Main menu

তর্ক: মুসলমান-লেখকদের বাংলা সাহিত্য – বুদ্ধদেব বসু ও আবুল মনসুর আহমেদ (১৯৪২) Featured

১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ – ১৯৭৪) একটা কলাম লেখছিলেন “সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব” নামে, যে পলিটিকালি পাকিস্তান আন্দোলন হইলেও সাহিত্যে মুসলমানি-সাহিত্য হওয়া ঠিক না, বাংলা-সাহিত্যই হইতে হবে! নাইলে উর্দু সাহিত্য করেন আপনারা!

তো, এর জবাব দেন আবুল মনসুর আহমেদ ১লা নভেম্বর, ১৯৪২ সালে পাকিস্তান রেনেসা নামে একটা সংগঠনের সভায় একটা লেখা পড়ার ভিতর দিয়া যেইটা পরে “সাহিত্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য” নামে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ছাপা হয়।

বুদ্ধদেব বসুর আরগুমেন্ট ছিল মেইনলি তিনটা –

১. নারী-সাহিত্যের মতোই মুসলমানি-সাহিত্য একটা সাব-সেট হয়া আছে বাংলা-সাহিত্যের, এর থিকা বাংলার মুসলমান সাহিত্যিকদের বাইর হইতে হবে!

২. অনেকে অভিযোগ করেন যে হিন্দু-সাহিত্যিকরা কেন মুসলমানদের নিয়া লেখেন না? কারন হিন্দুরা তো মুসলমানদের তেমন কিছু জানেন না! এই কারনে মুসলমান সাহিত্যিকদেরই মুসলামানি সমাজ থিকা বাইর হয়া সবার জন্য সাহিত্য করা লাগবে

৩. আর উনারা যদি সবার জন্য না লেখতে পারেন তাইলে বাংলা-সাহিত্য বাদ দিয়া উর্দু সাহিত্যই করা দরকার!

আবুল মনসুর আহমেদের জবাবগুলা অনেকটা এইরকম:

১. মুসলমান-লেখক যে একটা সাব-কেটাগরি হয়া আছে – এইটা বানাইছে কারা? কিভাবে তৈরি হইছে?

২. একই সমাজে থাকার পরেও হিন্দু-লেখকরা মুসলমান-সমাজ নিয়া জানে না কেন? নাকি না-জানাটারেই তাদের বাহাদুরি মনে করে?

৩. তো, মুসলমান সাহিত্যিকরা তাদের স্বাতন্ত্র্য ধইরা রাইখাই বাংলা-সাহিত্য করবে, আর সেইটা  থিকা মাওলানা বা পন্ডিতদের থ্রেটে সইরা যাবে না!

এইখানে, আবুল মনসুর আহমেদ ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা কিছুটা এড়ায়া গেছেন বইলা দেখি আমি, যে বাংলা-সাহিত্যের যেই ডিফল্ট বা ‘সাধারন পাঠক’ আছেন, তারা হইতেছেন মেইনলি – শিকখিত হিন্দু! বাংলা-ভাষা বইলাও যেইটা আছে সেইটা হইতেছে ‘সংস্কৃত বাংলা’ বা এখনকার ‘প্রমিত বাংলা’! এর বাইরে যা কিছু আছে, সবই হইতেছে – ব্যতিক্রম, অ-শুদ্ধ ও ভুল!

এবং খেয়াল কইরা দেখবেন অইসব ‘মুসলমান রাইটারদেরকেই’ (যেমন, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিন) হিন্দু সাহিত্য-সমাজ ‘সাহিত্যিক’ বইলা মাইনা নিতেছেন যারা উনাদের লগে যোগাযোগ রাখেন, মিনিমাম রিলেশন রাখেন এবং তাদের সাহিত্যিক-সুপিরিয়রিটি মাইনা নিতে রাজি আছেন; তার আগেও মীর মোশাররফ হোসেনরে যে মুসলমান-সাহিত্যিক হিসাবে একসেপ্ট করছেন তার কারন উনার ‘মুসলমানি-সাহিত্য’ না বরং ‘সংস্কৃত বাংলা’য় লেখতে রাজি হওয়ার ঘটনা! যেই কারনে দেখবেন ফররুখ আহমেদ অই লিস্টে নাই! ভালো-বাংলা মানে হইতেছে অই ট্রাডিশনটা, আর এখনো এইটা সেলিব্রেটেড ঘটনা… আপনি ‘মুসলমান-রাইটার’ হয়াও ‘বাঙালি লেখক হইতে পারবেন যদি ‘পরমিত বাংলায়’ লেখেন! 

তো, এই যে এটিটুড বুদ্ধদেব বসুর, সেইটা এখনো কন্টিনিউ হইতেছে আসলে, যেই কারনে তর্কের এই প্রিমাইজটা এখনো রেলিভেন্ট।

লেখা দুইটা পূর্ব বাঙলার ভাষা বইয়ে রিপ্রিন্ট করা হইছিল 

বুদ্ধদেব বসু
সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব

শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী (এবং সহযোগী) স্বরূপ একটি অদ্ভুতস্তানের কল্পনা ভারত ভাগ্যবিধাতার দপ্তরে অচিরেই পেশ করা হবে এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে একটি জেনানাস্তান (কিংবা পাকিস্তান)-এর দাবী যদি বিংশতি কোটি ভারতীয় ললনার কণ্ঠে কল কলম্বরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে তাহলেও অবাক হবার কিছু নেই। আমি রাজনীতিক নই, বিশাল ভারতকে অনেকগুলি খণ্ড ক্ষুদ্র স্থান কিংবা স্থান-এ বিভক্ত করবার প্রস্তাবে বিমূঢ় মৌনই আমার একমাত্র মন্তব্য। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যকামী মনোভাব যখন সাহিত্য ক্ষেত্রেও সংক্রামিত হতে দেখি তখন আমার পক্ষে চুপ করে থাকা শক্ত হয়। যখন দেখি একজন লেখক, যিনি দৈবক্রমে মুসলমান হয়ে জন্মেছেন, কিংবা অন্য একজন লেখক, যিনি প্রকৃতির খেয়ালে স্ত্রীলোকের দেহ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি লেখকের বৃহৎ ও বহমানকর পদবী অগ্রাহ্য করে মুসলমান লেখক কিংবা মহিলা লেখক-এর সংকীর্ণ আখ্যার জন্য লালায়িত তখন প্রতিবাদ না করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কতদিন আমি মনে মনে ভেবিছি যে আমাদের মেয়েদের মধ্যে যারা সাহিত্য চর্চা করেন তাঁরা কি চিরকালই লেখিকা থাকবেন, কোনোদিন লেখক হবেন না? সাময়িক পত্রে, সমালোচনায় কিংবা পণ্ডিতজন রচিত সাহিত্যের ইতিহাসে যখন বঙ্গীয় মহিলা কবি কি মহিলা ঔপন্যাসিকদের বিবরণ পড়ি, তখন ক্ষুব্ধচিত্তে এ প্রশ্নই বার বার জাগে, যে মেয়েদের আমরা আর কতকাল নাবালক করে রাখবো, তাঁরাই বা এই পিঠ চাপড়ানো আর কতকাল সইবেন? অথচ সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, এই অপমানকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মেয়েরা নিজেরা কখনো প্রতিবাদ করেন না, নিজেদের ‘লেখিকা’ বলে পরিচয় দিতে কদাচ তাঁরা লজ্জিত নন, বরং সেই আখ্যাই যেন তাঁরা কামনা করেন। অর্থাৎ সাহিত্যিক জেনানাস্তানের মাইনরিটি প্রিভিলেজেস-এর প্রতি তাঁদের লোলুপ দৃষ্টি। তাঁরা কি কখনো, ভেবেছেন যে এ ব্যবস্থায় তাঁদের যে আদপে আমলে আনা হচ্ছে তা তাঁরা ভালো লেখেন বলে নয়; তাঁরা মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলেই। মহিলা লেখকদের ফিরিস্তি যখন কোথাও প্রকাশিত হয় তার মধ্যে এমন অনেকেরই নাম পাওয়া যায় যাদের লেখক বলাই ভুল, প্রজাতিশ্রেষ্ঠ মহিলা কবি বলে সম্মান জানাচ্ছি বাংলার কবি-সভায় হয়তো তাঁর কোনো স্থানই হতে পারে না। এই নির্বোধ ব্যবস্থার ফলে মেয়েদের মনে সাহিত্যের আদর্শা ক্রমেই নেমে যেতে থাকে, কোনো রকমে দুচার লাইন মেলাতে পারলেই মহিলা কবি আখ্যা পাওয়া যায়, কোনো একটি উন্মত্ত প্রলাপ ছাপার অক্ষরে বের করতে পারলেই মহিলা-ঔপন্যাসিক হিসেবে মাল্যলাভের সম্ভাবনা থাকে, অপরপক্ষে যে দুচারটি মেয়ে সত্যি ভালো লেখেন, অর্থ্যৎ যারা লেখিকা মাত্র নন, যাঁরা লেখক, তাঁদেরও ঐ মহিলা-লেখকদের গড্ডলিকার ভিড়িয়ে দেওয়া হয়, যথাযোগ্য সমাদর তাঁরা পান, যতই তারা ভালো লিখুন, মেয়েদের মধ্যে ভালো লেখেন এই কলংকময় অপবাদ কাটিয়ে উঠতে তাঁরা পারেন না। এ সবই দুঃখের কথা, কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মেয়েদের তরফ থেকে কখনো আসেনি, প্রতিবাদ করতে হচ্ছে আমাকে – যে মেয়ে নয়।

এমন আর একটি প্রতিবাদ আজ আমার জানাবার আছে, সেটি সাহিত্যিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অমুসলমান হয়েও মুসলমান লেখকদের হয়ে যে কথা আমি আজ বলছি তা এতদিনেও কোনো মুসলমান লেখক যে বলেননি সেটা আমি আমাদের সাহিত্যের দুর্ভাগ্যই মনে করি। আমার বক্তব্য এই যে, এ-দেশে যেসব মেয়ে সাহিত্য চর্চা করেন তাঁরা যেমন মহিলা লেখক রূপে অনপনেয় অপমানে চিহ্নিত, তেমনি মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা লেখেন তারাও মুসলমান-লেখক মাত্র, কদাচ লেখক নন। আশ্চর্য এই যে, মুসলমান-লেখক এর সংকীর্ণ আখ্যা নিয়েই তাদের বেশ খুশি মনে হয়, বৃহত্তর সাহিত্য জগতে লেখক আখ্যা যেন তারা কামনাও করেন না। মুসলমান দ্বারা মুসলমানের জন্য পরিচালিত যে দু একটি পত্রিকা বাংলাদেশে আছে, তাতেই তাদের লেখা প্রকাশিত হয়, তাদের পাঠকও প্রায় পুরোপুরিই মুসলমান, দৈবাৎ দুটি একটি লেখা এদিক ওদিক ছিটকে যদি পড়ে, সাধারণ পাঠকের সঙ্গে এটুকুই তাদের যোগসূত্র। মুসলমান-লেখক – এই কথাটি মুসলমান এবং অমুসলমান উভয় পক্ষেই বারংবার ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং এইভাবে বাংলা সাহিত্যের বিরাট প্রাঙ্গণ থেকে নির্বাসিত হয়ে তাঁরা মুসলিম সাহিত্য নামে একটি ক্ষুদ্র সংকীর্ণ গণ্ডি আঁকড়ে পড়ে আছেন। আবার বলছি, এ-ব্যবস্থায় মুসলমানদের আপত্তি করা উচিত, কিন্তু আশ্চর্য এই যে, তাঁরা তা করছেন না। আমি জোর করেই বলবো যে মুসলিম সাহিত্য কি হিন্দু সাহিত্য বলে আজকের দিনে কিছুই নেই, কিছু হতে পারে না; যিনিই বাংলা ভাষায় লিখবেন, তিনিই হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রীষ্টান যাই হোন, তিনি বাঙালি লেখক। বাঙালি লেখক – এই আখ্যাই সবচেয়ে সম্মানের, সবচেয়ে সত্য এবং লেখক হিসেবে যাঁর আত্মমর্যদাবোধ আছে, এর চাইতে ক্ষুদ্র কোনো পদবী তিনি নিশ্চয়ই গ্রহণ করবেন না। আর যদি আমার স্বদেশবাসীর মধ্যে এমন যে কোনো মুসলমান থাকেন যিনি বিশ্বাস করেন যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ফলে মুসলমানরা ঘোরতর হিন্দু হয়ে উঠছিলেন, অতএব সমস্ত জিনিসটাই ত্যাগ করা এখন তাদের কর্তব্য বলা বাহুল্য এসব কথা তাঁর উদ্দেশ্যে আমি বলছি না। তাঁকে আমি বলবো আমি একান্তভবে আশাকরি যে, আপনি এতখানি পুরোপুরি মুসলমান হতে পারবেন যে হিন্দুগন্ধী বঙ্গ ভাষাকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সুমধুর উর্দুতে বিশুদ্ধ মুসলিম সংস্কৃতি পরিবেশন করতে পারবে – যদি পারেন, সেই নবীন ইসলামী সাহিত্যকে আমরা সাগ্রহে বরণ করবো। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আজকের দিনে হিন্দুর কিংবা মুসলমানের নয়, তা বাঙালির এবং এক হিসেবে বিশ্বমানবের; অতএব এক্ষেত্র আপনার নয়, আপনার নিজেরই মতানুসারে এ-ক্ষেত্র আপনার পরিত্যাজ্য।

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে এ-ধরনের আত্মঘাতী চিন্তা খুব সম্প্রতি কারো কারো মনে হয় দেখা দিচ্ছে, কিন্তু এ-মত যে সকলেরই মত নয়, এমন কি বেশীর ভাগেরই মত নয়, তার প্রমাণ এই যে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজকাল এমন অনেক তরুণ লেখক দেখা দিচ্ছে, যাঁদের ধর্ম ইসলাম। এঁদের অনেকের মধ্যে আমি শক্তির প্রতিশ্রুতি দেখতে পেয়েছি এবং আমার এই কথাগুলি বিশেষভাবে তাঁদের উদ্দেশ্যেই বলা। সাহিত্য ক্ষেত্রে এই পাকিস্তান মনোভাব তাঁদের যে কতখানি ক্ষতি করেছে তা কি তাঁরা বোঝেন না? নিজেদের যদি তাঁরা কেবল মুসলমান লেখক বলে ভাবতে শেখেন, যদি শুধু মুসলমান পাঠক সমাজের স্বীকৃতি লাভ করেই তৃপ্ত থাকেন, তাহলে সাহিত্যের আদর্শ তাদের মনে এমন শিথিল হয়ে যাবে যে সত্যিকার লেখক হওয়া তাদের পক্ষে আর সম্ভবই হবে না। তাঁরা কেউ কেউ হয়তো একটি দুটি ভালো কবিতা কি গল্প লিখছেন: সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান পরিচালিত পত্রিকা যদি তাঁদের প্রধান বলে ঘোষণা করে, সে যে তাঁদের কত বড়ো সর্বনাশ তা কি তাঁরা বোঝেন না? মহিলাদের পক্ষে যেমন, তেমনি তাঁদের পক্ষেও এই বিভেদই মনোভাবের অবিরল নিপীড়নের ফলে তাঁরা কখনো বাড়তে পারেন না, যাঁরা সত্যিকার ভালো লেখক তাঁরাও ঐমুসলমান লেখক-এর সংকীর্ণ অবিজ্ঞানেই আবদ্ধ হয়ে থাকবেন, পরিচয়ের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাবেন না। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে এ ধরনের মনোভাব পূর্বে আমাদের সাহিত্য জগতে ছিলো না, এটা দেখা দিয়েছে সম্প্রতি এবং ক্রমেই বেড়ে চলছে। প্রায় পঁচিশ বছর আগে নজরুল ইসলাম এবং পনেরো বছর আগে জসীমদ্দীন যখন বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে দেখা দিলেন, তখন তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই দেশবাসীর হৃদয়ের অভিনন্দন পেয়েছিলেন মুসলমান কবি হিসেবে নয়, কবি হিসেবেই। মননশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও হুমায়ুন কবির সম্বন্ধেও এই কথা। কিন্তু আজকের দিনের নজরুল এবং জসীমদ্দীন মুসলমানত্বের গণ্ডিটুকুর মধ্যেই হয়তো আটকে আছেন বাংলার সাহিত্য জগতের সঙ্গে ভালো করে তাঁদের পরিচয়ই হচ্ছে না। তাঁদের সঙ্গে আমাদের অর্থাৎ বাংলার লেখক সমাজের যোগাযোগ ক্ষীণ, ভাব বিনিময় নাম মাত্র, যে স্বাতন্ত্র্যমত্ততা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের মনে পার্থিব, স্বর্গের স্বপ্ন এনে দিয়েছে, সেই স্বতন্ত্র্য সাহিত্যের ক্ষেত্রেও যদি তাঁরা বজায় রেখে চলতে চান তাহলে বলতেই হবে যে রাজনীতির কুটিল প্রভাবে নিজেদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হেলায় হারাতে তারা প্রস্তুত হচ্ছে। কেন না একথা মনে রাখতেই হবে যে, সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব। কোনো বিশেষ কারণে কোনো একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা রাজনীতির ক্ষেত্রে কিছুকাল অন্তত চালানো যেতে পাবে। কিন্তু সাহিত্য চিরমুক্ত, কোনো শাসনকর্তার অনুশাসনে তাকে কোনো নির্দিষ্ট মূর্তি গ্রহণ করতে বাধ্য করা যায় না – বড়ো জোর সাহিত্যিকদের মুখ বন্ধ করা যায়। কিন্তু সাহিত্যিকের ব্রাম্য জোর চললেও সাহিত্যের উপর চলে না, সাহিত্য তার আপন ইতিহাস ও প্রতিভা অনুসারে নব-নব পূর্ণতার অভিমুখে প্রবাহিত হবেই, আইনের জোরে সে- স্রোত বড়ো জোর মাটির তলায় ঠেলে দেয়া যায়, থামিয়ে দেয়া যায় না। কথাটা মামুলি হলেও আজ আবার নতুন করে বলতে হচ্ছে যে, সাহিত্যই মানব জীবনের একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে কোনো রকম ভেদবুদ্ধির স্থান নেই, যেখানে জাতি, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, আর্থিক অবস্থা কিংবা বয়োক্রমের পার্থক্য স্বভাবতই অগ্রাহ্য এবং সাম্যই যেখানে রূলনীতি। এই জন্যই সাহিত্য জগতের গৌরবময় নাম রিপাবলিক অফ লেটারস, এবং এ শুধু নামে রিপাবলিক নয়, কার্যতও গণতান্ত্রিক, গণতন্ত্রের প্রকৃত প্রয়োগ যদি কোনোখানে হয়ে থাকে তবে আবহমানকাল এই সাহিত্য ক্ষেত্রে একবার প্রবেশ লাভের অধিকার যারা পেয়েছেন তাঁদের বয়স, ধর্ম কি জাতি যা-ই হোক, কিংবা প্রতিভার ও কীর্তির তারতম্য যতই হোক, তাঁরা একই মুক্তি ও মৈত্রীর সূত্রে সংযুক্ত। অতি-তরুণ অতি-প্রাচীনকে সমালোচনা করতে পারে একমাত্র সাহিত্য ক্ষেত্রেই, একমাত্র সাহিত্য ক্ষেত্রেই দেশবিশ্রুত কবি প্রতিশ্রুতিশীল বালকের গলায় বরমাল্য দিয়ে থাকেন। সাম্যের প্রকৃত সংজ্ঞা তো এখানেই – আমাদের রাজনীতিতে কি বাণিজ্যে কি সাধারণ সামাজিক জীবনে এই সাম্যের অভাব যে কী মর্মভেদী তা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সাহিত্য জগতকে তার চিরকালের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখেই চলতে হবে এখানে…

এখানে যিনি নবাগত, তাঁকে সকলের সঙ্গে সমান হয়েই অবতীর্ণ হতে হবে – হিন্দু বলে নয়, লেখক বলেই তিনি আমাদের মধ্যে আসবেন, সাহিত্যের সর্বজনীন আদর্শের বিচারেই তার পরীক্ষা হবে, তারপর যদি যে পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হন তবে যে আসন তিনি পাবেন সেই আসনই হবে সত্য ও স্থায়ী, আর যদি উত্তীর্ণ না হন তবে লেখক হিসেবে তিনি আর গণ্যই হবেন না, এবং সেটাই ভালো। সংকীর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে মিথ্যা আসন পাওয়ার চাইতে নগণ্যতার আরামদায়ক অবলুপ্তি আত্মসম্মানীর পক্ষে অনেক বেশী বাঞ্ছনীয়, এবং সাহিত্যের পক্ষেও মঙ্গলকর; যুগে যুগে হিন্দু-মুসলমান, অনেক তরুণ লেখকই বাংলা সাহিত্য জগতে প্রবেশের জন্য সচেষ্ট হবেন। কিন্তু ইপ্সিত দুয়ার সকলের জন্য খুলবে না, অনেককেই ফিরে যেতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যে-কজন প্রবেশের অধিকার পাবেন তাঁরা লাভ করবেন প্রকৃত গৌরব, সমগ্র পাঠক সমাজের অভিনন্দন, কোনো সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের কৃত্রিম স্বীকৃতি মাত্র নয়।

তরুণ মুসলমান লেখকদের এই কথাটি বিশেষ করে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। মুসলমান সমাজের মধ্যে খ্যাতি হলেই (সেটা হয়তো সহজেই হয়) তারা যেন মনে না করেন যে, তাদের সাহিত্যিক জীবনের সিদ্ধিলাভ হয়ে গেলো। তারা যেন বাংলা সাহিত্যকে সমগ্রভাবে দেখেন যেন প্রতিদিন একবার অন্তত এ-কথা ভাবেন যে যে- সাহিত্য রবীন্দ্রনাথ হয়ে গেলেন তার আদর্শ আজ পৃথিবীর যে কোনো সাহিত্যের চাইতে নিচুতে নয়, এবং তাদের সকল রচনা যেন সেই উচ্চ আদর্শকেই লক্ষ্য করে। বার বার তীর হয়তো লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে, কিন্তু যতদিন লক্ষ্যভেদ না হয় কিছুতেই মনে করা চলবে না যে সাহিত্যিক জীবনের কোনো সার্থকতা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ‘যটি সর্বজনীন বৃহৎ ক্ষেত্র, সেই ক্ষেত্রটিই যেন তাঁরা আপন মনে করেন, এবং তাঁদের লেখার উদ্দেশ্য হয় যেন সমগ্র বাঙালি পাঠক সমাজ। তা যদি না হয় তাঁদের প্রতিভা কখনো বিকশিত হবে না, ব্যর্থ হবে তাঁদের স্বাভাবিক বৃত্তি। মুসলিম সাহিত্যের গণ্ডি ভেঙে ফেলে তাঁরা যদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে আপন বলে গ্রহণ করেন, সেটাই কালক্রমে হতে পারে হিন্দু মুসলমান মিলনের প্রধান ভিত্তি। ভাষা সাহিত্য মানুষের সঙ্গে মানুষের একটি জীবন্ত অক্ষয় বন্ধন; দুজন একই ভাষায় কথা বলি, একই সাহিত্যে আমাদের উত্তরাধিকার-এর চেয়ে সত্য, এর চেয়ে বড়ো মিলনের ক্ষেত্র আর কী হতে পারে? আমি সেই ভাববিলাসীদের একজন যাঁরা এখনো হিন্দু-মুসলমানের মিলনে বিশ্বাস করেন। তাই তরুণ মুসলমানদের ডেকে আজ বলতে ইচ্ছা করে যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তাঁদের, কিন্তু রাজনৈতিক পবিত্রভূমির মতো এ উপহার, কেউ কাউকে হাতে তুলে দিতে পারে না। এ অর্জন করে নিতে হয় নিজের জীবনের সাধনায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকেও তাদের আপন করে নিতে হবে, তরুণদের প্রেমে, তাদের কর্মে, শিল্প সৃষ্টির আনন্দময় প্রেরণায়। সেটা যখন হবে তখন তাঁরা আমাদের কাছে এসে বলবেন না, আপনারা কেন মুসলমান সমাজ নিয়ে বই লেখেন না? এ প্রশ্ন একান্ত অবান্তর, কেননা হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক মিলনের ক্ষেত্র এখন পর্যন্ত অত্যন্ত সংকীর্ণ, এবং বিবেকবান সৎ লেখক যা জানেন না সে বিষয়ে কিছু লেখেন না। বাংলা সাহিত্যে এখন পর্যন্ত হিন্দু সমাজের কথাই বেশি, তার কারণ এ ছাড়া আর কিছু নয় যে লেখকরা বেশির ভাগই হিন্দু হয়ে জন্মেছেন – এ নিয়ে মনে অভিমানের ভাব রাখাটা ছেলেমানুষি। মুসলমান হয়ে জন্মেছেন এমন কোনো কোনো – লেখক যদি আজ দেখা দেন যিনি ‘তাদের সমাজের সুখ-দুঃখ, আশা আকাঙ্ক্ষার কথা আমাদের শোনাবেন, জোর করেই বলতে পারি বাংলা সাহিত্য সসম্মানে ও সানন্দে তাঁদের করণ করে নেবে – আমরা গভীর আগ্রহে তাঁদের আবির্ভাবের প্রতীক্ষা করছি। দেশের বর্তমান অবস্থায় এ কাজ অমুসলমান পারবে না; ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক মিলনের বাধা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায় তখনই সেই পারস্পরিক পরিচয়ের আলো বাংলা সাহিত্যে নিশ্চয় জ্বলে উঠবে।

মুসলমানরা যখন অভিযোগ করে বলেন যে বাংলা সাহিত্য পড়লে মনে হয় যে বাবুর্চি-বেয়ারা ছাড়া দেশে কোনো মুসলমান নেই, সে অভিযোগের সত্যতা যদিও অস্বীকার করতে পারি না, তবু মনে হয় এ অভিযোগ নিরর্থক, কারণ পারস্পরিক মেলামেশা যেখানে এতো কম সেখানে এ ছাড়া আর কী আশা করা যায়? আমরা – অর্থাৎ সরকারি সেন্সস যাদের হিন্দু বলে অভিহিত করে – মুসলমানের জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানি না, এবং সেটা আমাদের দোষ নয়। আমরা জানি না, কিন্তু জানতে চাই। তাই আমরা সমস্ত মুসলমান সমাজকে বাংলার সাহিত্য ক্ষেত্রে আহ্বান করছি, তাঁদের জীবনের কথা তাঁদের মুখেই আমরা শুনবো। যদি আমাদের সাহিত্যে কয়েকজন প্রকৃত শক্তিশালী লেখকের অভ্যাগম হয় যাঁরা মুসলমানের ঘরে জন্মগ্রহণ করে মুসলমান জীবনের অংশী হয়ে সেই সঙ্গে বৃহৎ উদার সর্বমানবিক সংস্কৃতির মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মুসলমার জীবনের সম্পূর্ণ সুন্দর ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরবেন তার চাইতে শুভ ঘটনা আজকের দিনে বাংলাদেশের পক্ষে কিছুই হতে পারে না। সাহিত্যের ভিতর দিয়ে মুসলমান সমাজের পরিচয় যখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, তখন অনেকের ভুল বোঝা অনেক সন্দেহ মুহূর্তে দূর হবে, সহজ হবে হিন্দু-মুসলমানে মৈত্রী স্থাপন। সেই লেখক যখন দেখা দেবেন, তিনিই মুসলমানকে প্রকৃত সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবেন, যা জিন্নাহ সাহেব কখনোই পারবেন না। রাজনৈতিক চালবাজির খাতিরে যা করা হয় সেই বিচ্ছেদও কৃত্রিম, সেই মিলনও মিথ্যা, সভা-সমিতি, আইন কিংবা কনস্টিট্যুশনের জোরে যা হয়, হৃদয় সব সময় তার বশ্যতা স্বীকার করে না। বিচ্ছেদ যেখানে আন্তরিক সেখানেই বিচ্ছেদ ভয়ঙ্কর; মিলন যেখানে আন্তরিক, সেখানেই মিলন মূল্যবান। সুখের বিষয়, হিন্দু-মুসলমানের বিচ্ছেদ আজও পলিটিক্সের কূটনীতির ক্ষেত্রেই আবদ্ধ, কিন্তু এখনো সতর্ক না হলে হয়তো শিগগিরই তা দেশের মর্ম মূলে প্রবিষ্ট হবে। এই বিষাক্ত ভেদশল্য উৎপাদিত করে আন্তরিক মিলনমুক্ত হবার সাহিত্যই শ্রেষ্ঠ উপায়।

 

আবুল মনসুর আহমদ
সাহিত্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য

খ্যাতনামা সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব বসু সম্প্রতি একটি খবরের কাগজের এক বিশেষ সংখ্যা ‘সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। এই প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বাবু বলিয়াছেন যে, মেয়ে সাহিত্যিকদের যেমন মহিলা লেখক বা লেখিকা নামে অভিহিত হওয়া উচিত নয়, তেমনি ইসলাম-ধর্মী সাহিত্যিকদেরও মুসলমান লেখক বা মুসলিম সাহিত্যিক বলিয়া পরিচিত হওয়া উচিত নয়। এটা খোদ মেয়েদের ও মুসলমানদেরই আত্মমর্যাদার হানিকর। কোনো রকমে দুচার লাইন মিলাতে পারলেই ‘মহিলা কবি’ আখ্যা পাওয়া যায় বলিয়া অথবা কোনো একটা উন্মত্ত প্রলাপ ছাপার অক্ষরে বের করতে পারলেই ‘মহিলা ঔপন্যাসিক’ হিসেবে মাল্য লাভের সম্ভাবনা থাকে বলিয়াই মেয়ে লেখকরা মহিলা লেখক বা লেখিকা নামে অভিহিত হইবার জন্য ব্যগ্র, ইহাই বুদ্ধদেব বাবুর মত। ঠিক সেইরূপ দুএকটা ভাল কবিতা কি গল্প লিখেই মুসলমান পরিচালিত পত্রিকায় “প্রধান লেখক বলে ঘোষিত” হইবার আশাতেই নাকি ইসলাম-ধর্মী লেখকরা শুধু লেখক নামে অভিহিত না হইয়া মুসলমান লেখক রূপে অবিহিত হইতে চান। বুদ্ধদের বাবুর মতে এটাই পাকিস্তানী মনোভাব। এ ধরনের মনোভাব আগে ছিল না, এটা সম্প্রতি দেখা দিয়েছে এবং ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। স্বাতন্ত্র্য-মত্ততা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানদের মনে পার্থিব স্বর্গের স্বপ্ন এনে দিয়েছে সেই স্বাতন্ত্র্যকে সাহিত্য ক্ষেত্রে আনিতে চান বলিয়াই নাকি মুসলমান লেখকরা শুধু লেখক ও সাহিত্যিক না হইয়া মুসলমান লেখক ও মুসলমান সাহিত্যিক রূপে নিজেদের অনপনেয় অপমানে চিহ্নিত করিতেছেন।

আমি নিজেকে বুদ্ধদেব বাবুর মত অতটা মেয়েদের-মুরুব্বী মনে করি না। অবলা দুর্বলা নারীরক্ষায় যে শিভালরী ও নাইট ইরান্ট মনোভাবের দরকার আমার মধ্যে সে বীরত্বের অভাব দেখিতেছি। আমি মনে করি, আমাদের মেয়েদের সকলে না হোক অন্তত সাহিত্যিক মেয়েরা আত্মরক্ষায় ও আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্ষম। বিশেষত আমি যেখানে দেখিতেছি, শ্রদ্ধেয় স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুরূপা দেবী ও নিরূপমা দেবী প্রভৃতি মহিলা ঔপন্যাসিকের উপন্যাস খোদ বুদ্ধদেব বাবুর উপন্যাসের চেয়ে কোনো অংশেই উন্মত্ত প্রলাপ নয়, আমি যেখানে বুঝিতেছি, শ্রদ্ধেয় গিরীন্দ্রমোহিনী, রাধারাণী, কামিনী রায় ও মিসেস সুফিয়া কামাল (পূর্বে সুফিয়া এন হোসেন) এর কবিতা বুদ্ধদেব বাবুর কবিতার চেয়ে কোনো অংশেই দুচার লাইনের মিল মাত্র নয়; তখন আমি কী রূপে বিশ্বাস করিব যে কোনো রকমে দুচার লাইন মিলাতে পারলেই মহিলা কবি আখ্যা পাওয়া যায়? অথবা, কোনো একটা উন্মত্ত প্রলাপ ছাপার অক্ষর বের করতে পারলেই ঔপন্যাসিক হিসেবে মাল্যলাভের সম্ভাবনা রহিয়াছে?

আমার ধারণা বরং এই যে, মেয়ে লেখকদের লেখিকা করিয়াছে বাংলা ব্যাকরণ, – মেয়েরা নিজেরা নয়। এর প্রতিবাদ মেয়ে নয় বুদ্ধদেব বাবু সকলের আগে করেন নাই, করিয়াছেন স্বয়ং মেয়েরাই। শ্রদ্ধেয় সরলা দেবী অধুনা-লুপ্ত ভারতীয় সম্পাদকই ছিলেন, সম্পাদিকা ছিলেন না। বুদ্ধদেব বাবুর মত বীর বাঙলা সাহিত্যে আর কতজন আছেন জানি না। কিন্তু এই ব্যাকরণদ্রোহিতার জন্য শ্রদ্ধেয় সরলা দেবীকে তাঁর সাহিত্যিক ভ্রাতাদের নিকট কম গাল খাইতে হয় নাই।

বুদ্ধদেব বাবু মুসলমানদিগকে মেয়েদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড় করাইয়াছেন, এ সম্মানের জন্য আমরা তাকে ধন্যবাদ দিতেছি। কিন্তু মেয়েদের পক্ষে কোন কথা না বলিয়া আমরা নিজেদের কথাই বলিতেছি।

বুদ্ধদেব বাবু প্রতিভাশালী লেখক। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, তার মনটা আধুনিক এবং তার দৃষ্টিটা উদার। সুতরাং সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর কথা আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গেই শুনিয়া থাকি। তিনি তার আলোচ্য প্রবন্ধে বলিয়াছেন যে, তিনি রাজনৈতিক নন, এবং নন বলিয়াই বিশাল ভারতকে অনেকগুলি খণ্ড ক্ষুদ্র স্থানে বিভক্ত করবার প্রস্তাবে বিমূঢ় মৌনই তার একমাত্র মন্তব্য। বুদ্ধদেব বাবু আমাদিগকে বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, বিশাল ভারতের রাজনৈতিক ভাগাভাগির বেলায় তিনি চুপ করিয়া মনের দুঃখ মনেই চাপিয়া রাখিতেছিলেন, কারণ তিনি রাজনৈতিক নন। কিন্তু এই রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকে এতদিনে সাহিত্যে টানিয়া আনা হইতেছে দেখিয়া তিনি আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না; তাঁর বুকে আর বরদাশত হইল না; কারণ তিনি সাহিত্যিক।

কথাটা ঠিক নয়। বুদ্ধদেব বাবুর আধুনিক মন এবং উদার দৃষ্টিও তাঁকে এখানে ফাঁকি দিয়াছে। তিনি রাজনৈতিক নন এ কথা ঠিক নয়। রাজনৈতিক চৈতন্য হইতেই তিনি পাকিস্তানের এই প্রতিবাদ করিয়াছেন, – সাহিত্যিক চৈতন্য হইতে নয়। মেয়ে সাহিত্যিকরা ‘মহিলা সাহিত্যিক’ ও ‘লেখিকা’ রূপে পরিচিত হইয়া আসিতেছেন বাঙলা সাহিত্যের সৃষ্টি হইতেই। মুসলমান সাহিত্যিকরা স্বতন্ত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন পঁচিশ বছর আগে। সুতরাং এ স্বাতন্ত্র্য বোধ সম্প্রতি দেখা দেয় নাই। তবু বাঙলার লেখক সমাজ অর্থাৎ বুদ্ধদেব বাবুরা অর্থাৎ হিন্দু সাহিত্যিকরা এতদিন এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করেন নাই। বরঞ্চ ‘বাঙলার সংবাদপত্রে’র অর্থাৎ হিন্দু-সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় মুসলমান গুণ্ডাদের মতই মুসলমান লেখকরাও এক স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসাবেই অভিহিত হইয়া আসিতেছিল। ‘মুসলমানদের জন্য অনপনেয় কলঙ্ক’ এ বোধ হিন্দুদের অর্থাৎ বাঙলার লেখক সমাজের কোনো দিন ছিল, এতদিন আমরা তা বুঝতে পারি নাই। বরঞ্চ সাহিত্য ক্ষেত্রে বাঙলার লেখক সমাজের কাছে এটা খুব স্বাভাবিক বলিয়াই মনে হইতেছিল বলিয়া বোধ হয়। আজ মুসলমানদের তরফ হইতে রাজনৈতিক পাকিস্তানের দাবি উঠিয়াছে বলিয়া যেমন অখণ্ড ভারতের প্রতি দাবি উঠিয়াছে; তেমনি বুদ্ধদেব বাবুর অখণ্ড বাঙলা সাহিত্যের এই নিতান্ত রাজনৈতিক দাবি তুলিয়াছেন এবং মেয়ে সাহিত্যিকদের খামাখাহ এই বিতর্কে টানিয়া আনিয়াছেন। ফলত রাজনৈতিক ‘পাকিস্তানের দাবি’ না উঠিলে, বাঙলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকদের এই ‘অনপনেয় কলঙ্কের’ জন্য বুদ্ধদেব বাবুর প্রাণ ব্যথাইয়া উঠিত কিনা সন্দেহ।

বস্তুত এটাই স্বাভাবিক। সাহিত্য মানব-জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন একটা হাওয়ায়ী জিনিস নয় এবং মানব-জীবনকেও রাজনীতি হইতে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। সুতরাং সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বুদ্ধদেব বাবুর উপন্যাসে স্বীকৃত না হইলেও, তার নিজের জীবনেরই প্রতি পরতে পরতে এটা তিনি দেখিতে পাইবেন, যে, যৌন-ক্ষুধার চেয়ে মানুষের পেটের ক্ষুধা কম শক্তিশালী অনুভূতি নয়। অপরের বিয়ে করা বউয়ের প্রতি লোভ হওয়ার নামকে ‘প্রেম’ আখ্যা দিলে অপরের অনাবশ্যক ধনের প্রতি লোভ হওয়াটাকে কিছুতেই ‘অপ্রেম’ আখ্যা দেওয়া যায় না। দুনিয়ার হাজার মেয়ে মানুষ পড়িয়া থাকিতে একজনের বউ চুরি করিয়া লইয়া যাওয়াকেই আমরা আর্টের রূপ দিতেছি। অথচ দরিদ্রদের ক্ষুধার অন্ন কাড়িয়া-নেওয়া ধনস্তূপের দিকে যদি অন্নহীনেরা বেআইনীভাবে একটু হাত বাড়ায় তবে আমরা তাকে ঘৃণা করিতেছি। এ-ব্যবস্থার প্রতিবাদকে বাঙলার লেখক সমাজ রাজনৈতিক আবর্জনা ও আর্ট-বিরোধী পার্থিব ব্যাপার বলিয়াই আসিতেছেন। স্বয়ং বুদ্ধদেব বাবু এই আর্টবাদীদের গণ্ডি হইতে ‘স্বতন্ত্র’ হইবার চেষ্টা করিতেছেন বলিয়াই বোধ হয়। তাই তিনি রাজনীতি হইতে যুক্ত নন। এটা ভাল কথা। এইখানেই বুদ্ধদেব বাবু আমাদের নমস্য।

কিন্তু রাজনীতির বিপদও কম নয়। এটা মানুষকে সাম্রাজ্যবাদীও করিয়া তুলিতে পারে। ‘অখণ্ড ভারতীয়’রা যেমন অন্তত নিজেদের অজ্ঞাতসারেও, সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন করিতেছেন, তেমনি বুদ্ধদেব বাবুও, নিজের অজ্ঞাতসারেই বোধ হয়, ‘অখণ্ড বাঙলা সাহিত্যের’ নামে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবেরই পরিচয় দিতেছেন। বস্তুত সাহিত্যিক কোনো দাম নাই; শুধু রাজনৈতিক স্লোগান হিসাবেই ইহা শক্তিশালী স্লোগান। কারণ রাজনীতিতে পাকিস্তান সম্ভব-অসম্ভব ও আবশ্যক-অনাবশ্যক দুই-ই হইতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে পাকিস্তান শুধু সম্ভব নয় – স্বাভাবিক এবং দরকারী।

সাহিত্যকে রিপাবলিক অফ লেটারস অভিহিত করিয়া বুদ্ধদেব বাবু স্বীকার করিয়াছেন যে, সাহিত্যে যতটা দেওয়ানী আজাদী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রহিয়াছে, রাজনীতি ক্ষেত্রে ততটা নাই। সাহিত্যে সম্রাজ্যবাদের প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। কাজেই অখণ্ড বাঙলা সাহিত্যের যে চীৎকার বুদ্ধদেব বাবু করিয়াছেন, এর সাহিত্যিক কোনো অর্থ নাই।

এই দিক হইতে বুদ্ধদেব বাবুর আলোচ্য প্রবন্ধের অনেকখানিই তার প্রতিপাদ্য বিষয়ের জন্য অবান্তর সুতরাং এ ক্ষেত্রে অর্থহীন। তিনি সাহিত্যে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যের প্রতিবাদেই এত সব উঁচুদরের লম্বা লম্বা পিঠ-চাপড়ানি কথা বলিয়াছেন। কিন্তু নিজের সব কথা এক কোপে তিনি নিজেই কাটিয়া ফেলিয়াছেন। নিজের প্রতিপাদ্য বিষয়ের বিরুদ্ধেই তিনি অকাট্য যুক্তি দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন আমরা মুসলমানদের জীবনের কথা তাদের মুখেই শুনবো। বর্তমান সময়ে এ কাজ অমুসলমানের দ্বারা হতে পারে না।

আর অধিক কথা দরকার নই, এইটুকুই যথেষ্ট। মুসলমানদের জীবনের কথা মুসলমানকেই লিখিতে হইবে; হিন্দুদের দ্বারা এটা অসম্ভব; একথা যদি সত্য হয় তবে বুদ্ধদেব বাবু কলহ করিতেছেন কী লইয়া? বাঙালী মুসলমান তার নিজের জীবন-কথা তার নিজের ভাষাতেই বলিবে। স্বয়ং বুদ্ধদেব বাবুও সগৌরবে স্বীকার করিয়াছেন ‘মুসলমানদের জীবন সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।’

সুতরাং মুসলমান সাহিত্যিকদের এমন একটা কাজ করিতে হইবে, যার সম্বন্ধে হিন্দুরা কিছু জানেন না এবং যা তাদের দ্বারা অসম্ভব। এত সব ব্যাপার স্বীকার করিয়া লইবার পরও বুদ্ধদেব বাবুর অজ্ঞাতসারে তার মনে সাম্রাজ্যবাদী অসঙ্গতি প্রবেশ করিয়াছে। বুদ্ধদেব বাবু বলিয়াছেন ‘আমরা মুসলমানদের জীবন সম্বন্ধে কিছুই জানি না, এবং এটা আমাদের দোষ নয়।’

পার্ল বাকের মত, মার্কিন খ্রীষ্টান মেয়েলোক কয়েকটি বছর চীনের এক শহরে বাস করিয়া বৌদ্ধ চীনাদের সমাজ জীবনের খুঁটিনাটি জানিতে পারিলেন; খ্রীষ্টান ইউরোপের লেখকরা দুচার সপ্তাহের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে বেড়াইতে আসিয়া ইরানী-তুরানী-আরবী-মিসরী মুসলমানদের নিখুঁত জীবন-চিত্র আঁকিতে পারিলেন, আর হাজার বছর এক দেশে বাস করিয়া এক ভাষায় কথা বলিয়া একই খোরাক-পোশাক ব্যবহার করিয়াও বাঙলার লেখক সমাজ বাংলার শতকরা পঞ্চান্নজন অধিবাসীর জীবনের কিছুই জানিতে পারিলেন না, সে দোষ নিশ্চয় বুদ্ধদেব বাবুর নয় – সে দোষ আলবৎ হতভাগ্য মুসলমান সমাজেরই। বাঙলার লেখক সমাজ বিবেকবান বলিয়াই তারা মুসলমান বাবুর্চি-বেয়ারা ছাড়া আর কারো সম্বন্ধে কিছু লেখেন নাই। এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে অভিমান করা ছেলে-মানুষি, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা নিরর্থক। কারণ, বুদ্ধদেব বাবু নিজেই বলিয়াছেন-‘হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক মিলনের ক্ষেত্র নিতান্তত সংকীর্ণ পারস্পরিক মিলামেশা এত কম।’

সংকীর্ণ ও কম নিশ্চয়ই, কিন্তু সে দোষ আমাদের মুসলমানদের নয়। কিন্তু যার দোষেই হোক, হিন্দু-মুসলমানে কম মেলামেশা বলিয়াই বোধ হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ত্রিশ বছরের ডিপুটি জীবনে একজন মুসলমান সহকর্মীর সঙ্গে তার জানাশোনা হয় নাই; তার বদলে বহুদিন আগে-মরা-মোগল বাদশা-বেগমদের সঙ্গে মেলামেশার তার সুবিধা হইয়াছিল। হিন্দু কোনো উকিল ঔপন্যাসিকের সঙ্গে মুসলমান-মওক্কেলের, হিন্দু কোনো জমিদার-কবির সঙ্গে মুসলমান-প্রজার, হিন্দু কোনো অধ্যাপক- সাহিত্যিকের সঙ্গে কোনো মুসলমান-ছাত্রের, মেলামেশা হয় নাই; এ জন্য দোষ আমরা হিন্দুদিগকে দেই না এবং দেই না বলিয়াই নীরবে আমরাই আমাদের আত্মপ্রকাশের সাধনা করিতেছি। হিন্দু দেশবাসীর কাছে আমরা আত্মপরিচয় দিবারও প্রয়াস পাইতেছি। আমাদের জীবন হিন্দুরা সাহিত্যে ফুটাইতে পারেন নাই, পারিবেনও না। কাজেই, এ কাজ আমাদেরই করিতে হইবে এবং আমার মত করিয়া আমাদের শক্তি ও প্রতিভা অনুসারেই তা করিতে হইবে। আমাদের সাহিত্য আমাদের ভাষাতেই হইবে। আমাদের ভাষা যদি বাঙলা হয় তবে বাঙলাতেই আমাদের জীবন রূপায়িত হইয়া উঠিবে। বুদ্ধদেব বাবুর তাতে চিন্তিত হইবার কারণ নাই; কারণ তাতে বাঙলা সাহিত্যই সম্পদশালী হইবে। আর আমাদের ভাষাকে যদি বুদ্ধদেব বাবু বাঙলা বলিয়া স্বীকার না করেন, তবে আমাদের জীবন জানিবার জন্য বুদ্ধদেব বাবুকে আমাদের ভাষা শিখিতে হইবে। কারণ বুদ্ধদেব বাবু বলিয়াছেন ‘আমরা মুসলমানের জীবন জানতে চাই।’

যদি মুসলমানদের সত্যিকার জীবন বুদ্ধদেব বাবু জানতে চান তবে তিনি মুসলমানদের গলা টিপিয়া ধরিতে চান কেন? তিনি যার কিছুই জানেন না, যা ফুটাইতে তারা পারিবেন না বলিয়া কেবলি জবাব দিয়াছেন, সে কাজ তিনি হুকুম বা ফরমায়েশ দিতে আসিলেন কেন কোনটুকুকে তিনি সাহিত্যে পাকিস্তান বলিয়া অভিহিত করিতে চান? মুসলমানদের গার্হস্থ্য জীবনের নিত্য-ব্যবহার্য আরবী-ফারসী শব্দের আমদানীকে? বুদ্ধদেব বাবুর মত আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক-মনা সাহিত্যিককে আমরা এতটা সংকীর্ণ মনে করিতে পারিতেছি না। আশা করি, বুদ্ধদেব বাবু বাঙলা সাহিত্যকে হিন্দুর হেঁসেল অথবা অন্তত সরস্বতী দেবীর মন্দির মনে করেন না- যাতে নামাজ-রোযা, হজ্ব-যাকাৎকে পিছনে ফেলিয়া, পায়জামা তহবন্দের বদলে ধুতি ও নামাবলী পরিয়া বদনার পানির বদলে গাড়ুর গঙ্গা-জল হাতে লইয়া, প্রবেশ করিতে হইবে। তবে বুদ্ধদেব বাবুর আপত্তি কিসে? শুধু কি মুসলমান-সাহিত্যিক এই বিশেষণ? এ-নাম কি মুসলমান সাহিত্যিকরা নিজেরা লইয়াছেন? না বুদ্ধদেব বাবুরা বলিয়াছেন, ‘আজকের দিনের নজরুল ইসলাম বা জসীমদ্দীন মুসলমানিত্বের গণ্ডির মধ্যেই হয়তো আটকে আছেন, বাংলার সাহিত্য-জগতের সঙ্গে ভালো করে তাদের পরিচয়ই হচ্ছে না। তাদের সঙ্গে আমাদের – অর্থাৎ বাঙলার লেখক সমাজের – যোগাযোগ ক্ষীণ, ভাব-বিনিময় নাম মাত্র।

এই যে নজরুল ইসলাম ও জসীমদ্দীনকে ‘তারা’ করিয়া বুদ্ধদেব বাবু নিজকেই আমরা অর্থাৎ বাঙলার লেখক সমাজ করিয়া বসিলেন, এর সাহিত্যিক কদর্য্যতা ও শিষ্টাচারগত দারিদ্র্যের কথা না হয় নাই বলিলাম; নজরুল প্রতিভা ও জসীমদ্দীনের মনীষাকে তারা করিয়া বুদ্ধদেব বাবু নিজেকেই বাঙলার লেখক সমাজের আমরা বলিয়া কতটা ওজন-জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন, সে কথাও এখানে না হয় নাই তুলিলাম। কিন্তু এখানে এটা ত দেখা গেল যে, বুদ্ধদেব বাবুর মত আধুনিক সাহিত্যিকও বাঙলার লেখক সমাজের আমরার মধ্যে নজরুল ইসলামের স্থান দেন নাই। নজরুল ইসলামের সঙ্গে বাঙলার লেখক সমাজের যে যোগাযোগ ক্ষীণ সেটাও কি নজরুল ইসলামের দোষ? যে নজরুল ইসলাম বাঙলা সাহিত্যে বিশেষতঃ কাব্যে ও সঙ্গীতে নূতন-রূপ ও প্রাণ দিয়াছেন, যিনি কাব্যে অসংখ্য নতুন ছন্দ ও গানে পাঁচ হাজারের মত নতুন সুর দিয়াছেন, নাটকে-সিনেমায়-গ্রামোফোনে-রেডিওতে যাঁর হাজার হাজার সঙ্গীত গীত হইতেছে; সেই নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কি বাঙলার লেখক সমাজের কর্তব্য নয়? বাঙলার লেখক সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কি এই নজরুল ইসলামেরই একতরফা কর্তব্য? নজরুল ইসলাম সম্বন্ধে এত বেশী বলিলাম এ জন্য যে, ইনি সাহিত্যে পাকিস্তান ত দূরের কথা, রাজনৈতিক পাকিস্তানেও শুধু মুসলমান কবি বা মুসলমান সাহিত্যিক বলিয়া অভিহিত করেন নাই। তিনি বাঙলার ‘জাতীয় কবি’ হইবার দাবী ও সাধনাই করিয়াছেন; সে অধিকারও তার আছে। তিনি শুধু ঈদ, কোরবাণী ও মোহাররমের কবিতাই লেখেন নাই; তিনি শ্যামা-সঙ্গীত, গঙ্গা-স্তোত্র এবং রাধা-প্রেমের সঙ্গীতও গাহিয়াছেন তবু কি তিনি বাঙলার সাহিত্য-জগতের বা বাঙলার লেখক সমাজের একজন আমরা হইতে পারিয়াছেন? স্বয়ং বুদ্ধদেব বাবুই তাকে মুসলমানের গণ্ডিতে আবদ্ধ করিয়াছেন। নজরুল ইসলাম প্রভৃতি যে দুচারজন মুসলমান লেখকের মধ্যে বুদ্ধদেব বাবু প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন অথবা যারা দুচারটি ভাল কবিতা বা গল্প লিখেছেন, বাঙলার সাহিত্য-জগত বা বাঙলার লেখক সমাজ তাদের কী মর্যাদা দিয়াছেন? বুদ্ধদেব বাবু ভারত-সচিব মিঃ আমেরীয় ভাষায় আমাদিগকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, সাহিত্যিকদের মর্যাদা কেউ কাউকে হাতে তুলে দিতে পারে না; এ অর্জন করে নিতে হয় নিজের জীবনের সাধনায়। অথচ আমরা বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ ও কাসিমবাজারের মহারাজাকে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনীর সভাপতিরূপে দেখিয়াছি। অন্য অন্য মুসলমানের কথা নাই বলিলাম; মীর মোশাররফ হোসেন ও কবি কায়কোবাদকেও বাঙলার লেখক সমাজ উক্ত মহারাজাদ্বয়েরও সমান সাহিত্যিক মর্যাদা দিয়াছেন কি?

এসব কথা আমি অভিমান করিয়াও বলিতেছি না; অভিযোগ করিয়াও বলিতেছি না। কারণ বুদ্ধদেব বাবুর কাছে অভিমান করা ছেলেমানুষি এবং অভিযোগ করা নিরর্থক। আমি শুধু প্রকৃত সত্যের সম্মুখীন হইব। সত্যের সাধনাই সাহিত্যিকের সাধনা; বাস্তবের রূপায়ণই সাহিত্যের প্রাণ। সত্য গোপন করিয়া অথবা ভণ্ডামী করিয়া সত্যিকারের সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। এই অপরাধেই বাঙলা সাহিত্য সত্যিকারের বাঙলা সাহিত্য আজো হয় নাই; বাঙলার মাটির সঙ্গে এ সাহিত্যের আজো প্রাণের যোগ-প্রতিষ্ঠা এই জন্যই হয় নাই। আর্টের নামে বুদ্ধদেব বাবুর বাঙালী লেখক সমাজ এ যাবৎ রচনা করিয়াছেন, সেটা হইয়া উঠিয়াছে সুদৃশ্য শ্বেতমর্মরের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল; তাজমহল ত দূরের কথা, বাঙলার কুটীরের প্রাণও সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।

বুদ্ধদেব বাবুরা রাগ করিবেন না; তারা সত্যকে স্বীকার করিয়া লউন। সাহিত্যকে তারা কৃষ্টির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিকাশের স্বাধীনতার লীলাভূমি বলিয়া মানিয়া লউন। তবেই তারা বুঝিবেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সাহিত্যিকদের দৃষ্টিতে কালচার‍্যাল অটনমী ছাড়া আর কিছুই নয়। খোদার বিচিত্র দুনিয়ার সত্যিকার প্রতিবিম্ব মানুষের মন, আর মানুষের মনের বিচিত্র বিকাশের ক্ষেত্র এই সাহিত্য। এখানে বুদ্ধদেব বাবুরা সকলকার কৃষ্টিকে স্বাধীনভাবে সফল হইবার সুযোগ দিন। বাগানের কৃত্রিম সৌন্দর্য সাহিত্যের আদর্শ। কল্পনার উচ্চতাই সাহিত্যের প্রাণ। অনুভূতির তীব্রতা কালচার‍্যাল অটনমীতেই সম্ভব। বিভিন্ন দেশের যে-সব মনীষীর সাহিত্য সৃষ্টি বিশ্ব-সাহিত্যে অমরত্বের মর্যাদা লাভ করিয়াছে তারা নিজেদের ভাষায় নিজেদের কৃষ্টিকেই রূপায়িত করিয়াছেন- কৃত্রিম বিশ্ব-কৃষ্টির বড় মানুষী ফলান নাই। কাজেই বুদ্ধদেব বাবুরা এখানে হুকুমের দৌরাত্ম্য আমদানী করিবেন না। মানুষের আত্মার টুটি চাপিয়ে আর যেই ধরুক, সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বাবুরা বাবুরা ধরিবেন না।

মুসলমান দেশবাসীর প্রতি বুদ্ধদেব বাবুরা একটু বিশ্বাস রাখুন। তাদের বুদ্ধির প্রতি একটুখানি শ্রদ্ধা অর্জনের চেষ্টা করুন। নিজেদের বুদ্ধির নির্ভুলতায় তারা অতটা আত্মহারা হইবেন না। তারা বিশ্বাস করুন, মুসলমান সাহিত্যিকরা বাঙলা সাহিত্যেরই সাধনা করিতে চান। তারা চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি, বঙ্কিম, মাইকেল রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সাহিত্য হইতেই সাহিত্যিক প্রেরণা লাভ করিয়াছেন এ কথাও বুদ্ধদেব বাবুরা বিশ্বাস করুন। বুদ্ধদেব বাবুরা মুসলমানদের কিছুই পাঠ করেন নাই বলিয়া মুসলমানরাও হিন্দুদের কিছুই পাঠ করেন নাই, বুদ্ধদেব বাবু এটাও মনে করিবেন না। বুদ্ধদেব বাবুরা মুসলমানদের কিছুই জানেন না বলিয়া মুসলমানরাও হিন্দুদের কিছুই জানেন না ইহাও বুদ্ধদেব বাবুরা মনে করিবেন না। এ-সব পাঠ- টাঠ করিয়া, বুঝিয়া-সুজিয়াই মুসলমানেরা আত্মবিকাশ করিতে চায় এবং তা মাতৃভাষার সাহায্যেই করিতে চায়। বুদ্ধদেব বাবু ধমক দিয়েছেন, আমরা মুসলমান সাহিত্যিকরা যদি তার পছন্দমত সাহিত্য সাধনা না করি তবে যেন আমরা বাঙলা সাহিত্য সেবা ত্যাগ করিয়া উর্দু সাহিত্য ধরি। বুদ্ধদেব বাবুর এ-ধমকে আমরা ভড়কাইয়া যাইব না। মুসলমান সাহিত্যিকরা সফলতার সঙ্গে উর্দুর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াছে। বাঙলা ভাষাকেই তারা মাতৃভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বাঙলা ভাষার সাহায্যে তারা নিজেদের জীবনের বিকাশ করিতে চায়। উর্দুওয়ালা কোট-প্যান্টধারী মওলানাদের ধমকেও বাঙালী মুসলমান তার মাতৃভাষা ত্যাগ করে নাই, কোট-প্যান্টধারী পণ্ডিতদের ধমকেও তারা মাতৃভাষা ত্যাগ করিবে না।

কিন্তু সেটা হইবে বাঙালী মুসলমানদের মাতৃভাষা-হিন্দুর মাতৃভাষা নয়া বিদ্যাসাগর প্রভৃতির পাণ্ডিত্যের ধাক্কায় যদি উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা মাতৃভাষ্য ত্যাগ করিয়াই থাকে, তবে বাঙলার মুসলমান তাহাদিগকে বিলাত-ফেরৎ ব্যারিস্টারদের মতই অনুকরণের অযোগ্য মনে করিবে। তাদের ধমকে তারা মাতৃভাষার স্বকীয়তা নষ্ট করিবে না। মুসলমানরাই বাঙলা ভাষা সৃষ্টি করিয়াছে, বাঙলা-সাহিত্যও সৃষ্টি করিয়াছে। তারাই, বুদ্ধদেব বাবু বিশ্বাস করুন, তারাই বাংলা সাহিত্যকে আরো উন্নত করিবে। বুদ্ধদেব বাবুদের কাছে রবীন্দ্র-সাহিত্যই বাঙলা সাহিত্যের চরম বিকাশ বিবেচিত হইতে পারে, কিন্তু বাংলার মুসলমান তা মনে করে না। বাংলা সাহিত্যকে তার আরো উন্নত করিতে চায়।

এটা মুসলমানদের তুকাব্বরী নয়। মুসলমান বাঙলা তথা ভারতের, শিল্প-সাহিত্য কৃষ্টি সভ্যতাকে উন্নত ছাড়া অবনত কখনো করে নাই। তারা এসরাব সোরা, সেরাজ, পেখওয়াজ, দিয়া সঙ্গীত-শিল্পকে উন্নত করিয়াছে। জুতা-মোজা আচকান-চাপকান, শিরওয়ানী-পাজামা-তহবন্দ-টুপী-পাগড়ী দিয়া পোষাককে সভ্য-ভব্য করিয়াছে, পিঁয়াজ-রসুন, মুরগী দিয়া পোলাও-কোর্মা পাকাইয়া তারা খোরাককে সুখাদ্য করিয়াছে; বুদ্ধদেব বাবু বিশ্বাস করুন, মাতৃভাষাকে, এবং এর সাহিত্যকে তারা আরো উন্নত করিতে চায়। বাঙলার পাড়াগাঁয়ে চারি কোটি মুসলমানের মুখে যে অফুরন্ত শব্দ-সম্পদ আছাড়িয়া মরিতেছে, সাহিত্যের মর্যাদায় যদি তারা বাঙলার অভিধানে স্থান পায়, তবে বাঙলা ভাষা হইয়া উঠিবে ভারতের আন্তর্জাতিক ভাষা; বাঙলা সাহিত্য হইয়া উঠিবে নিখিল ভারতীয় জাতীয় সাহিত্য। পিঁয়াজ-রসুনের গন্ধে, মুরগীর অত্যাচরে ও পাজামা-তহবন্ধ-টুপীর অসভ্যতায় বুদ্ধদেব বাবুরা এককালে অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিলেন। সে ভীতি তাদের এখন গিয়াছে। মুসলিম-ভাষা-ভীতি ও তাদের তেমনি দূর হউক; নয়া বাঙলার নয়া ভাষা ভারতের শ্রেষ্ঠ ভাষা হইয়া উঠুক; বুদ্ধদেব বাবুর সাহিত্যিক মন সে শুভক্ষণের জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকুক, ইহাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো প্রার্থনা।

 

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →