Main menu

বুদ্ধিজীবীর মুখে ছাই – মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮ – ১৯৮১)

বাংলাদেশের লিটারেচারের যেই ল্যান্ডস্কেপ সেইখানে মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮ – ১৯৮১) এর নাম অনেকেরই জানার কথা না; যারা জানেন তারা মনে করতে পারবেন উনার “পল্টন জীবনের স্মৃতি” নামের বইটার কথা, যেইটা উনি যখন পয়লা বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়াতে ছিলেন, সেই সময়ের কথা, ১৯৪০ সালে ছাপা হইছিল, পরে “মো’মেনের জবানবন্দী” (১৯৪৬) নামে একটা অটোবায়োগ্রাফিকাল বই লেখছিলেন যেইটা পপুলার হইছিল এবং ইংলিশে ও উর্দুতে ট্রান্সলেট হইছিল

কিনতু উনি মেইনলি স্টোরি-টেলার, সৈয়দ মুজতবা আলী’র ঘরানার রাইটার অনেকটা, খুবই উইটি-মেজাজের, কিনতু উনার দুনিয়া খুবই আলাদা এবং বাংলাদেশি; উনি ইতিহাসের বইও লেখছেন – চট্টগ্রামের ইতিহাস ৩ খন্ডে, বাঙ্গালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত লেখছেন ৪ খন্ডে, স্বাধিনতার পর পরে… ১৯৭৮ সালে একুশে পুরষ্কারও পাইছিলেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে আইয়ুব খাঁ’র সময়েও প্রাইজ-টাইজ পাইছিলেন; সরকারি চাকরি থিকা রিটায়ার করার পরে জামানা নামে একটা পত্রিকা ছাপাইতেন চিটাগাং থিকা…

এই লেখাটা উনার জীবনের শেষ লেখা, উনি মারা যাওয়ার পরে ১৯৮৪ সালে “মাহবুব-আলম স্মৃতি স্যুভেনির” নামে একটা বইয়ে ছাপা হইছিল; উনার আরগুমেন্ট’টা খুবই ইন্টারেস্টিং, যে, বুদ্ধিজীবীরা খালি ধ্বনি করেন, মানে, কথাই বলেন, কোন কাজ করতে চান না, জানেন না, এমনকি কাজ করাটারে খুবই খারাপ কাজ বইলা মনে করেন!

এবং এই বুদ্ধিজীবীরা একটা কলোনিয়াল লিগাসির ভিতর দিয়া ক্ষমতার সাথে একটা ক্লোজ রিলেশন মেইনটেইন কইরা এন্টি-পিপল পজিশন হিসাবে সমাজে রোল প্লে করেন!

এবং উনি ১৯৮১ সালে প্রেডিক্ট করতেছেন যে, এর ফলে দেশে এক ধরনের “পার্টিজান” পদ্ধতি চালু হবে, যেইটারে বাতিল না করতে পারলে সত্যিকারে স্বাধিনতা আসতে পারবে না! হলি কাউ! মানে, এই লেখার সাথে অনেক জায়গাতেই অন্যমত থাকতে পারে আমাদের, কিনতু কেমনে আন-নোটিশড থাকতে পারে!

মেবি, খালি পলিটিকাল-ই কালচারালি একটা “পার্টিজান” সিসটেমের কারনেই এইটা পসিবল হইতে পারছে! তো, উনার লেখা-পত্রগুলা আমাদের আবারো রিভিউ করতে পারাটা উচিত, এই লেখাটা দিয়া সেইটা শুরু করতে চাইলাম আমরা

ই.হা.

বুদ্ধিজীবী কথাটা এ দেশেই খুব চোখা হয়ে উঠেছে। পৃথিবীর আর কোন দেশেই এ কথাটার উপর এত বেশী জোর দেওয়া হয় না।

মানুষ মাত্রেই বুদ্ধিজীবী। বস্তুতঃ বুদ্ধি আছে বলেই সে মানুষ, প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ। নতুবা, ইতর-প্রাণী বা জন্তু-জানোয়ারের সাথে তার কোন পার্থক্য থাকতো না।

কিন্তু, বঙ্গে তথা বাংলাদেশে ‘বুদ্ধিজীবী’ কথাটা এক বিশেষ অর্থে’ ব্যবহার হয়ে আসছে। ‘বুদ্ধিজীবী’ সাধারণতঃ লেখা-পড়া জানা মানুষ।

এই লেখা-পড়াকে ‘কোরাণ’-এ কোন দ্বীকৃতি দেওয়া হয় নি। দেখান হয়েছে যে বনি-ইস্রাইল যখন ঠিক পথে চলছিল তাদের পথ-ভ্রষ্ট করেছিলেন যিনি তিনি হচ্ছেন পণ্ডিত সামেরী – এক বুদ্ধিজীবী – লেখা-পড়া জানা।

মুসা বনি-ইস্রাইলকে রওয়ানা করিয়ে দিয়েছিলেন নিরাকার একেশ্বরের উপাসক রূপে। এখন পণ্ডিত সামেরী বল্লেনঃ চলো হে, আমরা একটা সোনার গো-বৎস বানাই এবং তাকে পূজা করি।

মুসা ছোট ভাই হারুণকে সঙ্গে দিয়েছিলেন বনি-ইস্রায়েলের রক্ষক ও পথি প্রদর্শক রূপে। হারুণ কাজে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেনঃ বনি ইস্রায়েল একেশ্বরবাদ ছেড়ে প্রতিমা-পূজক হয়ে গেছে। বেপথু হয়ে গেছে।

পটিয়া রেল ষ্টেশনে একদিন ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলুম। এক ব্যক্তি এসে সালাম কর্লেন। দেখিঃ আমার এক দূর সম্পর্কে’র ভাগ্নে। জিগ্যেস কর্লমঃ বাবা, ভাল আছ? তোমার কয়টি ছেলে-মেয়ে?

বল্লে: একটি মাত্র মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গেই গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললে।

আমি প্রশ্ন কলম: বাবা, দীর্ঘশ্বাস ফেললে কেন? উত্তর কর্লে: মেয়েটিকে বেশী লেখা পড়া করাতে পারি নি!

আমি বললুমঃ ও, এ ব্যাপার! আচ্ছা, বলো দেখি, আমার গাঁয়ে গেলে যে দয়া-মায়া পাই – আমাদের মা-মাসীদের হাতে যাঁরা সকলকে সুখী করার জন্যে জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন-তাঁরা কি লেখা পড়া জানা লোক?

ভাগ্নে বল্লে: না, তাঁরা লেখা পড়া জানা নন।

আমি বললুম: বাবা কলমের আগায় এর জিনিস ওকে দেয় মামলা মোকদ্দমা লাগিয়ে দিয়ে সমাজকে শোষণ করে, সত্যকে মিথ্যা করে মিথ্যারে সত্য করে তারা কি রকম লোক, তারা কি নিরক্ষর অশিক্ষিত?

ভাগ্নে উত্তর কলে: তারা লেখা পড়া জানা লোক।

আমি বললুম, তবে? তুমি কেন আফসোস কচ্ছ যে তোমার মেয়েকে বেশী লেখা পড়া করাতে পার নি? আসল প্রশ্ন হলো লোকের ভাল হওয়া, লোকের লেখা পড়া জানা নয়। জান? ‘কোরাণ’-এ কেউ যদি ভাল কাজ করে তার পুরষ্কার বলা হয়েছে: তাকে ভাল লোকদের বৈঠকে আসন দেওয়া হবে – যে বৈঠকে প্রধান আসন হচ্ছে রসুলে আকরমের – আর কে না জানে যে রসূলে আকরম নিরক্ষর ছিলেন।

ইহার তাৎপর্য এইযে ইসলাম শরীয়ৎ (শাস্ত্র), মারেফৎ (অধ্যাত্ম), তরীকৎ (গুরু প্রদর্শিত পথ) ও হকীকৎ (সত্য স্বয়ং সমুদ্ভাসিত) – সাধনার এই চারি মার্গই স্বীকার করে। এর কোন মার্গের জন্যই লেখা-পড়া জানা অপরিহার্য নহে।

নিরক্ষর ব্যক্তিকে রসুলে আকরম কবে আল্লাহ তা’লা যেন মানুষকে তাঁর ‘মরজি’ সম্বন্ধে ইশারা করেছেন। কিন্তু, বঙ্গে তথা বাংলাদেশে বুদ্ধি-জীবীরা তাঁদের বুদ্ধিজীবিতাকে অর্থাৎ লেখা-পড়া জানা বিদ্যাকে এমন এক নির্লজ্জ আত্মশ্লাঘায় এবং ভয়াবহ মানব-পীড়নের নজিরে পরিণত করেন মানুষের ইতিহাসে সম্ভবতঃ যার কোন তুলনা নেই। তাঁরা ‘লেখা-পড়া’ করাকে তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ঘোষণা করেন এবং সমাজের বৃহত্তর অংশকে অযোগ্য ঘোষণা করে তাদের ‘লেখা-পড়া’ থেকে বঞ্চিত রাখেন। আবার, ইহাও করেন ‘ধর্ম’-র নামে – তাও আবার ‘সনাতন ধর্ম”।

ইতিহাস পর্যালোচনা কলে দেখা যায় বঙ্গ তথা বাংলাদেশের বুদ্ধি-জীবীরা দেশের নানারূপ ভাগ্য-বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এক ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে এসেছেন।

এ’দের চরিত্র ক্রমে এরূপ দাঁড়িয়ে যায় যে তাঁরা প্রত্যেকেই আত্ম-সর্বস্ব হয়ে উঠেন। দশের হিতে কোনরূপ ব্যক্তি-স্বার্থ ত্যাগ দূরের কথা, তাঁরা এর ধারণাই কর্তে অক্ষম হয়ে পড়েন।

জাতি গঠনে তাঁরাই প্রধান বাধা হয়ে পড়েন। কারণ, এই সংকীর্ণ শ্রেণী রাষ্ট্রের সব লেখা-পড়ার কাজ একচেটিয়া অধিকার করে নেয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা ‘ঘুষ’ ‘দস্তুরী’ ‘পাওন’ প্রভৃতি বসিয়ে ন্যায্য কর্তব্যের বদলে অন্যায় ভাবে আয় বৃদ্ধির উপায় করে নেয়।

এক দিকে যখনই যে শক্তি এ দেশের উপর শাসন কায়েম করেছে তাদের হাত থেকেছে ওদের পদ সেবায়, ওদের সঙ্গে সহযোগিতায়। অন্য দিকে তাদের পা থেকেছে এ দেশের জনগণের কাঁধে। অরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মত পা দিয়ে গলা টিপে ধরে তারা জনগণের উপর শ্বাসরোধী জুলুম চালিয়েছে।

সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে নূতন নূতন জুটি করে তার। এক দিকে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছে, অন্য দিকে জনসাধারণে উপর তাদের শোষণকে রুমে আরো কঠোর এবং সার্বিক করে তুলেছে।

ধর্মের নামে পন্ডিত সামেরীর ন্যায় তারা এমন এক বিধান প্রবর্তন করে যা একান্তভাবে স্থানীয় এবং পৃথিবীর অন্য কোন অংশের মানুষের সাথে যা মিল খায়না এবং যার যুক্তি ঐতিহাসিকতা তাদেরই পরবর্তী মনস্বীগণ অস্বীকার করেছেন। কিন্তু, তাদের অত্মশ্লাঘা এবং আত্ম-সম্মোহণ এত বেশী যে তাদের এই অস্বীকৃতি কার্যকরী হয় নি, কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

শুধু তাহাই নহে। তারা নবাগতদেরও দীক্ষিত করেছে তাদের এই সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তিতেঃ নবাগতরা পরিণত হলো নূতন এক বৃদ্ধি-জীবী সমাজে। কিন্তু, তারা ‘সনাতনী’ নহে। সনাতনী, প্রাচীন বুদ্ধিজীবী সমাজ ইতিমধ্যে বিদেশী শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতা করে নিজেদের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে নিয়েছে। এই ক্ষমতার ভিত্তি থেকে তারা রব তুললেঃ শাসন এবং শোষণে আমরাও ভাগ চাই। নূতন বুদ্ধিজীবী সমাজও তাদের অনুকরণে লেগে গেল। জন্ম হলো এদেশে আন্দোলন ধর্মী রাজনীতি।

একদিন বিদেশী শাসন বন্ধ হয়ে গেল। উভয় বুদ্ধিজীবী সমাজই যার যার এলেকায় শাসন ও শোষণের সম্পূর্ণ এখতিয়ার পেয়ে গেল।

কিন্তু, যেহেতু নূতন বুদ্ধিজীবী সমাজের কোন সনাতন ভিত্তি নেই, ধ্বনিই হলো তাদের আন্দোলনের সর্বস্ব। তারা কোন সেবার কাজ জানে নি, নিজেদের দল ছাড়া আর কিছুই গড়ে তোলেনি। শাসনের তালিম তারা পায়নি, সনাতন বুদ্ধিজীবীদের অভিজ্ঞতা-লব্ধ শিক্ষা তারা এড়িয়ে গেছে। এখন তাদের আশ্চর্য হবার পালা। এক কালে ধ্বনি দিয়ে কাঁধের ভূত তাড়ান সম্ভব হয়েছে। এখন ধ্বনিতে আর কাজ হচ্ছে না।

এক গৃহিনী উনানে ডাল চড়িয়ে দিয়ে ঘাটে গিয়েছিলেন। স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন ডালের উপর চোখ রাখতে, ডাল উৎড়িয়ে উঠতে পারে।

ডাল সত্যই উৎরিয়ে উঠল। স্বামীটি ছিল আমাদের হালের বুদ্ধি-জীবী সমাজের ন্যায় ধ্বনিসর্বস্ব। সে ডালকে লক্ষ্য করে ধবনি দিতে লাগল। কিন্তু, উৎরানো ডাল কি আর ধ্বনিতে বাগ মানে! নিরুপায় বুদ্ধিজীবী তখন একই ধ্বনিকে বিভিন্ন প্রকারে উচ্চারণ করে ‘দোহাই’ পাড়তে লাগল: আমাদের হালের বুদ্ধিজীবী সমাজের হয়েছে সেই অবস্থা।

তাদের এই তালিম হয় নি যে রাষ্ট্রের স্থিতি হলো জাতীয় ঐক্যের উপর। একে তো দেশের নিরক্ষর অংশকে তারা জাতির অংশ বলেই গ্রহণ করে নি, তদুপরি বিদেশী আধিপত্যের অবসান হওয়ার ‘শাসন’ ও ‘শোষণ এই দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে (এটা এ দেশের বরাবরের ঐতিহ্য) এখন ‘শোষণ’ই বড় হয়ে উঠেছে। সেই শোষণেরও আবার কোন ধর্ম’ নেই। ব্যক্তি-ভিত্তিক, দল-ভিত্তিক সব রকম শোষণই চলছে।

যে যাকে পাচ্ছে শোষণ কচ্ছে। কে কাকে শোষণ কচ্ছে ঠিক নেই। আর শোষনের নিত্য নূতন হেকমৎ বেরুচ্ছে।

মুরগী-কিনতে গেলাম। কেউ বেচে সের মাপা। এদের পাল্লা ওজন ঠিক নেই। পাল্লা ওজন দেখে নিলাম। মুরগী ওজন হবে এমন সময় দালাল এসে উপস্থিত। ঠিক পাল্লা ওজন দিয়ে এরা এমন ভাবে মেপে দেবে আপনি কয়েক ছটাক তো ঠকবেনই, কিন্তু হাতে নাতে কিছুই বুঝে উঠতে পাবেন না। অথচ, বাড়ি এনে ওজন করুন, ঠিক দু ছটাক ঠকে গিয়েছেন।

ক্রেতা ঠকে যায় বিক্রেতারা দালালকে ভয় করে। দালাল মাঝখান থেকে কয়েক ছটাকের দাম মেরে নেয়।

কেউ বেচে ঠিকা। এরা করে কি, প্রায় একই রকমের মুরগী তিনটা তিনটা করে হালি বাঁধে। আসলে হালিগুলি থাকে সরস, মাঝারি, নীরস এ রকম বিভিন্ন ওজনের। আপনি একটা হালি দর কল্লেন, বিক্রেতা বল্ল: হবে না। আপনি মুরগী রেখে দিয়ে চলে আসলেন কিছু, দূর সে ডেকে বল্লেঃ আচ্ছা নিয়ে যান। কিন্তু, এর মধ্যে সে হালি বদলে ফেলেছে।

ঘরে এনে হিসাব করে: প্রায় এক সেরের দাম সে মেরে নিয়েছে। এই দামটা দিয়ে আপনি ঠকামির একটা নূতন পদ্ধতি বুঝতে পার্লেন।

কিন্তু, কত আর বুঝবেন! আপনি একা চার ধারে শোষণের জগৎ গর্জন করে চলছে।

তবে সব শোষণই গিয়ে এক জায়গায় আঘাত করছে। সেটা জাতীয় ঐক্যের উপর। বুদ্ধিজীবীরা ভাবছে: তাঁরা শোষণও চালাবেন আর দেশের চেহেরাও সঙ্গে সঙ্গে ভাল হয়ে উঠবে শুধু ধ্বনির জোরে, ধ্বনির নূতন নূতন হের-ফেরে। বুদ্ধিজীবীদের যাঁরা পাণ্ডা তাঁরা নিত্য-নূতন এই হের-ফের বের কচ্ছেন যেন বিজ্ঞানের কোন মহামূল্য আবিষ্কার তাঁরা করে ফেলেছেন দুখে ও স্বরে এমন একটা গাম্ভীর্য নিয়ে।

কিন্তু, গৃহবধূর ডালের ন্যায় উৎরাণের অশান্তি আর কিছুতেই কমছে না। স্বামীর ন্যায় তাঁরাও ভাবছেন কি আশ্চর্য!

অর্থনৈতিক এত ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থা এ দেশে কখনই দেখা যায় নি। এই ছিন্ন-ভিন্নতা সমাজের সব স্তরেই ঢুকেছে। এক দিকে বহু লোক পরিস্থিতিকে মুকাবিলা কর্তে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অন্যদিকে বহ, লোক যেকোন মূল্যে দ্রব্য ক্রয় করার ক্ষমতা অর্জন করে পাজির পাহাড় গড়ে তুলছে। এরূপ নির্লজ্জ শোষণ এ দেশে কখনই দেখা যায় নি। আইনের, নীতির, ধর্মের কোন বালাই নেই। শুধ, সুযোগ সন্ধানেই সব তুরূপ হয়ে যাচ্ছে।

নুতন বুদ্ধিজীবীরা ভাবছেন ধ্বনি যখন দেশের সুস্থ চেহারা ফিরছেন। তখন কারণ বোধ হয় এই যে আমাদের হাতে আইনের যথেষ্ট ক্ষমতা নেই। সুতরাং, দিনকে দিন তাঁরা নিজেদের হাতে ক্ষমতার পর ক্ষমতা গ্রহণ করে চলেছেন। এখন চতুদ্দশ লাইর মত কেউ বলতে পারেন: আমিই রাষ্ট্র।

কিন্তু, ডালের উৎরান তবুও বন্ধ হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।

এই অবস্থা আরও বোঝাচ্ছে এই নূতন বুদ্ধিজীবীদের সত্যকার কোন দেশপ্রেম নেই। দেশ-প্রেম থাকলে তাঁরা জাতিকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে পাতেন না।

জাতির কোন মর্যাদা বোধ নিয়েও তাঁদের কোন মাথা-ব্যথা নেই। যদি থাকতো রাস্তা ঘাটে পড়ে এরূপ লোক মরে যাওয়ার দৃশ্যও আমাদিগকে দেখতে হতো না।

সাধারণ লোকেও বাংলাদেশের নাম নিয়ে উপহাস কর্তে আরম্ভ করেছে। কিন্তু, এতেও বুদ্ধিজীবীদের কোন টনক নড়ে মনে হয় না। শোষণের মুখ যেই তাঁরা পেয়েছেন জোঁকের ন্যায় তাঁরা ফুলে উঠছেন। আর কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নেই।

আসলে জনগণের প্রতি তাঁদের কোন শ্রদ্ধা নেই। গান্ধী বলেছেন: জনগণ যদি ‘মহাত্মা গান্ধী কি জয়’ না বলে আমার মুখে থুতু দিত, অথচ আমার কথা মত কাজ কর্তো আমি খুশী হতুম। আমি যে জনগনের কাজে যাই সেটা তারা আমাকে কিছু, শেখাবে বলে নয়। কিন্তু জনগণ হচ্ছে সমুদ্রের জলের ন্যায়। এ জল খাওয়া যায় না, কিন্তু, তার হাওয়া স্বাস্থ্যপ্রদ। আমি জনগণের সঙ্গে মিশে বুঝতে পারি আমাকে কি কর্তে হবে।

অথচ, জনগণের সমক্ষে কি রূপ কর-জোড় হয়ে কি বিপুল বিনয় ও শ্রদ্ধাই ছিল তাঁর সাফল্যের কুঞ্জিকা। আমাদের নূতন বুদ্ধিজীবীদের অবশ্য এ রকম কোন অভিজ্ঞতা নেই।

দেশে প্রয়োজন কর্মে’র। কারণ, কর্ম ছাড়া কোন সঙ্কট উত্তরণ, কোন কিছু, গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

কিন্তু, যদিও আমাদের নুতন বুদ্ধিজীবীদের ধ্বনি দিয়ে ডালের উৎরাণ শান্তি কর্তে ব্যর্থ হয়েছেন, তথাপি কর্মে’ তাঁদের কোন শিক্ষা-দীক্ষা-নেই। অবশ্য, নিয়ম হলো: আপনি আচরি ধর্ম’ পরকে শিখায়।

গান্ধী যখন মুখে বক্তৃতা কচ্ছেন হাত দিয়ে সুতো কাটতেন। বলতেনঃ এই দেখ, মুখে কথা বলি হাতে কাজ করি। কংগ্রেসের চাঁদা হলো মাসে চার আনা। এটা তোমরা নগদে দিওনা, চার আনা পরিমাণ সুতা কেটে দিও।

লোকে ভালেঃ অনেক নগণ্য কাজ! কিন্তু, এই নগণ্য কাজ দিয়েই মাঞ্চেষ্টার ও ল্যাঙ্কাশায়ারে আতঙ্ক সৃষ্টি করা সম্ভব হলো: ভারতে কাপড় রফতানী স্তিমিত হয়ে গেল কেন? পরে মাঞ্চেষ্টার-গার্ডিয়ান ভারতের স্বাধীনতা দাবীর সমর্থক হয়ে পড়ে।

বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবলে বাংলাদেশ যে এমন ভাবে মার খেল এই সঙ্কটেও কিন্তু আমাদের নূতন বুদ্ধিজীবীদের কর্মতৎপর হতে দেখা যায় নি। তাঁদের দেখা গিয়েছে ত্রাণ-কার্যের কো-অর্ডিনেটর অর্থাৎ সমন্বয়কারী হতে। অর্থাৎ, হস্তক্ষেপের অধিকার। ঐ পথে শক্তি, ঐ পথে লাভ।

নূতন বুদ্ধিজীবীরা নিজেরা কর্মী না হওয়াতে সরকারের অনুকূলে কোন কর্মোদ্যোগ সৃষ্টি করতে পারেন নি। অথচ জনসাধারণের কর্মোদ্যোগ ও সহযোগিতা ছাড়া কোন সরকারই সাফল্যের আশা করতে পারে না।

আমাদের নূতন বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই ব্যবসায়ী হয়ে পড়েছেন এবং ব্যবসা উপলক্ষেই সুযোগ সন্ধান করে আর্থিক দিক দিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র-গঠনে অথবা প্রশাসনকে জাতীয় লেভেলে দাঁড় করানোর ব্যাপারে তাঁদের কোন চেষ্টা আছে কি?

পাকিস্তান আমলে আয়ুব খাঁর শাসনতন্ত্র কমিশনের চেয়ারম্যান জাষ্টিস শাহাবুদ্দীন আমাকে পরীক্ষা কচ্ছিলেন চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে:

প্রশ্ন: ভোটারের লেখা-পড়ার যোগ্যতা সম্বন্ধে আপনার মত কি? আমিঃ লেখা-পড়া জানার কোন অপরিহার্য প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন: (অবাক হয়ে) লেখা-পড়া না জানলে ভোটার তার দায়িত্ব পালন করবে কি রূপে।

আমিঃ দেখুন, আমার বাবা সমাজ-পতি মানুষ। তিনি ইংরেজী লেখা-পড়া জানেন না। কিন্তু, তাঁর ছেলেকে (আমাকে) ইংরেজী পড়িয়েছেন। যখনই ইংরেজীর আশ্রয় গ্রহণ কর্তে হয় তিনি আমার সাহায্য নেন। আর, তিনি জানেন যে আমি তাঁকে ঠকাবো না।

প্রশ্ন: নিরক্ষর লোক মন্ত্রী হবে কি করে?

আমি: স্বাক্ষর লোকদের মধ্যে যেমন বহু পাজী লোক আছে নিরক্ষর লোকদের মধ্যেও তেমনি বহু পারগ লোক আছেন। লেখা-পড়া জানা লোকেরা যদি তাকে সৎভাবে সাহায্য করেন নিরক্ষর গুণী লোকের মন্ত্রী হতে দোষ কি?

প্রশ্ন: এ কথা কে বলেছে?

আমিঃ মহাত্মা গান্ধীরও এই মত ছিল।

গান্ধীর নাম শুনেই জাষ্টিস শাহাবুদ্দীন যেন জ্বলে উঠলেন।

আমারও হাঁশ হলো একজন পাকিস্তানী অফিসিয়েলের নিকট গান্ধীর নাম করা ঠিক হয় নি। যাহা হোক; আমাদের বৈঠক হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। তবে, আমার ঐ মত এখনও অনড় রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায়ীরা এবং জনসাধারণ মুনাফার এবং জীবিকার কাজ সপ্তাহে পাঁচ দিন। শনি ও রবিবার তাদের বন্ধ। এই দুই দিন পরম আগ্রহে তারা দেশের কাজ করে। এর মধ্যে প্রধান হলো এমন সব কাজ যে গুলি বেসরকারী লোকেরা সুষ্ঠু ভাবে কর্লে সরকারের বোঝা ও দায়িত্ব অনেক হাল্কা হয়ে যায়। এতে সরকারের ব্যয়ও অনেক কমে যায়।

এই সব কাজ করার জন্যে ব্যবসায়ীরা চাঁদা করে বড় বড় সংস্থা গড়ে তুলেছেন, উপযুক্ত লোককে তার ডিরেক্টর নিযুক্ত করেছেন, তার যাবতীয় ব্যয় নিজেরা নির্বাহ করেন এবং বন্ধের দিনে নিজেরাও তাতে কাজ করেন।

অমাদের নূতন বুদ্ধিজীবীরা ভাবেন যে সরকার রয়েছে তাঁদের লাইসেন্স ও পারমিট জোগাতে। এগুলো বাগিয়ে নিয়ে তাঁরা তিলকে তাল কর্বেন, কিন্তু সরকারের প্রতি তাঁদের কোন দায়-দায়িত্ব নেই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার মানে শোষণ থেকে জন-সাধারণের সত্য সত্যই মুক্তি লাভ। কিন্তু, এখন যখন শোষণ অবাধ ও ব্যাপক হয়ে গেছে – কি করে বলি যে দেশ স্বাধীন হয়েছে?

বরং, মনে হয়, আমাদের পার্টি’জান’ বা দলীয় অবস্থা চলছে।

রাশিয়ায় এবং চীনে উদ্যোগ জন-সাধারণের হাতে ফিরে আসার পূর্বে এরূপ ‘পার্টি’জান’ অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল। তাদের সঙ্গে লড়াই করে জন-সাধারণ স্বাধীন হয়।

চীনে বিদেশীদের ‘ক্যাপিচুলেশন’ আধিপত্যের পর দেশ চার জন নেতা ভাগ করে নেন-চিয়াং-কাইশেক, চেং-সোলিনা, ওয়া-পেই ফু এবং ফেঙ্গুশিয়ান। এদের বলা হতো ‘ওয়ার-লর্ড’। মাও-সেতুং-এর নেতৃত্বে কম্যুনিষ্টরা এদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে দেশকে স্বাধীন করে। – তবে; চিয়াং-কাই-শেক এখনও তাইওয়ানে টিকে আছেন।

‘পার্টিজান অবস্থার কতকগুলি আলামৎ আছেঃ

১ শোষণ অবাধ ও ব্যাপক হবে। দেশের প্রতিভা নিয়োজিত হবে নূতন নূতন লোক কর্তৃক শোষণের নূতন নূতন পন্থা উদ্ভাবনে মানুষ আত্ম-সর্বস্ব হবে। মানবীয় উদারতা লোপ পাবে।

লবনের ইতিহাস

আমরা লবন সমুদ্রে বাস করি। ইতিহাসে দেখা যায়: এক কালে বাংলাদেশ থেকে য়ুরোপে প্রতি বৎসর দুইশত জাহাজ লবন রফতানী হোত।

সেই বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষ যখন বৃটিশের কর্ত্তত্বে এলো ওরা এই দেশে লবন প্রস্তুত নিষিদ্ধ করে দিল। জাহাজ খালি আসতো এদেশ থেকে কাঁচা মাল নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারা নিয়ম কলাঃ জাহাজ খালি আসবে না, লবন নিয়ে আসবে।

এই অবস্থা লক্ষ্য করে কবিবর নবীন চন্দ্র সেন ক্ষোভ করে লিখ-লেন: লবনাশ্বরাশি বেষ্টিত যে স্থল, জনমে লিবারপুলে লবন তাহার!

গান্ধী এই ব্যবস্থাকে নাম দিয়েছিলেন ‘নিষ্ঠুর মনোপলি’ এবং এক পর্যায়ে ডান্ডিতে লবন সত্যাগ্রহ, দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্বোধন করেছিলেন।

লবন ভারতে পাচার হয় না।

তবুও ন্যায্য মূল্যের দোকান দিয়ে বাংলাদেশে লবনের সরবরাহ বজায় রাখতে হয়েছে। নতুবা, আভ্যন্তরীন বাজারেই কোথা কোথাও এর দর উঠেছে নাকি সের বত্রিশ টাকা!

২ কর্তা-ব্যক্তি হাতে বেপরোয়া ক্ষমতা গ্রহণ কর্বেন।

৩ স্থায়ী প্রশাসনিক কর্মচারীদের মনোবল ও নীতি-বোধ ভেঙ্গে পড়বে। তারা এবং পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এজেন্সী-সমূহ ‘তুমি আইন রাখলে, আইন তোমাকে রাখবে’ নীতি ভুলে যাবে। বরং তারা ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’ নীতিতে কর্তা-ব্যক্তি বা পার্টি’জান’দের ইচ্ছামত কাজ করতে ব্যগ্র হয়ে পড়বে।

৪ দ্রব্য-মূল্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে ‘অক্ষম হয়ে গরীবের। পথে-ঘাটে থাকবে আর ঠিক সে সময়ে পার্টিজানরা আর প্রশাসন এক-জোট হয়ে নিজেদের জন্যে সুযোগ ও সুবিধাবাদী নীতি (দুর্নীতি) চালিয়ে যাবে।

৫ শিক্ষার অঙ্গন দুর্নীতি দ্বারা কলঙ্কিত হবে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ব-বিদ্যালয় এবং ছাত্র-শিক্ষক, পরিচালকবর্গ’ সর্বত্র এবং সকলের মধ্যে দুর্নীতি প্রসার লাভ কর্বে।

৬ উৎপাদন কমে যাবে। কারণ, সনদ। বিশেষজ্ঞদের অর্থাৎ বুদ্ধি জীবী দেখে কর্মাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা হবে। দেশে সহজাত প্রতিভা নিরক্ষর ও স্বীকৃতিবিহীন বলে তাদের পাত্তা দেয়। (যেমন দেওয়া হয়েছিল রাশিয়ায়, বিপ্লবের পর) হবে না। আর, সনদী বৃদ্ধি-জীবীরাই প্রথম একচোট নিজেদের শোষণ চালাতে গিয়ে উৎপাদন ব্যাহত কর্বে।

৭ ‘পার্টি’জান’রা সবরকম বিরোধীতা ও সমালোচনাকে কাজে, লেখার ও কথায় অসম্ভব করে তুলবে। কিন্তু তবুও নূতন নূতন দলের অভ্যুদয় বন্ধ থাকবে না।

৮ দেশে ‘শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে না। যারা ‘অনুপার্জিত আয়’ ভোগ করে তাদেরই প্রতিষ্ঠা হবে।

৯ ব্যর্থতাবোধ ও নৈরাজ্যের ভাব দেশে নানারূপ দুষ্কর্মে’র যাদের জন্ম দেবে যার প্রধান-নায়ক হবে যুব-শ্রেণী। গুন্ডাদের হবে পোয়া বারো।

১০ নির্বাচন খাঁটি ও অপক্ষপাত হবে না। কারণ, স্থায়ী প্রশাসনিক কর্মচারীদের নৈতিক বল এত ভেঙ্গে পড়বে যে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছার বাইরে তারা আইন মাফিক কাজ করবার সাহস পাবে না।

১১ অর্থনৈতিক-বিশেষতঃ দ্রব্য-মূল্যের ক্ষেত্রে চোরা-বাজারই হবে নিয়ন্ত্রক, সরকার নয়। সরকার ‘কন্ট্রোল, রেইট’ বাড়াতে বাড়াতে চোরা-বাজারের প্রায় সমান করে তবেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। কিন্তু এই রেইট দেশের অধিকাংশ জনসাধারণের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে।

বহু রাজনৈতিক দলের অভ্যুদয় হবে বটে, কিন্তু দল পরিবর্ত নেও দেশের অবস্থার কোন সুরাহা হবে না কারণ রাজনীতির প্যাটার্ণ অধি নতা যুগের ন্যায়ই রয়ে গেছে-যখন ধনি বা শ্লোগান দেওয়াই ছিল একমাত্র কাজ এবং শাসন-ক্ষমতা দখলই ছিল একমাত্র লক্ষ্য।

এই প্যাটার্ণ চলতে থাকলে দল পরিবর্তন হলেও জন-সাধারণের কোন উপকার বা প্রকৃত মুক্তি হবে না।

একজন সাধারণ লোকের এক চমৎকার প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম এক নির্বাচনের প্রাক্কালে। আলাপটা হয়েছিল নিম্নরূপ:

আমার প্রশ্ন: এবার কাকে ভোট দিচ্ছ?

উত্তর: আমার মত যদি জিগ্যেস করেন, তবে বলি, নির্বাচনেরও প্রয়োজন নেই, সরকার পরিবর্তনেরও কোন দরকার নেই।

প্রশ্ন: কেন?

উত্তর: এই সরকার তো গদীতে কয়েক বছর থাকল, খেতে খেতে পেট আকণ্ঠ পুরেছে, আর খাওয়ার জায়গা নেই। আর ভাই-বেরাদরা যত আছে সকলেরই একটা সুরাহা করে ফেলেছে, আর কেহ বাকী নেই যে তার জন্য কিছু করতে হবে। এবার হয়তঃ আমাদের জন্য কিছু কর্বে।

কিন্তু এদের বদলে নূতন লোক আনলে অবস্থা হবে এই যে, ওরা আবার নিজেদের পেট পুরা কর্তে এবং নিজেদের ভাই-বেরাদের সুরাহা কর্তে লেগে যাবে। তা হ’লে আমাদের পালা কখন আসবে?

বুদ্ধিজীবীরা এ দেশের সাধারণ লোকদের যেখানে রেখেছেন তাতে এরূপ একটা বিশ্লেষণের জন্যে তার তারিফই কর্তে হয়। এর সঙ্গে আপনার মত মিলুক আর না মিলুক আপনি একটা সিদ্ধান্ত অস্বীকার কর্তে পারেন না। সেটা এই যে যে-দল যখনই ক্ষমতায় গিয়েছে তারা ঠিক পূর্ববর্তীর ধরণেই কাজ করেছে। একইভাবে ঘাঁটি রক্ষা-তার কৌশলগুলিকে বরং উত্তরোত্তর কঠোর করা কালাকানুনকে আরও এক ছোপ কাল করে দেওয়া – ইহাই চলে এসেছে দেশের ইতিহাসে।

একজন সাধারণ লোককে জিগ্যেস করুন। সে বলবে যে সে সব চেয়ে সুখী ছিল বৃটিশ আমলে। তারপর আমলও বদলেছে তার দুঃখও ক্রমে ক্রমে বেড়ে গেছে। এ জন্যে বুদ্ধিজীবীরাই দায়ী – যাঁরা শাসনের গদীতে বসেছেন এবং জন-গণের উপর শাসন ও শোষণ চালিয়ে এসেছে।

ম্যাজিক শব্দ যা অবস্থায় পরিবর্তন আনতে পারে তা হলো ‘কাজ’। যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছিঃ সকালে লোক যখন কাজে বেরোয় এবং বিকালে ফিরে-পুরুষ স্ত্রী-লোক এক সঙ্গে-ঠিক যেন পিপড়ের সারি চলেছে – কোন রূপ যতি ভঙ্গ নেই, হৈ-চৈ নেই – চলার সে কি পূর্ণতা, সে কি শৃঙ্খল।!

আমাদের দেশে আয়ুব খাঁর আমলে শহরে বন্দরে এরূপ কিছু, কাজ শুর, হয়েছিল-কিন্তু, সেটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

দেখেছি – তাদের চেহারা দিয়ে পোষাকে পরিচ্ছদে, চলনে-বলনে শুধু, ফুটে উঠছে কাজ আর কাজ।

অধীনতা যুগের যে আন্দোলন-ধর্মী রাজনীতি এদেশে চলে এসেছে, এখনও চলছে – যার বাহন ছিল ধ্বনি – সেটাকে বদলে ফেলে কর্ম’-ভিত্তিক কর্তে হবে।

এ দেশে বুদ্ধিজীবীরা শাসন ও শোষণ চালিয়ে এসেছে – কিন্তু নিজের হাতে কাজ না করে অপরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়েছে।

বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের দেখেছে অবসর-ভোগী নিজে-না-খাটা, পরের শ্রমের ফলের উপর ভাগ-বসানো তথা-কথিত ‘সুখী’ মানুষ রূপে। বস্তুতঃ, তাদের লেখা-পড়াই তাদের অভিশাপ।

আমি নিজেকে ‘বুদ্ধিজীবী’ (যে অর্থে’ আমাদের দেশে এটা প্রযুক্ত হয় ভাবতে ঘৃণা করি। আমি এবয়সেও পায়ে হেটে বেড়াতে ভালবাসি এবং নিজের গাঁটরী (যার ভিতর থাকে প্রধানতঃ লিখবার সরঞ্জাম ও পড়ার বই) নিজে বওয়াই পছন্দ করি। তার প্রধান কারণ: আমি এদেশের মাটির সন্তান এবং এই মাটিতে বুক দিয়ে যারা বাঁচছে-মরছে আমি তাদেরই একজন। (যাঁরা ‘তাজিয়া’য় আমার ‘আন-ব্যালেন্সড গল্পটি পড়েছেন তাঁরাই আমার মনের খবর জেনেছেন।)

আমাদের চেহারা চরিত্রে ‘কাজ’ নেই। অফিসে আদালতে কোন ‘কাজ’ হয় না। অথচ, এই উর্বর মাটিতে আমাদের অজস্র সম্পদ পানিতে কাজে লাগিয়ে আমরা সাত কোটি লোকের চৌদ্দ কোটি হাত কি না কর্তে পারি!

কিন্তু, বুদ্ধিজীবীরা এই দেশের হাতগুলোকে বহু পূর্বেই মেরে রেখেছেন। এটা একটু, সবিস্তার বলার প্রয়োজন দেখছি।

মানুষ প্রকৃত মানুষ পদবাচ্য হয় তখন যখন তার শিক্ষা ও অভ্যাস এই পর্যায়ে পৌঁছে যে যে কোন পরিস্থিতিতে তার দেহ-মন সর্ব’ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে প্রতিক্রিয়া করে। এর প্রমাণ বিশেষ করে পশ্চিমা জাতিগুলো। আমি লক্ষ্য করেছি যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়।

তাদের শুধু যে হাত আছে তা নয়, কিন্তু যান্ত্রিকতার মাধ্যমে তাদের হাতের সংখ্যা দুটারও উপর বাড়িয়ে নিয়েছে।

একটা পথের দৃশ্য বলি। যেখানেই মোটর বিকল হলো সেখানেই আরোহী (পুরুষ বা মেয়ে) গাড়ীর তলায় শুয়ে পড়ে তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে সেটা সারাতে লেগে গেল এবং শেষ পর্যন্ত সারালও। এরূপ যে কোন পরিস্থিতিতেই গোটা মানুষটি প্রতিক্রিয়া করে আর সব বিদ্যাও যেন তার নখ-দর্পণে।

আর, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা দেখুন। আমাদের হাত লিখতে এবং চোখ পড়তে অভ্যস্ত বটে, কিন্তু তার বাইরে তাদের কিছু, জানা নেই, তারা একান্ত অসহায়।

নওয়াব সিরাজদ্দৌলা এজন্য দানা শা ফকিরের নিকট ধরা পড়েছিলেন যে তাঁর জুতা বদলে দেবার জন্য খিদমৎগার কাছে ছিল না, তিনি নিজে তো আর জুতো বদলাতে জানেন না, সুতরাং বহুমূল্য জুতা পায়েই পালাতে লাগলে আর সেই জুতা দেখে দানা শা ঠিকই আঁচ করে নেয় যে এ নবাব না হয়ে যায় না।

তিন হাত পানিতে নৌকা ডুবে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মারা গেছেন এ রকম কিছু, দৃষ্টান্ত রয়েছে। কারণ, উপর দিকে হাত তুলে দেখার বিদ্যা তো তাঁর জানা নেই।

১৯২১ সালে আমি যখন সাব-রেজিষ্ট্রার হয়ে সরকার চাকুরীতে ঢুকি তখন ঐতিহ্যবাহী এক বংশের এক ভদ্রলোক প্রায়ই আমার নিকট কবলা রেজিষ্ট্রি করাতে আসতেন। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র দশায় পড়েছিলেন। ভিটে বাড়ির দরাজাটা পর্যন্ত বিক্রী করে দিচ্ছিলেন। ওদিকে নাম দস্তখত কর্তে’ন আরবীতে আর যখনই অফিসে আসতেন এক চাকর তাঁর অনুগামী থাকতো।

একদিন তোরাব আলী মিঞার আমার সঙ্গে আলাপ হলো। বল্লেন: অপনির সবই ভাল, কিন্তু নিজের ছাতা নিজে বহন করেন এটা বড়ই আপত্তিজনক।

আমি নিবেদন কর্লেমঃ কি কর্তে’ হবে?

বল্লেন: সঙ্গে একজন চাকর থাকবে। কোন কিছু, বইতে হয় সে-ই সে কাজ কর্বে। ভদ্র লোকের ছেলে যদি ছাতা বইতে হয় তার ভদ্রতার কিছু অবশিষ্ট থাকে?

এক সময়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাই এই ফর্মুলা বের করেছিলেন যে যাতে কাজ কলে’ ‘বুদ্ধিজীবী’দের শ্রেষ্ঠত্ব নষ্ট হয়ে যায় – ব্রাহ্মণ তার ব্রাহ্মণত্ব, সৈয়দ তার সৈয়দত্ব হারায়।

ফলে তাদের-আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হাত মরে গেছে। যাদের হাত মরে যায় তাদের মাথা হয়ে উঠে শয়তানের কারখান। আমাদের হয়েছে সেই দশা। ‘পাটি’জান’ অবস্থায় আমরা এখন শয়তানের কারখানার যুগে বাস করছি।

এই পরিণতি আমাদের প্রাচীনদের জানা ছিল। এটা এড়াবার জন্যে তাঁরা ব্যবস্থাও গ্রহণ কর্তেন।

(লেখাটা ইনকমপ্লিট; লেখাটা শেষ করার আগেই উনি একটা রোড একসিডেন্টে মারাত্মক আহত হন, এবং ৬ মাস অসুস্থ থাকার পরে ১৯৮১ সালে মারা যান)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →