[বই থেকে] ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন – শাহেদ আলী
[পাকিসতান আমলে দুইটা ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হইছিল, একটা ১৯৫৪ সালে, এবং আরেকটা ১৯৭০ সালে। ১৯৫৪ সালের ইলেকশনে খেলাফতে রাব্বানী পার্টি থিকা ইলেকশন করছিলেন গল্পকার শাহেদ আলী।
খেলাফতে রব্বানী পার্টির মেইন লিডার ছিলেন আবুল হাশিম (ব্রিটিশ আমলে যিনি মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন, বাংলা-প্রদেশের)। মুসলিম লিগ থিকা বাইর হয়া আইসা এই দল বানাইছিলেন উনি, এবং উনি ছিলেন মুসলিম-লিগ বিরোধি যুক্তফ্রন্ট তৈরি করার একজন কারিগর, থিওরেটিকালি এবং পলিটিকালি; কিনতু শেষে তাদেরকেই যুক্তফ্রন্টে রাখা হয় নাই। ১০টা সিটে রব্বানী পার্টি ইলেকশন করছিল, শাহেদ আলী ছিলেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের কেনডিটেট।
উনার ইলেকশন করার কাহিনি উনার মুখেই শুনেন। উনার “জীবন কথা” বই থিকা নেয়া হইছে নিচের কথাগুলা।]
১৯৫৩ সাল। আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করছি। একবার ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। তখন নির্বাচনের খুব তোড়জোড় চলছে। আল্লামা আবুল হাশিম সারা পূর্ব পাকিস্তান ট্যুর করেন। সে-সময় মোমেনশাহীতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমমনা বিরোধী দলগুলো যুক্তফ্রন্ট গঠনের ডাক দেয়। মুহূর্তে রাজনীতির অঙ্গনে এক প্রচণ্ড চাঞ্চল্যকর অবস্থা শুরু হয়ে গেল। আমি রব্বানী পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যার প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন জনাব আবুল হাশিম। (রব্বানী পার্টি: খেলাফতে রব্বানী পার্টি, প্রতিষ্ঠাকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৫৩।) তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি রংপুর যাবার সময় আমার একটা চিঠি নিয়ে যেয়ো। ওখানে আমার ঘনিষ্ঠ একজন নামকরা উকিল আছে। আবু হোসেন সরকার। আমাদের আন্দোলনের জন্য তাঁকে আমাদের একান্ত দরকার। তাঁকে বুঝিয়ে বলবে, উত্তরবঙ্গে তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে না। শেরেবাংলারও একই কথা।’
আমি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ফিরে পরদিন সকালে জনাব আবু হোসেন সরকারের সঙ্গে দেখা করি। দীর্ঘদেহী জনাব আবু হোসেন সরকার। তাঁর গোলাকৃতি মস্ত বড়ো মাথায় ঘন কাঁচাপাকা চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো মজবুত স্বাস্থ্য।
সরকার সাহেব আমাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নম্রকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার পরিচয়? কোনো কেস আছে?’
আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আমি কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক। আমি জনাব আবুল হাশিমের একটা চিঠি এবং শেরেবাংলার একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’ এ-কথা বলার পর আমি আবুল হাশিমের চিঠিখানা সরকার সাহেবের অনিচ্ছুক হাতে তুলে দিলাম। তিনি চিঠি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আবুল হাশিম এবং শেরেবাংলাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন, তাঁরা আমাকে স্মরণ করেছেন বলে। এককালে রাজনীতি করলেও আমি এখন আর রাজনীতি করি না। আমি দুঃখিত।’
আমি সরকার সাহেবের এই নিরুত্তাপ সংক্ষিপ্ত জবাবে হতাশ হয়ে পড়লাম। সরকার সাহেব বললেন, ‘আসুন, বসুন, চা খান। আপনি কেবল শিক্ষকতাই করেন, না রাজনীতিও করেন?’
বললাম, ‘এখন পর্যন্ত অধ্যাপনাতেই আছি। আর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে পারি না। আমরা আপনাকে মুসলিম লীগ শাহির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে সামনের সারিতে পেতে চাই।’ আমি ও সরকার সাহেব মুখোমুখি বসলাম। তিনি বললেন, ‘দেখুন, বয়স হয়েছে, জীবনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, জেলও কেটেছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। ওকালতি করে দুটো পয়সা আয় করি। আমাকে রোজ পঞ্চাশটি মুখে ভাত তুলে দিতে হয়। সুতরাং রাজনীতি করা আমার আর সাজে না।’
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘আপনার মুখে এ-কথা শুনব, আশা করিনি। আপনার পরিবারকে আপনি পঞ্চাশ জনের একটি পরিবার মনে কেন করছেন? দেশবাসী মনে করে পাঁচ কোটি মানুষ নিয়ে আপনার পরিবার। এই পাঁচ কোটি মানুষের মুখে আপনি ভাত তুলে দেবেন। আপনার কাছে এই তো দেশবাসীর ঢাবি।’
এবার সরকার সাহেবের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমাকে কিছু ভাবতে দিন। আমি কিছু দিনের মধ্যেই ঢাকা যাচ্ছি। তখন আমি শেরেবাংলা ও হাশিম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করব।’ কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠল। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে। জনাব আবুল হাশিম সাহেব দাবি করলেন, কেবল সমমনা ইসলামবিশ্বাসী দলগুলো নিয়েই যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে। কিন্তু বামপন্থিরা দাবি করল তাদেরও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত খেলাফতে রব্বানী পার্টিকে বাইরে রেখেই শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। খেলাফতে রব্বানী পার্টি দাবি করেছিল দশটি আসন, যেসব আসনে যুক্তফ্রন্ট নমিনি দেবে না। অন্যসব আসনে রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্ট নমিনিদের পক্ষে কাজ করবে। সেই দাবিও গৃহীত হলো না। খেলাফতে রব্বানী পার্টি বাধ্য হয়ে দশটি আসনে তাদের নিজস্ব নমিনির নাম ঘোষণা করে।
আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। আমার কাছে টেলিগ্রাম গেল। আমাকে আমার জেলা সিলেটের ১ নম্বর আসনে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ নিয়ে গঠিত ছিল এই বিশাল নির্বাচনী এলাকা। নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সময়ে আমার ওপর এই নির্দেশ আমার কাছে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে ১৯৫১ সালে। এর পর থেকে আমি প্রথমে বগুড়া কলেজে ও পরে কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় বলতে গেলে আমাকে কেউ চেনে না। আমিও সুনামগঞ্জের দু-একজন লোক ছাড়া আর কাউকে চিনি না। আমার নির্বাচনী এলাকায় তাদের কোনো পরিচিতিও নেই।
সুনামগঞ্জের একজন জাঁদরেল সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী, যিনি সাবেক আসামের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন এককালে, এখন পেয়েছেন যুক্তফ্রন্টের টিকিট। প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সিটিং সদস্য জনাব আবদুল খালেক আহমেদ পেয়েছেন মুসলিম লীগের টিকিট। দুজনেই এলাকায় সুপরিচিত। এই এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা তাঁদের সমর্থক ও কর্মী। এই অবস্থায় আমি আমার নমিনেশন নিয়ে মহাসংকটে পড়লাম। এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা আমাকে চেনে না। কারণ আমার জীবন কেটেছে বাইরে-বাইরে। ১৯৪৭-এর নির্বাচনে এবং রেফারেন্ডামের সময়ে আমি এলাকায় কাজ করেছি। রেফারেন্ডামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, জিন্নাত আলী প্রমুখ আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন এবং রেফারেন্ডামের পরে আমি এলাকা ছেড়ে চলে আসি। এলাকার কোনো লোকের সঙ্গেই আমার দৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে কে আমার পক্ষে কাজ করবে? কেন্দ্রেও আমার কোনো লোকজন নেই যে ওখানে গিয়ে তারা কাজ করবে। এলাকায় কেবল একজন লোক আছে, নাম হাফেজ আবদুর রহিম। তাকে কোথায় পাব? কী করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করব? আমার শ্বশুর সাহেব ঢাকায় থাকেন, আমার স্ত্রীও ঢাকায় থাকেন। আমি এ-ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি।
অধ্যাপক গোলাম আযম ও কবি মোফাখখারুল ইসলাম কারমাইকেল কলেজে ছিলেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সুনামগঞ্জ রওয়ানা হলাম। সোজা মানে-ট্রেনে রংপুর থেকে গাইবান্ধা হয়ে বাহাদুরাবাদ ফেরি পার হয়ে ময়মনসিংহ; ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে আখাউড়া, সেখান থেকে ট্রেনে সিলেট, সিলেট থেকে বাসে চড়ে সুনামগঞ্জ। এই পথ পাড়ি দিতে তখন বিরাট-বিরাট ফেরিঘাট ছিল অনেকগুলো। এভাবে কোনোমতে গিয়ে সুনামগঞ্জ গিয়ে পৌঁছলাম। রাত পোহালে একটিমাত্র দিন থাকবে নমিনেশন সাবমিট করার। তার মানে এক দিনে আমার নমিনেশন সাবমিট করতে হবে। ভেবেচিন্তে সুনামগঞ্জের মাহবুব ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তাঁর আসল নাম মির্জা গোলাম সামদানী। শুনলাম, কেবল আমার এলাকারই রেজিস্টার্ড ভোটারই নমিনেশন পেপারে প্রস্তাবক এবং সমর্থক হতে পারে। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহরে আমি কোথায় পাব আমার এলাকার ভোটার? সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর এবং ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর। এলাকায় যাওয়া-আসা করতে হয় নদীপথে নৌকা করে। তখন ইঞ্জিনবোট বলতে কিছুই ছিল না। তাহিরপুরের একজন লোক আমার পরিচিত। প্রভাবশালী একজন লোক। সম্ভবত সেকান্দার আলী ছিল তার নাম। তাঁকে বললাম, ‘আপনি আমার একটা নমিনেশন পেপারে প্রপোজার হন।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি আবদুল খালেক সাহবেকে কথা দিয়ে ফেলেছি তাঁর প্রপোজার হব। আমি দুঃখিত।’
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আগামী কালের মধ্যে নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। ভাবলাম, গয়নাঘাটে গিয়ে দেখি, যে-সময় নৌকা ছাড়বে সে-সময় আমাদের এলাকার কোনো লোক পাই কি না। গয়নাঘাটে গিয়ে পেলাম লক্ষ্মীছড়ির হোসেন বখতকে। হোসেন বখত রাজনৈতিক কর্মী। গণতন্ত্রী দলের ওয়ার্কার। আমার পেরেশানি দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার প্রফেসর সাব, এত চিন্তিত কেন? কাউকে খুঁজছেন?’
আমি তাঁকে খুব সংক্ষেপে আমার অবস্থাটা বুঝিয়ে বললাম। শুনে তাঁর কিছুটা সহানুভূতি হলো। একটা নৌকা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই নৌকায় আপনার এলাকার একজন কর্মীলোক যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই নৌকায় তাঁর বিছানা তোলা হয়েছে। একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি ওই লোক এসে পড়বে।’ সূর্য ডোবার আগেই সেই লোক এসে হাজির গয়নার ঘাটে। হোসেন বখত বললেন, ‘একে চেনেন? আপনার এলাকার লোক, অধ্যাপক শাহেদ আলী। নির্বাচনের জন্য আপনাদের এলাকায় নমিনেশন পেয়েছেন। কালকের মধ্যেই নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। তার জন্য দরকার আপনার এলাকার ভোটার, যারা প্রপোজ করবে এবং সাপোর্ট করবে। দেখেন আপনি কিছু করতে পারেন কি না।’
সেই লোক একজন তরুণ দীর্ঘদেহী দৃঢ় অভিব্যক্তির মানুষ, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তিনি বললেন, ‘আমি একজন প্রপোজার হতেই পারি, কিন্তু আরেকজন কোথায় পাব?’ এরপর একটু চুপ করে থেকে কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমাদের এলাকার কয়েকটি যুবক এখানে একটা ট্রেনিঙে এসেছে। ওরা প্রত্যেকেই ভোটার। দেখি এদের নিয়ে আসতে পারি কি না।’ তিনি আমার ঠিকানা জেনে নিলেন এবং সন্ধ্যার পরই চার জন যুবককে নিয়ে হাজির হলেন। এভাবে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সংকট থেকে পরিত্রাণ পেলাম। আমি তখন সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলাম আল্লাহর ওপর। বুঝতে পারলাম, তাঁর ইচ্ছেতেই সকল জটিলতার গিটগুলো খুলে যাচ্ছে।
পরদিন নমিনেশন পেপার সাবমিট করে কিছুটা হালকা হই। এক দিন পরই নমিনেশন পেপারগুলো স্কুটিনি হবে। স্কুটিনিতে টিকে থাকলেই এই নির্বাচনে দাঁড়ানো যাবে। এর মধ্যে প্রশ্ন ওঠে, স্কুটিনিতে আমার নমিনেশন পেপার না কি টিকবে না। কারণ আমি কলেজে চাকরি করি, আমি পদত্যাগ করিনি। পদত্যাগপত্র যে গৃহীত হয়েছে তার প্রমাণ আমার কাছে নেই। শুনে নার্ভাস হয়ে পড়লাম। এত কষ্ট করে এত দূর থেকে এসেছি। পদত্যাগ করিনি – এই যুক্তিতে স্কুটিনিতে যদি আমি আটকা পড়ে যাই, তবে আমার দুঃখের আর সীমা থাকবে না। ছোটো শহর সুনামগঞ্জের উকিল আর মোক্তার পাড়ায়ই শুধু নয়, রাজনীতিসচেতন প্রত্যেকটি মানুষের ঘরেই এ-কথা আলোচিত হতে লাগল। আমি মাহবুব ভাইকে নিয়ে কয়েকজন প্রবীণ হিন্দু উকিলের কাছে গেলাম। তাঁরাও বললেন একই কথা। আমি নমিনেশন পেপার সাবমিট করেই কারমাইকেল কলেজের প্রিন্সিপালকে রিপ্লাই পে টেলিগ্রাম করি। পরদিন সারা দিন গেল। টেলিগ্রামের কোনো জবাব এল না। আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। আমি কি হাসাহাসির পাত্র হতে যাচ্ছি? আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জনাব মকবুল হোসেন চৌধুরী, আবদুল খালেক আহমদ অভিজ্ঞ ও সুচতুর ব্যক্তি। তাঁরা এর আগে একাধিক নির্বাচনে লড়েছেন। নির্বাচনের নিয়মকানুন তো তাঁদের নখাগ্রে। পরদিন দশটায় এসডিওর এজলাসে স্কুটিনি হবে। মাহবুব ভাই মোক্তারি করেন। একজন হিন্দু উকিল, তাঁর নাম ঠিক মনে নেই, তাঁকে অনুরোধ করলাম আমার পক্ষে কোর্টে হাজির থাকতে।
তখন এসডিও ছিলেন আবদুল আজিজ সাহেব। মাদ্রাসা-পড়া লোক, পরে কলেজ পাশ করে বিএসসি পরীক্ষা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হন। একজন হোমিওপ্যাথ হিসেবেও তাঁর নাম ছিল। তিনি খেলাধুলায় ছিলেন চৌকশ। মুসলিম লীগের কঠোর সমর্থক। স্কুটিনিতে আমার নমিনেশন পেপার বাতিল হয়ে যাবে – এই বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ রইল না।
এজলাসটি লোকে লোকারণ্য। প্রথমে এসডিও সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করেন, আপনার পেশা কী?’ বললাম, ‘আমি রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করি, কিন্তু আমি টেলিগ্রাম মারফত আমার পদত্যাগপত্র সাবমিট করেছি।’
তখন আবদুল খালেক সাহেব উঠলেন। দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি এখনও চাকরিতে আছেন। আপনি যে পদত্যাগ করেছেন তার কোনো প্রমাণ নেই। আপনি নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন না।’
আমি আমার টেলিগ্রাম কপি এসডিও সাহেবকে দিলাম। এসডিও সাহেব বললেন, ‘এই ধরনের টেলিগ্রামের কোনো ভেলিডিটি নেই।’
ঠিক সেই মুহূর্তে পেশকার বললেন, ‘স্যার, এইমাত্র একটি টেলিগ্রাম এসেছে। মনে হয় ইলেকশন-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপার।’ আমি ভাবলাম, নিশ্চয় কারমাইকেল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে বার্তা পাঠিয়েছেন। এসডিও সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘যাক, বেঁচে গেলেন। হোম মিনিস্ট্রি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে। প্রাইভেট কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে-কোনো কর্মচারী নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে। আইনে কোনো বাধা নেই, তবে হ্যাঁ, নির্বাচনে জয়ী হলে পরে পদত্যাগ করতে বাধ্য থাকবেন।’
এজলাসের ভেতর একটা গুঞ্জন উঠল। খালেক সাহেব ও মকবুল হোসেন সাহেবের উকিলের মুখ কালো হয়ে গেল। এসডিও সাহেব তাঁর হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেক করার জন্য। স্কুটিনিতে আমি টিকে গেলাম।
অতঃপর কোথায় যাব? কে আমার সঙ্গী হবে? কোত্থেকে শুরু করব নির্বাচনী প্রচার? আমি কোনো পথ দেখতে পেলাম না।
ক’মাহবুব ভাই বললেন, ‘চিন্তা করছেন কেন? উপায় একটা হবেই। আজকে আমরা রেস্ট নেব। আগামীকাল নৌকা করে বের হব নদীপথে রামনগর। আদরে নির্বাচনী এলাকার পূর্বসীমানার একটি গ্রামে। ওখানে আমার পরিচিত একজন লোক আছে। একজন শিক্ষিত প্রভাবশালী লোক। নাম মোনায়েম পঞ্চায়েত। রামপুরের সাভার সাহেবের আত্মীয়। ওর বাড়িতে গিয়ে প্রথমে উঠব।’
একটা নৌকা ভাড়া করে পরদিন আমি ও মাহবুব ভাই রামনগর রওয়ানা করলাম। মনে হলো, আমি নির্বাচনের অকূল সাগরে নৌকা ভাসিয়ে দিলাম। মাহবুব ভাই সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি স্কুলে আমার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র ছিলেন। তিনি আর সাত্তার মিয়া এক ক্লাসে পড়তেন। আমাদের এই তিন জনের নেতৃত্বে সুনামগঞ্জের আজীবন মৃত মুসলিম ছাত্রসংঘ আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। আমাকেই করা হয়েছিল সেই সংঘের সেক্রেটারি। আমাদের চেষ্টায় ছাত্রসংঘের একটি লাইব্রেরি বিশাল আকার ধারণ করে। সুনামগঞ্জের মন্ত্রী মনোয়ার আলী সাহেব ও আবদুল বারী সাহেব মিলে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রচুর খাটাখাটি করেন। আসামের অ্যাসেম্বলির সদস্য আবদুল বারী চৌধুরী সাহেব এমএ এলবি ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। মাহবুব ভাই সর্বক্ষণ ছিলেন আমার সঙ্গে। ছাত্রসংঘের তহবিল গঠনের জন্য আমরা মুষ্টিভিক্ষা চালু করেছিলাম। প্রত্যেক বাড়িতে দিয়েছিলাম একটি করে মাটির পাত্র। প্রতি বেলা রান্নার সময় এক মুষ্টি করে চাল রেখে দেওয়ার জন্য। সুনামগঞ্জের ঘরে-ঘরে সাড়া পড়ে গেল। এক সপ্তাহ পরে যখন চাল সংগ্রহ করার প্রশ্ন উঠল তখন কর্মীদের অনেকেই পিছপা হয়ে গেল। চালের বস্তা তারা কী করে কাঁধে নেবে? সর্বাগ্রে আমিই এগিয়ে এলাম, বললাম, ‘আমি নেব বস্তা।’ তখন মাহবুব ভাই, সাত্তার ভাই ও আরও অনেকে এগিয়ে এলেন আমার সঙ্গে বস্তা নেওয়ার জন্য। এভাবে ত্যাগ ও সেবার মাধ্যমে মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল আমার সম্পর্ক। সহোদর ভাইয়ের মধ্যেও এমন সম্পর্ক হয় না।
ম্যাট্রিক পাশ করে গেলাম সিলেট এমসি কলেজে পড়তে। মাহবুব ভাইও তখন ওই কলেজে পড়তেন। সেখঘাটের জিতু মিয়ার বাড়ির কাছে একটা বাড়িতে তিনি জায়গির থাকতেন। সেখানে গিয়ে তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বুকে-পিঠে ব্যথা, দম ফেলতে পারেন না। আমি রাত-দিন তাঁর সঙ্গে থেকে তাঁর সেবা-যত্ন করি। মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়ে উঠল। সেই সময় থেকে মাহবুব ভাই লেখাপড়া শেষ না করেই ব্যবসায় নেমে পড়েছিলেন। কিন্তু তাতেও সুবিধা হলো না। তিনি মোক্তারি পাশ করে সুনামগঞ্জ কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু করেন। সুনামগঞ্জে তিনি রব্বানী পর্টির কর্মী ও নেতা ছিলেন। তাঁকে নিয়ে রওয়ানা হলাম রামনগর।
পঞ্চায়েত সাহেবের ঠিকানা নিয়ে তাঁর বাড়ি খুঁজে বের করলাম। তিনি মাহবুব ভাইকে চিনতেন। ধুতিপরা মাঝারি বয়সের একজন লোক। হালকা-পাতলা গাল ভাঙা, খুব নম্র কণ্ঠে কথা বলেন। আমাদের আদর-যত্ন করে বসালেন, বললেন, ‘দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। আপনারা মেহেরবানি করে খান। তারপর আপনাদের সঙ্গে কথা হবে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরগির আন্ডা ভাজি করে গরম গরম ভাত পরিবেশন করা হলো। ভাত থেকে ধোঁয়া উঠছে।
মাহবুব ভাই বললেন, ‘সাত্তার মিয়ার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি। আপনার কি দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে? দেশে যে নির্বাচন এসে গেল। এই নিয়ে কি আপনারা কিছু ভাবছেন?’
পঞ্চায়েত সাহেব বললেন, ‘শিগগিরই ইলেকশন হবে। রামনগরে মকবুল হোসেন সাহেবের কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। কয়েকটা ইলেকশনে আমরা তাঁকে সমর্থন করেছি। এবারও তাঁকে কথা দিয়েছি। আমাদের কী যায় আসে? এমএলএ-র সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্কই-বা থাকে? একজন হলেই হলো।’ মাহবুব ভাই বললেন, ‘শাহেদ ভাই এবার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইলেকশনে দাঁড়ালেন। আমরা কি আপনার কিছু সাহায্য আশা করতে পারি না?’ পঞ্চায়েত সাহেব বললেন, ‘উহ্, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন? কাজটা কিন্তু ভালো করলেন না। কলেজের প্রফেসরের কত ইজ্জত! রাজনীতির মতো নোংরামির মধ্যে তাঁর নামা ঠিক হয়নি।’
আমি চুপ করে শুনলাম তাঁদের কথাবার্তা। বললাম, ‘আপনার বাড়িতেই আমরা প্রথম নামলাম। আপনি জ্ঞানী মানুষ। আপনার কাছ থেকে কিছু আশ্বাস পেলে খুশি হতাম।’
ভদ্রলোক বললেন, ‘যান, আপনি নতুন মানুষ, আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।’ ভদ্রলোকের কথায় মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল।
এরপর আমরা রামনগরে আরও কয়েকটা বাড়িতে গেলাম। নেতৃস্থানীয় লোকদের বাড়ি। আলাপ করে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। কেবল তাঁরা জীবনে এই প্রথম একজন নতুন প্রার্থীর সঙ্গে পরিচিত হলেন। রামনগর থেকে আমার বাড়ি এত দূরে যে, অনেকে তো চিনতেও পারলেন না। জীবনে কখনও তাঁরা আমার নামও শোনেননি। আমাকে দেখেনওনি। এই গ্রামে আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তারা বলল, ‘চেষ্টা করে দেখেন, আল্লাহর মর্জি হলে সুবাতাস বইতেও পারে।’ বাতাস যে আমার জন্য একেবারেই বিপরীত – এই সম্বন্ধে তাঁরা প্রায় সকলেই একমত। তবুও একটা আশার কথা শুনলাম। আল্লাহ ইচ্ছে করলে কী না হয়!
আমরা এবার হাল ছেড়ে দিলাম। আজকে সোমবার। সাচনার হাট। এলাকার অনেক লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যেতে পারে। সমস্ত ভাটি অঞ্চলের লোক ওই হাটে আসে নৌকা ও বাঁশ কিনতে। এখানে একটি লঞ্চঘাট এবং থানা আছে। ছাতক থেকে লঞ্চ সুনামগঞ্জ-সাচনা হয়ে মারকুলি ও আজমেরীগঞ্জ ভৈরব নারায়ণগঞ্জ যায়। খবর না দিলেও সাত্তার ভাইকে অবশ্যই পাব। কেননা সাচনায় বসে তিনি হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস করেন। প্রায় তিনটার দিকে নৌকা এসে সাচনা ভিড়ল। আমরা ডাকবাংলোয় উঠলাম। ওখানে এসে শুনতে পেলাম আবদুর রশিদ নামক এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাচনার ‘নির্বাচনের জিকির তুলে’ এক নির্বাচনী দল গড়ে তুলেছেন। সাচনা থানা থেকে কেউ এর আগে কখনওই অ্যাসেম্বলির মেম্বার হয়নি। এবার সাচনা এই আসনকে তাদের দখলে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে লেগেছে। বাইশ জন লোকের এই কর্মিবাহিনী সাচনা থানার তরুণ যুবকদের নিয়ে গঠিত। তাদের মধ্যে গায়কও আছে। এদের নিয়ে রশিদ সাহেব পুরা দীর্ঘ একটি মাস সাচনার গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘরে-ঘরে প্রচার করে চলেছেন। তাহিরপুর এবং ধর্মপাশা গেছেন। খালেক সাহেব বা মকবুল হোসেন সাহেবের কারও এরকম কর্মিবাহিনী নেই। রশিদ সাহেবের বাহিনীকে বলা যায় অপ্রতিরোধ্য বাহিনী।
আমরা ডাকবাংলোয় আছি জেনে রশিদ মিয়া স্লোগান দিতে দিতে তাঁর দলবল নিয়ে এসে হাজির। শত্রুপক্ষের সঙ্গে এই প্রথম মোকাবিলা। রশিদ মিয়াকে আগে থেকে চিনতাম। তিনি সুনামগঞ্জ স্কুলের ছাত্র ছিলেন, এখন জামালগঞ্জ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। খুব সাহসী এবং কর্মঠ তরুণ। ওদের মধ্য থেকে একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার সঙ্গে তো আপনার এলাকার কাউকে দেখতেছি না। শুনলাম আপনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। আজই শুনেছি প্রথম। আমরা স্থির করেছি এবারে এ-আসনটিতে আমরা জামালগঞ্জের একজনকে নির্বাচন করব। পুরো থানা একমত। তাহিরপুর এবং ধর্মপাশাতেও আমরা কাজ করেছি। আশা করা যায় ওইসব এলাকাতেও আমাদের জনসমর্থন পাওয়া যাবে। তা আপনি কোন পার্টি থেকে দাঁড়িয়েছেন?’
মাহবুব ভাই বললেন, ‘আমাদের পার্টি একটা ছোট্ট নতুন পার্টি। আমরাই যুক্তফ্রন্টের ডাক দিয়েছিলাম। (যুক্তফ্রন্ট: মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যৌথভাবে নির্বাচন করার জন্য খেলাফতে রব্বানী পার্টি প্রথম প্রস্তাব দেয় এবং সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রতিবেদন ছাপিয়ে ব্যাপক জনমত তৈরি করে)। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্টে আমাদের টানাই হলো না। আমরা একটি আদর্শবাদী পার্টি। আমাদের এলাকায় তেমন কোনো সংগঠন নেই, কিন্তু অনেক জনসমর্থন আছে, যারা রব্বানী পর্টির প্রোগ্রামের মধ্যে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল মানুষের মুক্তির ইশারা দেখে। আমরা যুক্তফ্রন্টের বিরোধী নই। যুক্তফ্রন্ট স্বীকার না করলেও আমাদের যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল মনে করতে পারেন। যুক্তফ্রন্টকে আমরা একটা আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখতে চাই।’ মাহবুব ভাই আসন গ্রহণ করলে রশিদ মিয়ার দলের নেতৃত্বস্থানীয় একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘ক্যান্ডিডেট সাহেব চুপচাপ কেন? তাঁর মুখে আমরা কিছু শুনতে চাই। তাঁর কী পরিচিতি আছে যে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন? আগে তো তাঁকে জানতে হবে। এলাকার লোকদের সঙ্গে পরিচয় করতে হবে। কীভাবে সে-পরিচয় সারবেন।’
তখন আমি দাঁড়িয়ে দু-চার কথা বলার চেষ্টা করি, ‘এ এলাকার যাঁরা শিক্ষিত লোক তাঁরা আমাকে অবশ্য সহজেই চিনবেন। তাঁদের মুখে-মুখেই আমার নাম ঘরে-ঘরে পৌঁছতে পারে। আমি তো নিজের স্বার্থে এই নির্বাচনে দাঁড়াইনি এবং নিজের ইচ্ছেতেও নয়। আমার পার্টি জনতার ওপর তাদের কোনো মতামত চাপিয়ে দেয় না। আমি তো রংপুর কারমাইকেল কলেজে একটা সম্মানের চাকরি করতাম। ইলেকশনের কথা আমি চিন্তাও করিনি। পার্টি হুকুম দিল, তুমি তোমার নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে তোমার নমিনেশন পেপার সাবমিট করো। পার্টিই আমাকে এই আসনে এমপি পদে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। আমি সেই নির্দেশ মান্য করে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগ দুজন জাঁদরেল ক্যান্ডিডেট দিয়েছে। এঁরা একাধিকবার ইলেকশনে দাঁড়িয়েছেন, আমাদের প্রতিনিধি ছিলেন। আপনারা তাঁদের চেনেন, আপনারা আমাকে চেনেন না। আপনারা যদি মনে করেন আমার প্রার্থিতা বিবেচনাযোগ্য, তাহলে আপনারা বিবেচনা করবেন। এখানে কারও পারমানেন্ট গ্রহণযোগ্যতা নেই। যদি মনে করেন আমার পার্টি দ্বারা, আমার দ্বারা কোনো কাজ হবে, তো আপনারা সমর্থন করতে পারেন। সবই আপনাদের খুশি, জবরদস্তির কিছু নেই।’
আরেকজন উঠে বলল, ‘এ-ধরনের পার্টির নাম আগে কখনও শুনিনি। এর অর্থ কী, এ-পার্টি কী করতে চায়?’
‘রব্বানী পার্টি অনেক কিছু করতে চায়, সে অনেক কথা। এটা একটি আদর্শবাদী আন্দোলন। কোরআন-এর দর্শনের ওপর এর ভিত্তি। এ-পার্টি বিশ্বাস করে, দুনিয়ার সমস্ত সম্পদের মালিক এক আল্লাহ। সকল মানুষ ও প্রাণিকুলের এতে হক আছে। কাউকে তার নায্য হক থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আল্লাহর আসমানের আলো আমরা সকলে মিলে ভোগ করি। তার পানি-হাওয়ায় আমাদের সকলের সমান অধিকার, তেমনি তার জীবনেও রয়েছে সকল মানুষের নায্য হক। রাব্বানী পার্টি আপনাদের সহযোগিতায় সেই হক প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সুদ-ঘুষ ও শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি থেকে সকলকে মুক্ত করতে চায়। এই আন্দোলন আসলে জনতার আন্দোলন। খালিস নিয়তে এই আন্দোলনে শরিক হোন। আল্লাহ আপনাকে এ-জীবনে এবং পরবর্তী জীবনে দেবেন সুখ-শান্তি। মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের আমরা মূলোচ্ছেদ করতে চাই। এটাই রব্বানী পার্টির মিশন।’
আমি তাকিয়ে দেখলাম শ্রোতারা আমার কথা শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠছে। আমি বললাম, ‘সৎ মানুষই মানুষের আমানত পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে পারে। আমরা সেই মানুষের কাজে আছি। মজলুম জনতা অপেক্ষায় আছে। আদর্শের আগুনে জ্বলে উঠতে পারলেই পতঙ্গের মতো চারদিক থেকে নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষ ছুটে আসবে। মানুষকে ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছেন। সে বোঝে কীসে তার মঙ্গল আর কীসে তার অমঙ্গল। আমাদের বিশ্বাস, আমরা যদি সততার সঙ্গে কাজ করে যাই, তবে তার ঢেউ মানুষের অন্তরের মধ্যে লাগবেই। আমরা আশাবাদী, আল্লাহর দলের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। আমি আশা করি, এই দল আপনাদেরই দল, আপনাদের সাহায্যের দাবিদার। কারণ এ-দলে যারা, তারা সৎ রাজনীতি চায়। সকল প্রকার কুটিলতার ঊর্ধ্বে উঠে মাখলুকের খেদমতের আত্মনিবেদন করতে চায়, এ-পার্টি তাদেরই পার্টি।’
এর মধ্যে হালকা-পাতলা ছিপছিপে গড়নের এক তরুণ, মাথাভার্তি ঘনচুল, ব্যাকব্রাশ-করা, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনার কথা আমি এর আগেও শুনেছি। আছানপুর গ্রামে আমার এক আত্মীয় থাকে। ওই গ্রামে আমার এক চাচাতো বোনের বিয়ে হয়েছে। যখনই আছানপুরে যাই কথা-প্রসঙ্গে আপনার কথা ওঠে। মানুষ আপনাকে না দেখেও ভালোবাসে। রশিদ মিয়ার বয়স অল্প, জীবনে আরও সুযোগ পাবেন। কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে তা অন্যরকম। আমি আমার দলবলকে বলব আপনাকে সমর্থন করতে।’
তরুণটির নাম আবদুল মান্নান তালুকদার। বাড়ি সাচনার নিকটবর্তী দুর্লভপুর। ধোপদুরস্ত কাপড় পরনে। তার প্রস্তাব শুনে উপস্থিত সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করল।
মান্নান তালুকদার রশিদ মিয়াকে সম্বোধন করে বলল, ‘আপনাকে নিয়ে আমরা প্রায় দেড়টি মাস সাচনা, জামালগঞ্জের ঘরে-ঘরে গিয়েছি। আপনার সঙ্গী হিসেবে কাজ করেছি। মুসলিম লীগের দাপট তো আছেই, যুক্তফ্রন্টের যে-বান ডেকেছে তাতে আমরা টিকতে পারব কি না জানি না। মোকাবিলায় আমাদের প্রফেসর সাহেবকে দাঁড় করালে আমাদের কাজ সহজ হবে বলে মনে হয়।’ মান্নানের এই সাদামাটা প্রস্তাবে রশিদ মিয়ার কর্মীবাহিনী মুহূর্তের মধ্যে একটা সংকটে পড়ে যায়। মাহবুব ভাই বললেন, ‘আপনাদের সামনে আমাদের বক্তব্য রেখেছি। রশিদ মিয়া আমাদেরই প্রিয়ভাজন ব্যক্তি, তাঁকে নিয়ে সুনামগঞ্জে আমি অনেক কাজ করেছি। আমরা বলব না যে, নমিনেশন পেপার উইথড্র করুন, আপনি বিবেচনা করে দেখুন।’
মান্নান দাঁড়িয়ে বলল, ‘মির্জা সাহেব, আমাদের একটু ভাবতে দিন। আমরা নিজেদের মধ্যে একটু পরামর্শ করে দেখি। আশা করি, একটা ফয়সালায় পৌছতে পারব। আপনারা তো আজকে এখানেই আছেন।’ এ-কথা বলার পর আমি আর মাহবুব ভাই ডাকবাংলোর কক্ষে ঢুকে পড়ি। রশিদ মিয়া, মান্নান ও তাদের সঙ্গী কর্মীরা ডাকবাংলোর সামনের চত্বরে দূর্বাঘাসের ওপর বসে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মান্নান মাহবুব ভাইকে ডেকে বলল, ‘মির্জা সাহেব, আসুন আমরা ফয়সালায় এসে গেছি। আজ থেকে আমরা একজোট হয়ে কাজ করব রাব্বানী পার্টির পক্ষে। কিন্তু একটা শর্ত আছে, এ-পর্যন্ত আমাদের যে-খরচ হয়েছে এবং নির্বাচন পর্যন্ত যে-খরচ হবে সেই খরচ আপনাদেরই দিতে হবে।’
আমি আর মাহবুব ভাই বাইরে দূর্বায় ঢাকা চত্বরে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পরই সূর্যাস্ত হবে। আমি দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ যে আমাকে আপনারা চেনেন না, জানেন না, জীবনে এই প্রথম আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো, তবুও আপনারা আমার পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এজন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ জনাই। আল্লাহতাআলার প্রশংসা করি। কিন্তু আপনাদের এই শর্তটি আমি গ্রহণ করতে পারব না। প্রথমত বলা যায়, আমি একেবারে খালি হাতে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। আর আমি বিত্তবান লোক নই। আর টাকা থাকলেও নীতিগতভাবে আমি এই ব্যয় গ্রহণ করতাম না। কারণ আমি আমার নিজের জন্য নয়, আপনাদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি। আপনাদের এই কাজ যাতে করতে পারি, তার জন্য আপনাদেরই রসদ জোগাতে হবে। আমি তো দেশের একটি প্রথম শ্রেণির কলেজে অধ্যাপনা করতাম। নির্ঝঞ্ঝাট, শান্তিপূর্ণ সেই কলেজের কাজ ছেড়ে আপনাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। আপনারা যদি আমাকে দিয়ে কাজ করাতে চান তো আমাকে অ্যাসেম্বলিতে পাঠানোর দায়িত্ব আপনাদেরই, ভাটি এলাকার একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বললাম, ‘আপনারা যদি আপনাদের কোনো কাজের তদবিরের জন্য আমাকে সুনামগঞ্জ নিতে চান, তবে আপনারা কি বলবেন যে আমি দাঁড় বেয়ে সুনামগঞ্জ যাব? না কি তদবির করার জন্য আপনারাই নৌকা জোগাড় করে আমাকে নিয়ে যাবেন?’ এ-প্রশ্নের পর মান্নানই প্রথম বলল, ‘না, আমি কোনো খরচ নেব না। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে কাজ করব।’ মাহবুব ভাই মারহাবা-মারহাবা বলে উঠলেন। আমি তখন নাম ধরে একজন-একজন করে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁরা কে কী বলেন? প্রত্যেকেই মান্নানের সুর ধরে বলল, ‘আমরাও নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে নির্বাচনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ব।’ সঙ্গে-সঙ্গে তুমুল তকবির ধ্বনি উঠতে লাগল, ‘আল্লাহু আকবার, রব্বানী পার্টি জিন্দাবাদ।’
এরপর ওরা আমাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বাজারের দিকে মিছিল বের করে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে চলল, ‘আল্লাহ আকবার… রব্বানী পার্টি… মাঠভর্তি বিশাল জনতা প্রথম শুনল একটি নতুন পার্টি, একটি নতুন আন্দোলনের ধ্বনি। রব্বানী পার্টি জিন্দাবাদ। বাজারভর্তি লোকেরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
সেই দিন সাচনা থেকে রাব্বানী পার্টির আওয়াজ উঠল উচ্চকণ্ঠে। পরদিন সকালবেলা শুনতে পেলাম একদল তরুণ এসেছে গান গাইতে গাইতে, ‘জগতে থাকিলে পার্টি আছে রে রাব্বানী পার্টি’…তারপর আরও সুন্দর-সুন্দর কথা। এই কর্মিবাহিনীর একজন সদস্য নয়াহালটের আবদুস সামাদ গানটি বানিয়েছে এবং সুর দিয়েছে। ষোলো-সতেরো বছরের যুবক তারুণ্যে উৎসাহে ডগমগ। সেই দল নিয়ে তারা গান গেয়ে স্লোগান দিতে দিতে তিনটি থানায় গ্রামে, গঞ্জে, হাটে ছুটে বেড়াল। তাদের উৎসাহ এবং আবেগের উত্তাপে সারা এলাকার আরও বহু তরুণ উদ্দীপ্ত হলো। মোল্লা-মুন্সিরা সেই গানের সুরে ভিড় করে এল। ‘জগতে থাকলে খাঁটি আছে রে রব্বানী পার্টি’। এমন দাবি যারা করতে পারে তাদের উদ্দীপনা, নিষ্ঠা ও প্রত্যয় মানুষকে উত্তপ্ত না করে পারে না। নয়াহাটের মৌলবি আবুল বরকত মুসলিম লীগের সমর্থক এই গান শুনে বিস্মিত হলেন। এ কী নতুন কথা বলছে ওরা! রামপুরের সাত্তার ভাই, হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আবদুস সাত্তার মাহবুব ভাইয়ের বন্ধু। আমারও বড়ো ভাইয়ের মতো, তাঁর প্র্যাকটিস ফেলে রেখে আমাদের সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। খালেক সাহেবের পার্টি আছে, কিন্তু আমাদের মতো এত কর্মী নেই। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে যারা তাঁর দ্বারা উপকৃত হয়েছে কেবল তারাই একমাত্র সমর্থক। প্রশাসন প্রভাবিত করার মতো কর্মিবাহিনী তাঁর নেই। আর মকবুল ইসলাম সাহেব বিখ্যাত সাংবাদিক। খিলাফত আন্দোলনের জেলখাটা নেতা। তিনি যুক্তফ্রন্টের নমিনি-এই তাঁর সম্বল। তাঁর আর কোনো কিছুর দরকার নেই। তিনি বিত্তবান লোক। সুনামগঞ্জ শহরে তাঁর বাড়ি আছে। তাঁর কর্মীদের আমরা কোথাও দেখতে পেলাম না।
তিন থানায় আমাদের নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে হবে। আমাদের কোনো মাইক নেই। এলাকায় এই মৌসুমে কোনো যানবাহনের প্রয়োজন হয় না, কেবল চরণদুটি ছাড়া। বর্ষাকালে নৌকা নিয়ে এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে যাওয়া যেত। দূরে-দূরে গাঁ-ঘর পায়েহাঁটা পথ ছাড়া কোনো কাঁচা সড়কও নেই। বিশাল এলাকা জুড়ে তিনটি থানা ছড়িয়ে আছে। এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে যেতে হলে কেবল হাঁটো আর হাঁটো। রামপুরের সাত্তার ভাইয়ের ঘরে বসে আমি মাহবুব ভাই আর সাত্তার ভাই প্ল্যান-প্রোগ্রাম করি। সাচনা থানায় প্রবেশ তো করা গেছে, এখন অন্যত্র পৌছানো যাবে কী করে? কিছু লোকজনের নাম লিস্ট করলাম সাত্তার ভাইয়ের সাহায্যে। তিনি সাচনায় প্র্যাকটিস করেন, জামালগঞ্জ ও তাহিরপুরের অনেক লোকজনকে চেনেন। ধর্মপাশা এবং তাহিরপুরে কী করে খবর পাঠাই সেও এক সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। রশিদ মিয়া বললেন, ‘আমরা আমাদের দলবল নিয়ে তিন থানায় দ্রুত এক চক্কর ঘুরে আসি, তাতে আমাদের প্রচার হয়ে যাবে। অনেক লোকজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।’
এরপর শুরু হলো আমাদের যাত্রা। গ্রাম থেকে গ্রামে। মাহবুব ভাই সুখী মানুষ। তিনি আমাদের সঙ্গে তাল রাখতে পারতেন না। ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। দুর্লভপুরের মান্নান আমাদের সঙ্গ নিল, বলল, ‘আমি জয়শ্রীর আবুল হোসেনকে চিঠি দিয়েছি। বলেছি সুনইর হাফেজ আবদুর রহিমকে খবর দিতে।’ কয়েক মাস আগে, তখন বর্ষাকাল, মধ্যনগর বাজারে যেখানে বাঁশ-কাঠ বিক্রি হতো বাজারের পশ্চিম কিনারে। সেখানে এক নৌকায় বসে আবদুর রহিম নির্বাচনের কথা তোলেন। আমাকে অনুরোধ জানান, ‘আপনাকে নির্বাচনে দাঁড়াতেই হবে।’ কোনো আদর্শের কথা নয়, খালেক সাহেবকে ঠেকাতে হবে – এই হচ্ছে তার দাবি। খালেক সাহেব তো কর্মী মানুষ। সেলবরষের জমিদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেছেন। তবুও এলাকার মানুষ তাকে পছন্দ করে না। তাকে ঠেকাতে হবে এজন্য আমাকে ইলেকশনে দাঁড়াতে হবে। ঢাল নেই তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার!
আমি কী নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়াব? কে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে? স্বার্থ কী? খালেক সাহেব যে-কাজগুলো করতে পারেন আমার দ্বারা সে-কাজগুলো করা সম্ভব নয়। তিন থানাতেই কিছু দুর্নীতিপরায়ণ টাউট-বাটপারকে অর্থকরী সুযোগ-সুবিধা দিয়ে হাত করে নিয়েছেন। লম্বাবাঁক, পাটাবাঁক প্রভৃতি গ্রামে তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রভাবশালী লোকদের হাত করেছেন। তাঁরা তাঁর জন্য টাকাপয়সা লাঠিসোঁটা সবই সংগ্রহ করবে। মাফ করুন হাফিজ ভাই, আমি এ-ধরনের নির্বাচনে নামব না। আমার আছে কী যে আমি নির্বাচন করতে যাব? সেই হাফিজ আবদুর রহিমকে খবর দেওয়ার জন্য আবুল হোসেনের কাছে লোক পাঠিয়েছে মান্নান। হাফিজ আবদুর রহিমের বাড়ি ধর্মপাশা থানায়। তার গ্রামে আমার কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। শুনেছি, হাফিজ সাহেবের খালাতো ভাই মৌলবি আবদুল ওহাব মাদ্রাসায়-মক্তবে শিক্ষকতা করছেন। এলাকার শিক্ষিত প্রভাবশালী লোকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। তিনি খুব রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি। তাঁর ছোটো ভাই মৌলবি আবদুল হকও রাজনীতিসচেতন। দেশের হালচালের খবর রাখেন তিনি। আমি তখন মধ্যনগর মাইনর স্কুলে পড়ি। তখন তাঁর সংগ্রহ থেকে বেশ কয়েক বছরের মাসিক সওগাত-এর বাঁধাইকৃত কপি এনে পড়েছিলাম। রাজনৈতিক ও সাহিত্যসচেতন পরিবার তাঁর। মান্নান বলল, ‘মৌলবি আবদুল ওহাব নাকি খালেক সাহেবের সঙ্গে গলাগলি করে গাঁয়ে ঘুরেছেন। খালেক সাহেবের জন্য ভোট চাইছেন।’ ভাবলাম যাক, হাফিজ সাহেব এলে সব জানা যাবে।
এক সপ্তাহের মধ্যেই এলাকায় জানাজানি হয়ে গেল। পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই আমার দেখা পাওয়ার আগেই বিভিন্ন গ্রামে আমার নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিল। এ-বিশাল সাড়া দেখে আমি বিস্মিত হলাম।
এর মধ্যে আবুল হোসেন এসে আমাদের সঙ্গে মিলিত হলেন। মান্নান বলল, ‘প্রফেসর সাব, কী মনে হচ্ছে? তলে-তলে সাড়া পড়ে গেছে। নতুন যুগের মানুষ নতুন চায়।’ বলল, ‘জয় নতুনের জয়।’ হাফিজ আবদুর রহিম পাগলের মতো ছুটে এলেন। আমাকে পেয়ে যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলেন। বললেন, ‘ঘাবড়াবেন না, আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী।’ আমার নিজের বাড়ি তাহিরপুর থানায়, সেখান থেকে কেউ এগিয়ে এল না। পাটাবুকার গোলাম মোস্তফা ও মকবুল হোসেন কিছু দেরিতে হলেও এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। এরপর সভা-সমিতির আয়োজন হতে লাগল। আজ মধ্যনগর তো কাল বাদশাগঞ্জ, তারপর তাহিরপুর, শ্রীপুর প্রভৃতি স্থানে এক দিন পর থেমে থেমে হতে লাগল মিটিং। আমাদের কেনো মাইক নেই। আর যানবাহনের তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। চরণদুটি সম্বল করে খাল-বিল নদী-নালা পার হয়ে আমরা উপস্থিত হতে লাগলাম মিটিঙে। হাফিজ সাহেব সকলের অগ্রণী, বক্তৃতায়ও তিনি ছিলেন অগ্রগামী। লোক হাসাতেও খুবই ওস্তাদ। একদিন তাহিরপুরের জনসভায় তিনি বললেন, ‘স্যার নাজিমুদ্দীন খেতে খেতে পেটটা এরকম ডোল বানিয়েছেন যে, এখন আর তাঁর টেবিলের দরকার হয় না। পেটের ওপর কাগজ রেখেই লিখতে পারেন।’ রশিদ মিয়া হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন। মিটিঙের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল। সেদিনকার মিটিঙে সভাপতিত্ব করেন রতনশ্রীর আফতাব মিয়া, যিনি ছিলেন ইকরামের পিতা।
দেখতে দেখতে আমাদের কয়েকটি কেন্দ্র দাঁড়িয়ে গেল। মোশলঘাট, বালিজুরি, জয়শ্রী, ধর্মপাশা, সেলবরষ, জামালপুর, মধ্যনগর, বংশীকুণ্ডা, প্রভৃতি জায়গায় যুক্তফ্রন্ট ও মুসলিম লীগের পোস্টারে ছেয়ে গেছে। আমাদের কোনো পোস্টার নেই। এমদাদ ভাই ঢাকা থেকে হাতে লেখা কতগুলো পোস্টার পাঠিয়েছেন। এইগুলোই আমাদের সম্বল। সিলেট থেকে আরব আলী, মালেক আর রুহুল কুদ্দুস এসেছে নির্বাচনের কাজ করতে। আমার বন্ধু মির্জা হাবিবুর রহমান এসেছে। সে মাহবুব ভাইয়ের আপন চাচাতো ভাই, স্কুলজীবনে আমার ক্লাসফ্রেন্ড। সে এসেছে মকবুল হোসেন সাহেবের কাজ করতে।
যেসব স্থানে এই কেন্দ্রগুলো জেগে উঠল সেখানে আমি আগে কখনও যাইনি, এক মোশলঘাট ছাড়া। কেউ আমাকে চেনে না। আমিও কাউকে চিনি না। এর মধ্যে এক রহস্যজনক উপায়ে ওখানে ওসব স্থানে আমার কতিপয় সমর্থক জোট বাঁধল। তারা নিজেদের টাকা খরচ করে কর্মীদের খাওয়াদাওয়া করাতে লাগল। দল বেঁধে এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে যেতে লাগল। আমাকে সমর্থনের যুক্তি তারা নিজেই তৈরি করতে লাগল। এদের অনেকের সঙ্গে আমার আগে কখনও দেখাই হয়নি। তাদের আমি বুঝতেও পারিনি, তবুও গ্রাম জুড়ে তারা মৌমাছির মতো করে গুঞ্জন শুরু করে দিল। কান পাতলেই যেন সেই গুঞ্জন শোনা যায়।
আমাদের নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের মোটামুটি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। স্থানীয় গৃহস্থসমাজ, কিছু জেলে, বিপুলসংখ্যক বহিরাগত চাষি। এরা দু-তিন পুরুষ আগে থেকে ভৈরব, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এখানে এসে বসতি তৈরি করেছে। স্থানীয় লোকেরা এদের বলে আদিবাসী। এরা অদ্ভুত পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী। জমি থেকে কী করে ফসল আদায় করতে হয় তা ওরা জানে। নির্বাচনের সময় এরা একজন সর্দার দ্বারাই প্রভাবিত হয়। স্থানীয় লোকেরা নিজের পছন্দমতো কোনো ক্যান্ডিডেটকে সমর্থন-অসমর্থন করে। এতে স্থানীয় লোকের মতামতের প্রভাবই হয় চূড়ান্ত। সারা পূর্ব পাকিস্তানে তখন যুক্তফ্রন্টের বন্যা বইছে। বহিরাগতরা যুক্তফ্রন্ট ছাড়া কিছু বোঝে না। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো লোকজনকেও কেউ অত চেনে না। বহিরাগতদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী শিক্ষিত লোক ছিলেন, স্কুলশিক্ষক, মিয়াদ হোসেন ছিল তাঁর নাম। আমার সঙ্গে আলোচনার পর কনভিন্সড হয়ে তিনি আমাকে বললেন, তিনি আমার জন্য কাজ করবেন। তিন থানা মিলে কর্মীরা যে-জরিপ করল, তাতে বুঝতে পারলাম আমার জয়ের সম্ভাবনা ষোলো আনা। মুসলিম লীগের মুভমেন্ট খালেক সাহেবের আত্মীয়স্বজন ও তাঁর কিছু পুরোনো সমর্থকের মধ্যে সীমাবদ্ধতায় কোনো কর্মী কোথাও দেখা যায় না। তাঁর নিজ গ্রামে প্রায় সমুদয় লোক উঠেপড়ে লাগল আমার পক্ষে। সেলবরষের জমিদার আবদুল হান্নান চৌধুরী নিজে আমার পক্ষে কাজ করতে লাগলেন। তাঁর বাড়ি হলো আমার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে। হান্নান সাহেব তাঁর ঘোড়াটা দিলেন চড়বার জন্য।
এর মধ্যে খবর পেলাম, বহিরাগত এলাকায় যুক্তফ্রন্টের ঢেউ উঠেছে। মিয়াদ হোসেন তাঁর কথা রক্ষা করতে পারলেন না। দেখা গেল, সারা এলাকা শেরেবাংলা ও ভাসানীর দস্তখতযুক্ত একটি লিফলেট ছড়ানো হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান করা হচ্ছে। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার যে-সম্পর্ক তাতে আমার বিশ্বাস হলো না যে তিনি আমার বিরুদ্ধে ও-রকম বিবৃতি দিতে পারেন; আর শেরেবাংলা? তাঁর সময় কোথায়! তবুও এই লিফলেটের ফলে বহিরাগত অঞ্চলে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। কিন্তু স্থানীয় লোকদের মধ্যে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। তাদের স্লোগান উঠল – ‘আমরা যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগ বুঝি না। এবার শাহেদ আলী ভাইকেই ভোট দেব।’ নতুন-নতুন কর্মীর নাম শোনা যেতে লাগল। বালিজুড়ির মুসলিম ফতে আলী, মোমিন তালুকদার – এরা তাহিরপুরের পূর্বাঞ্চলে কাজ করছে। রশিদ মিয়ার পার্টির লোকেরাও তাদের সঙ্গে গাঁয়ে-গাঁয়ে যাচ্ছে। মুসলিমের বাবা বৃদ্ধ হাফিজ এলাহি তালুকদার করঙ্গীয়া এলাকায় থাকতেন। সেই অঞ্চলে তিনি বুড়ো বয়সে কাজ করছেন। মোহনগঞ্জ থানায় থানায় চদ্রপুরের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হাজি রবিউল্লাহ তাঁর পরিচিত মহলে কাজ করছেন। ধর্মপাশা অঞ্চলটি তাঁর এলাকার সঙ্গে লাগালাগি। মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা ও কলমাকান্দাসহ সীমান্ত অঞ্চলের বহু লোক চিড়া-মুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে বাড়িঘর ছেড়ে আমার পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করতে। এদের মধ্যে অনেকে আমার এলাকার লোকজনের আত্মীয় খেশ-কুটুম। তারা নিজ-নিজ পন্থায় এলাকার ইনডিভিজুয়াল ভোটারদের বোঝাতে লাগল। এভাবে অনেক অপ্রত্যাশিত মহল থেকে এই সমর্থনে আমি অভিভূত হয়ে পড়ি। সেলবরষ গ্রামে একটি জনসভা হয়, তাতে পার্টি প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান জনাব আবুল হাশিম এবং পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জনাব এ এস এম মুফাখার ঢাকা থেকে এসে মিটিঙে যোগদান করেন। হাশিম সাহেবের বক্তৃতা শুনে খালেক সাহেব বললেন, ‘বোঝা গেল এরা যুক্তফ্রন্টের বিরোধী। এ-কথা লোকদের বোঝাতে হবে।’ মুসলিম লীগের প্রার্থী ভাবলেন, এ একটা মওকা পাওয়া গেছে। যুক্তফ্রন্টের বিরোধী হিসেবেই এদের ঘায়েল করতে পারব।
গুলহার মজিদকে আগেই চিনতাম। সে কাজের দায়িত্ব পেয়েছে মধ্যনগর পশ্চিম অঞ্চলের। মহেশখলা থেকে শুরু করে দক্ষিণের মোহনগঞ্জের সীমানা পর্যন্ত পূর্বে জামালগঞ্জের সাচনা, রামনগর, কলকাতা, বিছনা, ফেনারবাগ, মুষলঘাট পুরো এলাকাটা হেঁটে জরিপ করলাম। পায়ের গোড়ালিতে ফোসকা পড়ে এমন অবস্থা হলো যে, জুতা পায়ে দিতে পারি না। তাহিরপুরের পূর্বাঞ্চলের বালিজুড়ি, বাদল, বাদাঘাট, কাউদকান্দি, শ্রীপুর, গোলকপুর হয়ে একদিন এলাম আমার নিজের বাড়িতে। দেড় মাসের মধ্যে এই প্রথম। আম্মা আমাকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। মুখ খুলে কিছু বললেন না। কিন্তু বোঝা গেল তিনি আমাকে দেখে খুব কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু তার পরও মাত্র এক দিন বাড়িতে থেকে আবার বেরিয়ে পড়লাম। শুনতে পেলাম জয়শ্রীর আবুল হোসেন সারা এলাকা একাই সফর করে বেড়াচ্ছে। কারণ হেঁটে তার সঙ্গে কেউ পারে না। আজ যদি তাকে দেখা গেল জয়শ্রীর বাজারে তো কাল তাকে দেখা যাবে ধর্মপাশা বাজারে। আর বিকেলে বাদশাগঞ্জ হয়ে মধ্যনগর। পরদিন তাকে দেখা গেল তাহিরপুর, বাদাঘাট। লোকে অবাক হয়ে গেল তার কাণ্ডকারখানা দেখে। এত উদ্যম, এত গতি সে কী করে পেল! বলা যায়, আবুল হোসেনই আমাকে নির্বাচনে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। আর এখন পার করবার দায়িত্ব তো তারই।
সেলবরষ গ্রামে মোস্তফা কামালের বাড়িতে ছিল আমার একটা আড্ডা। আরেকটি আড্ডা ছিল জামালপুরের লালমিয়া হাজির বাড়িতে। সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখলাম, কাদের মিয়া সেলবরষের একদল ছেলেদের নিয়ে মিছিল করছে। মিছিল শেষে আমাকে নিয়ে ছেলেদের বোঝাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী কাজ করার আদেশ দিচ্ছে।
মৌলবি আবদুল ওহাব, যিনি খালেক সাহেবের পক্ষ ছেড়ে আমার পক্ষে কাজ করার জন্য নেমেছেন, তিনি একদিন আমাকে বললেন, ‘খালেক সাব বাড়ি-বাড়ি গিয়ে লোকজনের পায়ে ধরছেন। মেয়েদের সালাম জানাচ্ছেন আর ভোট ভিক্ষা করছেন। এতে আমাদের সমর্থকরা তাঁর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আপনাকেও বাড়ি-বাড়ি যেতে হবে।’
আমি অবাক হলাম। বললাম, ‘ভাইসাব, এসব আমার দ্বারা হবে না। আমার দ্বারা সম্ভবও নয়। ইলেকশনে একটা ভোটও যদি না পাই তবুও আমি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে, মানুষের পায়ে ধরে ভোট ভিক্ষা করতে পারব না। আপনার গ্রামের লোকদের জড়ো করেন, যেখানে একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে পুরুষেরা থাকবে। আমি তাঁদের উদ্দেশে কী করতে চাই সে-সমন্ধে দু-চার কথা বলব। এর চেয়ে বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
সেই যে নৌকায় করে সুনামগঞ্জ থেকে রামনগর গিয়েছিলাম, সে-সময় নৌকা ভাড়া দিয়েছিলাম কুড়ি টাকা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত এক পয়সাও খরচ করিনি। নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এসেছে। কর্মীরা ও সমর্থকেরা যে যা পারছে নিজ থেকে খরচ করছে। আর আমি আমার পায়ের ওপর ভরসা করে সারা এলাকা ছোটাছুটি করছি। হাফিজ আবদুর রহিম আছে আমার সঙ্গে। যেখানে যাই দু-চারজন সঙ্গী জুটে যায়। তাদের নিয়েই আবার সফর শুরু করি। চকিয়াপুরের শামছউদ্দিন তখনও কলেজের ছাত্র। সে চকিয়াপুর ও রাজাপুর অঞ্চলে নিজ থেকে কাজের দায়িত্ব নেয়। আমার বাড়ি যদিও তাহিরপুর থানায়, তবুও তাহিরপুরে আমার কোনো পরিচিতি নেই। তাহিরপুরের লোকেরা আমাকে ধর্মপাশার লোক বলে মনে করে। নির্বাচনের পর দেখা গেল তাহিরপুর আর জামালগঞ্জ থেকে আমি ভোট পেয়েছি কম। কিন্তু ধর্মপাশা থানার বেশিরভাগ ভোট পড়েছে আমার পক্ষে। ধর্মপাশার ভোটারের সংখ্যা ওই দুই থানার ভোটার সংখ্যার কাছাকাছি। নির্বাচনের দিন আমি ছিলাম জয়শ্রী সেন্টারে। ওখানে শুনলাম, ধর্মপাশার আবদুল সোবহান চৌধুরী আমার বিরুদ্ধে লোকদের বোঝাচ্ছে। সোবহান চৌধুরীরা তিন ভাই। বড়ো ভাই তোতা আলী তালুকদার, মধ্যম ভাই মারাজের বাপ আর কনিষ্ঠজন আবদুস সোবহান চৌধুরী। এই সোবহান চৌধুরী আবার খালেক সাহেবের দীর্ঘদিনের বন্ধু। তারা এখনও একসঙ্গে চলাফেরা করে। তার দায়িত্ব সে কতটা গুরুত্ব দিয়ে করে তা আমি বুঝি। আবুল হোসেনকে দেখলাম আমাদের ক্যাম্পের সামনে বসেছেন পান-সুপারি নিয়ে। তিনি ভোটারদের পান-সুপারি দিচ্ছেন।
জয়শ্রী থেকে গেলাম সুনামগঞ্জ। ভোট কাউন্টিং হবে। এসডিও আবদুল আজিজ সাহেব রিটার্নিং অফিসার। ভোট গণনার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর চেহারার একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম। তিনি আশা করতে পারেননি যে নির্বাচনে মুসলিম লীগ হেরে যেতে পারে। তারপর যখন ভোট গণনা শেষ হলো তখন তিনি ইজি চেয়ারে কাত হয়ে শুয়ে গেলেন। তিনি আশাও করতে পারেননি যে আমি অপরিচিত একজন লোক হয়ে এত ভোট পেয়ে নির্বাচনে জয়ী হব। আমার যে গুটিকয়েক সাপোর্টার সেখানে উপস্থিত ছিল তারা কোর্ট-প্রাঙ্গণে ধ্বনি তুলল, ‘রব্বানী পার্টি জিন্দাবাদ, অধ্যাপক শাহেদ আলী জিন্দাবাদ।’
এরপর কয়েক দিন ধরে দেশ-বিদেশের রেডিওতে প্রচারমাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা হতে লাগল। বিভিন্ন পার্টির বিজয়ী সদস্যদের সংখ্যা ঘোষিত হবার পর সর্বশেষ সংখ্যাটি হলো: খেলাফতে রাব্বানী পার্টি – ১। সন্ধ্যার পরে সুনামগঞ্জ শহরে মিছিল বের হলো রব্বানী পার্টির উদ্যোগে। মিছিলে অনেক লোক হয়েছিল। মিছিলের পুরো ভাগে ছিল শায়েরউজ্জামান চৌধুরী, যার ডাক নাম ছিল শারন। সে জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দ্বিতীয় সন্তান। সে তখন সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র। তকবির ধ্বনির সঙ্গে ‘রব্বানী পার্টি জিন্দাবাদ’ মুখরিত হলো সুনামগঞ্জ শহর। লোকে অবাক হয়ে শুনতে লাগল সেই বিচিত্র স্লোগান।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024