Main menu

আধুনিকতার ‘বিপন্ন বিস্ময়’: একটি মার্কসবাদী-পোস্টমর্ডান আলাপচারিতা

পিয়াস করিম এই লেখাটায় মার্কসবাদের জায়গা থিকা পোস্টমর্ডানিজমরে কতোটা নেয়া যায় এবং কিভাবে নেয়া এই বিষয়ে আলাপ করছেন এইটা ধইরা নিয়া যে মার্কসবাদ হইতেছে আধুনিকতার পেরিফিরি’র ভিতর থিকাই আধুনিকতার ক্রিটিসিজম আর পোস্টমর্ডানিজমের কাজই হইলো আধুনিকতার বেসিসগুলারেই আউলাইয়া দেয়া; যেহেতু পোস্টমর্ডানিস্টদের প্রশ্নগুলা ভ্যালিড এই কারণে মার্কসবাদেরও বেইসগুলারে রিডিফাইন করা লাগে, আপডেটেড হওয়ার দরকার পড়ে এবং এই জায়গাতে পিয়াস করিম অ্যাজ আ্যা মার্কসিস্ট অ্যাকোমোডেটিভ হইতে চান; মার্ক্সসিজম এবং পোস্টমর্ডানিজমের ইন্টার-অ্যাকশনের স্পেসগুলারে ওপেন করতে চান।

এই লেখাটা এর আগে ছাপা হইছিল ‘প্রতিপাঠ: উত্তরআধুনিকতা’ (পৃষ্টা ১০৯ – ১৩০) নামের একটা সংকলনে। আর স্ক্যানকপিটা মৃদুল শাওনের মারফতে উনার কাছ থিকা নিছিলাম আমরা আপলোড করার জন্য।

– ই.হা.

 

এক.

পোস্টমর্ডানিজমের বিস্তৃত ব্যাখ্যান এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এর পরিসর আরো সীমিত, আরো সুনির্দিষ্টভাবে রাজনীতিমনস্ক। আমি একজন মার্কসবাদী। মার্কসবাদের কাছে আমার রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা। একজন মার্কসবাদী হিসেবে আমি পোস্টমর্ডানিজমের টেক্সট পাঠ করি, তাড়িত হই, আমার রাজনৈতিক বিশ্বাসের কাছে উত্থাপিত প্রশ্নগুলো বুঝে নেয়ার চেষ্টা করি। পোস্টমর্ডানিজমের সাথে আমি আমার মার্কসবাদের আলাপচারিতার একটি স্পেস তৈরি করি। পোস্টমর্ডানিজমকে কখনো ধারণ করি আমি আমার ডিসকোর্সে, কখনো সংশয়ী হই, কখনো অবিশ্বাসে, দ্বিমতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠি। কিন্তু শেষ অব্দি এই কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমার উপায় থাকে না।

একজন মার্কসবাদী হিসেবে, একই সাথে বৈশ্বিক ধনতন্ত্রের ক্ষেত্রে ও প্রান্তে অবস্থিত একজন মানুষ হিসেবে আমাকে আধুনিকতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়। আধুনিকতাকে আমি উপলদ্ধি করি কখনো স্পষ্টাস্পষ্টি, কখনো ধূসর, কিছুটা আলোআঁধারি অবয়বে। মার্কসে আমি অর্জন করি আধুনিকতার অন্তর্নিহিত বিপন্ন সংকটটির এ অব্দি সবচেয়ে ঋজু তীক্ষ্ণ পাঠ। য়ুরোপীয় বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে আমি যখন লেট ক্যাপিটালিজমকে দেখি, ধনতন্ত্রের অদৃষ্টপূর্ব বৈশ্বিক সংহতকরণ দেখি, আমাদের চেতনার অভ্যন্তরে, আরো ভেতরে আমাদের অবচেতনায় ধনতন্ত্রের শক্ত হয়ে ওঠা, দীর্ঘ হয়ে ওঠা অনুপ্রবেশ টের পাই, আমার অস্তিত্বের খুব কাছাকাছি পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষণের চিৎকার শুনি, আমার বাদামি চামড়া যখন শ্বেতবর্ণ ঘৃণার আগুনে ঝলসে ওঠে, আমার বাদামি/কৃষ্ণ শরীরের বিপরীতে- আধুনিকতা সম্পর্কে আমার তখন ক্রগাগত, ক্লান্তিহীন, রক্তাপ্লুত বোধের জন্ম হতে থাকে। এই মানুষ আমি, রাজনীতির কাছে দায়বদ্ধ, এই মার্কসবাদী-আধুনিকতা থেকে উত্তরণের প্রাক্সিস/ন্যারেটিভ এ আমাকে অংশ নিতেই হয়। পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে আমার আগ্রহের এই হচ্ছে জেনেসিস।

এই আগ্রহের কারণেই আমাকে কতগুলো প্রশ্ন দাঁড় করাতে হয়। আধুনিকতার এবং উত্তরআধুনিকতার সংকট পোস্টমর্ডানিস্টরা যেভাবে চিহ্নিত করেছেন তা আমার রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে তৃপ্ত করছে কী? আমার রাজনীতি জীবনকে যেমন আমূল পাল্টে দিতে চায়, এই পাল্টে দেবার পদ্ধতিতে পোস্টমর্ডানিজমের শক্তিটি কোথায়? এর দুর্বলতাগুলোই বা কী? মার্কসবাদের সাথে পোষ্টমডার্নিজমের কথোপকথনের একটি ভঙ্গি বা পদ্ধতি আমি কী করে তৈরি করে নিতে পারি?

কিন্তু এই প্রসঙ্গে আমাকে আরো দু’চারটা কথা বলে নিতে হবে। প্রথমত, পোস্টমর্ডানিজম কোন মনোলিথ নয়। আসলে একটা অবিভাজ্য হোলিস্টিক মতবাদের ধারণাটি পোস্টমর্ডানিজমের ধারণার বিরোধী। পোস্টমর্ডানিজমকে বরং দেখতে হবে আধুনিকতা এবং উত্তরআধুনিকতা সম্পর্কিত কতগুলো কখনো সমিল, কখনো সমান্তরাল, কখনো বিরোধী ডিসকোর্স এর একটি সাধারণ নাম হিসেবে। এই নামরকরণ সম্ভব হয়েছে কতগুলো প্রশ্নের, কতগুলো ভঙ্গির সাযুজ্যের কারণে। এই নামকরণের পেছনে পাঠকের স্বাধীনতার ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। পোস্টমর্ডান তত্ত্বের পথ ধরেই আমরা অথরশিপ এর কেন্দ্রানুগতাকে ডিসেন্টার করব, আমাদের পাঠককে প্রাধান্য দেব। ফুকো কিংবা দেরিদা নিজেদের পোস্টমর্ডান বলেছেন কিনা তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি নির্দিষ্ট পাঠের মাপকাঠিতে আমরা এঁদের পোস্টমর্ডান প্রবণতার অন্তর্ভুক্ত করব কিনা।

দ্বিতীয়ত, পোস্টমর্ডান যে লেখকদের কথা এই নিবন্ধে আমি উল্লেখ করেছি, এরা সবাই প্রতীচ্যের একাডেমিক জগতের বাসিন্দা। এই প্রতীচ্যকেন্দ্রিকতা এই নিবন্ধের একটি দুর্বলতা।

তৃতীয়ত, এটি আর আমাদের কারো কাছে নতুন কোনো সংবাদ নয় যে মার্কসবাদ কোনো অখন্ড প্রত্যয় নয়। মার্কসবাদ, এমনকি মার্কসের নিজস্ব টেক্সটেও, কখনো মনোলিথিক কোনো মেটান্যারেটিভ ছিল না। কাঠামো (স্ট্রাকচার) ও সক্রিয়তার (এজেন্সী), ইতিহাসপাঠের পদ্ধতির, বিজ্ঞান ও দর্শনের সম্পর্কের, অবকাঠামো/উপরিকাঠামোর দ্বান্দ্বিকতার, ক্ষমতার একনায়কতান্ত্রিক সংহতকরণের কিংবা বিপ্লবী গণতন্ত্রের স্বরূপ নির্ধারণের প্রশ্নগুলোতে মার্কসবাদের মধ্যে বহু কণ্ঠস্বরের অস্তিত্ব রয়েছে। পোস্টমর্ডানিজমের মতো এতটা অসংহত চেহারায় নয়, কিন্তু শেষ অব্দি মার্কসবাদও একটি প্লুরিফর্ম ডিসকোর্স। আমি আমার অ্যাক্টিভিজম এ, লেখায়, পাঠে এবং কথোপকথনে মার্কসবাদের অভ্যন্তরে এমনি একটি প্রবণতার পক্ষ নিই।

চুতর্থত, দু’একটি হালকা মন্তব্য ছাড়া পোস্টমর্ডানিজমের সহোদর ডিসকোর্স পোস্টস্ট্রাকাচারালিজমের কোনো আলোচনায় আমি এখানে যাইনি। এক অর্থে পোস্টস্ট্রাকচারালিজম পোস্টমর্ডানিজমে বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্বসূরী তো বটেই। যে সকল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা দিয়ে পোস্টমর্ডানিজমের অবয়বটি গড়ে উঠেছে, পোস্টস্ট্রাকচারলিজম তাদের অন্যতম। ফুকো কিংবা দেরিদার মতো লেখক পোস্টমডার্নিজম/পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের যুগল অংশীদারিত্ব বহন করেন। কিন্তু আমি পোস্টস্ট্রাকচারালিজমের আলোচনা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছি আলাপচারিতার দৃষ্টিটিকে একটি অপেক্ষাকৃত নির্দিষ্ট বিন্দুতে আবদ্ধ রাখার স্বার্থেই।

 

দুই.

এ ধরণের নিবন্ধের প্রায় অনিবার্য একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অতিসরলীকরণ, অতিসাধারণীকরণ। পোস্টমর্ডানিজমের কোলাহলময়, প্রায় চোখ ধাঁধানো বৈচিত্র্যের ভেতর থেকে এর মূল চরিত্রগুলোকে বের করে নিয়া আসা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু নিবন্ধ, বিশেষ করে তার যদি তত্ত্বমনস্ক হবার প্রত্যাশা থাকে, প্রায় ক্ষমাহীন একগুঁয়েমি নিয়েই এক ধরণের আঁটোসাঁটো অবয়ব দাবি করে লেখকের কাছ থেকে। পোস্টমর্ডানিজমের নিম্নবর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো তাই অসম্পূর্ণ, কিন্তু সম্ভবত প্রয়োজনীয়।

পোস্টমর্ডানিজমের যে চরিত্রটি প্রথমেই বোঝা দরকার তা হচ্ছে এর আধুনিকতা-বিরোধিতা। পোস্টমর্ডান লেখকরা বিশ্বাস করেন যে আধুনিকতা তার প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। য়ুরোপীয় বিংশ শতাব্দী যখন আসোয়েচ (Auschwitz) কিংবা গুলাখ আরসিপেলাগো’র (Gulag Archipelago) মতো ভয়াবহতা উপহার দেয় আমাদের, আমরা কী করে বিশ্বাস করি যে আধুনিকতা আমাদের জন্য প্রগতি আর আশার এক উজ্জ্বল বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে? পোস্টমর্ডানিস্টরা যখন ইতিহাসের দিকে তাকান, ইতিহাসের মধ্যে প্রগতির একমুখী কোনো প্রবণতা তাঁরা দেখতে অস্বীকার করেন। কিংবা প্রগতির পুরো ধারণাটিকেই বাতিল করে দেন তাঁরা। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিকরা যেমন ইতিহাসের অমোঘ গতির কথা ভাবতেন (যার ভূত আমাদের সনাতনী মার্কসবাদীদের ঘাড়ে এখনো চেপে আছে), পোস্টমর্ডানিস্টরা তো তা মানেনই না, প্রগতিকে একটি নরমেটিভ প্রত্যয় হিসেবে মেনে নিতেও এদের বেশির ভাগই গররাজি। ইতিহাস পাল্টাছে অবশ্যই, কিন্তু এগুচ্ছে কি? বেশিরভাগ পোস্টমর্ডানবাদীর কাছেই এর উত্তরটি হবে নেতিবাচক।

পোস্টমর্ডানিস্টরা আক্রমণ করেন পাশ্চাত্যের সভ্যতার অ্যাকোমুলেটেড অভিজ্ঞতাকে – এর শিল্পায়ন, নগরায়ন, উন্নত প্রযুক্তি, জাতি-রাষ্ট্র, তীব্র গতিশীল জীবনকে। আধুনিকতার কাছে যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ – ক্যারিয়ার, অফিস, আমলাতন্ত্র, উদারনৈতিক গণতন্ত্র, মানবতাবাদ, নিরপেক্ষতার ভান, নৈর্ব্যক্তিক নিয়মকানুন, সবকিছু্কেই পোস্টমর্ডানিস্টরা আক্রমণ করেন।

আমরা যাকে বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি, মেটান্যারেটিভ, গ্রান্ডন্যারেটিভ, টোটালাইজেশন বলি, পোস্টমর্ডানস্টরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। পৃথিবীর তাবৎ সমস্যার সমাধানের উত্তর একটি একক বিশ্ববীক্ষায় (যেমন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কিংবা বুর্জোয়া উদারনীতিবাদে) খুঁজে পাওয়া সম্ভব এটা কিছুতেই মানতে রাজি নন তারা। বদরিলার্দ-এর ইংরেজি থেকে উদ্ধৃত করি – “The great drivers or impulses, with their positive, elective and attractive powers are gone”। চূড়ান্ত গভীর কোনো একক সত্যের দিনও বিগত এই অর্থে। বহু, অসংখ্য সত্যের অস্তিত্বকে স্বীকার না করে আমাদের উপায় নেই আর। সুবিশাল মাপের গ্রান্ড ন্যারেটিভ এর বদলে পোস্টমডর্নিস্টরা তৃপ্ত থাকতে চান লোকাল ন্যারেটিভ এর সীমিত ব্যাখ্যায় কিংবা এমনকি ব্যাখ্যাহীনতায়। বৈশ্বিক ঐতিহাসিক কোনো টোটালাইজিং তাত্ত্বিক সূত্রায়নের বদলে পোস্টমর্ডানিস্টরা ইতিহাসকে বোঝেন ছোপ মাপের, ধারাবাহিক ন্যারেটিভ হিসেবে।

বদরিলার্দ

বদরিলার্দ

জীবনকে বোঝার জন্য যৌক্তিকতাকে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে মেনে নিতে নারাজ পোস্টমর্ডানিস্টরা। পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে, বিশেষ করে এর এনলাইটমেন্ট পর্বে যৌক্তিকতার একচ্ছত্র দাপট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যৌক্তিকতার অনুশাসনে আবেগ, অনুভূতি, স্বত্ত্বা, রিফ্লেকশন, স্পেকুলেশন, ব্যক্তিক অনুভূতি, সনাতনী রীতিনীতি, মেটাফিজিক্স, যাদু, মিথ, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে পিছু হটতে হয়েছে। নীৎসের প্রভাবে ভেবার যাকে বলেছিলেন “আইরন কেইজ অফ ফিউচার” ভবিষ্যতের যুক্তিশাসিত লোহার খাঁচা, আধুনিকতায় তার গঠনটি সম্পন্ন হয়েছে। এই একমাত্রিক যৌক্তিক মনোলিথের বিপ্রতীপে যা কিছু আদিম, বিস্মৃত, ফুকোর ভাষায় যা কিছু ‘সাবজেক্টিভ নলেজ’ পোস্টমর্ডানিস্টরা তার পুনরুত্থান কামনা করেন। আধুনিক যৌক্তিকতার আধিপত্যকে অস্বীকার করার ফলেই পোস্টমর্ডানিস্টদের লেখায় আধুনিক একাডেমিক ডিসকোর্সের সংহত, ছকে বাঁধা ফর্মটি দেখি না আমরা। এদের লেখায় রয়েছে একধরণের উন্মুক্ত নন্দনতাত্ত্বিক নিরীক্ষা, ঢিলেঢালা কবিতাময়তা, আত্মমগ্ন, অপ্রথাবদ্ধ শব্দচয়ন।

বেশিরভাগ পোস্টমর্ডান লেখকই আধুনিক সমাজের কেন্দ্রিয় বিন্যাসের প্রতি আকর্ষিত নন। বরং তাদের মুখ ফেরানো রয়েছে আধুনিকতার প্রান্তসীমায়, এর অবহেলিত প্রান্তরগুলোতে। জীবনের বিস্তৃত, যুক্তিহীন, তাৎপর্যহীন, নিষ্পেষিত, অদ্ভূত, পরাধীন, প্রত্যাখ্যাত, অদরকারি, এলোমেলো, নিঃশব্দ, আকস্মিক, অসংলগ্ন, এবড়োথেবড়ো সব ক্ষেত্রগুলোর উপর পোস্টমর্ডনিস্টদের নাড়ির টান। উদাহারণ হিসেবে বলি, ফুকো তাঁর ক্ষমতার বিন্যাসটি খুঁজতে গিয়ে রাষ্ট্র কিংবা উৎপাদন পদ্ধতির কাছে গেলেন না। প্রথম সুনির্দিষ্ট সাবসটেনটেটিভ যেই কাজটিতে তিনি ক্ষমতার কথন তৈরি করলেন তা হচ্ছে ম্যাডনেস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন এ উন্মাদনার ইতিহাস রচনায়।

পোস্টমর্ডানিজম প্রচলিত, একাডেমিক শ্রম বিভাজনকে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় রোসেনাউ (Rosenau) যেমন বলেছেন, সংস্কৃতি ও জীবন, তত্ত্ব ও গল্পকথন, কল্পনা আর বাস্তবের সীমারেখাগুলো ধূসর, অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে পোস্টমর্ডান ডিসকোর্সে। বদরিলার্দের উদাহারণ যদি দেখি তিনি তাঁর সামাজিত তত্ত্বকে বলেছেন ফিকশন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, কিংবা এক ধরণের কবিতা।

 

তিন.

আরো অনেক বিষয়ের মতোই মার্কসবাদ সম্পর্কেও পোস্টমর্ডান লেখকদের মধ্যে কোনো একক কণ্ঠস্বর নেই। মার্কসবাদ সম্পর্কে তাঁদের চিন্তা ও অনুভূতির বিভিন্নতা রয়েছে। যদিও জেমেসন কিংবা হার্ভে-র মতো কেউ কেউ মার্কসবাদের সাথে পোস্টমর্ডান তত্ত্বের মিলন ঘটাবার প্রয়াস পেয়েছেন, বেশিরভাগ পোস্টমর্ডান লেখকই মার্কসবাদকে দেখছেন একটি আধুনিক গ্রান্ড ন্যারেটিভ হিসেবে। উত্তরআধুনিক পৃথিবীর সংকট উপলদ্ধি এবং সমাধানের ক্ষেত্রে মার্কসবাদের উপযোগিতাকে প্রত্যাখান করছেন তাঁরা।

মার্কসবাদকে এর পোস্টমর্ডান সমালোচকরা দেখছেন একটি টোটালাইজিং ডিসকোর্স হিসেবে। এই ডিসকোর্সটি প্রোথিত রয়েছে এনলাইটমেন্টের স্বপ্নের ভেতরে। এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের একটি মুখ্য দিকই হচ্ছে জীবনকে যুক্তির মাপে বেঁধে ফেলা, এই যুক্তিগ্রাহ্যতার ভিত্তিতে চিন্তার এবং প্রয়োগের একটি বৈশ্বিক-সার্বজনীন পদ্ধতির তৈরি করা, আর এই পদ্ধতির বদৌলতে জীবনকে পাল্টে ফেলা। এনলাইটেনমেন্টের এই আপাতত লোভনীয় যৌক্তিকতার শুভ্রত্বে যখন আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, পোস্টমর্ডানিস্টরা এনলাইটেনমেন্টের ভয়াবহ অন্ধকার দিকটির দিকে নজর দিতে বললেন আমাদের। এক প্রজন্ম আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের হরকহেইমার এবং অ্যাডোরনো তাঁদের ডায়ালেক্টিট অফ এনলাইটেনমেন্ট-এ আমাদের জানিয়েছিলেন এলাইটেনমেন্ট কী করে প্রকৃতির উপর মানুষের, শেষে মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য তৈরি করে। পোস্টমর্ডান লেখকরা আমাদের বলছেন এনলাইটেনমেন্ট ন্যারেটিভগুলো কী করে জীবনের একটি সর্বগ্রাসী যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্ব উপস্থাপিত করে, এই যুক্তিগ্রাহ্যতা কী করে কল্পনা, মিথ, কবিতা সহ জীবন উপলদ্ধির অন্য পদ্ধতিগুলোর উপর সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তার করে শেষে নির্মাণ করে এক শ্বাসরুদ্ধকর যুক্তিআক্রান্ত বাস্তবতা। মার্কসবাদ, পোস্টমর্ডান ভাষ্যমতে, ঠিক এই কাজটিই করছে ইতিহাসের একমাত্রিক বয়ান সংগঠন করার মাধ্যমে। জীবনের বিচিত্রমাত্রিক অ্যামবিগিউয়াস যে চারিত্র্য, মার্কসবাদ তা ধারণে অক্ষম। পোস্টমর্ডানিস্টরা মার্কসবাদকে অভিযুক্ত করেন ইতিহাসের ধূসরতা আর অধারাবাহিকতাকে কতগুলো নির্ধারিত বৈজ্ঞানিক নিয়মের ছকে বেঁধে ফেলার জন্য। এনলাইটেনমেন্ট বিশ্ববীক্ষা আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আধুনিককতার সাথে। একটু ভিন্ন ভাষায় বদরিলার্দের মন্তব্য এখানে উল্লেখ্য। মার্কস, বদরিলার্দ বলছেন, তাঁর ধনতন্ত্রের তত্ত্বে ধনতান্ত্রিক সমাজের উৎপাদনের তত্ত্বের একটি মিরর ইমেজ বানিয়েছেন। যদিও আপাত দৃষ্টিতে ধনতন্ত্রের একটি উল্টো ইমেজ এটি, আদতে ইমেজটি ধনতন্ত্র দ্বারাই গভীরভাবে অবয়বপ্রাপ্ত হয়েছে। মার্কস ব্যর্থ হয়েছেন ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদদের রচিত ধনতন্ত্রের তত্ত্বের সাথে একটি র‌্যাডিকেল ব্রেক ঘটাতে। মার্কস প্রয়াস পেয়েছেন বুর্জোয়া ধারণাগুলোর আধিপত্য ধ্বংস করতে কিন্তু বুর্জোয়া চিন্তার আদলেই তিনি তৈরি করেছেন তাঁর ট্রান্সহিস্টোরিক্যাল তত্ত্ব, যাতে প্রতিফলিত হয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার তাবৎ মেটাফিজিক্স।

দেরিদাও এই তো সেদিন মার্কসের প্রতি তাঁর অ্যাপ্রিসিয়েশন জানান দিলেও, মার্কসবাদকে দেখেছেন পাশ্চাত্যের লোগোসেন্ট্রিক ঐতিহ্যের একটি অঙ্গাঙ্গি অংশ হিসেবে। লোগেসেন্ট্রিজম, কসমিক ঐক্য, ঈশ্বর, প্রলেতারীয় বিপ্লব কিংবা এমন কোনো বৈশ্বিক-সার্বজনীন মাপকাঠিতে সত্যের সন্ধান করে। তাই লোগোসেন্ট্রিজম এর বদলে দেরিদা প্রস্তাব করেন ডিকন্ট্রাসক্টিভ পদ্ধতির। সত্যের, বিশ্বাসের, টেক্সটের ক্রমাগত অবিনির্মাণের মধ্য দিয়েই আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে।

মার্কসবাদের বড় মাপের ন্যারেটিভের বিপরীতে পোস্টমর্ডান সমালোচকরা নির্ভর করছেন প্রেক্ষিত-নির্ভর, স্থানিক ন্যারেটিভের উপর। বিশ্ববিপ্লবের সুবিশাল আকাঙ্ক্ষার বদলে তাঁরা চর্চা করতে চাইছেন ছোট মাপের স্বপ্নের। দেলিউয়া এবং গুয়াতারি তাঁদের ধনতন্ত্র এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়ার অডিপাস-বিরোধী আখ্যানে কিংবা লিওতাঁর তাঁর উত্তর-আধুনিক চালচিত্র নির্ণয়ে এমনি করেই মার্কসবাদের গ্রান্ড ন্যারেটিভ চরিত্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ধনতন্ত্রকে খোলনলচে সমেত শুধু পাল্টে দিলেই জীবন শুদ্ধ, সুন্দর হয়ে উঠবে এই বিশ্বাস পোস্টমর্ডানিস্টরা আর রাখতে পারছেন না। তাঁরা স্তালিনবাদের অদ্ভূত আঁধার দেখেছেন… রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নেমে আসা যুথবদ্ধ জীবনের দর্শন তাঁদের কাছে সুখকর মনে হচ্ছে না আর কিছুতেই। বরং তাঁরা প্রতিরোধের স্পেস তৈরি করতে চাইছেন সর্বত্র। ধনতন্ত্রের ফাটলগুলোতে, আধুনিকতার ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজগুলোতে তাঁরা খুঁজছেন অসংখ্য ছোট মাপের মাইক্রোপলিটিক্যাল ক্ষেত্র। দক্ষিণ মেক্সিকান জাপাতিস্তা বিদ্রোহ থেকে লোককবির ঋজু, সবল, লালিত, পংক্তি, জঙ্গী সংখ্যালঘুর বিক্ষোভ থেকে জীবনের অসঙ্গতিতে প্রবল কৌতুক, যৌন স্বাধীনতার লড়াই থেকে ক্ষমতাধরের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে পড়া গুজব – এর সবখানেই সম্ভব প্রতিরোধের প্রত্যাশা। রাজনীতি শুধু আর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পদ্ধতি নয়। রাজনীতি এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জীবনের প্রতিটি কোণে। ফুকো যেমনটি বলেছেন – যেখানেই ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ। ক্ষমতা প্রতিরোধের এই অফুরন্ত কাপলেট (couplet)-এই ছড়িয়ে রয়েছে পোস্টমর্ডান রাজনীতির শেকড়-বাকড়।

পোস্টমর্ডান সমালোচকরা বলেছেন মার্কসবাদ একটি এসেনশিয়ালিস্ট তত্ত্বও বটে। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে মানবচরিত্রে কতগুলো মৌলিক উপাদান রয়েছে। তাঁর স্পেসিস বিং (species being) এর ধারণায় মার্কস মানবচরিত্রের মূল উপাদান হিসেবে দেখছেন মুক্ত সমবায়ী সৃজনশীল শ্রমকে। ধনতন্ত্র মানুষের এই মৌলিক চরিত্রকে হনন করে, ধনতন্ত্রের বাসিন্দা মানুষ হয়ে উঠে এলিয়েনেটেড মানুষ। পোস্টমর্ডানিস্টরা অন্যদিকে মানবচরিত্রের কোনো মৌলিক উপাদানকে স্বীকার করে নিতে রাজি নন। এই মৌলিক উপাদানের মিথ, দেরিদার ভাষা ব্যবহার করে যাকে বলা যায় ‘মিথ অফ অরিজিন’ বাইবেল, কোরানের সেই স্বর্গচ্যুত মানুষের মিথেরই একটা নতুন সংস্করণ।

মানবচরিত্র, পোস্টমর্ডানিস্টদের মতে, ঐতিহাসিক ডির্সকার্সিভ প্রক্রিয়ায় নির্মিত। মানবচরিত্রের অমৌলিকত্বের কারণেই লড়াই-এর চরিত্রও অহরহ পাল্টে যায় বিভিন্ন ডিসকোর্সে।

মানবচরিত্র সম্পর্কিত এই বির্তকের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে পাঠক কবছর আঘে ডাচ টেলিভিশনে প্রচারিত চমস্কি ও ফুকোর বির্তকটির খরব নিতে পারেন। চমস্কি ধ্রুপদী এনলাইটেনমেন্ট চিন্তার ঐতিহ্যে প্রায় গাণিতিক নিশ্চয়তার সাথে মানবচরিত্রের একটি সার্বজনীন ব্যাখ্যার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। ফুকো বিরোধিতা করেছেন এই সম্ভাবনার। ফুকোর কাছে মানবচরিত্রের ক্রমাগত ঐতিহাসিক গড়নটিই সত্য, অধারাবাহিক পরিবর্তনশীলতার বাইরে মানবচরিত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই।

পোস্টমর্ডানবাদীদের মতে সনাতনী মার্কসবাদ যেহেতু শ্রমকেই দেখে মানবচরিত্রের মৌলিক উপাদান হিসেবে, আধিপত্যের/নিপীড়নের অন্যান্য লৈঙ্গিক, জাতিসত্তাগত, যৌন প্রবণতা, ধর্মীয় ও অন্যান্য মাত্রাগুলোর স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা গঠনে তাকে ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়। বদরিলার্দ মার্কসকে অভিযুক্ত করেন বুর্জোয়া রাজনৈতিক-অর্থনীতিবিদদের মতই শ্রমের ‘অ্যাব্রান্ট স্যাংগটিফিকেশন’ (aberrant sanctification) এর জন্য। শ্রমের বাইরেও যে জীবনের বিস্তৃত উপত্যকা, যে প্লেফুলনেস, যে সাইন ও কোড এর প্রাবল্য – মার্কসবাদ তা ধারণ করতে পারেনি।

এই এসেনশিয়ালিজমের আরেকটি দিক রয়েছে। মার্কসবাদের কাছে যে নৈতিক মাপকাঠিগুলো রয়েছে – সাম্যবাদী সমাজ, উৎপাদনের সামাজিকীকরণ, কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিভাজক বিলুপ্তি, রিলিম অফ নেসেসিটি থেকে রিলিম আফ ফ্রিডম এ উত্তরণ – এগুলো কি একটি এসেনশিয়াল ফাউন্ডেশন তৈরি করছে? এই লক্ষ্যগুলোর পূরণের মধ্যেই কি মানবজাতির মুক্তির চূড়ান্ত সম্ভাবনা নিহিত? ধর্মবিশ্বাসের ঈশ্বরের রাজত্বের মতো মার্কসবাদের কমিউনিজমেও কি সকল সংকট, সকল দ্বেষ, সকল সমস্যার সমাধান মিলবে? সকল বৈরী দ্বন্দ্ব অবধারিতভাবে পরিণত হবে নিরীহ নখদন্তহীন অবৈরী দ্বন্দ্বে?

 

চার.

পোস্টমর্ডান এই ক্রিটিকের বিরুদ্ধে মার্কসবাদের পক্ষাবলম্বন করাটা জরুরি কেন? জরুরি এজন্য যে বৈশ্বিক ধনতন্ত্রের যে প্রেক্ষাপটে প্রাক্সিসের দর্শন হিসেব, বাস্তব ক্রিয়াশীলতার নির্দেশনা হিসেবে মার্কসবাদের উদ্ভব ঘটেছিল সেই ধনতন্ত্র জগদ্দল পাথরের মতো কিংবা বৃটিশ সমাজতত্ত্ববিদ গিডেনস আধুনিকতার চারিত্র্য নির্ণয়ে যেমনটি বলেছেন, জগন্নাথের রথের মতো আমাদের উপর এখনো চেপে বসে রয়েছে। এই ধনতন্ত্রের অবয়ব পাল্টেছে, এর বৈশ্বিকতা আরো সংহত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ এর নতুন ক্ষেত্র ও প্রক্রিয়া তৈরি হয়েছে, কিন্তু ধনতন্ত্রের মূল চরিত্রটিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

মাকর্সবাদের জন্ম হয়েছে আধুনিকতার প্রেক্ষাপট থেকে। মার্কস-এঙ্গেলসের শব্দচয়ন উনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক সম্ভার থেকে আহরিত, কিন্তু আদতে মার্কসবাদ আধুনিকতার সংকট নির্ণয়েরই তত্ত্ব। আধুনিকতার সংকটকে মার্কস এবং এঙ্গেলস বোঝার চেষ্টা করেছেন ধনতন্ত্রের উদ্ভব, বিকাশ ও সংকটের মধ্য দিয়ে। আধুনিকতার ভেতর থেকে উঠে এসেছে মার্কসবাদ, আধুনিকতার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আধুনিকতার বৈশ্বিক-ঐতিহাসিক পটভূমিতে সেই অর্থে মার্কসবাদই সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক উত্তরআধুনিক তত্ত্ব।

এই বিশেষ অর্থে মার্কসবাদী ক্রিটিক পোস্টমর্ডান ক্রিটিকের চেয়েও নির্মম, ক্ষমাহীন। আধুনিকতার এখানে-ওখানে প্রতিরোধ নয়, আধুনিকতাবে খোল-নলচেসহ পাল্টে ফেলা, ধনতন্ত্রের আমূল রুপান্তরই মার্কসবাদের লক্ষ্য।

কিন্তু আধুনিকতার সমস্ত অভিজ্ঞতাকেই মার্কসবাদ কি স্পর্শ করতে পেরেছে? ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের চারিত্র্য, সংকট ও রূপান্তর আধুনিকতার কেন্দ্রীয় সমস্যা নিঃসন্দেহে, কিন্তু তার বাইরে জীবনের সুবিশাল একটি উপত্যকা কি পড়ে নেই? মার্কসবাদ কি পেরেছে ‘ক্ষমতার’ একটি স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে? মার্কসবাদ কি পেরেছে তার য়ুরোপকেন্দ্রিকতাকে ছাড়িয়ে উঠতে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর উপর যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-যৌন শোষণটি চলে মার্কসবাদে কি তার কোন সংহত বিশ্লেষণ রয়েছে? মার্কসবাদের মধ্যে কি রয়েছে দেহের তত্ত্ব? ভালোবাসার? মার্কসবাদ কি প্রজ্ঞা-সজ্ঞা অনুভূতি-চেতনা-অবচেতনার একটি মনস্তাত্ত্বিক ডিসকোর্স তৈরি করতে পেরেছে? ঐতিহাসিক বস্তুবাদে কি আধ্যাত্মবাদের স্থান রয়েছে? আধুনিকতার সঙ্গে আধ্যাত্মের সম্পর্কের বিশ্লেষণ? কিংবা পোস্টমর্ডান লেখকদের অনেকেরই প্রিয় বিষয়বস্তু যেটি – আধুনিকতার এপ্টিস্টোমলোজিক্যাল ক্রিটিক, মার্কসবাদ সে ব্যাপারেই কি নতুন কিছু বলতে পেরেছে আমাদের? এক কথায় মার্কসবাদ কি আধুনিকতার সামগ্রিক রূপ, সংকট ও রূপান্তরের একটি দর্শন উপস্থাপিত করতে পেরেছে?

এখানে-ওখানে বিচ্ছিন্ন কিছু উপাদান বাদ দিলে মার্কস আসলে চাননি জীবনের টোটাল একটি মেটান্যারেটিভ দাঁড় করাতে। জীবনের সব সমস্যার সমাধানের কোনো অলীক তত্ত্ব নির্মাণের অভিলাষ ছিল না তাঁর। টোটাল গ্রান্ড ন্যারেটিভ রচনার যে বুদ্ধিবৃত্তিক মেজাজটি দরকার মার্কসের ছিল না তা আর ছিল না যে, আধুনিত চিন্তার ইতিহাসের জন্য তা একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। মার্কস ধনতন্ত্রের একটা কথন তৈরি করেছেন। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, বিশ্বাসযোগ্য এবং বৈপ্লবিক একটা কথন। কিন্তু কথনটি রূপ নেবে একটি সর্বরোগ উপশম ধর্মবিশ্বাসে, মার্কস তা চাননি। কিন্তু তারপরেও তো সত্যি, যারা মার্কসবাদী বলে দাবি করেন নিজেদের তাঁদের অনেকেই এক ধরণের ম্যাগালোম্যানিয়া-তে ভোগেন। স্তালিনবাদ তো এই ম্যাগালোম্যানিয়া-র একটি রূপ! অর্থনীতি থেকে ভাষাতত্ত্ব, যৌন আচার থেকে চিত্রকলা সব ব্যাপারেই স্তালিনবাদীদের একটা ছকে বাঁধা একমাত্রিক উত্তর আছে। জীবনের তাবৎ জটিলতা উন্মোচনে একটা সব পেয়েছি-র চাবিকাঠি তাঁদের হাতে কেমন করে পৌঁছে গেছে!

এই ম্যাগালোম্যানিয়া-র তাত্ত্বিক উৎস সন্ধান করতে গেলে আমাদের এঙ্গেলসের দিকে তাকাবার প্রয়োজন রয়েছে। মার্কসবাদের ইতিহাসে এঙ্গেলসের অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু মার্কস আর এঙ্গেলসের চিন্তার ধরনে যে কিছু পার্থক্য রয়েছে সেটাও যাতে ভুলে না যাই আমরা। মার্কসের চিন্তায় বেশিরভাগ সময়েই আমরা দেখি যে ওপেন-এন্ডেড ঝোঁক, তার বিপরীতে এঙ্গেলসে আমরা দেখি চিন্তার একটি সার্বিক কাঠামো তৈরি করার প্রবণতা। এঙ্গেলসের অ্যাণ্টি-ডুরিং এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহারণ। মার্কস যেখানে বস্তুবাদী পদ্ধতিকে ব্যবহার করেছেন ইতিহাস, সমাজ, কিংবা অর্থশাস্ত্রের পঠন-পাঠনে, এঙ্গেলস সেখানে বস্তুবাদী তত্ত্বকে কাজে লাগাতে চেয়েছেন সমস্ত প্রকৃতি এবং জীবনের ব্যাখ্যায়। উনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, কিংবা গণিতশাস্ত্রের যে পাঠ এঙ্গেলস করেছেন, আজকের প্রাকৃতিকবিজ্ঞানের নিরিখে তা সেকেলে, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা, এঙ্গেলস তৈরি করেছেন মার্কসবাদী বস্তুবাদের প্রথম টোটাল পাঠ, পরবর্তীকালের মার্কসবাদের সৃজনশীল বিকাশকে যা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই এঙ্গেলসীয় পাঠ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের তাত্ত্বিকদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের টোটাল মার্কসবাদের সাথে পরবর্তীকালের স্তালিনবাদী ভালগারাইজেশন-এর ধারাবাহিকতাটি আজকের মার্কসবাদী সাহিত্যের একটি পরিচিত আলোচনার বিষয়।

আমি যে মার্কসবাদী ঐতিহ্যের পক্ষাবলম্বন করি তা মার্কসবাদের এই টোটাল পাঠের বিরুদ্ধে। মার্কসবাদকে আমরা দেখি ইতিহাস বোঝার এবং পাল্টানোর একটি দ্বান্দ্বিক, গতিময়, প্রেক্ষিতনির্ভর পদ্ধতি হিসেবে। জীবনের কেন্দ্রিয় দিকগুলো স্পর্শের একটি দায়বদ্ধতা অবশ্যই এর আছে। কিন্তু এই দায় পূরণের মানে এই নয় যে সাম্য, স্বাধীনতা, এবং সহোদরত্বের প্রতিটি ডিসকোর্সকে মার্কসবাদের প্রাথমিক টেক্সটগুলোতেই আমাদের খুঁজে পেতে হবে।

মুক্তির ডিসকোর্সগুলো মার্কসবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে বিকশিত হতে পারে ক্রমান্বয়ে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মার্কসবাদীদের হাতে। আর এই বিকাশ সম্ভব ব্যাপকতর একটি ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির প্রেক্ষিতে – মার্কসবাদের বাইরের ডিসকোর্সগুলোর সাথে ক্রিটিক্যাল এনগেইজমেন্ট তৈরি করে। পোস্টমর্ডান ন্যারেটিভগুলোর সাথে মার্কসবাদের আলাপচারিতার প্রয়োজনীয়তাকে এই ব্যাপকতর ক্যানভাসেই বুঝতে হবে আমাদের।

গ্রামসী

গ্রামসী

আর এই বিকাশের কাজটি তো চলছেই। উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এটা সত্যি যে, এইটিনথ ব্রুমেয়ারই কিংবা আরো দু’একটি লেখা ছাড়া ক্ষমতার প্রসঙ্গটি একটি স্বাধীন প্রত্যয় হিসেবে উঠে আসেনি মার্কসের লেখায়। ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক ক্ষমতার প্রশ্নটি মার্কসের রচনায় উপস্থাপিত হয়েছে উৎপাদন পদ্ধতির একটি এপিফোনোমেনন হিসেবে। কিন্তু মার্কসের পরে ক্রমান্বয়ে গড়ে উঠেছে ক্ষমতার বিশ্লেষণের একটি চমৎকার জীবন্ত মার্কসবাদী ঐতিহ্য। গ্রামসীর কিছুটা পরস্পরবিরোধী, অসংলগ্ন, কিন্তু প্রতিভাদীপ্ত প্রয়াসের কথা এখানে আমাদের মনে রাখতেই হবে। গ্রামসীর অভিনভত্ব এই ক্ষেত্রে ক্ষমতাকে একটি বিস্তৃত উপাদান হিসেবে দেখা। বুর্জোয়া সিভিল সোসাইটির বিরুদ্ধে একটি বিকল্প সিভিল সোসাইটি গড়ার কাউন্টার হেজিমনিক প্রজেক্ট’টির মূল ব্যাপারটিই হচ্ছে ক্ষমতার প্রশ্নটিকে অর্থনীতির কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতার বৃত্তের বাইরে সমাজের একটু বিস্তৃত স্পেস এ নিয়ে আসা। ফুকোর ক্ষমতার তত্ত্বের চেয়ে গ্রামসীর ক্ষমতার বয়ান এখানটাতে অনেক বেশি দরকারি বিপ্লবী রাজনীতির জন্য। ফুকো ক্ষমতাকে একটি কাঠামো হিসেবে দেখেননি। ফুকোর ক্ষমতা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাজে টুকরো-টাকরা ছড়িয়ে রয়েছে। তাঁর মাইক্রোফিজিক্স অফ পাওয়ার সমাজের বিভিন্ন স্পেস এ ক্ষমতার গভীর, বিস্তৃত বিন্যাসের কথা বলে। কিন্তু রাষ্ট্রের যে অবস্থান ক্ষমতার স্ট্রাকচারাল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাষ্ট্রের সাথে উৎপাদন পদ্ধতির যে দ্বান্দ্বিক বিন্যাস, তার হদিস নিতে ফুকোর কোন আগ্রহ নেই। আর এখানেই গ্রামসী অনেক বেশি সাফল্যের সাথে মাইক্রো রাষ্ট্র ও অর্থনীতির সাথে মাইক্রো জীবনের সম্পর্কটির একটি দারুণ বিশ্লেষণ তৈরি করেছেন মার্কসীয় কাঠামোর মধ্য থেকে।

আরেকটি উদাহারণ। মার্কসের মধ্যে যে একটি পুরুষতান্ত্রিক উপাদান রয়েছে, মার্কসের অন্ধ, ক্রিটিকবিমুখ ভক্ত ছাড়া আর সবাই বোধহয় তা স্বীকার করবেন। নারীর গৃহশ্রমের উদ্বৃত্তটি ধনতন্ত্র কী করে আত্মসাৎ করে, গৃহশ্রম কী ভূমিকা রাখে পুঁজির উৎপাদনে ও পুনরুৎপাদনে তার ব্যাখ্যা নেই মার্কসের নিজস্ব টেক্সটে। কিন্তু আমরা কী করে অস্বীকার করি যে, এঙ্গেলসের “দ্য অরিজিন অফ ফ্যামিলি, দ্য স্টেট অ্যান্ড প্রাইভেট প্রপার্টি” আমাদের হাতে এসে পৌঁছানো প্রথম নারীবাদী গ্রন্থসমুহের একটি। আধুনিক নারীবাদী চিন্তার প্রথম দিকের কাজগুলোর মধ্যে এটি সমাজতান্ত্রিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। আজকের নৃতাত্ত্বিক তথ্যের মাপকাঠিতে এঙ্গেলসের বিশ্লেষণের সবটুকু যে আর গ্রহণীয় নয় সেটা আমরা জানি কিন্তু এঙ্গেলস নিঃসন্দেহে সমাজতান্ত্রিক নারীবাদের প্রারম্ভবিন্দু রচনা করেছিলেন। এঙ্গেলসের এই প্রারম্ভবিন্দু থেকে এবং মার্কসবাদের কাঠামোর বাইরে নারীবাদী তত্ত্ব/প্রাক্সিসের সাথে লাগাতার বির্তক ও সম্পৃত্তির মধ্য দিয়ে যে মার্কসাবাদী নারীবাদী ডিসকোর্সগুলো তৈরি হয়েছে, তার রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্য ত অবশ্যই বিশাল। কিংবা ধরা যাক মার্কসবাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটির কথা। এরিক ফ্রম, মার্কসের দার্শনিক রচনাসমূহের একটি মনস্তাত্ত্বিক পাঠ তৈরি করেছেন আমাদের জন্য। তাঁর বক্তব্য, মার্কসের ভালোবাসার তত্ত্ব ফ্রয়েডে তত্ত্বের চেয়েও গতিময়। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের চেয়ে মার্কসের অবিকশিত, কিন্তু অমিত সম্ভাবনাময় মনস্তত্ত্বের তত্ত্বটি অনেক বেশি ইতিহাসনির্ভর, দ্বান্দ্বিক। ফ্রম, ফ্রয়েডকে পাঠ করেছেন একটি মার্কসীয় অবস্থান থেকে, আবার মার্কসের পাঠে নিয়ে এসেছেন এক ধরণের ফ্রয়েডীয় সংবেদনশীলতা। মার্কস-ফ্রয়েডের সাবলীল যুগল পাঠ আমরা দেখি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের মেধাবী পুরুষ হাবার্ট মারক্যুসার ইরোস অ্যান্ড সিভিলাইজেশন কিংবা রেইষ এর অসাধারণ প্রতিভাদীপ্ত ফ্রয়েডীয়-মার্কসীয় রচনাসমূহে। মনস্তত্ত্বের চর্চা থেকে রাজনৈতিক চেতনার মধ্য দিয়ে মার্কসীয় চেতনায় উত্তরণের উদাহরণ হিসেবে ফ্রানৎস ফেনন তো একটি উজ্জ্বল উদাহারণ হয়ে রয়েছেনই। হালফ্যাশনের পোস্ট কলোনিয়াল টেক্সচুয়াল পাঠে ফেননকে নখদন্তবিহীন সিগনিফায়ার-এ পর্যবসিত করার চেষ্টা হয়। তবুও, ফেনন তো আসরে একজন ইতিহাসসেচতনাসম্পন্ন রাজনৈতিক যোদ্ধা, মার্কসের একজন সাহসী অসনাতনী পাঠক।

ফ্রম আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন মার্কসবাদের উপেক্ষিত আধ্যাত্মিক মাত্রাটির প্রতিও। মার্কসীয় রাজনীতিমনষ্কতার সাথে আধ্যাত্মবাদের মেধাবী মিশেল ঘটেছে ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের অবিস্মরণীয় রচনাগুলোতেও। লাতিন আমেরিকার লিবারেশন থিওলজি মার্কসবাদের সাথে সংলাপের একটি স্পেস তৈরি করে একটি ধর্মীয় অবস্থান থেকে। আমাদের মাওলানা ভাসানী, যার আরো অনেক বেশি আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন হওয়া উচিত, নিজে মার্কসবাদী না হয়েও মার্কসবাদ ও আধ্যাত্মিকতার এই যোগসূত্রটিতে কি প্রতাপের সাথে কি দীপ্তির সাথে, কি ইতিহাস কাঁপানো ভঙ্গিতেই না নিজেকে স্থাপন করেছিলেন!

নাস্তিকতার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু বস্তুবাদ ও ভাববাদের বাইনারি অপজিশনটিকে অতিক্রম করার চেষ্টাটির মধ্যে প্রগতিবিরোধী কিছু নেই। আস্তিকতা, নাস্তিকতা, অজ্ঞেয়বাদ কিংবা এদের মধ্যের ধূসর এলাকাগুলোকে কী করে মার্কসবাদী দর্শনে পাশাপাশি ধারন করা যায় সেটি নিয়ে প্রচুর বির্তক তো মার্কসবাদের তাত্ত্বিক কাঠামোটির মধ্যেই হতে পারে।

মার্কসবাদ আধুনিকতার বহুমাত্রিকতাকে স্পর্শ করেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মার্কসবাদীদের সম্মিলিত সৃষ্টিতে তৈরি হয়েছে আধুনিকতার সংকট রূপান্তরের যৌথ পাঠ। কিন্তু আধুনিকতার ব্যাপকতর অভিজ্ঞতাকে ধারণ করার প্রচেষ্টাটির সাথে মার্কসবাদের যান্ত্রিক একপেশে ব্যাখ্যার একটি মৌলিক পাথর্ক্য রয়েছে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মূলধারার মার্কসবাদী পাঠ, প্লেখানভের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ (স্মরণযোগ্য যে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ প্রত্যয়টি মার্কস কিংবা এঙ্গেলস কেউ ব্যবহার করেননি। মার্কসবাদী সাহিত্যে এই প্রত্যয়টির সূচনা করেন প্লেখানভ) এমনকি লেনিনের ম্যাটেরালিজম অ্যান্ড ইম্পেরো-ক্রিটিসিজম (যে লেনিন হেগেল নোটবুকস এর সৃজনশীল, দ্বান্দ্বিক লেনিনের চেয়ে অনেক বেশি যান্ত্রিক, একপেশে। এ ব্যাপারে রায়া ডুনাভস্কায়া কিংবা সম্প্রতি কেভিন এন্ডারসনের কাজ অবশ্যপাঠ্য) কিংবা স্তালিনীয় অধঃপতনের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদী তত্ত্বের যে ধারাটি এগিয়েছে তা আসলেই তৈরি করেছে এক অসহনীয় টোটালাইজিং গ্রান্ড ন্যারেটিভ-এর। জীবনের তাবৎ জটিলতাকে কিছু যান্ত্রিক সূত্রের মধ্যে বেঁধে ফেলার এই যে প্রচেষ্টাটি, তার পদ্ধতিটি, মৌলিক অর্থেই অদ্বান্দ্বিক। পোস্টমর্ডান লেখকদের যে গ্রান্ড ন্যারেটিভ এর উপর বিদ্বেষ এই প্রবণতাটির ব্যাপারে আসলেই তা প্রাসঙ্গিক। মার্কসবাদের যে বিকল্প ধারাটির কথা আমরা বলছি তা কিন্তু আধুনিকতার ব্যাপক প্রেক্ষিতটিকে কোনো মনোলিথিক তত্ত্বের ফ্রেমে বেঁধে ফেলতে চাচ্ছে না। আধুনিকতার বিস্তৃত ম্যাপিংটি এখানে করা হচ্ছে মার্কসবাদকে ক্রমান্বয়েই আরো আরো বেশি করে বহুমাত্রিক করে তুলে, মার্কসাবাদের কাঠামোর বাইরের ক্রিটিক্যাল ডিসকোর্সগুলোর সাথে লাগাতার আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে।

এই বিকল্প আধুনিকতাকে যদি বোঝা হয় একটি টোটালিটি হিসেবে তা অ্যাণ্টি-ডুরিং কিংবা প্লেখানভের মনিস্ট ভিউ অফ হিস্ট্রি’র টোটালিটি নয়, বরং অ্যাডোরনোর একটি ধারনার কিছুটা স্বাধীন ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে যদি বলি – একটি ডিটোটালাইজিং টোটালিটি। টোটালিটি গ্রান্ড ন্যারেটিভ কে তা ডিটোটালাইজ করে (কিংবা আজকের ভাষায় কাব্যের ডিকনস্ট্রাক্ট করে?) কিন্তু সাথে সাথে নিমার্ণ করে বহুকণ্ঠস্বরময় বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি বিকল্প টোটালিটির ধারণা।

এই বিকল্প টোটালিটি-র ধারণাটি একদিকে যান্ত্রিক মার্কসবাদের মনোলিথকে অবিনিমার্ণ করে। অপরদিকে পোস্টমর্ডান কথনে যে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের কাঠামোর ধারণাটি, সামগ্রিকতার ধারণাটি লুপ্ত হয়ে যায় – বাস্তবতা হয়ে ওঠে শুধুই ডিসকোর্স, শুধুই অনুক্ষমতা, শুধুই টেক্সট, শুধু্‌ই ল্যাংগুয়েজ গেইম, শুধুই সাইন, কোড কিংবা স্যামুলাক্রা, তার বিপরীতে রক্ষা করে ব্যাপকতর গন্ডির ম্যাক্রোরাজনীতির কাঠামোর সংহত বিশ্লেষণের মার্কসবাদী প্রতিশ্রুতিটিকে।

 

পাঁচ.

মার্কসবাদের এনলাইটেনমেন্ট চরিত্রটির কথা এবার লক্ষ্য করা যাক। এটা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এনলাইটেনমেন্ট জীবন দর্শনের মধ্যেই মার্কসবাদের তাত্ত্বিক ভিতটি গাঁথা রয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলস যে দর্শন-সমাজতত্ত্ব-অর্থশাস্ত্রকে আত্মস্থ করেছেন নিজেদের তত্ত্বে তার আদলটি পুরোপুরিই এনলাইটেনমেন্টের। বাস্তবতাকে যুক্তিগ্রাহ্য করে বোঝা এবং সেই যুক্তির উপর ভর করে বাস্তবতাকে পাল্টে ফেলার বড় মাপের বৈশ্বিক-ঐতিহসিক আকাঙ্ক্ষাটি মার্কষবাদ পেয়েছে এনলাইটেনমেন্ট থেকেই। কিন্তু এই এনলাইটেনমেন্টবদ্ধতা কি অবধারিতভাবে জন্ম দিয়েছে গুলাখ আরসিপেলাগো (Gulag Archipelago)-র? এনলাইটেনমেন্ট কি মার্কসবাদের কাছে গছিয়ে দিয়েছে ইতিহাসের এক অপ্রয়োজনীয় ব্যাগেজ?

এনলাইটেনমেন্টের একটা সুনির্দিষ্ট টাইম স্পেস প্রেক্ষিত রয়েছে। আধুনিক য়ুরোপের পটভূমিতে এর জন্মবিকাশ, পৃথিবীকে বোঝার এবং পাল্টাবার জন্য এর পদ্ধতিটিও একান্তভাবে য়ুরোপীয়।

মার্ক্স ও এঙ্গেলস

মার্ক্স ও এঙ্গেলস

মার্কস-এঙ্গেলস যখন কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে সবচেয়ে ‘বর্বর’ জাতিদেরও ‘সভ্যতার’ বৃত্তে নিয়ে আসতে পারা, চীনের প্রাচীরকে ধূলিস্মাৎ করে বিদেশীদের প্রতি ‘বর্বরদের’ ‘অবাধ্য ঘৃণাকে’ পরাস্ত করতে পারা য়ুরোপীয় বুর্জোয়ার বিপ্লবী ভূমিকা দেখে মোহিত হচ্ছেন তাঁদের ‘সভ্যতার’ ধারণাটি নির্মিত হচ্ছে য়ুরোপকেন্দ্রিক অ্যাজম্পশন-এর জমিতে। ‘চীন’ আর ‘বর্বর’ তাদের টেক্সট-এ উপস্থিত হচ্ছে ধূসর অস্পষ্ট আদার হিসেবে। আধুনিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সাহসী তত্ত্বটি নির্মিত হচ্ছে য়ুরোপের মানসজমিতে দাঁড়িয়েই। আলজেরিয়ার জনগণের নিজেদের উদ্যোগে স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষমতা সম্পর্কে এঙ্গেলসের সেই বহুউল্লেখিত য়ুরোপকেন্দ্রিক অনাস্থাজ্ঞাপক ব্যক্তবটি এই য়ুরোপকেন্দ্রিকতার আরেকটি উদাহারন।

কিন্তু মার্কসের চমৎকারীত্বটা হচ্ছে (যে চমৎকারীত্বটা আমরা দেখি বড় মাপের যে কোনো লেখকের ক্ষেত্রে) যে তিনি ওই জায়গাটিতে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন না। মার্কিনী মার্কসবাদী সমাজতত্ত্ববিদ কেভিন এন্ডারসন দেখিয়েছেন কী করে মার্কসের চিন্তার ধারণাটিতে বহুসংস্কৃতির (মাল্টিকালচারাজিম) বোধ বিকশিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। ন্যুইয়র্ক ট্রিবিউনের জন্য লেখা তাঁর সংবাদভাষ্যগুলোতেই ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসন সম্পর্কে তাঁর চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা দ্বান্দ্বিক পালাবদল দেখি, উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াই সম্পর্কে স্পষ্টতর বোধ গড়ে উঠতে দেখি। এই ক-বছর আগে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত মার্কসের এথনোলজি নোটবুক (যার ডেভিড স্মিথ সম্পাদিত ইংরেজি অনুবাদটি ঢাকার যে কোনো গ্রন্থাগারে সংগৃহীত হওয়া উচিত) মার্কসের এই বিকাশের উজ্জ্বল এক নিদর্শন। এই নোটবুক’টা মার্কস লিখেছিলেন তাঁর নিজের চিন্তাকে স্বচ্ছ করার জন্য। এর প্রকাশের কোনো উদ্যোগ বা ইচ্ছা মার্কসের ছিল না। মার্কস জীবনে যা লিখেছের তার অল্প একটি অংশই নিজের জীবদ্দশায় প্রকাশ করেছেন। আমরা জানি ক্যাপিটাল এর প্রথম খন্ডটি শুধু তাঁর বেঁচে থাকার সময় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮৪৪ ম্যানুস্ক্রিপ্ট সহ তাঁর প্রথমদিকের অনেক লেখা, যা মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের পঠন/পাঠনকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করেছে, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে। এথনোলজি নোটবুক এ আমরা মার্কসকে দেখি তাঁর য়ুরোপীয় ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক বোধের বাইরে যাবার একটা মনোযোগী প্রয়াস চালিয়ে যেতে। বাংলার গ্রাম থেকে জাভার সমাজ সম্পর্কে মনস্ক অধ্যয়নের একটি সৎ প্রয়াস পুরো নোটবুকটিতে স্পষ্ট। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে এথনোলজি নোটবুকের দূরত্ব শুধু সময়ের নয়, য়ুরোপের টাইম-স্পেস এ দাঁড়িয়ে সমস্ত পৃথিবীর মানবিক রূপান্তরের সবচেয়ে সাহসী স্বাপ্নিকের প্রথম বিকাশের কাল থেকে পরণতির দূরত্ব।

কিন্তু তারপরেও কথা থেকে যায়। এমনকি যখন মার্কস অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজের অয়ুরোপীয় পাঠে চেষ্টা করেন, য়ুরোপ সাবটেক্সট হিসেবে উপস্থিত থেকে যায় তাঁর চিন্তায়। এডওয়ার্ড সাইদ যাকে বলেছেন অরিয়েন্টালিস্ট। এই সাবটেক্সটটি তারই অর্ন্তগত। খুব গভীরে যাবার অবকাশ এখানে নেই। উদাহারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে সেই হেগেলের কথা যার দ্বান্দ্বিকতার কাছে মার্কসবাদের রয়েছে জন্মের ঋণ। হেগেল আমার প্রিয় মার্কসপূর্ব দার্শনিক। আমি বহুদিন হেগেলকে পাঠ করেছি স্তালিনবাদের বিপরীতে মার্কসবাদের মানবিক ব্যাখ্যার স্বার্থে। কিন্তু হেগেলীয় দর্শনের সেই সুগভীর প্রতীচ্যকেন্দ্রিকতা প্রাচ্যকে সভ্যতার মূলধারার বাইরে ঠেলে দিয়েছে, প্রাচ্যকে ইতিহাসবিহীন বলে অবজ্ঞা করেছে, তার ডিসর্কাসিভ অভিঘাতটি যে মার্কসবাদের সার্বজনীন বৈশ্বিক হয়ে ওঠার পথটিকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তাতে সন্দেহ নেই। মার্কস হেগেলের পায়ের উপর দাঁড় করিয়েছেন এই আপ্তবাক্যটি কোন মার্কসবাদী না জানেন! কিন্তু দ্বান্দ্বিক ভাববাদের যে ভূতটি মার্কস তাড়াতে পারেননি, যেই গলদটিকে মূল ধরে নাড়া দিতে পারেনি তাঁর ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তা হচ্ছে এর য়ুরোপকেন্দ্রিকতা। মার্কসের ইতিহাস পাঠের পদ্ধতি, এশিয়াটিক উৎপাদন পদ্ধতির ব্যতিক্রমটি বোঝা সত্ত্বেও, শেষ জীবনে ধনতন্ত্রের স্তর এড়িয়ে রুশী কৃষক সমাজের সরাসরি সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনার কথা ভাবা সত্ত্বেও, শেষ অব্দি অনিবার্যভাবে য়ুরোপকেন্দ্রিক। ইতিহাস এখানে পঠিত হয় য়ুরোপকে মডেল ধরে। আধুনিক ধনতন্ত্রের যে বিকাশটি য়ুরোপে ঘটেছে তা হয়ে উঠে ইতিহাসের সূত্রবদ্ধ প্রক্রিয়ার পরিণতি, ইতিহাসের মূল কেন্দ্র। অ-য়ুরোপীয় পৃথিবী এই মডেলে ব্যতিক্রম, প্রান্তিক, বাড়তি।

মার্কস বিপ্লব প্রত্যাশা করেছেন য়ুরোপ থেকে। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী থেকে, ধনতন্ত্র যেখানে বিকাশ লাভ করেছে সবচেয়ে বেশি, ফলত ধনতন্ত্রের সংকটও সেখানে সবচেয়ে গভীর।

মার্কসের যে প্রলেতারিয়েত ইতিহাসের ভবিষ্যত নির্মাতা, যার শ্রেণীস্বার্থ দাস-মালিক, সামন্ত, কিংবা বুর্জোয়া স্বার্থের মতো খন্ডিত নয়, বরং সার্বজনীন মানবিক স্বার্থের ধারক সেও কিন্তু আসলে এই য়ুরোপকেন্দ্রিকতার আত্মজ। “উৎপাদনের কোনো উপাদানের উপর যাদের নিজস্ব অধিকার নেই এবং নিজেদের শ্রমশক্তি বেচার ছাড়া যাদের বেঁচে থাকার আর কোন উপায় নেই”, এই প্রলেতারিয়েতটির অস্তিত্ব নেই মার্কসের সময়কার পৃথিবীর একটি বিস্তৃত অংশ জুড়ে। মানবজাতির মুক্তির এই সোনালী দূতরা বেরিয়ে আসছে ঐ য়ুরোপ থেকেই। য়ুরোপীয় বুর্জোয়ার বদলে য়ুরোপীয় প্রলেতারিয়েতের মুখের দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে ভবিষ্যতের শুভ দিনটির জন্য।

এই য়ুরোপকেন্দ্রিকতার দায়ভার মার্কসবাদীদের বইতে হয়েছে বেশ কিছু দিন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মধ্যে কেউ কেউ য়ুরোপীয় উপনিবেশবাদের সিভিলাইজিং মিশনকে প্রশংসা করেছেন প্রাচ্যের বর্বরদের সভ্যতার আলোতে নিয়ে আসার জন্য। গ্রামসীর মতো মেধাবী মার্কসবাদী, যার নিজস্ব বাসভূমি সার্ডিনিয়া ছিল ইতালীয় জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিকতার বাঁধনে বাঁধা, তিনি পর্যন্ত য়ুরোপকেন্দ্রিকতার ডোমেইন অ্যাজাম্পশনগুলো থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি।

কিন্তু এই য়ুরোপীয় কথনটির পাশাপাশি একটি প্রতিকথনও ধীরে ধীরে দানা বেঁধেছে। মার্কসীয় ঐত্যিহের ভেতরেই গ্রামসী অক্টোবর বিপ্লবকে বলেছিলেন দাস ক্যাপিটাল এর বিরুদ্ধে বিপ্লব। অক্টোবর বিপ্লব কিন্তু মার্কসবাদী তত্ত্বে য়ুরোপের ডিসেন্টোরিং এর একটি প্রারম্ভিক বিন্দু্ও আবার। বিপ্লবটি সংগঠিত হলো বৈশ্বিক ধনতন্ত্রের মূল কেন্দ্রে নয়, কিন্তু এর উপপ্রান্তে, আধা-য়ুরোপীয় রাশিয়ায়। চীন বিপ্লব তার য়ুরোপীয় কেন্দ্র থেকে মার্কসবাদী তত্ত্বকে আরেকটু দূরে ঠেলে দেয়। আমি মাওবাদী নই কিন্তু মাও জে দং এর চিন্তা ও পদ্ধতিতে মার্কসবাদের একটি অ-য়ুরোপীয় ধারা তৈরির সেই প্রক্রিয়াটি আছে, আমি প্রচন্ড আবেগ ও মনোযোগের সাথে তা অধ্যয়ন করি। ভিয়েতনামে, কোরিয়ায়, নক্সালবাড়ীতে, কিউবায় বিভিন্ন প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মার্কসবাদের অ-য়ুরোপীয় ন্যারেটিভ নির্মিত হয়েছে।

ফেনন তাঁর নিজস্ব জীবনের মতো, তাঁর চেহারার আদলের মতোই য়ুরোপীয় দর্শনের (হেগেলবাদ, মার্কসবাদ, অস্তিত্ববাদ, সাইকোঅ্যানালাইসিস) সাথে প্রাচ্যের কলোনাইজড অভিজ্ঞতার মিশেল ঘটিয়েছেন। য়ুরোপ আর অ-য়ুরোপের সন্ধিস্থলে ফেনন দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিভাদীপ্ত, জেদী, মার্কসবাদের অ-য়ুরোপীয় কথনের একরোখা সাহসী কথক।

 

ছয়.

দুর্ভাগ্যের বিষয়, মার্কসবাদের এই রাজনৈতিক রূপান্তরের বিষয়ে খবর রাখেন না বেশিরভাগ পোস্টমর্ডান লেখকই। এনলাইটেনমেন্টের যে মাত্রাটির ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন তা হচ্ছে এর এপিসটোমলজিক্যাল উত্তরাধিকার (কোনো কোনো পোস্টমর্ডানিস্টের অ্যান্টি-এপিসটোমলজিও তো আসলে এপিসটোমলজিক্যাল বিবৃতি।)

এনলাইটেনমেন্ট আধুনিক যুক্তিবোধকে আধিপত্যের আসনে বসিয়েছে। যুক্তির বাইরে অভিজ্ঞতার বিশাল ক্ষেত্রটিকে এপিসটেমিক ভায়োলেন্স এর শিকার করেছে। মার্কসবাদ আধুনিক যুক্তির লোগস কে আনক্রিটিক্যালি গ্রহণ করে, এর ডিকনস্ট্রাকশন করে না, এর পেছনে যে ক্ষমতা/জ্ঞানের নেক্সাস ক্রিয়াশীল তার ব্যাখ্যায় যায় না। মার্কস জীবনের সবকিছু ক্রিটিক করার কথা বলেন কিন্তু তাঁর তত্ত্বের এপিসটোমলজিক্যাল ভিত্তিটিকেই প্রশ্ন করেন না কখনো। যদিও আগে যেমন বলেছি এঙ্গেলসের টোটালাইজিং ঝোঁকটি মার্কসে নেই, বস্তবাদের যৌক্তিক গ্রান্ড ন্যারেটিভ মার্কসে নেই এই অর্থে। কিন্তু মার্কসের জ্ঞানের ভিত্তি আদ্যোপান্ত যৌক্তিক। মার্কসের টেক্সট এ পজিটিজম, প্রাগমাটিজম, রিয়ালিজম কিংবা ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম এর টানাপোড়ন দেখি আমরা। কিন্তু পৃথিবীকে বোঝার এই সবগুলো পদ্ধতিই এনলাইটেনমেন্ট প্রোথিত।

এই প্রসঙ্গে আমার কয়েকটি বক্তব্য রয়েছে। প্রথমত, পোস্টমর্ডানিস্টদের মতো যৌক্তিকতাকে ঢালাও ভাবে প্রত্যাখান করতে রাজি নই আমি। হাবারমাসের মতো আমিও বিশ্বাস করি আমি যদি যৌক্তিকভাবে প্রত্যাখান করি তাহলে যৌক্তিকতার ক্রিটিকের একটি শক্তিশালী পদ্ধতি থেকেই আমি নিজেকে বঞ্চিত করব। হাবারমাসের পুরোপুরি সমর্থক আমি নই। আর যৌক্তিকতার তত্ত্বের য়ুরোপকেন্দ্রিক ফাউন্ডেশনাল চরিত্রটি সম্পর্কে আমি সজাগ, কিন্তু তিনি কিংবা ফ্রাঙ্কফুট স্কুলে তার পূবসূরী হার্বাট মারক্যুসা যেমন ম্যাক্স ভেবারের পথ ধরে ইনস্ট্রুমেন্টাল র‌্যাশনালিটি এবং ক্রিটিক্যাল র‌্যাশনালিটি-র বিভাজন করেন আমার মনে হয় তার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যৌক্তিকতা কোনো একক প্রত্যয় নয়। জ্ঞানের লক্ষ্য এবং আহরণের পদ্ধতিভেদে যৌক্তিকতার প্রকারভেদ ঘটে। আজকের বিশ্বে বাজারী অর্থনীতির, বুর্জোয়া রাষ্ট্রের, মুনাফামনস্ক ভোগবাদী ব্যক্তির যে আদর্শিক ফ্রেমটি নির্মিত ও প্রসারিত হচ্ছে সেটি যে অর্থে র‌্যাশনাল, জীবনের বিপ্লবী রূপান্তরের তত্ত্ব মার্কসবাদ সেই অর্থে র‌্যাশনাল নয়। মার্কসবাদের মধ্যে যে যৌক্তিকতা নিহিত, তার চরিত্রটি বিপ্লবী-ক্রিটিক্যাল।

দ্বিতীয়ত, তবু মার্কসবাদকে ক্রিটিক্যাল র‌্যাশনাল অভিধাটি পরিয়ে দিয়েই কিন্তু আমাদের দায়দায়িত্ব ফুরিয়ে যাচ্ছে না। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের মনোযোগী হতে হবে যৌক্তিকতার ঐতিহাসিক এপিসটোমলজিক্যাল ভিত্তিটিকে পরীক্ষা করে দেখার ব্যাপারটিতে। মার্কসের সোশ্যাল এপিসটোমোলজি-র বিস্তৃত আলোচনায় না গিয়েই বলি, জ্ঞানে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী প্রেক্ষিতটির ব্যাখ্যা করে মার্কসবাদ দর্শনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কিন্তু কাজটা ওখানে থেমে গেলেই হবে না। জ্ঞানের সাথে সমাজের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতার বিন্যাসটি বোঝার জন্য যদি আমাদের ফুকো পড়তে হয়, প্রতীচ্যের লগোসেন্ট্রিক ঐতিহ্যে যৌক্তিকতার অবস্থান বোঝার জন্য যদি আমাদের দেরিদার সাহায্য নিতে হয় তবে তাই হোক না কেন। মজার ব্যাপার এ ধরণের কাজগুলোর ইঙ্গিত কিন্তু মার্কসবাদী ঐতিহ্যের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। গ্রামসীর ইংরেজি অনুবাদ থেকে যখন পড়ি ‘পলিটিক্স ইজ দ্য ফার্স্ট, দ্য লাস্ট, অ্যান্ড মেডিয়েটিং লিংক টু দ্য রিয়েল’ ফুকোর ক্ষমতা/জ্ঞান নেক্সাস এর আগাম আভাস আমরা পেয়ে যাই। আজকের প্রেক্ষিতে মাইকেল রায়ানের মার্ক্সসিজম অ্যান্ড ডিকনস্ট্রাকশন মার্কসবাদ ও অবিনিমার্ণ তত্ত্বের আলাপচারিতার একটি চমৎকার উদাহারণ। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক রিথিঙ্কিং মার্ক্সসিজম জার্নালটি, যারা কয় বছর পর পরই আমহার্স্টে রিথিঙ্কিং মার্ক্সসিজম সম্মেলনটির আয়োজন করেন, এই ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। লাকাউ এবং মাউফি-র তত্ত্বের একটি বিরাট অংশের প্রতি আমার অনুমোদন নেই কিন্তু একটা পোস্টমার্ক্সসিস্ট অবস্থান থেকে এনলাইটেনমেন্টর এপিসটোমলজিক্যাল ভিত্তিটির প্রতি তাঁদের সমালোচনা মনোযোগ দাবি করে।

তৃতীয়ত, সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীতে, বর্ণে, লিঙ্গে, জাতিসত্তায়, ধর্মে, যৌন আচরণে যৌক্তিকতার যে বিভিন্ন রূপগুলো ছড়িয়ে রয়েছে মার্কসবাদীদের প্রয়োজন সেগুলোকে অধ্যয়ন করা। এনলাইটেনমেন্ট যৌক্তিকতার যে অখন্ড, সংহত রূপটিকে তুলে ধরে তার বিপরীতে বহুমাত্রিক, বিচিত্র যৌক্তিকতার ধারণাটিকে মার্কসবাদী তত্ত্বে নিয়ে আসতে হবে। দার্শনিক স্পেকুলেশ এর স্বার্থে নয়, বরং সাম্যবাদের আন্দোলনকে একটি গণতান্ত্রিক, বহুত্ববাদী ভিত্তির উপর দাঁড় করানোর জন্যই এটি দরকার।

চতুর্থত, যৌক্তিকতার এপিসটোমলজিক্যাল ভিত্তিটিকে প্রশ্ন করার দায়িত্বটির সাথে সম্পর্কিত হচ্ছে যৌক্তিকতার সাথে জ্ঞানের অন্যান্য পদ্ধতিগুলোর সম্পর্কগুলো পাঠ করা। আজকের পোস্টমর্ডানিস্টদের অনেক আগে সোরেল শ্রমিক আন্দোলনে মিথের ভূমিকাটি বুঝেছিলেন মার্কস ও নীৎসের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল মার্কস, নীৎসে, ভেবার এবং ফ্রয়েডকে আত্মস্থ করে ক্রিটিক্যাল তত্ত্বকে সনাতনী যৌক্তিক জ্ঞানের পদ্ধতির বাইরে টেনে নিতে চেয়েছিলেন।

মার্কসবাদের সাথে আধ্যাত্মিকতার সম্পর্কটির কথা আগেই বলেছি। লিবারেশন থিওলজির আওতার বাইরেও লোকায়ত মিথের সাথে বিপ্লবী রাজনীতির যে মিথস্ক্রিয়াটি কাজ করছে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে, কিংবা ইরানের মৌলবাদবিরোধী বামশক্তির একটি অংশে যেমন হচ্ছে ধর্ম ও সাম্প্রতিক বিপ্লবী রাজনীতির সংলাপ, আমাদের মার্কসবাদীদের সে দিকে সজাগ চোখ তো রাখতেই হবে।

 

সাত.

আধুনিক এনলাইটেনমেন্ট এপিসটোমোলজি-র প্রেক্ষিতে মার্কসবাদের অবস্থানটি বুঝতে গেলে বিজ্ঞানের সাথে মার্কসবাদের সম্পর্কটিও আমাদের বোঝা দরকার। মার্কসবাদ কি একটি বিজ্ঞান? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে কী ধরনের বিজ্ঞান? আর বিজ্ঞান না হয়ে থাকলে মার্কসবাদ কী ধরনের জ্ঞানের তত্ত্ব?

এই বির্তকের একদিকে রয়েছে তাঁদের অবস্থান যাঁরা উনবিংশ শতাব্দীর পজিটিভিজমের ধরণের মার্কসবাদকে একটু পুরোদস্তুর বিজ্ঞান মনে করেন। অন্যদিকে রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক চরিত্রটির চেয়েও এর ক্রিটিক্যাল দর্শনের দিকটাকে বেশি গুরুত্ব দেন। এটা সত্যি যে ১৮৪৪ ম্যানুস্ক্রিপ্ট এর মতো একেবারে প্রথমদিকের রচনাতেও মার্কস প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের ঐক্যের কথা বলেছেন। এই অতিসরলীকৃত ঐক্যের ধারণাটিতে যে পজিটিভিস্ট ছায়াটি আমরা দেখি মার্কসকে একেবারে পুরোপুরি তা কখনো ছেড়ে যায়নি। কখনো কখনো তা বরং কিছুটা দানা বেঁধেছে।

কিন্তু শেষ বিশ্লেষণে, আমি আগে যেমনটি বলেছি, মার্কসের বুদ্ধিবৃত্তিক মেজাজ একটি টোটালাইজিং সিস্টেম গড়ে তোলার পক্ষে ছিল না। দ্বান্দ্বিকতার পদ্ধতিটিকে ইতিহাসের ক্ষেত্রে নয় শুধু, তাবৎ প্রকৃতি বোঝার একটি গ্রান্ড ন্যারেটিভ তৈরি করার আসল কাজটি করেছেন এঙ্গেলস। পরবর্তীকালে মহীরুহ বিস্তৃত করে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মূলধারা থেকে শুরু করে সোভিয়েত মডেলের তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ পর্যন্ত এই ন্যারেটিভ বিস্তৃতি পেয়েছে।

এই প্রবণতার বিপরীতে যাঁরা রয়েছেন তাঁদের কাছে মার্কসবাদের মূল আকর্ষণটি এর বৈজ্ঞানিকতা নয়। মার্কসবাদের আসল বিসয়টি হচ্ছে জগৎ সম্পর্কে এর একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। মার্কসবাদের এই দার্শনিক পাঠকরা মার্কসবাদের হেগেলীয় উপাদানটির উপর জোর দেন, হেগেলের দ্বান্দ্বিক দার্শনিকতার মধ্যে মার্কসবাদের মূল শক্তিটি খুঁজে পান।

লেনিন, মার্কসবাদের যে হেগেলীয় পাঠটি শুরু করেছিলেন ১৯১৪ সালে, মার্কস-পরবর্তী মার্কসবাদে সেটিই প্রথম জোরালো হেগেলীয় পঠন-পাঠন। রায়া ডুনাভস্কায়া কিংবা কেভিন এন্ডারসন যেমন দেখিয়েছেন, লেনিনের চিন্তার বিকাশের অন্যান্য অংশে যান্ত্রিকতার উপস্থিতি সত্ত্বেও লেনিন এই অর্থে অবশ্যই হেগেলীয় মার্কসবাদী ঐতিহ্যটির অর্ন্তগত।

এই দার্শনিক প্রবণতার আরেকজন প্রধান পুরুষ হাঙ্গেরীয় তাত্ত্বিক জর্জ লুকাস। কিছুটা পরস্পরবিরোধী টুকরো-টাকরা চেহারায় এই পাঠটি ছড়িয়ে রয়েছে গ্রামসীর টেক্সট এর বিভিন্ন কোণেও। গ্রামসী, আমরা জানি, মার্কসবাদকে ‘প্রাক্সিসের ক্রিটিক্যাল দর্শন’ বলে উল্লেখ করেছেন সেন্সরশীপের কড়া চোখ এড়াতে। কিন্তু মার্কসবাদকে প্রাক্সিসের দর্শন হিসাবে দেখার উৎসটি কিন্তু গ্রামসীর চিন্তার আরো গভীরে নিহিত। এই হেগেলীয় পাঠটিকে আমরা দেখি ফ্রাঙ্কফুট স্কুলে, এরিক ফ্রমে, মার্লো পণ্টি কিংবা সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী মার্কসবাদে, লাফেইউ কিংবা অন্যান্যদের ফরাসি মানবতাবাদী মার্কসবাদে, ষাট দশকের সিচুয়েশনালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এ কিংবা সোভিয়েত বৃত্তের পূর্ব য়ুরোপের ডিসিডেন্ট মার্কসবাদে।

হেগেলীয় মার্কসবাদের সাথে আজকের পোস্টমর্ডানিজমের একটা বুদ্ধিবৃত্তিক যোগসূত্র রয়েছে। গ্রামসী সাথে পোস্টস্ট্রাকচারলিজমের ডিসকার্সিভ সংযোগটির কথা তো আজকাল অনেকেই বলেন। এডওয়ার্ড সাইদ, বেরী স্মার্ট, স্টুয়ার্ট হল, কিংবা কর্ণেল ওয়েস্টের লেখায় আমরা এই গ্রামসী-ফুকো আলাপচারিতাটি দেখি। ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের প্রথম প্রজন্মের কয়েকজন প্রধান সদস্যের যে উত্তরাধিকারটি পোস্টমর্ডানিজম পর্যন্ত চলে এসেছে তার ধরনটি আরো সুস্পষ্ট। হরকহেইমার, অ্যাডোরনো, কিংবা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের থেকে ফুকো আর দেরিদার ধারাবাহিকতাটি বোঝার জন্য খুব বেশি প্রতিভার প্রয়োজন পড়ে না। প্রতিভাবান ইকসেন্ট্রিক গাই ডেবোরড তো সোজাসুজি দাঁড়িয়েছিলেন মার্কসবাদ আর পোস্টমর্ডানিজমের বাঁকটিতে। বদরিলার্দের মতো অনেকেই পোস্টমর্ডানিজমে এসেছিলেন একটি হেগেলীয় অতীত থেকে।

ফুকো, দেরিদা

ফুকো, দেরিদা

মূলধারার বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের এলিয়েনেটিং দিকটির বিপরীতে এই হেগেলীয় লেখকেরা আমাকে একটি ভিন্ন বিকল্প, অপজিশনাল মার্কসবাদের স্বাদ দেন। আমার মনে হয়, মার্কসবাদের প্রচলিত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ইতিহাস উপলদ্ধির একটি যান্ত্রিক বয়ান তৈরি করে। স্বতঃস্ফূর্ত, আনপ্রিডিক্টেবল যে মানবিক দিকটি ইতিহাসের স্বাধীন নির্মাণে ক্রিয়াশীল, তার গুরুত্বটি হারিয়ে যায় প্রাণহীন বৈজ্ঞানিক সূত্রায়নে। আরোপিত বৈজ্ঞানিকতা প্রাক্সিস কিংবা রিফ্লেক্টিভ প্রাকটিস এর প্রাণবন্ত গতিময়তাকে শুকনো তত্ত্বের আঁটোসাটো কাঠামোয় বেঁধে ফেলে। কিন্তু স্নানের জলের সাথে আমরা যাতে শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলে না দেই সে বিষয়ে আমাদের সর্তক থাকতে হবে। একটি নির্দিষ্ট ধাঁচের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিরোধিতা করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিকতার পুরো ধারণাটিকে আমাদের বাতিল করে দিলে চলবে না। মার্কসবাদের একটি গ্রহণযোগ্য বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক ন্যারেটিভ তৈরি করার জন্য আমাদের হেগেলের বাইরেও অন্যান্য উৎসের সন্ধান করতে হবে।

মূলধারার ‘বৈজ্ঞানিক’ মার্কসবাদীরা তাঁদের বিজ্ঞানকে দায়িত্ব দেন জীবনের ‘নিষ্ঠ’ একগেজক্ট প্রতিফলনের। এই বিজ্ঞান প্রকৃতিকে ক্রমান্বয়েই উন্মোচিত করবে, তাতে অনুপ্রবেশ করবে, শেষে দখল করে নেবে তাকে পুরোপুরি। এঙ্গেলসের অ্যাণ্টি-ডুরিং থেকে লেনিনের ম্যাটেরালিজম অ্যান্ড ইম্পেরিয়ো-ক্রিটিসিজম বিজ্ঞানের এই একমাত্রিক ধারণাটির উপর প্রতিষ্ঠিত। বাস্তবতার নিষ্ঠ কলোনাইজিং আয়ত্তীকরণের ব্যাপারটি যে আসলে মোটেই এত সোজাসাপটা নয় বিংশ শতাব্দীর হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব কোয়ান্টাম মেকানিকস, কেওস থিওরি থেকে শুরু করে অনেক ন্যারেটিভ আমাদের তা জানিয়েছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের শাস্ত্র মুখস্থ করে আজো যারা ইতিহাসের ‘অনিবার্য’ ‘অবজেক্টিভ’ নিয়মে ধনতন্ত্রের সংকট ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণের নিশ্চয়তা দেন আমাদের বিজ্ঞানের এই নতুন তাত্ত্বিক উদ্ভাবনের খবরগুলো তাঁরা রাখে না। উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের দর্শনের ওই বিতর্কের খবরগুলোও রাখেন না যেখানে প্রকৃতি ও সমাজের হদিস নেবার জন্য ভিন্ন বিজ্ঞানের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের নিয়মগুলো যে সমাজবিজ্ঞানের কাজে খু্ব একটা লাগবে না মার্কসবাদের নামে যারা অগাস্ট কোঁৎ-এর পচা শব্দটিকে বহন করে চলেছেন তাঁরা তার খবর রাখেন না।

আমি ধনতন্ত্রের সংকটটিকে অস্বীকার করছি না। বরং আমার মার্কসবাদী কনভিকশনটি প্রায় পুরোপুরি দাঁড়িয়ে রয়েছে ভবিষ্যতের এলিয়েনেশনহীন সমাজের স্বপ্নে। ধনতন্ত্রের সংকটের মধ্য দিয়েই যার বীজটি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। এই সংকটের এবং তার বিপ্লবী উত্তরণের সম্ভাবনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাতেও আমার আপত্তি নেই। পোস্টমর্ডান সমালোচকদের মতো বিজ্ঞানকে প্রত্যাখান করি না আমি।

কিন্তু যে ব্যাপারটি এখানে দরকারি তা হচ্ছে বিজ্ঞানের একটি নন-পজিভিস্ট আখ্যান তৈরি করা। বিজ্ঞান আমাদের জীবনের নির্ভুল খবর দেয় কিনা সেটা দরকারি বিষয় নয়। দরকারি বিষয় হচ্ছে এটা বোঝা যে বিজ্ঞান বাস্তবতার একটি মোটামুটি রিজনেবল, কংক্রিট, কোহেরিয়েন্ট, ওয়ার্কেবল চিত্র উপস্থাপিত করে। মার্কস যখন থিসিস অফ ফয়েরবাখ এ বলেন বাস্তবতার অস্তিত্ব আসলে রয়েছে কিনা সেটা দরকারি নয়, আসল কথাটি হচ্ছে বাস্তবতার কংক্রিট দিকটি বোঝা, আমরা তখন মার্কসের প্রাগমেটিক এপিসটোমলজি’টির ইঙ্গিত পাই। বাস্তবতা উন্মোচনে বিজ্ঞানে রিয়ালাস্টিক ও প্রাগমেটিক ব্যাখ্যার বিরোধটি কিন্তু নিছক বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন নয়। এটি আসলে প্রতিনিধিত্ব করে বাস্তবতা পাঠ এবং পাল্টানোর দুটি ভিন্ন পদ্ধতির। বিজ্ঞানের প্রাগমেটিক ব্যাখ্যা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের গ্রান্ড ন্যারেটিভ এর মতো ইতিহাসের ভূত-ভবিষ্যতের পূর্ণাঙ্গ কেচ্ছা তৈরি করে না। বিজ্ঞানের দায়িত্ব যেহেতু বাস্তবতার কংক্রিট ওয়ার্কেবল চিত্র নির্মাণ করা, তখন একাধিক চিত্র নির্মাণের সম্ভাবনা এই ব্যাখ্যার মধ্যেই নিহিত থাকে। বাস্তবতার একটি গ্রান্ড ন্যারেটিভ এর বদলে বিভিন্ন ন্যারেটিভ নির্মাণের কথা ভাবতে পারি আমরা এখন। ভবিষ্যতকে ক্লোজ-এন্ডেড, ডির্টারমিনেস্টিক একটা উপাখ্যান হিসেবে দেখি না আমরা আর, উৎপাদন শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতায় যাতে অমোঘ বিকাশ ঘটবে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার। ইতিহাস এখন হয়ে ওঠে ওপেনটেক্সচারড, প্রবেলাইজড একটি কথন – আমাদের লড়াইয়ে আমাদের প্রাক্সিস এ কিছুটা এবড়োথেবড়ো, কিছুটা অনিশ্চিত, কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা রচিত হবে। কমিউনিজম আমরা চাই তা অনিবার্য বলে নয়, কমিউনিজম আমরা চাই কারণ আমাদের একে দরকার। প্রাগমাটিক বিজ্ঞান এই উন্মুক্ত লড়াইয়ে আমাদের সাহায্য করবে।

উপরন্তু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভাজনটি আমি ধরে রাখতে চাই। এটা ঠিক, আগেই যেমন বলেছি, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিজেই উনবিংশ শতাব্দীর ডিটারমিনেস্টিক জমিটির উপর দাঁড়িয়ে নেই আর। তবুও মানবিক স্বাধীনতার কতগুলো বিশেষ দিক রয়েছে যার প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক সূত্রায়ন সম্ভব নয়। মার্কসবাদের একটি বিশেষ রকমের মানবিক সমাজবিজ্ঞান চাই আমরা। মানুষের ইতিহাস নির্মাণের স্বার্থেই এই বিজ্ঞানটি দরকার।

 

আট.

পোস্টমর্ডানিস্টরা যেমন অভিযোগ করেন, মার্কসবাদ কি তেমনি একটি এসেনশিয়ালিস্ট দর্শন? মার্কসবাদের এসেন্স এর প্রশ্নটিকে অন্তত দুই ভাবে উত্থাপিত করা যায়। মানুষের স্পেসিস বিং (specie being) সম্পর্কে মার্কসীয় ধারণাটির ভিত্তি হচ্ছে একটি আদি, মৌলিক উপাদান – স্বাধীন, সমবায়ী সৃজনশীল শ্রম। ধনতন্ত্র এই আদি উপাদানটি থেকে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। স্পেসিস বিং এর এই ধারণাটি সম্পর্কে তো প্রশ্ন উত্থাপন করাই যায়। এ ব্যাপারে আগে উল্লেখিত ফুকো-চমস্কি বির্তকে আমি ফুকোর পক্ষে। মানবচরিত্রকে আমি দেখি ঐতিহাসকিভাবে নির্মিত পরিবর্তনশীলতা হিসেবে। এই পরিবর্তনশীলতার একটি ধারণা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মধ্যেও আছে, কিন্তু আদি উপাদানের অরিজিনাল মিথ থেকে মার্কসীয় তত্ত্ব নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি কখনো। বলে রাখা ভাল, আলথুসারের মতো স্ট্রাকচারালিস্ট মার্কসবাদী যাঁর রচনায়া ইতিহাসচেতনার স্থান নেই একেবারেই, তিনিও কিন্তু স্পেসিস বিং এর এই ধারণাটির বিরোধিতা করেছেন।

এসেন্স এর প্রশ্নটি আরেকভাবেও উত্থাপতি করা যায়। মার্কসবাদ কি কতগুলো এসেনসিয়াল নৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ করে? মার্কসবাদ কি সাম্য, স্বাধীনতা এবং সহোদরত্বের ক্যাটাগরিগুলোকে একটা বৈশ্বিক স্ট্যাটাস প্রদান করছে না? এই ক্যাটাগরিগুলো কি মার্কসবাদের একটি এসেনসিয়ালিস্ট অবয়ব তৈরি করছে না?

এর উত্তরে আমি বলব, যে কোনো ডিসকোর্সেরই একটি আর্কেমিডিয়ান পয়েণ্ট থাকা উচিত। ধরা যাক, আমরা যখন ফুকো পড়ি, আমাদের কিন্তু কোনো স্পষ্ট তাত্ত্বিক/নৈতিক ধারনা থাকে না কেন উন্মাদনা, অপরাধ ও শাস্তি, চিকিৎসা কিংবা যৌনতার ক্ষেত্রে তাঁর কথনে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। ন্যানসী ফ্রেজার কিংবা লিন্ডা নিকলসনের মত নারীবাদী লেখকরা ফুকোর লেখার ব্যাপারে এই প্রশ্নটিই তুলে ধরেছেন। এই আর্কেমিডিয়ান পয়েণ্টটি সম্পর্কে মার্কসবাদ অনেকবেশি ঋজু এবং সৎ। কতগুলো স্পষ্ট তাত্ত্বিক/নৈতিক প্রারম্ভবিন্দু থেকেই মার্কসবাদের ডিসর্কাসিভ অবয়বটি গড়ে উঠেছে।

কিন্তু সনাতনী মার্কসবাদীরা যখন, যেমন ধরা যাক, কমিউনিজমকেই মানবজাতির চূড়ান্ত মুক্তির পথ হিসেবে দেখেন তখন মার্কসবাদের নৈতিক পেন্ডুলামটি আবার একেবারে উল্টোদিকে হেলে পড়ে। মার্কসবাদের মধ্যে এসেনসিয়ালিজম এর ফাঁদ পাতা হয়ে যায়।

এ ব্যাপারে স্টিভেন বেস্ট এবং ডগলাস কেলনর তাঁদের ‘পোস্টমর্ডান থিওরি: ক্রিটিক্যাল ইন্টারোগেশন’ এ কতগুলি জরুরি কথা বলেছেন। সনাতনী মার্কসবাদের কিংবা আজকের হ্যাবারমাসের ‘ইউনির্ভাসাল কোয়াসিফাউন্ডেশনলাজিম’ এর সাথে একমত নন বেস্ট এবং কেলনার। কিন্তু তাঁরা একটি সার্বজনীন নৈতিক মাপকাঠির কথা বলেন। এই সার্বজনীনতাটি কিন্তু ট্রান্সসেনডেন্টাল এবং এসেনসিয়ালিস্ট নয়। বরং একে গড়ে উঠতে হবে ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বেস্ট এবং কেলনারকেই উদ্ধৃত করি না কেন?

We would argue that these (historically) constructed universal rights and freedoms are themselves provisional, constructed, contextual, and the product of social struggle in a specific historical context, although human rights and democratic values are to be defended and extended, they should not be mystified. Consequently, we would provide a histories rather than an (sic) philosophical foundation for these values, interpreting them as the product of struggle and as the progressive of a specie social-historical situation rather than as essential features of human begins or quasitranscendental postulates of a specific sort, deriving from language or communication.

আমাদের যুগের মার্কসবাদকে এসেনসিয়ালিজম নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবে নির্মিত নৈতিক মাপকাঠিগুলোকেই ধারণ করতে হবে। ভবিষ্যতের বিপ্লবীরা হয়তো ভিন্ন লক্ষ্যের জন্য, ভিন্ন একটি আর্কেমিডিয়ান পয়েণ্ট থেকে তাঁদের গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিk করবেন, তাঁদের ব্যারিকেড গড়ে তুলবেন, তাঁদের তত্ত্ব রচনা করবেন।

 

নয়.

শুরুতেই বলেছি আধুনিকতার বিস্তৃত কথন তৈরি এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। মার্কসবাদ কিংবা পোস্টমর্ডানিজমের পুংখানুপুংখ বিশ্লেষণও আমার লক্ষ্য ছিল না এখানে।

এযাবৎ আমি আধুনিকতার সংকটের স্বরূপ নির্ণয়ে রত দুটো ন্যারেটিভের মধ্যে একটি আলাপচারিতার স্পেস তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কাজটি অনিবার্যভাবেই অসম্পূর্ণ। কিন্তু অসম্পূর্ণ এই কাজগুলো লাগাতার করে যাওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই কিছু।

 

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

পিয়াস করিম

পিয়াস করিম: শিক্ষক, সমাজ-বিজ্ঞানী, পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →