নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭)
মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসাবে ‘জীবন থেকে নেয়া’রে (১৯৭০) যতোটা হাইলাইট করা হয়, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র (১৯৬৭) কথা ততোটা শুনবেন না। অথচ যদি সোশ্যাল ইমপ্যাক্টের কথা চিন্তা করেন, সিরাজউদ্দৌলা ম্যাস লেভেলে ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার’ আইডেন্টিটিটা ছড়ায়া দেয়ার কাজটা করছিল। যেইখানে একটা মিডল-ক্লাস অডিয়েন্সের বাইরে ‘জীবন থেকে নেয়া’ যাইতে পারারই কোন কারণ নাই, এর এসথেটিক এপ্রোচের কারণেই। কিন্তু বাংলাদেশের সিনেমার রিডিং-এ এইটারে আমরা বানাইছি ‘মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা’ আর ‘সিরাজউদ্দৌলা’র কোন নাম-গন্ধও নাই।
/আ ক্রিটিকাল হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশি সিনেমা, ২০২২
১. মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা
১৯৬৭ সালের ১২ই জানুয়ারি রিলিজ হওয়া খান আতাউর রহমানের “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” (১৯৬৭) যে ‘মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা’ – এই রিকগনিশন কোথাও পাইবেন না! ১৯৬৭ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’র ধারনা তো ক্লিয়াললি ভিজিবল হইতে পারে নাই, কিনতু পুরা সিনেমা জুইড়া দেখবেন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নিয়া প্যাশোনেট কথা-বার্তা। এমনকি সিনেমা শুরু-ই হইছে ‘দেশপ্রেমের’ গান – “ও আমার জন্মভূমি মাগো মা…” দিয়া; এবং এই ‘দেশপ্রেম’ পুরাটাই ‘বাঙালির’ এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদে’ ভরপুর; পুরা সিনেমাতে পাকিস্তান শব্দটাও কোথাও পাইবেন না। তারপরও এই সিনেমারে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের পুর্ন-জাগরনের’ মুভি বইলা ভাবতে না পরার কতোগুলা কারন তো আছেই।
এক নাম্বার ঘটনা হইতেছে, যেইটা বলতেছিলাম, তখনকার কনটেসকটে তো ইনডিপেনডেনসের কোন ক্লেইম নাই বা ছিল না, বরং ব্রিটিশ-বিরোধি মুভমেনটে পুব-বাংলাও শামিল ছিল – এইরকম একটা হিস্ট্রিকাল ক্লেইমই ছিল। এই সিনেমারে তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি থ্রেট হিসাবে দেখা তো হয়-ই নাই, বরং এই সিনেমা উর্দু-ভার্সনেও রিলিজ দেয়া হইছিল একইসাথে পশ্চিম পাকিস্তানে, এবং ৩২ সপ্তাহ ধইরা চলছিল। দুইটা ন্যাশনাল (নিগার) এওয়ার্ডও পাইছিল মনেহয়। মানে, হিট-সিনেমা ছিল একটা! এখন যেই সিনেমা পাকিস্তানে ‘নিন্দনীয়’ হইতে পারে নাই, সেইটারে ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ ঘটনা হিসাবে রিড করবো কেমনে আমরা! এইটাই হইতেছে ফ্যাক্টচুয়াল ডিলেমাটা।
মানে, এই যে হিস্ট্রিকাল ভিউ-পয়েনট থিকা আমরা দেখি, সেইটারেই প্রবলেমেটিক মনে করি আমি। ১৯৪৭’র পর থিকা পুব-পাকিস্তান কখনোই একটা কনফেডারেশনাল স্টেইট হওয়ার দাবি ছাড়ে নাই, ১৯৫৪’র ইলেকশনে যুক্তফ্রন্ট যে জিতলো এবং মুসলিম লীগ নাই হয়া গেলো, সেইটার কারনও ছিল যে পুব-পাকিস্তানরে অনেক কিছু আলাদা কইরা দিতে হবে, এবং এরই পলিটিকাল মেনিফেস্টশন হইতেছে এই সিনেমা। তখন ১৯৬৬’র ছয় দফাও চলে আসছে, যেই জায়গাতে এই সিনেমা ‘বাঙালি’ আইডেনটিটিরে শেইপ-আপ করার কাজটা করছে, পলিটিকালি। এই জায়গাটা নিয়া ডাউট করাটা মোটামুটি ইমপসিবল-ই হবে আসলে।
সেকেন্ড হইতেছে, খান আতাউর রহমান নিজে; যিনি মুক্তিযুদ্ধের পরে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ (১৯৭৩) [যেইটা এখন বাংলাদেশে আন-অফিসিয়ালি নিষিদ্ধ] সিনেমা বানায়া মুক্তিযুদ্ধের ইনডিয়ান-নেরেটিভ’টারে বিপদে ফালায়া দিয়া ‘বির্তকিত’ হয়া উঠছেন! তো, উনারে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ একজন সার্পোটার হিসাবে দেখলে তো বিপদ! এইটার কনট্রিবিউশনও এইখানে আছে।
থার্ড হইতেছে, এইটা তো যাত্রা-সিনেমা! মানে, বাংলাদেশি সিনেমা আসলে শুরু-ই হইছে ‘রূপবান’ (১৯৬৫) থিকা; যেইটা গেরামের যাত্রা’র একটা সিনেমা-এডাপশন; তখনকার সময়ে ‘আধুনিক’ হইতে চাওয়ার বিপরীতে এইগুলা তো ‘কুসংস্কারচ্ছন্ন’ ঘটনা, এবং কোনভাবেই ‘আর্ট’ হয়া উঠার যোগ্য না – এই নেরেটিভ এখনো খুবই স্ট্রং, যার ফলে ‘সিরাজউদ্দৌলা’ও যেহেতু যাত্রা-পালা হিসাবে পপুলার ছিল, তারে ‘সিনেমা’ হিসাবে ‘স্বীকৃতি’ দেয়াটাই তো টাফ! এখন না হয় ‘অরিয়েন্টালিজম’ শিখার পরে নাম নিতে রাজি হইতে পারি আমরা, সেইটা তো কয়দিন আগেও পসিবল ছিল না আসলে।
তো, এইসব কারনে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মোটামুটি সব এলিমেন্ট থাকার পরেও ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ একটা সিনেমা হইতে পারে নাই। এই না হইতে পারাটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’রে ন্যারোই কইরা রাখছে একদিক দিয়া। যা-ই হোক, সেইটা যতটা না সিনেমার আলাপ, তার চাইতে পলিটিকাল ঘটনা বইলা এইখানে থামতেছি। কিনতু যেকোন আর্টের আলাপই পলিটিকাল আলাপের বাইরের ঘটনা না আসলে।
২. সিনস ও সিগনিফিকেনস
“বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব!, তুমি বলেছিলে এই ইস্ট ইনডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের কিছুতেই প্রশয় দিও না, তুমি বলেছিলে সুযোগ পেলেই তারা এই দেশ কেড়ে নেবে। আমি তাদের প্রশয় দেবো না, আমি বেঁচে থাকতে তোমার রাজ্যে তারা দুর্গ তৈরি করতে পারবে না, আর সৈন্য সমাবেশে সক্ষম হবে না! আমার জন্যে, দেশের জন্যে দারুণ দুশ্চিন্তা নিয়ে তুমি চলে গেছো। তাই বুঝি তোমার এই নিষ্ঠ আহবান! তোমার অন্তিম সময়ে, তোমার মসনদ স্পর্শ করে যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম, আমরণ আমি তা পালন করবো। তুমি শান্ত হও, প্রসন্ন হও! দাদু সাহেব, নবাব আলিবর্দি খাঁ।”
/নবাব সিরাজউদ্দৌলা
সিনেমার কিছু ঘটনা নিয়া কয়েকটা কথা বলি:
১. সিনেমার শুরু’র সিন হইতেছে এক ইংরেজ ঘোড়ার পিঠে বইসা এক কৃষকরে চাবুক দিয়া পিটাইতেছে; এবং ইংরেজ ইংলিশ এবং উর্দু/হিন্দিতে কথা বলে, বাংলায় কথা কইতে পারে না বা কয় না; তখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা অই ইংরেজরে খুন করেন এবং বলেন যে, অত্যাচারীর অত্যাচার যদি সীমা ছাড়ায়া যায় তাইলে তারে খুন করা জায়েজ। এইভাবে একটা ‘আদার’রে আইডেনটিফাই করার ভিতর দিয়া নেশনালিজমের শুরু হয়।
২. কেটাগরি হিসাবে ইনডিয়ান-বাংলা সিনেমার চাইতে বাংলাদেশি সিনেমার একটা ডিফরেনশিয়েট পয়েনট হইতেছে – ঘোড়া; ইনডিয়ান বাংলা সিনেমায় ঘোড়া তেমন পাইবেন না, বা রেয়ার; কলকাতার হিস্ট্রিকাল মুভিও নাই তেমন; কারন কলকাতার হিস্ট্রি শুরুই হইছে ইংরেজ-আমল দিয়া, যার ফলে হিস্ট্রিতে এর আগে যাইতে গেলে সেন্টার হিসাবে বাংলাদেশে চইলা আসতে হয়; পুব-পশচিম ভাগ করা যায়-না না, এর আগে পশচিম বইলাই কিছু থাকে না; এই কারনে ইনডিয়ান বাংলায় হিস্ট্রিকাল-মুভি নাই, ঘোড়া নাই; মোটামুটি সবই ‘মধ্যবিত্ত সামাজিক সিনেমা’। এর বিপরীতে বাংলাদেশের হিস্ট্রিকাল (এবং টু সাম এক্সটেন্ড ওয়েস্টার্ন) মুভি থাকাটা বাংলাদেশি-সিনেমার ‘দুর্বলতা’ না, বরং এই জনরা’টারে নানান ধরনের ফিউশনের ভিতর দিয়া যে আগায়া নেয়া হয় নাই, সেইটা এক ধরনের ‘ব্যর্থতা’-ই বরং।
৩. এখনকার দিনে রাষ্ট্র যেমন চালায় পুঁজিপতিরা, করপোরেশনগুলা, তখনকার দিনেও রাজ্য চালাইতে গেলে রাজা’রে ডিপেন্ড করা লাগতো এইরকম পাওয়ারফুল কিছু গ্রুপের লগেই। তো, সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যেই ষড়যন্ত্র বা কনসপিরেসি দেখানো হইছে সিনেমায়, সেইটার মেইন আরগুমেনট হইতেছে, সিরাজ তো বাচ্চা-ছেলে! হি ইজ ইয়াং! সে ইংরেজদেরকে বিজনেস করতে দিতেছে না! রাজ্য চালাইতে পারতেছে না। এখন কলোনিয়াল পিরিয়ডের আগে যুদ্ধ বা রাজ্য দখলের মেইন ঘটনা ছিল জমি-দখল বা খাজনা-আদায়; কলোনিয়াল পিরিয়ডে আইসা সেইটা হয়া উঠছে – ‘বাণিজ্য’, যে রাজ্য বা দেশ দখল না কইরা ‘অবাধ বাণিজ্য’ করা পসিবল না; তো, ইংরেজরা তো জমিদারি-ই নিতে চাইছে যাতে ‘অবাধে বাণিজ্য’ করতে পারে; কিনতু সিরাজউদ্দৌলা অই ‘বাণিজ্যে’ বাধা হয়া দাঁড়াইছেন; লোকাল পুঁজি লগে গ্লোবাল পুঁজির মিলনে উনি হয়া উঠছেন মেইন অবস্টেকল।
আর যেহেতু উনি রাজা, উনি একলাই যেন পাওয়ার-স্ট্রাকচারেই কন্ট্রোল করেন – এই ভুল নিয়া উনি পাওয়ারফুল লোকদেরকে পাবলিকলি অপমান করছেন, যার ফলে পতনের দিকে আরো আগায়া গেছেন। মোহনলাল তারে বুঝাইতেছিলেন যে,: ‘রাজাকে রাজনীতি বুঝতে হয়’, কিনতু সিরাজ হইতেছেন ‘ভালো-মানুশ’ উনি বলতেছেন, ‘রাজনীতি বুঝি না আমি, আমি শুধু বুঝি এই দেশকে, এই দেশের মানুষকে’। মানে, এজ আ ‘বাঙালি’ উনি তো একটু উদাস এবং বাউল, যখন বিপদে পড়ছেন, সামলাইতে পারতেছেন না, ডিসিশান নিতে পারতেছেন না, বলতেছেন, ‘‘এই প্রাসাদটাকে মনে হচ্ছে কারাগার…’ এবং এই যে ডিসিশান না নিতে পারা, ইমোশনাল হয়া যাওয়া – এইটা খালি সিরাজের ‘চারিত্রিক দুর্বলতা’ না, নেশনালিজমেরও গোড়া যে, যেকোন একটা ইমোশনাল এটাচমেনট ছাড়া এইটা সারভাইব করতে পারে না।
৪. পাবলিক মেমোরি’তে বাংলাদেশি-সিনেমা’র সবচে রিমার্কেবল সিন মেবি হইতেছে নবাব সিরাজদৌলা সিনেমাতে আনোয়ার হোসেনের শুরুর দিকের ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা…’ বইলা যেই এক মিনিটের মনোলোগ’টা ডেলিভারি দেন। এইটা (বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) যে একটা টার্ম হয়া গেছে, সেইটাতে সিনেমার এই সিনটার একটা ক্রেডিট থাকার কথা। বাংলাদেশি-সিনেমাতে গানের পরে ডায়ালগ একটা ক্রুশিয়াল জিনিস। বাংলাদেশের আর্ট-ফিল্মগুলা দেখবেন এই জিনিসটারে খুব হেইট করে; কথা-কওয়াটারে ‘যাত্রা’ টাইপের একটা জিনিস মনে করে। বাদ দিতে পারলে যেন বেটার। যত ডায়ালগ তত যেন ‘স্থূল-রুচি’র ঘটনা! এই কারনে সিরাজউদ্দৌলা’রে যেইখানে তারিফ করা দরকার সেইটারে নিয়া হাসি-ঠাট্টা করতে পারি আমরা।
শেষের দিকে আরেকটা মনোলোগ আছে – “বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘনঘটা…কে তাকে আশা দিবে, কে তাকে ভরসা দিবে…” অইটার কথাও অনেকে মনে করতে পারবেন সোশাল-স্পেইসে যেইটা ‘কমন ডায়ালগ’ হয়া উঠছিল; এবং সারপ্রাইজিংলি এই মনোলগের শেষে বলা হইতেছে – ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবে’।
৫. কারেক্টারগুলা নিয়া যদি বলি, মোহনলালের কারেক্টার’টা হইতেছে খান আতাউর রহমানের আরটিসটিক ইনসার্শন; মোহনলাল খালি লয়াল ও দেশ-প্রেমিকই না, বরং উনি হইতেছেন যাত্রার বিবেক! আর খান আতাউর রহমান এই ‘বিবেক’র রোল’টাতে নিজেই অভিনয় করছেন। যাত্রা-পালাতে একজন ‘বিবেক’ যেইরকম ক্রুশিয়াল মোমেনটে আইসা সত্যি-কথাটা বইলা যান, মোহনলাল সিনেমাতে এই কাজটা করেন বেশিরভাগ সময়। (রূপবান সিনেমাতে এই জিনিসটা মিসিং।)
তবে সিনেমাতে সিরাজের পরেই মেইন কারেক্টার হইতেছে আলেয়া, এবং খান আতাউর রহমানের পোয়েটিকাল ইনটারভেনশন! (আলেয়া যে আলো না, আলো’র ইলুশন, ইশারা…) সিনেমা’তে আলেয়া হইতেছে মোহনলালের ভগ্নী, যেহেতু রেইপড হইছিল শে (সিরাজ এই নিয়া মোহনলাল’রে ‘ভৎসর্না’ করে যে, এইটা তো আলেয়া’র দোষ না!) আর সমাজে থাকতে পারে না, কুঠি’তে থাকে। যে বাঈজী (নট বেশ্যা), মীরজাফরের ছেলের প্রেমিকা, কিনতু গোপনে শে সিরাজের উইল-উইশার (গোপন-প্রেমিকাও কি না?) এবং গুপ্তচর। শি ইজ কোয়াইট আ কারেকটার, ফ্রি-স্পিরিটেট উইমেনের কিছু ইশারাও পাওয়া যায় এইখানে। আর এই রোলে আনোয়ার ওয়াজ আ বিউটি; মেবি উনার পুরা ক্যারিয়ারে এইরকম ‘বিউটিফুল’ প্রেজেনস উনি পান নাই। (আনোয়ার হোসেনেরও এইটা বেস্ট এচিভমেন্ট। এইটা তো আসলে আনোয়ার হোসেন এবং আনোয়ারার সিনেমা, সিরাজউদ্দৌলা ও আলেয়ারও।) এর এগেনেসটে লুৎফা অবশ্যই ‘পতি-ব্রতা’ বউ, কিনতু উনার রোল কিছুটা ইনসিগনিফিকেনটই। এমনকি আলেয়ার ফাঁসিটাই ট্রাজিক ঘটনা হিসাবে আছে সিনেমাতে; লুৎফা জাস্ট হারায়া যান, কোন সিনে থাকেন না।
সিরাজ যখন যুদ্ধ করতেছেন তখন আলেয়া পূজা করতেছেন আর লুৎফা করতেছেন মোনাজাত।
৬. তো, ধর্মের কিছু জিনিস আছেই সিনেমা’তে; সেইটারে ‘অসাম্প্রদায়িকতা’র বেসিসে দেখতে চাওয়া ঝামেলারই হবে কিছুটা; কারন মুসলমান মীর-জাফরই গাদ্দারি করতেছে না এইখানে হিন্দু রায়-ভল্লব, জগত-শৈঠরাও (এইটা পদবী যদিও, নাম না) আছে, আবার সিরাজের পক্ষে হিন্দু মোহনলাল এবং মুসলমান মীর মদনও থাকতেছেন। মানে, হিন্দু ও মুসলমান তখনো একটা পলিটিকাল কেটাগরি হয়া উঠে নাই হিস্ট্রিতে। তবে একটা ডায়ালগ ইন্টারেস্টিং, ফোর্ট উইলিয়াম কব্জা কইরা মুর্শিদাবাদে আসার পরে সিরাজউদ্দৌলা বলেন: ‘ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম এখন জনগনের মসজিদ।’
৭. শেষের দিকে যখন ‘ষড়যন্ত্র’ ফাইনাল হয় তখন ইংরেজের সাথে একটা ডকুমেনটে সাইন করে লোকজন, মানে একটা ‘চুক্তি’ করে আসলে; কিনতু সিরাজ অই লোকজনরে একটা কসম খাওয়ান কোরান শরীফের উপরে হাত রাইখা। মানে, এই টুইস্ট’টা খেয়াল করার মতো একটা ঘটনা। আপনি যদি কসম না রাখেন তাইলে তো পাপ করলেন বা বেঈমান হইলেন, এর বেইজটাও হইতেছে ওরাল-ফরমেট; অন্যদিকে চুক্তির খেলাপ করলেন মানে একটা অপরাধ করলেন, আইন-ভাঙলেন, এর বেইজটা হইতেছে লিখিত-ফরমেট। এখন কোরান শরীফের উপর রাইখা খাওয়া মৌখিক/ওরাল কসমের চাইতে দলিলে সাইন করা রিটেন ডকুমেনট বেশি ‘মান্যতা’র ঘটনা হিসাবেও এপিয়ারড হইতেছে, যদিও নৈতিকভাবে বাজে ঘটনা।
৮. পাকিস্তান কায়েম হইছিল ১৯৪৭ সালে, ঢাকায় সিনেমাও বানানো শুরু হইছে নিয়মিত-ভাবে ১৯৬০’র দিকে, কিনতু নজরুলের গান কোন সিনেমাতে পাওয়া যায় না, সিরাজউদ্দৌলা আগে। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা দুইটা গান আছে সিনেমা’তে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানও বাংলাদেশি সিনেমায় পয়লা ইউজ করেন খান আতাউর রহমান-ই, ১৯৬৯ সালে ‘জোয়ার ভাটা’ সিনেমাতে। (গানের বেপারে আরেকটা ঘটনা হইতেছে, বাংলা-ভার্সনেও বাঈজী কিনতু উর্দু গান-ই গাইতেছে।)
৯. আমার পারসোনালি পছন্দ হইতেছে সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার লাস্ট-সিনটা, যেইখানে ‘জনগণ’ দরবারে আইসা তারে নিয়া ফান করতেছে, বুলিং করতেছে, মজা নিতেছে; মানে, এরা বুঝতেছে না কি করতেছে, যেহেতু রাজা’রে বাটে পাইছে, এর মজা নিতেছে; এখনকার দিনের অনলাইন বুলিংয়ের মতো! তো, সিরাজউদ্দৌলা তখন আবারও ইমোশনাল হয়া উঠেন (এইটাই উনার মেইন ফিচার আসলে সিনেমাতে), এবং রিয়ালিটি’টারে ব্যাখ্যা করতে থাকেন যে, জনগন’রে জাগতে হবে! যেইটা আসলে ১৯৬৭ সালের রিয়ালিটি, ১৭৫৭ সালের না; (কারন অই সময়ে জনগন বইলা কোন পলিটিকাল-এনটিটি এগজিস্টই করে না) কিনতু তার আবেগ দেইখা দরবারের লোকজন চুপ কইরা যায়, আর তখনই সৈন্যরা গুলি কইরা তারে মাইরা ফেলে। আর এইভাবেই ট্রাজিক এন্ডিং-ই হয় না বরং ট্রাজেডি-ই হয়া উঠে এনড পয়েনট অফ দা হিস্ট্রি!
৩.হিস্ট্রিকাল ট্রুথ ভারসেস আর্টের ট্রুথ
“…all regimes make their young study history in school… not to understand their society and how it changes, but to approve of it, to be proud of it…History as inspiration and ideology has a built-in tendency to become self-justifying myth. Nothing is a more dangerous blindfold than this as the history of modern nations and nationalism demonstrates.”
/ON HISTORY, ERIC HOBSBAWM
এখন কথা হইতছে সিরাজউদ্দৌলা সিনেমারে তো আসলে একটা আর্ট-মেটেরিয়ার হিসাবেই দেখতে হবে প্রাইমারিলি, হিস্ট্রিকাল ডকুমেনটেশনের চাইতে। আর সিনেমার কাহিনি’তে অনেকগুলা ফ্ল (flaw) তো আছেই; উপরে সিনেমার ঘটনাগুলা বলতে গিয়া কিছু বলছি। এর বাইরে যদি জিওগ্রাফিকালি দেখেন, মুর্শিদাবাদ ইটসেলফ-ই পুব পাকিস্তানে নাই, বা ছিল না তখনো।
তারপরে ধরেন, সিরাজউদদ্দৌলা কি ‘বাঙালি’ আছিলেন? তার নানা (নবাব আলিবর্দি খানের) বাপ ছিলেন তুর্কি, মোগল দরবারে ঝামেলায় পইড়া (বাংলা’তে ট্রাই করেন, কিনতু না পাইরা) উড়িষ্যা’তে গিয়া সাকসেসফুল হন আলিবর্দি খান, উড়িষ্যার সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবার হওয়ার পরে উনি বিহারের দায়িত্ব পান; উনি সাকসেসফুল একজন সেনাপতি ও নবাব ছিলেন। কিনতু সুজাউদ্দিন মারা যাওয়ার পরে তার পোলা সরফরাজ খানের সাথে ঝামেলা হইলে তারে পরাজিত কইরা মোগলদের কাছ থিকা বাংলার নবাবি পান আলিবর্দি খান। তার মানে, সিরাজউদ্দৌলা’র ইমিডিয়েট আগের জেনারেশন বাংলায় আসছিলেন, এবং উনি কি বাংলায় কথা কইতেন নাকি উর্দু’তে – এই কোশচেনও উঠতে পারে আসলে। কিনতু নো ডাউট, উনি হয়া উঠছিলেন ব্রিটিশ-বিরোধি মুভমেনটের একটা ফিগার… যেইটারে সিনেমা’তে রি-ইনভেনট করা হইছে একজন ‘দেশপ্রেমিক’ ‘বাঙালি-জাতীয়তাবাদী’ ফিগার হিসাবে, যেই জাতীয়তাবাদ পাকিস্তান হওয়ার পরেও এচিভ করা যায় নাই, বা যাইতেছে না।
আবার সিরাজের কিনতু তিন বউ ছিল, লুৎফা ছিলেন থার্ড, হিন্দু থিকা কনভার্টেট মুসলমান, দাসীও ছিলেন তিনি সিরাজের নানীর; কিনতু তখনকার এই নবাবি-কালচার’রে যেহেতু এখনকার (মানে, ১৯৬৭’র) সেকসুয়াল ফ্রেমওয়ার্কের লগে মিলানো যায় নাই, বাদ-ই রাখা হইছে।
মানে, এইরকম অনেক অ-মিলের ঘটনা তো আছেই, কিনতু এইগুলাতে ফোকাস না করাটাই বেটার। বেপারটা এইরকম না যে, একটা হিস্ট্রিকাল-ড্রামা হিসাবে সিনেমা সিরাজউদ্দৌলার এই ‘স্বাধীনতা’ ছিল বা আছে, বরং সিনেমা একটা হিস্ট্রিকাল ডকুমেনট হইলেও এর কাজ যতটা না ‘সঠিক ইতিহাস’ তুইলা ধরা তার চাইতে অনেক বেশি হইতেছে একটা সময়ের হিস্ট্রি’রে একটা এলিমেন্ট হিসাবে নিয়া আরেকটা সময়ের হিস্ট্রির সার্টেন পারপাসরে সার্ভ করা। আর এই জায়গাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার পারপাস ছিল একটা ‘বাঙালি’ নেশনাল আইডেনটিটি তৈরি করা, এবং ‘দেশপ্রেম’ জাগায়া তোলা। এবং এই দিক দিয়া বাংলাদেশের নেশনাল হিস্ট্রিতে এই সিনেমা ইম্পর্টেন্ট একটা ঘটনা।
মার্চ,২০২৪
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (তিন) - নভেম্বর 15, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024