ক্রিয়েটিভ
নাগরিক মানে এখনো মধ্যবিত্ত, ঢাকা শহরে; লাইফস্টাইল-ই হইলো তার ধর্ম; রিলিজিওন তার কালচার না, কালচার হইলো রিলিজিওন, এইরকম মিনিংয়ের ডুয়ালিটি-ই তারে মোর ফিট কইরা তুলতে পারে, সারভাইভালের লাইগা। এইখানে ট্রুথ সেইটা না যা আমরা বইলা ফেলতে পারি, ট্রুথ হইলো যেইটা আমরা বুঝাইতে পারি, না বইলাই!
__________________________________________________
ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র ইন্ট্রোভার্ট, শাই, জেদি ও সদাবিষন্ন রাইভি চলে যায় নীলক্ষেতে। নীলক্ষেতের বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে সে কুকুর দেখে, কুকুরের দাম জিজ্ঞাসা করে, জাত জিজ্ঞাসা করে। তারপর সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফিরে আসে। ঢাকার একটা লো ক্যাটাগরির প্রাইভেট য়্যুনিভার্সিটিতে পড়ে রাইভি। এই দুনিয়াতে তার আছে বড় ভাই- রায়হান ও তার স্কুল শিক্ষিকা মা। তার পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যায়। বড় ভাই রায়হান একটা ছোটখাটো চাকরি করে। অনার্স কমপ্লিট করতে পারে নাই বলে সে ভালো চাকরি পায় নাই। যাই হোক। রাইভি কুকুরের দোকানে ঘুরে কুকুর চুস করে। সে জার্মান শেফার্ড কিনবে বলে ঠিক করে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
বাসায় গিয়ে সে মা’কে বলে তাকে একটা জার্মান শেফার্ড কিনে দিতে। মা শুনে বলে- ‘খবরদার, কুত্তার কথা মুখে ও আনা যাবে না। কোন কুত্তা পালা যাবে না। কুত্তা ঘরে থাকলে ঘরে ফেরেশতা ঢুকে না।’ মা-কে রাইভির জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে- ফেরেশতারা কি ভীতু নাকি যে কুত্তা কে ভয় পায়। কিন্তু জিজ্ঞাসা করে না। মায়ের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সে বড় ভাইকে গিয়ে ধরে। সে কোন দিন বড় ভাইয়ের কাছে কিছু আবদার করে নাই। বড় ভাই রায়হানের কলিজার টুকরা রাইভি। ছোট ভাইয়ের আবদার পূরণ করতে না পারলে সে কিসের বড় ভাই। সে রাইভিকে কথা দেয়- সে অবশ্যই কিনে দিবে। কিন্তু তাদের মা কোন মতেই কুকুর কিনাতে সাঁয় দেয় না। তখন রাইভি মা-কে থ্রেট করে জার্মান শেফার্ড কিনে না দিলে সে পড়াশুনা ছেড়ে দিবে। রাইভির জেদ দেখে মা শেষবেশ রাজি হয়। সাথে সাথে বড় ভাই রায়হান চলে যায় নীলক্ষেত। কিন্তু কুকুরের দাম শুনে মাথা নষ্ট হয়ে যায় রায়হানের। তারা কুকুর না কিনেই ফিরে আসে। কারণ জার্মান শেফার্ড কিনার মতো ইনাফ পয়সা নাই রায়হানের পকেটে। রায়হান রাইভিকে ওয়েইট করতে বলে। নেক্সট মান্থের বেতন পেলেই সে রাইভিকে একটা জার্মান শেফার্ড কিনে দিবে।
এদিকে রায়হানের এক বন্ধু তারে খবর দেয় যে মিরপুরের পাশা নামধারী এক লোকের পোষা মা জার্মান শেফার্ড তিনটা বাচ্চা প্রসব করেছে। এর মধ্যেই সে দুইটা বাচ্চা বিনামূল্যে দিয়ে দিয়েছে। একটা বাকি আছে। শেষ শিশু শেফার্ডটিও সে বিনামূল্যে কাউকে দিয়ে দিতে চায়। রায়হান সাথে সাথেই পাশাকে কল করে বলে- কুকুরের বাচ্চাটা কাউকে না দিতে। আগামীকাল তারা গিয়ে বাচ্চা জার্মান শেফার্ডটাকে নিয়ে আসবে। রাইভির খুশি কে দেখে আর! রাইভি কাঠ জোগাড় করে জার্মান শেফার্ডের জন্য একটা ঘর বানিয়ে ফেলে। তাছাড়া আরো একটা জরুরি কাজ করতে হবে। সেটা হলো কুকুরের একটা নাম দিতে হবে। দুই ভাই নেট ব্রাউজ করে, মাথা খুঁটিয়ে একের পর এক নাম প্রস্তাব করে। শেষ পর্যন্ত ফিক্সড হয়- কুকুরের নাম হবে ‘ক্রিয়েটিভ’।
পরদিন সকাল সকাল দুই ভাই চলে যায় মিরপুর- পাশার বাসায়। রাইভির খুব পছন্দ হয় কুকুরটাকে। রায়হান পাশাকে জিজ্ঞাসা করে কেনো সে এই কুকুর দিয়ে দিচ্ছে, তাও আবার একদম ফ্রি তে। উত্তর দিতে গিয়ে ইমোশনাল হয়ে যায় পাশা। সে খুব শখ করে এক জোড়া জার্মান শেফার্ড কুকুর কিনেছিলো। কিন্তু কিনার আগে কি সে জানতো বিদেশি কুকুর পালা ফকিরনির পোলাদের কাম না। জোড়া শেফার্ডের খরচ চালাতেই তার জান বের হয়ে যায়। আবার বাচ্চা! পারলে সে এই বাচ্চার বাপ- মাকেও দিয়ে ফেলতো। কিন্তু মায়া পড়ে গেছে বলে দিতে পারছে না। কুত্তা পালার খরচ ও অনেক! এই ইনফর্মেশন শুনে কুকুর নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায় রায়হান। রায়হান ছোট ভাইকে বলে- প্রমোশনের আগে কুত্তা পালার কথা ভাবা ও যাবে না। ফলে ‘ক্রিয়েটিভ’কে না নিয়েই খালি হাতে ফিরে যায় দুই ভাই।
এরপর থেকে রাইভি রায়হানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, য়্যুনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, ঠিক টাইমে খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। রায়হান আদর করে ছোট ভাইকে বোঝায়। জাস্ট একটা বছর ওয়েইট করতে। এক বছর পরে সে এক জোড়া জার্মান শেফার্ড কিনে দিবে ছোট ভাইকে। কিন্তু জেদি রাইভিকে বুঝানো কি এতো সহজ! রায়হানের এক বন্ধু আছে নাম বাহাদুর। বাহাদুরকে খুব পছন্দ করে রাইভি। রায়হান বাহাদুরকে বাসায় ডাকে ছোট ভাইকে বুঝ দিতে। বাহাদুর আসে। কিন্তু বাহাদুর ছোট ভাইকে বুঝ না দিয়ে উল্টা বুঝায়- ‘ছোড ভাই, এই বয়সে যদি কুত্তা না পালো তবে কি বুড়া হইলে পালবা? কুত্তা পালার পারফেক্ট টাইমে আছো। কুত্তা পালা এখন ফরয কাজ।’ বাহাদুর রাইভিকে বুঝ না দিয়ে উল্টা রায়হানকে বোঝায় যে কুকুর পালা কোন ব্যাপার-ই না। বাচ্চা কুত্তাকে যা যা খাবার খাওয়াতে অভ্যস্ত করানো হবে তাই তাই সে খাবে। যেহেতু মাংস এফোর্ট করা যাবে না। সো মাংস দেয়া যাবে না। দিতে হবে ভাত আর সবজি। মাংসাশী না বানিয়ে এই কুত্তাকে বানাতে হবে ভেজেটেরিয়ান। বাহাদুর নিজেও ভেজেটেরিয়ান। বাহাদুরের কথা শুনে কনভিন্সড হয় রায়হান। সুতরাং তারা এক্ষুণি গিয়ে ‘ক্রিয়েটিভ’কে নিয়ে আসবে। তবে একটা শর্ত- ‘ক্রিয়েটিভ’কে মাংস খাওয়ানো যাবে না। ‘ক্রিয়েটিভ’ হবে ভেজেটেরিয়ান কুকুর।
রাইভি, রায়হান ও বাহাদুর চলে যায় মিরপুরে। মিরপুরে গিয়ে তারা দেখে ‘ক্রিয়েটিভ’কে নিতে এসেছে এক পাংক নওজোয়ান- মাহি। রায়হান পাশাকে শাসায় তাদের কুকুর কেনো এই পাংকুরে দেয়া হচ্ছে। পাশা জবাব দেয় এই প্রশ্ন ছুঁড়ে-‘ঐদিন নিয়া যান নাই কেন, মিয়া? আমি কি আপনার জন্য অপেক্ষা কইরা থাকুম? টাকা ছাড়া দিতাসিতো মাল মাথায় উঠে গেছে।’ রায়হান এই প্রশ্নের উত্তর জানে না। মাল মাথা থেকে কিভাবে নামিবে? মাথা একটু ঠান্ডা করে রায়হান বিনয়ের রাস্তা ধরে- ‘ডার্লিং পাংক, ভাইডি, তুমি যে গেটাপ নিসো এই এলাকাতো আর পুরান ঢাকা নাই মিয়া পুরা প্যারিস হয়া গেছে। তুমি ক্যান কুত্তা ফ্রি-তে নিবা? প্যারিসের সিস্টেমে চলো। প্যারিসে এইরকম একটা কুকুরের মালিক হইতে হইলে হিপ্পির বাচ্চারেও ক্যাশ ছাড়তে হবে। তুমি ভাই মার্কেট থেকে কিনো। আমার টাকা নাই। আমারে দিয়া দাও, ভাই। প্লিজ আমারে দান করে দাও, ভাই।’
কিন্তু মাহি গোঁয়ার। সে কুকুরের দাবি কোনমতেই ছাড়বে না। রায়হান এবার বাক্য গলা থেকে থ্রো করার স্টাইল চেইঞ্জ করে- ‘পাংকুর বাচ্চা, এই কুত্তা নিয়া তুই যাইতে পারবি না। একটা কল দিলে আশপাশের গলি থেকে এট লিস্ট আট নয়টা পোলা দশ মিনিটের ভিতর হাজির হয়ে যাবে। ব্লা, ব্লা, ব্লা।’ স্পনটেনিয়াসলি চাপাবাজি করে যায় রায়হান। মাহি ও ভয় করে না বুলেট বোমা। সে এই কুত্তা নিয়া যাবেই। ফলে সহসা গরম হয়ে উঠে মিরপুরের বাতাস। হুংকার দেয় রায়হান, হুংকার দেয় মাহি। হঠাৎ রায়হান মাহির হাত থেকে কেড়ে নেয় ক্রিয়েটিভকে। মাহি রায়হানের হাত থেকে কেড়ে নিতে ধস্তাধস্তি করলে রায়হান ভাবে মনে মনে- চাপাবাজিতো অনেক করেছে, কিন্তু এখন সে কোন লাইন ধরবে? সে তো মারামারি করে না, খালি হুংকার দিতে পারে, গলাও পুরা গরীবের মাইক। সে কি একটা ঘুষি দিবে? ভাবতে ভাবতে একটা চড় এসে লাগে রায়হানের মুখে- দেশি পাংক মাহির চড়। ফলে রায়হান একটা ঘুষি দেয়, জাস্ট একটা ঘুষি! উড়ে ফ্লোরে ছিটকে পড়ে যায় পাংক। মৃদু রক্তপাত।
রক্ত মুছতে মুছতে, কানতে কানতে এই দেশের পাংক কথা বলে উঠে- ‘আমার ভাই টাকা-পয়সা নাই- এই কুত্তা দিতে না পারলে আমার জিএফ এর সাথে আমার ব্রেকাপ হয়ে যাবে।’ রায়হান বুঝতে পারে এই ছেলে আসলে পাংক না, এখনো ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা না পাওয়া এক জেহাদি ক্ষ্যাত র্যাম্প মডেল। একটু পর ক্রিয়েটিভের কন্ট্রোল নিয়ে চলে যায় রাইভি, রায়হান ও বাহাদুর। পাশার বাসার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাইভি থামে, পিছায়, এবার সে উপরে উঠতে থাকে সিঁড়ি ধরে। ফ্লোরে পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাহি-র হাতে ক্রিয়েটিভকে তুলে দেয়। মাহিকে মুখে কিছুই বলে না রাইভি, মনে মনে বলে- ‘বেস্ট অফ লাক।’ বলে হ্যান্ডশেক করে রাইভি আবার নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে, মৃদু অতি মৃদু গতিতে।
ক্রিয়েটিভ হাতছাড়া হয়ে গেছে। কুকুর না নিয়েই বাসায় ফিরতে হয়েছে রাইভিকে। তবু বাসায় ফিরে রাইভির মন খারাপ লাগে না তেমন। ঘন্টা যায়। কিন্তু আস্তে আস্তে তার মন খারাপ হতে শুরু করে। এক সময় রাইভির খুব খুব কান্না পেতে থাকে। কিন্তু সে চারিদিকে যে আবহ জারি রাখে তার নাম- পুরুষ। ফলে রাইভি কাঁদবে না। রাইভি কাঁদে না। সাইলেন্ট হয়ে বসে থাকে সে। রায়হান ছোট ভাইকে বলে- নেক্সট মান্থেই রাইভিকে কিনে দিবে জার্মান শেফার্ড। কিন্তু রাইভির আর কোন জার্মান শেফার্ড লাগবে না। কুকুর পালার তূরিয় আনন্দ বা বিষাদ সে কুত্তা না পেলেই পেয়ে গেছে।
তবু পরের সকালে বেজে উঠে রাইভির বাসার কলিংবেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মাহি, তার কোলে ক্রিয়েটিভ। এই কুকুরের রঙ নাকি পছন্দ হয় নাই মাহির গার্লফ্রেন্ডের। মাহি এসেছে রাইভির কাছে ক্রিয়েটিভকে ফিরিয়ে দিতে। অবশেষে রাইভির হাতে চলে এসেছে একটা জার্মান শেফার্ড। রাইভি জড়িয়ে ধরে ক্রিয়েটিভকে। কুকুর সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা না থাকা বাহাদূর মনে মনে চিন্তা করে- মাংসের অভাবে কুকুরটা কি হাড্ডি প্রধান হয়ে যাবে? না না না, হবে না, হবে না। মাংসের অভাবে কি কুকুরটা মারা যাবে? না না না, কুকুরটা মরবে না, মরবে না।