ultimately it is for you, the people of this province, to decide what should be the language of your province.
But let me make it clear to you that the state language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Anyone who tries to mislead [you] is merely the enemy of Pakistan. Without one state language, no nation can remain tied up solidly together and function. Look at the history of other countries. There[fore] so far as the state language is concerned, Pakistan’s language should be Urdu; but, as I have said, it will come in time.” – Muhammad Ali Jinnah, Governor General of Pakistan, in Dacca, East Pakistan; March 21st, 1948]
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024