শহিদী তামান্না – ইয়াহিয়া সিনওয়ার Featured
[এমন একটা সময় পার করতেছি যখন আমাদের দেশে একটা গণহত্যা ঘইটা গেছে। এবং ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যা চলতেছে৷ প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে ফিলিস্তিনের ছবি, ভিডিও নানানকিছু আমাদের সামনে আইসা পড়ে। আমরা কথা বলতে থাকি। আমাদের আন্দোলনেও আমরা ফিলিস্তিনি পতাকা উড়াইছি। গাজার গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বইলা যাইতেছি৷ অনেকগুলা দিন ধরে আমরা ফিলিস্তিনে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে নানানভাবে দাঁড়াইছি। মিছিল, কবিতা, গান থেকে শুরু কইরা নানান এক্টিভিজম চালাইতেছেন কবি, লেখক এক্টিভিস্টরা। এই মর্মান্তিক, বর্বর হত্যাকাণ্ডের সামনে এইসব দাঁড়ায়া থাকা আসলে কতটুক কাজে আসবে আমরা জানি না। কিন্তু আমরা কথা বলতেছি এইটাই আপাতত ফ্যাক্ট।
গত ১৬ অক্টোবর, ২০২৪ এ হামাসের প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার ইজরায়েলি হামলায় শহিদ হন। তার শেষ সময় পর্যন্ত লড়াই চালায়া যাওয়ার ভিডিও বের হয় এবং ভাইরাল হয়ে যায় যা মানুষের ভিতর ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি করে৷ আমি কয়েকদিন আগে টিকটকে পোস্ট করা একটা ভিডিও পাই ফিলিস্তিনি একটিভিস্ট paliNada- এর। যিনি ইয়াহিয়া সিনওয়ারের লাস্ট উইল অনুবাদ করছেন আরবি থেকে (যেইটা তাঁর শহিদ হওয়ার পর সামনে আসে)। আরবিতে বলা হয় ওসিয়ত। ভিডিও দেখার পর আমি মূলত খুঁজে বাইর করি এই রাজনৈতিক মেনিফেস্টো যেইটা ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল ২৪ অক্টোবর পাবলিশড করে। এরপর workers world জার্নাল, প্রেস টিভি এবং নানান জায়গায় পাবলিশড হয় এবং ব্যাপকভাবে ছড়ায়া পড়ে৷ এই ওসিয়ত এত বেশি ইন্সপায়ারিং এবং এর ভাষা এত শক্তিশালী এবং পোয়েটিক আমি শখের বসেই প্রথম কয়েকটা লাইন অনুবাদ করি। এবং পরে ভাবি পুরাটাই অনুবাদ করার৷ আমার মনে হইছে, এই উইল যেকোনো মানুষের পড়া জরুরি। এইখানে দেশ ও তার নাগরিকের ইনসাফের জন্য যে লড়াইয়ের কথা বলা হইছে তা খালি ফিলিস্তিন না যেকোনো মজলুম মানুষরে হিম্মত দিবে। এই জায়গা থেকেই আমার এই কাজ করা।]
আমি ইয়াহিয়া, এক শরণার্থীর সন্তান—যে নির্বাসনরেই বানাইছে তাঁর মাতৃভূমি এবং খোয়াবরে বদলায়া ফেলছে চিরকালীন লড়াইয়ে।
এই কথাগুলা লেখার সময় জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনে পড়তেছে! গলিতে দৌড়ায়া বেড়ানোর শৈশব থেকে জেলখানার দীর্ঘ বছরগুলা। মনে পড়তেছে, এই জমিনের বুকে ঝরে পড়া প্রতিটা রক্তের ফোঁটা’র কথা।
আজাদির দিকে দীর্ঘ সফর
আমি ১৯৬২ সালে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মাই, ফিলিস্তিন তখন টুকরা টুকরা স্মৃতি হয়া গেছে এবং রাজনীতিবীদদের টেবিলে হইছে বিস্মৃত মানচিত্র। আমি তো সেই ব্যক্তি যার জীবন আগুন ও ছাইয়ের ভিতর গড়া, এবং আমি জীবনের পয়লাই বুঝছিলাম যে জালিমের দখল মাইনা নেয়া মানে আমৃত্যু কয়েদখানা। আমি সেই ছোট্টবেলা থেকেই জানি, এই জমিনে বাঁইচা থাকা স্বাভাবিক ঘটনা না, এবং এখানে যারা জন্মায় তাদের অন্তরে ধারণ করতে হয় একটা অবিচ্ছেদ্য হাতিয়ার; তাদের বুইঝা নিতে হয় আজাদী এক দীর্ঘ সফর। তোমাদের কাছে আমার ওসিয়ত সেই শিশুর কাছ থেকে শুরু হইতেছে, যে প্রথম পাথর ছুঁড়ছিল জালিমের দিকে, সে জানছিল পাথরই পয়লা শব্দ যা আমরা উচ্চারণ করি এমন এক দুনিয়ার মুখের উপর যে আমাদের জখমের সামনে বোবা হয়ে থাকে।
গাজার গলিতে আমি শিখছি, একজন মানুষের কদর তার বয়স দিয়ে হয় না, সে তার মাতৃভূমির জন্য কী কুরবানি দিছে তা দিয়ে মাপা হয় তার উচ্চতা। আমার জীবন ছিল এই : জেলখানা ও যুদ্ধ, জখম ও তামান্না। ১৯৮৮ সালে আমি প্রথম জেলে যাই এবং আমারে যাবজ্জীবনের সাজা শোনানো হয়, কিন্তু ডর কী জিনিস আমি জানি না। সেই আন্ধার ঘরের প্রতিটা দেয়ালে আমি একটা জানলা দেখতে পাইতাম যা দূর দিগন্তের দিকে খুইলা যাইত এবং প্রতিটা গরাদের মধ্যে এমন এক আলো যা আমাদের আজাদির রাস্তারে করতো রোশনাই। কারাগারে আমি শিখছি, সবুর খালি গুণই না বরং হাতিয়ার, একটা তিতা হাতিয়ার , যেন ফোঁটায় ফোঁটায় এক অসীম সমুদ্র পান করা।
“যা তোমার হক তার জন্য কখনো আপোস কইরো না”
তোমাদের প্রতি আমার ওসিয়ত: কয়েদখানারে ডরায়ো না, কারণ আমাদের আজাদির দীর্ঘ সফরে এটা একটা হিস্যা মাত্র।
কারাগার আমারে শিখাইছে, স্বাধীনতা কেবল চুরি করা হক না, এটা এমন এক কনসেপ্ট যা জখম থেকে জন্মায় আর তার চেহারা গইড়া ওঠে সবুর দিয়ে। ২০১১ সালের “ওয়াফা আল-আহরার” বন্দি বিনিময় চুক্তিতে জেলখানা থেকে বাইর হওয়ার পর আমি আর আগের মতো ছিলাম না। আমি আরো মজবুত হই, এই ঈমানের সাথে যে আমরা যা করতেছি তা কেবল সাময়িক লড়াই না, এ আমাদের তকদির; এমন এক তকদির যা আমরা আমাদের রক্তের শেষ বিন্দু দিয়া ধরে রাখি।
তোমাদের কাছে আমার ওসিয়ত এই, তোমরা অটল থাকবা, তোমাদের ইজ্জত ও খোয়াবকে ধরে রাখবা যা কখনো মরে না। দুশমন তো চায়ই আমরা লড়াই ছেড়ে দিই, আমাদের মনজিলকে সীমাহীন আপোসে বদলায়া ফেলি, কিন্তু আমি তোমাদের বলি: “নিজের হকের জন্য আপোস কইরো না”। তারা তোমাদের অবিচল দাঁড়ায়া থাকারে তোমাদের হাতিয়ারের চেয়েও বেশি ডরায়। প্রতিরোধ শুধু মামুলি হাতিয়ার না যা আমরা ধইরা থাকি , বরং এইটা ফিলিস্তিনের জন্য আমাদের সমস্ত নিঃশ্বাসে মিশে থাকা মহব্বত। এটাই আমাদের মর্জি সমস্ত অবরোধ আর আগ্রাসনের পরেও আমরাই টিইকা থাকবো।
আমার ওসিয়ত এই, তোমরা শহিদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করবা না, যারা আমাদের জন্য এই পাথুরে পথ রেখে গেছেন। তারা তাদের খুন দিয়ে আজাদির এই পথ তৈয়ার করছেন, তাই রাজনীতিকদের হিসাব বা কূটনীতির ছলচাতুরীতে সেই কুরবানি বিফলে যাইতে দিও না। আমরা আমাদের মনজিলের পথেই থাকব যা আমাদের প্রথম প্রজন্ম শুরু করছিল, এবং কোনো কিছুর বদলেই আমরা এইখান থেকে সরে দাঁড়াব না। গাজা ছিল প্রতিজ্ঞার রাজধানী এবং চিরকাল তাই থাকবে। পুরা দুনিয়া আমাদের খেলাফ চইলা গেলেও ফিলিস্তিনের হৃদয় নিঃশ্বাস নেওয়া বন্ধ করবে না।
“বন্দী অবস্থায় প্রতিদিন আমি আমার মানুষের ব্যথা ফিল করতাম”
২০১৭ সালে আমি যখন গাজায় হামাসের নেতৃত্বে আসি, এইটা শুধু ক্ষমতার অদল-বদল ছিল না, বরং সেই প্রতিরোধের সিলসিলা যা শুরু হইছিল পাথর দিয়া এবং রাইফেলের সাথে এখনো জারি আছে। প্রতিদিন আমি আমার জনগণের যন্ত্রণা ফিল করতাম, এবং জানতাম আজাদির পথে ফেলা প্রতিটা কদমের দাম চুকাইতে হয়; কিন্তু তোমাদের বলি, “হাতিয়ার ফেলে দেয়ার দাম আরও কয়েকশোগুণ বেশি।” তাই নিজের জমিনরে এত মজবুতভাবে আকঁড়ে ধরো যেমন শেকড় মাটিরে ধইরা থাকে, কেননা কোনও বাতাসই সেই জাতিরে উৎখাত করতে পারে না যারা জিন্দেগিরে বাইছা নিছে।
আল-আকসা প্লাবনে (২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরালের ভিতরে ঢুকে একটা নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। এই অভিযানের নাম দেয় তারা ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’), আমি কোনও দলের বা মুভমেন্টের নেতা ছিলাম না, বরং প্রত্যেক ফিলিস্তিনির আওয়াজ ছিলাম, যারা আজাদির খোয়াব দেখে। আমি এই ঈমানের সাথে অটুট থাকছি যে প্রতিরোধ কেবল একটা চয়েজ না বরং জিম্মাদারি। আমি চাইছি এই লড়াই ফিলিস্তিনি জিহাদের নতুন অধ্যায় হোক, যেখানে তামাম দল একত্র হবে এবং ঐ দুশমনের খেলাফ সবাই এক পরিখায় দাঁড়াবে যে বৃদ্ধ ও শিশু এবং গাছ ও পাথরের মধ্যে কোনোই ফারাকই করে না। আল আকসা জোয়ার ছিল শরীরের যুদ্ধের আগে রুহের যুদ্ধ, এবং অস্ত্রের যুদ্ধের আগে নিয়তের যুদ্ধ। আমি যা রাইখা যাইতেছি তা কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না, বরং প্রত্যেক ফিলিস্তিনিই এইটার ওয়ারিশ, যারা আজাদির খোয়াব দেখে, প্রত্যেক ওই মায়ের জন্য যিনি তাঁর শহীদ ছেলেরে নিজের কাঁধে বহন করছেন, প্রত্যেক বাপের জন্য যিনি নাফরমানের গুলিতে খুন হওয়া মেয়ের জন্য ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন।
আমার শেষ ওসিয়ত এই, সবসময় মনে রাখবা প্রতিরোধ বেকার কিছু না, না কি শুধু শুধু একটা গুলি ছোঁড়া; বরং ইজ্জত ও গৌরবের সাথে বাঁইচা থাকার এক জীবন । জেলখানা ও অবরোধ আমারে শিখাইছে যুদ্ধ দীর্ঘ এবং মুশকিল সফর, আমি এটাও শিখছি যে যারা হাতিয়ার ফালায়া দিতে অস্বীকার করে, তারা নিজেদের হাতেই ম্যাজিক সৃষ্টি করে। দুনিয়ার কাছে ইনসাফ আশা কইরো না কারণ আমি বাঁইচা থেকে দেখছি দুনিয়া আমাদের জখমের সামনে বোবা হয়ে থাকে। ইনসাফের জন্য বসে থাইকো না, নিজেই ইনসাফ হও। ফিলিস্তিনের খোয়াবরে অন্তরে ধারণ করো। প্রতিটা জখমরে হাতিয়ার বানাও এবং চোখের পানির প্রতিটা ফোঁটারে আকাঙ্ক্ষার উৎস বানায়া ফেলো।
শেষ ওসিয়ত
আমার ওসিয়ত এই : হাতিয়ার রাইখা দিও না, পাথর ফালায়া দিও না, শহিদদের ভুইলা যাইয়ো না এবং যে খোয়াব তোমার হক তার সাথে সমঝোতা কইরো না।
আমরা আমাদের জমিনে, আমাদের অন্তরে এবং আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে থাকব বইলাই এইখানে আছি।
আমি তোমাদের কাছে ফিলিস্তিন সঁপে যাইতেছি, যে জমিনরে আমি আমার মৃত্যু অবধি ভালোবাইসা গেছি এবং সেই স্বপ্নকে নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াইছি একটা পাহাড়ের মতো যা কখনো ঝুঁইকা যায় না।
আমি যদি পইড়া যাই, আমার সাথে পইড়া যাইয়ো না , বরং সেই পতাকারে ধইরা থাকো যা কখনও পড়ে না এবং আমার রক্ত দিয়া একটা সেতু বানাও আমাদের ওয়ারিশদের জন্য যারা আমাদের ছাই থেকে আরো মজবুত হয়ে উঠে দাঁড়াবে।
ভুইলা যাইয়ো না যে মাতৃভূমি কেবল বলার জন্য কোনো কাহিনী না, বরং বেঁচে থাকার জন্য সবথেকে জরুরি সত্য এবং এই ভূমিতে জন্মানো প্রত্যেক শহিদের সাথে আরও এক হাজার প্রতিবাদী জন্মায়।
যদি জোয়ার আবার ফিরা আসে এবং আমি তোমাদের ভেতর না থাকি, জানবা, আমি ছিলাম আজাদির ঢেউয়ে পয়লা ফোঁটা এবং আমি শুধু এইটা দেখার জন্যই বাঁইচা ছিলাম যে তোমাদের সফর জারি আছে।
তোমরা জালিমের গলায় একটা কাঁটা হও, একটা প্লাবন হও যা পিছু হটতে জানে না, এবং ওই ওয়াক্ত পর্যন্ত থাইমা যাইয়ো না যতক্ষণ না দুনিয়া স্বীকার করে যে আমরাই আসল হকদার এবং আমরা খালি খবরে প্রচার করার জন্য মামুলি সংখ্যা না।
[ইয়াহিয়া সিনওয়ার, জন্ম ২৯শে অক্টোবর, ১৯৬২; শহিদ হওয়ার তারিখ ১৬ই অক্টোবর, ২০২৪]
রুম্মানা জান্নাত
Latest posts by রুম্মানা জান্নাত (see all)
- শহিদী তামান্না – ইয়াহিয়া সিনওয়ার - নভেম্বর 9, 2024
- কোনো এক দূরবর্তী উত্তরবঙ্গীয় শীতের কথা ভেবে— - ডিসেম্বর 14, 2023