Main menu

লালসালুর মাজার ও টেক্সটবুকের রাজনীতি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ লালসালু লিখে এই জমানায় এসে মাজার ভাঙতেছেন ভাবা ঠিক হবে না। তবে লালসালু উপন্যাসটা মাজারের ইতিহাস না জানার থেইকা যে পয়দা হইছে, তা বললে মনে হয় না অত্যুক্তি হবে।

কুসংস্কার এর সংজ্ঞায়ন গুরুত্বপূর্ণ। কে নির্ধারণ করতেছে কোন জিনিস সু’সংস্কার’ তার খোঁজ রাখা দরকার। সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা কোন জায়গায় যখন কলোনি স্থাপন করতে চায় তখন খুব কমন একটা স্ট্র্যাটেজি ফলো করে, যে, ওই এলাকার লোকজন কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ফলে সিভিলাইজিং প্রজেক্ট হাতে নেয়া লাগে। একাডেমিক মহলে এরে হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন বলা হয়, যে, গায়ের রং শাদা হইলে কলোনির লোকজনরে সিভিলাইজড করার মতো বার্ডেন কান্ধে নেয়া লাগে। কারণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন মাত্রই তো অসভ্য! ফলে লোকালদের ধর্মও এর বাইরে নয়। এই পর্যন্ত আইসা থামা যাক। কারণ এর পরের প্রসঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ গং পড়েন না। কারণ এর পরেই আসে চার্চের প্রসঙ্গ, যেভাবেই হোক জেসাসের দয়া জোর কইরা ঢাইলা দিয়া হলেও লোকালদের সভ্য বানাইতে হবে, এইভাবে সে ক্রিশ্চিয়ান হয়ে উঠবে, নিদেনপক্ষে জুড্যিও-ক্রিশ্চিয়ান ক্যাপিটালিজমের বিপক্ষে যাবে না, ইম্পেরিয়াল কিংডম কায়েম হবে এক কিসিমের। এই লাইন ধইরা আগাইতে গিয়া নীৎশে নাস্তিকতার যেই ভ্যালুজ ওইগুলার গোড়ায়ও ক্রিশ্চিয়ানিটি আবিষ্কার করেন, এইভাবে সমালোচনা নামে যেই জিনিস প্রতাপশালী সেটা নিজে যে নিরপেক্ষ নয় বরং নানান ওয়েস্টার্ন ও ক্রিশ্চিয়ান ওয়ার্ল্ডভিউ এর ভিতর মুখ লুকাইয়া থাকে ও উরাধুরা নড়াচড়া করে তার হদিশ দেয় অনেকে…

তো, লালসালু হলো চার্চ প্রতিষ্ঠার আগেকার শানে নুজুল। ইণ্ডিয়ায় ইয়ং বেঙ্গল ইত্যাদি দেখবেন ও-ই সময়কার। ইংরেজদের যুক্তি ও দুনিয়া দেখার তরিকায় ফানা হওয়া কিছু লোক, যাদের কাছে দেশবাসী হলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধার্মিকরা হলো নষ্ট, ধর্ম দিয়া যাদের ধরা যায় না অতো তারা হতে পারতেন কোলাট্যারাল ড্যামেজ। কিন্তু কলোনিয়াল মাস্টাররা তো বেকুবাম (বেকুব বাম 🙂) না, ফলে তারা তাদের এমপ্লয়ি কইরা লইলেন, রাজায় কেন তাদের চুদির ভাই কইছে এই নিয়া তাদের আনন্দের আর সীমা নাই।

প্রিয় দেশবাসীকে “কুসংস্কার” ছাড়ানোর সিভিলাইজিং প্রজেক্টের এক্টিভ এজেন্ট হিসেবে এংলিসাইজড নেটিভরা ইউরোপীয়ানদের হয়ে ইনফরম্যান্টের কাজ শুরু করছেন কিছু, লালসালু এই ধাঁচের কিছু। ওয়ালীউল্লাহ বা যারা এরকম প্রক্সিতে যোগ দিছেন তারা সজ্ঞানে এমন কাজ করছেন নাও হইতে পারে, এজন্যে উপরে বললাম ইংলিশ ওয়ার্ল্ড ভিউতে অদের দেওয়ানা হওয়ার কথা। হালের আমেরিকান ওয়ার অন টেররে দুনিয়াব্যাপী মুসলিম রাইটারদের লেখাজোঁকা ফলো কইরা দেখেন, এরকম অনেক ইনফরম্যান্ট পাইবেন যারা অদের লেখার যেই ম্যাটেরিয়ারল বা ইসলামোফোবিয়া তার শিকার হইছেন নানান ইউরোপীয় এয়ারপোর্টে! উনারা হয়তো ভাবছেন কসমিক কোন কারণে লোকজন মুসলিম নাম দেখে শিউরে ওঠেন, অথচ ওই টর্চারের যেই যৌক্তিক বুনিয়াদ ওইখানে তার সরব অংশগ্রহণ ছিলো। বাইদ্যওয়ে, লালসালুর একটা মোরাল হইলো, পীর-খাদেম-মৌলানা-মৌলবীদের বকাঝকা দিলে হবে না শুধু, টিটকারিও মারতে হবে সিস্টেমে।

সে যাহা হইবার হোক, লালসালু উপন্যাস বা তার লেখকে আমি অতো দোষ দিই না, কারণ যে যা লেখার লেখুক। কিন্তু এর টেক্সটবুকে অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা সমস্যাজনক। কারণ তখন তা কোন জিনিয়াস লেখকরে স্বীকৃতি দেয় না শুধু, তার পজিশনরেও এক কিসিমের রাষ্ট্রীয় পজিশন হিসেবেও স্বীকার কইরা নেয়। যখন আমরা চাচ্ছি খোদ রাষ্ট্রের উচিত নানান ধর্মের ভিতর নিরপেক্ষ বা নিউট্রাল থাকা লাগবে, তখন খোদ রাষ্ট্র একটা রিলিজিয়নের আরো নির্দিষ্ট একটা স্কুল অব থটের লগে নিজের সম্পৃক্ততার জানান দিচ্ছে!

সামারাইজ করলে ব্যাপারটা এমন, যে, যেহেতু মাজার মাত্রেই মোদাচ্ছের পীরের হওয়ার চান্স আছে, সেহেতু ওই স্পিরিচুয়ালিটি ভুয়া না হয়ে যায় না। এই লাইনে যখন টেক্সটবুক পড়ুয়া তালবে এলম এগুবে, তখন স্পিরিচুয়ালিটি বা রিলিজিয়নের আদি ও আসল খুঁজতে শুরু করবে, বরং তা করাটাই বেসিক হিউম্যান টেন্ডেন্সি তখন…

আক্কাস চরিত্রটা খেয়াল করেন, গ্রামের বাঙলা শিক্ষিত যুবক, স্কুল বানাইতে চায় কিন্তু মজিদ তো দূর নিজের বাপরেও রাজি করাইতে পারে না! ফলে একদিন উধাও হইয়া যায়! আমি দেখছি লালসালু উপন্যাসটা যাদের প্রিয় পাঠ্য ছিলো স্কুল বা কলেজে, আমার অভিজ্ঞতায়, আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় প্রত্যেকে আক্কাস চরিত্রের, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে! কিরকম? এরা গড়পড়তা এন্টি-ডেমোক্রেটিক হয়, আমজনতা মাত্রই আক্কাসের বাপ মনে করে, যে, অদের বুঝানো যাবে না, ফলে বুঝানোরে টাইম লস মনে করে অথবা অশিক্ষিত মানেই রোগী এরকম একটা ভাবনা থেইকা নিজেরা ডাক্তারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এবং এই ডাক্তার গ্লোবাল প্যারামিটারে উত্তীর্ণও না, বরং এক কিসিমের হাতুড়ে ডাক্তার যারা আক্কাসের হয়ে প্রতিশোধ নেয়, এবং হরদম নাস্তিকতার প্রচার করে হিউম্যানিজমের নামে। এবং এই মানবতাবাদ ইটসেল্ফ বা এর পলিটিক্স নিয়াও ক্রিটিকাল না তারা, যতটুকু অন্তত নাস্তিক হিসেবে হওয়া উচিত। দাড়ি-টুপি-জোব্বা একলগে দেখলে তাদের ভিতর ইন্টার্নালাইজ ইসলামোফোবিয়ার ব্যাপার তো আছেই, ওইটা প্রকাশ না পাইলে অতো সমস্যার না, কিন্তু মুশকিল হয় যখন ওই লেবাসের লোক মাত্রই মজিদ হিসেবে ট্রিট করা শুরু করে।

চিনুয়া আচেবের “থিংস ফল এপার্ট” পড়া হইছিলো, হুমায়ুন আজাদ যেখান থিকা সবকিছুর ভেঙ্গে পড়া দেখছিলেন। লালসালুর কাছাকাছি সময়ে লেখা। দুইজনেই স্থানীয়-লোকাল-নেটিভ, কিন্তু আচেবে যখন র‍্যাশনালিজম আর কলোনিয়ালিজমের ভিতরকার রিলেশনশিপ নিয়া ক্রিটিকাল, সৈয়দ তখন অশিক্ষিত-মূর্খ-স্যাভেজদের শিক্ষিত করতে ব্যস্ত! এনলাইটেনমেন্টের নূরে আন্ধা সৈয়দ, কিন্তু আচেবের কমনসেন্স এতোই টনটনা যে পোস্ট-কলোনিয়াল রমরমার এইসময়ে আইসাও টাসকি খাইতে হয়!

কিন্তু এখানেই শেষ না, আচেবে নভেল লেখছেন ইংরেজিতে, ফলে তা তার দেশীয়দের স্বার্থে কতটুকু আসছে তা ভাবার অবকাশ খোঁজেন অনেকে। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ তো দেশী ভাষায় সাহিত্য করছেন, ফলে তারা আমরা কাজে লাগাইতে পারছি কতটুকু তার পার্সেন্টেজ হিসেবে যাইতে পারা দরকার। দেশী ভাষায় দেশী লোকদের জন্যে লিখে লালসালুর ভিতর দিয়া তিনি হয়তো এক কিসিমের সমাজবাস্তবতার খোঁজ দিছেন আমাদের। কিন্তু সেই সমাজ যখন রাষ্ট্রীয় টেক্সটবুকে ঢুকে রাষ্ট্র কর্তৃক এক কিসিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আদারাইজেশন বা এন্টাগনাইজিংয়ে শিকার হয়, তখন তা কনসার্নের বিষয়। এজন্য ক্রিয়েটিভ লোকদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা লাগে, নিজের পজিশনরে বাছবিচারে রাখা লাগে হরদম, এমনকি তা উপন্যাস বা চেরাগ জ্বালানিয়া প্রকল্প হইলেও। অন্যথায় ক্ষমতাসীন মতাদর্শ লেখকের ক্রিয়েটিভিটির মুখোশ সামনে রাইখা নিজের কাজকারবার আগাইয়া নিবে। আবার ভক্তদেরও ব্যাপার আছে, ভক্ত মানেই প্যাসিভ তা কিন্তু না, এক্টিভও হতে পারে ভক্ত, এমনও হতে পারে ভক্ত নিজের মতের সম্মতি উৎপাদনের স্বার্থে মুখোশ খুঁজতে নাইমা দেখা পাইলো লেখকের!

মাজার রক্ষার এই সময়ে যেহেতু লেখা হইতেছে এই লেখা, ফলে পজিশন হিসেবে এটুকু বলি, যে, মাজার ভাঙা যে ফৌজদারি অপরাধ, সেটা প্রতিষ্ঠিত করা গেলেই চলবে আমাদের। এর জন্যে মাজারী, ওয়ালীউল্লাহ, সালাফি, কাউকেই দোষী বা গুনী অথবা মহৎ করতে হয় না।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

জোবাইরুল হাসান আরিফ

চাঁটগাইয়া। রাইটার। কবি। ক্রিটিক।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →