ঢাকার আর্ট সিনে নতুন কালারিস্ট জে জে আর্ট
ইউরোপীয় রেনেসাঁ থেকেই শিল্পীদের মাঝে বিশেষত চিত্রশিল্পীদের মধ্যে এক অলিখিত অথচ দৃশমান বিভাজন থাকত রঙ ও রেখা বিষয়ে। চিত্রকলায় রঙ প্রধান না রেখা প্রধান এই ছিল বিভাজন, তর্ক। শিল্পীদের মাঝে এই নিয়া যেমন তর্ক চলত তেমনি দর্শককুলের মাঝেও তা নিয়া তর্ক থাকত, ক্ষেত্র বিশেষ অনেকটাই হট টপিকের মত জনতার মুখে মুখে তা উচ্চারিত হইত। বিশেষত মাইকেল এঞ্জেলো ও রাফায়েলের কাজ নিয়া। এঞ্জেলো রেখা প্রধান আর রাফায়েল রঙ প্রধান। রাফায়েল ও এঞ্জেলো থেকে এই তর্ক জনতার মাঝেও সংক্রামিত হইত। রেখা প্রধানকে ধরা হত ক্লাসিকাল আর রঙ আধুনিক। এই তর্কের ধারাবাহিকতাতে সেখানে এর পরের ২ মাস্টার শিল্পী রুবেন্স ও পশিন এরা ১৭ শতকের এবং এই ধারাবাহিকতার শেষ ২ মাস্টার শিল্পী দেলাক্রয়ে ও ইনগ্রেস ১৯ শতকের। যথাক্রমে রুবেন্স ও দেলাক্রয়ে রঙ প্রধান ও আধুনিক এবং পশিন ও ইনগ্রেস রেখা প্রধান ও ক্লাসিসিস্ট। [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
রেনেসাঁ থেকে চলতে থাকা এই তর্ক তাদের শিল্পের “আধুনিক”(ফরমালিস্ট) পর্বেও সমান গুরুত্ব নিয়া হাজির ছিল বিশেষত ইম্প্রেশনিজম ও পোস্ট ইম্প্রেশনিজমে। ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের কাজে যেমন রঙ প্রধান তেমনি রেখা ও গড়ন গুরুত্বহীন। তাদের এই রেখা ও গড়নের গুরুত্বহীনতাকে সমস্যা দায়ক হিসাবে চিহ্নিত করে তা থেকে বের হয়ে আসছিল রেনোয়া, মানে সহ আরো প্রমুখ শিল্পী এবং পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের প্রায় প্রত্যেকেই রঙের সাথে সাথে রেখা ও গড়নকে সমান গুরুত্ব দিয়েছিল। পল গগা, ভ্যন গখ প্রমুখ শিল্পী এই পথেই হেটেছিলেন।
আর এই পথের দিশা ছিল তাদের কাছে প্রাচ্যের শিল্পকলা।
সমগ্র প্রাচ্যেই চিত্রকলা আদতে কন্সেপচুয়াল যা রেনেসাঁ থেকে শুরু হওয়া দৃশ্যগত বাস্তবতার বিপরিত ধর্মী বা ভিন্ন। প্রাচ্য চিত্রকলা বুঝতে রঙ রেখা ও রুপ/অবয়বকে বুঝেছে। চিত্রকলায় তাই অবয়ব নির্মাণে রঙের সাথে সাথে পরিলেখ বা আউটলাইন দিত, দেয়। চিত্র নির্মাণে এই তিন এলিমেন্টসই সমান গুরুত্ব নিয়া হাজির থাকে। যেমন আমাদের রিক্সা চিত্র। আর ইউরোপের শিল্পীদের মাঝে এই প্রবণতা জাপানিজ ছাপচিত্রের প্রভাব থেকে এসেছিল। বস্তুত কেবল প্রাচ্যই নয় এমন কি তা তাবত পৃথিবীর আদিবাসিদের কাজেও এই রঙ, রেখা ও রুপ/আকৃতি/অবয়ব একত্রে হাজির থাকত, থাকে। কেবল মাত্র ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও তাদের ক্লাসিক্যাল ঐতিহ্য অর্থাৎ গ্রিকে চালু হওয়া এই চোখে দেখার বাস্তবতা পূর্ণ ইমেজে রঙের আভার সাহায্যেই বস্তুর আকৃতি ও রূপ তৈরি করত এবং রেখা অনুপস্থিত থাকত।
ফলে, ১৯ শতকের মধ্যভাগ থেকেই ইউরোপিয় শিল্পকলায় প্রাচ্য, আদিবাসি সহ তাদের উপনিবেশায়ীত অঞ্চলের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রভাব বা গ্রহণ চলতে থাকে ও আধুনিক মাস্টার শিল্পীদের কাজে রেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
কিন্তু চিত্রকলা যেহেতু ব্যক্তির সহজাত প্রবণতাও ফলে আধুনিক পর্বেও আমরা কিছু শিল্পী পাবো যাদেরকে আমরা ঐ রঙ প্রধান বা রেখা প্রধান চিত্র নিয়া হাজির হতে দেখবো। যেমন মাতিস রঙ প্রধান। আবার পিকাসো ও কান্দেনিস্কি রঙ ও রেখা উভয়কে গুরুত্ব দিয়েছে তাদের চিত্রে। শিল্পীর সহজাত ও সতস্ফুর্ত প্রকাশ হওয়াতে এই রঙ প্রধান বা রেখা প্রধান কাজ যে খুব একটা সচতেন প্রকাশ হয়তো না, অনেকটাই অটোনোমাস।
বাংলাদেশের শিক্ষায়তন কেন্দ্রিক শিল্পীদের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা দৃশ্যমান। এস এম সুলতান, কামরুল হাসান এই কাতারের, তাদের কাজে রঙ রেখা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম ও সাম্প্রতিক সময়ে রনি আহমেদের কাজেও রঙ ও রেখা উভয়ই প্রধান। অন্যদিকে জয়নুল ও শিশির রেখা প্রধান। জয়নুল ও শিশিরের কাজে যে রঙ নাই তা নয়, তাদের উভয়েরই কিছু সিরিজে রঙ ও রেখা উভয় থাক্লেও মূলত এই দুই শিল্পীর সিগ্নেচার মূলক কাজগুলা রেখা প্রধান।
এইকাতারে নতুন সম্ভাবনা নিয়া এই প্যান্ডেমিক সময়ে হাজির হয়েছেন Jinnatun Jannat মুন মূলত কালারিস্ট আর এই অঞ্চলের শিল্পী হওয়াতে রেখাও তার কাজে সহজাত। শিক্ষায়তেনের চর্চার কাজগুলো (চিত্র নং ২) থেকেই তার এই রঙ প্রধান প্রবণতা দেখা যায়, আর তার এই রঙের ভূবনকে আকাশের মত সীমাহীন করতেই যেন সে সারফেস হিসাবে বেছে নিয়েছিল শাড়ি। মসলিন তটে (চিত্র নং ৩) জলরঙের ঐকতান বেধে চলেছে অবিরাম।
মুনের এও এক সাহস ও ব্যতিক্রম উদ্যোগ, ফাইন আর্টে শিক্ষা নিয়া সকলেই যখন নতুন মিডিয়া ও পশ্চিম বা আন্তর্জাতিক মাধ্যম ও ধরণের শিল্প করতে ব্যস্ত সেখানে সে মননিবেশ করল, বলা চলে প্রথা ও ট্রেন্ডের বিপরীতে গিয়ে তার ভাষায় ওয়ারেবল আর্ট নিয়া। এই ক্ষত্রে মুন ইতিমধ্যেই সাক্সেস ও ঢাকায় নতুন শাড়ির ট্রেন্ড চালুকরার প্রথিকৃত হয়ে উঠেছে। (ফ্যাশন ডিজাইন বা ওয়ারেবল আর্ট কম গুরুত্বের কি না সেই তর্ক তোলা থাকল আপাতত বাহাউসের বড়াতে, ইউরোপীয় আধুনিক শিল্পশিক্ষার অন্যতম প্রতিষ্ঠান, যাদের হাত ধরে আদতে মর্ডান আর্কিটেকচার থেকে শুরু করে প্রোডাক্ট ডিজাইন ও খোদ ফাইন আর্ট চর্চার বাকপরিবর্তেন ঘটেছিল সেই বাহাউস মনে করত আর্টের সকল মাধ্যমই সমান ক্রিয়েটিভ)।
অনলাইনে এই সময়ে যে সমস্ত শিল্পী এক্টিভ মুন তাদের মধ্যে নিশ্চিত ভাবেই ব্যতিক্রম। ফেসবুক ফ্রেন্ড ও অতিত শিক্ষক হওয়াতে তার কাজের এই সময়ের গতি প্রকৃতি দ্রুতই অবলোকন করতে পারার সুবিধা হেতু প্রায় সব কাজই ধারাবাহিক ভাবে দেখেছি তাৎক্ষণিক ও আশ্চর্য হয়েছি ক্ষণে ক্ষণে। আশ্চর্য এই জন্য যে, প্যান্ডেমিকের শুরুর আতংক, হতশাতে যখন আমরা প্রায় সকলেই বিষাদগ্রস্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ঠিক সে সময়েই মুন একটি স্টাটাসে উল্লেখ করল “মৃত্যুর আগে কয়েকটি ছবি একে যেতে চাই…” ( চিত্র ১)।
এর পরপরই খ্যাপা শিল্পীর মত প্রতিদিনই কাজ করে চলেছে। মূলত ২টা নতুন সিরিজে কাজ করেছে। এখানকার মাস্টার শিল্পীদের কাজের রিমেক ও নাড়ি সিরিজ। এই স্বল্প সময়ে তার এই দুই সিরিজের কাজের সংখ্যা দেখলে হতবাক হতেই হবে যে কাউকে। আর এক্ষেত্রেও সে এই অঞ্চলের শিল্পের পথেই হেটেছে। জীবিকার প্রয়োজনেই রিকশা শিল্পীদের দিনে কয়েকটি কাজ শেষ করতে হত, আর এও এক কারণ থাকত শিল্পের গড়ন তৈরিতে। এটি উপনিবেশিক সময়ের কালিঘাটের পটচত্রের ক্ষেত্রেও একি। সেই পথে হেটেছিলেন ভারতের আধুনিক শিল্পী কে জি সুব্রামানিয়ামও। আমাদের কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরীও এই কাতারের শিল্পী। মুনের ক্ষেত্রে এই অধিক কাজ করা সহজাত হয়েছে সম্ভবত তার শাড়িতে ব্রাশ চলানোর অভ্যাস থেকে। ফলে তার নাড়ি সিরিজে এই সহজাত রেখা ও রঙের উপস্থিত। (চিত্র ৪ ও ৫ )
অন্যদিকে A Tribute to great masters of Bengal Art (চিত্র ৬ ও ৭)সিরিজের কাজগুলা সিলেকশনেও দেখা যাচ্ছে রঙের প্রাধান্য। ফলে তার শিক্ষাতায়নের কাজ থেকে শুরু করে এই প্যান্ডেমিক সময়ের কাজগুলার মধ্যে দিয়া মুন নিজেকে সহজাত ও সতস্ফুর্ততার সাথেই ক্লারিস্ট হিসাবে মেলে ধরেছে। আর তার এই অনন্য দিকটিই আমাকে তার কাজ সম্বন্ধে আগ্রহী করে তোলে।
সাম্প্রতিক সময়ে কন্সেপচুয়াল ও নতুন মাধ্যমের কাজের যে তুমুল শ্রোত মুন তাকে যেন চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিয়েছে, আর সেই সাথে আমরাও এক সম্ভাবনা দেখছি- শিল্প থেকে যেন প্রায় বিতারিত ব্যক্তির যে নানা সংবেদন, সেই সংবেদনকেই পূজি করে গড়া শিল্প দেখার সম্ভাবনা।
শিল্পের ভ্যালু জাজমেন্ট ও গুরুত্ব দেবার ক্ষেত্রে এখানে নানা কর্তৃত্বমূলক প্রতিষ্টান যে সমস্ত দিক ও ক্রাইটেরিয়া নিয়ে থাকে তাতে হয়তো মুনের কাজ তার মধ্যে ঠিক ফিট হবে না, বা নানা প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। সেই ভ্যালুজাজমেন্ট যারা করার তারা করবে, আপাতত তার আগেই আমরা তার এই প্রচণ্ড রঙ প্রধান কাজগুলা থেকে আনন্দ নিতে থাকি। সম্ভবত মুনের এও এক অনন্য বৈশিষ্ট্য যে সে তার ক্যানভাসে, সারফেসে দুক্ষ জাগানিয়া কোন গল্প নয় আনন্দের সমাহার নিয়া হাজির হতে চায়।
তবে দুক্ষবাদীদেরকেও সে হয়তো নিরাশ করবে না আগামীতে, কেননা মহাজন কাহিনী নিয়া আরেক সিরিজ নিয়া সে হয়তো অচিরেই হাজির হবে যেখানে উপস্থিত থাকবে তার জন্মস্থানের জীবন যুদ্ধে পর্যদুস্ত নারীদের আখ্যানের রঙ ।
তার কাজ দেখতে চোখ রাখুন:
https://www.facebook.com/pg/jinnatunjannatart/photos/?tab=album&album_id=177342436057832
আব্দুল হালিম চঞ্চল
Latest posts by আব্দুল হালিম চঞ্চল (see all)
- জনরোষে কি কেবল ‘ভাস্কর্য’ ভেঙ্গে পড়তেছে? - আগস্ট 11, 2024
- অবিচুয়ারি: মাহমুদুল হক - জানুয়ারি 12, 2022
- ঢাকার আর্ট সিনে নতুন কালারিস্ট জে জে আর্ট - জুলাই 29, 2020