দেবাশিসের ডিজিটাল ড্রয়িং
বাছবিচারের এই আয়োজনে জুলাই-আগস্টের সময়কালের ‘ছবি’ গুলিই আছে। চলমান নানান অকল্পনীয় ঘটনাপ্রবাহের রিফ্লেকশন আছে, সচেতন সিদ্ধান্ত আছে আবার অজ্ঞান বা আনকনসাসও হাজির আছে। অনেকক্ষেত্রে এই আনকনসাস শুধু ব্যক্তিগত না, যৌথও বটে। তবে আমি এখানে কালেক্টিভ আনকনসাস নিয়ে বিস্তারে যাব না। সচেতন সিদ্ধান্ত এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে কিছু বাক্যখরচ করবো। অজ্ঞানের বাছবিচারের কাজটা আপাতত দর্শক-রিডারের দরবারেই থাকুক। আবার গণঅভ্যুত্থানের বিস্তৃত তত্ত্বায়ন বা চিহ্নায়ন করার সাধও নাই। যদিও কিছু ইঙ্গিত থাকলেও থাকতে পারে।
জুলাইয়ের শুরুর দিকেই খেয়াল করছিলাম কোটা সংস্কারের জন্য দাবি উঠছে ঢাকায়। দাবিতো ঠিক না, দাবির মেজাজটা আবদারের। মনে মনে একটু হতাশ এবং রাগও হচ্ছিল। স্বৈরাচার-মাফিয়ার কাছে আবদার কিসের? এই মনঃক্ষুণ্ণ অবস্থায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে ভেতর থেকে সায় দিচ্ছিল না। মনে পড়ে জুলাইয়ের ৮ তারিখে ‘ফ্যাসিস্ট তাড়াও ন্যায্যতা পাও’ এবং ‘বাটপার হটাও সমতা পাও’ নামে দুইটা কাজ করি। শুধু কথার কথা না, কথার সাথে ছেলে মেয়েদের সংগ্রামী শরীরী ভাষাও কল্পনা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এই বিষয়ে আর আগাই নাই। কিন্তু জুলাইয়ের ১৫-১৬ তারিখ নাগাদ পরিস্থিতি ভিন্ন বাঁক নিয়ে সবকিছু বদলে দেয়। হাসিনাশাহীর সেই চিরাচরিত ডিহিউমানাইজিং স্টাইলে দেয়া বক্তব্যে সব বদলে যায়। রাজাকারের ট্যাগ শুনে মানুষের মাথার তার শেষ পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়। “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার।”- স্লোগান শুনে টের পেলাম অবস্থা আগের মতন নাই। দ্রোহের আগুন জ্বলে গেছে। আমারও দ্বিধার বাঁধটা ভেঙ্গে গেলো। এই আন্দোলনের মধ্যে বৃহত্তর দ্রোহের শক্তি টের পাই আর নিজেও সম্পৃক্ত হয়ে যাই। কিন্তু দুই দিন না যেতেই জুলাইয়ের ১৮ তারিখে ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট কারণে বাংলাদেশের সাথে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। শুরু হল অনিঃশেষ অনিশ্চয়তা, আশংকার দিন। এই পুরাটা সময় নিজের কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভরসা রাখতে হয়েছে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা নানা শ্রেণী-পেশার প্রবাসী বাংলাদেশীরা ছাড়া কারো মাথা ব্যাথা ছিল না। নানান উদ্যোগ-আয়োজন-সমাবেশের জন্য কিছু কাজ উন্মুক্ত করে দিতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র আন্দোলনের সাথে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিছুটা হয়তো কাজে লেগেছে। ব্ল্যাক আউটের সময় অনেক টেমটেশন সামাল দিতে হয়েছে। কেউ কেউ অনেক স্বৈরাচারী আকাঙ্ক্ষা প্রচার করতে ফুসলিয়েছেন, কেউ কেউ হাসিনার বিকল্প নাই বলে ভয় দেখিয়েছেন। এসব প্রলোভন-টোপ-ফাঁদ সামাল দিতে হয়েছে। এমন দুর্বল সময়ে, অনিশ্চয়তার মধ্যে অনেকেই খারাপ আচরণ করেছেন। পরিচিত বর্গের কিছু মানুষ হুমকি ধামকি দিয়েছেন, আমি কেন হিজাবি বা মাথায় ঘোমটা দেয়া নারীদের ছবি আঁকছি! আমার কাজের সাথে পরিচয় নাই বোঝাই যাচ্ছে। তারা সকল আর্টিস্টকেই নাদান মনে করেন। যেন আন্দাজে করেছি। গণমানুষের আকুতিতে, গণঅভ্যুত্থানের কল্পনায় কি ‘গণের’ উপস্থাপনা থাকবে না? তাহলে গণঅভ্যুত্থান কোথায়? ৫ আগস্টের আগেই, যতদূর সম্ভব, সীমিত কারিগরি দক্ষতায় যা কল্পনা করেছি, সেটাই মূর্ত করার চেষ্টা করেছি। গণঅভ্যুত্থান শব্দটাও নানান মানুষের চেষ্টায় জন পরিসরে চাউর ছিল। গণঅভ্যুত্থান যে হবে সেটা কে জানতো। আকাঙ্ক্ষায় হয়তো ছিল। তাছাড়া ঘটনাবহুল প্রায় ২০ দিনের গতিপ্রকৃতির ধাক্কা ছবিগুলিতে পড়েছে নিশ্চয়ই। নানা শ্রেণী-পেশা-লিঙ্গের মানুষের বহুত্ববাদী কল্পনাটা শুধু কথার কথা না, এই গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র একটু তত্ত্বায়ন বা বাছবিচারের চেষ্টা করলেই ব্যাপারটা বোঝা যাবে। আশা করি নানান পেশাজীবী এবং ডিসিপ্লিনের কামেল লোকজন কাজটা করবেন, নিয়তির কাছে সবটা ছেড়ে দিবেন না।
আয়োজকেরা যে ছবিগুলি এখানে জড়ো করেছেন, সবগুলিই ডিজিটাল ড্রয়িং, এগুলিকে শুধু জুলাই-আগস্টের প্রেক্ষাপটে রেখে পড়া গেলেও তাতে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে তৈরি হওয়া অভ্যুত্থানের পূর্বশর্তগুলি পুরাপুরি বোঝা যাবে না। আমি যেমন অভ্যুত্থান হবে ভেবে কাঁটায় কাঁটায় কাজ করি নাই ঠিক তেমনি বাংলাদেশের মানুষজনও অভ্যুত্থান হবে হবে ভেবে প্রতিটা প্রদক্ষেপ নেন নাই। প্রতি মুহূর্ত, প্রতিটা নিপীড়নের উদ্যোগ নতুন নতুন প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করেছে। ব্যাপারটা যেমন অর্গানিক আবার গত ১০-১৫ বছর ধরে জমে ওঠা নানান অন্যায়-অবিচারের ফসল। যেহেতু গত পাঁচ বছর ধরে এই সিরিজটা করছি, আসল তৎপরতাই প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত হওয়া, লক্ষ্যবস্তু মূলত কাঠামো, ক্ষমতা সম্পর্কের অসম অবস্থা এবং নতুন সিভিল ইমাজিনেশন, তাই এই আর্ট প্রজেক্টকে বাংলাদেশের বৃহত্তর বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার অংশ হিসাবে দেখা উচিত। ব্যক্তিগত আর্টিস্টকে বেশী উচ্চকিত না করাই ভাল হবে।
২০২০ সাল থেকে সচেতনভাবে কাজ শুরু করলেও সব কিছু যে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক করে করেছি এমন না। ছবিগুলিকে আমি ড্রয়িং-ই মনে করি। অনেকে পোস্টার বলেন, অনেকে ইলাস্ট্রেশন। সমস্যা নাই। নান্দনিক অনুপ্রেরণা নিয়েছি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অপরাপর দেশগুলির রাজনৈতিক পোস্টার, ব্যানার, সিনেমার প্রচারচিত্র, প্যাকেজিং ডিজাইন, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি থেকে। অজ্ঞানে আরও অনেক অনুপ্রেরণা থাকতে পারে। মোটের উপর হাই-আর্টের ছোঁয়াচ এড়ানোর সচেতন চেষ্টা ছিল। অস্বীকার করার কিছু নাই। গণপরিসর থেকেই কাঁচামাল নিয়েছি। কথা নিয়েছি মানুষের মুখের বুলি থেকেই। কথাগুলি আবার শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই না, রংরেখার মতই সামগ্রিক চিত্রকর্মের প্রাথমিক উপাদন হিসাবে বিবেচনা করেছি। এর ফলে আমার নিজের মতন একটা খিচুরি নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে। অনেক চরিত্রের উপাদানের একটা মিলমিশ হয়েছে নিশ্চয়ই। পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়ে আবার বলছি, এই কাজগুলিকে ব্যক্তি আর্টিস্টের ব্যক্তিগত রোজগার বা আর্টিস্টিক সাবলাইম হিসাবে না দেখে বাংলাদেশের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা, চলমান নানান বুদ্ধিবৃত্তিক-নাগরিক আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্যোগের অংশ হিসাবে দেখলে ভাল হয়।
ওয়েস্টল্যান্ড, মিশিগান
সেপ্টেম্বর, ২০২৪
দেবাশিস চক্রবর্তী
Latest posts by দেবাশিস চক্রবর্তী (see all)
- দেবাশিসের ডিজিটাল ড্রয়িং - সেপ্টেম্বর 13, 2024