নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে
[চিঠি লেখা একটা সময়ে ‘সাহিত্য’ ছিল; এখন তো তেমন কেউ আর কাউরে চিঠি লেখে না, পারসোনাল লেভেলে ‘লাভ লেটার’ বা ‘প্রেম পত্র’ কিছুটা চালু থাকতে পারে, কিনতু সেইটার ‘সাহিত্য মর্যাদা’ও মোটামুটি ‘বাতিল’ হইতে পারছে; ইমেইলে ঠিক চিঠি-লেখার অই ইমোশন নাই বা থাকে না, বরং যে কোন আলাপের ‘স্ক্রিনশট’ ফাঁস হওয়ার ভিতর দিয়া ‘বেইজ্জতি’ হওয়ার চান্স এখন অনেক বেশি, মানে, এইসব জায়গাতে আগের দিনের কনভারসেশন বরং রিটেন ফরমেটে চলে আসছে… যা-ই হোক, আগে রাইটার’রা কবি-সাহিত্যিকরা যখন চিঠি লিখতেন, সেইটা পুরাপুরি পাবলিক-ঘটনা না হইলেও উনাদের মনে এই ধারনা থাকার কথা যে, কোন সময় এই চিঠি ছাপানো হইতে পারে; চিঠি পারসোনাল জিনিস-ই, কিনতু সেইটার ‘ঐতিহাসিক’ গুরুত্বও তৈরি হইতে পারে, ফিউচারে… চিঠি-লেখাতে এইরকম একটা জায়গা ছিল, বা থাকার কথা একভাবে
তো, এই জায়গা থিকা নজরুলের ৮৮টা চিঠি ছাপা হইছে বা পাবলিক ডেমোইনে এভেইলেবল আছে; এর মধ্যে কিছু জিনিস অফিসিয়াল-লেটার বা পত্র-সাহিত্যই, যা পত্রিকার সম্পাদক বা সভা-সমিতির আয়োজকদেরকে লেখছেন; তবে সবচে বেশি চিঠি লেখছেন কাজী মোতাহার হোসেনকে (অবশ্য চিঠি-তে ফজিলাতুন্নেসা’র কথাই লেখছেন অনেক); ইয়াং-কবিদেরকে কিছু চিঠি লেখছেন; আর সুন্দর দুইটা চিঠি লেখছেন শামসুরনাহার’কে, অইগুলা অনেকটা ‘পত্র-সাহিত্য’; আর এর বাইরে ‘প্রেমপত্র’ বা ‘ঐতিহাসিক গুরুত্ব’ আছে হইতেছে ফজিলাতুন্নেসা ও উনার প্রথম বউ নারগিস আসরার খানম’রে লেখা চিঠি দু্ইটার।
এই দুইটা চিঠি এইখানে রাখা হইলো।]
…
১৯২৮
[মিস ফজিলতুন্নেসাকে]
১১, ওয়েলেসলি স্ট্রিটে
সওগাত অফিস
কলিকাতা
শনিবার, রাত্রি ১২টা
আজ ঈদ। ঈদ মোবারক।
অসহায় হইয়া আপনার নিকট এই পত্র লিখিতেছি। যদি বিরক্ত করিয়া থাকি, মার্জনা করিবেন। আজ ১৪ দিন হইল মোতাহার সাহেবের কোনো চিঠি পাই নাই। তাহার শেষ চিঠি পাইয়াছি ১০ই মার্চ। তাহার পর আমি তাহাকে দুইখানা পত্র দিয়াছি ১০ই ও ১৮ই মার্চ। আজো কোনো উত্তর না পাইয়া ছটফট করিতেছি। জানি না তিনি ঢাকায় আছেন কি না, না অসুখ করিয়াছে–কত কি মনে হইতেছে। আপনার শারীরিক সংবাদটুকুও তাহার মারফতই পাইতাম। বড় উদ্বিগ্নে দিন কাটাইতেছি।
আপনি যদি দয়া করিয়া – জানা থাকিলে আজই দু লাইন লিখিয়া তাঁহার খবর জানান, তাহা হইলে সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকিব।
তিনি আমার ঐ চিঠি দুইখানা পাইয়াছেন কি-না জানেন কি? তিনি কি আমার উপর রাগ করিয়াছেন? না অন্য কারণ? জানা না থাকিলে জানাইবার দরকার নাই।
আমি সওগাতের লেখা লইয়া বড় ব্যস্ত আছি। কলিকাতায় আরো দুই চারিদিন আছি। পত্র সওগাতের অফিসের ঠিকানাতেই দিবেন।
আপনার শরীর খুবই অসুস্থ দেখিয়া আসিয়াছিলাম। কেবলি মনে হয়, যেন আপনার শরীর ভালো নাই। দুদিনের পরিচয়ের এতো বড় আস্পর্ধাকে আপনি হয়তো ক্ষমা করিবেন না, তবু সত্য কথাই বলিলাম।
– আপনাকে দিয়া বাংলার অন্তত মুসলিম নারী-সমাজের বহু কল্যাণ সাধন হইবে – ইহা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই আপনার অন্তত কুশল সংবাদটুকু মাঝে মাঝে জানিতে বড্ডো ইচ্ছা করে। যদি দয়া করিয়া দুটি কথায় শুধু কেমন আছেন লিখিয়া জানান – তাহা হইলে আমি আপনার নিকট চির-ঋণী থাকিব। আমার ইহা বিনা অধিকারের দাবি।
আমি এখন বেশ ভালোই আছি। আর একটা কথা। আপনি বার্ষিক সওগাতের জন্য একটি গল্প দিয়াছেন ‘শুধু দুদিনের দেখা’ শীর্ষক। সওগাত সম্পাদক আমায় তাহা দেখিয়া দিতে দিয়াছেন। কিন্তু আপনার অনুমতি ব্যতীত তাহার একটি অক্ষর বদলাইবারও সাহস নাই আমার, আমি লেখাটি পড়িয়াছি। যদি ধৃষ্টতা মার্জনা করেন – তাহা হইলে আমি উহার এক-আধটু অদল-বদল করিয়া ঠিক গল্প করিয়া তুলিবার চেষ্টা করি। সামান্য এক আধটু বাড়াইয়া দিলেই উহা একটা ভালো গল্প হইবে। অবশ্য এ স্পর্ধা আমার নাই যে আপনার লেখার তাহাতে কিছুমাত্র সৌন্দর্য বা গৌরব বাড়িবে।
মনে হয় গল্পটা বড্ডো তাড়াতাড়ি লিখিয়াছেন। উহা যেন আপনার অযত্ন-লালিতা।
অবশ্য আপনার অসম্মতি থাকিলে যেমন আছে তেমনটা ছাপিবেন সম্পাদক সাহেব। আপনার অমত থাকিলে স্পষ্ট করিয়া লিখিবেন, কিছু মাত্র দুঃখিত হইব না তাহাতে।
আর আমার লিখিবার কিছু নাই। আপনার খবরটুকু পাইলেই আমি নিশ্চিত হইতে পারিব।
হাঁ আর একটি কথা। আমার আজ পর্যন্ত লেখা সমস্ত কবিতা ও গানের সর্বাপেক্ষা ভালো যেগুলি সেগুলি চয়ন করিয়া একখানা বই ছাপাইতেছি ‘সঞ্চিতা’ নাম দিয়া। খুব সম্ভব আর এক মাসের মধ্যেই উহা বাহির হইয়া যাইবে।
আপনি বাংলার মুসলিম নারীদের রানী। আপনার অসামান্য প্রতিভার উদ্দেশে সামান্য কবির অপার শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ ‘সঞ্চিতা’ আপনার নামে উৎসর্গ করিয়া ধন্য হইতে চাই। আশা করি এজন্য আপনার আর সম্মতিপত্র লইতে হইবে না। আমি ক্ষুদ্র কবি, আমার জীবনের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ফুলগুলি দিয়া পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করা ব্যতীত আপনার প্রতিভার জন্য কি সম্মান করিব?
সুদূর ভক্ত কবির এই একটি নমস্কারকে প্রত্যাখান করিয়া পীড়া দিবেন না — এই আমার আকুল প্রার্থনা।
দুই একদিনের মধ্যেই আমার লেখা সব বইগুলি পাঠাইয়া দিব আপনায়। আপনার মতো বিদূষী মহিলার পড়ার তাহার উপযুক্ত নয়, তবু দিব। আপনার আঙিনায় season flower-এর গাছ দেখিয়াছিলাম যেন। তাহারও তো যত্ন নেন দেখিয়াছি। সুতরাং আমার লেখাও ফেলিবেন না, ভরসা করি।
একটু কষ্ট করিয়া আজই পত্র দিবেন। আপনার ভগ্নিদেরে ও ভাইকে স্নেহাশিস দিবেন।
ইতি –
নজরুল ইসলাম
[বলা বাহুল্য, ফজিলতুন্নেসা (১৯০৫-১৯৭৭) এই চিঠি উত্তর দিছেন, এইরকম কোন তথ্য পাওয়া যায় না।]
…
দু্ই.
[১৯২১ সালে নজরুল ইসলামের সঙ্গে নার্গিস আসার খানম ওরফে সৈয়দা খাতুনের বিয়া হয়। বিয়ার রাতেই কাজী নজরুল ইসলাম শ্বশুড়বাড়ি থিকা চলে আসেন, আর কখনো ফিরা যান নাই নারগিসের কাছে। নজরুল ১৯২৪-এ প্রমীলাকে দেবীরে বিয়ে করেন। নারগিস এর মধ্যে নজরুলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন,২-৩টা চিঠিও লেখেন; অই চিঠিগুলার একটার প্রতি-উত্তর হইতেছে নজরুলের এই চিঠি।]
১৯৩৭
106 Upper Chitpur Road
Gramophone Rehearsal Room
Calcutta
1.7.37
কল্যাণীয়াসু!
তোমার পত্র পেয়েছি – সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি করছিল। পনর বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল তা তুমিও হয়তো স্বরণ করতে পার। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীবাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়। এই আষাঢ় আমার কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।
তুমি বিশ্বাস কর, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাক, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে আর তা মিথ্যা।
তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি – তা দিয়ে তোমার কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না — আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণ-রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির-অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি।
তুমি ভুলে যেও না, আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর, কুৎসিত সাধনা আমার নয়। আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জানো বা শুনেছো, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।
আমি কখনো কোনো ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তাঁর ‘সেতু’ কোনো লোক তো নয়ই-স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কি না সন্দেহ। আমায় বিশ্বাস কর, আমি সেই ‘ক্ষুদ্র’দের কথা বিশ্বাস করিনি। করলে পত্রোত্তর দিতাম না। তোমার উপর আমার কোনো অশ্রদ্ধাও নেই, কোনো অধিকারও নেই – আবার বলছি। আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরে’র সেবা করছি, তবুও কোনো কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমার কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি – তাদের প্রতি আঘাত করিনি।
সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালোবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা ক্ষমা করেছিল। নইলে তাদের চিহ্নও থাকত না এ পৃথিবীতে। তুমি আমায় জানবার যথেষ্ট সুযোগ পাওনি, তাই এ কথা লিখেছ। যাক তুমি রূপবতী, বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আমি কোনো অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দেব? নিষ্ঠুরা নিয়তি সমস্ত অধিকার থেকে আমায় মুক্তি দিয়েছেন।
তোমার আজকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয়-বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণদেবীর মতোই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ।… জীবনভরে সেইখানেই চলেছে আমার পূজা-আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা, ব্যর্থ, তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়তো সে রূপ দেখে বঞ্চিত হবো, অধিকতর বেদনা পাব,- তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।
দেখা? না-ই হলো এ ধূলির ধরায়! প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় স্নান, দগ্ধ হতশ্রী। তুমি যদি সত্যই আমায় ভালোবাসো, আমাকে চাও, ওখানে থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সেনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো তা হলে তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে? তারি মায়া স্পর্শে তোমায় সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে। দুঃখ নিয়ে একই ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয় না। মানুষ ইচ্ছে করলে সাধনা দিয়ে তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল-রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাকো জীবনে এই জীবনেই তার সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ, মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান। নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো। স্বয়ং বিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাতে অতিক্রম করে ঊর্ধ্বলোকে – সেখানে গেলে পৃথিবীর সকল অসম্পূর্ণতা সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা দেয়।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগেকার কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার অরে্যাগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি। মনে হয় যেন কালকার কথা। মহাকাল সে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলে না। কী উদগ্র অতৃপ্তি; কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল! সারা দিনরাত আমার চোখে ঘুম ছিল না।
যাক – আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষ রশ্মি ধরে ভাঁটার স্রোতে। তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস কর, আমার অক্ষয় আশীর্বাদী কবচ তোমার ঘিরে থাকবে। তুমি সুখী হও, শান্তি পাও-এই প্রার্থনা। আমার যতে মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি ততো মন্দ নই-এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ। ইতি –
নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম
P.S. আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিলো।
ইতি–
‘Gentleman’
[এই চিঠির পরে কলকাতায় নজরুলের সাথে করতে গেছিলেন নারগিস। দেখা করার পরে ১৯৩৮ সালে নজরুলের কাছ থিকা ডিভোর্স নিয়া কবি আজীজুল হাকিম’রে (১৯০৮-১৯৬৭) বিয়া করেন নারগিস। (বিয়ার আগে নারগিসরে নজরুল আরেকটা ছোট্ট,করুন চিঠি লেখছিলেন বইলা জানা যায়।) আজীজুল হাকিম নজরুলের ‘গুন-মুগ্ধ’ জুনিয়র-পোয়েট ছিলেন। ১৯৪০ সালে, ঢাকায় আজীজুল হাকিমের বাসাতেই তিনজনের একবার দেখা হইছিল বইলা জানা যায়।
১৯৪২ সালে নজরুল মানসিক-ভাবে অসুস্থ হয়া পড়েন। মারা যান ১৯৭৬ সালে, ঢাকায়। নারগিস আসরার খানম (১৯০৪-১৯৮৫) ইংল্যান্ডে মারা যান।
এইখানে খেয়াল করার মতো ঘটনা হইতেছে, নারগিস কিনতু রাইটার ছিলেন, বেশ কয়েকটা বই ছাপা হইছিল উনার, যার মেনশন নজরুলের এই চিঠিতেও আছে; তো এর ‘সাহিত্য-মূল্য’ যা-ই থাক,’ঐতিহাসিক গুরুত্ব’ বিবেচনায় এর খোজ-খবর করাটা দরকারি কাজ হইতে পারে আসলে।]
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024