” ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন”: বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ক্যাপ্টেন মাজহারের স্মৃতি
“বিডিআর হত্যাকাণ্ড”-এ শাহাদাত বরণকারী ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দার আমাদের বন্ধু। এতো সুন্দর দেখতে ছিল সে! কোন ছেলে এতো সুন্দর হতে পারে, ভাবা যেত না। অমিত সম্ভবনাময় এই মানুষটি বিডিয়ার হত্যাকাণ্ডের শিকার সবচেয়ে কম বয়সী আর্মি অফিসার। বিয়ের মাত্র তিন মাস পর শহীদ হন মাজহারুল হায়দার। ওকে আমরা ডাকতাম রুবেল বলে। শিক্ষকরা মাজহার ডাকতো, কেউ কেউ রুবেলই ডাকত। তৎকালীন পুলিশের আইজি নূর মোহাম্মদ সাহেব ছিলেন রুবেলের শ্বশুর।
আমরা ক্লাস সেভেন পর্যন্ত একসাথে স্কুলে পড়েছি। এইচ এম আই ইন্সটিটিউট, করটিয়া, টাঙ্গাইলে। ও পরে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়। স্কুল জীবনে আমি ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলাম ব’লে একটা প্রচার ছিল। রুবেল বিশ্বাস করতো, এ টি দেবের পুরো ডিকশনারি আমার মুখস্ত!! একটা বিহবল বোধ ছিল আমাদের একে অপরের প্রতি। শেষবার ওর সাথে যখন দেখা হয়, তখন সম্ভবত আমি নটরডেম কলেজে পড়ি বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ি। ঠিক মনে নেই। তবে এতোটুকু মনে আছে, একবার একই সাথে আমরা সিএঞ্জি ক’রে করটিয়া এসেছিলাম, খুব সম্ভবত টাঙ্গাইল শহর বা কোথাও থেকে! আমাকে নিয়ে ওর পরম শ্রদ্ধাসূচক কিছু কথা আমাকে স্তব্ধ ক’রে রাখছিল। খুব সম্মান দিতে জানতো রুবেল সবাইকে, খুবই। আমি আর রুবেল সিক্স-সেভেন পর্যন্ত একসাথে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসতাম। রুবেলের বাবা ছিল সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যাপক। আমার ছোট বোন সৈয়দা সামিরা, রুবেলের বোন মিমি ও বন্ধু সুমনের বোন সুমিও একই ক্লাসে ( প্লে গ্রুপে বা ক্লাস ওয়ানে সম্ভবত) পড়তো। তখন চাঁদ লিলিলিক নামের একটা স্কুলে পড়ত আমাদের বোনেরা। সা’দত কলেজের সাথেই ছিল স্কুলটি । এখনও আছে কি-না জানা নেই। যা বলছি, সেগুলো সবই কিন্তু গত শতাব্দীর কথা!
রুবেলের সাথে আর দেখা হয় নি। দীর্ঘকাল কারো সাথেই আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দার,ওরফে রুবেল,আমাদের এই বন্ধুটির কথা জিজ্ঞাসা করতাম সকলকে। আমার কথাও ও জিজ্ঞেস করতো। কিন্তু সরাসরি কোন যোগাযোগ হয়নি দীর্ঘকাল। আমি ২০০৯ সালে আমার তৎকালীন কর্মস্থল সিলেট (সুনামগঞ্জ) থেকে আসার পথে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের কথা শুনি ! পরের দিন জানি অজস্র সেনা অফিসারদের সাথেই শহীদ করে দেওয়া হয়েছে ক্যাপ্টেন মাজহারকেও, আমাদের প্রাণের বন্ধু রুবেলকে। অপূর্ব আখলাক, মায়াবী মুখশ্রী, ও বিশাল মনের এই বন্ধুটির মৃত্যু আমাদেরকে হতবাক ক’রে দেয়। স্তব্ধ হয়ে থাকি কয়েকদিন। মনে পড়ে, অনেকগুলো পত্রিকা বিশেষ ফিচার প্রকাশ করে ক্যাপ্টেন মাজহারকে নিয়ে, তাঁর সদ্য গড়ে তোলা সংসার নিয়ে, তার অনবদ্য আচার-ব্যবহার আর বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে। সে ভবিষ্যতে আর্মি চিফ হতো, এমনও বললো কেউ কেউ। আমার সুস্পষ্ট মনে আছে, ডেইলি স্টার একটা কলাম ছেপেছিল ক্যাপ্টেন মাজহারকে নিয়ে, ” O Captain, My captain” শিরোনামে । আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে কবিতা লিখেছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান । সেটির নামও ছিল ” ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন”। কলামটি আমাদের শোককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ওর মুখটার দিকে এখনো আমি তাকিয়ে থাকি। আল্লাহতায়ালা ওর আত্মাকে শান্তি দিন। জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। ক্ষমা করুন।
ক্যাপ্টেন মাজহারুল হায়দারের হত্যার বিচার চাই। বিডিআর হত্যাকান্ডের তদন্ত ও বিচার হোক।