Main menu

বাঙালি ব্যাশিং: কয়েকটা প্যাটার্ন, উইদ এক্সাম্পল

গত ১ দশকে ধরে ভয়াবহ ১ প্রবণতা দেখে আসতেছি।

প্রবণতাটা আগেও ছিল তবে এখনকার মতো এত ব্যাপক মাত্রায় হয়তো ছিল না। থাকলেও অনলাইন না থাকায় চোখে পড়ে নাই।

দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সবচে বড় বাজার হয়ে উঠছে ঘৃণা ইন্ডাস্ট্রি। আর এই ঘৃণা ইন্ডাস্ট্রির বেস্টসেলিং প্রডাক্ট-এর নাম বাঙালি/বাংলাদেশিদের হরেদরে গালি দেয়া।

বাঙালি ব্যাশিং-এর ৩টা ভার্শন আছে মোটাদাগে। চিকনদাগে আরও বেশি। মোটাদাগের সংস্করণ নিয়া আলাপ করা যাক।

১. হার্ডকোর
২. সফটকোর
৩. জোক/এফরিজম-কোর

১. হার্ডকোর:

১ কথায় কাচাখোলা ভঙ্গিতে ‘বাঙালি’ ডেমোনাইজিং।
এই গ্রুপটা কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়া বাঙালিরে গাইলায়। গালি দিতে দিতে ডিমোনাইজ করে। এরা যদি রকেট সায়েন্স নিয়াও লেখে, তার উপসংহার ১টাই: বাঙালি খাচ্চর। বাঙালি ছোটলোক। বাঙালি অসভ্য।

এরা বাঙালি নাম দিয়া স্টেরিওটিপিকাল, ছায়াবাস্তব ১টা বর্গ হাজির করে আর হরদম ঠুয়া মারতে থাকে। দেশি ও বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়া এই গ্রুপ গঠিত। হুমায়ূন আজাদ এই ধারার আদি পুরুষদের ১জন। এই প্রবণতা দেখবেন শাফকাত রাব্বী, মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এর মধ্যে। ফাহাম আব্দুস সালামের অনেক লেখাতেও এইটা দেখছি।

২. সফটকোর ভার্শন:
এই ভার্শনটা এত সফট যে খেয়াল না করলে চোখেই পড়ে না। সিউডো-নিরপেক্ষতার ভাব ধরে এমন হালকা ভয়েসে লেখাগুলি হাজির হয় যে সতর্ক না হইলে মনে হয় ঠিকই তো।

যেমন ১টা টেমপ্লেট।

‘আমি [ ‘সংখ্যা’] বছর ধরে [ পশ্চিম ইউরোপ/ উত্তর আম্রিকার ১টা দেশের নাম ]-এ আছি। অথচ ‘অমুক’ বিষয়ে [ জাতির নাম ] এত [ দোষবাচক বিশেষণ ] না, বাঙালিকেই এমনটা দেখি।’

এরা খালি লাইফস্টাইল আর ম্যানার শিখায়। যেনবা ‘অসভ্য বাঙালি’রে এনলাইটেন্ড বা সভ্য বানানোর ১ মহা সিভিলাইজিং প্রজেক্ট নিয়া তারা আছে।

প্রবাসী আমিনুল ইসলাম, দেশের আরিফ আর হোসাইনসহ অনেকের মধ্যে এই সফটকোর ভার্শন পাবেন। নামগুলা নিচ্ছি জাস্ট বোঝানোর জন্য। চেনানোর জন্য। নইলে, ব্যক্তিতে না, এরকম অসংখ্য ব্যক্তির বা কালেক্টিভের প্রবণতায় মূলত আমার আগ্রহ।

এই সফটকোর ভার্শনের আদিপুরুষ মনে হয় নীরদ সি চৌধুরীরে। বিসাকের আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মধ্যে ও চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের মধ্যেও কিছুমাত্রায় এইটার চটুল ১টা ভার্শন পাওয়া যায়।

এরা আপনারে বলবে বাঙালি চিপসের প্যাকেট ফালায়ে ড্রেনেজ সিস্টেমের ১২টা বাজায়, ফলে শহরে জলাবদ্ধতা হয়। জায়গায় বেজায়গায় মুতে শহরটারে নষ্ট করে ফেলে।
কিন্তু কেন করে?
এরা বলবে, এই জাতটাই খারাপ।

এরা সিস্টেম বা রাষ্ট্রপ্রণালী নিয়া কিছু বলবে না, বাঙালি নামক বায়বীয় ১টা বর্গরে গালিগালাজ করবে আর বলবে এই ‘মাইন্ডসেটের কারণেই দেশের কোনো উন্নতি নাই’।

৩. জোক/এফরিজম/মিম-কোর:

জোকরে পলিটিকালি কারেক্ট হইতে বলাটা বাড়াবাড়ি। ফলে এই ভার্শন নিয়া বলায় জটিলতা আছে। তবে কিছু প্রবণতা নিয়া প্রশ্ন তোলা যাইতেই পারে।

আসেন, প্রিয় কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের প্রচুর শেয়ার হওয়া ১টা পোস্ট দেখি (এটাও কি এফরিজম/ম্যাক্সিম?)।

‘আদম নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো সিংহল দ্বীপে।
ইভ খোরাসানে।
আর ইবলিশ ঢাকায়।’

মানে কী এইটার?
মানে ১দম পরিষ্কার; কোনো দ্ব্যর্থবোধকতা নাই: মানে বাংলাদেশের মানুষ খারাপ/শয়তান।

এটা ফানি? কেন? ট্রুথ বলে? চমক দিয়া বলা বলে?

এইটা উদাহরণ মাত্র। কিন্তু এইরকম প্রচুর পোস্ট/মিম/জোক শেয়ার হইতে দেখি যার মূলভাব ঠিক এমনই। বাঙালি ছোটোলোক, খাচ্চর, অসভ্য। অনেকে আবার এই চিন্তারে ব্যাপক ইন্টেলেকচুয়াল আলাপ হিসেবে বোঝেন।

চালাক চালাক ভঙ্গিতে বলা বোকা বোকা এইসব কথার জনপ্রিয়তারে আমি ডরাই।

এইরকম আত্ম-ঘৃণা আমার কাছে সমস্যাজনক ঠেকে। অসুস্থ ঠেকে। এত এত আত্মঘৃণা প্যাথলজি তৈরি করে।

না, আমি বাঙালি বা বাংলাদেশি ভালো বা মন্দ এইরকম বর্গে ফেলতেছি না। কারণ এরকম বর্গে ফেলাটাই উগ্র জাত্যাভিমান কিংবা বিপরীতে জাতিঘৃণা তৈরি করে।

যেকোনো জাতি সম্পর্কে এইরকম স্থূল বিবৃতি ভুল। কোন দেশ বা জাতি নির্দিষ্ট ব্র‍্যান্ডের প্রডাক্ট না, যে সবাই একইরকম হবে। দেখার এই নজর বর্ণবাদে দুষ্ট। শতাব্দীর পর শতাব্দী কৃষ্ণাঙ্গদেরকে এইভাবে বলা দেখা হয়েছে, তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গরা জন্মগতভাবেই অপরাধপ্রবণ ইত্যাদি নানান স্টেরিওটাইপ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত, পূর্ব ইউরোপে হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টদের মধ্যে রোমানি বা জিপসিদের নিয়া এইরকম ‘জন্মগতভাবেই অপরাধপ্রবণতা’র স্টেরিওটাইপ চালু আছে।

এমন না যে বাঙালি/বাংলাদেশিদের মধ্যে ভন্ডামি, নষ্টামি নাই; আছে। সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেই নানান মাত্রায় আছে। কিন্তু আপনার ভাবনায় কোনো ★★জনসমষ্টির এসেনশিয়াল/ ফান্ডামেন্টাল ফিচার★★ সম্পর্কে অনুমান যদি এমন হয় তা ভয়াবহ ঝামেলার।

অথচ বড় সংখ্যক বাংলাদেশিদের কাছে বর্গ হিসেবে বাঙালি নিজেই যেন ১টা কমন পাঞ্চিং ব্যাগ হয়ে উঠছে।

আমরা যদি নতুন বাংলাদেশ ও পলিটি বানাইতে চাই, খালি হাসিনাশাহীর পতনে তা অর্জিত হবে না। স্থূল স্টেরিওটাইপ ভেঙে আরও বেটার, সকল এথনিসিটি, ধর্ম, বর্ণরে নিয়া ইনক্লুসিভ জাতীয় পরিচয়ও বিনির্মাণ লাগবে। আমাদের লাগবে নতুন ন্যারেটিভ, বয়ান এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক নির্মাণ।

সেজন্য সবার আগে প্রয়োজন এইসব সেল্ফ-হেইট্রেডের স্টেরিওটাইপ ভাঙা। আর দরকার চালাক চালাক ভঙ্গিতে বলা এই সব বোকা বোকা, স্থূলচিন্তারে কালচারাল ও বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে সাইজ করা।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

কে এম রাকিব

গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →