২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিভীষিকাময় নির্বাচন ও কিছু অভিজ্ঞতা
অভিজ্ঞতা জঘন্য, কেঁদেছি নিজের অক্ষমতায়।
আমি প্রিজাইডিং অফিসার ছিলাম। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়েও পাইনি, যদিও তখনো জানতাম না কি ঘটতে যাচ্ছে। ট্রেনিং-এর সময়ও প্রশাসনের হাবেভাবে মনে হয় নি এমন ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। আমার কিছুই করার ছিলনা। আমার কেন্দ্রে ভোটার ছিল ২৩৮৭ টা। ওরা রাতেই (২৯ ডিসেম্বর,২০১৮) ১৫০০ ব্যালটে সীল মেরেছে। দিনেও জোর করে আরো ৪০০ ব্যালট নিয়া নিজেদের লোক দিয়ে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়েছে। শুধু এভাবেই ওরা ভোট নিয়া নেয় ১৯০০; এই কেন্দ্রে ধানের শীষ পেয়েছে মাত্র ২৭ ভোট, তাতেই তাদের মাথা গরম। এই ২৭ জন কারা, এটাও তাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে!
আসল কথা বলি: এসপি, ডিসি, নৌকার প্রার্থী এরা সকলে বসে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এভাবেই ভোট হবে। সকালে আর কোন লুকোছাপা ছিলনা। ছিলনা কোন গোপনীয়তার ব্যাপারও। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা প্রশাসন ও উচ্চপর্যায়ের পুলিশ অফিসারদের প্রশ্রয়ে ও সম্মতিতে খুব নিরাপদে, উৎসাহ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট ডাকাতি করছে, কিছুই করার ছিলনা অন্য কারো! তাদের সামনে আমরা সকলে ছিলাম অসহায়।
আমাকে ইউএনও, এসপি, ডিসি সবাই ফোনে কল দিয়েছে। একইভাবে অন্য কেন্দ্রে দায়িত্বরত আমাদের সহকর্মীদেরও কল দিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, কি করা যাবে না এবং কাদের কথা শুনে কাজ করতে হবে।
বলা হয়েছিল, স্থানীয় নেতারা যেভাবে বলে ঠিক সেভাবেই সহযোগিতা করতে হবে। একই মিটিং-এ এসপি, ডিসি ও প্রার্থী বসে থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ফোনে কল দিয়া বেশীর ভাগ ব্যালট রাতেই আওয়ামী লীগের কর্মীদের দিয়ে দিতে বলছিল। তা না করলে, আমাদের সমস্যা হবে বলে শাসিয়েছিল!
আমাদের এখানে সব কেন্দ্রে একই ঘটনা ঘটছে। আমার কাছ থেকে জোরাজুরি করে প্রথমে ৬০০ ব্যালট (৬ বান্ডিল) নিয়া নেয় । সীল শেষে আবার চাইতে আসে ব্যালট, আমি নিষেধ করায় ফোনের পর ফোন। পরে আরো ৬ বান্ডিল নেয় তারা । সেগুলো সীল মারার পর আবার আসে। এবারো দিতে চাই নাই বলে স্থানীয় আওয়ামী নেতা হুমকি দেয়। তার পর আরো ৩ বান্ডিল দেই, মোট ১৫০০ (পনের শ’)। এই সকল কর্মীদের নাকি এসপি, ডিসি বলে দিয়েছে, যে কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, সে কেন্দ্রের দায়িত্বশীল গ্রুপ পুরস্কার পাবে। ওই নেতা রেগেমেগে চিৎকার করে বলে, আপনি আমাকে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করতে চান?
এই সব কিছুই প্রশাসনের সহায়তায় হয়েছে। দুই দিনের অসহনীয় ও অসম্মানজনক ঘটনার ভেতর দিয়ে কষ্টকর বিপুল অভিজ্ঞতা আমাদের সকল সহকর্মীদের হয়েছে। এমন কি, আমাদের নারী কলিগদের একই ধরণের ঘটনার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে! সবাই একে অন্যের ঘটনা আমরা জানি। আজকে আরো জানছি!
আমি মাঝখানে আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্টদের কয়েকজনকে সরিয়ে দিয়ে, ইয়াং ভোটারদের জোর দিয়ে বলছি, তোমরা যাকে ইচ্ছে তাকে ভোট দাও, এদের কথা শুনবা না। তাতেও লাভ হয়েছে বলে মনে হয় নাই।
আমাদের এক নারী সহকর্মীকে নৌকা প্রার্থীর কেউ একজন ধমক দিছিল। ঘটনাটা ডিসি’কে জানিয়ে প্রতিকার চাইলে তিনি বলছেন, কোন হেল্প পাবেন না, বিপদ তৈরী করছেন কেন? প্রশাসন ও পুলিশের জুনিয়র কর্মকর্তারা আমাদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকালেও তারাও ছিল অসহায়। আমার সাথে থাকা পুলিশ সদস্যকে এসপি ও ওসি যে অর্ডার দিয়েছিল, তাতে সে হতবাক হয়েছিল! তার চোখের কোণে আমি দু’এক ফোঁটা জলও দেখেছি।
প্রশাসনে আমার নিকট আত্মীয় আছে। সে আমাকে আগে থেকেই সতর্ক করে বলেছে, নির্বাচন নিয়ে কোন ঝামেলা করো না। এসপি, ডিসি, ওসি যা বলবে সে অনুযায়ী কাজ করো! সবাইকে ম্যানেজ করা হয়ে গেছে। তুমি-আমি কিছুই করতে পারবো না। এভাবেই হবে ভোট সারাদেশে।
আরো বহু ছোট ছোট অভিজ্ঞতা আছে। সারাদেশে সবার হয়েছে এই অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাটা ধ্বংস হয়ে যেতে দেখছি, এর মৃত্যু ঘটেছে আমাদের সকলের চোখের সামনে!
প্রশাসনে আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের উপরের পর্যায়ে কি ঘটেছে শুনলে আৎকে উঠবেন। বিভিন্ন জেলায় এসপি, ডিসি সাহেব, ডিজিএফআই, এনএসআই, পুলিশের অফিসাররা একসাথে বসে, সবাই মিলে মিটিং করে প্ল্যান করছেন। নিশ্ছিদ্র প্ল্যান করতে জেলায়, জেলায় ডিসিরা ডিনারের দাওয়াত দিয়ে ২/৩ বার মিটিং করছে। জেলা পর্যায়ের সব অফিসারদের একই অর্ডার দেয়া হয়েছে। তারপর সব প্রিজাইডিং অফিসারদের ডাকা হয়েছে, তাদেরকে ব্যালট দিয়ে দিতে বলা হয়েছে আগের রাতেই। প্রশ্ন করেছিল কেউ কেউ তাহলে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ভোট কি ভাবে চলবে! জবাবে বলা হলো, প্রত্যেক গ্রুপের নাস্তার জন্যে টাইম ওয়েস্ট করতে বলতে হবে। আসিস্টেন্ট প্রিজাইডিং অফিসাররা নাস্তা করবে, তাই ভোট কিছুক্ষণ স্থগিত থাকবে। তারপর পোলিং অফিসাররা নাস্তা করবে, তাই ভোট স্থগিত। আনসারররা নাস্তা করবে, তখন আবার ভোট স্থগিত। তারপরেও ভোটারের চাপ সৃষ্টি হলে নৌকার কর্মীরা নিজেদের মধ্যে মিছেমিছি মারামারি করবে, সে করণে বিজিবি ডাকা হবে, ওরা আসার পর এক/দেড় ঘন্টা ভোট স্থগিত রাখতে হবে। সবশেষে ভোট গুনে নৌকাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করে চলে আসতে হবে!
গতকাল এডমিনের জুনিয়ার অফিসারদের সাথে মিটিং করে ডিসি সাহেব সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে বলছেন, তোমাদের হয়তো মন খারাপ হয়েছে আমার কাজে। বাট এটা না করলে বিএনপি ক্ষমতায় আসতো। দেশে খুনাখুনি হতো, লক্ষ লক্ষ লোক মারা যেত। দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হতো। ২০৪১ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন হোক, দেশ একটা পর্যায়ে আসুক, জনগণ কাকে ভোট দিতে হয় শিখুক, তারপর তারা ভোটাধিকার পাক। ভোটের অধিকার পাবার আগে ভোট বুঝতে হয়।
সব জেলাতেই একই অবস্থা। তবে, আমাদের এখানে সব প্রিজাইডিং অফিসারকে আলাদা আলাদা করে ডেকে খাম (টাকার) দিয়ে পৃথক ভাবে বলে দেয়া হয় নাই। অন্য এলাকায় সকলকে ডেকে একসাথে বসিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, যাতে ভুলে না যায়, সেজন্য আবার ফোন করেও বলে দেয়া হয়েছে রাতে।
…
[বর্ণিত অভিজ্ঞতা জগলুল আসাদের। পেশায় তিনি শিক্ষক ৷ তাঁর সাথে মেসেঞ্জারে এক মানবাধিকার কর্মীর সাথে আলাপ ছিল এটি। ২৯ ডিসেম্বর রাত ও ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮-এর ঘটনা। এই অভিজ্ঞতা অন্য একজনের আইডি থেকে ২ জানুয়ারি, ২০১৯-এ ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল।]
জগলুল আসাদ
Latest posts by জগলুল আসাদ (see all)
- ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিভীষিকাময় নির্বাচন ও কিছু অভিজ্ঞতা - ডিসেম্বর 29, 2024
- ” ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন”: বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ক্যাপ্টেন মাজহারের স্মৃতি - আগস্ট 31, 2024