Main menu

কোনো কিছু করতে পারার সক্ষমতা অন‌্য কিছু একটা করতে না পারার অক্ষমতারে মাইনাস করে দেয় – নোম চমস্কি ও আন্দ্রেয়া মুরো’র আলাপ Featured

[১]

নোম চমস্কিরে আপনারা প্রায় সবাই চিনবেন। অন্তত নাম শুনছেন, একবার হইলেও। লিঙ্গুইস্টিক্স নিয়া যারা নাড়াচাড়া করেন তারা আন্দ্রেয়া মুরোরেও চিনেন। কিন্তু যারা লিঙ্গুইস্টিকসের বাইরের বা এই দুনিয়ায় নতুন তাদের কাছে আন্দ্রেয়া মুরো একটা নতুন নাম মনে হইতে পারে। তাদের জন্য আন্দ্রেয়া মুরোর একটা প্রাথমিক পরিচয় দিতেছি। আন্দ্রেয়া মুরোর যে পরিচয়টা আমি দিতে চাই সেইটা হইলো মুরো নোম চমস্কির ছাত্র। চমস্কির এমআইটির ক্লাসে মুরো ছিলেন। এবং পরবর্তীতে চমস্কির লং টাইম কলিগ হিশেবে একসাথে কাজ করছেন। আন্দ্রেয়া মুরো জাতিতে ইতালিয়ান। কর্মে লিঙ্গুইস্ট, নিউরোসায়েন্টিস্ট আর নভেলিস্ট। সিনট্যাক্স আর নিউরোলিঙ্গুইস্টিক্স হইলো মুরোর প্রধান ইন্টারেস্ট আর গবেষণার বিষয়। লিঙ্গুইস্টিকসের নামকরা কয়েকটা এক্সপেরিমেন্টের প্রধান আর প্রথম কুশলী হিশেবেও মুরো খ্যাত আছেন। দুনিয়ার বহু নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন, পড়াইছেন। এমআইটি আর হার্ভাডেও ফুলব্রাইট গ্রান্টে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট হিশাবে কাজ করছেন। তার বিখ্যাত বইগুলা হইল: ইম্পসিবল ল্যাঙ্গুয়েজেস, দ্য বাউন্ডারিস অব বাবেল, আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দ্য ভার্ব টু বি ইত্যাদি। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি স্কুল ফর এডভান্স স্টাডিজ পাভিয়া, ইতালিতে জেনারেল লিঙ্গুইস্টিকসের প্রফেসর হিশেবে কর্মরত আছেন।

আর মর্ডান লিঙ্গুইস্টিকসের বাপ আব্রাম নোম চমস্কিরে তো আপনারা চিনেনই! আমেরিকান প্রফেসর আর বুদ্ধিজীবি। লিঙ্গুইস্টিকসের বাইরে পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিজম আর সোশ্যাল ক্রিটিসিজমেও তার নাম আছে। অ্যানালিটিক ফিলোসফিরও একজন উস্তাদ পাবলিক। কগনিটিভ সায়েন্সের ফাউন্ডারদের একজন। ভাষাবিজ্ঞান, যুদ্ধ, রাজনীতি নিয়া দেড়শোরও বেশি বই লিখছেন। আমেরিকান বামদের মধ্যে, সেই ১৯৬০ সাল থেকেই, চমস্কি আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি, হাল জমানার পুঁজিবাদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার উপরে কর্পোরেট প্রভাবের লাগাতার সমালোচনা করে আসতেছেন।

[২]

মুরো এবং চমস্কির এই আলাপের কিন্তু একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে। আলোচনার ডাইনামিক চরিত্র, এক বিষয়ে আটকায়ে না থেকে কৌতূহল সৃষ্টিকারী বহু বিষয় নিয়া নানামুখী আলাপ তোলার দিক দিয়া। ল্যাঙ্গুয়েজ আর লিঙ্গুইস্টিক্স ছাড়াও হিস্ট্রি অব সায়েন্স, ভাষা আর ব্রেইনের সম্পর্ক নিয়াও বিস্তর আলাপ করছেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়া বর্তমানে যে উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা দেখা যায় চমস্কি এইগুলারে সিলিকন ভ্যালি থেকে ছড়ায়া দেয়া হাইপ আর প্রোপাগান্ডা বলে উল্লেখ করছেন। ব্রেইন স্টাডিজ নিয়া আলাপের সময় দেখাইছেন, ১৯৫০ এর দশকে ব্রেইন নিয়া করা গবেষণাগুলার কোনো ফলাফলই শেষ পর্যন্ত সেই সময়ের সাইকোলজির কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়াইতে পারে নাই। লিঙ্গুইস্টিকসে মুরোর করা কিছু নামকরা এক্সপেরিমেন্ট নিয়াও বিস্তারিত আলাপ আছে আলোচনাটাতে। পুরা আলোচনাটা এমন সহজ একটা ভঙ্গিতে আগায়ে গেছে যে পাঠক যত ভিতরে ঢুকতে থাকবেন তত নতুন নতুন বিষয় জানতে পারবেন। আরো বেশি জানার দিশা খুঁজে পাবেন। কেউ যদি এই বিষয়গুলা নিয়া পরবর্তীতে আরো পড়তে চান তাইলে কিভাবে আর কোথা থেকে আপনার শুরু করতে হবে এই নির্দেশনাটাও আপনি আলোচনাটাতে পায়া যাবেন। ফলে বলা যায়, লিঙ্গুইস্টিকসের পাবলিক তো বটেই, যারা লিঙ্গুইস্টিকসে নতুন বা এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী তাদের জন্য পুরা আলোচনাটা একটা পথের দিশারি হয়া কাজ করবো।

[৩]

ইন্টারভিউ হিশাবে আপনারা যে লেখাটা এখন পড়বেন এইটারে ইন্টারভিউ না বলে আলোচনা বলাই ভালো। চমস্কি আর মুরোর সম্পর্কটা যেহেতু বহুমুখী আন্তরিকতার, মানে একে তো ছাত্র-শিক্ষককের সম্পর্ক, তার উপর দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী সম্পর্কও আছে, ফলে এইটা কোনোভাবেই একপেশে সওয়াল-জওয়াব মার্কা কোনো রোবোটিক ইন্টারভিউ না থেকে খুবই উপভোগ্য একটা দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা হয়ে দাঁড়াইছে শেষ পর্যন্ত। ফলে পাঠকগণ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়াই পড়তে করতে পারেন।

চমস্কি আর মুরো যখন এই আলোচনা করতেছেন তখন পৃথিবীর মানুষ করোনার ভয়ে ঘরবন্দি হয়া দিন গুজরান করতেছেন। সাল চলতেছে একুশ, মাস জুলাই। চমস্কি বসে আছেন আমেরিকার অ্যারিজোনার টুসনে, মুরো আছেন ইতালির মিলানের এক শহর পাভিয়াতে। এই আলাপটা প্রথম ছাপা হয় দ‌্য এমআইটি প্রেসে, বাইশ সালে। পরে মুরো এই আলাপ নিয়া নিজের কিছু নোক্তা যোগ করে বই আকারে পাবলিশ করছিলেন।

শেষ কিছু কথা, এই কাজটা যে একজন মানুষ করছেন এইটার প্রমাণস্বরূপ কিছু ভুলত্রুটি হয়তো রয়েই গেছে। ভুলত্রুটিগুলারে মার্জনা করে লেখাটা থেকে আশল জিনিশটা যেন অর্জন করে নিতে পারেন এই আশাবাদ থাকলো।

পাঠকদের জন্য শুভ কামনা আর উস্তাদ মুজাহিদ শেখের প্রতি রইলো বিনম্র কৃতজ্ঞতা!

শাদাব হাসিন
উকিলপাড়া, কিশোরগঞ্জ

[আলাপের অংশ]

আন্দ্রেয়া মুরো: এই বিষয়ে এর আগেও আমরা অনেক আলোচনা করছি যে বর্তমানে সম্পূর্ণ নতুন চ‌্যালেঞ্জটা হইল “হোয়‌্যার প্রবলেম” থেকে মনোযোগ সরায়ে এখন আমাদেরকে “হোয়াট প্রবলেম”-এ ফোকাস করতে হবে। হোয়‌্যার প্রবলেম মানে মস্তিষ্কের কই কই অন্য কগনিটিভ ক্যাপাসিটির বদলে ভাষার প্রতি সংবেদনশীল নির্দিষ্ট সার্কিটগুলা সক্রিয় হয়। আর হোয়াট প্রবলেম হইল, যেখানে এখন আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত, ঠিক কী কী তথ‌্য একটা নিউরন আরেকটা নিউরনে পাস করে তা আলাদা করে ধরতে পারা, নির্ধারন করতে পারা। তবে আবারও সেই একই কথা, জেনারেটিভ লিঙ্গুইস্টিক থিওরিরে ব‌্যাকগ্রাউন্ড না ধইরা এই ব‌্যাপারে চিন্তা করাই শুরু করতে পারবেন না। বিখ‌্যাত, সর্বব‌্যাপী ছড়ায়া যাওয়া ”বিগ ডাটা”রে ধইরাও চলব না। কারণ, প্রায় অগুণতি বাক‌্য বিশ্লেষণ করে মানুষের ভাষার সিনট‌্যাক্স ধরতে চাওয়ার ব‌্যাপারটা অনেকটা এমন হবে যে, ঘরে বসে জানালা দিয়া সূর্যের কোটি কোটি ছবি তুলে এইটা প্রমাণ করতে চাওয়ার মতো যে, সূর্য আশলেই স্থির, আমরাই সূর্যরে কেবলা করে ঘুরতেছি। বৈজ্ঞানিক কোনো গবেষণা এইভাবে কাজ করে না; যদিও নীতিগতভাবে এইটারে আপনি সম্ভব বলতে পারেন। তাছাড়া, বিগ ডাটা গবেষণা যদি ভাষার একটা মোটামুটি স্ট্রাকচার ধরায়াও দিতে পারে, তবুও বিগ ডেটার পরিসংখ‌্যান যে খালি আন্ধা নকল করার বদলে আমাদের মস্তিষ্কের আসল মেকানিজমরে খুব ভালোভাবে ডিকোড করে ফেলতে পারবে এই সম্ভবনা খুবই কম। আর শিশুরা যখন তাদের নিজেদের গ্রামার আত্মস্থ করতে থাকে তখন যে ভুলগুলা ওরা বারবার করে সেইগুলা যে ধরতে পারবে না এইটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সব কথার এক কথা, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি মনে করি হিউম‌্যান ল‌্যাঙ্গুয়েজের কোর পার্ট, সিনট‌্যাক্স, সম্পর্কিত এই ফিল্ডের যে সব এক্সপেরিমেন্ট ডিজাইন করা সম্ভব তা কেবল জেনারেটিভ লিঙ্গুইস্টিককের প্রক্রিয়া এবং ৫০-এর দশকে এই বিষয়ে আপনার মাথা থেকে আসা ব্যাখ্যা বা টিকাটিপ্পনিগুলোকে মাথায় রেখেই সম্ভব।

কিন্তু নতুন ধারার রিডাকশনিজমের বিপদগুলা নিয়া আপনার মতামতের কথায় ফেরত যাইতে চাই, কাছাকাছি এমন একটা বিষয়ে আপনি একবার রিসার্চ করছিলেন, এইগুলা আমাদের সাথে শেয়ার করতে আপনারে অনুরোধ জানাই। আমার মনে আছে, ক্লাসে একবার আপনি গ্র্যাভিটি নিয়ে আলাপ করছিলেন। কার্তেসিয়ান যুগে, তখনকার ট্রেডিশনাল দার্শনিকরা ভাবতো যে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতেছে কারণ চাঁদ পৃথিবীর কেন্দ্রে থাকা একধরনের ইথারিক ভর্টেক্সের চক্করে আটকা পড়ে গেছে, মানে চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝখানে একটা সরাসরি মধ্যস্থতাকারী কানেকশন আছে। তারা চাঁদের ঘূর্ণনকে এইভাবে ব‌্যাখ‌্যা করছিলো কারণ যৌক্তিকভাবেই ছাড়া কোনো কিছুকে নাড়ানো সম্ভব না। কিন্তু এরপরেই নিউটনের ম‌াধ‌্যাকর্ষণ সম্পর্কিত সূত্রগুলা আবিষ্কার হইলো। সূত্রগুলা ব্যাখ্যার সুবিধার্থে একশন এট আ ডিস্টেন্স-কে সত্য বলে ধরে নেওয়া হইলো। এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পরিস্থিতি এবং আইডিয়াগুলা নিয়া আপনার নিজের চিন্তাভাবনাগুলা আমাদের যদি বলতেন। কারণ আমার কাছে লাগে যে, আজকের দিনে নিউরোসায়েন্স যে চ‌্যালেঞ্জগুলা মোকাবেলা করতেছে, ওই সময়ে মাধ‌্যাকর্ষণের ধারণার মোকাবেলা করা চ্যালেঞ্জগুলার মতোই অনেকটা।

নোম চমস্কি: আচ্ছা, কিছু পিছের শতকের কথা দিয়া আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলে নেই। যেমনটা আমি আগেই বলছিলাম, বর্তমানের “বিগ ডাটা” ইউফোরিয়ার সাথে বার-হিলালের বর্ণনা করা সেই আগের ইউফোরিয়ার ভালোই মিল আছে। যেই ইউফোরিয়ার কথা ছিলো: আমাদের কাছে সব ঘটনার ব্যাখ্যা আছে। এইটাই প্রথম এমন ঘটনা না। ষোলো শতকেও, যেইটারে নিও-স্কলাস্টিক পিরিয়ড বলে, একই ঘটনা ঘটছিলো। নিও-স্কলাস্টিক যুগের ফিজিক্সের এমন অনেক রেজাল্ট ছিল; বহুত জিনিশের খুব ভালো ভালো ব‌্যাখ‌্যা দিছিলো। আর তখন প্রায় সবকিছুর একটা না একটা উত্তর ছিলই।

মনে করেন, আমার হাতে একটা কাপ আছে। কাপভর্তি গরম পানি। কাপটারে আমি ছাইড়া দিলাম। কাপটা গিয়া পড়লো মাটিতে। পানি বাষ্প হয়া আকাশে উড়ে চলে গেল। বলেন, কেন? এইটার উত্তরও তাদের কাছে ছিল। তারা বলতো, সবকিছু তাদের নিজেদের আশল জায়গায় ফিরা যায়। কাপটা ফিরা গেল মাটিতে, কারণ মাটি থেকেই কাপ তৈরি হয়; পানি বাষ্প হয়া উড়ে গেল বাতাসে, কারণ বাতাসই বাষ্পের আশল জায়গা। দুইটা জিনিশ যদি নিজেদেরকে আকর্ষণ আর বিকর্ষণ করতে থাকে তাইলে বুঝবেন জিনিশগুলার মধ‌্যে পরস্পরের প্রতি সিম্প‌্যাথি আর এন্টিপ‌্যাথি কাজ করতেছে। আপনি যদি পরস্পর তিন বাহু দিয়া বানানো একটা ফিগারের দিকে তাকান, তাইলে একটা ত্রিভুজ দেখতে পাইবেন। কারণ? ত্রিভুজের যে আকার বা ফিগারটা আছে, সেইটা বাতাসের মাধ‌্যম হয়া এসে ঢুকে আমাদের চোখে, তারপরে আমাদের মস্তিষ্কে একটা ছবি বানায়ে নেয় এইটার। তাইলে দেখেন, আপনি কিন্তু এই প্রশ্নেরও একটা উত্তর পাইলেন। আশলে, প্রায় সবকিছুরই এইরকম একটা না একটা উত্তর ছিল তাদের কাছে। অনেকটা স্ট্রাকচারালিস্ট পিরিয়ড, মার্কোভিয়ান ইনফরমেশন থিওরেটিক পিরিয়ড ইত‌্যাদির মতন।

গ‌্যালিলিও এবং তার সমসাময়িক অন্য চিন্তকদের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্জন আছে। তারা নিজেদেরকে গভীরভাবে ভাবার সুযোগ দিছিলেন। তারা ভাবতে গিয়া নতুন নতুন জিনিশ পাইলেন আর বললেন,“ওয়েইট আ মিনিট!” এই বর্ণনাগুলা আশলে সেসবের উপরে ভিত্তি করে দেয়া যেইগুলারে তারা বলতেন “অকাল্ট আইডিয়া”: এমন আইডিয়া যেগুলার আশলে কোনো‌ মালমশলা নাই। “ভাষা আশলে শিখন আর অভ‌্যাসের বিষয়”, ৪০ ও ৫০-এর দশকের এই অর্থোডক্সি ধারণার মতো আরকি। এই আইডিয়া দিছিলেন আমেরিকার বিখ‌্যাত লিঙ্গুইস্ট লিওনার্ড ব্লুমফিল্ড। অন‌্যরাও একই জিনিশ বিশ্বাস করতেন। বাচ্চাদেরকে অগুণতি উদাহরণ দিয়া শিখানো হয়। ফলে তাদের মধ‌্যে কোনো একভাবে একটা অভ‌্যাস গড়ে উঠে। ফলে তারা বুঝে যায়, এর পরে কী কী বলতে হবে। তারা যদি নতুন কিছুও বানায়ে ফেলে বা বুঝে ফেলে, ধরা হয় এইটা আশলে অ‌্যানালজির ফল। খেয়াল করবেন, কথাটা নিয়ে চিন্তা করাও অসম্ভব, এর ভেতর সার বলতে কিছু নাই।

গ‌্যালিলিও আর তার সমসাময়িকরাও নিও-স্কলাস্টিক যুগের সায়েন্স নিয়া একই ধারণা পোষণ করতেন। তারা বলতেন, এইগুলা ননসেন্স। এরপর তারা মূলত থট-এক্সপেরিমেন্টগুলা করতে শুরু করলেন। গ‌্যালিলিও তার এক্সপেরিমেন্টগুলা কখনো প্র‌্যাকটিক‌্যালি করেন নাই। করলেও তেমন সফল হইতেন না, কারণ তার টুলগুলা ছিল খুবই ব‌্যাকডেটেড। ফলে তিনি “হবেই হবে” এমন জিনিশগুলা নিয়া কাজ করলেন। এইজন‌্যই তিনি পিসার টাওয়ার থেকে সত‌্যি সত‌্যি বল ফেলে দিয়া পরীক্ষা করেন নাই। তিনি যা যা করছেন সবই আশলে বিস্ময়কর কিছু থট-এক্সপেরিমেন্ট। তিনি ভেবে বের করে দেখাইলেন যে, আপনার কাছে যদি লোহার একটা করে বড় বল আর ছোট বল থাকে, আর আপনি যদি বল দুইটারে উঁচা থেকে ফেলে দেন তাইলে দুইটা বলই সমান গতিতে পড়তে থাকবে। ভালো যুক্তি।

গ‌্যালিলিরও এই চিন্তাভাবনা তখনকার দিনের পৃষ্ঠপোষক, অভিজাত মহল আর ন‌্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের উপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে নাই। কনভিন্সও করতে পারেন নাই তাদের। তাদের বুঝেই আসতেছিলো না কেন ফ্রিকশন নাই এমন একটা সার্ফেসে বলের গড়ায়া যাওয়া নিয়া আমাদের গবেষণা করতে হবে, যেখানে ফ্রিকশন নাই এমন কোনো সার্ফেস এগজিস্টই করে না। এইগুলা বাদ দিয়া তো আরো কত কত দারুণ বিষয় আছে গবেষণা করার মত, যেমন ফুলের বেড়ে উঠা, সূর্যাস্ত এবং এইরকম আরো যা যা আছে। তো, তাদেরকে কনভিন্স করাই ছিল তখন সবচাইতে কঠিন কাজ যে, দেখেন ভাইসব, এই ছোট ছোট জিনিশগুলা নিয়া গবেষণা করা যাইতে পারে।

ধরেন, পালতোলা নৌকার মাস্তুলের একেবারে উপরে একটা বল আছে। নৌকাটা সামনের দিকে আগায়ে যায়তেছে। তাইলে বলেন, বলটা কেন মাস্তুলের তলাতে এসে পড়লো, কেন পিছনের দিকে পড়লো না, কারণ কী নৌকাটা সামনের দিকে আগায়ে যায়তেছে এইজন‌্য? কিন্তু গ‌্যালিলিও শুধু থট-এক্সপেরিমেন্ট করেই দেখাইলেন যে, এমনিই হয় নাই, এইটার একটা নির্দিষ্ট কারণ আছে। আধুনিক বিজ্ঞান এমনেই ডানা মেলতে শুরু করছিলো।

কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের এই বিকাশটাও হইছিলো এক মজার উপায়ে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা, গ‌্যালিলিও এবং আরো যারা যারা আছেন, সবাই প্রশ্নগুলার একটা সিরিয়াস ব‌্যাখ‌্যা খুঁজতেছিলেন। তখন তারা নিয়া আশলেন মেকানিক‌্যাল ফিলোসফির ধারণা। এই ধারণাটা ইউরোপের তখনকার বেশ কিছু ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হইছিলো। দক্ষ শিল্পী-কারিগররা তখন খুব জটিল জটিল সব জিনিশ তৈরি করতেছেন–অনেক ধরনের কাজে আসার মতো জটিল ঘড়ি বানাইতেছেন। আর্টিফিশিয়াল কিন্তু দেখতে প্রায় জীবন্ত ফিগার বানায়তেছেন। ভার্সাইয়ের গার্ডেনের কথা বলা যায়। ‍পুরা ইউরোপই তখন জটিল জটিল সব আর্টিফ‌্যাক্টে ভরা। আরেকটা মডেল আছে, একটা হাঁস খাইতেছে এমন, জ্যাক দ্য ভক্সানসনের নকশা করা। এই জিনিশগুলা ইঙ্গিত করে যে, হইতে পারে এই পৃথিবীটাও একটা বড় জটিল কোনো মেশিন। যেমনে ঘাগু শিল্পীরা এমনসব জিনিশ তৈরি করে যেগুলা দেখলে আমাদের মাথা গুলায়ে যায়, মনে হইতে থাকে এইগুলার বুঝি জীবন আছে, মনে হয় সেইভাবেই মহান কোনো শিল্পী পুরা পৃথিবীটারে একটা জবর-জটিল মেশিনের মত করে বানায়ছেন।

আমি মনে করি বর্তমানে আমাদের সামনে একটা খোলা প্রশ্ন আছে যেটা নিয়া আমাদের বিস্তারিত আলাপ করার সময় হইছে। আমার মন বলে, মানে এই মনে হওয়াটা আশলে একেবারে অন্তরের ভেতর থেকে উঠে আসা–কথাটা হইল, দুনিয়া সম্পর্কে একটা সহজাত বোঝাপড়া বা ইনসাইট সকল মানুষেরই থাকে, এই বোঝাপড়া একেবারে নিজস্ব। যেমন, বিখ্যাত একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা বলি আপনারে। মনে হয় এক্সপেরিমেন্টটা করছিলেন মিশট, ১৯৪০-এর দশকে। পরীক্ষাটাতে দেখানো হইছিলো, আপনি যদি একটা বাচ্চার সামনে দুইটা পাথরের টুকরা রাখেন আর টুকরা দুইটার মধ্যে হালকা ফাঁকা আছে দেখা যায়। আপনি যদি বাচ্চাটারে দেখাইতে পারেন, একটা টুকরা নাড়াচাড়া করলে বা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরালে দ্বিতীয় টুকরাটাও সরে বা জায়গা পরিবর্তন করে, তাইলে বাচ্চাটা নিজে থেকেই এটা ধরে নিবে যে বার দুইটার মধ্যে গোপন কোনো না কোনো কানেকশন আছেই। সাধারণভাবেই, আমরা চোখের সামনে যা যা ঘটতে দেখি প্রতিটা জিনিশের জন্য আমাদের মন একটা মেকানিক্যাল এক্সপ্লানেশন রেডি করে ফেলে, এই ব্যাপারটা ঘটে খুব ন্যাচারালি। আর আমার মন বলে, এই বিষয়ে কোনো পরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, মেকানিক্যাল ফিলোসফির জ্ঞান আমরা ইনবর্ন লাভ করি, খুব ন্যাচারাল, দুনিয়ারে ব্যাখ্যা করার জন্য এইটা আমাদের একটা সহজাত প্রতিক্রিয়া। সায়েন্সরেই আগে “ফিলোসফি” বলা হইতো। যারে আগে বলা হইতো “সায়েন্স”, মূলত মেকানিক্যাল সায়েন্সরেই বলা হইতো।

দেকার্তেও এমনভাবে চিন্তা করতেন, যেমনটা আপনি উল্লেখ করছিলেন, ওনি তো ছিলেন বড় মাপের বিজ্ঞানী। দেকার্তে বিশ্বাস করতেন তিনি প্রমাণ করে দেখাতে পারবেন যে এই পৃথিবীটা আশলে একটা মেশিন। মজার বিষয় হইল, এই বিষয়ে খোঁজখবর করার সময় তার মনে হইল, ‍দুনিয়াতে তো এমন একটা জিনিশ আছে যেটা মেশিনের চরিত্রের সাথে যায় না, জিনিশটা হইল ভাষা। তিনি বললেন, এমন কোনো মেশিন বানানো সম্ভব না যেটা মানুষের মতো আবেগ, অনুভূতি (ভাষার ঐচ্ছিক ব্যবহার) দেখায়তে পারবো। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ যেমনে খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়া (অথবা ভাষা ব্যবহার করে) দেখায়, মানে এমন তো কোনো বাঁধাধরা নিয়ম মানুষের নাই যে একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এমন এমন নির্দিষ্ট আচরণই (অথবা ভাষার ব্যবহার) সে করতে পারবে শুধু।

কার্তেসিয়ানরাও একই কথা বলে, মানুষ যে নিজের মতো করে কথা বলে বা ভাষার ব্যবহার করে এইটা সে নিজের খেয়ালখুশি মতোই করে, কেউ তারে বাধ্য করে ভাষারে এমনভাবে ব্যবহার করতে বলে না। মানুষ নিজের মন-স্বাধীন মতো বাঁচে আর নিজের মন-স্বাধীন মতো নিজের মাথার ভিতরে চিন্তাভাবনা বানায়ে নেয়, অন্যজনে বুঝতে পারবো ভাষার এমন নতুন নতুন ব্যবহার সে নিজের ইচ্ছামতো বানায়ে নেয়। মানব চরিত্রের এই ন‌্যাচারাল সত্যগুলারে স্বীকার করে নেয়ার জন্য দেকার্তে মেটাফিজিক্সের এক নতুন প্রিন্সিপাল বা নীতির প্রস্তাব তুলছিলেন, নীতিটা ছিল রেস কজিটানস (res cogitans), চিন্তা তৈরি করার জন্য ভাষার ন‌্যাচারাল ব্যবহারবিধি।

আশলে, ‌গ‌্যালিলিও এবং পোর্ট রয়‌্যালের ভাষাবিদ, যুক্তিবিদরাও এই একই জিনিশ খেয়াল করছিলেন, তবে ভিন্নভাবে। এই ফ‌্যাক্টটার প্রতি তাদের বিস্ময় আর মুগ্ধতা প্রকাশ করছিলেন। তাদের কাছে এইটারে অলৌকিক মনে হইছিলো, এবং কিছু অর্থে এখনো এইটারে অলৌকিকই মনে হয়। কেবলমাত্র কয়েকটা সিম্বল (বর্ণ, ধ্বনি, সংখ্যা ইত্যাদি) ব‌্যবহার করে আপনি লক্ষ-কোটি চিন্তা বানায়ে ফেলতে পারতেছেন আবার এই চিন্তাগুলারে এমনসব মানুষের কাছে প্রকাশ করতে পারতেছেন যাদের আপনার মনের কথা বুঝে ফেলার কোনো ক্ষমতাই নাই। বলেন, এইটা কেমনে সম্ভব হইলো? ল‌্যাঙ্গুয়েজ স্টাডির এইটা একটা বড় জিজ্ঞাসা।

তো তখন দেকার্তে, গ‌্যালিলিও, আরনল্ড এবং আরো যারা আছেন এটা স্বীকার করে নিলেন যে, ভাষা আর চিন্তা ছাড়া বাকি পৃথিবীটা একটা যন্ত্রই, ভাষা আর চিন্তা মেকানিক‌্যাল ফিলোসফির আওতায় পড়ে না। এরপর আইজ‌্যাক নিউটন মঞ্চে আসলেন। বস্তুসমূহের পারস্পারিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া (ইন্টারেকশন) সম্পর্কিত দেকার্তের ভর্টেক্স থিওরি নিয়া ওনি একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। ভর্টেক্স থিওরি যে আশলে কাজের না এইটা বুঝানোর জন‌্যই নিউটন প্রিন্সিপিয়ার দ্বিতীয় খণ্ড লিখছিলেন। তাইলে, শেষমেষ আমরা কী পাইলাম? বস্তুগুলা একে অপরকে আকর্ষণ করে, বিকর্ষণ করে কিন্তু বস্তুগুলার মধ‌্যে কোনো পারস্পারিক কানেকশন নাই। নিউটন এই ধারণাটারে বললেন অ‌্যাবসার্ড; বিজ্ঞানের ন‌্যূনতম জ্ঞান আছে এমন কোনো লোকই এইটারে বরদাশত করবেন না। অন‌্য গ্রেট সায়েন্টিস্টরাও নিউটনের কথায় সায় দিয়া এই ব‌্যাপারটারে বিনা বাক‌্য ব‌্যয়ে বাতিল করে দিলেন। লিবনিজ বললেন, এইটা হাস‌্যকার: কেমনে এইটা সম্ভব হইতে পারে? গ্রেট এক্সপেরিমেন্টালিস্ট ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স বললেন, এই জিনিশ ননসেন্স। এইটা তো সেই অকাল্ট আইডিয়াগুলারে ফিরায়ে আনার মতো। নিউটনও তার কথায় সায় দিলেন। নিউটন সাহেব বললেন, হ, এইটা অকাল্ট আইডিয়াগুলারে ফিরায়ে আনার মতোই, তবে একটু ফারাক আছে। বস্তুর আচরণ ব‌্যাখ‌্যার জন‌্য এই আইডিয়াগুলা ব‌্যবহার করে একটা থিওরি বানাইছি। তিনি কিন্তু কাজগুলারে ফিজিক্সের ফিলোসফি বা এমন কিছু বলে মেনশন করেন না। তখন ফিলোসফি মানে বিজ্ঞানরেই বোঝাইতো। তিনি এইটারে শুধু ম‌্যাথমেথিকেল বললেন, ম‌্যাথমেথিক‌্যাল থিওরি। কারণ হইলো, তিনি বলছিলেন, “আমার কাছে এর কোনো ব‌্যাখ‌্যা নাই।” “আমি কোনো হাইপোথিসিস দিতেছি না”, তার বিখ‌্যাত এই উক্তিটা এই ব্যাপারেই দিছিলেন। তিনি বলছিলেন,“এইটার কোনো ফিজিক‌্যাল এক্সপ্লানেশন নাই আমার কাছে। কোনো হাইপোথিসিসও এই ব‌্যাপারে আমি দিব না।” আর এই কথা বলেই নিউটন তার হাত ধুয়ে ফেলছিলেন। আশলে, গ‌্যালিলিও, লিবনিজ, নিউটনসহ আধুনিক বিজ্ঞানের আরো যারা ফাউন্ডিং ফাদারস আছেন, তাদের কাছে কোনো কিছুর একটা মেকানিক‌্যাল মডেল ছিল বোধগম‌্যতার মানদণ্ড বা স্ট‌্যান্ডার্ড অব আন্ডারস্ট‌্যান্ডিং-এর মতো। তারা মেকানিক‌্যাল মডেলরে আন্ডারস্ট‌্যান্ডিং-এর একটা স্ট‌্যান্ডার্ড হিশেবে গ্রহণ করে নিছিলেন। আপনার কাছে যদি কোনো কিছুর একটা মেকানিক‌্যাল মডেল না থাকে, তাইলে বুঝে নিবেন জিনিশটা আপনি ঠিক ভালোভাবে বুঝতে পারেন নাই। ফলে, গ‌্যালিলিও জোয়ার-ভাটার থিওরিগুলা নিয়া একটু নাখোশ ছিলেন, কারণ জোয়ার-ভাটার কোনো মেকানিক‌্যাল মডেল আপনি দাঁড় করাইতে পারবেন না।

মঞ্চ থেকে নিউটনের চলে যাওয়ার পরই মজার ঘটনাটা ঘটলো। ইন্টারপ্রিটেবল বা পুরাপুরি বুঝতে পারার যোগ‌্য একটা পৃথিবীর আশা বিজ্ঞান একেবারে ছেড়ে দিলো। থিওরিগুলা বোঝা যায় ঠিকই, কিন্তু থিওরিগুলা যে আশলে কী কইতে চায় ওইটাই কেউ বুঝতে পারে না। নিউটনের থিওরি বুঝনের মতো ছিল। লিবনিজ নিউটনের থিওরিরে বুঝছিলেন। কিন্তু নিউটনের থিওরিটা যে আশলে কী বলতে চাইতেছে ওইটা লিবনিজ বুঝেন নাই। থিওরির ব‌্যাখ‌্যাটা বুঝনের মতো ছিল না। বহুত সময় লাগছিলো, কিন্তু নিউটন চলে যাওয়ার পরের বিজ্ঞান দুনিয়াটারে ব‌্যাখ‌্যা করতে পারার আশা একপ্রকার প্রায় ছেড়েই দিছিলো। দুনিয়াটা আশলে দুই চোখে যেমন দেখতেছেন এমনই। আমরা সর্বোচ্চ যেটা করতে পারি তা হইলো বুঝতে পারা যায় এমন থিওরির আশা করা। এরপর, কান্ট এবং তার সময়ের অন‌্যান‌্যদের হাতে এইটা একটা নতুন আর ভিন্ন দিশা খুঁজে পাইলো। তবে মূলত, বিজ্ঞান তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, এম্বিশনরে কমায়ে ফেলছিল। তাই, বুঝতে পারা যায় এমন বা বোধগম‌্য থিওরি পাওয়াটাই সবচাইতে বড় সফলতা। এরচে বেশি কিছু বোঝার, বেশি গভীরে যাওয়ার চেষ্টা আমরা করবো না। আধুনিক বিজ্ঞানের মহান প্রতিষ্ঠাতাগণের এই স্বপ্ন ফলে নাই।

অনেক সময় লাগছিলো এর জন‌্য। তাই, উদাহরণ দিয়া বলি, নিউটনের ইউনিভার্সিটি ক‌্যামব্রিজে , তার মৃত‌্যুর প্রায় অর্ধ শতক পরে তার থিওরিগুলা পড়ানো শুরু হইছিলো। কারণ, তার থিওরিগুলা কোনো সত‌্যিকারের বিজ্ঞান (রিয়েল সায়েন্স) ছিলো না, এইগুলা ছিল কেবল গাণিতিক হিশাবনিকাশ। এই বিশ শতকেই দেখেন, ইন্টারেস্টিংলি এইটা কিন্তু চলতেছে। ফিজিক্স আর ক‌্যামেস্ট্রির কথাই ধরেন। এক শতক আগেও, ফিজিক্সের সূত্র আর প্রিন্সিপালগুলা দিয়া ক‌্যামেস্ট্রিরে ব‌্যাখ‌্যা করা গেছে না। ফিজিক্সের মতো ক‌্যামেস্ট্রিরে ফান্ডামেন্টাল সায়েন্স হিশাবে বিবেচনা করা হইছে না। ক‌্যামেস্ট্রিরে শুধু এক্সপেরিমেন্টের ফলাফলগুলা ব‌্যাখ‌্যা করতে পারার একটা ওয়ে বা টুল হিশাবেই বিবেচনা করা হইতো। ১৯২০-এর দশকেও, ক‌্যামেস্ট্রি আর ফিজিক্সের নোবেল জয়ীরাও ক‌্যামেস্ট্রিরে একটা হিশাবনিকাশের টুল ভাবতেন। এইটা কোনো রিয়েল সায়েন্স না। কারণ, ক‌্যামেস্ট্রির ফেনোমেনাগুলারে আপনি ফিজিক্সের প্রিন্সিপাল আর ল’ দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করতে পারবেন না। বারট্রান্ড রাসেলের কথাই ধরেন। ওনার তো বিজ্ঞান নিয়া ভালোই জানাশোনা ছিল। ১৯২৮ সালে তিনি লিখলেন, ক‌্যামেস্ট্রি এখনো ফিজিক্সের মতো ফান্ডামেন্টাল সায়েন্স হয়া উঠতে পারে নাই। হয়তো কোনো একদিন হবে, কিন্তু অতদূর এখনো আমরা পৌঁছাই নাই। অনেকটা ওই রকম আরকি, লোকে যেমন বলে: আমাদের মেন্টাল প্রসেসগুলা (থট এন্ড কনশাসনেস) এখনো নিউরাল প্রসেস (ব্রেইনের ফিজিক‌্যাল ক্রিয়াকলাপ) দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করতে সক্ষম হয়ে উঠি নাই। কিন্তু কোনো একদিন আমরা আমাদের মনের মতিগতিরে মগজের কাজকারবার দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করতে পারবো।

তাইলে, রসায়ন আর পদার্থবিজ্ঞানের ভাগ‌্যে কী ঘটছিলো? দেখা গেল যে, রসায়নের ফেনোমেনাগুলারে ফিজিক্সের প্রিন্সিপাল আর ল’ দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করা সম্ভব না। কারণ, যেখানে রসায়ন সবদিক দিয়া সঠিক থাকে, সেখানে ফিজিক্স হয় ভুল। তখন বিজ্ঞানীরা নিয়া আসলেন এক নতুন ফিজিক্স। প্রায় অপরিবর্তিত রসায়নরে তখন এই নতুন ফিজিক্সের সাথে রিডিউস করা গেল। নির্দিষ্টভাবে বললে, রাসায়নিক বৈশিষ্ট‌্যগুলারে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করা গেল। রাসায়নিক বন্ডগুলারে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়া ব‌্যাখ‌্যা করছিলেন লিনাস পলিং। ফিজিক্স আর ক‌্যামেস্ট্রিরে নিজের জায়গাতে রেখেই তিনি একটা একীভূত পদ্ধতি নিয়া আসলেন। আশলে, মাত্র গত শতকের ফিজিক্সের সাথেও রসায়নরে এক করা সম্ভব ছিল না।

ওকে, এইবার চলেন বর্তমান সময়টারে দেখি। নিউরোসায়েন্স উন্নতি করছে। কিন্তু ১৯২০-এর দশকে ফিজিক্স যেমন উন্নতি করছিলো নিউরোসায়েন্সের উন্নতিগুলা তত বেশি না। আমি সমালোচনা করতেছি না। নিউরো সায়েন্স আশলেই জটিল বিষয়। হইতে পারে যে রিডাকশনের ধারণা বা দুইটা ভিন্ন জিনিশরে একই পর্যায়ে নিয়া এসে ব‌্যাখ‌্যা করতে চাওয়ার প্রবণতাটাই ভুল, যেমন পুরা পৃথিবীর সবকিছুরে মেকানিক‌্যাল মডেলে রিডিউস করে নিয়া আসা যায় নাই বা মেকানিক‌্যাল মডেল দিয়া সবকিছুর ব‌্যাখ‌্যা দাঁড় করানো যায় নাই। ক্যামেস্ট্রিরে ফিজিক্সে রিডিউস করা যায় নাই। এর কারণ, রিডাকশনের ধারণাটা ভুল। তেমনিভাবে, এখন পর্যন্ত আবিষ্কার করা আমাদের ভাষা, চিন্তা ও জ্ঞানের চরিত্র বা প্রকৃতির সাথে যদি নিউরোসায়েন্স, ব্রেইন সায়েন্সকে ইউনিফাই বা একীভূত করতে চান তাইলে এই সায়েন্সগুলারে নতুনভাবে তৈরি করে নিতে হবে।

আমার মনে হয়, এই বিষয়ে কিছু সাইন বা ইঙ্গিত আছে যেগুলা সত্য হইতে পারে। আমি র‌্যান্ডি গ্যালিস্টেলের কাজগুলার কথা ভাবতেছি। গ্যালিস্টেল আমাদের বন্ধু, কগনিটিভ নিউরোসায়েন্সের নামকরা লোক। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরেই একটা কথা বলে আসতেছেন, দিন দিন তার কথাগুলা ফলতেও শুরু করতেছে যে, নিউরাল হিশাবনিকাশ করার জন্য নিউরাল নেটওয়ার্ক উপযুক্ত জায়গা না। আশলে উনিশ শতকে, হেল্মহল্টেজের একই জিনিশ বিশ্বাস করার কিছু কারণ ছিল। নিউরাল নেটওয়ার্কগুলা ধীর গতির। আমাদের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী নিউরাল ট্রান্সমিশন দ্রুত গতির অবশ্যই, কিন্তু ব্রেইনের কার্য সম্পাদনের চাহিদার স্ট্যান্ডার্ডে এইটা ধীর গতিই। এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়, গ্যালিস্টেল খুব ভালোভাবে দেখায়ছেন এইটা, আমার মনে হয়, নিউরাল কম্পিউটেশনের জন্য ন্যূনতম যে কম্পিউটেশনাল ইলিমেন্টটা প্রয়োজন, ট্যুরিং কম্পিউটেবিলিটি, নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আপনি এইটা বানাইতে পারবেন না। যে প্রসেসে একটা কম্পিউটার কাজ করে: কম্পিউটেশনের জন্য স্পেশালাইজড যে বেসিক ইউনিটটা নিয়োজিত থাকে ওইটা তো নিউরাল নেটওয়ার্ক দিয়া বানানো যাবে না; তাই, অন্য কিছু লাগবে। মনে হয়, সেলুলার লেভেলে, যেখানে কম্পিউটিং ক্ষমতা আরো বেশি থাকে, সেলের ভিতরের কোনো জায়গায় হইতে পারে, মাইক্রোটিউবিউলস অথবা অন্য কোনো অঙ্গাণু হইতে পারে।

এবং দেখেন, ডিপ লার্নিং সিস্টেমের ভিত্তি হইলো নিউরাল নেট। নিউরাল নেটগুলার উপর ভিত্তি করে ডিপ লার্নিং সিস্টেমগুলা ডিজাইন করা হয়। এরা সম্ভবত ভুল জায়গায় খোঁজাখুঁজি করতেছেন, ফলে যতটুকু কাজ আদায় হইতেছে সবই হইতেছে জোরজবরদস্তি করে, অর্থাৎ ব্যাপক ডাটা দ্রুত বিশ্লেষণ করে প্যাটার্ন খুঁজে বের করার মাধ্যমে কাজ আদায় করতেছেন। এইগুলাও উপকারে আসতে পারে, কিন্তু যদি ভাষার ব্যাপারটা বিবেচনায় ধরি, তাইলে বলেন এইখান থেকে আমরা কী শিখতে পারতেছি? আপনার পসিবল আর ইম্পসিবল ল্যাঙ্গুয়েজগুলার কথাই চিন্তা করেন না। যে সিস্টেম তারা বানাইলো এইটা দুই ক্ষেত্রেই, মানে পসিবল আর ইম্পসিবল ল্যাঙ্গুয়েজের ক্ষেত্রে, সমানভাবে কাজ করতেছে। যার মানে হইলো ভাষা সম্পর্কে এই সিস্টেস আশলে আমাদেরকে কিছুই বলতে পারতেছে না, নতুন কোনো দিশাই দেখায়তে পারতেছে না। কার্ল পপারের রিসার্চ বলতেছে, একটা থিওরি কী কী জিনিশ বাদ দিতে পারলো, এইটার উপর ভিত্তি করেই বলে দেওয়া যায় যে ওই থিওরিতে কতটুকু সারবস্তু বা মালমশলা আছে।

তাই, আপনি এমন এমন জিনিশ পাবেন যেগুলা দেখতে এক্সাইটিং, ওই ষোলো-সতের শতকে ঘাগু কারিগরদের হাতে তৈরি আর্টিফ্যাক্টগুলা দেখে যেমন শিহরিত হন তেমন, ওইগুলা শুধু দেখতেই এক্সাইটিং কিন্তু দুনিয়াটারে ব্যাখ্যা করার জন্য বা ভালোমতো বোঝার জন্য কোনো হেল্প করে না । এই কথাগুলা আমরা যেই এরিয়া নিয়া কথা বলতেছি তার জন্যও সত্য হইতে পারে, এইটা আমার মতামত। বর্তমানের নিউরোসায়েন্স আমাদের মেন্টাল লাইফকে ব্যাখ্যা করতে পারতেছে না কারণ মনে হয়, আমরা যে সিস্টেম বা প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে এইটা করতে চাই, ওই সিস্টেমটাই এখনো পুরাপুরি ডেভেলপ করে নাই। যেদিন এই ভিত্তি পুরাপুরি বিকশিত হইতে পারবে, তখন আমরা সত্যিকার একটা ইউনিফিকেশন দেখবো, নিউরোসায়েন্স আর মেন্টাল সায়েন্সের।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

শাদাব হাসিন

পুরা নাম শাদাব হাসিন আবরার আহবাব। পরিচিত মানুশরা কেবল শাদাব হাসিন বলেই ডাকেন। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবকিছু কিশোরগঞ্জ শহরেই। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি ফ্রেশার, সাবজেক্ট ম‌্যাথমেটিক্স।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →