সাফা প্রামাণিকের কবিতা Featured
…
স্থির স্বপ্নে ৷ আমার ঘুমের ওপাড়ে ৷ নভেম্বরের শীতে ৷ কেমন শোক করবেন ৷ শহিদদের নাম ৷ স্বপ্নের প্যাটার্ন ৷ বিষ্টি নামলো অনেক বছর পর ৷ আফগানি নাম ৷ রাতের ট্রেনে ৷ আংটি বদল ৷
…
স্থির স্বপ্নে
একটা স্বপ্ন দেখে শেষ করার পর পরই
আমার ঘুম ভাঙে—
আর তারপর দেখি চোখের স্ক্রিনের ভিতর দৃশ্যগুলা
একে একে পার হয়
বিষাদ বিষণ্ণ হরিনের মত ৷
যোগাযোগ কি কখনো শেষ হয় বলো?
স্বপ্নে ঠিক দেখা হবে, জানো তুমিও
আমাদের আত্মা থেকে ছিটকে বের হওয়া
সেইসব নাবাল স্মৃতি
বিষ্টির আদর ছাড়াই বাড়তে থাকা তেজি ঘাসের মত
তোমার রিদয়ে পৌছেছিল ৷
লিভিংরুমের বাতাসে গোঙানি ছড়ানো স্বর আর ইতস্তত টুকরা টুকরা টান ধরা কান্না
তোমার রিদয়ে পৌছেছিল ৷
এই আজকে সকালেই,
চোখ মুছতে মুছতে তোমার সুন্দর সুশ্রী মোলায়েম চেহারাটা স্বপ্নের দৃশ্য থেকে আরো একবার মনে পড়ে যাবে—
১৭ ডিসেম্বর ‘২৪
আমার ঘুমের ওপাড়ে
আমার ঘুমের ওপাড় থেকে যে শব্দের দোলানি
আমার কানে এসে লাগত
সেখানে আমি আমার মায়ের গলা শুনতাম
আমি শুনতাম—থেমে থেমে একটা মৃদু ছন্দের আওড়ানি
এক তালে বাতাসের সাথে বেজে বেজে আসত
আমার মাথার কাছে এই উত্তুরে জানলার শিকের ওপর—
যেনো একদল সুফি তাদের দরগা থেকে ছড়ায়ে দিচ্ছে খোদার জিকিরের খুশবু আর বাতাসের ফেরেশতা তাকে আমার কান পর্যন্ত পৌছে দিচ্ছে উড়ে আসা পাতলা জরিদার পর্দার মত
আমার এখনো কিভাবে যে মনে পড়ে যায় ! পাচতলা ছাদের বাসাটাতে আমরা ছিলাম যখন সেই সময়ের কথা
আমি ত কখনোই আগে জাগতে পারিনাই তাহাজ্জুদে!
আমার মায়ের মোনাজাতে ঘরের ভিতর বাতাসের যে গোঙানি উঠত সেই শব্দ আমার ঘুম ভাঙে দিত প্রতিদিন
আমি চোখ মেলে দেখতাম তার নীল মখমল জায়নামাজের
সুতার পাড় মেঝেতে বিছিয়ে আছে
বিগলিত প্রার্থনার মত
আর সেখানে একটা নাবাল আত্মা সেজদার ভিতর শুধুই হাহাকার করছে—
তখন আমার মনে পড়ে যেত তুরে সিনার কথা
তখন আমার মনে পড়ে যেত সেই রোশনির কথা
যে উজ্জ্বল রোশনি আমার নবী মূসা দেখেছিলেন সফরের পথে—
আমি কতটুকু আর ডাকতে পারলাম খোদা তোমাকে? আমার ফজর ত শুধু কাযাই হয়ে যায়
আমার মায়ের যেই তাসবি অন্ধকারেও জ্বলে উঠত আমি আমার কবরে সেই তাসবিটাই শুধু আমি নিতে চাই!
২১ নভেম্বর ‘২৪
নভেম্বরের শীতে
দুনিয়াতে নতুন করে শীত আসতেসে আবার
এইখানে আমার উঠানে মায়ের হাতে কাচা কাপড়ের মত পরিষ্কার-চকচকা রোদ ওঠে প্রতিদিন—
প্রতিদিন যেখানে ছিটানো ছিটানো মিহি হাওয়া আর মখমল রোদের আচ আমাকে মনে করায়
তোমার পিরিতের আলাপ
সেখানে তেলাকুচা ফোটে পালানের ঘাসের ওপর—
ডাকলে তোমার পিরিতে সাড়া ত দিব না রে জান!
তবুও দিলে একটা সামান্য যখমের দাগ কখনো হয়ত বোঝা যাবে—
ভালো ত বাসতেই হতো তোমারে
যেনো ইচ্ছা করেই খুলতে পারি নিকাবের গিট
ভালো ত বাসতেই হতো রে জান!
যেনো ছোয়ার অনুভূতিতে ছড়ায়ে পড়ে স্বাদ
আর শরিল থেকে বের হয় পরিতৃপ্তির ঘ্রাণ
ভালো ত বাসতেই হতো তোমারে—
এমনই এক শীত কালে আমাদের হাসগুলা তাদের নতুন পাখায় ওড়া শিখতে শুরু করে আর কুমরুলের পানি শুকায়ে বের হয় নতুন চড়া—
৯ নভেম্বর ‘২৪
কেমন শোক করবেন
শোক যদি করতেই হয়
সেই রিকশাঅলা মামার জন্যে করেন
যার দুই পায়ে করা হইলো অজস্র গুলি
দুইটা পা’ই পইচা গেলো তার
সে কি বাচবে এই পচা পা নিয়া?
সে দুনিয়াতে কেমনে হাটবে আর?
পচা পায়ের ঘা শরিলে আরো ছড়ায় যদি
সে কি একটা খোড়া মানুষ হয়েও বাইচা থাকবে?
অথচ তার বৌটা পোয়াতি ছিল
হয়ত ঘরে একলা’ই ছিল সে
সে কি খাবে? আর তার রেহেমের ভ্রুণটা?
দিন কেমনে যাবে তার?
বাচ্চা পয়দা হবার পর
সে কিভাবে বলবে তার পইচা যাওয়া পায়ের কথা?
নাকি বাচ্চা কথা বলার আগেই মৃত্যু তারে রেহাই দিবে
তার বাচ্চার সওয়ালের মুখ থেকে?
শোক যদি করতেই হয়
বাইশ বছরে বিধবা হওয়া
সেই নারীর জন্যে করেন
যার একটা মেয়ে বাবু আছে
একটা ছোট্ট মেয়ে বাবু ৷
১৫ আগষ্ট ২৪
শহিদদের নাম
তোমাদের নামগুলা ক্ষোদিত করা হবে
আমাদের আত্মার ভিতর
আমাদের আত্মার ভিতর দেখো তোমাদের শববাহী ফেরেশতাদের জমায়েত হইতেছে—
আমাদের শহরের দেয়ালে দেয়ালে
আর বসত বাড়ির প্রধান ফটকে
আমরা গ্রাফিতি করসি
তোমাদের হত্যার প্রতিবাদে—
এশিয়া থেকে ইউরোপ আর ইউরোপ থেকে আফ্রিকায়
আমরা জানায়ে দিব তোমাদের খুনির পরিচয়
তোমরা,
যারা মিছিলে গেলা
তারা সবাই ত আর ফিরলা না
কেউ কেউ চোখে ঢুকাইলা টিয়ারশেলের ধূমা আর
বুক পিঠ ঝাঝরা করে
কেউ কেউ উড়ে চইলা গেলা আকাশে ৷
হলুদ পাখির আত্মা হয়ে উইড়া গেলা
বেহেশতে খুশবুদার পানিতে গোসল করলা
ফেরেশতাদের হাম্মামে—
গায়ে পিনলা এমন জরিদার জামা
যার ঝলকানি দেখে মনে হয়
দুনিয়ার সব খুনিদের চোখ আন্ধা হয়া যাবে—
তোমাদের নামগুলা আমাদের জানের ভিতর
বিলাপ তোলে একটানা সুরের মত
তোমাদের নামগুলা আমাদের দরদ-জমা বুকের ভিতর
ছেলে মরা মায়ের শোকের মাতম
তোমাদের নামগুলা আমাদের কবিতার ভাজে ভাজে
আর খোদার আরশে লেখা হয়ে গেছে—
১৩ আগষ্ট ২৪
স্বপ্নের প্যাটার্ন
মৃত্যুভয় আমাদের স্বপ্নের প্যাটার্ন চেঞ্জ করে দিচ্ছে
আমরা এখন প্রেমিকের উজ্জ্বল ত্বক স্বপ্নে দেখিনা
দেখিনা ভবিষ্যতের ইঙগিতসূচক কোনো স্বপ্ন!
চোখ ত বন্ধ হতে চায়না আরামে
আমাদের আরাম ছিলোনা শরিলে কারোই
কখনও ক্লান্তিরও অধিক কাতর হয়া
চোখ বুজে আসত,
চোখ বুজে আসত মনের ভুলে—
কেউ বা চায় বলো স্বপ্নের ভিতর পুলিশের সাথে বাহাস করতে
কেউ বা চায়, তার ঘর দুয়ার, জামা কাপড় আর মোবাইলের লক ফোল্ডারে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চলুক
কেউ বা চায়?
মৃত্যুভয় আমাদের স্বপ্নের প্যাটার্ন চেঞ্জ করে দিছে!
১লা অগাস্ট ২৪
বিষ্টি নামলো অনেক বছর পর
ধাম কইরা বিষ্টি নামলো, আকাশ গজরাইলো
আর সারা ঘর একটা কালা আন্ধারে ডুইবা গেলো
তখনও সন্ধা হয়নাই—
একটা বাতাস ধাক্কা দিয়া দরজা মেইলা দিল বারান্দার
চুল উড়ল, বানলাম না
এই শহর, আমার শৈশবের অবয়ব কোলে নিয়া ভিজলো
আর মনে পড়লো অজস্র মানুষের মুখ—
দক্ষিণের ছাদটাতে কার একটা শেফালির ডাল ভাঙলো মড়াৎ—
আর কারখানার সবগুলা বাতি নিভা গেলো
তখনও সন্ধা হয়নাই—
দোকানের নিচে আটকা পড়া মানুষের মত কেমন যে তড়পাইলাম!
মনে হইতে থাকলো,
মা জানলার গ্রিল ধইরা দাড়ায় আছে
অপেক্ষা করতে করতে তার মাগরিবের ওয়াক্ত হয়া যায় ফোনে কোনোই ব্যালেন্স নাই—
আমার রুমের দরজা বন্ধ, ভিতরে বিলাইটা একলা একলা কি কি যে করে!
আর আমি এইখানে হেদায়া রুমের বারান্দায় বইসে বইসে হাফসার সাথে গল্প করি, আর খানিক পর পর উশপিশ করি, কেমনে বাসায় যাবো?
তখনও সন্ধা হয়নাই—
সন্ধার পর খারেজী ক্লাস নিবেন মুফতি আলি হুসাইন
আমার স্মৃতির ভিতর শোক করতেছে আমার আত্মা!
আমার স্মৃতির ভিতর আমার মরা বিড়ালের আওয়াজ শোনা যাইতেছে শুধু!
২৭ এপ্রিল ‘২৩
আফগানি নাম
এখন কত রাত! তুমি ঘুমায়েছো?
তুমি ঘুমায়েছো এক নাবাল শিশুর সরলতা নিয়া—গালে এক আনারের ফুল ফুটতেছে ক্রমে—
তোমারে ডাকব নিরিবিলি কোনো রোদে তোমারে ডাকব আত্মার গালিচায়—
তোমারে ডাকব এমন আদর দিয়া
যেখানে ভ্রমের পর্দা ছিড়া যাবে জান!
তোমারে ডাকব আফগানি নামের কায়দায়!
লিভিংরুম নিজ্ঝুম হয়া ওঠে
আর তুমি হও গাঢ়—
রাতের ভিতর আরো নরম কোনো রাত আমাদের ডাকে
আমাদের ডাকে বিসর্পিল ভঙ্গি আর ব্যাকুল আন্ধার
যেখানে একটা মায়া পাক খেতে খেতে হঠাৎ কান্নার মত ভিজা যায় সোনা!
আহা! আমার ফুসফুস ভরে যায় তোমারি নিঃশ্বাসে—
আমি কি যে করি! নোনা পানির তোড়ে ধুয়ে যায় সবই
যখন তোমারে ভাবি না
তখনও তোমারেই ভাবি—
কে তুমি আমারি দেমাগের ভিতর বিছায়ে দিছিলা মখমল
বিছায়ে দিছিলা তোমার বাহুর মাংসের বিছানা!
তোমার মুখ একটা মোলায়েম খরগোশের লোমের সুন্দরতা
তোমার মুখ একটা সুবাসি রুমালের জরিদার পাড়!
তোমার ঠোট একটা নীল সমুদ্রের করুণ টলমল
তুমি তো পশ্চিমের কোনো পাখি তবু কেনো এত টান লাগে আজ জানের ভিতর?
তোমার ত্বক ছোয়ার মত ভ্রমে
দ্যাখো আমার দুনিয়া মাতাল পইড়া আছে—
১৮ সেপ্টম্বর ‘২২
রাতের ট্রেনে
আরো একটা সফর হবে তোমার সাথে
শাউনের রাতের ট্রেনে—
কি যে স্নেহের ভিতর আমাদের হাত ধরে থাকা!
আহারে তালু ঘেমে যাবে
অমল মেঘের মত এক রাতে—
মুখোমুখি যতবার বসি ভাবি দুনিয়ার সব পাহাড়ের মাটি ফুলের গন্ধে ভিজে যায়—
আর লাল পালকের ভিতর যে ‘মখমল’ নরম হতে হতে পায়রার পায়ের দিকে নিয়ে যায় সেখানে শুধু গোলাপের পাপড়ি ছড়ায় বাতাস—
আমি চিনেছি তোমার চোখের রঙ, নিবিড় কী যে! আহা তাকালে মনে হয় একটা নিঝুম বন আমার জন্য পেতে রেখেছে হলুদ পাতার বিছানা—
আমি বলে দিতে পারি তোমার দেহের ছায়া ছায়ার ভিতর কেমন পাখির বাসা!
আহা! কেমন নিনাদ যে ওঠে রুহে—
আত্মার আব্রু আমার!
তোমার চুল আর নখের ঘ্রান আলাদা আলাদা বলে দিতে পারি আমি—
২২ অগাষ্ট ‘২২
আংটি বদল
এখানে ফিদা হয়ে আছে বাতাস—
তোমার ঘ্রানে,
আমাকে দিয়েছে দিশা তোমার সফরের গান
কেমন আরাম হবে রোদ, আমাদের দেখা হবার দিনে?
সুর থেকে সুরে খালি সন্তরণ—
তবু আমি মনে রাখতে পারিনা লিরিক
আমাকে চাইতে বলো কতকিছু!
কুমকুমদানি আর রঙের তুলি
আরো কিছু রুশ অনুবাদ,
তুমি ভুলে গেলে বলি থাক তবু ওইসব এবার—
শুধু পাপড়ি খুলে খুলে তোমাকে দিয়ো
পাজরের ওপরে আমার—শীতের ওমে
তোমার পাঞ্জাবীর রঙ
যেনো ধুতে গিয়ে লেগে থাকে আমার নখে—
কত পারুলের ঘ্রাণ আমার শরিলের ভিতর
বলে গেলো তোমার কথা !
সারাদিন সারারাত ধরে
কোন গীত বলো তোমাকে শোনাবো মনা?
তামাকের বনের ভিতর ডুবে গেলে চাদ
আমরা ফুটবো—হয়ে আরশের শাদা ফুল
ডিসেম্বর ২০২১
সাফা প্রামাণিক
Latest posts by সাফা প্রামাণিক (see all)
- সাফা প্রামাণিকের কবিতা - জানুয়ারি 16, 2025