নতুন দলের প্রতি নসিহতনামা: এথিকস ও মেটাফিজিক্স নিয়া কয়েক ছত্র

যারা রাজনীতি করেন বা করবেন তাদেরকে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে হয়। ইসলামের এথিকাল প্যারাডাইমে কতগুলো দারুণ নীতি আছে, যেগুলো একই সাথে ধর্মাচার ও প্রবলভাবে রাজনৈতিকও। যেমন, নিজেদের মানুষদের প্রতি রহমদিল হওয়া : রু্হামাও বাইনাহুম। আক্রমনোদ্যত শত্রুর প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনও রাজনৈতিকতার জন্যে জরুরি (এই ক্ষেত্রে কোমলতা ও ক্ষমার প্রসঙ্গ আলোচনা করছি না, আপাতত)। নিজেদের মানুষদের সাথে নীতিপ্রণোদিত আসাবিয়া ব্যতিরেকে উন্নত শির নিয়ে কোন কমিউনিটি, পার্টি চলতে পারে না। তবে, এই “নিজ” ও “আপন” এর পরিমণ্ডলও বাড়াতে হয়।
অনেক ব্যাপারেই “নিজের চেয়ে অপরকে অগ্রাধিকার দেওয়া” আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি । পারিভাষিকভাবে, এটাকে “ইসার” বলা হয়। সুরা হাশরে, আনসারদেরকে প্রশংসা করা হয়েছে এই বলে যে, তাঁরা নিজেদের অভাব সত্ত্বেও অগ্রাধিকার দিত মুহাজিরগণকে। অনেক সময় নিজের প্রয়োজন ছেড়ে দিয়ে হলেও অপরের প্রয়োজন মেটাতে হবে ৷ এই কাজ বেশ কষ্টের, তাই এই কাজ খোদার কাছে পছন্দনীয়ও বেশি, অর্থাৎ সোয়াব বেশি। আবার, একই সাথে উপকৃত ব্যক্তির সাথে, যিনি শুধু ব্যক্তি নন, কেননা তারও পরিবার ও বন্ধুবান্ধবও আছে, কার্যকর একটা সম্পর্কও তৈরি হলো। জগতপরিমন্ডলে উপকৃত মানুষটিও উপকারকারীর কাজে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। ইসলামে care of the self যেমন গুরুত্বপূর্ণ, care of the worldও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এইভাবে সম্পর্কের নেটওয়ার্কও তৈরি হয়, যা একই সাথে আদর্শ ও মানবিক কনটিনজেন্সির দ্বারা রঞ্জিত। একটা হাদিসের মূলভাব এমন , যে তার ভাইয়ের কোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তাঁর সাথে হেঁটে গেল, তা নফল ইবাদতের চেয়েও উত্তম। আরেক জায়গায় সম্ভবত, মসজিদে এতেকাফে থাকার চেয়েও উত্তম বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, যে তার ভাইয়ের কোন দুর্ভোগ বা মুসিবত দূর করলো, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাঁর দুর্ভোগ দূর করবেন। একজন আরেকজনকে সাহায্যরত থাকলে আল্লাহও তাঁকে সাহায্য করতে থাকেন। কমিউনিটির অপর ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলাকেও সাদাকা বলা হয়েছে। অভুক্তকে খাদ্য দান, চাকুরীহীনকে চাকুরী প্রদান, ঋণগ্রস্থ মানুষের ঋণ পরিশোধে সহায়তা করা, অধিকারহীন ও বঞ্চিতকে তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এই কাজগুলো মুসলিম কমিউনিটিসমূহের এথিকাল ফ্যাব্রিক। তাদের সাব্জেক্টিভিটি বা কর্তাসত্তার পরিগঠন ও তাগলিব (বিজয়) এইভাবেই ঘটেছিল, এই ভ্যালুসগুলোর ইন্টার্নালাইজেশনের মধ্য দিয়ে।
এগুলোকে নীতিকথা বলে মনে হলেও, ইসলাম চায় এগুলো মানুষের “হ্যাবিটাস”-এ রূপান্তরিত হোক, এগুলোর একালচারেশন ঘটুক, এগুলো হয়ে উঠুক মানুষের ডিসপজিশন, একদম স্বাভাবিকীৃত আচরণ। ইসলামে ল ও এথিক্স আলাদা নয়। আমরা জানি, আইন মানেই বলবৎযোগ্য, অর্থাৎ যেটার পেছনে ও প্রয়োগে বলের ব্যাপার থাকে। ইসলামে ব্যাপারটার ভিন্ন মাত্রা আছে; তা এই রকম যে, একজন ব্যক্তি নিজেকে আইন, যা এথিক্সও, তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। এই যে নিজেকে সঁপে দেওয়া, নিজেকে সমর্পণ করে দেওয়া, এটাই ইসলাম। ইসলামে আছে রুল অব ল , যা জাতিরাষ্ট্রের “রুল অব দ্য স্টেইট ” থেকে আলাদা ও বৃহৎ । সেকুলার পাওয়ারের লোকেশন হচ্ছে, আইন ও এথিক্সের দ্বিবিভাজমের মাঝখানটায়। আধুনিক রাষ্ট্রে রুল অব দ্য স্টেইটের উপর আর কিছু নাই, ইসলামে “ল” সবার উপরে, যে ল’র ভেতরে আছে অপরিবর্তনীয়তা, ঐশীডাক ও রোবাস্টনেস। ইসলামে, শরীয়াহ একটা মরাল প্যারাডাইম ও কালচার বটে , শুধু লিগাল ডক্ট্রিন বা জুডিশাল সিস্টেম নয়। এইখানে এথিক্স ও মরালিটি আইনের উৎস। ল ইজ দ্য ইন্সট্রুমেন্ট অব মরালিটি হেয়ার। ইসলাম বলে, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে আমালে সালেহ বা ভালো কাজের জন্যে, ইবাদতের জন্যে। এই উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে অনটোলজি মিশে যায় টেলিওলোজির সাথে ; মানুষের বিদ্যমানতার অর্থই নিহিত আছে এই উদ্দেশ্যময়তায়।
ইসলামের প্যারাডিগম্যাটিক স্ট্রাকচারের ভেতরে, প্রত্যেক মানুষকেই দায়িত্বশীল মনে করা হয়। প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে৷ তাই, দায়িত্বশীলতা একটা প্র্যাক্সিস, একটা হ্যাবিটাস, একটা সাইকো-এপিস্টেমোলজি। নতুন দল করতে হলে নতুন মানুষ হয়ে উঠতে হবে। এর মধ্যে কয়েকটি গুণ অর্জন করতে হবে ।
১। এন্টি-ম্যাটেরিয়ালিস্ট হইতে হবে৷ অতি বস্তুবাদী হওয়া যাবে না। বস্তুবাদ মানে হচ্ছে ” Critical and ultimate transgression of the divination of material world “। মনে রাইখেন, এই জগতই শেষ না, জীবনের এই পর্যায়ই শেষ না, বর্তমান সুসময়ই চিরন্তন না। এটা কোন ফেইথের ব্যাপারও না, এটা একটা ফেইথ না, একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা।
২। নিজেরা সার্বভৌম হয়ে উঠবেন না। ম্যাটেরিয়ালিস্ট হয়ে উঠার সাথে নিজেরা সার্বভৌম হয়ে উঠার সম্পর্ক আছে।
৩।” হায়া” রাখবেন। এটা লজ্জাশীলতার নিষ্ক্রিয়তাকে বোঝায় না। এটি ” psycho-epistemic humility and gratitude” । “হায়া” একটা পারফরমেটিভ বিষয়। জুডিথ বাটলারীয় অর্থে এটার তাৎপর্য হচ্ছে, এমন একটা কাজ চুজ করা যা রিয়ালিটিকে রিফ্যাশন করে, নতুন ক’রে গড়ে তোলে। এই “হায়া”র মধ্যে পড়বে বিনয়, শুকর বা কৃতজ্ঞতাবোধ ও অপরের শরিকানার স্বীকার। এই ” হায়া” আধুনিক জমানায় ব্যক্তির বা দলের সভরেন হয়ে ওঠার এন্টিডট বা প্রতিষেধক ।
৪। কথা ও কাজ ( স্পীচ এন্ড এক্ট) এ অর্থপূর্ণ হবেন৷ কোন কথা ও কাজকে নিরঅর্থকতা ও শুণ্যার্থে পর্যবসিত হতে দিয়েন না৷ এইখানে আপনি জগতমুখী হবেন, বসবাস করবেন দায়িত্বশীলতার একটা এপিস্টেমোলজি ও অন্টোলোজির ভেতরে।
৫। তত্ত্ব ও চর্চার ডায়ালেকটিক রিলেশনটা মনে রাখবেন। খোদার জগতের একটা ইকোলজি আছে, সব কিছু এইখানে ইন্টারকানেক্টেড। আপনার কথা ও কাজ প্রভাবশুণ্য নয়। জগতের সব কিছুর স্টুয়ার্ডশিপ বা ট্রাস্টিশিপ মানুষের, সেই খলিফা হবার উপযুক্ত হয়ে উঠুন, নফসানিয়াতের লাগাম টেনে ধরুন। অনুভব কইরেন, যে “শক্তি” আমরা জগতে আসার আগেও ছিল, এবং আমরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার পরেও থাকবে সেই অমোঘ ও চিরন্তন বিদ্যমানতার সাথে আমাদের প্যারাডিগমেটিক লিংক ছিন্ন হবার ফলেই আমাদের আধুনিকতার এই দেউলিয়াত্ব।
মনে রাখুন, মানুষের মাখলুকিয়াত ( Createdness) ও অনিবার্য নশ্বরতা ও ক্ষণস্থায়িত্বকে ( Ephemerality)।
রাষ্ট্রতত্ত্বে প্রি-ফিগারেটিভ পলিটিক্স বলে একটা ধারণা আছে। এটির অর্থ হচ্ছে, কোন আন্দোলন বা দল রাষ্ট্রে যে ধরনের পলিটিক্স করতে চায়, নিজেরা বা নিজেদের দলের মধ্যেও তারা সেই চর্চাগুলো করবে । তাঁরা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চান , নিজেরা সেই আদর্শের “এম্বডিমেন্ট” বা মূর্তরূপ হয়ে উঠবেন । কোন দল রাষ্ট্রে যে ব্যবস্থা বা নীতি কায়েম করতে চান, নিজেদের মধ্যে সেই চর্চা শুরু করবেন ও জারি রাখবেন। বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যতকে আগেভাগেই মূর্ত ক’রে তোলার এই চর্চাকে প্রি-ফিগারেটিভ পলিটিক্স বলা হয় । সম্ভবত, সেলিম রেজা নিউটন প্রি-ফিগারেটিভ পলিটিক্সের অনুবাদ করে ছিলেন “প্রাক-রূপায়নের রাজনীতি”। আরও ভালো অনুবাদ লাগবে। দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক রূপান্তরের পরিবর্তে দ্রুত রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাবনিকাশ করবার যে প্রচলিত রাজনীতি, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করে এই প্রি-ফিগারেটিভ পলিটিক্স-এর ধারণা৷
বন্দীত্বের দীর্ঘরাত্রি শেষে আসুক মুক্তির শুভসকাল, নফসানিয়াতের ঘনঘোর ঘেরাটপ ভেঙে জেগে উঠুক রুহানি আসমান। বাংলাদেশের একেবারে সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ আমার নসিহা, হে বন্ধু, ভাই ও সন্তানগণ আমার…

জগলুল আসাদ

Latest posts by জগলুল আসাদ (see all)
- নতুন দলের প্রতি নসিহতনামা: এথিকস ও মেটাফিজিক্স নিয়া কয়েক ছত্র - ফেব্রুয়ারি 28, 2025
- ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের বিভীষিকাময় নির্বাচন ও কিছু অভিজ্ঞতা - ডিসেম্বর 29, 2024
- ” ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন”: বিডিআর হত্যাকাণ্ড ও ক্যাপ্টেন মাজহারের স্মৃতি - আগস্ট 31, 2024