ব্রিটিশ বাংলায় গরু জবাইয়ের রাজনীতি (পার্ট ১) Featured

ব্রিটিশ আমলে মুসলমানদের গরু কোরবানি এবং হিন্দু জমিদারদের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ ভারতে গরু নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিতর্কের সূত্রপাত উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। সূত্রপাতের সূচনা হিন্দু জমিদারদের মাধ্যমে। জমিদারি ব্যবস্থায় প্রজা জমিদারের হুকুম মানতে একপ্রকার বাধ্যই ছিল। যদি জমিদারের হুকুম বে-আইনি হয় তাহলে প্রজা আইনের আশ্রয় নিতে পারতো। কিন্তু আইন কি আইনের গতিতেই চলে? ঔপনিবেশিক শাসনামলে ইংরেজের তৈরি আইনের সুশাসন/সুফল ভোগ করা কি অর্থবিত্ত আর ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব ছিল? স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজ সরকার ও তার কর্মচারী প্রাধান্য দিবে জমিদারকে। এবং তাই হয়েছিল। একজন প্রজার পক্ষে জমিদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা রীতিমতো অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। কারণ, একজন স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের এই বোধটুকু ছিল যে, জমিদারের অর্থবিত্ত আর ক্ষমতার কাছে আইন মামুলি ব্যাপার। মাঝখান দিয়ে টাকা-পয়সা আর শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের বেহুদা খরচ!
জমিদার আর প্রজার দুয়েকটা কেস যে ইংরেজের দরবারে হাজির হয় নাই, তা না। তার রায়/মীমাংসা হয়েছিল কিভাবে তা দেখাতে, নজির হিসেবে দুয়েকটা কেস পরবর্তীতে পেশ করবো আমরা।
১৮৮৭ সালে মোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। সদস্য হিসেবে অধিবেশনে যোগ দেন রাজশাহীর তাহিরপুরের জমিদার শশিশেখর রায়। i সেখানে তিনি গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব নাকচ হয়। বলা হয়, এই মুহূর্তে এই প্রস্তাব পাশ করলে তা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যাবে এবং তখন কংগ্রেসের মুসলিম স্বার্থবিরোধী একটি ভাবমূর্তি দাঁড়াবে যা কংগ্রেসের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ক্ষতিকর। প্রস্তাব নাকচ হলেও,মুসলমানদের গরু-জবাই ইস্যুতে জমিদারের মনোভাব পরিষ্কার হয়েছিল সেই অধিবেশনে। যে জমিদার এমন প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে তার জমিদারির ত্রিসীমানায় যে মুসলমানরা নিরাপদে গরু জবাইয়ের স্বাধীনতা পাবে না তা হলফ করেই বলা যায়।
রাজশাহীর কেবল শশিশেখর নয়, অন্যান্য জমিদারদের অঞ্চলেও ছিল একই চিত্র। The Moslem Chronicle পত্রিকায় ১৭ মার্চ ১৮৯৫ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, রাজশাহীর খোকসার অন্তর্ভুক্ত পানানগর ও অন্যান্য গ্রামের মুসলমানদের সাথে গরু জবাইয়ের কারণে দুর্ব্যবহার করা হয়। ii এবং কমিশনারের রিপোর্টের রেফারেন্স উল্লেখ করে বলা হয়, মুসলমান প্রজাদের গরু জবাই এবং গোশত খাওয়ার ব্যাপারে জমিদাররা সরাসরি হস্তক্ষেপ করে।
The Moslem Chronicle পত্রিকার ২০ মে ১৮৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ময়মনসিংহের অম্বরিয়া, মুক্তাগাছা ও সন্তোষের জমিদারগণ কয়েকজন গ্রামবাসীকে গরু জবাইয়ের জন্য জরিমানা করেছিলেন। iii ময়মনসিংহে জমিদারের হস্তক্ষেপের ফলে গরু জবাইয়ের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কথা জানা যায় আবুল মনসুর আহমদের জবানেও। তিনি লিখেছেন: “বক্রা ঈদে গরু কোরবানি কেউ করিত না। কারণ জমিদারের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।” iv আবুল মনসুর আহমদের জন্ম ১৮৯৮ সালে। শৈশব থেকে সাবালক হওয়া অবধি— ১৯১০-২০ সালের দিকেও— ময়মনসিংহের একই চিত্র ছিল। অর্থাৎ, ১৮৯৫ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের হেরফের পরবর্তী বিশ-ত্রিশ বছরেও হয়নি। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং আবুল মনসুর আহমদের সাক্ষ্য থেকে বলা যায়, ময়মনসিংহে মুসলমানদের গরু জবাই এবং গোশত খাওয়ার উপর জমিদারদের নিষেধাজ্ঞা উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই বলবৎ ছিল।
১৮৯৫ সালে ফরিদপুর গো-রক্ষিণী সভার সম্পাদক যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ গরু জবাই বন্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি লিফলেট বিতরণ করেন। লিফলেটের শিরোনাম ছিল ‘কসাই-এর গো-হত্যা’। লেখা ছিল, মুসলমান কসাইয়ের কাছে হিন্দুরা যেন গরু বিক্রি না করে এবং এমন ভয়ঙ্কর পাপ কাজের বিরুদ্ধে সকলে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। সাথে এও বলা হয়, হিন্দু জমিদারগণ যেন নিজ নিজ জমিদারিতে গরু জবাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। v গো-রক্ষিণী সভার বাস্তবজ্ঞানের প্রশংসা না করলে অন্যায় হবে। ভয়াবহ হিন্দু-মুসলমান রেষারেষির উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেও তারা ভুলেননি যে, মুসলমান প্রজার গরু জবাই বন্ধ করতে হিন্দু জমিদারের নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বড় কোনো হাতিয়ার নাই। এবং এই হাতিয়ার তারা ওপেনলি ব্যবহার করে সৎসাহসের পরিচয় দিয়েছেন।
গো-রক্ষিণী সভার এমন কাণ্ড স্থানীয় মুসলমান সমাজের জন্য ছিল সরাসরি হুমকি। যে কারণে বিচলিত মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে ‘আঞ্জুমনে ইসলাম’ নামক সংগঠন থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদনপত্র পাঠানো হয়। এই আবেদনপত্রের প্রেক্ষিতে একটি খবর প্রকাশিত হয় The Moslem Chronicle পত্রিকায়। বলা হয়: “I have been directed by the members of the Anjuman-i-Islam, Faridpore to bring to your kind notice the fact that cow-killing question has been the source of constant disputes between the Hindus and the Muhammadans of Behar and other provinces of upper India. But fortunately the Eastern Bengal was quite free from those riots upto this time. Recently placards are being circulated, inciting the people to exert their best to stop cow-killing any how they can. The result of the circulation and notification has been that the powerful Hindu Zamindars are combining themselves to prevent the sale of cows to butchers and the killing of them in their Zamindari Mohallas. If the Hindus combine to prevent cow-killing, Muhammadans are not likely to yield; thus the result will be a constant dispute and ill-feeling between two communities so long living in peace and amity in eastern Bengal.
I, therefore, request you on behalf of the members of the Anjuman to take early step to prevent the circulation of those objectionable placards.” vi
খেয়াল করলে দেখা যাবে, জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরিত আঞ্জুমনে ইসলামের এই আবেদনপত্রেও স্পষ্টভাবে জমিদারের ভূমিকাটা তুলে ধরা হয়েছে। মানে এই নিয়ে তখনই তারা নিশ্চিত ছিল।
মুসলমান প্রজাদের গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে জমিদারের ভূমিকা নিয়ে আরেকটি দৃশ্য দেখা যায় সাহিত্যিক মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদের স্মৃতিকথায়: “গোবিন্দপুর, হরিশঙ্করপুর, সনাতনী, গোপীনগর, আমলা, গোসাঞী পুকুর প্রভৃতি কতকগুলি গ্রাম একজন প্রচণ্ড প্রতাপান্বিত বড় হিন্দু-জমিদারের জমিদারীভুক্ত; সেখানকার মুসলমানগণ বহুকাল অবধি গরু কোরবানি করিতে বা গরু জবে ও উহার মাংস ভক্ষণ করিতে পারিত না। কেহ করিলে তাহার আর রক্ষা ছিল না। জমিদার কাছারীর দুর্দান্ত হিন্দু নায়েবগণ কোরবানিদাতা ও গরু হত্যাকারীকে ধরিয়া আনিয়া প্ৰহার ও নানা প্রকার অপমান করিত এবং তাহাদের নিকট হইতে জরিমানা আদায় করিত। সুতরাং তাহাদের অত্যাচারে ঐ অঞ্চল হইতে গো-কোরবানী প্রথা উঠিয়া গিয়াছিল।” vii উল্লেখিত এলাকাগুলো বর্তমান ঝিনাইদহ জেলার হরিশংকরপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত।
জমিদার ছাড়াও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ক্ষমতা আর অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রভাব কিভাবে এই গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে কাজে লেগেছিল তখন, তার একটা নমুনা পাওয়া যায় এই সংবাদে। বাংলা ১৩১২ সনের ৫ জ্যৈষ্ঠ মিহির ও সুধাকর পত্রিকায় ‘গরুজবাই’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চাঁদপুরের কিছু মুসলমান ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু কোরবানি দেওয়ায় গোপালচন্দ্র নামক জনৈক ধনী ব্যক্তি তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে। মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, কতিপয় মুসলমান রাস্তায় প্রকাশ্যে গরু জবাই করেছে এবং বদ্ধ জলে গরুর মাংস ধৌত করার মাধ্যমে জল অপবিত্র করেছে। তৎকালীন চাঁদপুরের জেলা-হাকিম ছিলেন জগদীশচন্দ্র সেন। তিনি স্ব-সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে কোনপ্রকার তদন্ত তল্লাশি ও ঘটনাস্থল সরেজমিনে পরিদর্শন না করেই তিনজন মুসলমানকে যথাক্রমে এক মাসের কারাদণ্ড, ৫০ টাকা ও ১৫ টাকা জরিমানা করেন। viii
সুধাকর পত্রিকা এই ব্যাপারে ছিল বেশ সরব, অবশ্যই মুসলমানদের পক্ষ থেকে। তারা একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিল সেই সব জমিদারদের, যারা মুসলমানদেরকে গরু জবাইয়ে বাঁধা দেয়। সেখানে ঢাকা জেলার ভাওয়ালের রাজা, ভাগ্যকুলের বাবু, বিক্রমপুরের জমিদার, ময়মনসিংহ জেলার কাগমারী ও মুক্তাগাছার জমিদার, যশোরের নড়াইল এবং রাজশাহীর পুঠিয়ার জমিদারের কথা উল্লেখ আছে। মফস্বল থেকেও এমন একাধিক খবর কলকাতা থেকে প্রকাশিত একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। The Moslem Chronicle পত্রিকার ২৩ মে ১৮৯৫ আর মিহির ও সুধাকর পত্রিকার ১৩ জুন ১৮৯৫ সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে অভিযোগ করা হয়, জমিদাররা তাদের জমিদারির মধ্যে মুসলমান প্রজা কর্তৃক গরু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তারও ২ বছর আগে, ১৮৯৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর The Mahomedan Observer পত্রিকায় বলা হয়, একজন জমিদার গরু জবাইয়ের ‘অপরাধে’ কয়েকজন মুসলমান প্রজাকে তিরস্কার করে এবং একটি কাগজে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয় এই মর্মে যে, তারা আর কখনো গরু জবাই করবে না। ix
উপরোক্ত খবরাখবর থেকে এটা স্পষ্ট যে, গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদার তার মুসলমান প্রজার উপর জমিদারিত্বের প্রভাব খাটিয়ে জুলুম করতো। অলিখিত নিষেধাজ্ঞা তো বটেই, তিরস্কার এবং জরিমানার মাধ্যমে জমিদার সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতো মুসলমানদেরকে গরু জবাই থেকে বিরত রাখতে। আমরা অধ্যায়ের শুরুতেই যা বলেছি, মুসলমান প্রজা ছিল নিরুপায়। একে তো সে প্রজা, জমিদারের আওতাধীন, তারউপর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। এমতাবস্থায় কিভাবে সম্ভব আইনের শরণাপন্ন হওয়া? জমিদারের ক্ষমতা আর অর্থের দাপটের সাথে অনেক ক্ষেত্রে যোগ হতো স্থানীয় সরকারি হিন্দু কর্মকর্তার স্বজনপ্রীতি। হিন্দু কর্মকর্তার স্বজনপ্রীতি হিসেবে উপরোক্ত চাঁদপুরের ঘটনাটি উদাহরণ হিসেবে পাঠ করা যায়।
সুধাকর পত্রিকায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, মুসলমান জমিদারের অধীনে থাকা মুসলমানগণ যেন প্রতিবেশী হিন্দু জমিদারের অধীনে থাকা মুসলমানদের সাহায্য করেন।x এই পরামর্শ কতটা কার্যকর হয়েছে তা জানা যায় না, কিন্তু গরু জবাই ইস্যুতে ‘জমিদার’ বর্গের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে দারুণ কার্যকর। যেহেতু গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে থাকা হিন্দুরা তাদের এই দাবি বাস্তবায়ন করতে স্বধর্মের জমিদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিচ্ছে সেহেতু তাদেরকে মুসলমান জমিদারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটা চেষ্টা করেছিলো সুধাকর। অর্থাৎ, হিন্দু জমিদার আর প্রজার সম্মিলিত জুলুমের বিরুদ্ধে কেবল মুসলমান প্রজার অসম লড়াই না করে, মুসলমান জমিদার এবং প্রজার সম্মিলিত লড়াইয়ে রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
ড. ওয়াকিল আহমদ লিখেছেন: “গোরক্ষিণী সভার পরেই জমিদারদের স্থান। অনেক জমিদার মুসলমান প্রজাদের ঈদ উপলক্ষে গো-কোরবানি অথবা বিবাহ উপলক্ষে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করে দেন”। xi কিন্তু তথ্য বলছে, গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে জমিদারদের স্থানই সর্বাগ্রে। কারণ, জমিদারের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যতীত কি গোরক্ষিণী সভা কোনোক্রমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারতো? কোনো জমিদারির মধ্যে গোরক্ষিণী সভা মুসলমানদের গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে অথচ জমিদার জানেন না, তার সমর্থন নেই— এমনটা তো কল্পনাতীত! কল্পনার অতীতে যাওয়ার সুযোগ ছিল না স্যার এন্থনি ম্যাকডোনেলের (Sir Anthony MacDonnell)। তিনি ছিলেন গভর্নর অফ বেঙ্গলের লেফটেন্যান্ট কর্মকর্তা। গরু জবাই সংক্রান্ত ঘটনা তদন্ত করে সরকারের নিকট তিনি যে রিপোর্ট পেশ করেন সেখানে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, “যদি জমিদারের হস্তক্ষেপ না থাকতো তাহলে গরু জবাই নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কখনোই এমন বিরূপ আকার ধারণ করতো না” (The Agitation could never have gone to the lengths it did, had the landlords `not countenanced the unruly spirit which has shown itself’. xii
মূলত জমিদারের আশ্রয় প্রশ্রয়ে গো-রক্ষিণী সভা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতো। অনেক সময় স্থানীয় কমিটির মধ্যেও জমিদাররা যুক্ত থাকতো। যেমন: দার্জিলিংয়ের গয়া গো-রক্ষিণী সভার প্রতিষ্ঠাতা ছিল জমিদার বাবু ভিখারি শংকর ভট্টাচার্য। সেই সভার সভাপতি ছিল জমিদার রায় রাম নারায়ণ সিং, সহ-সভাপতি সরকারি কর্মকর্তা বাবু ইন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী আর সেক্রেটারি জমিদার বাবু ভিখারি শংকর ভট্টাচার্য স্বয়ং। ভট্টাচার্যের বড় ভাই বাবু দুর্গা শংকর ছিল সদর উপজেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান। xiii এমতাবস্থায় কোনো মুসলমান প্রজা কি আইনের আশ্রয় নিয়ে সুবিচার পাবে? এভাবেই মূলত বাংলায় গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক এবং সরকারি ক্ষমতা একত্রে কাজ করেছে।
জমিদার আর স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের মিশেলে গঠিত গো-রক্ষিণী সভার এমন চিত্র উদাহরণ হিসেবে পাঠ করা যায়। কারণ, বাংলায় গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে হিন্দু জমিদারদের অবস্থান স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। এমতাবস্থায় গো-রক্ষিণী সভা তাদের কাছে ছিল সোনায় সোহাগা। প্রথমত, গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো ব্যক্তিগত তৎপরতার চেয়ে বেশি ফলদায়ক; দ্বিতীয়ত, সকল শ্রেণীর হিন্দুরা এর মাধ্যমে জমিদারের কব্জায় চলে আসে। জমিদার তার নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রজার উপর যে অর্থনৈতিক এবং বর্ণবিদ্বেষী অত্যাচার চালায় তার ফলে প্রজার মনে জমিদারের উপর যে ক্রোধ, ক্ষোভ জমা হয় তা সম্পূর্ণ ধুয়ে মুছে যায় এই গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক আন্দোলনের মাধ্যমে। যে জমিদারকে সে নানা কারণে ঘৃণা করে, সেই একই জমিদার যখন গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে কাজ করতে তাকে আহ্বান করে তখন সে না করতে পারে না। কারণ, গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তার কাছে `ধর্মরক্ষা’র ব্যাপার। তো জমিদার যখন তার `ধর্মরক্ষা’র ব্যাপারে তার সাথে গলা মিলিয়ে কাজ করে, তৎপরতা প্রদর্শন করে এবং তা কার্যকর হয় তখন তার সব ঘৃণা লীন হয়ে যায়। ধর্মীয় উত্তেজনার স্রোতে ভেসে যায় অর্থনৈতিক নিপীড়ন।
জমিদারের প্রভাব ছাড়া গো-রক্ষিণী সভার কার্যক্রম কেমন ছিল তার দুয়েকটা উদাহরণ পেশ করছি। ঢাকা জেলার গো-রক্ষিণী সভার লোকজন কিছু কসাইকে গরু জবাই করতে বাধা দেয়। ফলশ্রুতিতে কসাইরা সরকারের কাছে তাদের ব্যাপারে নালিশ করে। xiv কিন্তু এ নিয়ে কোনো বড় ধরনের সমস্যা হয়নি।
কুষ্টিয়ায় ১৮৯৭ সালে গরু জবাই নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিছু মুসলমান গরু জবাই করে এবং স্থানীয় হিন্দুরা তাতে ক্রুদ্ধ হয়। তারা গো-রক্ষিণী সভার মাধ্যমে প্রতিবাদ করলো এবং স্থানীয় সংগঠন ‘আঞ্জুমান’ মুসলমানদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালো। তারপর যে পরিস্থিতি তৈরি হলো কুষ্টিয়ায় তা রীতিমতো ভীতিকর। হিন্দু গোয়ালারা এবং ধোপারা তাদের সকল মুসলমান ক্রেতাদেরকে বয়কট করলো; মুসলমানরাও তেমনি হিন্দুদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের হিন্দু ক্রেতাদেরকে বয়কট করলো। কুষ্টিয়া শহর দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেলো। কেউ কারো কাছে নিরাপদ নয় এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। xv হিন্দু জমিদারের সরাসরি হস্তক্ষেপ না থাকায় লড়াইটা হয়েছিল সমানে সমান। কিন্তু এখানে হিন্দু জমিদারের অধীনে যদি মুসলমানরা গরু জবাই করতো তাহলে তা আর স্রেফ আন্দোলন/নিন্দায় সীমাবদ্ধ থাকতো না, জমিদারের পক্ষ থেকে রীতিমতো শাস্তির সম্মুখীন হতে হতো।
১৮৯৬ সালে বাবু গিরিজা কান্ত সেন অভিযোগ করেন, স্থানীয় পুলিশ মুসলমানদেরকে উস্কে দিচ্ছে হিন্দু জমিদারের আওতায় গরু জবাইয়ের জন্য এবং তিনি আশঙ্কা করছেন, ভবিষ্যতে এজন্য এখানে দাঙ্গা বাঁধতে পারে।xvi অভিযোগের পয়েন্টটা যদি খেয়াল করি, সরাসরি গরু জবাইকে দাঙ্গার কারণ হিসেবে না এনে ‘জমিদারি’র মধ্যে করার কারণকে সামনে এনেছেন। অর্থাৎ, গরু জবাইতে সমস্যা নাই কিন্তু হিন্দু জমিদারের আওতায় করলে সমস্যা। সরাসরি গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় পড়ে না কিন্তু যখন ‘জমিদার’র ইস্যু যুক্ত হয় তখন আইনের মারপ্যাঁচ দেওয়া সহজ হয়ে যায়।
গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিরোধ যে মূলত জমিদারির উপর নির্ভরশীল তা মুসলমানরা বুঝতে পেরেছিলেন ব্রিটিশ আমলেই। নজির হিসেবে পেশ করা যায় একটি ঘটনা। বর্ণনা করেছেন আবদুল গফুর। ১৯৪০ সালের দিককার ঘটনা।
পাবনা জেলার সাতানী এলাকা। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও জমিদারের ভয়ে প্রকাশ্যে গরু কোরবানি করতে পারে না, করলেও গোপনে— খুব সাবধানে। কিন্তু মুন্সী পরিবারের সহায়তায় তালিমনগর মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর চিত্র পাল্টে গেলো। পরেরবার কোরবানিতে প্রকাশ্যেই গরু কোরবানি শুরু করলো মুসলমানরা। প্রতিক্রিয়া হিসেবে জমিদারের নির্দেশনায় ঢোল-বাদ্য নিয়ে মাগরিবের নামাজের সময় মসজিদের সামনে দিয়ে গেল জন্মাষ্টমীর মিছিল। অভিযোগ নিয়ে জমিদারের কাছে যাওয়ায় কথা কাটাকাটি হয়। জমিদার গিয়ে স্থানীয় মুসলমান নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। মুসলমানদের পক্ষ থেকে কলকাতা থেকে আনা হয় শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হককে। মামলার রায় যায় মুসলমানদের পক্ষে। জমিদারের বিরুদ্ধে মামলায় বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে ঈদে মিলাদুন্নবীর আয়োজন করা হলো তালিমনগর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে। উৎসবের আমেজ এতটাই তুঙ্গে ছিল যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মোট ১৮টি গরু জবাই করা হয়েছিল। xvii
জমিদারের আতে ঘা লাগানোর জন্যই যে ১৮টি গরু জবাইয়ের আয়োজন হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য! অর্থাৎ চল্লিশের দশকেই মুসলমানরা ধরে ফেলেছে জমিদারের ব্রাহ্মণ্যবাদি আগ্রাসী মানসিকতা, এবং সেভাবেই তারা মোক্ষম দাওয়াইয়ের মাধ্যমে তা মোকাবেলা করেছে।

মোহাম্মদ আবু সাঈদ

Latest posts by মোহাম্মদ আবু সাঈদ (see all)
- ব্রিটিশ বাংলায় গরু জবাইয়ের রাজনীতি (পার্ট ১) - জুন 5, 2025
- পপুলারিটির ধান্দা - জানুয়ারি 9, 2025