তর্ক: বাংলা-কবিতার আধুনিকতা নিয়া সমর সেন ও সরোজকুমার দত্ত
১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত প্রগতি সম্মেলনে কবি সমর সেন সাহিত্য (বিশেষ কইরা কবিতা) কেমনে রেভিউলেশনে হেল্প করতে পারে বা কবিতা ও প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের সর্ম্পক নিয়া একটা ইংরেজী প্রবন্ধ পড়েন যেইটা পরে নিউ ইন্ডিয়ান লিটারেচারে ছাপা হয়। সেইটা নিয়া অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক সরোজকুমার দত্ত ‘অতি আধুনিক বাংলা কবিতা’ শিরোনামে একটা সমালোচনা লিখেন, ‘অগ্রণী’ পত্রিকার দ্বিতীয়বছরের চার নাম্বার সংখ্যায় (এপ্রিল, ১৯৪০)। সমর সেন এর একটা উত্তর করেন একই শিরোনামে, ছাপা হয় একই পত্রিকায় ঐ বছরেরই পাঁচ নাম্বার সংখ্যায় এবং একইসাথে সরোজকুমার দত্তের একটা দীর্ঘ ‘প্রত্যুত্তর’ও। সমর সেন সেই প্রত্যুত্তরের আর কোন জবাব করেন নাই; কিন্তু অনেক পরে, ১৯৭৭ সনে উনার স্মৃতিকথা ‘উড়ো খৈ’-এ এই বির্তক নিয়া উনার একটা সিনথেসিস শেয়ার করেন। পাঁচটা গদ্য-ই পুলক চন্দ সম্পাদিত দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত সমর সেনের “বাবুবৃত্তান্ত ও প্রাসঙ্গিক” বই (১৯৯১-এর সংস্করণ) থিকা টেক্সটগুলা নেয়া হইছে। টেক্সটের মালিকানা বিষয়ে বইয়ে কিছু বলা নাই।
সমর সেনের এই টেক্সটে আধুনিক কবিতা (এলিয়েট এবং অন্যান্য) ও মার্কসীয়-বিপ্লবরে মিলানোর একটা চেষ্টা আছে; উনি বলতেছেন যে, যেই আধুনিক কবিতা লেখা হইতেছে ,কবিরা তাঁদের পেটি-বুর্জোয়া জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়া এট বেস্ট সেইটাই করতে পারেন এখনকার সময়ে (মানে, সেই সময় এবং সেইটা এক্সটেন্ডড হইয়া এই পর্যন্তও অবশ্য) এবং যেহেতু প্রকৃত সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া কবিতা লেখা সম্ভব না, এখন এইটা লেখাই কাজ। ইকোনমিক বেসিস এবং কালচারাল সুপারষ্ট্রাকচারের মধ্যে পাথর্ক্য আছে; কবিতার ভিতরে ডাইরেক্ট প্রপাগান্ডা চালানো ত সম্ভব না! কিন্তু এইটা সর্ম্পকে সচেতন থাকার ফলে কিছু কাজ হইছে; যেমন, বাংলা-কবিতা অন্তঃত রবীন্দ্রনাথের পাতলা সেন্টিমেন্টালিজম থিকা বাইর হয়া আসতে পারছে!কবিতা হইলো একজন ইন্ডিভিজ্যুয়াল কেমনে সমাজের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতেছে, তার একটা মাধ্যম এবং এইখানে সমাজের ডেকাডেন্স-এর উপলদ্ধিও বিপ্লবের জন্য একটা অগ্রগতি।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
সরোজকুমার দত্ত বলেন যে, কবিতা দিয়া বিপ্লবরে হেল্প করবেন ভালো কথা; কিন্তু এই ডেকাডেন্স-প্রকাশ করা মোটেই কোন বিপ্লবী কাজ না, বরং এইটা গোপন বিপ্লব-বিরোধিতা। সাহিত্যরে বোঝা যায় তাঁর উদ্দেশ্যকেন্দ্রিকতা এবং ভাবাদর্শের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার ভিতর দিয়া; এইটা মানলে টি.এস.এলিয়ট কখনোই একটা বিপ্লবী সাহিত্যের উদাহারণ হইতে পারেন না। আর এলিয়েট-অনুসারী সমর সেনের কবিতাও ইন্ডিভিজ্যুয়াল অ্যানার্কি মাত্র এবং এইরকম কবিতা-লেখা ব্যাপারটা টেকনিক ফ্যাটিশিজমে গিয়াই শেষ হইবো।
সমর সেন এবং সরোজকুমার দত্তের দুইজনেরই আস্থা মার্ক্সসিস্ট লিটারালি থিওরীতে যে, সাহিত্য বা কবিতার কাজ হইলো রেভিউলেশনের একটা টুল হিসাবে কার্যকরী থাকা। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত সমর সেন একটা অ্যানার্কি বা অস্থিরতা তৈরি করারেই তাঁর কবিতার কাজ বইলা ভাবতে পারছিলেন এবং লিখতেও পারতেছিলেন; পরে, সম্ভবত যখন তিনি বিপ্লব সর্ম্পকে সচেতন হইছেন তখন কবিতা-লেখারে গুরুত্বপূর্ণ বইলা ভাবতে পারেন নাই আর! তারপরও আধুনিক বাংলা-কবিতায় উনার টেকনিক বাঁইচা আছে, কথিত ‘বাহুল্যবর্জিত’-এর উদাহারণ হিসাবে।
কবিতা ও রাজনীতি বিষয়ে এই তর্কটা একটা সময়ের কিছু টেনশনরে খোলাসা করতে পারে।
২.
যদিও তর্ক আধুনিক বাংলা কবিতার শিরোনামে, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে মার্কসবাদী সাহিত্য নিয়া। সমর সেন কইতেছেন যে, উনি নিজেরে কখনোই বিপ্লবী বইলা দাবি করেন নাই, উনার কবিতার নায়ক একজন পেটিবুর্জোয়া এবং এলিয়টরেও উনি বিপ্লবী কবি বলেন নাই, বরং আধুনিক কবিতাতে উনার কন্ট্রিবিউশনের কথাই বলছেন। সমর সেন-এর এই এস্কেপিস্ট টাইপের বয়ানের বিপরীতে সরোজকুমার দত্ত আরো এগ্রেসিভ হয়া ওঠেন: সমর সেন যদি বিপ্লবী না-ই হইবেন, উনি বিপ্লবের সাথে আধুনিক কবিতারে কেন বারবার রিলেট করতে চান; খালি তাঁর এই লেখাতেই না, কবিতা বিষয়ে অন্যান্য লেখা এবং কবিতা পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যাতেও; আর বাংলাসাহিত্যের কথাতেও এলিয়ট এতোটা রিলেভেন্ট না বা হইলেও সেইটা পজিটিভ কোন ঘটনা না। সমর সেন যে কইছেন বাংলা-কবিতা আগাইছে, কিন্তু গত দশ বছরের রাজনৈতিক অবস্থার কোন চিহ্নই ত কবিতাতে না-ই, বরং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কাজী নজরুল ইসলামের যে রাজনৈতিকতা ছিল, সেইটারে বাতিল করা হইছে কবিতাতে দুর্বোধ্যতারে অ্যাপ্রিশিয়েট করার ভিতর দিয়া। এবং সম্ভবত এই তর্কের ক্যাচ’টা এইখানেই যে, সম্ভাবনা থাকার পরেও দুইজনের কেউই আধুনিকতা এবং মার্কসিজমের সম্পর্কটারে আর যাচাই করার দরকার মনে করেন নাই!
– ই. হা.।
_______________________
১
Samar Sen:
In Defence of the ‘Decadents’
Certain critics point out with a sneer that ‘Progress’ is a Victorian word. Perhaps they are right: the Victorian belief in progress was based upon security and a rising level of production. Forebodings and uneasy apprehensions shad-owed the late-Victorian period, because it was an age of finance unlike the early Victorian age of production. The relation between production and distribution is far less apparent in our age of finance, hence the sense of frustration marking the closing years of the last century. To the sceptical critics of progress it may be pointed out that though the present century has widened the gap between productive forces and social relations and to a certain extend justifies their enlightened scepticism, the latest powers of the world production still permit a rational belief in progress. We find that production power of man has still immense possibilities. So we are still for progress. It is not desirable in our day to reaffirm the medieval conception of human life, to declare that man’s fate is inevitably tragic and all notions of progress an illusion. To assert this under the painful pressure of circumstances is a subterfuge, a means to shrink responsibility.
It is rather easy to talk about our belief in progress with reference to past history. But the moment we come to consider the present, to define the meaning of the progressive movement in literature, we seem to be in a melting pot, and confused voices of lamentation, denunciation and warning strike the ear. The modern Bengali poet is between two fires. If the tries to be honest with regard to the vices of his own class and voices his sense of decay he falls under, and is found guilty of the charges of obscenity and obscurity. The eternal principles of art, he is told, are beauty and truth, truth and beauty, to deny which is bad taste, a perversion. On the other hand he is told from the progressive quarter, which emphasizes his defeatism and obscurity, that he is a decadent and damned petty-bourgeois. The damning is thus complete. He then thinks of perhaps a dozen or so his admirers and continues to use a medium of expression whose beauties commend themselves only to the dozen or so, with confusing results both for the moralist and the progressive critic. A gentleman, sceptical of the progressive demands on poetry, when politely told that he was a decadent bourgeois, reported: “you can call me a swine if you like, but I am what I am.”
It is certainly time to clear up a host of misunderstandings. A really progressive critic will be a great force today. But a certain notion is gaining ground, fanned by some the progressives and the newspapers which have their own sentimental ideas about literature, that to be progressive means to write about mazdoors and kisans in a broad, sentimental vein, to depict all the glories of a possible proletarian revolution and to do all these in a way which would be understood by the man in the street. Away with defeatism and all bourgeois subtleties of expression! Nothing is more important than direct propaganda. It may be that the results will be slightly disappointing for some time, but all will be well in the future society.
The progressive who proceeds in this manner is not an objective critic. He is a sentimental humanist. We must not forget in our new-born enthusiasm for the cause that literature has a tradition of its own and that there are many invisible gaps between the economic basis and the cultural superstructure. If we consider the changes effected in Bengali poetry in the last fifteen years we must admit that it has definitely ‘progressed’. The best of it has almost got clear for that sickening vice bequeathed by the Tagorean tradition – sentimentalism. It has improved and made considerable changes in technique. From a loose and ineffective language to a highly polished and flexible one, from a mere turning loose of emotion to a consciousness of the disruptive forces threating society, – these are considerable achievements. To sacrifice all these in order to widen the appeal and rouse the people by direct propaganda will be a dangerous sacrifice. It will mean a swing backward in literary tradition and revive the sentimental age in a changed grab. Such demands on poetry, backed by the newspaper and the progressives, will have dangerous consequences for the rising generation, which has every chance of being taken in by these easy methods of cheap and quick popularity. The critic who asks for such a literary change in the name of progress, we repeat, is at best a sentimental humanist.
What can be achieved if, in the immediate present, the Bengali poet tries to widen his appeal? Mass-appeal is indeed a tremendous thing. It can at least help to fill up the empty pockets of the unfortunate writers. But how do the masses come in? The vast majority of them is illiterate. The reading section consists entirely of the middle-classes. To appeal to them is to pander to the tastes of a demoralised class, to turn poetry into simple wish-fulfillment. Consider the plight of the Indian film industry and the Radio, both of which are middle-class and popular. If the middle-class has any vitality left it would have at least created something significant during and after the Civil Disobedience Movement. But nothing of that kind happened, because at this later hour in history the colonial bourgeoisie has no life at all. With huge and vital section of population illiterate and dim in the background, we cannot really hope to effect a revolution with our writings. That would be putting the cart before the horse. We can at present only soliloquise, we cannot address the real audience.
To be really progressive in our time and in our country, where only a fraction is literate, is to preserve the integrity of what is good in our past tradition, to be true to oneself and at the same time to realise that poetry is medium through which the individual tries to adjust his relations to society, to be conscious of the complex forces which are changing our world. To be able to preserve one’s personal integrity as a poet will help the progressive cause in the long run. People consider Hopkings and Eliot to be among the real pioneers of English poetry. And it will not be superfluous to remind that Eliot is often condemned for his obscurity, and is the one poet who is convinced to his bones of the decay of all civilisation. In these times of dereliction and dismay, of wars, unemployment and revolutions. The boredom and the horror, rather than glory of life, is our immediate reality. Perhaps that is because we have our roots deep in the demoralised petty-bourgeoisie and the lack the vitality of a rising class. It is best to admit this and write about the class you know well than to exult in the future glories of a classless society. Consciousness of decay is also power. We believe that mankind will undergo a far-reaching transformation in a classless society, that only in a changes social order, politically free, and based on emancipation and equality of the peasant and the worker, will it again be possible to establish the vital links between literature and the people which have snapped, but at present we find ourselves unable to translate that belief in to good poetry. We cannot do that unless we act. In the meantime we draw a distinction between the poetry of revolutionary struggle and the poetry of revolution as a literary fashion.
Consciousness of decay is certainly a power. But a critical situation arises when we find that at a certain stage this also is not enough even from the point of view of poetic integrity. We will reach that stage very soon, and we must make a choice if we are to continue as living writers. This involves an entire reconstruction of our ways of living. An active part in the mass-movement will certainly help that poet who has been able to preserve his integrity. He will be able best to combine literary tradition with social content and will act as a releasing force. He will then perhaps cease to soliloquise and will begin to be representative. Such a reconstruction of living is not an easy job for the present generation of Bengali poets, most of them settled in life and approaching the critical age of thirty. It would have been easier with Congress out of office, an active body in the anti-imperialist front. But now the problem is infinitely more complex in an atmosphere thick with sheepish pacifist slogans of truth and non-violence and all the accumulated rubbish of an out-of-date, constitutional nationalism. But no task is too difficult when it is a vital affair. If the modern Bengali writers fails to make this difficult choice, we can take leave of him and ask him not to mourn any longer for the decay of society but rather to mourn for himself.
২
সরোজকুমার দত্ত:
অতি আধুনিক বাংলা কবিতা
(গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা)
১৯৩৮ সালের শেষভাগে কলিকাতায় নিখিল ভারত প্রগতি সম্মেলনের যে অধিবেশন হয় তাহাতে শ্রীবুদ্ধদেব বসু ও শ্রীসমর সেন আপন আপন সাহিত্য রচনার বৈপ্লবিকতা ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করিয়া দুইটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। শ্রীযুত বুদ্ধদেব বসু-র প্রবন্ধ সর্ম্পকে আমরা প্রথম বর্ষের অগ্রণী’র দ্বিতীয় সংখ্যায় আলোচনা করিয়াছি, উহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। শ্রীযুত সমর সেনের রচনার সমালোচনা করিতে বসিয়া তাঁহার প্রবন্ধের বিষয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা প্রয়োজন। কারণ, প্রথমত ঐ প্রবন্ধটি (In Defence of the ‘Decandents’) নাকি বিশেষ প্রতিপত্তিশালী উদীয়মান এক লেখক-সম্প্রদায়ের সাহিত্যিক অভিমত সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত করিতেছে, অর্থাৎ উহা কোনো সুসমৃদ্ধ দলবিশেষের সরকারি ইস্তাহারের সামিল এবং দ্বিতীয়ত উহা আলোচ্য কাব্যপুস্তিকার গ্রন্থকারের আত্মসমর্থন – In Defence of the ‘Decadents’। সমালোচকের সময়াভাব ও অগ্রণী’র স্থানাভাববশত প্রবন্ধটি হইতে বিস্তৃত আক্ষরিক উদ্ধৃতি সম্ভব নহে। সংক্ষেপে উহার মুখ্য বিষয়গুলি এই: (১) ধনতন্ত্রী সমাজে যে প্রগতি স্তব্ধ হইয়াচে বিপ্লবোত্তর সাম্যবাদী সমাজে সেই প্রগতি অব্যাহত চলিবে, অতএব প্রবন্ধকার আশাবাদী ও প্রগতিতে বিশ্বাসী; (২) ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রী সমাজ ‘ডেকাডেন্ট’ অতএব এ সমাজে সত্য, শিব ও সুন্দরের সাধনা অসম্ভব এবং ‘ডেকাডেন্টস’ সাহিত্যই একমাত্র আন্তরিক সাহিত্য। এই আন্তরিকতার জন্য ডেকাডেন্টস হইয়াও তাঁহাদের সাহিত্যে বৈপ্লিবক শক্তিমত্তা বর্তমান। নজীর ইংরেজ কবি টি.এস.এলিয়ট–এর কাব্য; (৩) ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার যে-কোনোরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি; (৪) কিষাণ-মজদুর লালঝান্ডা-ব্যারিকেড সংঘর্ষ লইয়া নাকি তাঁহাদের উত্তেজক সাহিত্য রচনার নির্দেশ বা ফরমাইস দেওয়া হইতেছে এবং ঐ সকল বস্তুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁহাদের না থাকায় রোমাণ্টিক হইবার ভয়ে ঐ নির্দেশ বা ফরমাইস তাঁহারা পালন করতে পারিতেছেন না।
কবির (১) অভিমত সম্পর্কে কবির সহিত আমাদের কোন বিরোধ নাই, আমরাও আশাবাদী ও সাম্যবাদী সমাজ ও প্রগতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু (২) অভিমতে কর্মভীরু বুদ্ধিজীবীর চিন্তার অন্তঃসারশূন্যতা পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রী সমাজ (আমাদের সমাজ কি সম্পূর্ণরূপে ধনতন্ত্রী?) যে ডেকাডেন্ট, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। সে সমাজে সত্য, শিব ও সুন্দরের (অ্যাজ দে আর) সাধনা অসম্ভব, স্বীকার করি। কিন্তু বিগতপ্রাণ সত্যশিবসুন্দরের পুনরুজ্জীবনের (Revival-এর নহে) সাধনাও কি অসম্ভব? এ সাধনা চক্ষু মুদিয়া, শিরদাঁড়া খাড়া করিয়া পণ্ডিচেরী-মার্কা সাধনা নহে, কিংবা মাঘোৎসবের সাম্বৎসরিক শান্তিপাঠ ও মানবকল্যাণ কামনাও নহে। এ সাধনার অর্থ – সংগ্রাম, ষ্ট্রাগল। সমাজ যেখানে ডেকাডেন্ট, সামাজিক কোনো আন্দোলনকে সেখানে বিপ্লবীরূপ পরিগ্রহ করিতে হইলে আপনার অঙ্গ হইতে ডেকাডেন্ট-এর শেষ দাগ মুছিয়া ফেলিতে হইবে, সেইজন্য ডেকাডেন্ট-সমাজ হইতে উদ্ভূত সামাজিক বিপ্লবী আন্দোলন কমিউনিজম–এ হতাশা, অবসাদ, আত্মবিলাপ সাফল্য-স্বপ্নভীরু পরাজিতের ক্লীবকান্নার স্থান নাই। চিন্তা, কর্ম ও উৎপাদনের উদ্দাম বিশৃঙ্খলার মধ্যে ক্ল্যাসিক্যাল শৃঙ্খলা এই আন্দোলনের উপজীব্য ও জাস্টিফিকেশন, ডেকাডেন্স-এর অবলুপ্তির প্রচেষ্টাই কমিউনিজম-এর সার্থকতা। বর্তমান ডেকাডেন্ট যুগের যদি কোনো আন্দোলনে যুগধর্মের অজুহাতে ডেকাডেন্স প্রবেশ করে এবং যুগধর্মেরই দোহাই পাড়িয়া কায়েমী হইয়া বসে, রাষ্ট্রিক হৌক, সাহিত্যিক হৌক, সে আন্দোলনকে ডেকাডেন্ট অতএব রিঅ্যাকশনারি বলিবার নিষ্ঠুর কর্তব্যজ্ঞান যেন আমাদের থাকে। কোনো সাহিত্য যদি ক্ষয়িষ্ণু গলিত সমাজের উপদংশ ক্ষতগুলিকে যথাসম্ভব যথাযথভাবে প্রতিফলন করে, এবং তথাপি উদ্দেশ্যবিহীন হয় কিংবা কোনো ভাবাদর্শের সহিত সংশ্লিষ্ট না হয় তবে উহা যান্ত্রিক ও জড়ের জঞ্জাল হইতে বাধ্য এবং সাহিত্যিকের পক্ষে উহা এক নিকৃষ্ট শ্রেণীর লালসা নিবৃত্তির উপায়ও বটে। উপায় ও ভাবাদর্শই সাহিত্যের অন্তর, ইহাদেরই যুগল নিকষে সাহিত্যের আন্তরিকতার পরীক্ষা হয়। ডেকাডেন্ট সমাজের সাহিত্যে ডেকাডেন্স আন্তরিকতার লক্ষণ নহে, ইহা কর্মবিমুখতা ও গোপন বিপ্লব-বিরোধিতার নামান্তর মাত্র। ইহা সাবজেক্টিভ ইনিশেয়েটিভের অস্বীকার এবং আত্মনিষ্ক্রিয়তা সমর্থনকল্পে ঐতিহাসিক অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস। ইহা মার্ক্সসিজম নহে। বর্তমান জগতে মার্ক্সসিজম ভিন্ন অন্য কোনো ভাবাদর্শ বৈপ্লবিক নহে একথা আমি বলিতে চাহি না: আমি বলিতে চাহি যে, যাহা মার্ক্সসিজম নহে তাহাকে মার্ক্সসিজম বলার মধ্যে বিপ্লব বা প্রগতির নামগন্ধও নাই। নিজের কাব্যের বৈপ্লবিকতা সপ্রমাণের জন্য শ্রীযুক্ত সেন ইংরেজ কবি টি.এস. এলিয়টের নাম করিয়াছেন কিন্তু একথাটি সুকৌশলে চাপিয়া গিয়াছেন যে টি.এস.এলিয়ট নিজেকে কোনোদিন মার্ক্সিস্ট বলেন নাই, বরঞ্চ তাঁহার সাম্যবাদবিরোধিতা যে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রে বিশ্বাসে আসিয়া ঠেকিয়াছে, তাহা তিনি স্পষ্টরূপেই স্বীকার করিয়াছেন। এ-উক্তি তাঁহার সাহিত্যের সহিত সম্পূর্ণ সুসমঞ্জস। ব্রিটিশ ডেকাডেন্স-এর সর্বশ্রেষ্ঠ পদকর্তা টি.এস.এলিয়ট নিষ্কলুষ ডেকাডেন্স-এর সুদীর্ঘ পদাবলী রচনা করিয়া গেলেন অথচ তিনি রোমান ক্যাথলিক মোনার্কি-তে বিশ্বাসী। বলা বাহুল্য, সাম্যবাদের শত্রু, চিরজীবন ধরিয়া তিনি ডেকাডেন্স নিঙড়াইয়া গেলেন, এক ফোঁটা বিপ্লব পাওয়া গেল না। শ্রীযুত সেন হয়তো বলিবেন যে তাহার সাহিত্যের অবজেক্টিভ মূল্য সর্ম্পকে তিনি সচেতন নহেন, প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিকের সাহিত্য বিপ্লবী সাহিত্যের ভিৎ তৈয়ারী করিয়াছে। কিন্তু তিনি গলিত ক্ষত দেখিয়া শিহরিয়া উঠিয়া পাতার পর পাতায় তার বর্ণনা-বিলাস করিলেন, গলিত ক্ষত আর কাহারও দেখিতে না হয় তজ্জন্য যাঁহার কাব্যে কোনো উৎকণ্ঠা বা প্রচেষ্টা দেখা গেল না, বিপ্লবী উৎকণ্ঠা বা বিপ্লবী প্রচেষ্টাহীন এই বিশুদ্ধ সিনিকিজম-এর উপর ভবিষ্যৎ বিপ্লবী সাহিত্যের ভিৎ যাঁহারা গড়িতে চাহেন তাঁহারা হয় নির্বোধ, না হয় প্রবঞ্চক। সাম্যবাদীগণ ইলিয়টী সাহিত্যকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেন, মার্ক্সিস্ট সেন তাহাকে বিপ্লবী বলেন, কারণ ‘পিপল সে’।
ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অন্তঃসারশূন্যতার যে কোনোরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি নহে, লিভিং, প্যাশনেট ও সেন্সেটিভ মনে এই অন্তঃসারশূন্যতার প্রতিক্রিয়াই প্রতিফলিত হয় বিপ্লবী সাহিত্যে, আন্তরিকতার খড়্গাঘাতে নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কবিলাস সেখানে মহূর্তে ভূলুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। তাই একদা যখন রোমাঁ রোলাঁ গান্ধী-রামকৃষ্ণে বিশ্বাসী ছিলেন তখনও তাঁহার সাহিত্য বিপ্লবী সাহিত্য ছিল, প্রাক-বলশেভিক গোর্কীর সাহিত্যের বৈপ্লবিকতাকে বলশেভিকরা অস্বীকার করিতে পারেন নাই, অহিংস টলস্টয়ের সাহিত্য সর্ম্পকে লেনিনের প্রশাংসোচ্ছ্বাস তো বহুবিদিত। ভাবাদর্শের দিক হইতে দেখিলে ডি.এইচ.লরেন্স-এর সাহিত্যে প্রতিক্রিয়া চূড়ান্ত কিন্তু ভাবাদর্শ তো এখানে মুখ্য নহে। তাহার ভাববলিষ্ঠ জীবন্ত মন পত্রে-পত্রে যে রক্তসিক্ত পদচিহ্ন রাখিয়া গিয়াছে, তাহার বিপ্লবীরূপকে অস্বীকার করিব কোন দুঃসাহসে? অপরপক্ষে অলডাস হাক্সলির গান্ধীবাদে বিশ্বাসে কি আন্তরিক? যিনি জীবনে ভালোমন্দ কিছুতেই কোনদিন বিশ্বাস করিলেন না, তাহার হঠাৎ-বিশ্বাসের পশ্চাতে কি বিরাট ফাঁকি নাই? মন যেখানে জাগ্রত ও জীবন্ত, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও প্রবাহমান পারিপার্শ্বিকতার আঘাতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শ সেখানে আন্তরিকতায় উদ্বেল এবং ক্রমবিবর্তনের পথে সত্য উপলদ্ধির অভিমুখে গতিমান। এই সত্য উপলদ্ধির পথে পরিবর্তনশীল ভাবাদর্শের প্রতিটি মুহূর্ত বৈপ্লবিক বেদনায়, উৎকণ্ঠায়, আর্তক্রন্দনে নিবিড়। ডেকাডেন্স-এর প্রতিটি বন্ধনরজ্জু ছেদনের সঙ্গে সঙ্গে তাই তাহার আর্ট হইতে যন্ত্রণায় আর্তনাদ ধ্বনিত হইয়া উঠে। শেষরজ্জু ছিন্ন হইবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাহার শান্তি নাই। এই অশান্তি, উদ্বেগ ও আর্তনাদ, মহাভুজঙ্গের নির্মোক পরিহারের এই প্রতিটি মুহূর্ত বৈপ্লবিক – রেভিউলেশনারি ইভালোশন টুওয়ার্ডস অ্যা রেভিউলেশনারি আইডোলজি। ইহা নিষ্ক্রিয় মস্তিকজীবীর বিলাপ-বিলাস নহে। ইহা ডেকাডেন্ট সমাজের প্রগেসিভ বুদ্ধিজীবীর প্রাকবিপ্লবী জীবনের বৈপ্লবিক পাথেয়। বর্তমান ইয়োরপীয় সাহিত্যে রোলাঁ, বার্বুস ও মালরোর শ্রেণীবিচ্যুতির পশ্চাতে এই প্রচন্ড বেদনার ঐতিহ্য বর্তমান।
শ্রীযুত সেন ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত সমাজের অধিবাসী অথচ বিপ্লবী। অতএব, স্বভাবতই আমরা তাঁহার কাব্যে ভাবাদর্শের বেদনাময় পরিণতির একটি পথরেখা আবিষ্কার করিব। কিন্তু কোথায় সে পরিণতি? ক্ষয়িষ্ণু সমাজের ক্ষয়িষ্ণু কবি শ্রীযুত সমর সেনের সাম্যবাদী ভাবাদর্শ উর্বশীর মতো ‘যখনি জাগিলে বিশ্বে যৌবনে গঠিতা পূর্ণ প্রস্ফুটিতা’। কবি ক্ষয়িষ্ণু বলিয়া কাব্যও ক্ষয়িষ্ণু হইবে, কিন্তু ভাবাদর্শ হইল সমস্ত ক্ষয়, অপচয়ের ঊর্ধ্বে সুগঠিত, সুসম্পূর্ণ, সুসমৃদ্ধ সাম্যবাদ। কোকেনের প্যাকেটে ঔষধের লেবেল মারিয়া দিবার মধ্যে যেটুকু বাহাদুরী আছে তাহা শ্রীযুত সেনেরই প্রাপ্য। একটি উদাহারণ দিই:
‘তবু জানি-
জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে, চূর্ন হবে, ভস্ম হবে
আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে
ততদিন
ততদিন নারীধর্ষণের ইতিহাস’
‘তবু জানি’ – কিন্তু তিনি জানিলেন কি উপায়ে? জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে, চূর্ণ হবে, ভস্ম হবে, এ জ্ঞান তাঁহার কোথা হইতে আসিল? বিপ্লবী আন্দোলনের ভিত্তিমূল শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তো তাঁহার নাই। অভিজ্ঞতার পরিধি তো একদিকে অশিব, অসত্য, অসুন্দর মধ্যবিত্তজীবন ও অন্যদিকে –
‘আবার নিঃশব্দ হিংস্র প্রান্তরে,
রক্ত-পতাকা আকাশে ওড়ে,’
এই পর্যন্ত। তিনি তো মার্ক্সিস্ট – তিনি তো গান্ধীর মতো ইনার ভয়েস কিংবা সুভাষ বসু-র মতো ইনটোশন-এ বিশ্বাস করেন না। এ ভাবাদর্শ তিনি গ্রহণ করিয়াছেন কোন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও বেদনার সংঘাতে? বর্তমান ডেকাডেন্ট মধ্যবিত্ত সমাজে বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীর ভিড়ের মধ্যে টেক্সট বুক মার্ক্সসিজম-এর যে সহজ সিদ্ধির পথ শ্রীযুত সেন আবিষ্কার করিয়াছেন তাহাতে তাঁহার বৈষয়িক ধূর্ততার প্রশংসা না করিয়া আমরা থাকিতে পারি না। ‘রোমান্টিসিজম’-এর ভীরু কবির ভাবাদর্শ যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বিচ্যুত হইয়া রোমান্টিক হইয়া উঠিয়াছে, কবির কি সে খেয়াল নাই?
কিষাণ-মজদুর, লালঝান্ডা-ব্যারিকেড সংঘর্ষ লইয়া উত্তেজক কাব্য-রচনার হুকুম কেহ কোনোদিন শ্রীযুত সেনকে দিয়াছেন কিনা জানি না, বোধহয় এ অভিযোগ শ্রীযুত সেনের স্বকপোলকল্পিত। কিন্তু কেহ যদি বিপ্লবী-কবিযশাকাঙ্ক্ষী কাহাকেও সমাজের অগ্রগামী বিপ্লবীশ্রেণীর জীবন বৈপ্লবিক ভঙ্গীতে দেখাইবার অনুরোধ করেন, তবে কি তাঁহার অনুরোধ অযৌক্তিক হইবে? শ্রীযুত সেন বলিবেন, তিনি বিপ্লবী কবি বটে তবে বিপ্লবীশ্রেণীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁহার নাই, অর্থাৎ কেবলমাত্র রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগদান করিতে হইলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, সাহিত্যে কিংবা কাব্যে নহে। রেভিউলেশনারি ট্রেনিং এড়াইয়া বিপ্লবী সাজিবার ইহা এক অদ্ভুত কৌশল। শ্রীযুত সেনের এ ফাঁকিকেও না হয় আমরা ক্ষমা করিলাম, কিন্তু যে মধ্যবিত্ত জীবনের সহিত তাঁহার জন্মগত ও প্রাত্যহিক পরিচয় তাহার গলিত, স্থবির ও নপুংসক রূপটিই তাঁহার চোখে পড়িল, অথচ ইস্পাত-কঠিন যে অংশ ব্যক্তিগত ভাবাদর্শে কিংবা নিষ্ঠুর পারিপার্শ্বিকতার আঘাতে বিপ্লব-প্রবাহের সহিত আপনাকে মিশাইয়া দিয়াছে ও দিতেছে তাহার কঠোর সুন্দর রূপ, তাহার শ্রেণীবিচ্যুতির বেদনা-ইতিহাস, তাহার বুদ্ধিবিদগ্ধ আশাবাদের কোনো আভাস শ্রীযুত সেনের কাব্যে মেলে না। শ্রীযুত সেন যে কাব্য আন্দোলনের উত্তর-সাধনা করিতেছেন তাহা অতীতে মধ্যবিত্তপরিচালিত বিপ্লবী আন্দোলনকে উপেক্ষা করিয়াছে – অসহযোগ, আইন অমান্য ও সন্ত্রাসবাদের সহিত কোনো সম্পর্কই রাখে নাই, তাই আজ সাম্যবাদী আন্দোলনের সহিত তাহার এই ঐতিহ্যহীন একত্ববোধের পশ্চাতে যে বিরাট প্রবঞ্চনা রহিয়াছে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই।
সমালোচনা দীর্ঘ হইয়া পড়িতেছে, এইবার শ্রীযুত সেনের কাব্যিক আঙ্গিক সম্পর্কে কিছু বলিয়া উপসংহার করিব। শ্রীযুত সেনের কবিতা সাধারণের বোধগম্য নহে – কেবলমাত্র ‘চুজেন ফিউ’-এর উপভোগ্য। আমি যথেচ্ছ দুইটি স্থান উদ্ধার করিতেছি:
আকাশচরের শব্দ আকাশ ভরায়।
নীবিবন্ধে কুটগ্রন্থি,
শিবিরে আর নিবিড় মায়া নেই।
তুষার পাহাড়ের শান্তি যদিচ শিশিরে ঝরে।
কিংবা,
পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া
অন্ধকূপে স্তব্ধ ইন্দুরের মতো,
ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে
বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার।
এ কবিতা ‘ইন্টেলেকচুয়াল ক্লীক’-এর জন্য লেখা, আমার আপনার জন্য নহে। পাঠক-সম্প্রদায়ের প্রতি এই সানুনাসিক অবহেলা, আপনার কাব্যকে সর্বসাধারণের উপভোগ হইতে বাঁচাইয়া দুর্বোধ্য করিবার এই গলদঘর্ম প্রয়াস, ইহা আর যাহাই হউক, বিপ্লবী মনোভাবের পরিচায়ক নহে। মসীকৌলীন্যের অভিমানে শ্রীযুত সেন আজ আর্টের প্রচাররূপ ও কমিউনিকেটিভনেস-কে পরোক্ষভাবে অস্বীকার করিতেছেন। রচনার আবেদনের পরিধি সঙ্কীর্ণ হইতে সঙ্কীর্ণতর হইয়া ক্রমে আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হইতে বসিয়াছে। এই শম্বুকবৃত্তিকে কি বিপ্লবী প্রচেষ্টা বলিব? ইহা বিপ্লবের নামে ইন্ডিভিজ্যুয়াল অ্যানার্কি-র চরম অবস্থা মাত্র। সমুদ্রপারে সাবজেক্টিভ ইন্ডিভিজ্যুয়ালিজম-এর যে ঐতিহাসিক আন্দোলন একদা বিপ্লবীরূপে উদ্ভূত হইয়া অবশেষে কালের কঙ্কালপথে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হইয়াছে, সাম্যবাদের ছকরূপে ইহা তাহারই অনুকরণহীন অনুকরণ মাত্র।
কাব্যের বিষয়বস্তু, কাব্যের উৎসমুখ, কাব্যের দায়িত্বের প্রশ্নকে ছাপাইয়া আজ কাব্যের আঙ্গিকের প্রশ্ন বড় হইয়া উঠিয়াছে। যৌবনের তাগিদে বল্কল পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, খুশিমতো বল্কল পরিবর্তন করিলে সঙ্গে সঙ্গে দেহেরও পরিবর্তন হইবে ইহা মনে করা বাতুলতা। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে ও অভ্যন্তরীণ তাগিদেই আঙ্গিকের পরিবর্তন হইবে, ইহার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা হয় নির্বোধ কালক্ষয় নতুবা সংগ্রাম এড়াইবার প্রচেষ্টা। টেকনিক ফেটিসিজম-এ ইহার অনিবার্য পরিণতি। ঘোড়া আসিলে চাবুকের জন্য ভাবিতে হইবে না। স্বল্পপরিসর প্রবন্ধে আমারদের বক্তব্য যথাযথভাবে বলিবার সুযোগ মিলিল না, বারান্তরে এ সম্বন্ধে আরও লিখিবার ইচ্ছা রহিল। ইতিমধ্যে শুধু এই কথাটি পাঠককে স্মরণ রাখিতে বলি যে, ইন্টেলেক্টুয়ালী কুসংসর্গ হইতে সাম্যবাদের সাবধান হইবার দিন আসিয়াছে।
৩
অতি আধুনিক বাংলা কবিতা
সমর সেন
উপরোক্ত নামের একটি সমালোচনা অগ্রণীর এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে আমার কিছু বলার আছে, কারণ সমালোচক বিনা কারণে শূন্যে ঘন ঘন ছোবল মেরেছেন, এবং আমার লেখা ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্টস’ শীর্ষক যে প্রবন্ধটি সম্বন্ধে তাঁর ঘোরতর আপত্তি, তার সারাংশ দিতে গিয়ে আমার বক্তব্যের বিকৃতি অনেক জায়গায় করেছেন। ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্টস’ নিউ ইন্ডিয়ান লিটারেটার-এর দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু পত্রিকাটি কাছে না থাকায় পান্ডুলিপি ব্যবহার করতে হয়েছে, ফলে দু’এক জায়গায় ভাষার অদল-বদল থেকে যেতে পারে। কিন্তু তাতে ভাবের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। হাওয়ায় ছোবল মারার কথা এক্ষেত্রে নেহাৎ অপ্রাসঙ্গিক নয়। সমালোচকের কী কারণে জানি না দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে আমি নিজেকে ‘বিপ্লবী’ কবি বলে প্রচার করি, অথচ আসলে আমি নির্বোধ, কিংবা প্রবঞ্চক, বিপ্লবী নই; এ নিদারুণ জুয়াচুরীর জন্য তিনি মর্মাহত ও ক্ষিপ্ত বোধ করছেন। এই মূল অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, কারণ জ্ঞাতসারে আমি নিজেকে ‘বিপ্লবী’ বলে জাহির করিনি, উপরুন্তু কর্মভীরু পলাতক, আধাবাস্তব আধা-রোমাণ্টিক ভাবেই আমার কাব্যের নায়ককে বর্ণনা এবং বিদ্রুপ করে এসেছি। গ্রহণ-এর নাম-কবিতায় যে টাইপের জীবন, এবং আত্মপরিক্রমার কথা আছে সে টাইপ বিপ্লবী নয়, মুমূর্ষ শ্রেণীর প্রতীক, সেটা বোঝাবার জন্য একটি লাইনও উদ্ধৃত হয়েছিল: The waking have a common world but the sleeping turned aside each into a world of his own. যদি লোকমুখে অগ্রণীর সমালোচক ‘বিপ্লবী’ বিশেষণ আমার সম্বন্ধে শুনে থেকে ক্রুদ্ধ হয়ে থাকেন, তাহলে আমি নিরুপায়। আমার প্রবন্ধটি বাংলা কবিতা এবং সমালোচনার কয়েকটি ধারার বিষয়ে লিখিত, ‘আপন সাহিত্য রচনার বৈপ্লিবকতা… ব্যাখ্যা’ করার কোনো উদ্দেশ্য তাতে ছিল না; বাংলা কবিতার আলোচনাকে নিজের কবিতার আস্থায় রূপান্তরিত করতে আমি সচেষ্ট হইনি। বরং তাছাড়া, উপরোক্ত প্রবন্ধটির যে ব্যাখ্যা সোজা বাংলায় তিনি করেছেন, তাতে আমার মতো বুদ্ধিহীন বুদ্ধিজীবীর বিস্মিত হবার যথেষ্ঠ কারণ আছে। তিনি নম্বর করে প্রবন্ধটির সারাংশ (!) দিয়েছেন! সে নম্বরগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে প্রবন্ধের কয়েকটি অংশ পড়লে মন্তব্যের প্রয়োজন আশা করি বিশেষ হবে না। ‘(২) ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রী সমাজ ‘ডেকাডেন্ট’ অতএব এ সমাজে সত্য শিব ও সুন্দরের সাধনা অসম্ভব এবং ডেকাডেন্ট সাহিত্যই একমাত্র আন্তরিক সাহিত্য। এই আন্তরিকতার জন্য ডেকাডেন্ট হইয়াও তাঁহাদের সাহিত্যে বৈপ্লবিক শক্তিমত্তা বর্তমান।’ (অগ্রণী, ২১৩ পৃঃ)
আমার প্রবন্ধে একটি অংশ: ‘In these times of dereliction and dismay, of wars, unemployment and revolutions, the decayed side of things attracts us most… Perhaps that is because we have our roots deep in the demoralized petty-bourgeoisie and lack the vitality of a rising class.’
(৩) ‘ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার যে কোনোরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি।’
‘Consciousness of decadence is certainly a power.’ (In Defence of the ‘Decadents’) এখানে ‘শক্তি’র কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বৈপ্লবিক বিশেষণটি সমালোচক যোগ করেছেন। উপরোক্ত পংক্তিতে সচেতনতার উপর জোর দেওয়া হয়েছে: ‘সাবজেক্টিভ ইনিশিয়েটিভ’ আধুনিক কবিতায় অত্যন্ত প্রয়োজন সে কথা সমালোচক স্বীকার করেছেন। তাঁর অভিধানে সচেতনতার কী অর্থ সেটা আমার জানা নেই।
আর একটি জায়গায় তিনি লিখেছেন: ‘শ্রীযুত সেন বলিবেন, তিনি বিপ্লবী কবি বটে তবে বিপ্লবী শ্রেণীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁহার নাই, অর্থাৎ বিপ্লবী শ্রেণীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, সাহিত্যে কিংবা কাব্যে নহে। রেভিউলেশনারী ট্রেনিং এড়াইয়া বিপ্লবী সাজিবার ইহা এক অদ্ভুত কৌশল।’ এ প্রসঙ্গের প্রথম বক্তব্য যে, আমার প্রবন্ধে আধুনিক বাংলা কবিতা কী আমার নিজের কবিতা সম্বন্ধে ‘বিপ্লবী’ বিশেষণ একবারও ব্যবহৃত হয়নি, শুধু বলা হয়েছে যে গত দশ বছরের মধ্যে বাংলা কবিতার যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে, উন্নতি এবং বিপ্লব আশা করি এক কথা নয়। তাছাড়া গণ-আন্দোলনে যোগদান সম্বন্ধে আমার প্রবন্ধে এই কয়েকটি কথা শেষের দিকে ছিল: “Consciousness of decay is certainly a power. But a critical situation arises when we find that at a certain stage this also is not enough… We will reach that stage very soon, and we must make a choice if we are to continue as living writers. This involves an entire reconstruction of our ways of living. An active part in the mass-movement will certainly help that poet who has been able to preserve his integrity… He who is bent in living a little cell, will be dying with a little patience.’
এলিয়টের নাম উল্লেখ করে আমি সমালোচকের বিরাগভাজন হয়েছি। তিনি লিখেছেন: ‘সাম্যবাদীগণ ইলিয়টী সাহিত্যকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেন, মার্ক্সসিস্ট সেন তাহাকে বিপ্লবী বলেন, কারণ ‘পিপল সে’।
আমার প্রবন্ধে এলিয়টকে বিপ্লবী কবি বলা হয়নি, তবে এটা বলা হয়েছে যে আধুনিক প্রগতিক কবিদের উপর তাঁর প্রভাব অসামান্য। অডেন প্রমুখাদি সাম্যবাদী কবিরা এলিয়টের প্রভাব এবং ঐতিহাসিক মূল্য স্বীকার করতে কখনো কার্পণ্য করেননি, এবং সাহিত্যে যে অন্তর্দৃষ্টি থাকলে এলিয়টী সাহিত্যের মূল্যবিচার সম্ভব তার উপস্থিতি কডওয়েলের ইলিউশন অ্যান্ড রিয়ালিটি নামক পুস্তকে আছে। এবং আমার যতদূর জ্ঞান তাতে কডওয়েলকে সাম্যবাদী বলেই জানি। শক্তি থাকলে ধনতন্ত্রের অনেক গলিত অংশ নিঙড়ে বিপ্লবের ফোঁটা সংগ্রহ করা যে সম্ভব সেটা আমাদের সাম্যবাদী সমালোচক জানেন না কিংবা মানেন না, কিন্তু এলিয়টের ‘ডেকাডেন্স’ নিঙড়ে অনেক ফোঁটাই আধুনিক ইংরেজ কবিরা কাজে লাগিয়েছেন (এ প্রসঙ্গে ডে লুইস-এর অ্যা হোপ ফর পোয়েট্রি, স্পেন্ডার-এর দ্য ডেসট্রাক্টিভ ইলিমেন্ট, দ্য আর্টস টু-ডে-তে ম্যাকনিইস-এর প্রবন্ধ পঠিতব্য)।
আধুনিক বাংলা কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁদের অনেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করেননি, সেটা আমাদের দুর্ভাগ্য। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই শক্তিমান লেখক, তাঁরাই এতদিন রাজত্ব করে এসেছেন এবং মধ্যবিত্ত সমাজের উপর কিছু কিছু প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন। এর কারণ কী? কারণ এদের অনেকে মধ্যবিত্ত জীবনের গ্লানি এবং বহুমুখী ব্যর্থতা সম্বন্ধে সচেতন, এবং সত্য শিব সুন্দরের অবাস্তব মায়া কাটিয়ে দৃষ্টিভঙ্গী এবং প্রকাশভঙ্গীতে পরিবর্তন এনেছেন। নিপীড়িত শ্রেণীর আশা-ভরসা, কিংবা সংগ্রামের সংযম এঁদের লেখায় আজ পর্যন্ত বিশেষ মেলে না, কারণ গণআন্দোলনের সঙ্গে এরা সংশ্লিষ্ট নন। এবং যেহেতু যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং আছেন (মধ্যবিত্ত সমাজের ‘ইস্পাতকঠিন যে অংশ ব্যক্তিগত ভাবাদর্শে কিংবা নিষ্ঠুর পারপার্শ্বিকতার আঘাতে বিপ্লব প্রবাহের সহিত আপনাকে মিশাইয়া দিয়াছে বা দিতেছে’) তাঁরা এখন পর্যন্ত বিপ্লবী সাহিত্য রচনা করতে পারেননি, সেহেতু প্রথমোক্ত ভদ্রলোকদের কানামামা হিসেবে নেওয়াই কর্তব্য। নেই মামার চেয়ে কানামামা শ্রেয়। ভবিষ্যতে ইতিহাস অন্তত কানা মামা হওয়ার জন্য এঁদের মূল দেবে, এবং যদি তাঁরা জীবন ও সাহিত্যে শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে অক্ষম হন, তাহলে বিদায় দেবে। কিন্তু সে সময় ‘নির্বোধ’, ‘প্রবঞ্চক’ ইত্যাদি ছাড়া অন্যান্য বিশেষণ বোধহয় সাম্যবাদী সমালোচনা-সাহিত্যের অভিধানে পাওয়া যাবে। বর্তমানে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং নিস্ফল আক্রোশ মার্ক্সিস্ট সমালোচনার নামে যদি চলে তাহলে বিস্মিত হওয়াটা মানসিক বিলাস, কারণ বাংলাদেশের আজ যে অবস্থা তাতে অগ্রগামী ব্লক রাতারাতি গুন্ডাব্লকে পরিণত হলেও বাহবা পায়। যে গালি-গালাজ, যে উগ্র বামপন্থা আজ সাম্যবাদের নামে সমালোচনা-সাহিত্যে আস্ফালনরত সেটা পূর্বতন বাঙালি সন্ত্রাসবাদের দায়ভাগ।
৪
প্রত্যুত্তর
সরোজকুমার দত্ত
১৯৩৬ সালের এপ্রিল লক্ষ্ণৌ-এ নিখিল ভারত প্রগতি সাহিত্যিক সঙ্ঘের যে প্রথম অধিবেশন হয়, তাহাতে গৃহীত প্রস্তাবগুলির মধ্যে একটিতে বলা হইয়াছে: ‘We consider that collectively and individually we stand in the ranks of those who are striving to build up a new social order…’
উক্ত সঙ্ঘের যে দ্বিতীয় অধিবেশন ১৯৩৮ সালের শেষভাগে কলিকাতায় অনুষ্ঠিত হয়, তাহাতেই এই অংশের কোনো পরিবর্তন করা হয় না, উপরুন্ত মোটামুটিভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিজম-বিরোধী পূর্বতন চারিটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সংগ্রামাত্মক প্র্রস্তাবই গৃহীত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণার্থ ভারত গভর্নমেন্ট কতকগুলি স্বেচ্ছাচারী দমন আইন প্রণয়ন করিয়া ও অন্যান্য নানাভাবে প্রগতি চিন্তাধারার কণ্ঠরোধ করিতে যে অভিযান চালান, তৎসম্পর্কে প্রথম প্রস্তাবটির শেষাংশে বলা হয়, “The conference considers these restrictions to be a serious attack on the free cultural development of the country and calls upon all Indian writers to organise countrywide protests against the Govt. policy and to support all other efforts to secure the repeal of these laws.’ চতুর্থ প্রস্তাবে বলা হয়, ‘This conference considers that it is necessary for free cultural development of the students that they should have freedom to express themselves on all social and political subjects.’ এই প্রস্তাবটিতেও পরোক্ষভাবে সংগ্রামের সংকল্পই প্রকাশ পাইয়াছে। সাম্রাজ্যবাদের গ্রাস হইতে সংস্কৃতিকে বাঁচাইবার যে সংকল্প এই অধিবেশনে গৃহীত হয় তাহাও সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রামের রূপেই আমার নিকট প্রতিভাত হইয়াছিল। কারণ, যে দেশে ‘হিউজ অ্যান্ড ভাইটাল সেকশন অফ আওয়ার পপুলেশস ইলিটারেট’, অর্থাৎ, সংস্কৃতি-বর্জিত, যে দেশে সংস্কৃতিকে রক্ষা করিবার অর্থ এই হিউজ অ্যান্ড ভাইটাল সেকশন-এর অশিক্ষা অসংস্কৃতি নগ্নরূপ, ইহার কারণ ও প্রতিকারের নির্দেশ, ‘অ্যাসথেটিক মিডিয়াম’ এর সাহায্যে সংগ্রামমূলক মনোভাব লইয়া প্রস্ফুটিত করিয়া তোলা, রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী বা মেঘনাদ সাহার গবেষণাবলী এই ‘হিউজ’ ও ‘ভাইটাল সেকশন’-এর আয়ত্তাধীনে আসিবার পথে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা সৃষ্টি করিয়াছে, তাহার স্বরূপ উদঘাটিত করিয়া সাহিত্যসম্ভোগক্ষম পাঠক-সাধারণে রাজনৈতিক চেতনায় ও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা।
এই স্বীকৃতি, এই ইস্তেহার ও এই প্রস্তাবাংশসমূহ হইতে আমার ধারণা হইয়াছিল, প্রগতি সাহিত্য সঙ্ঘ একটি বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান, কারণ তাহার গৃহীত কার্যসূচী বৈপ্লবিক ও রাজনৈথিক সংগ্রামের ভিত্তিতে রচিত। এই কার্যসূচী উক্ত সঙ্ঘের বঙ্গীয় শাখার একজন বিশিষ্ট ও উদ্যোগী সভ্য হিসাবেই শ্রীযুক্ত সেনকে জানি। তাই ভাবিয়াছিলাম কোনো বিপ্লবী সঙ্ঘের সহিত পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যিনি সংযুক্ত তিনি নিজেকে বিপ্লবী না বলিলেও বলেন বৈ কি? তাঁহাকে বিপ্লবীমনা ভাবিবার আরও কারণ আছে। প্রবন্ধকাররূপে যখন শ্রীযুত সেনের সাক্ষাৎ পাই, তখন দেখিতে পাই ভাবাদর্শে ও দৃষ্টিভঙ্গীতে সম্পূর্ণ সাম্যবাদী ঢং আনিবার চেষ্টা তিনি করিয়াছেন। কবিতা ত্রৈমাসিকের ১৩৪৫ সালের বৈশাখ সংখ্যায় ‘বাংলা কবিতা’ শীর্ষক যে প্রবন্ধ তিনি লিখিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে লেখকের সাম্যবাদীমন্যতা সম্পর্কে পাঠকের বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না।
‘পারিপার্শ্বিকের প্রভাব বিশিষ্টভাবে উপলদ্ধি করা মেনে নেওয়া স্বাধীনতার সূত্রপাত’ (ফ্রিডম ইজ দ্য রিকগনিশন অফ নেসেসিটি)।
‘কাব্যের ইতিহাসে অন্তরায় আসে, তার কারণ কবিতা বিশুদ্ধ নয়, পরিবর্তনশীল শ্রেণীগতির স্থান কাল পাত্রের মুখাপেক্ষী’…
‘ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী না থাকলে কাব্যের মূলসূত্র খুঁজে পাওয়া অসম্ভব…’।
‘দাসদেশে বুর্জোয়া (?) সভ্যতার অগ্রগতি অল্পদিন পরেই দমিত হয়, কারণ বর্ধিষ্ণু দাস দেশ বুর্জোয়া প্রভুর স্বার্থবিরোধী’।
‘রিয়ালিটির থেকে নিষ্কৃতির চেষ্টা পরাজয়ের দুর্বল ভঙ্গী, প্রকৃতির স্বপ্নলোক ক্লীবের অলীক স্বর্গ।’
এইসকল বিপ্লবী মূলসূত্রের (রেভিউলোশনারী প্রিন্সিপালস অফ ক্রিটিসিজম) ভিত্তিতে যিনি সমালোচনা-সাহিত্যে (ক্রিটিক্যাল লিটারেচার) রচনা করেন এবং বলেন, ‘জ্ঞাতসারে কোনো কবিতা বা অন্য লেখায় আমি নিজেকে বিপ্লবী বলে প্রচার করিনি’ তাঁহাকে বলিবার আমার কিছুই নাই। ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্স’ প্রবন্ধটির বেলায়ও ঐ কথাই প্রযোজ্য।
তাঁহাকে বিপ্লবীমন্য ভাবিবার তৃতীয় কারণ, কবিতা ত্রৈমাসিক পত্রিকায় একাধিকবার তাঁহাকে বিপ্লবী বা সাম্যবাদী বলা হইয়াছে, ‘বিপ্লবী অঙ্গীকার সমর সেন ও বিষ্ণু দের মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট।’ – কবিতা, আষাঢ় ১৩৪৬, পৃ ৯০।
শ্রীযুত সেন ‘কবিতা’ ত্রৈমাসিকের অন্যতম সম্পাদক, প্রত্যেক প্রকাশিত প্রবন্ধ সম্পর্কে তাঁহার সম্পাদকীয় দায়িত্ব রহিয়াছে।
এই সকল কারণে আমার ধারণা হইয়াছিল শ্রীযুত সেন নিজেকে বিপ্লবী বলিয়া মনে করেন। কিন্তু শ্রীযুত সেন বলিতেছেন, বিপ্লবী তো তিনি ননই, উপরুন্তু কর্মভীরু, পলাতক, আধাবাস্তব, আধারোমাণ্টিকভাবেই তিনি তার নায়ককে বর্ণনা ও বিদ্রূপ করিয়া আসিয়াছেন। এই সম্পর্কে আমার বক্তব্য, তাঁহার এই উক্তি যদি সত্য হয় (অর্থাৎ মাহাত্মা ব্যক্তির বৈষ্ণব বিনয় না হয়) তবে এই উক্তিটি তাঁহার বহু পূর্বেই করা উচিত ছিল, বিলম্বে সত্যভাষণ সত্যগোপনের নামান্তর মাত্র।
আমার দ্বিতীয় বক্তব্য, ‘আধাবাস্তব ও আধারোমাণ্টিক’ কথাটি ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার সাম্প্রতিক আধা-সমাজতন্ত্র আধা-সাম্রাজ্যবাদের মতোই অর্থহীন ও কৌতুকাবহ। ‘আধা-বাস্তব আধা-রোমাণ্টিক’ না লিখিয়া শুধু রোমাণ্টিক লিখিলে শ্রীযুত সেন মানসিক সততার পরিচয় দিতেন। তৃতীয় বক্তব্য, এই স্বীকৃতি উপযুক্ত সময় করিলে আমার পরিশ্রমের অনেকটা লাঘব হইত।
ছোবল হয়তো শূন্যেই মারিয়াছি, কিন্তু বিষ বোধকরি যথাস্থানেই পৌঁছিয়াছে, নচেৎ অবিলম্বে এই তাগা বাঁধিবার প্রয়োজন হইত না। আত্মপরিক্রমাপথে ‘মুমূর্ষশ্রেণীর প্রতীকে’র যদি এই জ্ঞানলাভ হইয়া থাকে, The waking have a common world but the sleeping turn aside each into his own, অর্থাৎ তিনি যদি নিদ্রিত ব্যক্তির স্বপ্নজগতের অবাস্তবতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হইয়া থাকেন তাহা হইলে বুঝিতে হইবে, মুমূর্ষশ্রেণীর হইলেও তাঁহার স্বীয় শ্রেণীর ‘প্রতীকত্ব’ ঘুচিয়া গিয়াছে, তিনি ডিক্লাসড বা শ্রেণীবিচ্যুত হইয়াছেন, এবং তখনও যদি তাঁহার আত্মপরিক্রমা অবিশ্রাম চলিতে থাকে, তখন তাঁহাকে সুকৌশলী জ্ঞানপাপী ভিন্ন আর কি আখ্যা দেওয়া চলিতে পারে? ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্স’ প্রবন্ধ সম্পর্কে আমার অভিমতকে খন্ডানোদ্দেশ্যে শ্রীযুত সেন বলিয়াছেন, ‘আপন সাহিত্য রচনার বৈপ্লিবকতা… ব্যাখ্যা’ করার উদ্দেশ্য তাতে ছিল না। প্রবন্ধটির নাম ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্স’ এবং তাঁহারই স্বীকৃতি অনুসারে তিনি নিজে একজন ডেকাডেন্ট (অবশ্য সচেতন) এবং বর্তমান সমাজে এই সম্প্রদায়ের সামাজিক প্রয়োজনীয়তাই যে এই প্রবন্ধে ব্যাখ্যাত হইয়াছে, প্রবন্ধকার যদি তাহা অস্বীকার করেন, তবে তিনি সত্যকে অস্বীকার করিবেন। এই সমাজ-বিপ্লবের যুগে (In these times of… wars… and revolutions – In Defence of ‘Decadents)’ সামাজিক প্রয়োজনীয়তা বলিতে সমাজবিপ্লবের পরিপোষকতা – অর্থাৎ বৈপ্লবিকতা বুঝিয়াছি, বোধ হয় ভুল বুঝি নাই। ‘There is no middle position between Revolution and Reaction’ – T.Cornfold.
শ্রীযুত সেনের তৃতীয় অভিযোগ, আমি তাঁহার মূল প্রবন্ধটির কয়েকটি অংশের অর্থ বিকৃতি করিয়াছি। কি কারণে আমি প্রবন্ধটি হইতে আক্ষরিক উদ্ধৃতি করিতে পারি নাই, আমার সমালোচনায় তাহা পরিষ্কাররূপেই লিখিয়াছি। শ্রীযুত সেন লিখিতেছেন, ‘In these times of dereliction and dismay, of wars, unemployment and revolutions. The boredom and the horror, rather than glory of life, is our immediate reality. Perhaps that is because we have our roots deep in the demoralised petty-bourgeoisie and the lack the vitality of a rising class. It is best to admit this and write about the class you know well than to exult in the future glories of a classless society.’ (কে তাঁহাকে exult করিতে বলিয়াছে জানি না, তবে এই প্রফেসরীয় একাডেমিক ও নিতান্ত শিশুসুলভ আশাবাদ তাঁহারই কবিতা পড়িতে গিয়া পাতায় পাতায় চোখে পড়িয়াছে, যথা, ‘তবু জানি… আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে…’) কারণ consciousness of decay is also a power অবশ্য এ consciousness honest (আন্তরিক) হওয়া চাই (If he tries to honest ইত্যাদি, ২য় প্যারা ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্স’), অর্থাৎ নৈতিক শক্তিহীন পেটিবুর্জোয়া সমাজের প্রাণশক্তিহীন লেখকের রচনায় যদি নিষ্ক্রিয় সচেতনতার (লেখকের শ্রেণীরূপ নিষ্ক্রিয় হইতে বাধ্য) আভাস পাওয়া যায় (এই নিষ্ক্রিয় প্রাণশক্তিহীন ও কনশাসনেস-সর্বস্ব সাহিত্যকে আমি ডেকাডেন্ট সাহিত্য বলিয়াছি) তবে তাহা আন্তরিক, কারণ তাহা ‘Eternal principles of art, truth and beauty’-তে বিশ্বাস করিয়া মানসিক অসাধুতার পরিচয় দেয় না। এই সচেতনতাই একটি শক্তি।
শ্রীযুত সেনের এই বক্তব্যকেই আমি আমার ভাষায় লিখিয়াছিলাম, ‘ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রী সমাজ আজ ডেকাডেন্ট, অতএব এ সমাজে সত্য, শিব ও সুন্দরের সাধনা অসম্ভব এবং ডেকাডেন্ট সাহিত্যই একমাত্র আন্তরিক সাহিত্য। এই আন্তরিকতার জন্য ডেকাডেন্ট হইয়াও তাঁহাদের সাহিত্যে বৈপ্লবিক শক্তিমত্তা বর্তমান।’ সমাজবিপ্লবের যুগে সামাজিক ক্ষয়িষ্ণুতা সম্পর্কে চেতনা যদি শক্ত হয়, তবে সমাজে বা সমাজসাপেক্ষ সাহিত্যে তাহা বৈপ্লবিক শক্তি ভিন্ন আর কি হইতে পারে? ইহা কি অর্থবিকৃতি? ‘কনশাসনেস অফ ডেকাডেন্স ইজ সার্টেনলি অ্যা পাওয়ার’ (‘ইন ডিফেন্স অফ ডেকাডেন্স’) আমি ইহার অর্থ করিয়াছি, ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার যে কোনরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি। শ্রীযুত সেনের আপত্তি ‘বৈপ্লবিক’ বিশেষণটির ব্যবহারে। এ আপত্তির অযৌক্তিকতার আমি পূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করিয়াছি, পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। কনশাসনেস ও সাবজেক্টিভ ইনিশিয়েটিভ-এর অর্থ এক নহে। নিছক নিষ্ক্রিয় চেতনার উদ্দেশ্যহীন অভিব্যক্তি ও সক্রিয় চেতনার উৎকণ্ঠা, উদ্যম ও কর্মরূপের মধ্যে পরিবর্তন আছে বৈ কি? কর্মভীরু জ্ঞান ও সজ্ঞান কর্ম এক বস্তু নহে।
শ্রীযুত সেন যখন স্বীকার করিয়াছেন তিনি বিপ্লবী কবি নন তখন তাঁহার পরবর্তী অনুযোগ সম্পর্কে উত্তর করিয়া পূর্বতন বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করিতে চাহি না। তিনি বলিতেছেন, ‘গত দশবছরের বাংলা কবিতার যথেষ্ঠ উন্নতি হয়েছে।’ এই দশ বৎসরের মধ্যে বাংলা দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা অবিশ্বাস্যরূপে বৃদ্ধি পাইয়াছে, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অতি দ্রুত বৈপ্লবিক পরিবর্তন আরম্ভ হইয়াছে, সারা প্রদেশময় শ্রমিক ও কিষাণ অশান্তি দিনে দিনে সঙ্ঘবদ্ধ বিপ্লব-প্রচেষ্টার রূপ পরিগ্রহ করিতেছে, নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজে বেকারের সংখ্যা মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং সেখানে অতিদ্রুত শ্রেণীবিচ্যুতি চলিয়াছে, গর্ভমেন্টের দমনমূর্তি রুক্ষ হইতে রুক্ষতর হইয়া উঠিয়াছে, চাষী ও দিনমজুরের দৈনন্দিন খন্ড সংগ্রামের মধ্য দিয়া সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ব্যাপক সংগ্রাম সংহত হইয়া উঠিয়াছে, মধ্যবিত্তশ্রেণীর নিম্নাংশ কিষাণ মজুরশ্রেণীর সহিত স্বার্থসাম্যে ঘনিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে এবং রাজনীতি সাধারণের জীবনের সহিত অবিচ্ছেদ্যরূপে গ্রথিত হইয়া গিয়াছে। অথচ এই দশ বছরের বাংলা কবিতায় স্থানীয় রাজনীতির ছায়ামাত্র পড়ে নাই, ‘sickening sentimentalism’ বলিয়া ভাবাবেগকে পরিহার করা হইয়াছে এবং সৌখীন সাম্যবাদের বাকবিভূতি দিয়া নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কবিলাসের প্রবর্তন করা হইয়াছে। শিক্ষিত ও সাধারণের নিকটা কবিতাকে ক্রমশ দুর্বোধ্য করিয়া তোলা হইয়াছে, লেখক ও পাঠকের মধ্যেকার স্বাভাবিক ব্যবধানকে অস্বাভাবিক উপায়ে বহুবিস্তৃত করিয়া তোলা হইয়াছে। অসহযোগ আন্দোলনের কবি সত্যেন্দ্র দত্ত ও নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের কবি কাজী নজরুলকে বিদ্রূপ করা হইয়াছে। টেকনিকের বহু পরিবর্তন করা হইয়াছে, অর্থাৎ একই কথা বহুবার বহুভাবে বলা হইয়াছে। হত দশ বছরে যখন মানুষের জীবনে রাজনীতি অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে, সেই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের কাব্য হইতে নজরুল-সত্যেন দত্তীয় সামান্য রাজনৈতিক ঐতিহ্যটুকু পর্যন্ত মুছিয়া ফেলা হইয়াছে, অবশেষে ১৯৪০ সালের মে মাসে সাম্প্রতিক কালের বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট প্রগতিক কবি স্বীকার করিলেন, আধুনিক বাংলা কবিতা যাঁরা লেখেন তাঁরা অনেকেই রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেননি, সেটা তাঁহাদেরই দুর্ভাগ্য। ‘কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই শক্তিমান লেখক, তাঁরাই এতদিন রাজত্ব করে এসেছেন এবং মধ্যবিত্ত সমাজের উপর কিছু কিছু প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছেন।’ এই প্রভাব বিস্তারের একটু নমুনা দিতেছি; ‘The damning is thus complete. He then thinks of perhaps a dozen or so his admirers and continues to use a medium of expression whose beauties commend themselves only to the dozen or so…’ (ইন ডিফেন্স অফ দ্য ‘ডেকাডেন্স’) প্রভাব বিস্তারের নমুনাই বটে। ভয় হয়, পাছে এই সাংঘাতিক উন্নতি আমাদের কপালে না টেঁকে। বর্তমানে তাঁহাদের সামাজিক চেতনা যথেষ্ঠ উদগ্র হইয়াছে, সামাজিক ক্ষয়িষ্ণুতা সম্পর্কে অনুভূতি সুতীব্রতম হইয়াছে, সাম্যবাদী সমাজের অবশ্যম্ভব্যতা সম্পর্কে তাঁহারা নিঃসন্দেহ হইয়াছেন, কংগ্রেস কর্তৃক মন্ত্রীত্বগ্রহণ মন্ত্রীত্ববর্জনে তাঁহাদের কাব্যের তুলাদন্ড উঠানামা করিতেছে (It would have been easier with Congress out of office, an active body in the anti-imperialist front. – Ibid.) তথাপি এখনও রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রতিফলিত করিবার সময় তাঁহাদের আসে নাই, তবে ভয় নাই বোধ হয় শীঘ্রই আসিবে, কারণ উপসংহারে শ্রীযুত সেন আমাদের বড় আশার বাণী শুনাইয়াছেন: ‘But a critical situation arises when we find that at a certain stage this also is not enough even from the point of view of poetic integrity. We will reach that stage very soon, and we must make a choice if we are to continue as living writers. This involves an entire reconstruction of our ways of living. An active part in the mass-movement will certainly help that poet who has been able to preserve his integrity. He will be able best to combine literary tradition with social content and will act as a releasing force. He will then perhaps cease to soliloquise and will begin to be representative. Such a reconstruction of living is not an easy job for the present generation of Bengali poets, most of them settled in life and approaching the critical age of thirty.’ অর্থাৎ এখনও তাঁহারা আলগোছে গণস্পর্শ বাঁচাইয়া, ‘dozen or so’ হাত ধরাধরি করিয়া কিছুকাল আত্মপরিক্রমায় অতিবাহিত করিবেন, তারপর গণ-আন্দোলন আরম্ভ হইলে (অর্থাৎ এখনও হয় নাই, অতএব তাঁহাদের আপাতত কোন কর্তব্য নাই) তাঁহারা রাতারাতি স্বগতোক্তি পরিত্যাগ করিয়া গণ-কবি হইয়া বসিবেন। রাতারাতি তখন তাঁহারা জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বদলাইয়া ফেলিবেন, কিন্তু মুস্কিল হইবে সেইসব কবিদের লইয়া যাহাদের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, এবং জীবনযাত্রা একরূপ পাকা হইয়া গিয়াছে। সাংঘাতিক ‘প্রবলেম’, ভাবিয়া কূলকিনারা পাইতেছি না। দশ বছরের প্রগতির কি এই পরিণাম? কিন্তু শ্রীযুত সেন বলিতেছেন, ‘To sacrifice all these in order to widen the appeal and rouse the people by direct propaganda will be a dangerous sacrifice.’
আমি গ্রহণ পুস্তিকার সমালোচনায় বলিয়াছি, এখনও বলিতেছি সরাসরি প্রোপাগান্ডা দ্বারা গণ-জাগরণ আনয়নের জন্য কেহ তাঁহাকে বলে না, বলিবেও না; কিন্তু নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের শ্রেণীবিচ্যুত দুর্গতগণের দুর্গতির বাস্তব ইতিহাস রচনা কিংবা শ্রমিক-কৃষকশ্রেণীর বাহিরে শ্রীযুত সেনের নিজের শ্রেণীর যে অংশ নানা কারণে প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে অক্ষম, তাহাদের জন্য aesthetic medium-এর সাহায্যে ‘Literature of exposure’ (Lenin) রচনা, তাহাদিগকে গণ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন করিয়া তোলা, এক কথায় যে সাহিত্যিক-ঐতিহ্যের তাঁহারা উত্তরাধিকারী তাহার নিঃস্বার্থ সামাজিক সদ্ব্যবহার –তাঁহাদের আয়ত্তাধীন এইটুকুই যদি তাঁহারা করিতেন তবে নিঃসঙ্কোচে তাঁহাদিগকে আমরা প্রগতিক ও বিপ্লবী বলিতাম। (আশা করি ইহা অগ্রগামী ব্লক বা তাহার অনুচরী দলের উগ্র বামপন্থী ভাবাদর্শ নহে।) কিন্তু শ্রীযুত সেন বলিতেছেন: ‘With huge and vital section of population illiterate and dim in the background… We can at present only soliloquise, we cannot address the real audience.’ কিন্তু এই ‘রিয়েল অডিয়েন্স’ (গণ-সাধারণ কিংবা ডজন অর সো নহে) অ্যাড্রেস করার ক্ষমতা, ঐতিহ্য ও সাহিত্যিক উত্তরাধিকার তাঁহাদের আছে, অভাব সাবজেক্টিভ ইনিশিয়েটিভ-এর। এই অভাবকেই কি বলে ‘টু প্রিসার্ভ ওয়ান’স পারসোনাল ইন্ট্রিগ্রিটি?’ ইহাই কি ‘ইন দ্য লং রান’ ‘প্রগেসিভ কজ’-কে হেল্প করিবে? করে তো ভালোই। শ্রীযুত সেনের সম্প্রদায় গণ-আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। এবং যেহেতু যাঁরা সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং আছেন তাঁরাও এখনও পর্যন্ত বিপ্লবী সাহিত্য রচনা করিতে পারেননি, সেহেতু প্রথমোক্ত ভদ্রলোকদের কানামামা হিসাবে নেওয়াই ভালো। ‘নেই মামার চেয়ে কানামাম শ্রেয়’ (আমার সমালোচনার উত্তরে শ্রীযুত সেনের উক্তি)। আমার বক্তব্য কানামামা যখন জানেন তিনি কানা (অর্থাৎ, এ সম্পর্কে তাঁহার কনশাসনেস আছে) এবং ছানি কাটানো যখন তাঁহার আয়ত্তাধীন তখন অন্ধ অবস্থায় নিষ্ক্রিয় বিলাপ-বিলাসে দিন যাপন করা বিপ্লবে বিশ্বাসী কানামামার পরোক্ষে বিপ্লব-বিরোধিতা। অতএব, ছানি না কাটিলে ভবিষ্যৎ ইতিহাস ইহাকে মূল্য দেওয়া দূরের কতা, সমাজ-বিপ্লবের যুগে ডিমর্যালাইজড পেটিবুর্জোয়া-এর এই স্বার্থপর সংক্ষোভের প্রতি হয়ত কোনো মনোযোগই দিবে না। না হয় বড় জোর উহার কাপুরুষ পলায়ন প্রবৃত্তিকে ঘৃণার সহিত অঙ্কিত করিবে। এবং সে সময় ‘নির্বোধ’, ‘প্রবঞ্চক’ ইত্যাদি ছাড়া অন্যান্য বিশেষণ সাম্যবাদী সাহিত্যের অভিধানে পাওয়া যাইবে সত্য (এখনো যায়) কিন্তু ঐ দুইটি বিশেষণও থাকিবে। যদি সাম্যবাদী-অসহিষ্ণু অথচ অনেষ্ট কোনো বুদ্ধিজীবীর রচনার সমালোচনা আমাকে করিতে হইত, তবে আমাকে আরও অবজেক্টিভ আরও ব্যাপক ও আরও নৈর্ব্যক্তিক হইতে হইত, কিন্তু, সাম্যবাদে বিশ্বাসী ও সাম্যবাদী আন্দোলনের সহানুভূতিশীল শ্রীযুত সেনের কাব্যের আলোচনায়, আমি কতকগুলি কাব্যের বিশেষণ ইচ্ছা করিয়াই ব্যবহার করিয়াছি, এই প্রসঙ্গে মার্ক্সিস্ট সমালোচনার নামে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও নিস্ফল আক্রোশের অভিযোগ আনিয়া শ্রীযুত সেন ব্যবহারিক সুরুচি ও মানসিক শুচিতার পরিচয় দেন নাই।
গত দশ বছরের বাংলা কবিতায় প্রগতি (?) আলোচনা আমি পূর্বে করিয়াছি এবং তৎসম্পর্কে ‘To be able to preserve one’s personal integrity’-র (Ibid) তাৎপর্যও দেখাইয়াছি। এই personal integrity সংরক্ষণ সম্পর্কে শ্রীযুত সেন আধুনিক ইংরেজী কাব্য হইতে ইলিয়টকে নজীর টানিয়াছেন ও ইলিয়টী কাব্যের দুর্বোধ্যতা ও সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণুতা সম্পর্কে সুতীব্র চেতনার বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার মধ্যে গত দশ বছরের বাংলা কাব্যধারার সহিত ইলিয়টের কাব্যধারার সমান্তরালতা প্রদর্শনের ইঙ্গিত পাঠকমাত্রের নিকট স্পষ্ট হইয়া উঠে। অবশ্য যাঁহারা ভারতীয় বা বঙ্গদেশীয় অবস্থা সম্পর্কে ‘বুর্জোয়া যুগ’ ‘বুর্জোয়া সভ্যতা’ ‘বুর্জোয়া সমাজ’ ‘বুর্জোয়া কবি’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেন না, তাঁহাদের নিকট হইতে ইহার বেশি আশা করাও অন্যায়; ঐতিহাসিক বস্তুবাদ যে বহু কমরেডকে ইতিহাস পাঠের পরিশ্রমের হাত হইতে নিষ্কৃতি দিয়াছে, একথা একদা ফ্রেডরিশ এঙ্গেলস বহু দুঃখেই বলিয়াছিলেন। আমার বক্তব্য ছিল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ইংল্যান্ডে বসিয়া সভ্যতার ক্ষয়িষ্ণুতা সম্বন্ধে যে মনোভাব বা অ্যাটিটুড লইয়া ইলিয়ট কাব্য রচনা করিয়াছেন তাহার সুরিয়ালিজম ও অ্যার্নাকিস্ট রূপ ব্রিটেনের সমাজবিপ্লবের বিন্দুমাত্র সহায়ক নয়, বরঞ্চ তাহার ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শে পরিণতিই স্বাভাবিক বেশী। পরবর্তী সাম্যবাদী লেখক তাঁহার কাব্যের কতটুকু বৈপ্লবিক সদ্ব্যবহার করিতে সক্ষম হইবেন সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, স্পেংলার ও হাক্সলির লেখা পড়িয়াও অনেক বিপ্লবীর উপকার হইতে পারে, তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। কিন্তু উদ্দেশ্যহীনভাবে যে ডেকাডেন্স নিঙড়ায়, তাহার কপালে (অন্যের নয়) যে তাহা হইতে এক ফোঁটা বিপ্লবও জোটে না, বরঞ্চ ভয়াবহ ফ্যাসিস্ত ভাবাদর্শে পরিণত হয়, যে বঙ্গীয় কবিগোষ্ঠী ইলিয়টী ঢং-এ কাব্য রচনা করিয়া ভবিষ্যৎ বিপ্লবী কাব্যের ভিৎ রচনা করিতে চাহিতেছেন, একথা তাঁহাদের মনে রাখা উচিত; তাঁহারা যেন নিজের ভবিষ্যৎ আগে ভাবিতে বসেন। ইংল্যান্ডের সামাজিক পরিমন্ডলীতে ইলিয়টের হয়ত কোনো সামাজিক উপযোগিতা আছে, বাংলাদেশে ইলিয়ট সম্পূর্ণ সমাজসম্পর্কহীন, তাঁহার অবস্থা কলিকাতার ছাদের টবে বিলাতী মৌসুমী ফুলের মতো। কাব্যে ঐতিহ্যবাদী ইলিয়টের সহিত বঙ্গীয় কাব্যের কোনো ঐতিহ্যগত সম্পর্ক নাই। তথাপি যদি কাব্য বিপ্লবের হাবিলদার সাজিবার জন্য বাংলাদেশের কাব্যবেদীতে ইলিয়টের প্রতিষ্ঠা করেন, তবে তাঁহাদের প্রবঞ্চকই বলিব। এই নজীর প্রদর্শনের মধ্যে মমত্ববোধ ও একত্ববোধ যে পুরামাত্রায় রহিয়াছে তাহা যে-কোনো পাঠকের চোখে পড়িবে। কর্নফোর্ড, কডওয়েল ও হেন্ডারসনের লেখায় কোথায় ইলিয়টকে বিপ্লবী-কাব্যের পুরোধা বলা হইয়াছে, জানাইলে সুখী হইব। কডওয়েলের ইল্যুশন অ্যান্ড রিয়ালিটি যদি সাম্যবাদী সমালোচনার স্ট্যান্ডার্ড হয়, তবে অডেন, স্পেন্ডার ও ডে-লুইসকে সাম্যবাদী লেখক বলা চলে না, অতএব উহাদের রচনা বিতর্কের মধ্যে না আনাই ভালো। ইংল্যান্ডের সাম্প্রতিক কাব্যের সমালোচনায় কর্নফোর্ডের কথাটা আবার স্মরণ করি: ‘There is no middle position between Revolution and Reaction.’ এই মূলসূত্রই ‘ইউনাইটেড ফ্রণ্ট’ আন্দোলনের ভিত্তি।
উপসংহারে শ্রীযুত সেন বলিয়াছেন, ‘বাংলাদেশের আজ যে অবস্থা তাতে অগ্রগামী ব্লক রাতারাতি গুন্ডাব্লকে পরিণত হলেও বাহবা পায়। যে গালি-গালাজ, যে উগ্র বামপন্থা আজ সাম্যবাদের নামে সমালোচনা-সাহিত্যে আস্ফালনরত সেটা পূর্বতন বাঙালি সন্ত্রাসবাদের দায়ভাগ।’
কথাটা সাম্যবাদীগণ বলেন, শ্রীযুত সেনও বলেন, আমিও বলি। কিন্তু কথাটির সত্যতা নির্ভর করিতেছে কনটেক্স-এর উপর। কঠোর বিরুদ্ধ সমালোচনাকারীকে কৌশলে সাম্যবাদ-বিরোধী দলভুক্ত বলিয়া প্রচার করিয়া শ্রীযুত সেন কি ভারতবর্ষের অফিসিয়াল সাম্যবাদের সমর্থন এ সহানুভূতি লাভ করিতে চাহেন? কারণ এই অতিসত্য উক্তিটি এত অবান্তর, এত অসঙ্গত ও এত অপ্রত্যাশিত যে ইহাকে অপকৌশলী ডিমাগগী ছাড়া আর কোনো আখ্যা দান সম্ভব নহে।
৫.
[সমর সেন এর আত্মজীবনী ‘উড়ো খৈ’ থেকে…] i
সরোজবাবুর সঙ্গে শেষ দেখা কবে হয়েছিল? খুব সম্ভব তিরিশের দশকের শেষে, দিল্লি যাবার আগে? একটি বন্ধু সবিস্ময়ে মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৬৬-র জানুয়ারিতে একটি বৌভাতের নিমন্ত্রণে সরোজ দত্তের সঙ্গে আমার গল্পগুজব হয়, খেতে বসেছিলাম পাশাপাশি। মনে না থাকাটা অহমিকার দরুন নয়, ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি প্রায়ই অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অনেকদিন অদেখা প্রিয় বান্ধবীদের মুখ পর্যন্ত অস্পষ্ট ধূসর হয়ে আসছে।
একটি বাংলা পত্রিকায় [নতুন পরিবেশ, শারদীয় ১৩৮৪] সেদিন সরোজ দত্তের কলমের তীব্র ধার আবার অনুভব করলাম। অতি আধুনিক বাংলা কবিতা বিষয়ে একটি প্রবন্ধের সমালোচনা, ১৯৪০-এ লেখা। সরোজবাবুর সংক্ষিপ্তসার ও তাঁর ভাষা অনুযায়ী আলোচ্য প্রবন্ধের বক্তব্য হ’ল: “(১) ধনতন্ত্রী সমাজে যে প্রগতি স্তব্ধ হইয়াচে বিপ্লবোত্তর সাম্যবাদী সমাজে সেই প্রগতি অব্যাহত চলিবে, অতএব প্রবন্ধকার আশাবাদী ও প্রগতিতে বিশ্বাসী; (২) ধ্বংসোন্মুখ ধনতন্ত্রী সমাজ ‘ডেকাডেন্ট’ অতএব এ সমাজে সত্য, শিব ও সুন্দরের সাধনা অসম্ভব এবং ‘ডেকাডেন্টস’ সাহিত্যই একমাত্র আন্তরিক সাহিত্য। এই আন্তরিকতার জন্য ডেকাডেন্টস হইয়াও তাঁহাদের সাহিত্যে বৈপ্লিবক শক্তিমত্তা বর্তমান। নজীর ইংরেজ কবি টি.এস.এলিয়ট–এর কাব্য; (৩) ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অবস্থার অন্তঃসারশূন্যতার যে-কোনোরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি; (৪) কিষাণ-মজদুর লালঝান্ডা-ব্যারিকেড সংঘর্ষ লইয়া নাকি তাঁহাদের উত্তেজক সাহিত্য রচনার নির্দেশ বা ফরমাইস দেওয়া হইতেছে এবং ঐ সকল বস্তুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁহাদের না থাকায় রোমাণ্টিক হইবার ভয়ে ঐ নির্দেশ বা ফরমাইস তাঁহারা পালন করতে পারিতেছেন না।”
সংক্ষিপ্তসার দেবার পর সরোজ দত্ত জোরালো ভাষায় বলেন যে:
“ধনতন্ত্রী সভ্যতার বর্তমান অন্তঃসারশূন্যতার যে কোনোরূপ অভিব্যক্তিই বৈপ্লবিক শক্তি নহে, লিভিং, প্যাশনেট ও সেন্সেটিভ মনে এই অন্তঃসারশূন্যতার প্রতিক্রিয়াই প্রতিফলিত হয় বিপ্লবী সাহিত্যে, আন্তরিকতার খড়্গাঘাতে নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কবিলাস সেখানে মহূর্তে ভূলুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। তাই একদা যখন রোমাঁ রোলাঁ গান্ধী-রামকৃষ্ণে বিশ্বাসী ছিলেন তখনও তাঁহার সাহিত্য বিপ্লবী সাহিত্য ছিল, প্রাক-বলশেভিক গোর্কীর সাহিত্যের বৈপ্লবিকতাকে বলশেভিকরা অস্বীকার করিতে পারেন নাই, অহিংস টলস্টয়ের সাহিত্য সর্ম্পকে লেনিনের প্রশাংসোচ্ছ্বাস তো বহুবিদিত। …মন যেখানে জাগ্রত ও জীবন্ত, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও প্রবাহমান পারিপার্শ্বিকতার আঘাতে সাহিত্যের উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শ সেখানে আন্তরিকতায় উদ্বেল এবং ক্রমবিবর্তনের পথে সত্য উপলদ্ধির অভিমুখে গতিমান। এই সত্য উপলদ্ধির পথে পরিবর্তনশীল ভাবাদর্শের প্রতিটি মুহূর্ত বৈপ্লবিক বেদনায়, উৎকণ্ঠায়, আর্তক্রন্দনে নিবিড়। ডেকাডেন্স-এর প্রতিটি বন্ধনরজ্জু ছেদনের সঙ্গে সঙ্গে তাই তাহার আর্ট হইতে যন্ত্রণায় আর্তনাদ ধ্বনিত হইয়া উঠে। শেষরজ্জু ছিন্ন হইবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাহার শান্তি নাই। এই অশান্তি, উদ্বেগ ও আর্তনাদ, মহাভুজঙ্গের নির্মোক পরিহারের এই প্রতিটি মুহূর্ত বৈপ্লবিক… ইহা নিষ্ক্রিয় মস্তিকজীবীর বিলাপ-বিলাস নহে।”
সরোজ দত্তের বক্তব্য বলিষ্ঠ। উপসংহারে তিনি কবি-প্রবন্ধকারকে নির্বোধ, প্রবঞ্চক ইত্যাদি বলেছেন।
বহুদিন পরে লেখাটি পড়ে মনে হ’ল সরোজ দত্ত ঠিক লিখেছিলেন। তিরিশের দশকের অনেক লেখক বোধহয় বিপ্লবীর অভিনয় করে বাহবার চেষ্টায় করতেন, তাঁদের আসল চেহারা সরোজ দত্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।
কিন্তু পরের দু-তিনটি পৃষ্টায় আক্রান্ত প্রবন্ধকারের জবাব পড়ে মনে হ’ল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রবন্ধকার বলেছেন যে নিজেকে কখনো ‘বিপ্লবী’ বলেননি। তার কবিতায় যে টাইপের জীবন এবং আত্মপরিক্রমার কথা আছে, সে টাইপ বিপ্লবী নয়, মুমূর্ষ শ্রেণীর প্রতীক। অবক্ষয় এদের আকর্ষণ করে তার কারণ বোধহয় এই যে উদীয়মান কোন শ্রেণীর প্রাণশক্তি এদের নেই, বরং পাতিবুর্জোয়ার গভীরে এদের শিকড় ইত্যাদি। অবক্ষয় বিষয়ে সচেতনতা এক ধরণের শক্তি, কিন্তু এমন একটা সময় আসছে যখন সেই শক্তিটুকু দিয়ে চলবে না, তখন মন স্থির করতে হবে। যে কবি তাঁর ব্যক্তিসত্তা অটুট রাখতে পেরেছেন গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলে তাঁর উপকার নিশ্চয় হবে। আর… “He who is bent on living in a little cell, will be dying with a little patience.” প্রবন্ধকারের জবাবটা বালখিল্যসুলভ নয়, যদিও কোথাও একটা ফাঁকি রয়ে গিয়েছে। সরোজবাবুর প্রত্যুত্তরটা কিন্তু অনেকটা উকিলসুলভ। যেমন, কবিপ্রবন্ধকার যে পত্রিকার সাথে যুক্ত সেই পত্রিকায় তাঁকে এবং অন্যদের মাঝে মাঝে বিপ্লবী বলা হয়েছে: প্রবন্ধকারের কবিতায় বিপ্লবী সুলভ উক্তি আছে অতএব বিপ্লবী শব্দটি আরোপ করা অযৌক্তিক হয়নি ইত্যাদি; সে সময়কার মনোভাব বিষয়ে সরোজ দত্ত যা লিখেছিলেন তা উপভোগ্য – ” এখনও তাঁহারা আলগোছে গণস্পর্শ বাঁচাইয়া, ‘dozen or so’ হাত ধরাধরি করিয়া কিছুকাল আত্মপরিক্রমায় অতিবাহিত করিবেন, তারপর গণ-আন্দোলন আরম্ভ হইলে…তাঁহারা রাতারাতি স্বগতোক্তি পরিত্যাগ করিয়া গণ-কবি হইয়া বসিবেন। ” তবু নির্বোধ প্রবঞ্চক কথাগুলি অস্বস্তিকর ঠেকল, কেননা প্রবন্ধটি আমার লেখা ১৯৩৮ সালে; এম.এ. পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৃত্তি পেয়ে তখন জীবনটা মন্দ কাটছিল না।
তারপরে অনেক কাল অতিবাহিত হয়েছে। সাহিত্য বিষয়ে বির্তক নানা রূপ নিয়েছে, চল্লিশ দশকের শেষাশেষি রবীন্দ্রনাথকে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করার প্রস্তাব উঠেছে, তারপর গান্ধী রবীন্দ্রনাথ আবার কম্যুনিস্টদের অনুরাগ আকর্ষণ করেছেন, নকশালপন্থীরা আবার তাঁদের বর্জন করেছেন। তিরিশ দশকের বেশ কিছু লেখক এখন বিগত। গণ-আন্দোলনে যোগ দিলেও অনেকে লেখক হিসেবে মহান হতে পারেননি; পার্টির ভাবাদর্শ অনেক সময় বাঁদর নাচ নাচিয়েছে। এর জন্য দায়ী অবশ্য গণ-আন্দোলন নয়, ‘লাইন’ বেঠিক হলে আন্দোলনে যোগ দিয়েও ব্যর্থতা আসে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান লেখক পার্টির প্রভাবে কোনো মহারচনা করতে পেরেছিলেন? তাঁর বিচ্ছিন্ন ডায়েরিতে একটা অবিশ্বাসের ভাব তো স্পষ্ট হয়ে উঠে। তিরিশের দশকে ও পরে কবিদের মধ্যে সহজ ও বলিষ্ঠ ভাষায় লেখেন সুভাষ, সুকান্ত, পার্টির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু মাও থেকে মেয়াওতে সুভাষের উত্তরণ যুগান্তকারী কিছু একটা হয়নি এবং সুকান্ত বেঁচে থাকলে মস্কোমুখী সি.পি.আই-এর জালে আটকে পড়ার যথেষ্ঠ ভয় ছিল। সি.পি.এম.-এ অবশ্য সাহিত্যিক ও বিলেতফেরতের সংখ্যা অনেক কম, সাংসারিক বিবিধ ক্ষেত্রে সি.পি.আই.-এর মতো সি.পি.এম তাই গুছিয়ে নিতে বড়ো একটা পারেনি।
তিরিশের দশকের শেষে নবীন কবিদের ভাষা স্বচ্ছ হওয়াতে আশার কারণ ছিল। তার আগে কবিদের অনেকেই ইংরেজির ছাত্র ও পরে অধ্যাপক হওয়াতে পেশার দোষে বড়ো বেশি পাউন্ড-ইয়েটস-এলিয়ট-অডেন চর্চা করতেন, কবিতার ভাষা ও ভাবভঙ্গি সাধারণ পাঠকের বোধগম্য হতো না। কিন্তু কিছুদিন কিছু কবির সহজ ভাষার পর ব্যাপারটা আবার গোলমেলে হয়ে গেল, খুব সম্ভব অনেকটা জীবনানন্দ দাসের ক্রমশ প্রসারিত প্রভাবের ফলে। জীবনানন্দের অসাধারণ শক্তি যাঁদের নেই তাঁদের সান্ধ্য ভাষা হজম করা কঠিন। তাঁরা গণ-আন্দোলনে গেলে দেশের দশের সুবিধা হবে না।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024