সুইসাইড
আমার জন্মস্থান ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জে। তো ভার্সিটিতে ভর্তির পর বাড়ি কই এই প্রশ্নের জবাবে ঝিনাইদহ বলতেই অনেকে হাসি ঠাট্টার ছলে বলতেন আরে এ তো সুইসাইড জোনের লোক। কথা সত্যি। আমাদের এলাকায় একসময় সুইসাইডের রেট ছিলো বাংলাদেশের যেকোনো এলাকার তুলনায় বেশি। কারণ কি তা জানতাম না, এখনো জানি না। রাস্তাঘাটে সুইসাইড রিলেটেড সচেতনতামূলক পোস্টার দেখেছি অনেক। একবার আমাদের কোন এক রিলেটিভ অসুস্থ এবং তিনি ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তো তাকে দেখতে আম্মু আমাকে সাথে করে নিয়ে গেছেন। এইটা ২০০১/২ এর দিকে। তো আম্মু হাসপাতালে ঐ রিলেটিভের সাথে কথা বলছেন আর আমাকে অস্থির দেখে হাতে টাকা দিয়ে বললেন বাইরে গিয়ে কিছু খাওয়ার জন্য। হাসপাতালের গেইটে এসে দেখলাম কীটশানক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালানো ২ জনকে ফ্লোরে ফেলে ওয়াশ করানোর কাজ করছে হাসপাতালের কর্মীরা। গলার মধ্যে পাইপ দিয়ে একদিক দিয়ে পানি পুশ করছে আরেকটা পাইপ দিয়ে পানির সাথে খাবার, রক্ত বের হয়ে আসছে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি নাই। আম্মুর দেয়া টাকা দিয়ে কিছু খাইতেও পারি নাই। ইভেন ঐ রাতেও খাইতে বসে বারবার ঐ দৃশ্য মনে পড়ছিলো। কি যে প্যাথটিক😑
এর পরের ঘটনাটা আমাদের এক বন্ধুর, স্কুল থেকে ড্রপ আউট হওয়ার পর হোটেলে কাজ করতো। খুব আর্লি এইজে বিয়ে করে আমাদের বাসার পাশেই একটা বাসায় ভাড়া থাকতো। ছোট্ট একটা বাচ্চা ছিলো ৪/৫ মাস বয়সী। ২০০৬/৭ সালের দিকে আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, এক ঈদের দিন দুপুরবেলা দোকানে বসে আছি। হঠাৎ চিৎকার চেচামেচি শুনে দোকান থেকে বের হয়ে দেখি আমার ঐ ফ্রেন্ড অচেতন। কীটনাশকের দুর্গন্ধ আসছে আর তার শ্বাশুড়ি তাকে টেনে হিচড়ে রাস্তায় নিয়ে আসছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আশপাশে আরো কয়েকজন জড়ো হয়ে গেছে। একটা রিকশায় তুলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ওয়াশ করানো হয়েছিলো। বাট একদিন পর মারা যায়। শুনেছিলাম ঈদের আগেরদিন রাত থেকে সকাল পর্যন্ত হোটেলে কাজ করে দুপুরে বাড়িতে এসে ঘুমাচ্ছিলো। বউয়ের সাথে স্টূডিও-তে ছবি তুলতে যাওয়ার কথা ছিলো এবং সেই বিষয়ে কথা কাটাকাটির জেরে সুইসাইড করে।
এর পরে ২০১৭ সালে চারকলার বন্ধু প্রদীপ সুইসাইড করে। প্রদীপও ড্রপ আউট হয়েছিলো বাট ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলো বিভিন্নভাবে। কিন্তু ডিপার্ট্মেন্টের সেশন জটের ঝামেলায় রেগুলার হইতে পারছিলো না, কিছুদিন একটা সিনেমার প্রোটাগনিস্ট হিসেবে একটা পাগলের ক্যারেক্টারে রিহার্সাল করতে করতে নাকি তারও বেশ আগের একটা রোড এক্সিডেন্টে মাথায় আঘাত পেয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারায়। আমাদের বন্ধু অয়ন আর হিমেল ওর যথেষ্ট টেক কেয়ার করতো। ওরা প্রদীপকে বাসায় দিয়ে আসে। আর ট্রিটমেন্টও চলতে থাকে। একবার সুস্থ হয়ে ঢাকায় আসছিলো কিন্ত একবেলা থেকেই আবার বাড়িতে চলে যায়। বলেছিলো নয়েজ সহ্য করতে পারে না। তারপর একদিন রাতে ফোন আসলো যে প্রদীপ সুইসাইড করেছে গলায় ফাস দিয়ে।
২০১৮ সালে চারুকলার এক বড় ভাই সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছিলো কিন্তু সময়মত ট্রিটমেন্ট করায় তিনি বেচে যান এবং এখন খুব সুস্থভাবেই নিজের কাজকর্ম করে যাচ্ছেন।
তো এই মানুষগুলোর ব্যাপারে যতবার ভেবেছি সুইসাইড করাটা ঠিক না বেঠিক সেইটা নিয়ে কোনো সমাধানে আসতে পারি নাই। মানুষের এই স্বাধীনতা থাকা উচিত নাকি অনুচিত সেইটাও ঠিক ক্লিয়ার না আমার কাছে। কিন্তু কেন একজন সুইসাইড করে সেই ব্যাপারে আমার এক ধরনের বোঝাপড়া আছে। যেটা ভুলও হইতে পারে।
আমার ধারণা মানুষ সুইসাইড করে আত্ম অভিমান থেকে। মানে নিজের ব্যাপারে কিছু সামাজিক নির্মান তাকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে যে কোনকিছু তার ইমাজিনেশনের সাথে না মিললে সে স্কেপ রুট হিসেবে সুইসাইড বেছে নেয়। তো এই যে নিজের ব্যাপারে একজন মানুষ সমাজের যেইসব চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে সেইটারে ওভারকাম করতে না পারার জায়গাটা তারে এইদিকে ঠেলে দেয়। এমনও শুনেছি ভালো ছাত্র ছিলো, এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করছে বইলা সুইসাইড করছে😑 তো এই যে ভালো ছাত্র সে ফেইল করলো পরীক্ষায়, কিংবা বউ তার সিচুয়েশন বুঝতে পারছে না ক্যান এইসব ভেবে হুট করে সুইসাইড করার ডিসিশন কি আদৌ তারে মুক্তি দেয়? জানি না তো? সে হয়তো ভাবে যে, এটাই মুক্তি।
কিন্তু সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকাইলে যা দেখা যায় তা মোটেও স্বস্তিদায়ক কিছু না। আমার এক বন্ধু তার তার কোন একটা পার্সোনাল কথা কারো কাছে শেয়ার করতে পারে না কারণ ঐটা নিয়ে তারে বুলিং করা হয়। মানে নিজের কোন খারাপ লাগার কথা নির্দ্বিধায় শেয়ার করবেন এরকম বন্ধু এই সমাজে খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে😑
সমাজের এই বিচ্ছিন্নতার পিছে অনেক অনেক রাজনৈতিক স্বার্থ খেলা করে। ধর্ম, বর্ণ, আর্থিক ক্লাস ইত্যাদি নানা ভাগে বিভক্ত। আমার কাছে এই বিভাজনগুলো খুব সাজানো বলে মনে হয়। কারণ সমাজে ঝামেলা, বিভাজন এইসব থাকলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নেয়া খুব ইজিয়ার। কিন্তু সমাজকে এই দায় থেকে মুক্তি দেয়ারও সুযোগ নাই। মুলত যিনি সুইসাইড করেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার মনে হয় সমাজ-রাষ্ট্র মিলে তারে খুন করছে আসলে।
ক্যাম্পাসের এক বড়বোনের সাথে দেখা হয়েছিলো কয়েক বছর আগে। হাজবেন্ড ও বাচ্চাসহ ধানমন্ডির এক রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া দাওয়া করছেন। তাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করার পর দেখলাম কথা আগাইতে চাইলেন না। রাতে দেখি মেসেঞ্জারে ভ্যানিশ মুডে টেক্সট করেছেন। “শাওন তোমার সাথে ভালোমতো কথা বলতে পারলাম না। সরি। আমার হাজবেন্ড নানারকম সন্দেহ করবে ভেবে আমি তোমাকে এভোয়েড করলাম। কিছু মনে করো না। আমি খুব বিপদে আছি। আমার ফোন রেগুলার চেক করে। তাই ভ্যানিশ মুডে টেক্সট করলাম। আমাকে ছেলে মেয়ে কারো সাথেই বেশিক্ষণ কথা বলতে দেয় না। আমি সিরিয়াসলি এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমার হাজবেন্ড সুইসাইডের হুমকি দেয়। ”
তো আমি ওনাকে রিপ্লাই দিলাম- “যিনি নিজেরে খুন পারেন তার কাছে আপনি কতটা নিরাপদ? মানে সে তো আপনারেও খুন করতে পারে।”
এরপর ওনার সাথে আর কোনদিন কথাও হয় নাই। তবে এই কথাটা বলার পর খারাপ লাগতেছিলো। যে সাত পাচ না জেনেই ওনার মধ্যে আরেকটা সন্দেহ ঢুকিয়ে দিলাম না তো?
যাইহোক, সুইসাইড সমাধান কিনা জানি না। তবে সমাজটা সুন্দর হইলে সুইসাইডের ইচ্ছা কমতে পারে বলে মনে হয়। আর যাদের বাসনা আছে সুসাইড করার তাদেরকে বলি- যতক্ষণ পারেন ফাইট দেন, একটাই তো জীবন, সেইটারে দেখেন যতক্ষণ পারেন দেখেন। সমাজটারে দেইখা যান ভালো করে। মরে যাবেন এইটা তো নিশ্চিতই, ফলে যত পারেন দেখেন। মরলে তো আর দেখতে পাবেন না।🙂
শাওন চিশতি
Latest posts by শাওন চিশতি (see all)
- আমার ভিজুয়াল আর্টের পথ এবং তারপর - আগস্ট 24, 2024
- চারুকলার মেইন্সট্রিমের থটস ও ডক্ট্রিন - আগস্ট 7, 2024
- সুইসাইড - এপ্রিল 9, 2023