অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশি সিনেমা (৫)
।। এক ।। দুই ।। তিন ।। চাইর ।।
বাংলা সিনেমা নিয়া আলাপ-আলোচনা
বাংলা সিনেমা নিয়া যত লেখালেখি চোখে পড়ছে, কম-বেশি সবাই একমত যে, বাংলা সিনেমা হইতেছে গরিবের সিনেমা। মিডলক্লাসের রুচিসম্মত (মানে ‘ভালো’) সিনেমা বানানোর কিছু চেষ্টা হইছে, কিন্তু পাবলিক সেই সিনেমাগুলা যে ‘ভালো’ – এইটা বুঝতে পারে নাই। এই কারণে ‘ভালো’ বাংলা সিনেমা কখনোই খুব একটা বানানো হয় নাই। জহির রায়হান আর আলমগীর কবির হইতেছেন “আসল” আর বাকি সবাই কম-বেশি ফেইক, বাণিজ্যিক ও এভারেজ… এইরকম।
বাংলা সিনেমা যেমন কম-ই বানানো হইছে বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া লেখালেখিও কমই, আমার ধারণা। বাংলাদেশে সিনেমা নিয়া যা বই-পত্র আছে, তার বেশিরভাগই বিদেশি সিনেমা বা সতজিৎ রায়, ঋতিক… এইসব নিয়া। তো, যেই বইগুলা আমি ব্রাউজ করছি সেইগুলা নিয়াই আলাপ করতে চাইতেছি। আরেকটা জিনিস বইলা রাখা ভালো, আমি ‘সব লেখা’রে নিতেছি না; বাছাই করতেছি। লেখার এভেইলেবিলিটি যেমন একটা জিনিস, কিছু লেখা নিয়া কথা বলা অ-দরকারিও মনে করতেছি; তবে দরকারি এবং অ-দরকারি সব বইয়ের এবং লেখার লিস্টই এই চ্যাপ্টারের শেষে রাখবো।
…………………
এই জিনিসটা ইন্টারেস্টিং, বাংলাদেশে সিনেমা বানানোর আগে কিন্তু ‘সিনেমা’ নামে পত্রিকা ছাপা হইছিল, ১৯৫০ সালে। তা-ও বগুড়া’তে শুরু হইছিল, পরে অবশ্য ঢাকা’তে শিফট হয়। এডিটর ছিলেন আবু তাহের মোহাম্মদ ফজলুল হক (সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের হাজব্যান্ড; চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর আর কেকা ফেরদৌসি’র বাপ)। জহির রায়হান-ও (অই সময়ে জহিরুল্লাহ্ নামে উনারে পারসোনালি চিনতেন অনেকে) অই পত্রিকা’তে কাজ করতেন। হলিউড-বলিউড নিয়া লেখা অনুবাদ করতেন। (রাবেয়া খাতুন, যিনি নিজেও এই পত্রিকার ছাপাছাপি’র সাথে ছিলেন, বলছেন।)
মানে, এইটা খুব ভুল ধারণা যে, বাংলাদেশে সিনেমা বানানো শুরু হইছে, তারপরে ‘চলচ্চিত্র-সমালোচনা’ :p শুরু হইছে; বরং সিনেমা হল বানানো হইছে, সিনেমা হলে লোকজন হিন্দি-উর্দু-ইংলিশ-কলকাতার বাংলা সিনেমা দেখছে, সিনেমা নিয়া পত্রিকা ছাপা হইছে, তারপরে গিয়া ঢাকা’তে সিনেমা বানানো শুরু হইছে। মানে, সেভেনটিইজ-এইটিইজে সিনেমাহলগুলাতে বাংলা সিনেমা ছাড়া কিছু দেখানো হইতো না বইলা, অইটারে হিস্ট্রি’র বেইজ হিসাবে ধরলে মুশকিলই হবে আসলে।
আর অ্যাজ অ্যা জেনারেল রুল, হিস্ট্রিতে ঘটনাগুলা ঘটার আগেই ঘটনা’টা ঘটার তোড়জোড় শুরু হইতে থাকে। এইটা মানতে পারলে ভালো।
…………………
বাংলা-সিনেমা নিয়া লেখালেখিগুলারে মোটামুটি তিনটা ক্যাটাগরি’তে ফেলা যায়। একটা হইতেছে, একাডেমিক লেখা; মনে ভার্সিটিতে পড়ায় বা ভার্সিটির টিচার’রা স্টুডেন্টদের লাইগা, রিসার্চারদের লাইগা লিখছেন… এইরকম। দুসরা হইতেছে, ইন্ডিপেন্ডেড লেখা-পত্র, ঠিক একাডেমিক না বা মিডিয়া রিপোর্টং-ও না, বরং নানানরকমের ভিউজ; এই জায়গাটা যদিও খুব বেশি অর্গানাইজড হয়া উঠতে পারে নাই এখনো, কিন্তু এর ইন্সফ্লুয়েন্স বাড়তে থাকার কথা। লাস্টলি হইতেছে, পত্র-পত্রিকায় সিনেমা নিয়া আলাপ, রিভিউ, এইসব; একটা সময় এইগুলা হইছে খুব, মেবি স্বাধীনতার পর পর থিকা আশির দশক পর্যন্ত; তো, এর পরে সিনেমা যেহেতু আর হয় না, বাজারও ছোট হয়া আসছে, পত্র-পত্রিকাগুলাও টিইকা থাকতে পারে নাই, কিন্তু ইনফরমেশনের দিক দিয়া এই ধরণের লেখাগুলা একটা ভালো সোর্স।
একটা জিনিস ক্লিয়ার করা দরকার, একাডেমিক লেখা মানে খুব ইর্ম্পটেন্ট লেখা – তা না, এইটারে বরং একটা প্যাটার্ন হিসাবে দেখতে পারাটাই দরকার। এই ‘একাডেমি’ জিনিসটা বরং পাওয়ার-স্ট্রাকচারের একটা বড় উইপেন। অ্যাকাডেমিক লেখা বইলা যেইটা আলাদা হয়, সেইটা হইতেছে ফর্ম, অন্য যে কোন ফর্মের মতোই, এইখানেও গু-মুত পাইবেন। কিন্তু জায়গাটারে কনশাসলি খুব নির্দোষ, নিরপেক্ষ ও পবিত্র রাখার একটা ব্যাপার থাকে। এইটা মোস্টলি সোসাইটিতে চিন্তা-ব্যবস্থারে দখলে রাখার একটা ঘটনাই। ২০০৭ সালে অ্যাপলের আইপড রিলিজ করার সময়ে একটা প্রেস রিলিজে (https://bit.ly/32OLXVX) কইতেছিলেন, দুনিয়াতে মিউজিকের মার্কেট-ব্যবস্থাটা কেমনে কাজ করে; অনেকগুলা মেশিন যে বানানো হইতেছে গান শোনার, এখন মেশিনগুলা চালানোর লাইগাই তো গান বানানো দরকার! এমন না যে, লোকজন গান শুনতে চায় না, কিন্তু গান শোনার মেশিনগুলা আছে বইলা একটা ডিমান্ড ক্রিয়েট হইতেছে তো! তো এইরকম ‘একাডেমি’র দরকার নাই – তা না, কিন্তু এইটা যেহেতু আছে, পেপারও বানাইতে, রিসার্চও করা লাগে তো! চাকরি করেন না আপনারা! এইরকম। আরেকটা ঘটনা হইতেছে, মিউজিক কোম্পানি যেমন কন্ট্রোল করে বা করতে পারে, কোন কোন মিউজিক বানাইবো, এইরকম একাডেমিতেও দেখবেন, কোন কোন জিনিস নিয়া রিসার্চ হইবো, সেইটা ফান্ডিংয়ের উপ্রেই ডিপেন্ড করে বেশিরভাগ সময়।… তো, এই কারণে একাডেমিয়ারে পাওয়ার স্ট্রাকচারের জায়গা থিকা দেখতে পারলে ভালো, কিভাবে সে সার্ভিসটা সে দেয়।…
বাংলাদেশে ১৫টা পাবলিক আর ৭০টার মতো জেনারেল ভার্সিটি আছে, (https://bit.ly/2WSl0Nm) , এই দুইটা মিলায়া মেবি ৭/৮টার বেশি ভার্সিটিতে সিনেমা নিয়া পড়ায় না। মোস্টলি জার্নালিজম আর মিডিয়া স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলাই ফিল্ম-স্টাডিজরে ইনক্লুড করছে, বা আলাদা ডিপার্টমেন্ট বানাইছে। কয়েকজনের সাথে কথা বইলা যা মনে হইছে, বেশিরভাগ কোর্সই হইতেছে টেকনিক্যাল জিনিসপত্র আর ওয়ার্ল্ড সিনেমার হিস্ট্রি নিয়াই, বাংলাদেশ পার্টে খুব কম জিনিসই পড়ানো হয়, বা পড়ানোর তেমন কিছু তো নাই! 🙂 তো, ভার্সিটিগুলাতে বরং কিছু টিচার আছেন, যারা সিনেমা নিয়া পড়ান, উনারাই বাংলাদেশি সিনেমার নিয়া আলাপ করার একটা অথরিটির জায়গাতে আছেন। এইখানে আমি উনাদের কিছু লেখা নিয়াই কথা বলতে চাইতেছি, যেইগুলা উনারা উনাদের স্টুডেন্টদের জন্য লিখছেন আর পাবলিকলি এভেইলেবল।
এই একাডেমিক লেখা-পত্রগুলা ১৯৮০/৯০’র আগে আসলে শুরু হয় নাই। টাইমলাইন অনুযায়ী যদি দেখেন, এইরকম একাডেমিক এবং সেমি-একাডেমিক ইন্টেলেকচুয়াল লেখালেখি শুরু হইছে ১৯৬০/৭০’র দিকেই। আলমগীর কবিরেরই একটা শুরু’র পয়েন্ট হিসাবে নিতে হবে।
১. আলমগীর কবির
আলমগীর কবিরের ফিল্ম ইন বাংলাদেশ (১৯৭৯) বইটা মেবি বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া পয়লা বই যেইটা বাংলা সিনেমারে ক্রিটিক্যালি দেখতে চাইছে। কিন্তু এইটারে অ্যাকাডেমিক বই বলাটা মুশকিলেরই হবে, কারণ ভার্সিটির স্টুডেন্টদের জন্য বা রিসার্চের জন্য এই বই লেখা হয় নাই, বরং এক্টিভিজমের কিছু ব্যাপার আছে। এইগুলারে আমি বলতে চাইতেছি ইন্ডিপেন্টেড বুক, যেইটার অ্যাকাডেমিক রিলিভেন্স আছে, আমাদের জানা-বোঝা’র জায়গাতে কন্ট্রিবিউট করতে পারে, এইরকম।
তো, আলমগীর কবিরের ৬টা লেখা আমি পড়ছি বাংলাদেশের সিনেমা নিয়া – আজ ও কালের প্রেক্ষণে বাংলাদেশের ছবি (১৯৭১/৭২), সংস্কৃতির সংকট ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৭৩), একুশ বছরের চলচ্চিত্রাঙ্গন: একটি সমীক্ষা (১৯৭৮), স্বাধীনতা-উত্তর চলচ্চিত্র (১৯৭৮), বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পঁচিশ বছর (১৯৮১), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৮৯)। উনার এই লেখাগুলা নিয়া ইন-ডিটেইল বলতে চাইতেছি, কারণ এখন পর্যন্ত বাংলা সিনেমা নিয়া যেই সাহিত্য, ক্রিটিক আর দেখার যেই নজর সেইটা গ্রসলি আলমগীর কবিরেরই ন্যারেটিভ। এই কারণে উনার কথাগুলারে খেয়াল করাটা দেয়া দরকার।
এই জিনিসটা মনে রাখা ভালো যে, এইখানে ডিরেক্টর আলমগীর কবির’রে নিয়া কথা না, বরং উনার ‘চলচ্চিত্র সমালোচনা’র ব্যাপারটা নিয়াই কথা বলতে চাইতেছি। যদিও উনারা বানানো সিনেমা আর সিনেমা নিয়া কথা-বার্তার মধ্যে যোগাযোগ তো আছেই, কিন্তু দুইটা একই জিনিস না। সিনেমা’তে একটু হইলেও (বাস্তবতার কারণে) ফেক্সিবিলিটি আছে উনার; কিন্তু সিনেমা নিয়া কথা বলার জায়গাগুলাতে উনার আইডিওলজির জায়গা থিকা কোনরকম কোন ‘ছাড়’ দিতে উনি রাজি না।
তো, উনার ‘আইডিওলজি’টা কি? উনার লেখা থিকাই ৩ টা কোটেশন দেই:
১. “অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত প্রযোজকদের হাত থেকে সিনেমা শিল্পকে মুক্ত করে তার সমাজতন্ত্রীকরণের পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। ভেজাল ও অপদার্থ জিনিশের অনুপ্রবেশ [যাতে] না ঘটে…”
২. “আমি চিত্রনাট্য এমনভাবে করতে প্রবৃত্ত হলাম, যাতে সামনের সারির দর্শকরা একবারই মাত্র ছবিটি দেখতে আসে। যাতে বড়লোক বারবার এই ছবি দেখতে এসে তাদের উদ্বৃত্ত টাকা দিয়ে যেতে পারে – তারই আশা করেছিলাম।”
সংস্কৃতির সংকট ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৭৩)
৩.”আমার মতে আমাদের বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যিকারের জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন হবে তখন, যখন:
১. চলচ্চিত্রকার বাংলাদেশের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ তথা বাঙ্গালি সংস্কৃতির সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কে নির্ভূলভাবে সজাগ থাকবেন, এবং
২. যখন চলচ্চিত্রকার ও তাঁর প্রযোজক রাতারাতি বড়লোক হবার লোভ সামলাতে পারবেন, সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট সস্তা সেন্টিমেন্ট বাজারজাত করা থেকে নিরস্ত হবেন এবং চলচ্চিত্রিক চৌর্যবৃত্তি বর্জন করবেন।” /স্বাধীনতা-উত্তর চলচ্চিত্র (১৯৭৮)
এক নাম্বার কোটেশনটাতে খেয়াল করবেন, আলমগীর কবিরের আইডিওলজি ছিল “সমাজতান্ত্রিক চলচ্চিত্র নির্মাণ”; কিন্তু আমার ধারণা, এইরকমের ‘কড়া’ পজিশন থিকা উনি পরে সইরা আসছিলেন, “জাতীয় সংস্কৃতির প্রতিফলন”-এ, তিন নাম্বার কোটেশনটা দেখেন। কিন্তু এই পজিশনেও উনি ‘কড়া’ মেজাজ’টা ধইরা রাখছিলেন। দুই নাম্বার কোটেশনে দেখেন, উনি যে টাকা-পয়সাঅলা লোকদের লাইগা, বা এলিট ক্লাসের লাইগা সিনেমা বানাইতে চাইছিলেন, এইটা গোপন করেন নাই, কিন্তু একইসাথে এই জিনিসটাও স্পষ্ট করতেছেন যে, যেই সিনেমা টাকাঅলা লোকদের জন্য, সেই একই সিনেমা থার্ড-ক্লাসের দর্শকদের জন্য না; উনি থার্ড ক্লাসের দর্শকদের জন্য সিনেমা বানাইতে চান না, চান ফার্স্টক্লাসে বসা দর্শকদের জন্য। আর্ট-কালচারের কনজামশন অবশ্যই সমাজের ক্লাসের লগে এসোসিয়েটেড একটা ঘটনা; কিন্তু কোন সিনেমা বা আর্ট অ্যাক্রস দ্যা ক্লাস অপারেট করতে পারে না – এইটা আর্ট নিয়া সবচে বাজে ধারণাগুলার একটা।
একটা সিনেমা যে একই সাথে ‘ভালো’ সিনেমা এবং পপুলার সিনেমা হইতে পারে – এইটা উনার ধারণার মধ্যেই নাই। ব্যাপারটা অনেকটা এইরকম যে, আগে একটা ‘সংজ্ঞা’ ঠিক করবেন, তারপরে সেইটার উপ্রে বেইজ কইরা সিনেমা বানাইবেন। মানে, সিনেমা’রে হইতে হবে খুবই পলিটিক্যাল একটা ঘটনা। তো, আলাদা কইরা পলিটিক্যাল হওয়ার তো দরকারই নাই! কারণ অ্যাজ অ্যা আর্ট ফর্ম সিনেমা না চাইলেও পলিটিক্যাল জায়গাগুলাতে তারে অপারেট করতে হয়। কনশাস হইতে পারলে তো অবশ্যই ভালো, কিন্তু এই কনশাসনেসটাই সিনেমাটা না; বা যেই পলিটিক্যাল পারপাসটা এইটা সার্ভ করে। এইভাবে ভাবতে চাওয়াটা বরং সিনেমারে রিডিউস করারই একটা ঘটনা।
থার্ড পয়েন্টটা হইতেছে, উনি সময়ের সাথে উনার ধারণাটারে যে বদলাইতে পারছেন, ‘সমাজতন্ত্র’ থিকা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’তে আসতে পারছেন – এইটা অবশ্য বাজে ঘটনা না; কিন্তু যেই জায়গাটাতে উনি কন্সটেন্ট আছেন, যে সিনেমার কাজ হইতেছে তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করা – এই জায়গাতে বরং উনি আটকায়া গেছেন। উনার লেখালেখি’তে খেয়াল কইরা দেখবেন ডিফাইনিং একটা এটিটুড নিয়া উনি কথা বলছেন; ফতেহ লোহানী’রে কইছেন ‘অভিনেতা’, রূপবান’রে কইছেন ‘যাত্রাসিনেমা’; মানে, যেই যেই সিনেমা খুব কড়াকড়িভাবে ‘সামাজিক দায়িত্ব’ পালন করতে ব্যর্থ হইছে, সেইগুলারে সিনেমা বলতে উনি রাজি হন নাই। এই টেনডেন্সিটার সবচে বাজে দিক হইলো, ‘সংজ্ঞা’র ভিতরে ফালায়া মাইর-ধর করা; যেইরকম আছে না যে, যারে মারতে চান, তারে একটা ব্যাড নেইম দেন, শয়তান হিসাবে পরিচয় করায়া দেন, ভিলেন বানান, ‘অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত…’ বানান, তারপরে বাতিল কইরা দেন!
উনার আইডিওলজি’র জায়গা থিকা দর্শকরে উনি দেখছেন এমন একটা আইডেন্টিটি হিসাবে যাদের কোনকিছু চিন্তা করার ক্ষমতা নাই: “একজন সাধারণ লোক, ধরা যাক রিকশাঅলা, অশিক্ষিত। স্থুল আনন্দের দিকে তার স্বাভাবিক ঝোঁক থাকবেই। সে বারবার বেশ্যালয়ে যেতেও ভালবাসে।” (সংস্কৃতির সংকট ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, ১৯৭৩) মনে হইতে পারে, উনি দর্শকদেরকে বাঁচায়া দিতে চাইতেছেন, যে, দর্শকদের তো কোন দোষ নাই! কিন্তু ঘটনা এইটা না, ‘রিকশঅলা’ ‘অশিক্ষিত’ লোকদেরকে উনি আইডেন্টিফাই করতেছেন, একটা রিসিভিং যন্ত্র হিসাবে, যারা সিনেমা বুঝে না! খেয়াল কইরা দেখবেন, যারা ‘অশ্লীল’ সিনেমার বিরোধিতা করতো, তারা তো বিশ্বাস করতোই; যারা ‘অশ্লীল’ সিনেমা বানাইতো তারাও বিশ্বাস করতো যে, সেক্স-সিন থাকলেই সিনেমা চলবো! পাবলিক আসলে এইগুলাই খায়। তো, আলমগীরের কবিরের এই ‘জড়’ দর্শকের আইডিয়া থিকা আমরা এখনো সরতে পারি নাই।
তবে, আলমগীর কবিরের একটা সুবিধা হইলো, জিনিসগুলা উনি দেখছেন যে সিনেমা, মিডিয়া কেমনে কাজ করে বাংলাদেশে; কিন্তু মুশকিল হইলো, জিনিসগুলারে উনি রিলেট করতে চাইছেন একটা আইডিওলজি’র জায়গা থিকা; যার ফলে উনার দেখার জায়গাটারে উনি ন্যারো কইরা ফেলছেন সবসময়। যেমন, সিনেমা যে একটা বিজনেস এইটা উনি জানতেন, আর এইখানে খালি ডিরেক্টর আর দর্শকরাই না, আরো কিছু এজেন্ট আছেন – সিনেমা হল-মালিকেরা এবং সিনেমার ডিস্ট্রিবিউটরা, এবং এই বিজনেসটারে কন্ট্রোল করেন উনারাই। উনার সিনেমা ফ্লপ হওয়ার পরে উনি জিনিসটারে বলছেন কিছুটা: “‘ধীরে বহে মেঘনা’ যদি মার খাওয়া ছবির তালিকাভুক্ত করা যায় তবে ডিস্ট্রিবিউদের লাভ। কেননা প্রযোজকরা তখন কম হিশেব-নিকেশ দেখতে আসেন। আয়করও ফাঁকি দেয়া যায়। ডিস্ট্রিবিউদের এই প্রতারণার কৌশল মোকাবেলার জন্য প্রযোজকরা ঝগড়া করতে কমই আসেন।” এইটা অবশ্যই একটা কারণ যে ডিস্ট্রিবিউটর’রা চাইলে ভালো ভালো সিনেমারে ধরা খাওয়াইয়া দিতে পারতেন, দিতেনও অনেক সময়; এইভাবে বাংলা সিনেমার ‘রুচি’ কন্ট্রোল করতে গিয়া নিজেদের বিজনেসেরই গোয়া মারছেন। কারণ দোকানদার হিসাবে আপনার কাজ হইতেছে জিনিস বেচা, আর পাবলিক যেই জিনিস কিনতে চায় সেইটা এভেইলেবল রাখা। এখন পাবলিকরে যদি আপনি পচা-ধজা মাল গছাইয়া দিতে থাকেন, পাবলিক সেইটা নিতে সবসময় আসবো না। এবং হইছেও সেইটা, পাবলিক আর সিনেমা হলে আসে না, কারণ পাবলিক যেই সিনেমা দেখতে চায়, সেই ধরণের সিনেমা সিনেমা হলগুলাতে দেখানো হয় নাই। সেই সিনেমা “ধীরে বহে মেঘনা” টাইপের সিনেমা না, কিন্তু অবস্টেকলটা যে ছিল, এইটা মিথ্যা না।
……………………………………………………
আলমগীর কবিরের নিজের বানানো পয়লা অডিও-ভিজ্যুয়াল কাজ কোনটা, জানেন? উনি একটা ‘বিজ্ঞাপণ চিত্র’ বানায়া উনার কাজ-কাম শুরু করছিলেন। ‘বিজ্ঞাপণ চিত্র’টা ছিল নাবিস্কো বিস্কুটের, ১৯৬৮ সালে।
তো, ‘বিজ্ঞাপণ চিত্র’ বানানো যে বাজে কাজ – এই ধারণা তো আমাদের দেশে অনেকদিন থিকাই চালু আছে; যে, ‘টাকার জন্য’ কাজ করে! বা ‘পাবলিকরে পটানোর জন্য মিথ্যা কথা বলার নাম’ হইতেছে বিজ্ঞাপণ! এই ধারণা থিকা যা হয়, সত্যি কথা যদি থাকেও, সেইটা বলাটা আর ‘বিজ্ঞাপণ’ মনে হইতে পারে না। বিজ্ঞাপণ বা অ্যাড’রে তখন একটা ‘কাজ’ হিসাবে দেখার আর উপায় থাকে না, ‘বাজে কাজ’ হিসাবে ভাবতে হয়; আর এইরকম ভাবতে ভাবতে কাজটাও খারাপ হয় আসলে। (ইদানিং অবশ্য ‘মিছা কথা’ এতোটা বেচা-বিক্রি হয় না আর, এই কারণে আইডিওলজি বা ‘সোশ্যাল কজ’ বেচা-বিক্রি শুরু হইছে। তো, এইটার ডিমান্ড এখন ভালো 🙂 ) মানে, আমি বলতে চাইতেছি না যে, বিজ্ঞাপণ বানানো খুব ভালো কাজ, কিন্তু বিজনেস আর টাকা-পয়সা বাদেও এইটা যে একটা অডিও-ভিজ্যুয়াল কাজ – এই জিনিস’টা মিসিং-ই থাকে আমাদের আলাপের ভিতরে, বেশিরভাগ সময়।
এর একটা এফেক্ট সিনেমার ধারণা’র উপ্রেও ইম্পোজ হওয়ার কথা যে, পাবলিকের (মনোরঞ্জনের 🙂 ) লাইগা বিজ্ঞাপণ বানানো যেহেতু ‘খারাপ কাজ’, একইভাবে ‘ভালো সিনেমা’ও তো পাবলিকের জন্য বানানো যাইতে পারে না! এমনকি, এইরকমের বাণীও থাকার কথা যে, ভালো সিনেমা কখনোই দর্শকের মনোরঞ্জনের বানানো হইতে পারে না। 🙂 মানে, আমি বলতে চাইতেছি, এই ধরণের চিন্তার তেমন কোন রিলিভেন্স নাই। পাবলিকের পছন্দ হওয়া সিনেমাও ‘ভালো সিনেমা’ হইতে পারে তো! বরং পাবলিকের পছন্দরে গুরুত্ব না দিতে পারাটাই ‘ভালো সিনেমা’র বৈশিষ্ট্য হইতে পারে না আর কি! পারে না যে – এই সত্যি কথাটা হাইড কইরা রাখে ‘বিজ্ঞাপণ চিত্র’ নিয়া হেইট্রেট’টা। তো, ভালোবাসা’র দরকার নাই, কিন্তু আন-নেসেসারি হেইট্রেটগুলা সরায়া রাখতে পারলেও অনেককিছু দেখতে পাওয়ার কথা আমাদের।
নাবিস্কো বিস্কুটের ‘বিজ্ঞাপণ চিত্র’ আমি দেখি নাই। কিন্তু আলমগীর কবিরের সেকেন্ড অ্যাড, যেইটা ছিল গ্যাকো টাচ সাবানের (১৯৮০), অইটা দেখছি। হয়তো ছোটবেলায় দেখা জিনিস বইলা মনে আছে, অ্যাডটা। তখন তো অ্যাড খুব কমই ছিল, টিভি’তে। তো, অ্যাডের জিঙ্গেলটা ভালো ছিল। গরমে ঘাইমা গলা চুলকাইতেছে একটা লোক, একজন মহিলা, পরে গ্যাকোটাচ সাবান দিয়া গোসল কইরা আরাম পাইতেছে; শেষে, ‘টাচ, টাচ, টাচ/ গ্যাকো টাচ’ বইলা গান গাইতো। 🙂 ইউটিউবে সার্চ কইরা পাইলাম না, কিন্তু থাকার কথা মনেহয় অ্যাড’টা কোথাও।
…………………………………..
আলমগীর কবিরের বাংলা সিনেমা নিয়া লেখাগুলাতে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস খেয়াল কইরা দেখবেন, উনি জীবনেও কোনদিন সিনেমার ডিরেক্টর হিসাবে এতহেশাম আর খান আতা’র নাম নেন নাই। (মানে, গালি-গালাজ করার লাইগাও না। 🙂 উনার এই টেকনিক উনার মুরিদরাও ফলো করে, দেখবেন।) অ্যাজ ইফ দে ডোন্ট এগজিস্ট।
তো, উনারা আলমগীর কবিরের ডেফিনেশন অনুযায়ী সিনেমা না বানানোর বাইরেও ব্যাপারটা কেমনে ডিল করছিলেন? দেখা যায়, দুইটা ক্যাঁচালে ‘খোলা চিঠি’ লিখছিলেন, মানে পাবলিকলি কাইজ্জা করছিলেন। অ্যাপার্ট ফ্রম দ্য ঝগড়া-ঝাটি, দুইজনে দুইটা পারসোনাল কমেন্ট করছিলেন।
এতহেশাম সাহেব লিখছিলেন, “আলমগীর কবির সাহেবের একটা কথা মনে রাখা উচিত, চলচ্চিত্র শিল্প অতীতে হিন্দি ছবি, ভারতীয় ছবি, উর্দু ছবি – এগুলোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছেন এবং তা আলমগীর কবির সাহেবের নেতৃত্ব ছাড়াই।” (১৯৭৭)
খান আতাউর রহমান লিখছিলেন, “প্রতিবারই এই ভূখন্ডে আপনার এবং কয়েকজন নির্মাতার পরিচালিত ছায়াছবি ছাড়া সমস্ত চলচ্চিত্র কিছুই হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন।… কিন্তু মনে রাখবেন যে আমি এবং আমার সতীর্থরা আগেও যেমন আপনার অস্বীকৃতিকে কোন গুরুত্ব দেইনি, তেমনি এটাকেও দেব না।” (১৯৮৬)
কিন্তু লেখার একটা গুরুত্ব তো আছে। সিনেমা বানায়া না, বরং বাংলা-সিনেমা নিয়া আলাপগুলাতে উনাদের নাম না নিয়া আলমগীর কবির উনাদেরকে বাদ দিয়া দিতে পারছেন তো! আর উনার পরে যারা ‘চলচ্চিত্র সমালোচনা’ করতে আসছেন, উনারা দেখবেন, আলমগীর কবিরের মতোই একটা ‘এলিট ক্লাসের রুচি’রেই সিনেমা বইলা ভাবতে চাইছেন।
২. নিউ ক্রিটিকস
আলমগীর কবিরের এই পজিশনটারে ক্রিটিক করছেন জাকির হোসেন রাজু। কিন্তু গোড়াতে অ-মত বা অ-মিল খুব কমই আছে উনাদের। জাকির হোসেন রাজু আলমগীর কবিরের পজিশনটারে একটু আপগ্রেড করার সাজেশনই আসলে রাখছেন। আগে মিলের জায়গাটা নিয়া বলি, তারপরে উনার এক্সটেনশনের জায়গাটা নিয়া বলতেছি।
জাকির হোসেন রাজু’র “চলচ্চিত্রের চালচিত্র” বইটা হইতেছে রিলেটিভলি পপুলার বা পরিচিত একটা বই। ২০১২ সালে সেকেন্ড এডিশন ছাপা হইছিল। উনার ইয়াং বয়সের লেখা। ভূমিকাতে উনি বলছেন, “বিশেষভাবে প্রথম পর্যায়ের চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্যে এ বইয়ে চলচ্চিত্রের শিল্পরূপ ও প্রেক্ষাপট নিয়ে কয়েকটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেছি মাত্র।” এই বইয়ে বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া একটাই লেখা আছে উনার: “চলচ্চিত্রে শ্রমজীবী মানুষ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ” (পেইজ, ৯৩ – ৯৮); লেখাটাতে ৬টা সিনেমার নাম নিছেন উনি – জাগো হুয়া সভেরা (১৯৫৯), সূর্যস্নান (১৯৬২), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), লাঠিয়াল (১৯৭৬), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮) আর সূর্যদীঘল বাড়ি (১৯৭৯)। এইগুলা কম-বেশি “প্রথম শ্রেণীর সিনেমা হিসেবে কম বেশি আদৃত” বইলা মানছেন।
এর মধ্যে ৪টা সিনেমা ভালো হইলেও, লাঠিয়াল সিনেমা নিয়া কমেন্ট হইতেছে, “শ্রমজীবী মানুষের দ্বন্দ্ব আংশিকভাবে ধরা পড়েছে… সর্বহারাদেরকে বিভ্রান্ত ও বিভাজিত…প্রসঙ্গও এ ছবি’তে উঁকি দিয়ে গেছে। তবুও সমালোচকদের দৃষ্টিতে এ ছবি বাস্তবতা ছুঁয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র।” গোলাপী এখন ট্রেনে’র অবস্থাটা আরো বাজে 🙂 “এই ছবিতে শ্রমজীবী মানুষের চেহারাকে অনেকখানি বিকৃত করে ফেলা হয়েছে। তাই, এ ছবিতে যদিও শ্রমজীবী মানুষের পক্ষেই বক্তব্য রাখা হয়েছে, তবুও এ ছবি সত্যিকারভাবে কোন পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে, তা একটি ভাবনার বিষয়।” এই ভাবনা উনি আর এইখানে করেন নাই অবশ্য, কিন্তু পরে বলছেন, “…চলচ্চিত্রের মূল ধারাই চলছে এরকম সাজানো ঘটনা প্রবাহকে সম্বল করে যা শ্রমজীবী মানুষকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে এবং দর্শকদেরকে বোকা বানায়।” মানে, ‘দর্শক’রা বোকা’ হওয়ার লাইগা বইসা থাকেন, রিয়েলি! উনি এখনো এইরকম জায়গা থিকাই সিনেমারে দেখতে চান! ২০১২ সালের ইন্ট্রো’তে যদিও বলছেন, “…পাঁড় নন্দনতাত্ত্বিকদের মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকে কিছুটা হলেও অবজ্ঞা করেছি।” কিন্তু উনার এই সিনেমা রিডিং’রে ‘অবজ্ঞা’ হিসাবে মাফ কইরা দিলে তো উনার কথা-বলার জায়গাটাই আসলে থাকার কথা না।
বইয়ের ফার্স্ট এডিশনে জাকির হোসেন রাজু বলছিলেন, “সবিনয়ে বলবো, এ বই-এ নতুন কোন তত্ত্বের ইশারা নেই কিংবা নেই অজানা তথ্যের সমারোহ। লেখকের চিন্তাও খুব গভীর নয়, এমনকি চিন্তাগুলো খুব ঘনসংঘবদ্ধও নয়…” তো, এই কথাগুলারে ‘বিনয়’ হিসাবে না নিয়া ‘সত্যি কথা’ হিসাবে মানতে পারাটা দরকার।
উনার এর পরের লেখাগুলারে এই বইয়ের ‘প্রায়শ্চিত্ত’ হিসাবে পড়া যাইতে পারে যেইখানে উনি উনার পজিশনরে অস্বীকার না কইরা বরং আপগ্রেড করছেন, এটলিস্ট দুইটা লেখাতে – “চলচ্চিত্র বিশ্লেষণ বিভিন্ন ধারা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চর্চা” (যোগাযোগ পত্রিকা, সংখ্যা ৭, ২০০৫) এবং “বাংলাদেশের জনপ্রিয় সিনেমা: জঁরা ও জাতীয়তার বন্ধনে” (যোগাযোগ পত্রিকা, সংখ্যা ১১, ২০১৩)। পরে যেই বইটা (Bangladesh Cinema and National Identity: In Search of the Modern?) উনি লিখছেন সেইটাও উনার এই লেখাগুলারই একটা কোর ভার্সনই হওয়ার কথা।
২০০৫ সালের লেখাটাতেই উনি আলমগীর কবিরের পদ্ধতিরে “চলচ্চিত্র-টেক্সট অধ্যয়ন পদ্ধতি” হিসাবে রিকগনাইজ করছেন এবং বলছেন যে, টেক্সচুয়াল এবং আঙ্গিকবাদী দুইটা পদ্ধতিতেই ‘দর্শক’ ক্যাটাগরিটারে ঠিকমতো কন্সিডার করা হয় না: “তারা কখনোই দর্শকের বহুমুখী ভূমিকাকে অথবা বিভিন্ন দর্শকগোষ্ঠীর চলচ্চিত্র আস্বাদনের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করেননি। ফলে বাণিজ্যিক-জনপ্রিয় ধারার চলচ্চিত্রের দর্শক নামহীন, আদলহীন এক ভোক্তাশ্রেণীতে পরিণত হয়েছে। যেখানে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই দর্শককে কেবল সিনেমার টিকেটবিক্রেতা হিসেবে দেখা হয়। অপরদিকে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের অভিভাবকদের মতে এই দর্শক-শ্রেণীকে অবোধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের দর্শকমাত্রই অশিক্ষিত, দরিদ্র, নিরক্ষর জনসাধারণ, যারা শুধুমাত্র একটু সস্তা বিনোদন চায়।” তো, এইটা হইতেছেন আসলে আলমগীর কবির। যারে জাকির হোসেন রাজু আর নিতে পারতেছেন না।
উনি কি সাজেস্ট করতেছেন? উনি বলতেছেন, সিনেমারে ‘আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে’ বিবেচনা করা লাগবে: “…আমার প্রস্তাব হলো, বাংলাদেশের সিনেমাকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি সমাজ-সত্তা হিসেবে দেখতে হবে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র উৎপাদন থেকে আস্বাদন পর্যন্ত বিভিন্ন সমাজ-সত্তার সংঘাতে চলচ্চিত্রকে বিশ্লেষন অর্থাৎ চলচ্চিত্রকে দেখতে হবে অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও ডিসকোর্সের সাথে সম্পর্ক ও মিথস্ক্রিয়ার ভিত্তিতে।” একটা আর্ট বা প্রডাক্ট না, একটা প্রসেস হিসাবে দেখার সাজেশন জাকির হোসেন রাজুর।
তো, এর জন্য কি করতে হবে? “জনপ্রিয়” সিনেমা নিয়া কথা বলতে হবে। এই কাজ উনি করছেন, ২০১৩ সালের লেখাটাতে। দুইটা “জনপ্রিয়” সিনেমা (বাবা কেন চাকর ও আম্মাজান) নিয়া কথা বলছেন। কিন্তু উনি যেইরকমটা বলছিলেন, “চলচ্চিত্র উৎপাদন”-ও সিনেমার আলাপ, সেইটা নিয়া একটা শব্দও বলেন নাই, “দর্শক”রেও উনি “অবোধ” “অশিক্ষিত” “দরিদ্র” না ধইরা নিলেও বলছেন “স্বল্প আয়ের” “খেটে খাওয়া মানুষ”… মানে, একটু “মর্যাদা” তো দিছেন আসলে :p সবচে ইম্পর্টেন্ট হইলো, কেউ তো এইগুলা নিয়া কথা-ই কয় না, উনি যে, কইছেন বা কওয়া যাইতে পারে – এই মাসালা যে দিছেন, এইটাই যেন অনেক!…
আলমগীর কবির যেইরকম একটা “জাতীয় বিপ্লবের” জায়গা থিকা সিনেমারে দেখছেন, সেই জায়গাটারে চেইঞ্জ কইরা জাকির হোসেন রাজু খালি “ন্যাশনাল আইডেন্টিটি” বানাইছেন, বেসিক ডিফরেন্স এইটুকই আসলে। আলমগীর কবির কথা কইতেই রাজি না এইরকম “ট্রাশ” নিয়া, জাকির হোসেন রাজু বলছেন, না, ‘সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট’ বিবেচনা কইরা কথা যাইতে পারে, পারমিশন উনি দিছেন। উনাদের দুইজনের কেউ-ই সিনেমার জায়গা থিকা বাংলাদেশি সিনেমার আলাপটা করতেই রাজি না, কারণ এইগুলা তো সিনেমাই হয় নাই!
সোশ্যাল স্পেইসে যে কোন আর্টই একটা প্রডাক্ট। আর্ট যেমন প্রডাক্ট হইতে পারে, প্রডাক্টও আর্ট হইতে পারে। আর এইটা দুইটা জিনিসই প্রসেস হিসাবে সমাজে এক্টিভ থাকার ভিতর দিয়া নানান রকমের থিওরি ও আইডিয়ারে রিলিভেন্ট কইরা তুলতে পারে। কিন্তু এরা এই রিলিভেন্সটা ক্রিয়েট করতে পারে বইলাই সমাজে চালু থাকে না, বরং এইগুলা টুল হিসাবেও সমাজে এক্টিভ আছে; মানে, সিনেমা কোন ন্যাশনাল আইডেন্টিটিরে হাজির রাখতে পারে বইলা কেউ সিনেমা দেখে না। এইটুকের ভিত্রে সিনেমারে আটকানো’টা সিনেমারে একটা টুল হিসাবেই দেখতে পারার ঘটনা, মানুশরে মেশিন ভাবার মতন। ন্যাশনাল আইডেন্টিটির জায়গাতে যতটুক এইটা ফিট-ইন করে ততটুকই হইতেছে এই সিনেমাগুলার আলাপ! আর এই বিচার খালি “জনপ্রিয় বা বাণিজ্যিক” সিনেমার ব্যাপারে, কারণ আসল সিনেমা হইতেছে আর্ট-ফিল্ম বা ইন্ডিপেন্ডেড ফিল্মগুলা। যার ফলে উনার বাংলাদেশি সিনেমার আলাপের সিগনিফিকেন্স এইটুকই যে, “জনপ্রিয় বা বাণিজ্যিক সিনেমা” নিয়া আলাপ করতে হবে!
ঘটনা’টা হইতেছে, উমবের্তো একো কইতেছিলেন, মার্কো পলো যখন চীনে গেছেন তখন উনি দাবি করছেন যে, ইউনিকর্ন দেখছেন, কিন্তু উনি যেহেতু অনেস্ট ছিলেন, একটু পুরাটা বলছেন। বলছেন যে, আমরা যেই ইউনিকর্নের কথা জানি (গ্রীক মিথোলজির) তার মতোই এর একটা শিং আছে, কিন্তু এরা শাদা না, কালা; এদের গায়ের লোম ষাঁড়ের মতন, পায়ের খুরও হাতিদের মতন, এদের শিং-ও কালা, মাথাও বন্য শুয়োরের মতন… মানে, মার্কো পলো আসলে কোন ইউনিকর্ন দেখেন নাই, দেখছিলেন গন্ডার। তো, জাকির হোসেন রাজু এইরকম ইউনিকর্নের মতন কইরা বাংলা-সিনেমা নামে গন্ডাররে পরিচয় করায়া দিতেছেন, দুনিয়ায়।
২.২
এর বাইরে, ফরহাদ মজহার, গীতি আরা নাসরিন, মানস চৌধুরী, কাবেরী গায়েন, ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন, মোহাম্মদ আজমের কিছু লেখা ইন্ডিপেন্ডেড হইলেও এইগুলা ধীরে ধীরে ভার্সিটিগুলাতে ‘পাঠ্য’ হয়া উঠতে পারবে মনেহয়। মানে, এইরকমের এক্সপেক্টশন যে নাই লেখাগুলার ভিতরে – তাও না; কিন্তু তেমন কোন একাডেমিক জার্নাল যেহেতু নাই বাংলাদেশে এখনো পাবলিক আলাপের জায়গাগুলাতেই থাকতেছে লেখাগুলা।
ফরহাদ মজহারের বেদের মেয়ে ছোসনা নিয়া লেখাটা নিয়া অই চ্যাপ্টারে কিছু বলছি আমি। মানস চৌধুরী’র অশ্লীল সিনেমা নিয়া লেখাটা নিয়াও। এর বাইরে, বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া উনাদের কোন ভিউ-পয়েন্ট আছে বইলা আমার জানা নাই।
গীতি আরা নাসরিন আর ফাহমিদুল হকের “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র: সংকটে জনসংস্কৃতি” বইটা আউট অফ প্রিন্ট, কিন্তু এই বইয়ের একটা চ্যাপ্টার “জনসংস্কৃতি ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র” ফাহমিদুল হক উনার ব্লগে রাখছেন, যেইটা অনলাইনে এভেইলেবল। লেখাটা কনক্লোড করছেন এইভাবে যে, “তবে বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সর্বাধিক ছবি উৎপাদনকারী দেশগুলির একটি, এর খানিক গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। একটা রমরমা ইন্ড্রাষ্ট্রি ক্রমশ দর্শক হারিয়ে ফেলেছে…” (https://bit.ly/2ZZwLn4)
খুবই ভুল একটা কথা! 🙁 বাংলাদেশে মোটেও ‘সর্বাধিক ছবি উৎপাদকারী দেশগুলার’ একটা না; নাম্বারের দিক দিয়া প্রথম ১৫টার মধ্যে নাই, কখনো ছিলো না (https://bit.ly/2Eir3EH) । সিনেমার বাজেট, বক্স অফিস… এইসবের কথা যদি ধরেন, অবস্থা আরো বাজে হওয়ার কথা। দুই-একটা সিনেমা বাদে, বাংলাদেশে কোন সিনেমা কোনদিনই ‘দর্শক’ টানতে পারে নাই; সিনেমার ইনকামের দিকে তাকাইলেই টের পাওয়া যাবে।.. মানে, ব্যাপারটা এইরকম না যে, উনি ভুল অনুমান করতেছেন, বরং একটা আইডিয়ারে ভ্যালিড প্রমাণ করার লাইগা ভুল অনুমানগুলা করা লাগতেছে উনারে। এইটা আমার অনুমান। 🙂
এই লেখা যখন আমি শেষ করতেছি, তখন দেখলাম ফাহমিদুল হক একটা বই ছাপাইছেন “Bangladeshi Cinema: A brief history” নামে, অই বইয়ে এই ‘রমরমা ইন্ড্রাষ্ট্রি’ জায়গাটারে এডিট কইরা কইছেন, ১৯৬০/৭০/৮০’তে বাংলা-সিনেমা ভালো চলতো 🙂 মানে, এইরকম এডিট করাটা অবশ্যই ভালো জিনিস, কিন্তু বাংলা-সিনেমারে রিড করার সমস্যাটা এইরকম না যে, “আগে একটু ভুল বলছিলাম”, বরং যেই জায়গা থিকা উনারা দেখতেছেন, সেইটাই ভুল।
আমার অবজারভেশন হইতেছে, বাংলা সিনেমা নিয়া আলাপে ফাহমিদুল হকের থিওরেটিক্যাল কোন কন্ট্রিবিউশন নাই, উনি আলমগীর কবির ও জাকির হোসেন রাজুর থিওরেটিক্যাল বেইজটারে আরো তথ্য-প্রমাণ দিয়া জাস্টিফাই করতে চাইছেন। যেই কারণে অনেকগুলা ভুল তথ্যও উনি দিছেন বইয়ে।* [ আপাতত ২টা ভুলের কথা বলি:
১. বইয়ের একদম সেকেন্ড লাইনেই বলছেন: “It produces more than 50 films every year.” (It মানে Bangladesh) আর এর সোর্স হিসাবে নিছেন বাংলা মুভি ডেটাবেইজরে। অথচ bmdb.co কখনোই ক্লেইম করে নাই যে, উনারা সব বাংলা সিনেমার লিস্ট উনারা রাখতেছেন, বরং উনাদের এবং উইকিপিডিয়ার এগেনেস্টে আমার ক্লেইম হইতেছে যে, “অশ্লীল সিনেমা”গুলা যেহেতু সিনেমা না, উনারা সিনেমা হিসাবে লিস্টের মধ্যেই রাখেন নাই, যেন এই সিনেমাগুলা বানানোই হয় নাই! তো, সিনেমার নাম্বার যদি গুণতে হয় সেন্সর বোর্ডের লিস্টটা নেয়াটাই বেটার না! সরকারি ওয়েব-সাইটেই নাম্বারগুলা আছে। (https://cutt.ly/ojdQtpB) আমি নিচে এইভাবে নাম্বারটা লিখতেছি: ।। বছর ।। ফাহমিদুল হকের মেনশন করা নাম্বার ।। সেন্সর সার্টিফিকেট পাওয়া সিনেমার নাম্বার।। আমদানি করা সিনেমা।। শর্ট ফিল্ম ।। ডকুমেন্টারি ।।
২০১৩ – ৫৩ / ৭০+০+৬+২
২০১৪ – ৭৬/ ৮৮+০+৩+১
২০১৫ – ৬৩ / ৭১+১+৪+৩
২০১৬ – ৫৭/ ৭১+৩+৬+৩
নাম্বারটা ৭০’র নিচে না, এমনকি একটা বইয়ে (বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, পাঁচ দশকের ইতিহাস – আবদুল্লাহ জেয়াদ, ২০১০) ২০০০ টু ২০০৯’তে ৮৩০টা সিনেমার নাম দেয়া আছে, মানে, গড়ে ৮৩টা। তো, মনে হইতে পারে, জাস্ট নাম্বারই তো ভাই! কিন্তু দেখেন, নাম্বার হিসাব করতে গিয়াই শর্টফিল্ম আর ডকুমেন্টারি’রে সিনেমা হিসাবে তো কাউন্ট করেনই নাই, এমনকি ২০১৫ সাল থিকা যে ইন্ডিয়ান বাংলা-সিনেমা আমদানি করা শুরু হইছে বাংলাদেশে, এই কথাও বলতে ‘ভুলে’ গেছেন!
২. আরেক জায়গায় উনি বলছেন, কলকাতার সিনেমাতে কাজী নজরুল ইসলামের ইনভলবমেন্ট ছিল খুবই আলগা একটা ঘটনা: “A rare instance is Kazi Nazrul Islam’s co-directed Dhruba (1934) where he also acted and directed the music. Nazrul also wrote scripts and songs of several other films. (p.29) তো, এই several other হইতেছে আরো ১২টা; এর বাইরে ‘ধূপছায়া’ নামে সিনেমার ডিরেক্টর ছিলেন বইলা ধারণা করা হয়, কিন্তু অই সময়ের হিস্ট্রি যারা লিখছেন, সেইখানে কোন মেনশন নাই সিনেমাটার, যেই কারণে হইছিল কি হয় নাই – শিওর হয়া বলা যাইতেছে না। চলচ্চিত্রে নজরুল – আসাদুল হক (১৯৯৩) বইটাতে ডিটেইলস পাইবেন।…
তো, হিন্দু-ডমিনেটিং অই সময়ের কলকাতায় মুসলমান কারো এন্ট্রি পাওয়া যে মোটামুটি ইম্পসিবল ছিল (এমনকি মুসলমান লোকজন হিন্দু নাম না নিলে হল-মালিকেরা সিনেমা চালাইতেছিল না বইলা দুইটা ঘটনার কথা বলার পরে বলতেছেন) সেইটারে উনি কনক্লোড করছেন এইভাবে যে, “…Muslims were far behind of Hundus even in the last British India…” (এমনকি বোম্বেতেও ইউসুফ খান’রে যে দিলীপ কুমার হইতে হইছিল, সেইটাও মনে করতে পারেন) মানে, মুসলমানদের জন্য অবস্থাটা কোনভাবেই ফেভারেবল ছিল না – এইরকম না, বরং মুসলমানরা পারে নাই!…]
ব্যাপারটা এইরকম না যে, উনি ‘ইচ্ছা কইরা’ বা ‘খেয়াল করেন নাই বইলা’ ভুল তথ্য দিছেন, বরং যেহেতু অই থিওরেটিক্যাল বেইসগুলারে উনি ‘সত্য’ বইলা প্রমাণ করার একটা আর্জ উনি ফিল করেন, এই কারণে ইনফরমেশনের জায়গাগুলাতে ভুলগুলারে তার একটা রেজাল্ট হিসাবে উনি বরং পিক করতে পারেন। তবে সাহিত্যিক ক্যারিয়ারের কারণে মেবি উনার লেখা এনগেইজিং, পড়তে কষ্ট কম হয়, ‘সত্য’ বইলা মনে হওয়ার রিস্কটাও বেশি থাকে।
আবারও বলি, ফাহমিদুল হক ‘ভুল তথ্য’ দিছেন – এইটা আমি প্রমাণ করতে চাইতেছি না, বরং বলতে চাইতেছি, উনারা ভুল একটা জায়গা থিকা দেখতেছেন…
তো, আমি উনাদের লেখারে আউট-রাইট বাদ কইরা দিতে চাইতেছি না, বরং একটা টেনডেন্সিরে দেখতে পাইতেছি যেইখানে ‘অ্যাকাডেমিক’ হইতে হবে – এই ফোকাসের কারণে কোনকিছু চিন্তাও করা লাগবে, এই জিনিসটা মিসিং-ই থাকতেছে বেশিরভাগ সময়। 🙁 ছন্দ মিল দিয়া কবিতা লেখতে গেলে যা হয়, অইরকম কিছু একটা।
ইউল্যাবের (ULAB) টিচার মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন’র একটা ডকুমেন্টারি (https://www.youtube.com/watch?v=t_NnvqfY8Lk&fbclid=IwAR0vDcuMShVIk55c57rVDTSOnY_CQQiS4cHzf3Fl9OnHQ-JNmv8lhUzAZxc) আছে, সিনেমা নিয়া। বাংলাদেশের নামি-দামি সিনেমা ডিরেক্টদের ইন্টারভিউ, সিনেমার ফুটেজ দিয়া বানাইছেন। একটা পলিটিক্যাল হিস্ট্রি দাঁড়া করানোর ট্রাই করছেন। পয়লা পর্বের (১৯৩১ – ১৯৭০) নাম দিছেন “The Protest” এবং ১২:০১ মিনিট টাইমে তানভীর মোকাম্মেল শুরুটা করছেন একটা মিছা কথা দিয়া; যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে “জেদ” করে বাংলা সিনেমা বানানো শুরু হইছিল; আবদুল জব্বার খানের লগে গুলিস্তান সিনেমাহলের মালিকের বা উনার লাহোরের ডিস্ট্রিবিউটরের পারসোনাল ঝামেলা হইছিল এইটা মিছা কথা না, কিন্তু এইটারে একটা পলিটিক্যাল ঘটনা হিসাবে বলাটা একটা হিস্ট্রিক্যাল লাই। বাংলা সিনেমা বানানো শুরুই হইছে সরকারি অনুদানেই, আর ঢাকাতেও অনেক উর্দু সিনেমা বানানো হইছিল। মানে, একটা বাঙালি জাতীয়বাদের জায়গা থিকা বাংলা সিনেমা বানানো শুরু হয় নাই, বরং এখন যেহেতু বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র হইছে, এখনকার বাস্তবতার লগে মিলানোর একটা চেষ্টা হইতেছে, খুবই সুবিধাবাদী এবং বাজে চেষ্টা এইটা। চাষী নজরুল ইসলামও ১৩:০০ মিনিট টাইমে হলিউডের সিনেমা যে ঢাকা শহরে চলতো, এর কথা বলতেছিলেন; কিন্তু দেখেন, অডিয়েন্স হিসাবে ইংরেজি-জানা মিডল-ক্লাসরে মাথায় রাইখাই কথা বলতেছেন।… ১৫:০০ মিনিটে আজিজুর রহমান বলতেছিলেন, ১৯৫৮ সালে বানানো একটা সিনেমা ভালো চলছিল, অইখানে থিকা সিনেমা বানানো শুরু হইছিল, সেই সিনেমার নাম অবশ্য উনি বলেন নাই, ‘বাণিজ্যিক ধারা’র সিনেমা ছিল বইলা হয়তো। মানে, ইনফরমেশনের চাইতে কোন জায়গা থিকা বাংলা সিনেমা’রে লোকেট করা হইতেছে, সেইটা যদি খেয়াল করতে চান, খুব বেশি ভ্যারিয়েশন নাই। যেমন, গিয়াস উদ্দিন সেলিম ভালো কথা বলছেন যে, রূপবানের মতন এইরকম মিউজিক্যাল সিনেমা তো হয় নাই আর! খুবই সত্যি কথা এইটা।… তো, যারা বাংলা সিনেমার একটা ভিজ্যুয়াল স্টোরি দেখতে চান, আমি রিকমেন্ড করবো যে, ফ্রেমগুলা যে খুব একটা চেইঞ্জ হইতে পারে নাই ওভার দ্য পিরিয়ড অফ টাইম, সেইটা দেখতে পাইবেন এইখানে। কিন্তু ইতিহাস বর্ণনা বা ন্যারেটিভ’টারে বিশ্বাস কইরেন না। 🙂
৩. সিনেমা-সাংবাদিকতা
বাংলাদেশের সিনেমা নিয়া যেই বইটার নাম সবচে বেশি শুনছি, সেইটা হইতেছে অনুপম হায়াৎ এর লেখা “বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিকথা”। সিনেমা নিয়া যারা কথা বলেন, বা টুকটাক কিছু জানেন তারা এই বইটার নাম বলেন। এমনিতে বাংলা সিনেমা নিয়া টুকটাক কিছু লেখা আছে, তার পুরাটাই হইতেছে অনুপম হায়াৎ’য়ের। কিন্তু এইটা আসলে একটা ইনফরমেশন বুক, তা-ও খাপছাড়া ধরণেরই কিছুটা। সিনেমা নিয়া উনার অবজারভেশন বা বিচার কিছু নাই। ৩২৮ পেইজের (A4 সাইজ) এই বইয়ে “রূপবান” সিনেমা নিয়া লাইন আছে ৫টা। আর বাংলাদেশের সবচে বেশি ব্যবসা করা সিনেমা “বেদের মেয়ে জোসনা” নিয়া একটা লাইনও লেখা হয় নাই। এমনকি টপ ৫টা সিনেমা (স্বপ্নের ঠিকানা, সত্যের মৃত্যু নেই, আম্মাজান, শান্ত কেন মাস্তান নিয়াও) কোন আলাপই নাই।
সিনেমা মানে যে ‘আর্ট’ আর ‘পুরষ্কার’ – এই আইডিয়ার একটা ট্রু ডিপ্টিকশন হইতেছে এই বই। মানে, বাংলাদেশের “চলচ্চিত্র সমালোচনার” যেই ধারা, সেইখানে খুব ভালোভাবে ফিট-ইন উনার অ্যাপ্রোচটা। নো ডাউট, এই কারণে হয়তো ইউনির্ভাসিটি লেভেলে রেফারেন্স বুক হইতে পারছে ‘পাঠ্যপুস্তক’ ফরম্যাটে লেখা এই বইটা। “চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব পরিচিতি” আসলে একটা ডিরেক্টরি টাইপ জিনিস, যেইটা রেগুলার বেসিসে আপডেট হইতে পারে, এই বইয়ে জরুরি ছিল না। অল্প কিছু ইনফরমেশন যা আছে, বেশ খাপ-ছাড়াই।… মানে এক্সপেক্টেডই ছিল ব্যাপারটা; তারপরও না বইলা তো পারা গেল না।
কিন্তু বাংলাদেশি সিনেমা নিয়া মিনিমাম কিছু ইনফরমেশন যে পাওয়া যায়, এর পিছেন হি ইজ দ্য ম্যান। আমি সবচে বেশি ইনফরমেশন পাইতে পারছি উনার বই, লেখালেখি থিকা। কিন্তু এই ইনফরমেশনগুলারে বেইজ কইরা উনি কোনভাবেই কোন আলাপে যান নাই। এইটাও রিকগনাইজ কইরা রাখাটা দরকার মনেহয়।
আমার ধারণা, এইরকম আরো ইনফরমেশন-অলা বই পাওয়া যাবে। যেমন, bmdb.co যে পুরাপুরি বাংলা-সিনেমা বেইজড একটা জিনিস করতে চাইতেছে, সেইটা ভালো ব্যাপার। ফজল এলাহী নামে একজন বিএনপি’র এক্টিভিজমের পাশাপাশি বাংলা-সিনেমা নিয়া অনেককিছু লেখেন, বাংলা-সিনেমারে সাপোর্ট করার একটা জায়গা থিকাই মোস্টলি, উনি বলতে চান যে, দেখেন, ‘ভালো’ অনেক বাংলা-সিনেমাও কিন্তু হইছে! তো, এইগুলা বলতে গিয়া বেশিরভাগ সময়ই লোয়ার কিছু প্যারামিটার’রে বাইছা নেন; যেমন, শেক্সপিয়রের নাটক থিকা সিনেমা বানানো হইছে – এইটা ভালো, কিন্তু এইটা শেষমেশ ‘ন্যাশনালিস্টিক’ একটা প্লেজারই হয়া থাকে। মানে, সিনেমার এই ‘ভালো-খারাপ’ কেমনে ঠিক করা হইতেছে, সেই জায়গাগুলারেই ক্রিটিক্যালি দেখতে পারাটা দরকার। এই ধারণার জায়গায়, এটিটুডের জায়গায় যেই ট্রেন্ড বা ন্যারেটিভের কথা আমি শুরুতে বলছি সেইটার বাইরে মেজর কোন আলাপ নাই।
আমার ধারণা, সিনেমা নিয়া বই-টইয়ের চাইতে সিনেমা-পত্রিকাগুলা বরং অনেকবেশি পপুলার ছিল। শুরুর দিকের পত্রিকাগুলা সিনেমা, উদয়ন খুব বেশি মার্কেট না পাইলেও, ১৯৭০ থিকা শুরু কইরা ১৯৯০ পর্যন্ত হয়তো সিনেমা-পত্রিকা আলাদা একটা ক্যাটাগরি হিসাবে ছিল। চিত্রালী, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রা সচিত্র সন্ধানী তখনকার সময় পাবলিক ও ইন্টেলেকচুয়াল দুই জায়গাতেই পপুলার ছিল; পরে ছায়াছন্দ, তারকালোক… এই ট্রেন্ডটারে ধইরা রাখছিল। তারকালোকে অনেক সিনেমা-পারসনদের অটোবায়োগ্রাফি ছাপানো হইছিল, সুমিতা দেবি ও সুভাষ দত্তের দুইটা খুবই সিগনিফিকেন্ট লিটারেচার হিসাবেও। এই ধারাতে লাস্ট চেষ্টা ছিল মেবি আনন্দভূবন, বেক্সিমকো মিডিয়ার; একই সময়ের আরেকটা পত্রিকা হইতেছে, আনন্দধারা। কিছু কিছু পত্রিকা তো এখনো ছাপা হইতেছে, আর অনেক পত্রিকাই “সিনেমা পত্রিকা” থিকা “বিনোদন পত্রিকায়” শিফট করছে উনাদের ক্যাটাগরি। কিন্তু তেমন কোন ইনফুয়েলন্স বা কন্ট্রিবিউশন উনাদের নাই বাংলা-সিনেমার জায়গায়।… ফিল্ম সোসাইটিগুলাও তো অনেক কিছু ছাপান মনেহয় এখনো, কিন্তু কোন লেখার কথা আমার জানা নাই যেইটা বাংলাদেশের সিনেমার ব্যাপারে কোন ইম্পর্টেন্ট আলাপ হাজির করতে পারছে।
আরেকটা ঘটনার কথা বলা যায়, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা যখন খুব হিট ছিল তখন (সময়টা শিওর হইতে হবে, ১৯৯৮ – ২০০৭/৮ মেবি) উনাদের “রস আলো” সাপ্লিমেন্টারিতে “ছিঃ নেমা” নামে একটা রিভিউ সেকশন ছিল, অইখানে ধইরা ধইরা ‘বস্তাপচা’ বাংলা-সিনেমাগুলারে পচানো হইতো। তো, অই সিনেমাগুলা ‘ভালো’ ছিল – এইরকম না, বরং অই হিউমারগুলা আসলে ছিল একটা রেইজ (rage)। বাংলা সিনেমা যে ছোটলোকের জিনিস, সেইটা তথ্যসহ প্রমাণ করার ঘটনা ছিল অইটা। সিনেমার জায়গাতে নাটকের লোকজনরে সেলিব্রেটি বানানো চেষ্টা হইছে পরে, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে।…
এমনিতে পত্রিকার ব্যাপারে যা হয়, পপুলারিটির বাইরে কোন ইন্টেলেকচুয়াল কোন পজিশন তৈরি করা তো উনাদের কাজ বইলা উনারা ভাবতে পারেন বইলা মনেহয় না; মানে, এইভাবে কোন পত্রিকা বা কোন সিনেমা-সাংবাদিক বাংলা-সিনেমারে শেইপ-আপ করতে পারেন নাই। তবে অনেকভাবেই অনেক কন্ট্রিবিউশন তো অনেকেরই থাকার কথা। অই রিকগনিশনগুলাও থাকা উচিত। কেউ কোনদিন এই চ্যাপ্টারটা নিয়া সুন্দর একটা বই লিখতে পারবেন হয়তো, আরো ডিটেইলে।
বই, লেখা ও ওয়েবসাইটের লিস্ট
১. বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিকথা – অনুপম হায়াৎ (২০১৭)
২. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, পাঁচ দশকের ইতিহাস – আবদুল্লাহ জেয়াদ (২০১০)
৩. চলচ্চিত্রের চালচিত্র – জাকির হোসেন রাজু (২০১২)
৪. বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, আর্থ-সামাজিক পটভূমি – আহমেদ আমিনুল ইসলাম (২০০৮)
৫. পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচনা (১৯৫৬ – ২০০৯) – অনুপম হায়াৎ (২০১০)
৬. চিত্র পরিচালক ও তারকাদের আত্মকথা – অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত (২০১৬)
৭. সিনেমা থেকে চিত্রালী – খন্দকার মাহমুদুল হাসান (২০১১)
৮. চলচ্চিত্রে নজরুল – আসাদুল হক (১৯৯৩)
৯. চলচ্চিত্র বিচার – বিধান রিবেরু (২০১৯)
১০. বাংলাদেশের ডিজিটাল চলচ্চিত্র – ফাহমিদুল হক (২০১৮)
১১. Cinema of Bangladesh: A Brief History – Fahmidul Haq (2020)
১২. Bangladesh Cinema and National Identity: In Search of the Modern? – Zakir Hossain Raju (2015)
১৩. চলচ্চিত্রকার সালাহউদ্দিন (২০০৯)
১৪. আমার সিনেমা জীবন – শাহজাহান চৌধুরী ( ২০১৫)
১৫. আলমগীর কবির রচনা সংগ্রহ ১ (২০১৮)
১৬. bmdb.co
১৭. www.filmfree.org
১৮. বাংলা সিনেমার ইতিকথা: দুই বাংলার সিনেমা (১৯৩১ – ২০১৪) – চন্ডী মুখোপাধ্যায় (২০১৫)
১৯. বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস (১৮৯৭ থেকে ১৯৪৭) – কালীশ মুখোপাধ্যায় (২০১২)
২০. আমার সিনেমার স্মৃতিকথা – আজিজুর রহমান
২১. বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস – প্রণব কুমার বিশ্বাস
২২. ফারুকীর টেলিভিশন, দূর-দর্শনের মিডিয়া এবং ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ – আ-আল মামুন
২৩. সিনেমা রেপ্রিজেন্টেশন: বোমা-জঙ্গি-মাদ্রাসা-ইসলাম এবং বাংলাদেশ – আ-আল মামুন
২৪. কিছু কালচারাল উইপন মিউজিয়ামে রাখতে চাই আমি – রক মনু
২৫. চলেন আমের কোলে উঠি – রক মনু
২৬. চলচ্চিত্রে ‘অশ্লীলতা’ প্রসঙ্গ এবং শ্যামলালের গল্প – মানস চৌধুরী
২৭. পাঠ: বেদের মেয়ে ছোসনা – ফরহাদ মজহার
২৮. ‘অশ্লীলতা’-বিরোধী প্রপাগান্ডা ও ‘সুস্থ’ চলচ্চিত্রের যুগে ঢাকাই সিনেমা – মোহাম্মদ আজম
২৯. নতুন সিনেমা সময়ের প্রয়োজন – নুরুল আলম আতিক
৩০. চলচ্চিত্র বিশ্লেষণের বিভিন্ন ধারা ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র চর্চা – জাকির হোসেন রাজু (২০০৫)
৩১. বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমা: জঁরা ও জাতীয়তার বন্ধনে (২০১৩)
(লিস্ট’টা ইনকমপ্লিট। আরো কিছু বই, লেখা, সিনেমা দেখার, পড়ার ইচ্ছা আছে। )
[টু বি কন্টিনিউ…]
Latest posts by ইমরুল হাসান (see all)
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (দুই) - সেপ্টেম্বর 17, 2024
- পলিটিকাল ডাইরি – ২০২৪ (এক) - সেপ্টেম্বর 4, 2024
- ধর্ম প্রশ্নে পুরান কমিউনিস্টদেরকে ইনডেমনিটি দিতে চাওয়াটা অনেকটা ইন্টেলেকচুয়াল অসততার ঘটনা: ফরহাদ মজহারের ‘মোকাবিলা’ (২০০৬) বই নিয়া আলাপ - আগস্ট 9, 2024