Main menu

দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীদের মধ্যে বিভাজন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া

এই রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় বা ইতিহাসে আপনারা অনেক ধরনের ক্যু এর নাম শুনছেন সাথে আরেকটি সম্ভাব্য ক্যু এর বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।

গণতান্ত্রিক উপায়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তাই তারা চেষ্টা করছে বিভিন্ন অরক্ষিত গোষ্ঠীর ওপর সওয়ার হওয়ার তা আপনারা গত কয়েকদিনেই দেখেছেন। এর মধ্যে একটা গোষ্ঠী হলো চারুশিল্পী গোষ্ঠী, বিশেষত ভাস্কর। আওয়ামী লীগের তৈরি করা ধর্মীয় হেজিমনির আতঙ্ক ভাস্করদের মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত।

শিল্পীদের গ্রহণযোগ্যতা আছে অত্যন্ত সংবেদনশীল, প্রগতিশীল, সাহসী ও সত্যভাষী হিসেবে, আদতে পুরো পৃথিবীতে একমাত্র দেশ বাংলাদেশ যেখানে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে শিল্পীদের প্রত্যক্ষ/ পরোক্ষভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে, নিদেনপক্ষে নিষ্ক্রিয় সমর্থন আদায় করা হয়েছে। আপনারা দেখবেন কোন চারুকলা থেকে জুলাই ম্যাসাকার বা গত পনের বছরের আওয়ামী গুম, খুন, ধর্ষণ, নিপীড়ন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন বিবৃতি দিতে পারেনি। এক্ষেত্রে চারুকলা, অন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুষদের ভূমিকা হতে আলাদা নয় তবে অধিক শঙ্কার। কারণ, অন্য অনুষদগুলোর কতিপয় ছাত্র- শিক্ষকের সম্মিলিত সার্ভিস (আওয়ামী লীগের প্রতি) প্রতীয়মান/ দৃশ্যমান (apparent) হয় না যেমনটা হয় চারুশিল্পের ক্ষেত্রে।

উদাহরণ দেই একটাঃ অধ্যাপক আলী রীয়াজের ‘ডেমোক্রেটিক ব্যাকস্লাইডিং ইন বাংলাদেশ’ নামক গবেষণার উপর বিরক্ত হয়ে ২০ জুন ২০২৪ এ প্রাক্তন সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি আরেকটি গবেষণার রেফারেন্স দেন যা আলী রিয়াজের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে রিফিউট করে। পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায় উক্ত গবেষণা সরকারের ছত্রছায়ায় হয়েছিল। এই গবেষণা আর এর সাথে জড়িত গবেষকদের আমরা চিনিই না, অন্যদিকে চারুকলা বিষয়টি এমন নয়। এখানে দৃশ্যমান করা ও দর্শকের সম্পৃক্ততা তৈরি করাই বিষয়টির বৈশিষ্ট্য।

শিল্পী হাশেম খান, নিসার হোসেনের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দলীয় ভাষাই হয়ে ওঠে শিল্পের ভাষা। ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে (নির্বাচনের আগে) আমেরিকান স্যাংশনের জবাবে শেখ হাসিনার শিষ্টাচার বহির্ভূত অকূটনৈতিক মন্তব্যকে শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য এক মাসের মধ্যে গঠন করা হয় ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শিল্পীসমাজ’। সদস্য সচিব নিসার হোসেন বলেন “তারা সংঘবদ্ধভাবে এদেশের প্রতিটি কাজে প্রতিটি সিদ্ধান্তে নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করছে, বাধা প্রদান করছে, এমনকি আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিকে রোধ করার জন্য মানবতার শত্রু হিংস্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের পক্ষে প্রকাশ্য তৎপরতা চালাচ্ছে।” এই বক্তব্য সেসময় কয়েকজন মন্ত্রীর বক্তব্যের সারমর্ম। এখানে উল্লেখ্য যে দৃশ্যশিল্পীদের মধ্যে নানা কারণে পেইন্টাররা সমাজে ভাস্করদের তুলনায় অধিকতর সমাদর পান। এমনকি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও। তাদের সহযোগিতায় ভাস্করদের নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। নানা জায়গায় সরকারি বেসরকারি ভাস্কর্য বসানোর দখল থাকে তাদের পছন্দের লোকদের কাছে। তাই আমাদের দেশের গুটিকয়েক শিল্পীরা চায় আওয়ামী লীগ থাকুক। আবার ফিরিয়ে আনার জন্য কন্সেনসাস তৈরির লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ থাকলে টেন্ডারবাজি আর মনোপলি করে অমেধাবী ভাস্করও কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট পেতে পারে প্রতিযোগিতা আর জবাবদিহিতা ছাড়াই।

আওয়ামী রেজিমে হওয়া উল্লেখিত বিখ্যাত শিল্পীদের প্রদর্শিত কাজের বিষয়বস্তু, যেমনঃ দেশ ও ব্যক্তির স্বাধীনতা ও তার উপর ধর্মীয় আগ্রাসন দেখিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার ; শিল্পীর ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা- ট্রমা, আনন্দ-উচ্ছাসের ভিজ্যুয়াল দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে জাতির সামষ্টিক হাহাকার। আর হাজারে হাজারে স্মারক ভাস্কর্য বানিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে আয়নাঘর। আর এজন্যই আওয়ামী লীগের শিল্পীরা তার গুরুত্বপূর্ণ সাইলেন্ট ক্যাডার। এক যুগের কুকর্ম Samdani Art Foundation এর একটা একজিবিশন বা চারশ কোটি টাকার ভাস্কর্য দিয়ে কাভার-আপ করা গিয়েছে। প্রমাণ করতে পেরেছে আওয়ামী লীগ শিল্পের কত বড় পৃষ্ঠপোষক।

এমন পরিস্থিতি হওয়ার পিছনে চারুকলার একাডেমিক সিলেবাসকে আমি ভীষণ দায়ী মনে করি। এটি অত্যন্ত কলোনিয়াল এবং জাতীয়তাবাদি। দাবি করা হয় এটা একটি পূর্ণাঙ্গ বিষয় কিন্তু আদতে এটা একটা টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট ছাড়া কিছুই হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছাকৃতভাবে চারুকলায় ভর্তির পরীক্ষা পদ্ধতি মেধা বিচারের জন্য অসঙ্গতিপূর্ণ রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রতি বছর শুধুমাত্র একটি তত্ত্বীয় (থিওরি) বিষয় পড়তে হয়। এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে একটি বিষয় যার সাথে নৃতত্ত্ব থেকে শুরু করে অর্থনীতি, ইতিহাস সব কিছু জড়িত সেখানে অল্প কিছু শিল্পীর নাম, কাজ, সামান্য প্রেক্ষাপট, ইজম আর মাস্টার্সে খন্ডিত ভারতীয় নন্দনতত্ত্ব মিলিয়ে সাত বছরের সিলেবাস তৈরি করা হয়েছিল। একটি বিষয়কে নানান দিক থেকে বোঝার সক্ষমতা তৈরি করার কোন পরিবেশ ও সময় নেই। যেমন ধরুনঃ রেনেসাঁ । চারুকলায় রেনেসাঁ বা অজন্তা- ইলোরা যেভাবে পড়ানো হয় তা একেবারেই মুক্তিযুদ্ধের বয়ানের মত। এক্ষেত্রে দেখা যায় কোন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর ক্রিটিকালি পড়ার বা পড়ানোর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা ব্যক্তিগতই থেকে যায়।

আমার মতে ইতিহাস, যুদ্ধনীতি, ধর্ম, নৃতত্ত্ব, রাজনীতিসহ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সাথে চারুশিল্পের সম্পর্ক কম্পারেটিভ এনালাইসিসের মাধ্যমে না পড়লে এটা কোন মেথডই না এবং আমি মনে করি গির্জার অনুমতিক্রমে কাজ করা প্রাচীন শিল্পীদের সাথে এই ধরনের শিল্পীদের কোন পার্থক্য নাই। আর আমি এটাও মনে করি চারুকলা অনুষদকে এরকম নপুংসক, নখরবিহীন করে রাখা গভীর পরিকল্পনার অংশ। এতে করে শিল্পীদেরকে ভয়ার্ত ও নির্ভরশীল করে রাখা যায়।

যেকোন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার পরিসরে ব্যক্তিগত ভাবনা রেফারেন্স পয়েন্ট হতে পারে না। কিন্তু গত বিশ বছরে মাস্টার্স ডেজারটেশনগুলোর বেশিরভাগই তেলবাজী আর আনচ্যালেঞ্জড শিল্পানুভূতির আখড়া। সমাজের ব্যাখ্যায় শিল্পীর অনুভূতিই সর্বেসর্বা ও নিষ্পাপ হতে পারে না। কোন বিষয়কে ক্রিটিক ছাড়া চ্যালেঞ্জ ছাড়া পড়ার ও দেখার এই পদ্ধতির সাথে পনের বছর জবাবদিহিতাহীন সরকার থাকার সম্পর্ক দূরবর্তী নয়, নিকটে।

রাষ্ট্র সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, বাহিনী সংস্কারে কথা এসেছে আমাদের বুলিতে। এবার অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের মাধ্যমে অনুষদগুলো সংস্কারের কথা তুলতে হবে।

আর একটা কথা মনে রাখি আমরা যেখানেই জবাবদিহিতা নেই সেখানে স্বৈরাচারের বীজ বপন হয়।

The following two tabs change content below.

সামান্তা শারমিন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। মুসলিম নারী ভাস্কর। বিভাজনের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →