আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) Featured
[আসিরুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত সিনে-পত্রিকা ‘ঝিনুক’র ১৯৬৭ সালের জানুয়ারি সংখ্যায় জহির রায়হানের এই লেখাটা ছাপা হয়। জহির রায়হান রচনাবলী’সহ যে কোন এন্থোলজি’তেই এই লেখাটা রাখা হয় নাই বইলাই আমরা জানি। এমনিতেও উনার সিনেমা বিষয়ে কথা বা লেখা তো খুব একটা গুরুত্ব দিয়া কালেক্ট করা হয় নাই; কিন্তু করা যে দরকার, এবং খুঁজলে যে কিছু জিনিস পাইতে পারি আমরা, সেইটার একটা নমুনা হিসাবে এই লেখাটারে দেখা যাইতে পারে। – এডিটর, বাছবিচার]
…
কি লিখবো?
আমাকে অকারণ কিছু লিখতে বলে অপ্রস্তুত করার কোন মানে হয় না।
আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত।
অভিজ্ঞতা অপ্রতুল। সঞ্চয় অতি সামান্য।
আকাঙ্ক্ষা অনেক। অনেক। অনেক। সাগরের ঢেউয়ের মত। আকাশের তারার মত।
শ্রাবণের ধারার মত। এর কোন ইতি নেই। যতি নেই। শেষ নেই।
লিখবো কি?
এককালে স্বপ্ন দেখতাম। ভারী সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন।
সূর্যের সোনাঝরা রোদে একঝাঁক পায়রা যেমন করে ডানা মেলে দিয়ে ওড়ে। আঁধারের অন্তরঙ্গ ছোঁয়া পেয়ে জোনাকীরা যেমন মৃদু মৃদু জ্বলে। আর বাতাসের অকৃপণ উদারতার স্পর্শে পালতোলা নৌকোগুলো যেমন দুর্বার বেগে ছুটে চলে, তেমনি আমার অল্প বয়সের অনভিজ্ঞ মনে স্বপ্নের বলাকারা কখনো উড়তো, কখনো জ্বলতো, কখনো ছুটে চলতো এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে।
এখন ওসব বাজে অভ্যেস বর্জন করেছি।
স্বপ্ন দেখি না।
কারণ, স্বপ্নের সাথে বাস্তবের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। অকারণ হতাশার বোঝা বাড়িয়ে জীবনকে ভারাক্রান্ত করতে চাইনে।
আমি আমার আবেগের ক্রীতদাস। আমার আবেগ আমাকে যখন যেখানে নিয়ে যেতে চায় আম সুবোধ বালকের মত তাকে সেখানে অনুসরণ করি।
আবেগ যদি বলে, আগুনে ঝাঁপ দাও। দিই। দগ্ধ হই। পুড়ি। পোড়াই আবেগ যদি বলে, মরো। মরি। সে মরণেও সুখ। ওই আবেগের অঙ্কুর থেকে আমার জন্ম। সে আছে বলেই বেঁচে আছি।
সে যেদিন থাকবে না, সেদিন আমার এই অর্থহীন তুচ্ছ দেহটাকে দু’হাত মাটির নীচে পুঁতে আসবে সবাই।
তাই আমার আবেগকে আমি আমার প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসি। সে যদি বলে, ভাঙ্গো। ভাঙ্গি। ভেঙ্গে সব চুরমার করে দিই।
সে যদি বলে, গড়ো। আবার গড়ার কাজে লেগে যাই।
আমি যে তার হাতের পুতুল।
একদিন। সে অনেকদিন আগের কথা। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী।
সেদিন অপরাহ্ণে, সে আমার মনে এক দুর্জয় সাহসের সঞ্চার করেছিলো। সে বলেছিলো, ওই হিংস্র দানবের মুখোশগুলা খুলে ফেলো। ভেঙ্গে ফেলো ফেরাউনের দূরাশার স্বর্গ। নইলে তোমার কণ্ঠ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যাবে।
আমি তক্ষুনি সাড়া দিলাম।
আর আমার আবেগ আমাকে কারাগারের অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করলো।
একবার নয়।
দু’বার নয়।
তিনবার।
বয়স তখন কত হবে? চৌদ্দ। কিম্বা পনেরে।।
জেলখানার নিঃসঙ্গ দিনগুলোতে নিজেকে বড় একা লাগতো। দেখন সে আমাকে নিয়ে এক নতুন খেলায় মেতে উঠলো। বললো, এক কাজ করো, জীবনের মূল্যবান সময়ের অশ্চয় না করে মাঝে মাঝে কিছু লিখতে চেষ্টা করো।
কি লিখবো? মনে মনে তাকে প্রশ্ন করলাম।
সে জবাব দিলো। কেন, হৃদয়ের নিভৃত কোণে বিন্দু বিন্দু করে জমে ওঠা অব্যক্ত অনুভূতিগুলোকে ভাষা দাও। অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দের বিন্যাসে বাক্যের সৃষ্টি করো।
আমি তাই করলাম।
সেই আমার লেখক জীবনের সূচনা।
আমি লিখতে শুরু করলাম। প্রথমে কবিতা, তারপর গল্প, তারপর উপন্যাস।
তারপর?
অনেক। অনেক লিখেছি। আমার সে লেখাগুলো এখন আর খুঁজে পাইনে। মাঝে মাঝে ওগু’লার জন্যে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। কোথায় যে হারিয়ে গেলো! সঞ্চয়ে বিশ্বাস করি না। তাই হয়তো নিজের লেখাগুলোকে যে সযতে সংগ্রহ করে রেখে দেবো, তাও রাখিনি।
ইতিমধ্যে, আমার পরম বন্ধু, আমার সুখ-দুঃখের একমাত্র সহচর-আমার আবেগ আমাকে প্রকাশের এক মাধ্যম থেকে অন্য এক মাধ্যমে অধিষ্ঠিত করেছে। সে মাধ্যমের নাম চলচ্চিত্র।
সৃষ্টির এ এক অপূর্ব জগৎ।
এখানে, পাপ-পুণ্য।
স্বর্গ-নরক।
ভালো-মন্দ। যেন দুই সহোদর ভাই। একটি পাখীর দুটি ডানা। একের অস্তিত্ব ছাড়া অন্যটা অর্থহীন।
তাই। হয়তো তাই। এ জগৎ আমার ভালো লাগে।
পাপ আর পুণ্যের পাশাপাশি বিচরণভূমিতে দাঁড়িয়ে একটি মানুষের ক্ষণে ক্ষণে বদলানো রূপের মাধুর্য আমি উপভোগ করি।
বহুরূপীদের এই সমাবেশে সম্ভব-অসম্ভবের কোন সীমারেখা নেই।
সকাল বেলার শিশির ভেজা মুহূর্তে যে মৃদু হেসে বলে, জানেন, রোজ রাতে আপনাকে স্বপ্নে দেখি।
এবার দুপুরের সূর্যকে মাথায় নিয়ে সে হয়তো অবাক চোখে না চেনার ভান করে চেয়ে থাকে। বলে, এর আগে কি কোনদিন আমাদের দেখা হয়েছিলো?
রূপক ছবির রাজ্যের সবকিছুই ছবির মতই ক্ষণস্থায়ী। বানানো। মেকী।
এ যেন শ্যামের গণ্ডী। একবার যে এই বহুরূপীদের আসরে পদার্পণ করেছে তার আর নিষ্কৃতি নেই। বারবার এই চার দেয়ালের মাঝখানে ফিরে আসতে হবে। এ এক আশ্চর্য নেশা যা একবার পেলে মৃত্যুর আগে মুক্তি দেয় না।
এখানে আমার জীবনের আটটা বছর কেটে গেছে। কখনো সুখে। কখনো দুঃখে। কখনো ব্যর্থতার তীব্র যন্ত্রণায়। কখনো অনিশ্চিতের ভয়াবহ অস্থিরতায়। আবার কখনো মানুষের মূর্খতার প্রতি ক্ষুব্ধ অভিমানে।
আমার তৈরী ছবিগুলো নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছে।
কেউ বলেছে ভালো।
কেউ বলেছে মন্দ।
কেউ প্রশংসা করেছে।
কেউ গালাগাল দিয়েছে।
আমার কাছে দুটোই সমান। সমান অর্থহীন।
কারণ ভালো-মন্দের বিচারে সময় হলো শ্রেষ্ঠ বিচারক।
আজকের ভালো কালকের মন্দ।
কালকের মন্দ পরশুর ভালো।
তুমি আমার ভাই। তাই, তুমি ভালো। সে আমার শত্রু। তাই, সে খারাপ। তার ভালোটাও মন্দ। তার পুণ্যেও আমি পাপ দেখি।
পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতির সদস্য আমরা। আমাদের বিচার ক্ষমতা তাই সংকীর্ণ মনোবৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই, সময়ের বিচারে অর্থহীন।
আম সাধক নই।
সাধক হবার যোগ্যতা আমার নেই।
আমি একটি সাধারণ মানুষ। অতি সাধারণ।
আর সাধারণ বলেই হয়তো সাধারণের কাছে অতি দুর্বোধ্য। দুর্জেয়। এবং অপ্রিয়।
বহুরূপীদের এই বিকিকিনির হাটে আমার মন যখন যা চেয়েছে আমি তাই করেছি। কারো ভালো লেগেছে কি লাগেনি। কেউ মন্দ বলেছে কি বলেনি।
সেটা আমার কাছে মুখ্য নয়, গৌণ।
আমার আনন্দ সৃষ্টিতে। সৃষ্টির অমরতায় নয়।
আমার প্রথম তিনটি ছবি। কখনো আসেনি। সোনার কাজল। কাঁচের দেয়াল। ছবিগুলো এদেশে চলেনি।
চলেনি বলে আমার বন্ধুরা অনেক দুঃখ পেয়েছে। সহানুভূতির সঙ্গে আমাকে বলেছে, বোকা কোথাকার। কি হবে এসব ছবি বানিয়ে। । বাদ দাও। তার চেয়ে লোকে যেমনটি চায়, তেমনটি বানাও। কিছু টাকা-পয়সা রোজগার করো।
তাই বানালাম।
বানালাম, সঙ্গম। বাহানা। অবশেষে বেহুলা।
ছবিগুলো ভালো চলেছে। লোকে ভীড় করে দেখেছে। দু’পয়সা রোজগারও হয়েছে। আর আমার বন্ধুরা অশেষ দুঃখ পেয়েছে তাতে। সমুখে না হোক আড়ালে আফসোস জানিয়ে আক্ষেপ করেছে। আহা, জহিরটার এত অধঃপতন হবে ভাবিনি। আমি নিজেও কি কোনদিন ভাবতে পেরেছিলাম যে, আমাকে এমন একটি পরিবেশের মধ্যে এসে কাজ করতে হবে যেখানে সত্যের চেয়ে মিথ্যার, আসলের চেয়ে নকলের, হীরার চেয়ে কাঁচের মূল্য বেশী?
আগেই বলেছি, আমি আমার আবেগের দাস।
তাই আমার চলার পথের কোন ধরাবাঁধা ছক নেই। আবেগ যেদিকে নিয়ে যাবে, যাবো।
হয়তো আলোতে।
কিম্বা অন্ধকারে।
হয়তো স্বর্গে।
কিম্বা জাহান্নামে।
চলার পথের পাথেয় আমার অতি সামান্য।
আমার পরম হিতাকাঙ্খীদের শত সহস্র উপদেশ। অজস্র অপবাদ। কুৎসা রটনা এবং তাদের দু’চোখে জ্বলা ঈর্ষার আগুন আমার এই অজানা পথের একমাত্র সম্বল।
এ সম্বল যার আছে তার তো কোনকিছুতেই ভয় পাবার কথা নয়।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024