Main menu

‘সংখ্যা’ এজ আইডিওলজি

ফ্যাসিবাদের দিনে, ইতিহাস, সংখ্যা, এমন কি অধিকারও যে এজ আইডিওলজি ফাংশন করে, তারে আমি পড়ার চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সময়।সর্বশেষ, কয়েকদিন আগে, বন্ধু স্বাধীন সেনের সোশাল মিডিয়ার একটা শেয়ারকে ঘিরে, এই পাঠটারে আবার মনে করার প্রয়োজন বোধ করলাম। স্বাধীন সেদিন হঠাৎ কী মনে কইরা ‘মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ: মিথ না রিয়েলিটি’ নামে একটি লেখা শেয়ার এবং ট্যাগ করলেন আমাকে। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনের দেওয়া লেখাটার লেখক আরিফ রহমান। ১৫ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে, প্রতিচিন্তা নামের সাইটে প্রকাশিত হইছে।

সম্ভবত, আয়নাঘর থেকে ফেরা গোলাম আজমপুত্র ব্রিগ্রেডিয়ার আজমি সংবাদসম্মেলনে শহীদের সংখ্যা লইয়া আলাপ তোলায়, তিনি ‘প্রকৃত সংখ্যা’ জানাতে ব্রতি হলেন। যদিও এই আলাপ গোলাম আজমপুত্রেরও বহু আগের, দুই হাজার পনেরতে খালেদা জিয়া তুলছিলেন। আরো অনেকেই হয়ত তুলছেন, তার আগে পরে, কিন্তু আমার খালেদার এই ঘটনা মনে আছে একটি বিশেষ কারণে। সেই সময়ই খালেদার এই মন্তব্য নিয়া আমাদের বন্ধু পিনাকী ভট্টাচার্যর সাথে একটা তর্ক হইছিল, ফেসবুকে বা অফলাইনে। পিনাকী মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিরুপণ ও তালিকা প্রণয়নের খালেদার আহ্বানের ‘ঔচিত্য’ এবং ‘আস্পর্ধা’ নিয়া প্রশ্ন তুলছিলেন।

পরে, দুই হাজার পনেরতে তার একটি বইয়ের আলোচনায় পুরনো দিনের এই তর্কে তার রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও পরে অবস্থান পরিবর্তনের ভ্রমণ ও স্মৃতি উল্লেখ কইরা আলাপ করছিলাম, তাই মনে আছে। তখন পিনাকীর বোঝাপড়া ও রাজনৈতিক অবস্থান, বর্তমানের যে রেডিক্যাল চেহারা দেখেন আপনারা, ইউটিউবে, তার চাইতে ঢের রক্ষণশীল ও পচা বাম চেহারার ছিল। তো, আজকে স্বাধীনকে যে কমেন্ট করলাম, পিনাকীকেও তখন, কাছাকাছি কথা বলছিলাম। পিনাকির বই এর সেই আলোচনা থেকে, আমার কমেন্টটা এখানে কোট করতে পারি:

‘খালেদার এই আহ্বান রাজনৈতিকভাবে সঠিক আছে। কারণ, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে আওয়ামীলীগের একটি জমিদারি ও নাগরিকদের প্রতি প্রজাসুলভ ভাব নির্মাণের প্রকল্প আছে, যারে নিয়ে একটা ধর্মভাব তৈরী করা হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। আওয়ামীলীগের এই ইতিহাস নামক ধর্মপ্রকল্পের বাইরে থাকা জরুরি। এই আওয়ামী ইতিহাস প্রকল্পের নৈতিক ভিত্তিগুলোরে প্রশ্ন ও গুড়িয়ে দেওয়া দরকার। কারণ এই ধরণের অসংখ্য মিথ ও ইতিহাস প্রকল্পের উপরে ভর করেই তাদের সব গুম-খুন-জননিপীড়ণ ও লুঠপাটের বৈধতা তৈরী হয়।’

তো, স্বাধীনের শেয়ার করা লেখাটাও, নজর বুলালাম, সেই সংখ্যা। যেহেতু সংখ্যাবিষয়ক গবেষণায় আমার কোন আগ্রহ নেই, পড়লাম না। সংখ্যা তো বুদ্ধিজীবীর জন্য কাল্পনিক ব্যাপারই, ফলে লঘু কাজও। বরং, উপরে যে কইলাম, এই ধরনের আলাপগুলোতে সংখ্যা হল ‘আদর্শ’, ইতিহাস অনুসন্ধান না। এবং আওয়ামীলীগের যাবতীয় ইতিহাস প্রকল্পই হল এরকম, আদর্শ ও ধর্ম প্রকল্পই, ইতিহাসের চাইতে। ফলে, এই সংখ্যার আলাপগুলোরে এই ধর্মপ্রকল্পের বাইরে পড়া তো সম্ভবই না।

যেমন, এখানে সংখ্যা ব্যাপারটির চরিত্র হল, এই তর্কের কোথাও এই সংখ্যা, মানে ‘ত্রিশ লক্ষ’ শহীদের প্রতি ইনসাফ ও নায্য অধিকার সংরক্ষণের আলাপ আসে না। ‘সংখ্যা’ অক্ষুণ্ণ রাখার আলাপ শুধু। এমন না যে, এই তর্ক স্রেফ কল্পনা দিয়াই করার জরুরত, কোন ফ্যাক্টফাইন্ডিং ডকুমেন্ট নেই। শহীদের সংখ্যা ও তালিকা প্রণয়ন নিয়া মুজিবের সময়েই জাফরুল্লাহ চৌধুরী কমিশন হইছিল। সেই কমিশনের একটা ক্লাসিফায়েড রিপোর্টও আছে। এই রিপোর্ট এর আলাপ পাবেন না কোথাও। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই কমিশন পরে ভেঙে দেওয়া হইছিল। কেন? এইটা কি সেই আইডিওলজি ভাঙার ভয়ে? মানে, এই আলাপগুলো তাদের পূর্বানুমাণ, আওয়ামী রাজনীতি ও প্রপাগাণ্ডা, তার ভাড়াটে হবার বাইরে সব ধরনের অনুমান এবং তর্করেই গরহাজির রাখা কর্তব্য মনে করেছে। ফলে, শহীদেরা ব্রাত্য রহিয়া গেল, তাদের নামই জানা হল না, অধিকার দেওয়া দূরে থাক।

একইরকম ভাবে, দুই হাজার চব্বিশেও আমরা একটা গণহত্যার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এলাম, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে, শেখ হাসিনার বাহিনীর মাধ্যমে। শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পলায়নের মাধ্যমে এই গণহত্যার শেষ হল। তো, এই যে জুলাই গণহত্যা, এখানেও, কতজন শহীদ হল, এইটা প্রথমত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন প্রশ্ন। ফলে শহীদের কাল্পনিক সংখ্যা নিয়ে ব্যবসা, বা সংখ্যানুভূতির আইডিওলজি বানানোর চাইতেও, গুরুত্বপূর্ণ হল, তাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন করা সবার আগে। সুনির্দিষ্ট তালিকা, কারণ, তাদের হক ও পরিবারের পুনর্বাসনের দাযিত্ব আছে রাষ্ট্রের, বা জীবিত সকলের। এইটা আমরা দাবী করে আসছি ফ্যাসিস্টের পতনের দিন থেকেই। সমস্যা হল, মুজিব সরকারের যেমন, বর্তমান সরকারেরও ব্যর্থতা হল, শহীদদের সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হওয়া ও এখনতক তাদের হক নিশ্চিত করতে না পারা। তবে, জুলাই অভ্যুত্থানের এই তালিকা তৈরী ও হক নিশ্চিতের সময় এখনও যথেষ্ট আছে, মাত্র এক মাস সময় গেল।

কিন্তু, একাত্তরের শহীদদের বিষয়ে তো আপনি পরিচয় জানতেই পারলেন না, তাদের হক নিশ্চিত করা দূরে থাক। একাত্তরে শহীদের পরিবার বলতে আপনি মুষ্টিমেয় কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আর এলিট পরিবার মাত্র বোঝেন। বাকিরা কই? মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের হক ও ভাতা বংশ পরিক্রমায় নাতিপুতিসহ রক্ষার ব্যাপার থাকে, শহীদদের হক তারও চাইতে বেশি হবার কথা। কারণ, তিনি সর্বস্ব বিসর্জন করেছেন। কিন্তু, পঞ্চাশ বছরেও শহীদদের গ্রাম ও এলাকাভিত্তিক তালিকা পর্যন্ত করতে পারা গেল না। কেন?

তাদের প্রাণের দাম কি বেঁচে থাকাদের চাইতে কম?

এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন না তাদের ইতিহাসে। বরং, এই ‘সংখ্যা’রে আওয়ামী ইতিহাস প্রকল্পের একটা প্রেত মন্ত্র হিশেবেই হাজির পাবেন, যার নামে ইতিহাসে সব সময়ই আপনারে কোরবান করা হইছে শুধু তাই নয়, এই কোরবানির লেজিটিমেসিও হাজির করা হইছে এই সংখ্যা দিয়ে, তাদের সবগুলো শাসনামলে। এমন কি শাসনামলের বাইরেও। একটু উহ যদি করেন, তখন বলা হইছে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা, আপনি উহ করেন কোন সাহসে? ফলে, ইতিহাসের এই আওয়ামী প্রেতসাধনার কেন্দ্রগুলো গুড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে আমি। এখন না, আরো বহু বছর আগ থিকা।

 

 

 

 

 

রিফাত হাসান। সেপ্টেম্বর ০৪, ২০২৪

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রিফাত হাসান

কবি, বুদ্ধিজীবী ও ক্রিটিক । কবিতা, কৃষি ও বুদ্ধিজীবিতার আলাদা করে যে ক্ষমতাসম্পর্ক ও সভ্যতা, তার বিরোধীতা করেন রিফাত হাসান। জন্ম ১৭ জানুয়ারী, ১৯৭৯। শোভনদণ্ডী গ্রাম। পটিয়া, চট্টগ্রাম। বাংলাদেশ। ভাষা চাটগাঁইয়া ও বাংলা। বাহ্য: লুঙ্গি, জিনস ও শার্ট। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা: মক্তব, কওমি ও সরকার অনুমোদিত মাদ্রাসা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অর্থনীতি, পরে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে নন্দিত ও নিন্দিত। তার বই সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি প্রকাশের পরই বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে নতুন ধরণের কনটেন্ট হিশেবে চিহ্নিত হয়। গ্রন্থ: সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও রাজনীতি, দুয়েন্দে পাবলিকেশনস, ফেব্রুয়ারি ২০১৪। এই সময়টি আপনি কীভাবে উদযাপন করবেন, দুয়েন্দে পাবলিকেশনস, ফেব্রুয়ারি ২০১৫। জল্লাদখানায় বইসা কবিতাপাঠ, বৈভব, ফেব্রুয়ারি ২০২০। টেক্সট, কন্সপিরেসি ও রূপকথা, দুয়েন্দে, ফেব্রুয়ারি ২০২১
Avatar photo

Latest posts by রিফাত হাসান (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →