ফররুখ আহমদের ইন্টারভিউ: সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমার পেশা নয় (১৯৬৮)
কপিরাইটের ব্যাপারটা নিয়া সন্দেহের ভিতরই থাকি আমরা, ১৯৬৮ সালে বই পত্রিকার জুন সংখ্যায় ফররুখ আহমদের এই ইন্টারভিউটা ছাপা হইছিলো। তো, বই পত্রিকার বা ফররুখ আহমদের টেক্সটের মালিকানা দাবি করতে পারেন, এইরকম কারো সাথে আমাদের যোগাযোগ নাই বইলা আগে থিকাই মাফ চাইয়া রাখতে হইতেছে। কেউ যে নাই, এইরকম মনেহয় না, বরং আমরা আসলে যোগাযোগ করতে পারতেছি না। এই কমিউনিকেশনের জায়গাটা ডেসরাপটেড হইছে আসলে।…[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
পরে এই ইন্টারভিউটা আবদুল মান্নান সৈয়দ ২০০৯ সালে উনার “ফররুখ আহমদ জীবন ও সাহিত্য“ বইয়ে রিপ্রিন্ট করছেন। মেবি ফররুখ আহমদের একমাত্র ইন্টারভিউ এইটা, যা এখনো এভেইলেবল। তো, উনার ঘাড় ত্যাড়ামিটা ভালোই টের পাওয়া যায়, এই আলাপে। ট্রাডিশন্যাল মিথগুলি নিয়াই তামাশা করছেন ফররুখ। লেখক প্রকাশকের জায়গায় যখন একটা ব্যালেন্সিংয়ের ট্রাই করতেছিলেন ইন্টারভিউয়ার তখন ফররুখ এক কাহিনি শোনান, ইরানে এক দরবেশ আছিলেন, যিনি আধমণ রুটি খাইয়া সারারাত ইবাদত বন্দেগি করতেন। তো, পাবলিশারদের আধমণ রুটির একটু আধটুও যদি রাইটাররা পাইতো, তাইলেও হইতো… এইরকম টাইপ আরেকটা কাহিনি আছে, সম্ভবত চীনদেশে এক রাজা এক আর্টিস্টরে ডাইকা পাঠাইলেন সুন্দর একটা ছবি আঁইকা দেয়ার লাইগা, তো আটিস্ট কইলো, তার ছবি আঁকতে পাঁচ বছর টাইম লাগবো, আর এই পাঁচ বছর তার থাকার থাকার লাইগা সুন্দর একটা বাড়ি, ৪/৫ জন চাকর-বাকর, ভালো খাবার-দাবার আর জামা-কাপড় লাগবো। তো, রাজা প্রায়ই খোঁজ-খবর নেন, আর্টিস্ট কিছুই করে না, পাঁচ বছর পরে রাজা তারে ধরলেন, ছবি কই? তখন আর্টিস্ট একটা কাগজ নিয়া দুই-তিন পোঁচ দিয়া একটা ছবি আঁইকা দিলো, যেইটা দেইখা সবাই তব্দা লাইগা গেলো! মানে, কবিতা লেখা বা আর্ট করা তো কোন কম্পিটিশনের ব্যাপার না! একটা নরমাল সোশ্যাল লাইফ তো তার দরকার, চলতে-ফিরতে পারার মতোন! তারে গরিব থাকতেই হবে – এর চে বাজে মিথ তো আর কিছু হইতে পারে না! কিন্তু রাইটারের বাঁইচা থাকাটা, অ্যাজ অ্যা রাইটার সারভাইব করাটা খুবই টাফ একটা ব্যাপার হয়া উঠতেছে, সোসাইটিতে।
ফররুখের পারসোনাল লাইফের সেই ক্রাইসিসগুলি কিছুটা টের পাওয়া যায়, উনার এই ইন্টারভিউর কথা-বার্তায়।
ই. হা.
……………………………………………………………………………………….
ইন্টারভিউয়ার: দীর্ঘকাল যাবত আপনি কবিতায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। আপনার সদ্য পুরস্কার পাওয়া হাতেম তা’য়ী কাব্যও এইরকম পরীক্ষার ফল বলে সুধীমহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। আপনি নিশ্চয় খুব পড়াশোনা করেন। তাই না?
ফররুখ: আমি যদি বলি যে, পড়াশোনা চিন্তা-ভাবনার পাট এখান থেকে প্রায় উঠেই গেছে, তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বিস্মিত হবেন।
ইন্টারভিউয়ার: তা হব বৈকি!
ফররুখ: কথাটা বিস্ময়কর হলেও মর্মান্তিকভাবে সত্য।
ইন্টারভিউয়ার: আপনি বড় অদ্ভুত কথা বলছেন দেখি।
ফররুখ: অদ্ভুত কথা নয়। কাজের পরিচয় ফল দেখেই পাওয়া যায়।
ইন্টারভিউয়ার: কি রকম?
ফররুখ: দুনিয়ার আরো দশটা উন্নত দেশের চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক অথবা শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক আর শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট অবদানের তুলনা করে দেখুন, খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, আমাদের পড়াশোনার বহর আর বিদ্যার দৌড় কতটুকু। আমাদের চিন্তাভাবনার পরিধি কতটুকু সে কথা বুঝতেও দেরি হবে না।
ইন্টারভিউয়ার: পড়াশোনার সঙ্গে আপনি কেন বারবার চিন্তাভাবনার কথা বলছেন?
ফররুখ: আমি স্বাধীন চিন্তার কথা বলছি।
ইন্টারভিউয়ার: কেন?
ফররুখ: স্বাধীন চিন্তা ভাবনার সঙ্গে গ্রহণ-বর্জন, হজম, বদহজমের যোগ আছে বলেই।
ইন্টারভিউয়ার: বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনি আমাদের পড়াশোনা সর্ম্পকে যে-মন্তব্য করেছেন তাতে সায় দিতে পারছি না।
ফররুখ: কেন?
ইন্টারভিউয়ার: অনেকেই আমাকে একথা পরিস্কারভাবে বলেছেন যে না পড়লে তাদের ঘুম হয় না। এ কথা কি মিথ্যে?
ফররুখ: ডাহা ভাওতাবাজি। ঘুমানোর জন্য কেউ পড়াশোনা করে না। সত্যিকারের জ্ঞানান্বেষী পাঠক তো নয়-ই।
ইন্টারভিউয়ার: তবে কি মানুষ না ঘুমনোর জন্য পড়াশোনা করে?
ফররুখ: যে মানুষ পড়শোনা করে সে শুধু নিজেই জেগে থাকে না, অন্যকেও জাগায়, তাতে জাতি জাগ্রত হয়ে ওঠে। যারা ঘুমানোর জন্য পড়াশোনা করে তারা পাঠকই নয়।
ইন্টারভিউয়ার: তাহলে আপনি আমাদের পাঠক সম্প্রদায়কে সত্যিকারের পড়ুয়া মনে করেন না?
ফররুখ: যারা ঘুমানোর জন্য পড়ে তাদেরকে আমি পাঠক মনে করি না।
ইন্টারভিউয়ার: আর লেখক সম্প্রদায়কে?
ফররুখ: যে-সব লেখকের স্বকীয়তা আছে, যাদের চিন্তা-ভাবনায়, প্রকাশভঙ্গিতে মৌলিকতা আছে তাদেরকে আমি সত্যিকারের লেখক বলে মনে করি।
ইন্টারভিউয়ার: আমাদের দেশে কি এরকম লেখকের সংখ্যা বেশি?
ফররুখ: কোনো দেশেই এরকম লেখকের সংখ্যা বেশি নয়।
ইন্টারভিউয়ার: তাহলে আপনি আমাদের দেশের সাধারণ লেখক অথবা পাঠক সম্প্রদায়কে বাজে বলে মনে করেন?
ফররুখ: কোনো মানুষকেই আমি বাজে বলে মনে করি না, শুধু হামবড়া দাম্ভিক প্রকৃতির মানুষকেই আমি বাজে মনে করি।
ইন্টারভিউয়ার: আপনি আমাদের লেখক ও পাঠকদের সর্ম্পকে করেন কি?
ফররুখ: নগণ্য হলেও নিজে যখন এক-আধটু লেখার চেষ্টা করি তখন ও বিষয়েও কিছু চিন্তা করি বৈকি।
ইন্টারভিউয়ার: আপনি যেভাবে চিন্তা করেন, জানাবেন কি?
ফররুখ: উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এইসব সাধারণ পাঠকই হয়ে উঠবে অসাধারণ পাঠক, নকলনবিশ হবে সত্যিকারের ভালো লেখক।
ইন্টারভিউয়ার: এটা কি আপনার কাব্যিক উচ্ছ্বাস?সর্বসাধারণের পড়াশোনার জন্য আপিন কিরকম পরিবেশ চান?
ফররুখ: সাধারণ পাঠাগার।
ইন্টারভিউয়ার: পাঠাগার কি আমাদের নাই?
ফররুখ: আছে, কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। এত কম যে বলতেও লজ্জা বোধ হয়।
ইন্টারভিউয়ার: আপনার কথা মেনে নিলাম। মনে করুর কোনো অলৌকিক উপায়ে রাতারাতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাগার স্থাপিত হলো, কিন্তু তাতেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
ফররুখ: না। নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে।
ইন্টারভিউয়ার: কিসের সমস্যা?
ফররুখ: বইয়ের। লেখকের। প্রকাশকের।
ইন্টারভিউয়ার: সে কিরকম?
ফররুখ: দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের পাঠক সম্প্রদায়কে পরিচিত করতে হলে মাতৃভাষার মাধ্যমেই সে চেষ্টা করতে হবে, এক্ষেত্রে বইয়ের অভাব কেন হবে তা আপনাকে খুলে বলতে হবে না।
ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু লেখকের অভাব হবে কেন?
ফররুখ: আমাদের দেশের অনেকের ধারণা এই যে, ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। কাজেই লেখকেরও অভাব হবে না কোনোদিন। কিন্তু কথাটি ঠিক নয়। তৈরি কাক পাওয়া যায়। বিশেষ করে শহরে অনেক কাক মৌজুদ থাকে। কিন্তু তৈরি লেখক অতটা সহজে পাওয়া যায় না, শহরেও খুব বেশি মৌজুদ থাকে না। কাজেই মৌলিক রচনার কথা বাদ দিলেও তরজমা করার মতো লোকেরও তখন অভাব হবে। আর যে সমস্ত লেখা বা তরজমা করা হবে তারও প্রকাশক খুজে পাওয়া যাবে না।
ইন্টারভিউয়ার: আপনার শেষের কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। এখনো কি আমাদের সমাজে প্রকাশনা একটা বড় সমস্যা?
ফররুখ: বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজে এটা চিরন্তন সমস্যা। এই সমস্যার জন্যই ছোট একখানা বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে বিশ্বকোষ জাতীয় বিরাট গ্রন্থের ব্যাপারে আমাদের পরমুখাপেক্ষী থাকতে হয়েছে।
ইন্টারভিউয়ার: আগেও কি এই সমস্যা ছিল?
ফররুখ: আগেও ছিল। আপনারা বোধহয় জানেন যে, নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমরা এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি সেই নজরুল ইসলামের প্রায় সব বই-ই প্রকাশক করেছিলেন অমুসলিম প্রকাশক। মাত্র দু’চারখানা বই প্রকাশ করেছিলেন কোনো কোনো মুসলিম প্রকাশক; তাও শেষ অবস্থায়।
ইন্টারভিউয়ার: নজরুল ইসলাম কি তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত মূল্য পেয়েছিলেন?
ফররুখ: তা আমি জানি না।
ইন্টারভিউয়ার: এটা তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেকার ঘটনা।
ফররুখ: হ্যাঁ।
ইন্টারভিউয়ার: তখন হয়তো মুসলিম প্রকাশকদের অবস্থা খারাপ ছিল।
ফররুখ: ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক। এখন আর সে অবস্থা নাই। অনেক প্রকাশকই এখন বিত্তের অধিকারী। ধন-দৌলতের মালিক। অনেক বাড়ি, গাড়ি, মোটা ব্যাংক ব্যালান্স এখন তাদের সৌভাগ্যের খবর দিচ্ছে। কিন্তু র্দুভাগা লেখকদের অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। লেখকদের অর্থনৈতিক সমস্যার মতো সৎ গ্রন্থ প্রকাশের সমস্যাও প্রায় অপরিচিত রয়ে গেছে।
ইন্টারভিউয়ার: আপনি কি শুধু লেখকদের দিকটিই তুলে ধরছেন না? আমার তো বিশ্বাস যে প্রকাশকরাই এখন লেখকদের সবচাইতে বেশি পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।
ফররুখ: লেখকের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন না নিজেরা পরিপুষ্ট হচ্ছেন?
ইন্টারভিউয়ার: লেখক সম্প্রদায় কি একেবারেই বঞ্চিত হচ্ছেন?
ফররুখ: পুরোপুরি বঞ্চিত হচ্ছেন বললে হয়তো বাড়াবাড়ি হবে কিন্তু অধিকাংশ লেখকই যে তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না এ কথা ঠিক। তার প্রমাণ বই এর ব্যবসা করে প্রকাশক বড় হলে তার সঙ্গে লেখকেরও তো হওয়া উচিত, কিন্তু তেমন হয়নি আজ পর্যন্ত।
ইন্টারভিউয়ার: প্রকাশনা একটা নতুন শিল্প হিশেবে এদেশে গড়ে উঠেছে, দেনাপাওনার ব্যাপারে প্রকাশকের ক্রুটি-বিচ্যুতি কিছুটা থাকতে পারে, কিন্তু লেখক-প্রকাশক সর্ম্পক উন্নয়নের মধ্যেই এই সমাধান খুজে পাওয়া যাবে বলেই আমরা আশা করি।
ফররুখ: দেখুন এই প্রসঙ্গে ছেলেবেলায় পড়া একটা ফারসি গল্প হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মুখতাসার গল্পটা বলব। ইরানে এক দরবেশ ছিলেন। তিনি সন্ধ্যার সময় আধমণ রুটি খেয়ে সারারাত এবাদত বন্দেগি করতেন।
ইন্টারভিউয়ার: আধমণ?
ফররুখ: হ্যা, আধমণ। গল্পলেখক এই আধমণ রুটি খাওয়ার উল্লেখ করে বলছেন যে, আধমণ রুটি খেয়ে সারারাত এবাদত বন্দেগিতে না কাটিয়ে দরবেশ যদি আধখানা রুটি খেয়ে সারারাত ঘুমিয়ে কাটাতেন তাহলে কি চমৎকার ব্যাপারই না হতো। অর্থাৎ বিশ-তিরিশ জন লোক খেয়ে বাচত।
ইন্টারভিউয়ার: আধমণি দরবেশের যে কাহিনী আপনি শোনালেন সে কথা আমাদের সকল প্রকাশকের ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। প্রকাশকরা শুধু নিজেদের উদরপূর্তিই করেন না। পৃষ্টপোষকতা ও সৎ কাজও করে থাকেন।
ফররুখ: তা হয়তো করে থাকেন। কিন্তু লেখকের ন্যায্য পাওনাগন্ডা ঠিক সময়ে মিটিয়ে দিলেই লেখক সম্প্রদায়ের সঙ্গে গোটা সমাজেরও উপকার করা হতো। লেখকরাও নিশ্চিত মনে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন।
ইন্টারভিউয়ার: লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার ব্যাপারে আপনি এত আগ্রহশীল কেন?
ফররুখ: পেশা হিসেবে গ্রহণ না করলে এ যুগে লেখকের এবং লেখার অস্তিত্ব রক্ষা প্রায় অসম্ভব বলেই আমি লেখাকে স্বাধীন সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পক্ষপাতী।
ইন্টারভিউয়ার: দুনিয়ার সব দেশেই কি লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন?
ফররুখ: দুনিয়ার সব দেশের খবর আমি বলতে পারি না, তবে অধিকাংশ উন্নত দেশের লেখকরাই লেখাকে স্বাধীন, সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইন্টারভিউয়ার: এর তো খারাপ দিকও আছে?
ফররুখ: আছে। লেখক যদি নিজের বিবেক বিক্রি করে অর্থপিশাচের ভূমিকায় নেমে লিখতে বসেন তাহলে সেটা ব্যক্তির জন্যেই নয়, সমাজের জন্যেও মারাত্মক ক্ষতি হবে। কিন্তু খারাপ দিকটার কথাই আগে ভাবছেন কেন?
ইন্টারভিউয়ার: না, ও কথা আমি ভাবিনি। আমি এমন কয়েকজন লেখককে দেখছি যারা বিত্তশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
ফররুখ: আমাদের দেশে লিখে বিত্তশালী হয়েছেন?
ইন্টারভিউয়ার: না, লিখে নয়। নানারকম ব্যবসাবাণিজ্য করে।
ফররুখ: তাই বলুন। তা উত্তর তো আপনি নিজেই দিলেন।
ইন্টারভিউয়ার: একজন বয়স্ক পত্রিকা-সম্পাদকও কিছুকাল আগে আমাকে বলেছেন যে, যতদিন লেখক দরিদ্র থাকেন ততদিন নাকি তিনি ভালো লিখতে পারেন। কথাটা কি সত্য?
ফররুখ: কথাটার উত্তর সরাসরি নিজে না দিয়ে আমি আপনাকে আবার অনুরোধ করব দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাতে। সচ্ছল অবস্থান দরুন সে সব দেশের লেখকরা ভালো লিখতে পারছেন, বেশি লিখতে পারছেন – না আমরা পারছি।
ইন্টারভিউয়ার: পত্রিকা-সম্পাদেকর কথার উপর আমি কোনো গুরুত্ব দিইনি।
ফররুখ: না দিয়ে ভালোই করেছেন। কারণ অভুক্ত অবস্থায় থাকলে পত্রিকা সম্পাদকের যে ঐ দারিদ্রবিলাস থাকত না সে আমি নি:সন্দেহ।
ইন্টারভিউয়ার: লেখাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার পক্ষে এটি তাহলে আপনার বড় যুক্তি?
ফররুখ: লেখাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করার সবচাইতে বড় লাভ এই যে, লেখক লেখাপড়ায় সবসময় আত্মনিয়োগ করতে পারেন। রুজি-রোজগারের ধান্দায় লেখককে যদি অকারণ ঘুরতে না হয় তাহলে সত্যিকারের প্রতিভাবান লেখক অনেক বেশি কাজ করতে পারেন বা পারবেন বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উন্নত মানের লেখার জন্যে এই পরিবেশ বিশেষভাবে প্রয়োজন।
ইন্টারভিউয়ার: যতদিন এই পরিবেশ সৃষ্টি না হচ্ছে ততদিন কি লেখক সম্প্রদায় লেখাপড়া বাদ দিয়ে বসে থাকবেন?
ফররুখ: তা যে থাকবেন না তা আপনি নিজেও জানেন। কিন্তু বিনা চাষের ফসল যে কি হয় তার নমুনা তো আপনারা আমাদের লেখা থেকেই পাচ্ছেন।
ইন্টারভিউয়ার: আচ্ছা একটা কথা আবার আপনাকে জিজ্ঞেস করব, যদি কিছু মনে না করেন।
ফররুখ: অত সংকোচবোধ করছেন কেন, সরাসরি বলে ফেলুন।
ইন্টারভিউয়ার: আলোচনার শুরুতে আপনি ও কথাটা বললেন কেন, লেখাপড়া চিন্তাভাবনার পাট এখান থেকে প্রায় উঠেই গেছে। কথাটা আমার কাছে যেন কেমন বোধ হচ্ছে।
ফররুখ: অর্থাৎ অপ্রিয় সত্যকে মেনে নিতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্যকে না মেনে উপায় কি বলুন। একটা স্বাধীন, গতিশীল জাতির লেখক হিশেবে যেভাবে পড়াশোনা করা দরকার সেভাবে যে আমরা পড়াশোনা করি না, করছি না অথবা করতে পারছি না সেটা তো আমাদের কাজের নমুনা দেখলেই বোঝা যায়। নিজেদের ব্যর্থতার কথা বলি আর কিভাবে?
ইন্টারভিউয়ার: আমরা যারা লেখাপড়াকে দৈনন্দিন জীবনের কার্যক্রম হিসেবে গ্রহণ করছি তারা যদি না পড়ি তাহলে এদেশে সাধারণ পাঠক জন্মাবেই না। অতএব সেদিকে চেয় দেশেরও বিষয়টা একবার চিন্তা করুন।
ফররুখ: একথা বলতে গিয়ে আপনি এত মনমরা হয়ে গেলেন কেন? আমি বরং আমাদের দেশের একশ্রেণীর পাঠকের খবর দিতে পারি, যারা বয়সে প্রাচীন আর উচ্চশিক্ষিত তারা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সারা জীবন পড়ছেন, এমনকি ডিটেকটিভ নভেল কি ঐ ধরণের অন্যান্য বই পড়ে সময় কাটাচ্ছেন।
ইন্টারভিউয়ার: এসব পাঠক সর্ম্পকে আপনার কি ধারণা?
ফররুখ: গদ্যে আর কি উত্তর দেই, এর উত্তর দিতে হয় পদ্যে।
ইন্টারভিউয়ার: তাই দিন।
ফররুখ: অবাক হলাম দাদুর হাতে/ দেখে চুষিকাটি/ ঘোরেন তিনি মারবেল আর/নিয়ে দুধের বাটি।
কেমন, হলো তো? এই যে চির-নাবালক দাদুর পড়াশোনা দেখলে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
ইন্টারভিউয়ার: নাবালক কেন, ঘোরানও হতে পারেন।
ফররুখ: তা পারেন, তবে এ বিষয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।
ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু একথাও তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে সৱ পাঠকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
ফররুখ: আপনার কথা সত্য হোক, এটাই দোয়া করি। তবে একথাটাও আমাদের জানা আছে যে, আজাদি পাওয়ার পর এমন এক উৎকট ভব্যতার শিকারে পরিণত হয়েছি – যেখানে কার্পেট বিছানো ড্রয়িংরুমের একপাশে দামি শেলফে রেক্সিনে বাধানো অনেক অনেক বই সাজানো থাকে। কোনোদিন সে সব বইয়ের পাতা খোলা হয় না। সেখানে শুধু আলোচনা হয় হাল ফ্যাশানের বাড়ি, গাড়ি আর শাড়ি সর্ম্পকে।
ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু ঐ শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে লেখকদের কি সর্ম্পক?
ফররুখ: লেখকদের উপরেও এখন ঐ তথাকথিত অভিজাত সম্প্রদায় প্রভাব বিস্তার করছেন, যার ফলে কঠিন শ্রম-সাধনার পথ ছেড়ে অনেক লেখক বাড়ি-গাড়ির স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন।
ইন্টারভিউয়ার: আপনার বুঝি এখনো বাড়ি-গাড়ি কিছুই হয়নি?
ফররুখ: আমার নয়, আমাদের কথা বলছিলাম।
ইন্টারভিউয়ার: আশা করি, এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরো কথা হবে।
ফররুখ: তবে সেটা যেন সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান না হয়।
ইন্টারভিউয়ার: কেন?
ফররুখ: সাক্ষাতকার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমার পেশা নয়।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024