Main menu

গোলাম মুস্তাফার কবিত্ব

সম্প্রতি একটা বড় খবর আমরা পাইয়াছি, যাঁহারা বাংলাসাহিত্যের গৌরব করেন, তাঁহারা এ খবর পাইলে আহ্লাদে আটখানা হইবেন। খবরটি এই, বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি খাজা গোলাম মুস্তাফা নূরউল মুল্ক মহোদয়কে তাঁহার অসামান্য কাব্যকীর্ত্তির জন্য, হিন্দু ও মুসলমান বাঙ্গালীর পক্ষ হইতে একটি সম্মান-পত্র দিবার আয়োজন হইতেছে। অনেকে তাহার সংবাদ রাখেন না জানি, কিন্তু যাঁহারা বাংলাসাহিত্যের জোত-জমি অধিকার করিয়া আছেন, তাঁহারা জানেন ইহাতে আয়বৃদ্ধির সম্ভাবনা কতখানি। তাই রায় বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্রের সভাপতিত্বে এই সম্বর্দ্ধনা কার্য্য সম্পন্ন হইবে শুনিয়া আমরা বাংলাসাহিত্যের কৃষিবিভাগের উন্নতির আশায় উৎফুল্ল হইয়াছি।

শনিবারের চিঠি’র প্রচ্ছদমুস্তাফা-সাহেবের এই সম্বর্দ্ধনা অতিশয় সময়োচিত হইয়াছে। ইতিপূর্ব্বে তিনি ‘গর্ভবতী’ নামক একটি কবিতা লিখিয়া বাঙ্গালী সাধারণের একটি অতি সুকোমল মর্ম্মস্থানে ঘা দিয়াছিলেন। তাহাতেই তাঁহার কবিযশ দিকদিগন্তে বিস্তৃত হইয়াছিল। তখনই ভাবিয়াছিলাম এই গর্ভ-যন্ত্রণাপীড়িত সমাজে তিনি ‘গর্ভবতী’র মত কবিতা লিখিয়া যে আনন্দ বিতরণ করিলেন তাহাতে রসলোলুপ বাঙ্গালী মাত্রেরই অবিলম্বে তাঁহার ‘কদমবুখি’ করা উচিত। কিন্তু কি জানি কি সঙ্কোচ বশতঃ তাহা করা হয় নাই। কবিবর তাহাতে কিছুমাত্র হতাশ না হইয়া আদিরস ছাড়িয়া বীররসের শরণাপন্ন হইলেন—আজ কাল বীররস ছাড়া আর কিছুই জমে না। অতঃপর বাঙ্গালী জাতির প্রাণ-উন্মাদন ‘বঙ্গবিজয়’-কবিতা লিখিয়া তিনি একেবারে জাতীয় মহাকবির আসন দখল করিয়া ফেলিলেন।

মনে হয়, সেই কবিতাটির মহাভাবে বিভোর হইয়াই এ জাতি আর স্থির থাকিতে পারিল না—এত বড় প্রতিভার আদর না করিয়া থাকিবার জো আছে? তাই হিন্দু ও মুসলমান একযোগে তাঁহার সম্বর্দ্ধনা করিতে অগ্রসর হইয়াছে।

আমরা সে কবিতাটি পড়িয়াছি। জগতের সাহিত্যে যত বীরগাথা আছে, জাতির প্রাণে প্রেরণা সঞ্চার করিবার, অতীত গৌরব উদ্বুদ্ধ করিবার যত কবিতা আছে, তাহার মধ্যে এই কবিতাটি সর্ব্বোকৃষ্ট একথা অকুতোভয়ে বলিতে পারি। এমন কবিতা যে-কবির লেখনী-মুখে আবির্ভূতা হইয়াছে, তাঁহাকে আমরা কি বলিয়া প্রাণের পুলক নিবেদন করিব ভাবিয়া পাই না; সে পুলকের ভাষা নাই; তাই আমরা এই সম্বর্দ্ধনা উপলক্ষ্যে পূর্ব্বাহ্নেই তাঁহাকে ‘খাজা’ উপাধিতে ভূষিত করিলাম, ‘নূর-উল্-মূলক’ চলিতে পারে কিনা, তাহা ভক্তবৃন্দ ভাবিয়া দেখিবেন। এ উপলক্ষ্যে ঐ কবিতাটির একটু পরিচয় দেওয়া নিতান্ত আবশ্যক বলিয়া মনে হইতেছে।

কবিতাটির নাম ‘বঙ্গবিজয়’। বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতি আজ যে গৌরবে গৌরবান্বিত তাহার অধিকাংশই যে মুসলমান কর্ত্তৃক বঙ্গবিজয়ের ফল, তাহা কে না জানে? সেই যে সপ্তদশ মাত্র অশ্বারোহী লইয়া একদা এক তুরুক যোদ্ধা একটি সমগ্র দেশ জয় করিয়াছিলেন, ইতিহাসে এমন কাহিনী আর কুত্রাপি নাই;–বাঙ্গালী হইলেও কবি গোলাম মুস্তাফা বঙ্গভারতীর সর্ব্বাঙ্গে শিহরণ জাগাইয়া সেই কাহিনী শুধুই বিশ্বাস করানো নয়—তাহার গৌরব-রোমাঞ্চ এই কবিতাটিতে রণদুর্ম্মদ ছন্দে সঞ্চারিত করিয়াছেন। সতেরো জন অশ্বারোহীর আক্রমণে মুস্তাফাসাহেবের পূর্ব্বপুরুষগণ যে ভাবে কাপড়ে চোপড়ে বেসামাল হইয়াছিলেন, তাহারই কাহিনী কহিবার কালে কবিবরের ঘন ঘন রোমাঞ্চ হইয়াছে; বাংলা ভাষায় বাংলা ছন্দে কবিতাকারে তাহা বর্ণনা করিয়া যে জাতীয়তার মন্ত্রে তিনি আমাদিগকে দীক্ষিত করিয়াছেন তাহাতে বাঙ্গালীজাতি নবজীবন লাভ করিবে সন্দেহ নাই, তাই এই গোলাম-কবির অপূর্ব্ব কবিত্ব ও অসামান্য ধীশক্তির তারিফ করতেই হয়।

একটু উদ্ধৃত করি,–পাঠক বুঝিতে পারিবেন, কোন্ মহাভাষের অনুপ্রেরণায় বাঙ্গালী কবির কাব্যোন্মাদ ঘটিয়াছে—

বিহারের সীমা পার হয়ে তারা পৌছিল আসি’ বাংলাদেশ,
মুগ্ধ সবাই হেরি’ বাংলার শ্যাম-কুন্তলা স্নিগ্ধ বেশ;
কহে মনে মনে বখতিয়ার—
“হইলে খোদার এখতিয়ার,
মুসলিম-ভূমি হ’বে এ বাংলা, সন্দেহ তাহে নাহিক লেশ!”
**

হেথায় এদিকে প্রভাত বেলায় মহাবীর বিন্-বখতিয়ার
ভীম বিক্রমে হুঙ্কার দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিল দুর্গ-দ্বার,
দেখিল—রাজার সৈন্যগণ
দিল নাক’ বাধা, দিল না রণ,
বরণ করিয়া লইল তাহারে, কুর্ণিশ করি’ বারম্বার!
**

পূর্ব্ব তোরণে অরুণ তখন হাসিয়া উজল করেছে, দিক্,
আকাশের নীল নয়ন মেলিয়া চাহিল সে যেন নির্ণিমিখ।
আজি যেন কার পূণ্য নূর
আশীর্ব্বাণীর আনিল সুর,
যত ফেরেশতা খিলজীর শিরে বর্ষিল শুভ-মাঙ্গলিক!
**

এ কবিতা বাঙ্গালীর জাতীয় বীর-গাথাই বটে। যে জাতি বিদেশীর পদতলে এমন করিয়া আত্মবিক্রয় করে, সেই জাতির মধ্যে ইসলাম প্রচার করিলে ইসলাম ধর্ম্মেরও যে মহিমা-বৃদ্ধি হয় তাহা আজ কে অস্বীকার করিবে?—সেই জাতির মধ্যেই যে এমন কবি প্রতিভার উদয় হইবে, তাহাতেই বা আশ্চর্য্য হইবার কি আছে? কবিতাটির মধ্যে এই যে পরম তত্ত্বটি পরিষ্ফুট হইয়াছে, ইহার জন্যই কবি সমগ্র জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। তাই আমরা তাঁহাকে পূর্ব্বাহ্নেই সম্বর্দ্ধনা করিয়া ‘খাজা’ উপাধিতে ভূষিত করিলাম; তার পর রায় বাহাদুর মিত্র প্রমুখ ‘যত ফেরশতা গোলামের শিরে বর্ষুন শুভ-মাঙ্গলিক’।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রক মনু

কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →