চতুর্দ্দশপদী কবিতাবলী – মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮৬৬)
মাইকেল মধুসূদন দত্তরে (১৮২৪ – ১৮৭৩) বলা যাইতে পারে পয়লা সাকসেসফুল পোয়েট, কলোনিয়াল বাংলা-ভাষার। নাটক, প্রহসন লেখলেও উনার “মেঘনাথবধ কাব্য” এবং “চতুর্দ্দশপদী কবিতা” হইতেছে সবচে সিগনিফিকেন্ট ঘটনা। উনার আগে বাংলা-ভাষায় যারা কবিতা লেখছেন – ভারতচন্দ্র রায় (১৭১২), এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও (১৮১২) কবিতাতে ইউরোপিয়ান, কলোনিয়াল চিন্তা ও ফর্মরে সেন্টার করতে পারেন (চাইছিলেনও কি!) নাই। সেইখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত-ই ফার্স্ট এক্সাম্পল।
এইটা বাদে বা এইটাসহ মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার আরো এটলিস্ট দুইটা সিগনিফেকন্স আছে। এক, উনি ‘আধুনিক’ বা কলোনিয়াল-বাংলাতে লেখছেন। যেইটা ধরেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রেস্কাইবড বাংলা, সংস্কৃত-বহুল, কইতে গেলে ঝঙ্কার উঠে, জিব্বায় টং কইরা উঠে, এইরকম।… মানে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের আগে (এবং এমনকি পরেও) এই ঝঙ্কার খুববেশি পাইবেন না। এইটা উনার ভাষার একটা ইউনিক ফিচার। উনার কবিতা আধুনিক-কলোনিয়াল বাংলা-ভাষার একটা মেনিফেস্টেশন। যেই কারণে “অতি আদরের জিনিস” এবং এখনো কলেজ-ভারসিটিগুলার বাংলা-ডিপার্টমেন্টে উনার কবিতা পড়ানো হয়। ভাষা হিসাবে “আধুনিক” – এইটা মেজর একটা ক্লেইম উনার কবিতার।
সেকেন্ড হইতেছে, কবিতার ফর্ম। মধুসূদনের আগ পর্যন্ত বাংলা-কবিতা ছিল “গীতি-কবিতা” এবং এর পরেও তিরিশের দশকে আইসা ইউরোপিয়ান মডেলটা আইডিওলজিক্যালি বাংলা-কবিতার দখল নেয়ার আগ পর্যন্ত কবিদের গান লেখতে হইতো, গান বা গীতি-কবিতা না লেইখা কারো পক্ষে কবি হওয়াটা বেশ টাফ ছিল, মানে, তেমন কোন নজির মনে হয় নাই।… গান আর কবিতা – দুইটা আলাদা ঘটনা হইতে পারে নাই অইভাবে, বাংলা-ভাষায়। (কিছু ফারাক তো ছিলই, কিন্তু সেইটা জরুরি ছিল না।) কিন্তু মধুসূদনের কবিতা তো গান না-ই, বরং এর থিকা অনেক দূরের একটা ঘটনা। সুর কইরা তো অবশ্যই পড়া যায়, কিন্তু সেইটা হইতেছে “কবিতার ছন্দ”। সনেটের চাইতেও উনার বড় আবিষ্কার হইতেছে “অমিত্রাক্ষর ছন্দ”; করি, পড়ি, মরি… এইরকম মিল-দেয়াটা যেইখানে জরুরি না।… কিন্তু উনার এই ছন্দ “অলংকার” হিসাবেই রয়া গেছে, অনেক বেশি ফলো করা হইছে – এর উদাহারণ কমই।
তো, খালি ছন্দই না, কবি হিসাবে উনার লিগাসিও পরের বাংলা-কবিতাতে কমই। মানে, খেয়াল করলে দেখা যাবে, মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা এক ধরণের “বিচ্যুতি”, বাংলা-কবিতার হিস্ট্রিক্যাল কনটেক্সটে। কিন্তু অই একসেপশনের কারণেই সেলিব্রেটেড – এইটা ভাবাটা কিছুটা ভুলই হবে। যদিও এইটাই ন্যারেটিভ হিসাবে চালু আছে। কিন্তু সোশিও-পলিটিক্যাল জায়গাগুলারে বাদ দিয়া পড়ার কারণে এইটা অনেক বেশি অবভিয়াস মনে হইতে থাকে আসলে।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত অবশ্যই ‘বিদ্রোহী’ হইছেন, ট্রেডিশনাল বাংলা-কবিতার কনটেক্সটে, কিন্তু সেইটা হইছেন উনি ‘ইউরোপিয়ান’ ট্রেডিশনরে মান্য করার ভিতর দিয়া। কলকাতার বামুনদের দিয়া ‘ত্যাজ্য’ হওয়ার পরে এর চে বড় বামুনের পৈতা উনি পড়ছেন। এবং একসেপ্টেড হইছেন। এইটা খালি উনার কবি-জীবনের ঘটনাই না, কবিতার ব্যাপারেও ইরিলিভেন্ট না এতোটা। এট লিস্ট দেড়শ বছর পরে আইসা এইটা কিছুটা খেয়াল করতে পারা যাইতে পারে মনে হয়।…
…
৩.
বঙ্গভাষা
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;—
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।
অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,
মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;—
কেলিনু শৈবালে; ভুলি কমল-কানন!
স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী কয়ে দিলা পরে—
“ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি,
এ ভিখারী-দশা তবে কেন তোর আজি?
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, যা রে ফিরি ঘরে!”
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে
মাতৃ-ভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে॥
১৬.
কবি
কে কবি— কবে কে মোরে? ঘটকালি করি,
শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন,
সেই কি সে যম-দমী? তার শিরোপরি
শোভে কি অক্ষয় শোভা যশের রতন?
সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী
যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,
অস্তগামি-ভানু-প্রভা-সদৃশ বিতরি
ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ-কিরণ।
আনন্দ, আক্ষেপ ক্রোধ, যার আজ্ঞা মানে
অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে;
নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে
পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে;
মরুভূমে— তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে
বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!
১৯
কবিতা
অন্ধ যে, কি রূপ কবে তার চক্ষে ধরে
নলিনী? রোধিলা বিধি কর্ণ-পথ যার,
লভে কি সে সুখ কভু বীণার সুস্বরে?
কি কাক, কি পিকধ্বনি,—সম-ভাব তার!
মনের উদ্যান-মাঝে, কুসুমের সার
কবিতা-কুসুম-রত্ন! —দয়া করি নরে,
কবি-মুখ-ব্রহ্ম-লোকে উরি অবতার
বাণীরূপে বীণাপাণি এ নর-নগরে। –
দুর্ম্মতি সে জন, যার মনঃ নাহি মজে
কবিতা-অমৃত-রসে! হায়, সে দুর্ম্মতি,
পুষ্পাঞ্জলি দিয়া সদা যে জন না ভজে
ও চরণপদ্ম, পদ্মবাসিনি ভারতি।
কর পরিমলময় এ হিয়া-সরোজে—
তুষি যেন বিজ্ঞে, মা গো, এ মোর মিনতি।
৩৪
কপোতাক্ষ নদ
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-যন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!—
বহু-দেশে দেখিয়াছি বহু-নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্ম-ভূমি-স্তনে।
আর কি হে হবে দেখা?—যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ-জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে তব নাম বঙ্গের সঙ্গীতে!
৩৬
বসন্তে একটি পাখীর প্রতি
নহ তুমি পিক, পাখি, বিখ্যাত ভারতে,
মাধবের বার্তাবহ; যার কুহরণে
ফোটে কোটি ফুলপুঞ্জ মঞ্জ, কুঞ্জবনে !
তবুও সঙ্গীত-রঙ্গ করিছ যে মতে
গায়ক, পুলক তাহে জনমে এ মনে ।
মধুময় মধুকাল সৰ্বত্ৰ জগতে,
কে কোথা মলিন কবে মধুর মিলনে,
বসুমতী সতী যবে রত প্রেমব্রতে ?
দুরস্ত কৃতান্ত-সম হেমন্ত এ দেশে
নির্দয় ; ধরার কষ্টে দুষ্ট তুষ্ট অতি !
দেয় শােভিতে কভু ফুলরত্নে কেশে,
পরায় ধবল বাস বৈধব্যে যেমতি।
ডাক তুমি ঋতুরাজে, মনােহর বেশে
সাজাতে ধরায় আসি, ডাক শীঘ্রগতি।
৭২
ভাষা
“O matre pulchrá—
Filia pulehrior ! ” HoR
লো সুন্দরী জননীর
সুন্দরীতরা দুহিতা !—
মৃঢ় সে, পণ্ডিত-গণে তাহে নাহি গণি,
কছে যে, রূপসী তুমি নহ, লো সুন্দরি
ভাষা!—শত ধিক তারে। ভুলে সে কি
করি শকুন্তলা তুমি, তব মেনকা জননী?
রূপ-হীন দুহিতা কি, মা যার অঙ্গরী?—
বীণার রসনা-মূলে জন্মে কি কুন্ধনি?
কবে মন্দ-গন্ধ শ্বাস শ্বাসে ফুলেশ্বরী নলিনী?
সীতারে গর্ভে ধরিলা ধরণী।
দেব-যোনি মা তোমার ; কাল নাহি
নাশে রূপ তার; তবু কাল করে কিছু ক্ষতি।
নব রস-সুধা কোথা বয়েসের হাসে?
কালে সুবর্ণের বর্ণ স্নান, লো যুবতি!
নব শশিকল তুমি ভারত-আকাশে,
নব-ফুল বাক্য-বনে, নব মধুমতী।
৯৭
মিত্রাক্ষর
বড়ই নিষ্ঠুর আমি ভাবি তারে মনে,
লো ভাষা, পীড়িতে তোমা গড়িল যে আগে
মিত্রাক্ষর-রূপ বেড়ি! কত ব্যথা লাগে
পর যবে এ নিগড় কোমল চরণে—
স্মরিলে হৃদয় মোর জ্বলি উঠে রাগে!
ছিল না কি ভাব-ধন, কহ, লো ললনে,
মনের ভাণ্ডারে তার, যে মিথ্যা সোহাগে
ভুলাতে তোমারে দিল এ কুচ্ছ ভূষণে?—
কি কাজ রঞ্জনে রাঙি কমলের দলে?
নিজ-রূপে শশীকলা উজ্জ্বল আকাশে!
কি কাজ পবিত্রি মন্ত্রে জাহ্নবীর জলে?
কি কাজ সুগন্ধ ঢালি পারিজাত-বাসে?
প্রকৃত কবিতা-রূপী প্রকৃতির বলে,—
চীন-নারী-সম পদ কেন লৌহ-ফাঁসে?
৯৯
আশা
বাহ্য-জ্ঞান শূন্য করি, নিদ্রা মায়াবিনী
কত শত রঙ্গ করে নিশা-আগমনে!—
কিন্তু কি শকতি তোর এ মর-ভবনে
লো। আশা!— নিদ্রার কেলি আইলে যামিনী,
ভাল মন্দ ভুলে লোক যখন শয়নে,
দুখ, সুখ, সত্য, মিথ্যা! তুই কুহকিনী,
তোর লীলা-খেলা দেখি দিবার মিলনে,—
জাগে যে স্বপন তারে দেখাস্, রঙ্গিণি!
কাঙ্গালী যে, ধন-ভোগ তার তোর বলে;
মগন যে, ভাগ্য-দোষে বিপদ-সাগরে,
(ভুলি ভূত, বর্ত্তমান ভুলি তোর ছলে)
কালে তীর লাভ হবে, সেও মনে করে!
ভবিষ্যত-অন্ধকারে তোর দীপ জ্বলে;—
এ কুহক পাইলি লো কোন্ দেব-বরে?
১০২
সমাপ্তে
বিসর্জ্জিব আজি, মা গো, বিস্মৃতির জলে
(হৃদয়-মণ্ডপ, হায়, অন্ধকার করি!)
ও প্রতিমা! নিবাইল, দেখ, হোমানলে
মনঃ-কুণ্ডে অশ্রু-ধারা মনোদুঃখে ঝরি!
শুখাইল দুরদৃষ্ট সে ফুল্ল কমলে,
যার গন্ধামোদে অন্ধ এ মনঃ, বিস্মরি
সংসারের ধর্ম্ম, কর্ম্ম! ডুবিল সে তরি,
কাব্য-নদে খেলাইনু যাহে পদ-বলে
অল্প দিন! নারিনু, মা, চিনিতে তোমারে
শৈশবে, অবোধ আমি! ডাকিলা যৌবনে;
(যদিও অধম পুত্র, মা কি ভুলে তারে?)
এবে—ইন্দ্রপ্রস্থ ছাড়ি যাই দূর বনে।
এই বর, হে বরদে, মাগি শেষ বারে,—
জ্যোতির্ম্ময় কর বঙ্গ—ভারত-রতনে!
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024