ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ
[মাস খানেক আগে ফরহাদ মজহারের মোকাবিলা বইটা নিয়া কিছু কথা বলছিলাম আমি; অই আলাপের নোটগুলাসহ আলাপ’টা শুনতে পারেন। – ইমরুল হাসান]
বইটা কেন পড়তে চাইছি?
১. ফরহাদ মজহারের চিন্তা নিয়া যেন কোন criticism ও critique নাই বাংলাদেশে! অথচ অনেক কথাই তো অনেক জায়গায় বলছি আমি, এবং অনেকেই, তো ইসপেসিফিক একটা বই নিয়া বললে সেইটা মেবি ডকুমেন্ট হিসাবে বেটার হইতে পারে।
২. বাংলাদেশে চিন্তার বই তো কম-ই, ফরহাদ মজহারের এই বইটা বাংলাদেশি চিন্তার একটা বই, যেইটা কিছু জায়গারে এক্সপ্লোর করার ট্রাই করে বইলা আমি মনে করি।
৩. উনার তো অনেক জিনিস নিয়া অনেক চিন্তা আছে, কিনতু এইটা উনার পলিটিকাল চিন্তার জায়গাটারেও রিপ্রেজেন্ট করে, অনেক বেশি পরিচিত উনার বইগুলার মধ্যে, যার ফলে স্যাম্পল হিসাবে নেয়া যাইতে পারে।
বইটা নিয়া ওভারঅল কমেন্টস বা মেজর সমালোচনা
১. সবচে ঝামেলার জিনিস হইতেছে, উনি বাংলাদেশের কমিউনিস্টদেরকে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এক ধরনের ইনডেমনিটি দিছেন, ইনোসেন্ট বানায়া রাখছেন।
যেন প্রপাগান্ডা কইরা কমিউনিস্টদেরকে নাস্তিক বানানো হইছে > মার্কসের কথা বুঝতে পারেন নাই বইলা উনারা নাস্তিক হইছেন > উনারা আসলে ‘প্রকৃত কমিউনিস্ট’ না… এইভাবে আগাইছেন; এইটা খালি ভুল-চিন্তা না, ইনটেলেকচুয়াল অসততাও, যেইটা বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের মধ্যে ‘উঁচা জাতের লোক’ হওয়ার কারনে একটা ‘জাত-গত’ বৈশিষ্ট্য 🙂 হিসাবে আছে; উনি এর বাইরে যাইতে পারেন নাই
২. বেপারটা খালি মার্কসরে ডিফেন্ড করা না, বরং যেন বাঁচায়া দিতে চাইতেছেন একভাবে, যে উনি ঠিক-কথাই বলছিলেন, মার্কসিস্টরা, কমিউনিস্টরা সেইটা ঠিকঠাক-মতো বুঝতে পারে নাই; বরং ঘটনা হইতেছে যে, দুইশ বছর আগে অনেক কিছু বুঝা’টাই তো পসিবল ছিল না! এখন অনেকগুলা ফ্যাক্টর অ্যাড হইছে যেইগুলা দিয়া তখনকার সময়ের কনটেক্সটে এই আলাপগুলার জায়গাটাতে ইন্টারভিন করাটা পসিবল ছিল না। অই কম্পারিজনের জায়গাগুলা প্রায়োরিটি পায় নাই, বা আসে-ই নাই।
৩. পলিটিকাল বেইজটা থিকা উনি কালচার ও ধর্মরে ধরতে চাইছেন; উপর-নিচ যেন বেপারটা, সাইড বাই সাইড না! এই বেইজটার কারনেই উনার আলাপগুলা সাফার করছে আসলে।
বইয়ের লেখাগুলা নিয়া
১. বইটা ছাপা হইছিল ২০০৬ সালে। বইয়ে ভূমিকাসহ ১৩টা লেখা আছে, আর বাড়তি ২টা লেখাসহ টোটাল ১৫টা লেখা আছে।
২. পয়লা কথা হইতেছে, কবিতা ও ইনটেলেকচুয়ালিটি একই জিনিস না। দুইটার মধ্যে লেনদেন নাই না, কিনতু এক্সপ্লোরেশনের জায়গাগুলা কমপ্লিটলি আলাদা।
৩. ধর্ম ও ধর্মতত্ত্ব নিয়া ক্রিটিকাল হইছেন, ধর্ম নিয়া এতোটা হইতে পারেন নাই। কিছু ওভার-জেনারালাইজেশন করছেন; যেমন “বাজারে মাল বেচাকিনি করতে গেলে ধর্ম লাগে না…” (প. ২২), কিনতু লাগে তো, ২০০৮-১০’র দিকেই আমি একটা আলাপ করছিলাম ম্যাগি নুডুলস ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সার্টিফিকেট নেয়ার সময়; ধর্ম একটা ব্যবসা না, বরং ধর্ম ছাড়া তো ব্যবসাই হয় না এখন, এইরকম আরো উদাহারন আছে…
৪. মাওলানা ভাসানী নিয়া কমিউনিস্টদের যেই হিস্ট্রিকাল লাই বা মিথ্যাচার সেইটারেই উনি কনটিনিউ করছে। বলছেন, “বাংলাদেশে মাওলানা ভাসানিকে সামনে রেখেই তো ধর্মবিশ্বাসী কৃষকমজুর আর কমিউনিস্টরা শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলছিল” (প. ৩১) এইটা ভুল-কথা, ভাসানীরে ইউজ-ই করছিল কমিউনিস্টরা, ভাসানী নিজেও বলছেন সেইটা, নুরুল কবিরের ‘রেড মাওলানা’ বইয়ের রিভিউ করতে গিয়া অই জায়গাটা নিয়া কিছু কথা বলছি আমি।
৫. উনার মেইন রেফারেন্স পয়েন্ট হইতেছেন; উনি কনক্লোড করছেন এইভাবে যে, “এঙ্গেলসের এই সকল রচনা থাকা সত্ত্বেও ধর্ম মাত্রই নির্যাতনমূলক, শোষণের হাতিয়ার বাংলাদেশের তথাকথিত “গনতন্ত্রী” বা “প্রগতিশীল”দের মধ্যে এই বিকৃত চিন্তা কীভাবে এতো গভীরে প্রোথিত হতে পারল সেটা সত্যি সত্যিই ভাববার বিষয়।” (প. ৪৫); তো, উনি আর ভাবেন নাই, এর পরে আর যান নাই, বরং সইরাই আসছেন একভাবে
৬. নাস্তিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা’র যেই ভুল-নেরেটিভ সেইটা উনি লোকেটই করতে পারেন নাই, বা করতে রাজি হন নাই। যার ফলে কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দেয়াটা সহজ হইছে উনার জন্য।
৭. লেনিনের জায়গাটা বরং উনি ভালো-ভাবে লোকেট করতে পারছেন। (প. ৬৫-তে দেখতে পারেন।)
৮. মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মের জায়গাটা নিয়া উনি ক্রিটিকাল হইতে পারেন নাই, ট্রেডিশনাল নেরেটিভের কাছেই সারেন্ডার করছেন। (প. ৭১, ৭৫ ও ১১২-তে কিছু জায়গা পাইবেন।)
৯. বিজ্ঞানের সাথে ইমপেরিয়েলিজমের রিলেশনের জায়গাটা নিয়াও উনি ‘উদাসিন’ আসলে। (প. ৮৫)
১০. লালন ও মার্কসরে মিলানো যায়-না না, জোর-জবরদস্তিটা না করলেও হয়; বা যেই জায়গা থিকা করা হয়, সেইটা এতোটা জরুরি কিছু না।
১১.ধর্ম জিনিসটা কি – সেইটা আবিষ্কার করাটা ঘটনা না, বরং এইটা নানান সময়ে নানান সমাজে কিভাবে ফাংশন করে, সেইটা হওয়া উচিত কনসার্নের জায়গাটা; সেইটা উনি দুয়েক জায়গায় বললেও আমল করতে পারেন নাই খুব একটা
১২. নাস্তিকতা বা ধর্ম-বিরোধিতাটা কেন আধুনিকতা বা পুঁজিবাদের জন্য জরুরি, সেইটা নিয়া বলছেন উনি, যেইটা ভুল না।
১৩. বাংলাদেশের কমিউনিস্টদেরকে কেন নাস্তিক হইতে হইছে এইটা নিয়া প.১২৫-১২৬ এ কিছু কথা বলছেন উনি, যেইটা ইন্টারেস্টিং… কিনতু পরে এই পথে আর হাঁটেন নাই
১৪. ধর্ম ও রাষ্ট্রের আলাপে চালু নেরেটিভগুলার মধ্যেই থাকছেন উনি, নতুন কোন পরস্তাব রাখতে পারেন নাই আসলে
১৫. বাংলাদেশের বুর্জোয়া, আধুনিক ও মধ্যবিত্ত চিন্তার গতি নিয়া কিছু কথা বলছেন ‘পরিশিষ্ট ১’-এ; টেনডেন্সিগুলারে দেখাইছেন, অইগুলা এখন মেবি ইনটেলেকচুয়াল ‘কমনসেন্সের’-ই ঘটনা
১৬. হেগেলের চিন্তা ও ক্রিশ্চিয়ানিটি নিয়া লেখাটা ভালো, রিকমেনড করবো আমি
বইয়ে কি নাই?
১. ডেমোক্রেসি নিয়া আলাপ-ই নাই! দুনিয়াতে যেন একটা পথ-ই খোলা আছে – বিপ্লবী-রাজনীতি করা! যেইটা খালি সেক্সি ও ডেঞ্জারাস ঘটনাই না, বাজে-ইনটেশনের ঘটনাও।
২. রাষ্ট্র ও ধর্ম-ভাবনা নিয়া বাংলায় আর কারো লেখা কি নাই? বঙ্কিমের তো আছে, আহমদ ছফাও কথা বলছেন সেইটা নিয়া… তো, অই রেফারেন্সগুলা বাদ দিয়া গেছেন উনি
৩. সবচে ক্রিটিকাল ঘটনা হইতেছে, কমিউনিস্টরা কেন ডিল করে নাই ধর্ম-প্রশ্নটারে, বা সিউডো-নাস্তিক কেন হয়া থাকতে চাইছে? নাস্তিক হওয়াটা যে একটা কালচারাল-কেপিটাল – অই আলাপটাতে উনি যান-ই নাই
বইটার মেইন সিগনিফিকেন্স’টা কি?
১. বাংলাদেশে, কমিউনিস্ট-শাসিত ইনটেলেকচুয়াল ঘরানা’তে ধর্ম নিয়া যে কোন আলাপরে ট্যাবু-ঘটনা বানায়া রাখা হইছিল, এই বইটা সেইটারে ‘নরমাল’ বানায়া তোলার কাজটা করতে পারছে – যেইটা মোস্ট সিগনিফিকেন্ট ঘটনা; ধর্মরে একটা সোশাল কম্পোনেন্ট হিসাবে কনসিডার করা; ‘যার যার ধর্ম তার তার’ টাইপের সিউডো-আলাপের বাইরে নিয়া আসার কাজটা করতে পারছে
২. চিন্তা করার তো পদ্ধতি অবশ্যই আছে, কিনতু চিন্তা করার সাহস করতে পারাটা তার চাইতে জরুরি ঘটনা, ফরহাদ মজহার অই সাহসটারে ভিজিবল করতে পারছেন, উনার ব্যর্থতাসহ
৩. কিনতু সেই সাহস নিয়া উনি এগজিসটিং চিন্তার বেইজটার সমালোচনা করছেন সেইখানে নতুন যেই বেইজ তৈরি করছেন সেইটার ইসট্রাকচারটা ফান্ডামেন্টালি ডিফরেন্ট কিছু হয়া উঠতে পারে নাই
কনক্লোশন
বইটা একটা মাস্ট রিড, যারা বাংলাদেশে পলিটিকাল থিওরি নিয়া জানতে চান, পলিটিকাল কাজ-কাম করতে চান; উনার ফ্লাওয়ারি কথা-বার্তাসহই এইটা পড়তে পারাটা বেটার
সাবধান-বানী
আমাদের ইনটেলেকচুয়ালরা একটা জিনিস ভুল – সেইটা বলার পিছনে যেই পরিমান সময় ও শ্রম দেন, এর অর্ধেকও যদি নতুন বেইজ তৈরি করার দিকে দিতেন তাইলে ভুল-ঠিক যা-ই হোক, নতুন কিছু থিওরেটিকাল বেইজ আমরা পাইতে পারতাম মনে হয়
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024