গনতন্ত্র কেন দরকার?
অরুন্ধতী রায়ের এই কথাটা আমি পোস্ট করসিলাম ২০১৮-এর “ইলেকশন”-এর পরে। সত্যি কথা বলতে কি, কোটা সংস্কার নিয়ে আমার খুব বেশি মাথাব্যথা ছিলো না, বরং গণতান্ত্রিক সংস্কারটা আমি বরাবর চেয়ে আসছি।
কী চাইসি? কেন চাইসি? কী হচ্ছে? কী হবে? কে আসবে?
এমনতর প্রশ্নগুলার উত্তর জনে জনে দিতে দিতে আমি খুব ক্লান্ত, একবারে বলে দেই।
তো, চাইসি তো গণতন্ত্র। তাতে, কে আসবে এরপরে?
জনগণ যাকে নির্বাচিত করবে, সে আসবে। আপনাকে নির্বাচিত করলে আপনি আসবেন। সাফ জানায়া রাখি, যদি আওয়ামী লীগও ফ্রি & ফেয়ার ইলেকশনে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে দায়িত্বে আসতে পারে, আমি মেনে নিবো।
(হাইসেন না। আপনাদের যাঁদের মনে হচ্ছে রাস্তায় টোকাই-লীগ, আর ফেইসবুকে আফসোস-লীগ ছাড়া আওয়ামী লীগের কোথাও কোন অস্তিত্ব নাই, জনমনের এই তীব্র ঘৃণা লীগ কোনদিন কাটায়া উঠতে পারবে না, তাঁরা জেনে দু:খ পেতে পারেন যে, স্বৈরশাসক মার্কোসের ছেলেকে ফিলিপাইনের জনগণ ভোট দিয়েই আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করসে। তাতে মাইন্ড করার কিছু নাই, লেজিট।)
অলসো, গণতন্ত্র মানে “সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন”, এই ধারণাটা আসলে অসম্পূর্ণ। গণতন্ত্রের আসল স্পিরিটটা এখানে যে, গণতন্ত্রে সব নাগরিকের একটা করে ভোট। ইলেকশন আসলে গণতন্ত্রের পয়লা কদম মাত্র। ধরেন, দেশে ইলেকশন আছে, কিন্তু দেশের প্রধান বিচারপতিকে মাস্তানি করে নির্বাসনে পাঠানো যাচ্ছে, তাহলে বুঝে নিবেন যে দেশে ইলেকশন থাকলেও আসলে গণতন্ত্র নাই। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলাই সত্যিকারের গণতন্ত্র নিশ্চিত করে, ওই একটা-ভোট-দেয়া প্রত্যেক ভোটারের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে। কার্যকর গণতন্ত্রে যাকে আপনি চান নাই, সে নির্বাচনে জিতে আসলেও আপনি খারাপ থাকবেন না। ওদিকে ভোট না থাকলে ভোটারের সামান্য নিরাপদ-সড়কের দাবির উপরে পরিবহন মালিক সমিতির স্বার্থই রাখতে চাবে আপনার সরকার।
ধরেন, আমাদের ডোনাল্ড ট্রাম্প (ধরে নেই তিনি মানুষটা খুব খারাপ), প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় যতটা বাগাড়ম্বর করতে পারসেন, ততটা খারাপ কাজ আসলে করতে পারেন নাই তো। তাঁকে থামাতে সিনেট-কংগ্রেস ছিলো, সুপ্রিমকোর্ট ছিলো। অন্তিম মুহূর্তেও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তাঁর কথা না মেনে সংবিধান মেনে চলসেন। মার্কিন জনগণ তাঁর চাকরি নট করে দিসেন। হয়তো তিনি আবার আসবেন (এবং সেই দ্বিতীয় মেয়াদের পর তাঁর আর প্রেসিডেন্ট হবার সুযোগ থাকবে না), কিন্তু আপনিও জানেন, আমিও জানি, নাগরিকের উপর দমন-পীড়ন তিনি করতে পারবেন না।
আমেরিকার উদাহরণ শুনে আপনারা কী বলতে চাইতে পারেন, তা আমি অলরেডি জানি। গত কয়েকদিনে অনেক কথা শুনসি তো আমি; “বেশি বুঝো” থেকে শুরু করে “পলিটিক্স এর প-ও বুঝো না”। তো, সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে যিনি পলিটিক্স-এর-প না বোঝার কথা বলসিলেন, আরো আলাপে বুঝা গেলো, তিনি অস্ট্রেলিয়া আর বাংলাদেশের পলিটিক্স একইরকম ভাবতে (চাইতে) নারাজ। বটে!
এই যে নোশনটা, যে বাংলাদেশে জনগণ “এরচেয়ে ভালো কিছু ডিজার্ভ করে না” – তা প্রচন্ড অশ্লীল (যেমন আওয়ামী বয়ানগুলার মধ্যে সবচেয়ে অশ্লীল হলো, “তিনি এক অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিসিলেন”। প্লিজ অলসো নোট যে, এই বয়ানের বয়াতি নিজেই মুক্তিযুদ্ধে যান নাই)। আমি ভেহেমেন্টলি এই নোশনটা ডিনাই করতে চাই। ইতিহাস স্বাক্ষী, বাংলাদেশের জনগণ কালেক্টিভলি কোন ফ্রি & ফেয়ার ইলেকশনে সরকার নির্বাচন করতে ভুল করে নাই।
আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশের যোজন দূরত্ব আছে তো। কিন্তু সেই দূরত্ব আমরা কমিয়ে আনতে চাবো না কেন? “লাল-লাল নীল-নীল বাতি দেইখা আশা পুরাইলো” উন্নয়নে, জবলেস গ্রৌথের প্যারাডক্সিকাল উন্নয়নে, আপনি খুশি থাকলে থাকেন, আমি তো খুশি না। আমি সত্যিকারের উন্নতি চাই।
“জবলেস গ্রৌথ” যেমন প্যারাডক্সিকাল, “ভালো জমিদার” কথাটাও তেমনই একটা অক্সিমোরন। স্বৈরশাসন একজন ভালো মানুষকেও স্বেচ্ছাচারী করে তুলবেই। অন্যদিকে কার্যকর গণতন্ত্র একজন দানবকেও দানবীয় হয়ে উঠতে বাঁধা দিবে। আমি প্রজা না, আমি নাগরিক। আমি ইশতেহার (সিভি) দেখে জনপ্রতিনিধিকে চাকরি দিবো, পাঁচ বছর পরে তাঁর পারফরমেন্স ইভ্যালুয়েট করবো, চাকরিতে রাখবো, অথবা ছাঁটাই করে দিবো।
দেশের রাজনীতি রাখতে চাবেন মধ্যযুগীয় “ক্ষমতার রাজনীতি”, আর বিদেশের রাজনীতি থাকবে “দায়িত্বের রাজনীতি” – কেন?
অরাজকতা নিয়ে যেসব বন্ধুরা পেরেশান, তাঁদের আমি দুনিয়াব্যাপী রেভলুশনগুলার ইতিহাস শুনাবো না। কেন “বিপ্লবের পরের দিনটা বিপ্লবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ” তা আগেই বলসি। হাসিনার দোষে তৈরি হওয়া এই ক্ষমতা/দায়িত্বের ভ্যাকিউমের কথাও আমি টানবো না। স্যাবোটাজ অথবা ভেঞ্জেন্স/রিপারকাশন/সংক্ষুব্ধ-জনতার গল্পও আমি করবো না। এমনকি তাঁদের আমি কিছুদিন ধৈর্য ধরতেও বলবো না।
আমার সেইসব শান্তিপ্রিয়, মধ্যবিত্ত-মধ্যচিত্তের বন্ধুগুলাকে আমি শুধু (ফর দা আম্পটিন্থ টাইম) স্মরণ করায়া দিবো যে, সবথেকে পিসফুল ট্রানজিশন-অফ-পাওয়ার এর উপায় আমরা বহুকাল আগে থেকেই জানি, তার নাম ইলেকশন!
যারা বছরের পর বছর স্বৈরাচারী সরকার দেখেও আশা করে গেসেন যে, “রাজায়-রাজায় যুদ্ধ” হবে কেবল, গুম-খুন যে হবার সে হবে, এপলিটিকাল আপনি নির্বিঘ্নে দিন কাটাতে পারবেন, নৈরাজ্য কখনো আপনার জীবন-জীবিকাকে ছুঁয়ে যাবে না… (পারডন মাই ল্যাঙ্গুয়েজ) আপনারা নিতান্তই গর্দভ।
আরেক আর্কিটেক্ট বড়ভাই আমাকে বলসেন (নাকি সাবধান করসেন) যে, “রাজনীতিতে শেষকথা বলে কিছু নাই”। এটা আসলে আমিও জানি এবং মানি। আমি এ-ও জানি যে, “মিছিলের সব হাত, কণ্ঠ, পা এক নয়”। আমি জানি যে, প্রতিবিপ্লব হয়, বিপ্লব বেহাত হয়। আমি জানি যে ভেস্টেড গ্রুপ এখনো জায়গা মতোই আছে। চাইসি বলেই কার্যকর গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যাবে, তার নিশ্চয়তা আমরা কেউ-ই দিতে পারবো না। আমি তো এখনই নিজেকে বিজয়ী মনে করতে রাজি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, ভবিষ্যতে কোন সরকার নাগরিকদের পাখির মতো গুলি করে মারার স্পর্ধা দেখাতে পারবে না! পুলিশ-প্রশাসন-আর্মি-মিডিয়া-অলিগার্ক না, “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস” – এই কথাটা যে কেবল কাগজে (সংবিধানে) লিখে রাখা কথার কথা না, স্রেফ নির্বিবাদী জনতা তাঁদের এই শক্তির কথা ভুলে থাকে বলে ওরা জনগণের উপরে “ক্ষমতা” প্রয়োগের সুযোগ নিতে পারে… এই গণঅভ্যুত্থান অন্তত সেটা ওদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়া দিয়ে গেসে আরো একবার। অনেক অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অন্তত এতটুকু আমরা অর্জন করতে পারসি।
রেদওয়ান বাশার
Latest posts by রেদওয়ান বাশার (see all)
- গনতন্ত্র কেন দরকার? - আগস্ট 10, 2024
- মাইকেল সরকিন ও মার্সেল - মার্চ 28, 2020
- প্রিয় প্রিয়ভাষিণী - মার্চ 6, 2018