কোনো এক দূরবর্তী উত্তরবঙ্গীয় শীতের কথা ভেবে—
কখনো মনে হয় অনেক লম্বা একটা লেখা লিখি। তার জন্য শীতকালের বিষন্নতা হাজির হইছে আবার। এই শহর নিয়েও দু’একটা ভালো কথা ভাবতে ইচ্ছা করে। দুএকটা ভালো ঘটনা এই শহর যে আমারে দেয় নাই এমন তো না। লিখতে ইচ্ছা করে আমার বন্ধু আশার কথা। যে বন্ধু ধীরে ধীরে পরিবার হয়ে ওঠে, তারও পরে হয়তো শরীরের হাত পায়ের মতো একটা অংশ হয়ে যায়। জীবনের একেকটা সময় এসে আমরা টের পাই পাতার মতোন ঝরে যাওয়া। একটা ডাল থেকে একটা পাতা যেমনে ঝরে যায়, না চাইতেও। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও আমরা কোনো দল থেকে, কোনো মানুষ থেকে এমনে ছিটকে পড়ি। অনেক আপন ভাবলেও কারো কাছে আমি অটটুক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারি না যতটুক ভাবি তারে। ঘটনাগুলা থাইকা যায় কোথাও না কোথাও। কিন্তু আমি আর আশা এক অপরের কাছ থেকে ছিটকে পড়ি নাই। আশারে ভাবতে পারি আমার নিজের মানুষ হিসেবে।
কোনোকিছু অর্জন না করে মানে নিজে না বানায়া, না কিনে ওই জিনিসরে নিজের ভাবতে পারা তো টাফ। বাড়ি ছাড়ার আগে বাড়িরে একান্তই আমার মনে হইতো না আমার। আব্বা মার টাকারেও আমি কখনো আমার টাকা ভাবতে পারি নাই। এখনো পারি না। দুনিয়ায় কোনোকিছুই আসলে আমার ওইভাবে নিজের মনে হয় না। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন আমি আশা দুজনেই অর্থনৈতিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত তখন কিসের জন্য যেন আশা আমার কাছে টাকা চাইলো। আর বললো তোর টাকারে যতটা আমার নিজের টাকা মনে হয় অতটা আর কারো বেলায় হয় না। একটা টঙের দোকানে, বিশ্রি শব্দের মধ্যে এমন একটা কথা শুনে কেমন আনন্দ লাগতে পারে তা আমি জানি। দলা পাকানো কান্নার মতো এমন সুখের মোমেন্ট আমার জীবনে আসছে। এইসব তো হুট করে হয় নাই৷ একদিনে না। ভার্সিটিতে থাকতে আমাদের যে কোনো একজনের টিউশনি থাকলেই আমরা বলতাম, চাপ নাই৷ চলে যাবে আমাদের৷ এবং চলে গেছে আমাদের পাথরের দিন। দীর্ঘ রাত। আমার লকারে আশার হাজার হাজার টাকা থাকতো। আমি যখন খুশি খরচ করতে পারতাম বিনাদ্বিধায়৷ এবং আজও চাপ লাগলে আমি জানি আশার কাছে টাকা থাকলে ওইটা দিয়ে আমি চালাইতে পারবো। এইটা ধারের মতো না। মনে হয় আমার জমানো টাকা খরচ করতেছি, আবার জমলে রাইখা দেবো৷ আমার সামান্যতম অভাব নিয়েও আমি যেমনটা আশার সামনে দাঁড়াইতে পারি তেমনটা তো আব্বার সামনেও পারি না। এমন একটা সম্পর্কে থাকা তো শুধু আনন্দই দেয় না—এই ধূসর শীতকালের মতো বিষন্ন করে তোলে আমাদের।
আমাদের হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি নিয়ে এই শহরের রাস্তাগুলা বদলায়া যাইতেছে৷ কত অজস্র হাঁটার স্মৃতি আমাদের। কোথায় কোন ঝুপড়িতে পটল ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ার স্মৃতি। খুঁজে খুঁজে ধানমন্ডি এলাকায় একটা ভর্তার দোকান বের করা। আশা যখন চীনে চলে যাইতেছিলো এমফিল করতে, ভেতরে কিছু একটা মরে যাইতেছিলো আমার। এত দুরত্বের সংকেত মেনে নেওয়ার মতো শক্ত আমি হইতে পারি নাই কখনো। মানসিক চাপ শরীরের উপর নেমে আসলো। জ্বর আসলো৷ বমি করলাম। আরও হাবিজাবি। তারপর ও চইলা গেল। আমি খুব কম কথা বলতাম ওর সাথে। খুবই কম। কারণ ভাবতেই চাইতাম না ও এই শহরে নাই৷ আমাদের তো হলের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার অভ্যাস৷ তখন রাস্তায় বের হয়ে অদ্ভুত লাগতো আমার, মনে হইতো এই শহরে বোধহয় এমন কোনো রাস্তা নাই যেখানে হাঁটলে আমার ওর কথা মনে পড়বে না।
যেহেতু আলাদা হলে থাকতাম ঢাকার বাইরে যাওয়ার আগে আমরা দেখা করতাম। ও চীনে থাকার সময়টায় কোথাও যাওয়ার আগে মনে হইতো যাই দেখা করে আসি। ওর বন্ধ সিমে মেসেজ পাঠাইতাম। হা হা….
ব্যাপারটা এমন না আমাদের সম্পর্ক সবসময় ভালো গেছে। কিন্তু দেখা হইলে আমরা আবার শুরু করতে পারছি অজস্র কথা—যেখানে শেষ হইছিলো গতকাল। মানুষের সম্পর্ক এখন লাগে বোঁটা ছিড়ে খসে যাওয়া পাতার মতোন। যেকোনো সময় আমি যে কাওরে হারায় ফেলতে পারি। কিন্তু আশারে আর হারানোর ভয় লাগে না আমার। আমার কাছে এই দুনিয়ায় এগজিস্ট করাটা এমন লাগে এখন—আমি আছি তাইলে আশাও আছে। আছে তো।
আমার বইয়ে আশারে উৎসর্গ করা একটা কবিতা আছে৷ সেঁজুতি আপা প্রোগ্রামের দিন বলতেছিলো, কোনো কবিতায় নাম নাই, এই একটা কবিতা বাদে আর কাওরে উৎসর্গ নাই, এই আশাটা কে? পরে আশারে দেইখা উনি আলোচনার মাঝখানে সবার সামনে ওরে দাঁড় করাইলেন। পরিচিত করাইলেন। (আপার এই ট্রিটটুকু আমার সারাজীবন মনে থাকবে৷) আমি তো আপারে বলতে পারি নাই, আমার জীবনে আশার এগজিস্টেন্স এমন—আমি তো এক জীবনে এত লেখা লিখতেই পারবো না যত লেখা আমি ওরে উৎসর্গ করতে চাই।
শীতের রোদে বইসা আছি এখন। উশুম উশুম রোদে দাঁড়াইতে আশার কল আসলো। আমার গায়ে যে চাদর এইটা ও সিকিম থেকে নিয়া আসছিলো। বন্ধু আমার নানান জায়গায় ঘোরে। এইটা সেইটা আনে। কিছু জিনিস এত সুন্দর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভাঁজও খুলি না। আমরা যেবার সেন্টমার্টিন গেলাম ও আমারে ছোট্ট একটা ঝিনুক দিলো ফিরে। এমনিই। ঝোলা ভর্তি করে নিজেরা নিজেরা এত্তগুলা করে ঝিনুক আনছি। কিন্তু ওই ঝিনুকটা আমার কলম রাখার ব্যাগে আছে এখনো। কোনো কারণ ছাড়াই। এমনি। আশাও আছে যেমন। এখন আর লাগে না অনেক সুন্দর সময় কাটানোর জন্য সমুদ্রে কিংবা পাহাড়ে যাইতে হবে। কিছু কিছু মানুষ শীতের সকালে জানলা গলায়া আসা রোদের মতোন আরামদায়ক হয়ে ওঠে। যার পাশে বসে থাকাই সুন্দর৷ উশুম।
শীতকাল এমন ঝিমঝিম মন খারাপি ক্যান নিয়া আসে কে জানে। এমন গাঢ় অলস তাকায়া থাকার মধ্যে আশারে নিয়ে লিখতে মন চাইলো। প্রিয় কোনো মুহূর্তই বলা গেলো না। সেসব ক্যামনে বলে জানি না। কারো দিকে ছুটে যাওয়ার তাড়না ভাষায় তুলতে পারা অতটা সহজ হয়তো না। সহজ না হওয়াই বরং ভালো।
লিখে আর কতটুক ধরা যায় তারে—
রুম্মানা জান্নাত
Latest posts by রুম্মানা জান্নাত (see all)
- শহিদী তামান্না – ইয়াহিয়া সিনওয়ার - নভেম্বর 9, 2024
- কোনো এক দূরবর্তী উত্তরবঙ্গীয় শীতের কথা ভেবে— - ডিসেম্বর 14, 2023