Main menu

জনরোষে কি কেবল ‘ভাস্কর্য’ ভেঙ্গে পড়তেছে?

বেশ একদল “শিল্পী সমাজ” পাওয়া যাইতেছে যারা ফ্যাসিস্ট শক্তির আইকনিক মুর্তি/ভাস্কর্য এবং কালচারালি কনফ্লিক্টেড মুর্তি/ভাস্কর্য ভাঙ্গা নিয়া চিন্তিত। তাদের চিন্তা ও তৎপরতার অন্তসারশূন্যতা ও ধোঁয়াশা সংকটের সমাধানের থেকে আরো বেশী সংকটময় করে তুলতে পারে।

আমি সমস্ত ভাঙ্গাভাঙ্গি নিয়া কথা বলবো না। কেবল ২টি “মুর্তি/ভাস্কর্য” নিয়া আলোচনা করবো।

১। ধরুন একটি মুদি দোকান ভাঙ্গা হয়েছে আর ভাঙ্গা হয়েছে একটি সংসদ ভবন। এখন আপনি প্রতিবাদে বললেন বা প্রতিবাদ মূলক কোন পোস্টারে লিখলেন যে “স্থাপত্য ভাঙ্গা যাবে না”। কিনবা কোন সংবাদ মাধ্যম নিউজে হেড লাইন করলেন ” ২টি স্থাপত্য” ভাঙ্গা হয়েছে। যেমন অনেক উদবিগ্ন শিল্পী বলতেছে “ভাস্কর্য” ভাঙ্গা হয়েছে।

তাহলে সংকট কি হয় বুঝতে পারছেন নিশ্চয়?

সকলের সুবিদার্থে আরো পরিস্কার করে বলি। মুদি দোকান ও সংসদ ভবন ২টাই স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। যদি মুদি দোকানের স্থাপত্য না বলে কেবল স্থাপনা বলেন আবার সংসদ ভবনের স্থাপত্য না বলে কেবল স্থাপত্য বলেন এতে ২টারই গুরুত্ব কমে। এবং প্রায় এক বিমুর্ত ধারণা তৈরী হয় ভাঙ্গাভাঙ্গি সম্পর্কে। সত্যও লুকানো গেল এতে।

শেখ মুজিবের যে মুর্তি/ভাস্কর্য জনরোষে ভাঙ্গা হয়েছে তা ছিল এই জনরোষ তৈরীর মূল আইকন, অর্থাৎ যে ফ্যাসিস্ট শক্তি গণঅভুত্থানের মধ্যে দিয়া বিদায় নিল তার মূল প্রতিক । শেখ মুজিব নিয়া জনমনে নানা রাজনৈতিক চয়েজ থাকা অস্বাভবিক না। কিন্তু জনতা যে ফ্যাসিস্ট রেজিমের উপরে ক্ষুব্ধ ছিল তা তো এই মুজিব বিক্রির, দেশ তার বাপের, ইত্যাদির যে আইকন তা তো এই মুজিবের মুর্তিতেই আছে বলে মনে করছেন বিক্ষুব্দ জনতা, (এমনকি কিছু জাইগাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি দেরও তা করতে দেখাগেছে, জনতার সাথে সাথে)। ফলে তারা কেবল ভাস্কর্য ভাঙ্গে নাই ভেঙ্গেছে সেই ফ্যাসিস্ট আইকনের মুর্তি।

এখন যদি এই ভাঙ্গাকে আপনি কেবল “ভাস্কর্য” ভাঙ্গা বলেন তাইলে সত্য/ফ্যাক্ট লুকানো হয় বা সত্যের অবলোপন করা হয়। এইটা কংফ্লিক্ট করে আরেক জাইগাতে। ফ্যাসিস্ট রেজিমও তো কইতেছেই ” বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য” ভাঙ্গা হয়েছে আর অন্যদিকে কেউ কেউ দাবী করছেন কেবল “ভাস্কর্য” ভাঙ্গা হয়েছে। কোনটা ঠিক? এক অর্থে ২টাই ঠিক। কিন্তু পরের টা ফ্যাক্টস লুকায় এবং একটিকে কেবল “ভাস্কর্য” বিরোধী বা শিল্প বিরোধী কর্মকাণ্ড হিসাবে দেখানোর রাজনীতি চালু হয়।

ফলে, আপনারা যদি বিরোধিতা করতে চান তাইলে “শেখ মুজিবের/বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য” ভাঙ্গা যাবে না তা বলেন। তা যদি আবার ইন্সটল, সংরক্ষণ করতে চান তাহলে বলেন “শেখ মুজিবের/বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সংরক্ষণ করুন/করবো” । কিন্তু এইটা না বইলা যদি বলেন “ভাস্কর্য সংরক্ষণ করতে চাই” বলেন তাহলে তা ধূর্ততাপুর্ণ হয়। আপনাদের থেকে তারা পরিস্কার যারা বলতেছে “বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য” ভাঙ্গা হয়েছে।

ধোঁয়াশাপূর্ণ অবস্থা রাজনীতিকে আরো বেশী সংকটময় করে তুলতে পারে।

২। ময়মনসিংহের শশি লজের নূড ভেনাস ভাস্কর্য নিয়াও একি আচরণ করতেছে যা উপরে বর্ণিত করলাম। এক্ষেত্রেও ভেনাস উল্লেখ না করে যদি কেবল ভাস্কর্য সংরক্ষণ বলা হয় তাতেও একি সমস্যা। ফ্যাক্টস/সত্য লুকানো হয়।

ঔপনিবেশিক সময়ের জমিদার বাড়ির এই ভেনাস মূর্তি/ভাস্কর্য নিশ্চিত ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। সেটা সংরক্ষণ জরুরীও। এইটা কেবল গ্রিকের প্রেমের দেবী ভেনাস নয়, এইটা একি সাথে ঔপনিবেশিক সময়ের ১৯ ও ২০ শতকের হিন্দু জমিদারের সাংস্কৃতিক চিহ্ন এবং বাংলাদেশের উপনিবেশিক সময়ের শিল্পকলার নিদর্শন যেমন, তেমনি এর প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক গুরুত্বও অনেক। ফলে এই “ভানাস ভাস্কর্য” অতি অবশ্যই দলমত নির্বিশেষে সকলকেই সংরক্ষণ করার দায়িত্ব নিতে হবে।

এইটা যেমন কেবল ভাস্কর্য নয় তেমনি এইটা ফ্যাসিস্ট রেজিমের আইকন না হলেও এইটা কালচারাল কনফ্লিক্ট তো করেই। ফলে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এই কালচারাল কনফ্লিক্টকে অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে। এবং এইটা পূণঃপ্রদর্শণের ক্ষেত্রে কমিউনিটি স্টান্ডার্ড নিশ্চিত করতে হবে।

আমরা খুব নিশ্চিত না যে এইটা কোন ইসলামিস্ট দল ভেঙেছে, নাকি সাধারণ কোন মুসলিম ব্যক্তি ভেঙ্গেছে, নাকি কোন সুবিধা নিতে আগ্রহী কোন গুপ্ত ব্যক্তি ভেঙেছে। ফলে কোন পক্ষকে আগেই দোষ না দিয়ে এই ভাঙ্গার ফলে যে রাজনীতি তৈরী হয় তা নিয়া আমরা আলাপ করতে পারি।

দেখা যাচ্ছে, একদল কইতেছে ইসলামী মৌলবাদী কোন দল বা গ্রুপ এইটা করেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা রেজিমের পতনের পরে একদল যে কইতেছে দেশে জামায়ত আসবে এইটা তার লক্ষণ। তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নেই এইটা তারাই করেছে। জামায়াতের ইসলামী মূল্যবোধে আঘাত লাগার কারণে এমন কাজ করলে রাজনীতিটি পরিস্কার হয় উভয়ের জন্যই। কিন্তু আমরা তেমন ঘোষণা এখনো পাই নাই। বরং “ভাস্কর্য” রক্ষা কারীরা তাদের কালচারের উপরে আঘাত হিসাবে দেখতেছে এইটা। ফলে এই দুই তর্ককে পাশে রেখে আমরা বরং নুড ভাস্কর্য ও এর সেনসরশিপ নিয়া কিছু আলাপ আগে করে নেই।

শিল্পীদের প্রয়াশ ধারণা/চাহিদা থাকে যে শিল্পের সেন্সরশিপ একদম করা যাবে না। কিন্তু শিল্পের সেন্সরশিপ সেই আদি থেকেই এক জটিল ফেনোমেনা। বর্তমান সময়েও ফিল্মে সেন্সর দেওয়া হয়। রাজনৈতিক ও আদর্শিক সেন্সরশিপ সকল সময়েই তর্ক সাপেক্ষ। যেমন ধরেন আমাদের চলচিত্র নির্মাতা ফারুকির “শনিবার বিকেল” এখনো সেন্সরশিপের মধ্যে আছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার তা বন্ধ রেখেছে। এমনকি, কেন বন্ধ রেখেছে তার কোন ব্যক্ষা পর্যন্ত দেয় নাই। এই রাজনৈতিক সেন্সরশিপের অধিকাংশই মূলত ক্ষমতা কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। ক্ষমতার পালাবদলে তা পালটে যায়, বা বলবত থাকে। শিল্পী সমাজ এই নিয়া আন্দোলনও করে। প্রায় সকল সমাজেই এইটা খুব পরিচিত ঘটনা ।

ফিল্মে আরেক রকম সেন্সর থাকে যা বয়স দিয়া নির্ধারণ হয়। যাকে এক কথায় কমিউনিটি স্টান্ডার্ড বলে। প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ফিল্ম হইলে তা আগে উল্লেখ করতে হয় যাতে শিশু-কিশোররা তা দেখা থেকে বিরত থাকে। কমিউনিটি স্টান্ডার্ড খুব বেশী কার্যকর হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পরে। এখন ফেসবুকসহ প্রায় সমস্ত সোসাল মিডিয়া এই বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রনোয়ণ করেছে। কমিউনিটি স্টান্ডার্ড নীতিমালাতে না পড়লে তা সয়ংক্রিয় ভাবে সোসালমিডিয়াগুলা রেস্ট্রিকশন দেয়।

সোসাল মিডিয়া কী শিল্পকর্মের ক্ষেত্রেও এমন সেন্সর করেন/ বা রেস্ট্রিকশন করেন?

উত্তর হচ্ছে হা করেন। ২টি উদাহরণ দেই।

প্রথমটি ফেসবুকের শুরু দিকে একটা গ্রুপ খোলা হয়েছিল। তাদের দাবী ছিল ফেসবুক যেন শিল্পকর্মের উপরের রেস্ট্রিকশন না দিতে পারে, শিল্পের স্বাধীনতায় যেন হস্তক্ষেপ না করে। গ্রুপটি ২০১০ পর্যন্ত নানা ভাবে চেষ্টা করেছে, কিন্তু তারা সক্ষম হয় নাই। পরে আর গ্রুপটির হদিস পাওয়া যায় না। তারা কিছুদিন পরপর ফ্রেন্স আর্টিস্ট গুস্তাব কুর্বের “অরিজিন অব দা ওয়ার্ল্ড” ছবিটি পোস্ট আকারে দিয়ে দাবী দাওয়া করতো, জনমত তৈরী করার চেষ্টা করত শিল্পের স্বাধীনতার জন্য, শিল্পের নো সেন্সরশিপের জন্য । ( ১নং ছবিটি গুগল সার্স দিয়ে দেখে নিন)। আর প্রতিবারেই ছবিটি ফেসবুক সরিয়ে ফেলত। কোন ভাবেই ফেসবুক তা এলাও করেনি।

১৮৬০ এর দশকে গুস্তাব ছবিটি আকেন। খুব ডিটেইলে এক নারী যৌনাঙ্গ। ছবিটির নাম দেন অরিজিন অব দা ওয়ার্ল্ড। ছবিটি প্রদর্শনীর প্রথম দিনেই নানা তর্ক সমালোচনা চলতে থাকে। পরে জৈনক এক ফরাসি ব্যক্তি মামলা করে দেন, ফ্রেন্স সরকার তা প্রায় ১০০ বছর প্রদর্শীত করতে দেয় নাই। ১৯৬০এর দশকের পরে এটি লুভ মিউজিয়ামে রাখা হয় ও দর্শণার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। উন্মুক্ত করার পরপরই একি তর্ক চলতে থাকে, পক্ষ-বিপক্ষে। সেকেন্ড ওয়েভের নানা নারীবাদী শিল্পী প্রতিবাদ স্বরুপ এই শিল্পকর্মের সামনে নানা পার্ফমেন্স করেছেন।

পশ্চিমা মিউজিয়ামের ইতিহাসেও নানা রোমাঞ্চকর সেন্সরশিপের ঘটনা আছে , সেই আলাপ দিয়া দীর্ঘ করার দরকার নেই। বরং আমরা উপরের ঘটনা থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, কোন শিল্পকর্ম মিউজিয়ামে ঠায় পাইলেই তা গণপরিসরে সব ক্ষেত্রে উন্মুক্ত করার নজির নাই। বিভিন্ন সমাজ, প্রতিষ্টান তা নিজ নিজ সংস্কৃতি, বয়স ইত্যাদির মাফকাঠিতে তাতে সেন্সরশিপ আরোপ করে।

২য় টি আমার নিজের আব্বার তোলা আলোকচিত্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তোলা তার একটি জনপ্রিয় ছবি ( ছবি ২)/ আলোকচিত্রটি আমি নিজে ২০২১ পর্যন্ত নানা সময়ে আপলোড করেছিলাম। কিন্তু ২২এ, বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোকচিত্রটি আপলোড করতেই ফেবু তা রেস্ট্রিকশন দিয়া দিল। যতবার চেষ্টা করি ততবার রেস্ট্রিকশন দিতে থাকে। এমন কয়েকবার দেবার পর আমার একাউন্ট সাস্পেন্ড করে দেওয়া হয়। একদিন পরে তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানায় এইটা আমাদের কমিউনিটি স্টান্ডার্ড ভায়োলেশন করে । তাদের জানাইলাম এইটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ আলোকচিত্র, সত্য ঘটনা, ইত্যাদি। হয়তো তাদের এআই অটো জেনারেটেড কাজ করছে বিধায় তা বাদ দিচ্ছে। এমন কথা জানিয়ে আমি তাদের কাছে এপ্লিকেশন করলাম। তারা রিভিউ করে জানাইল আমরা শিশুদের নুড ছবি এলাও করি না।

Two boys stand among rocket bombs left by Pakistani army at the picnic corner in Jessore, Bangladesh. December 11, 1971.
The Bangladesh Liberation War or Mukti Juddho in Bangla, was a war between West Pakistan (now Pakistan) and East Pakistan (now Bangladesh), from 26 March until 16 December 1971. The war started as an insurgency in East Pakistan. Indian support for the insurgency resulted in war between India and Pakistan (the Indo-Pakistani War of 1971), during which Pakistani forces deployed in the East.

উপরে বর্ণিত উভয় ইমেজ মিউজিয়াম ও গুগলে পাওয়া গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক তা গ্রহণ করছে না তার কমিউনিটি স্টান্ডার্ডের জন্য। ফলে আমরা বলতেই পারি এই সমাজ গুগল বা মিউজিয়াম থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা তার নীতি আদর্শ সহ বৃহত্তর সমাজকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।

ফরাসি বিপ্লবের পরে নারীবাদের উত্থানের পর থেকেই নারী নুড আকার ও তা প্রদর্শণ নিয়া নানা তর্কবিতর্ক আছেই। এইটা আমরা সকলেই জানি। পুরুষ শিল্পীর আঁকা নারী প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পীর/সমাজের পুরুষতান্ত্রিক যৌন আকাংক্ষার প্রকাশ ঘটেছে (দেখুন , ওয়েজ অব সিন। বিবিসি ডকু, ইউটিউব) হয় তা স্বজ্ঞানে নয়তো সাবকন্সাসে। নারীবাদের ১ম ওয়েভের লেখাপত্র ও সাইকোএনালাইসিস আসার পরেই আধুনিক সময়ে বিশেষত ২১ শতকের গোড়া থেকে পশ্চিমা শিল্পীরা নিজেরাই নারী নুড ইমেজ আঁকা থেকে বিরত থেকেছে। ব্যতিক্রম থাকলেও তা নিয়ে তর্কবিতর্কও প্রচুর আছে। ২য় ওয়েভে নারী বাদী আন্দোলনে নারী শিল্পীরা নিজেদের দেহকে শিল্পবস্তু করে যে সমস্ত পার্ফমেন্স করেছে তা নিয়াও নারীবাদী শিল্পীদের মধ্যে নানা তর্ক বিতর্ক আছে।

ফলে, নারীর শরীর উপস্থাপন এককথায় সারার উপায় নাই, মুসলিম দেশগুলাতেও এইটা কেবল ইসলামিক কোন রেস্ট্রিকশন নয় একই সাথে নারীবাদীদেরও তা আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

তাহলে শশি লজের নুড ভেনাসরে নিয়া আমরা কি করবো? এইটা তো ঐতিহাসিক এক স্থাপনা।

এই প্রশ্নের সুরাহার আগে গত শতকের শেষ দশকে আমাদের পাশের দেশ ইন্ডিয়ান বিক্ষাত শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা নুড স্বরসতি নিয়া যে বিক্ষোভ হয়েছিল, এমনকি মকবুল ফিদার বাড়িতে পর্যন্ত হামলা হয়েছিল তা নিয়া কিছু আলাপ করে নেই।

আমরা সকলেই জানি মূলত ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক দলের বিজেপি ও আরএসএসএর কর্মী সমর্থক থেকে শুরু করে সাধারণ হিন্দু নাগরিকও এই হামলা ও বিক্ষোভ করেছিল। এর প্রতিবাদ স্বরুপ সে সময়ে ভারতের নানা স্তরের বুদ্ধিজীবী সমাজ দাড়িয়েছিল। সহমত বইলা একটা গ্রুপ ছিল, যাদের মধ্যে অরুন্ধুতি, গায়ত্রী স্পিভাক, গীতা কাপুর থেকে শুরু করে সে সময়ের ইন্ডিয়ার নানা প্রদেশের প্রায় অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী এক্টিভিস্ট এই গ্রুপের সদস্য ছিল। তারা প্রতিবাদ স্বরুপ একটি প্রদর্শণীর আয়োজন করতে চেয়েছিল, যেখানে তারা ভারতের নানা ঐতিহাসিক মন্দীর থেকে স্বরসতীর নুড ও রামের কুকির্তি নানা ভাস্কর্যের আলোকচিত্র নিয়া দিল্লিতে একটি প্রদর্শনী করতে চাইছিল। তাদের মূল কথা ছিল প্রাচিন মন্দিরে যদি স্বরসতি নুড থাকে তাইলে এখন মকবুল ফিদা তা কেন আকতে পারবে না?

বিজেপি আরএস এস ঐ খবর জানার সাথে সাথেই তাদের প্রদর্শনীর সমস্ত ডকুমেন্ট ভাংচুর করেছিল। আয়োজক ও বিদ্দত সমাজও তা নিয়া আর আগায় নাই।

এই ঘটনা সমুহ ১৯৯৮/৯৯ সালের। আমি ২০০০-০২ পর্যন্ত ভারতের গুজরাতে ছিলাম, আমার চিত্রকলায় এমএ সম্পন্ন করারা জন্য। সহমতের সেই ডকুমেন্ট আর কিছুই খুজে পাই নাই। আমার থিসিসের কাজের জন্য যা খুব জরুরী ছিল। এই নিয়া কেউ তেমন কথাও বলত না।

যাহোক, ২০০৪ সালে এমন ঘটনা আবার ঘটল, ভারতে আমি যে ফ্যাকাল্টিতে ছিলাম, সেখানেই। ইতিমধ্যেই সেখানে ২০০২এর বিজেপির মোদী কতৃক মুসলিমদের উপর জেনসাইড ঘটে গিয়েছিল। ফ্যাকাল্টির একজন হিন্দু স্টুডেন্ট এবার স্বরসতীকে নুড করে একটি পেন্টিং করলেন এবং ফ্যাকাল্টির বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করলেন। আরএসএস এর কর্মী বাহিনী এসে তা ভেঙে দেয়। এই ভাঙ্গার প্রতিবাদ স্বরুপ তৎকালীন ফ্যাকাল্টির ডিন ও শিল্পকলা ইতিহাসের অধ্যাপক , আর্ট ক্রিটিক শিবজী পানিকার এর প্রতবাদ স্বরুপ বললেন যে, এই পেন্টিং যদি ভাঙ্গা হয় তাহলে তাদের উচিত ভারতের সমস্ত প্রাচীন মন্দির থেকে নুড ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা। তার এই কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হবার সাথে সাথে তাকে বরখাসস্ত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আমার অত্যন্ত প্রীয় শিক্ষক ছিলেন। বছর ৫ আগেও শুনেছি, তারপর থেকেই তার জীবনে বিভিষিকাময় অধ্যায় শুরু হয় , কোথাও চাকরি হইত না। এমন কি পেনশন স্কিমও তাকে দেওয়া হয় নাই।

এই দুই ঘটনায় আপনি কি বিজেপির মৌলবাদ ও ফ্যাসিস্ট অবস্থা হিসাবে দেখবেন? নাকি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়া স্বরসতির যে ইমেজ নুডহীন ইমেজ দাড়াইছে তা দেখবেন? বিজেপি বা হিন্দু সমাজের বড় এক অংশের মধ্যে যে স্বরসতির/নারীর আব্রু সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন হইলে তাকে কিভাবে দেখবেন?

এইটাকে আমি জনসংস্কৃতির ঐতিহাসিক বিবর্তন হিসাবে দেখতে চাই। আর এই ক্ষেত্রে ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজ বরং সমাজকে উপেক্ষা করেছে যেমন তেমনি নারীর/দেবীর শরীর উপস্থাপন সম্পর্কে ক্রিটিক্যালি এঙ্গেজ না হয়ে কেবল “শিল্পের ও শিল্পীর স্বাধীনতা” বিষয়ক জবরদস্তির মধ্যে ছিল। এই জব্রদোস্তি সমস্যা যুক্ত ও সমাজে বিভেদ তৈরী করে।

২০ শতকের আধুনিকতা ও উত্তর –আধুনিকতা পরবর্তী ২১ শতকে শিল্পের পাবলিক স্ফেয়ারে উপস্থাপনার ধারনায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। ফলে, প্রায় সমস্ত বিশ্বেই ওপেন স্পেসে ও পাবলিক স্ফেয়ারের ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে কমিনিউটি স্টান্ডার্ড সেট করেই তা নির্মাণ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসাতে আমাদের সমাজ সম্পর্কে ধারণারও ব্যপক পরিবর্তন এসেছে। উন্নত বিশ্বেও জাদুঘর থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রদর্শনীতেও কমিউনিটি স্ট্যান্ড সম্পর্কে সচেতন করা হয়।

১৯৯৯ সালে বৃটিশ শিল্পীদের একটি গ্রুপ শো “সেনসেশন” ব্রুকলিন মিউজিয়াম বন্ধ করে দেয়। নিউ ইয়র্কের মেওরও এই প্রদর্শনির একটি কাজকে ঘিরে ধর্মীয় অফেন্সিভ আক্রমন হিসাবে দেখে তা মিউজিয়াম থেকে সরাইতে বলে, এই নিয়া নানা আইনি লড়ায় পর্যন্ত হয়। (ইন্ট্রোডাকশন টু আর্ট/৩৯)

পাবলিক স্ফেয়ারে কমিউনিটি স্টান্ডার্ড তাই এখন যে কোন শিল্প উপস্থাপনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিমুর্ত ভাষা/শৈলীই বেশী স্থান পায়। এইটা এমন ভাবার কারণ নাই যে এইটা কেবল ইসলামিক আদর্শের জন্য বা ইসলামিক রাষ্ট্রগুলাতেই। বরং এই ক্ষেত্রে ৩টা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক হিউম্যান ইমেজ গড়ার ক্ষেত্রে রেপেজেন্টেশনের সমস্যা (দেখুন- ওয়েজ অব সিন), যেকোন ইমেজের রাজনৈতিক ও আদর্শিক অবস্থান যেহেতু সময়ের আবর্তে পালটে যায়। যেমন বর্তমান “বঙ্গবন্ধু/ফ্যাসিস্ট মুর্তি”। ২ যেকোন বয়স ও জাতী ধর্মের জন্য তা কোন সমস্যা হয় না। যেমন মুকবুল ফিদার নুড স্বরসতি আর নিতে চাই নাই ভারতীয় সমাজ। ৩, সমসাময়িক স্থাপত্য কলার সাথেও তা সামঞ্জস্ব পূর্ণ হয়।

আমার প্রস্তাবনা শশী লজে গ্রীক প্রেম ও প্রণয়ের দেবীর নুড প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কমিউনিটি স্টান্ডার্ড সেট করা হোক, বয়স ও সমাজ ভিত্তিক। অর্তাথ শিশু কিশোরদের এই “ভেনাস নুড ভাস্কর্য” দেখা থেকে বিরত রাখা। প্রাপ্ত বস্কদের ক্ষেত্রেও সতর্ক বার্তা আগাম দেওয়া যাইতে পারে। সতর্ক বার্তায় অবশ্যই ভিনদেশী ও অন্য ধর্মে বা সমাজের স্থাপনা উল্লেখ থাকা ও এই বিষয়ে দেশীয়/আর্ন্তজাতিক নিয়ামবলি ও শর্ত যুক্ত থাকতে হবে।

অথবা ভেনাসের নুড ভাস্কর্যটি মিউজিয়ামে রাখা যেতে পারে।

শিল্পের স্বাধীনতার নামে সমাজকে অবজ্ঞা আমরা না করি। এতে সমাজে খুব্ধ প্রতিক্রিয়া হবার সম্ভাবনাই বেশী থাকবে।

পরিশেষে বলা যায়, ভাস্কর্য/মুর্তি বা শিল্প বস্তু ভাঙ্গার ইতিহাস এর গড়ার ইতিহাসের মতই দীর্ঘ। সমস্ত সমাজে, সভ্যতার নানা পর্যায়ে এই ভাঙ্গা ভাঙ্গি চলেছে। নিশ্চিত ভাবেই এই ভাঙ্গা-ভাঙ্গি কখনোই শিল্পের গুনগত মান নির্ভর করে হয় না, বা ইস্থেটিক্যাল কারণে নয় বা শৈল্পিক কারণে নয়। বরং ভাঙ্গা হয় এর রাজনৈতিক ও আদর্শিক কারণেই। দুক্ষজনক হলেও রাজনৈতিক আদর্শিক দন্দ ও বাহাস না বুঝে এই ভাঙ্গা-ভাঙ্গি নিয়ে কোন সুরুহা করা যায় না। বর্তমান সময়েও এইটা নানা সমাজে বিদ্দমান। এই তো বছর ২ আগে পৃথিবির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী “ডকুমেন্টাতে” জার্মান একদল ক্যাথলিকও প্রদর্শনীর নানা শিল্পকর্ম ভাঙ্গচুর করেছিল।

খেয়াল রাখা জরুরী ধর্মীয় সেনসেশন কেবল ইসলামের একার না যেমন তেমনি নুড ভাস্কর্য উপস্থাপনও। একি সাথে চরম রাজনৈতিক সংঘাতের সময় পক্ষবিপক্ষের প্রতিকে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস কেবল বাংলাদেশের নয়। সাথে ভাস্কর্য ও মুর্তিকে কে তো আলাদা করতে শিখতে হবে, অন্তত চারুশিল্পীদের। চারুশিল্পীদের আরো ভাবনার ব্যাপার আছে যে কেন ঢাকা চারুকলা জনরোষে পড়তেছে? চারুকলার আইকনিক চরিত্রের উপরেও কেন হামলা হইল? এই প্রশ্নগুলার আওয়ামী ন্যারেটিভের বাইরে গিয়ে উত্তর খোজা জরুরী।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

আব্দুল হালিম চঞ্চল

সাম্প্রতিক উদ্যক্তা হিসাবে কাজ শুরু করেছেন, "আঁতুড় ঘর" নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন, গ্রাফিক্স এনিমেশন বিষয়ে গ্রাম পর্যায়ে কর্মদক্ষ জনবল তৈরিতে। ফ্রিল্যান্সিং করে থাকেন এনিমেশন ও মোশন গ্রাফিক্সে। মোশন গ্রাফিক্সে কাজ করেছেন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে। পাশাপাশি অল্পসল্প দৃশ্য শিল্প চর্চা করে থাকেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ও পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউটে আধুনিক শিল্পকলা বিষয়ে পড়িয়েছেন। ঢাকা চারুকলা ও গুজরাতের এমএস ইউনিভার্সিটি থেকে যথাক্রমে ডিগ্রি ও এমএ করেছিলেন চিত্রকলায়।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →