চারুকলার মেইন্সট্রিমের থটস ও ডক্ট্রিন
২০১৪ সালের ইলেকশনের পর বিএনপি-র জ্বালাও-পোড়াও নিয়ে শিল্পীরা চারুকলার সামনে বিশাল বিশাল শিল্পকর্ম করলেন এবং যত অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে মোল্লাদেরকে দেখাইলেন। এর পরের মানে ২০১৫ সালের বৈশাখেও অশুভ শক্তির টুটি চেপে ধরা প্রতীকে চাঁদ তারার সিম্বল মারা হইছিলো। অথচ ১৫৩ আসনের আনকন্টেস্টেড ইলেকশন নিয়ে এদের মধ্যে মিনিমাম কোনো পাবলিক আলাপ দেখা যায় নাই। কারণ আওয়ামীলীগ জিতছে।
২০১৮ সালের শুরুর দিক, কলাকেন্দ্রে কাজ করি তখন আমি। কলাকেন্দ্রে বইসা বোধিচিত্তের চ্যানেলে মানস চৌধুরী-র একটা লেকচার শুনছি আন্তেনিও গ্র্যামসির উপর। হঠাৎ পিছন থেকে নিসার হোসেন আসলেন। আমাকে বললেন -” এই এইসব কি শুনতেছো? এ তো ফরহাদ মজহারের শিষ্য, এ তো জামাত-শিবিরের লোক।” আমি পুরাই বেকুব হয়ে গেছি। কি কয় এইটা। আস্তে আস্তে ঐ গং এর রাজনৈতিক পরিচয় স্পষ্ট হইতে শুরু করলো আমার কাছে। বিশেষ করে এর কিছুদিন পরেই যখন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু দাবী করলেন খান আতাউর রহমান একজন রাজাকার। ১৬ ডিসেম্বরের পর তিনি নাকি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কল্যাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
যাইহোক কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে একজন ভদ্রলোক বললেন কিভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। যেখানে সবচেয়ে বড় ক্রেডিট তিনি দিলেন ছায়ানটের ওয়াহিদুল হক এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে। অথচ চারুকলার তৎকালীন শিক্ষার্থীদের বক্তব্য সম্পুর্ন আলাদা।
আওয়ামীলীগের এই লাস্ট রেজিমে দেশের গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে এরা কোনোদিন কোনো পাবলিক প্রোগ্রাম করে নাই। করবেও না কারণ এরা চেয়েছে আওয়ামিলীগ-ই টিকে থাক। আর এদের পকেট ভর্তি হইতে থাকে।
মুলত বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর তার সাথে আওয়ামিলীগ কে একাকার করে দেখার বয়ান এই সুশীল প্রগতিশীল তকমাধারীরা দিয়ে যাচ্ছেন লম্বা সময় ধরে এবং যা কিছু এটাকে চ্যালেঞ্জ করে সেটাই যেনবা বিএনপি/জামাত/শিবির।
চারুকলায় একটা ভক্তিবাদী ট্রেন্ড আছে যেইখানে সবচেয়ে শক্তিশালী ট্রেন্ডের গোড়া হইলো আমাদের ৮০’র দশকের কয়েকজন শিল্পী কেন্দ্রিক। এরা স্বাধীনতার পরের প্রথম জেনারেশন যারা চারুকলায় পড়া শেষ করে বিভিন্ন এক্টিভিটিতে ছিলেন এবং এরা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের লেজুড়বৃত্তিক দল। ঐ সময়ে বাংলাদেশে মিডিয়ার সংখ্যা বাড়তেছে সেখানে চারুকলার কারো চাকরি বাকরি এবং চারুকলার ছাত্র হিসেবে দেশের বাইরে পড়তে যাইতে হইলে এই ভক্তিবাদের আনুকুল্যে থাকতে হইতো বলেই আমি ধারণা করি। সেইটাই এরা ক্যাশ কইরা যাইতেছিলো বহুদিন ধইরা। শুধু তা-ই নয়, যারা ছবি বেঁইচা খাইতে চান তাদেরও এই আনুকুল্যে থাকতে হইছে। এতে করে প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের মাথা হিসেবে যারা বইসা আছেন তাদের বেশিরভাগই এই ভক্তিবাদের লিগ্যাসি অথবা এর প্রোডাক্ট। অনিবার্যভাবে চারুকলা সময়ের সাথে সাথে লুথা একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইছে। মানে সম্পুর্ন অন্ত:সারশুন্য।
বিপত্তি-টা শুরু হইছে ০ দশকের শিল্পীরা যখন একটু এই লিগ্যাসির বাইরে আসতে শুরু করেছেন তখন থেকে। বিশেষত চাকরি বাকরি ফিল্ড বাড়ছে, বাইরে এসব শিল্পীদের নিজস্ব অবস্থান তৈরি হয়েছে তখন ঐ ভক্তিবাদী গ্রুপের ক্ষমতা ক্রমশ কমেছে এবং টিকে থাকার জন্য বাঙালী জাতীয়তাবাদ এদের অস্ত্র হিসেবে আবারও সামনে নিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামীলীগের একটানা ক্ষমতায় থাকা এরা বিভিন্নভাবে ভ্যালিডেট করতে শুরু করেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা সবচেয়ে বড় একটা টুলস। এই জেনারেশনের প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করেন দেখবেন এখন যারা আওয়ামীলীগ তারা আগে বাম করতো। এদের এক্টিভিজম অলয়েজ সিলেক্টিভ মানে আওয়ামী প্রোপাগান্ডা বাস্তবায়ন হওয়াটাই এদের এক্টিভিজম। আর এদের আর্টের কেবলা শান্তিনিকেতন, যেখানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চাষ হয়। এদের রাজনৈতিক সচেতনতা বলতে অতটুকুই মানে বাঙালী জাতীয়তাবাদ এর বাইরে আর কোনো রাজনীতি শিল্পীদের করার দরকার নেই যেনবা।
আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি/জামাত/শিবির বাইনারি খেলায় এদের মুল অস্ত্র। এর বাইরে কোনো মানুষ থাকতে পারে এরা জানলেও তা স্বীকার করবে না। যারাই একটু চ্যালেঞ্জ করবে তাদেরকেই বিএনপি/জামাত/শিবির ট্যাগ দিবে।
এখন এই ডক্ট্রিনের আলাপ খেয়াল করেন ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে চিন্তিত। অথচ এতগুলো মানুষ নিহত, আহত আর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে সেখানে এরা সামনে আনতেছে ভাস্কর্য ভাঙার খেলা। ভাস্কর্য ভাঙা আনডাউটেডলি খারাপ কিন্তু এই আওয়ামী ন্যারেটিভরে সামনে নিয়ে আসলে ইন্ডিয়ান মিডিয়ার সাথে তা এলাইন্ড হয়ে আমাদেরকে কতটা কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সেটা বুঝেশুনেই সমানে এই রিলেটেড ইভেন্ট করার পায়তারা করতেছে এই গ্রুপ। এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা প্রয়োজন যে যেসব ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে তার বেশিরভাগই ফ্যাসিবাদের আইকন। অবশ্যই কিছু পুরাতন ঐতিহ্যের ভাস্কর্যও সেখানে আছে কিন্তু সেগুলোকে এই ক্রিটিকাল টাইমে প্রাধান্য দিয়ে মুলত সংকট ঢেকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। ভাস্কর্য কিংবা যেকোনো ইমেজের রিপ্রেজেন্টেশন কিভাবে জনমানুষের সাথে কানেক্ট করে সেই ক্রিটিকাল আলাপ তুলবো দ্রুতই। আগে মানুষের পাশে দাঁড়াই, চিরায়ত আওয়ামী ন্যারেটিভ ভেঙে দিই, ভাস্কর্য আবার বানাইতে পারবো কিন্তু একটা জীবনও ফেরত নিয়ে আসার ক্ষমতা আমাদের নাই।
যারা এইসব করতেছে তাদেরকে চিনেন। সাবধানে থাকেন।
শাওন চিশতি
Latest posts by শাওন চিশতি (see all)
- আমার ভিজুয়াল আর্টের পথ এবং তারপর - আগস্ট 24, 2024
- চারুকলার মেইন্সট্রিমের থটস ও ডক্ট্রিন - আগস্ট 7, 2024
- সুইসাইড - এপ্রিল 9, 2023