Main menu

সৈয়দ আলী আহসান: আমার সাক্ষ্য – “আরবী হরফে বাংলা লিখবার প্রস্তাব” নিয়া Featured

১৯৯৪ সালে সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২ – ২০০২) “আমার সাক্ষ্য” নামে একটা বই লেখেন, উনার নামে চালু থাকা নানান ক্রিটিক ও অভিযোগের জায়গায় নিজের পারসপেক্টিভ তুইলা ধরেন

তো, অবভিয়াসলি এইগুলা কোন ভেরিফাইড হিস্ট্রিকাল ট্রুথ না, কিনতু একইসাথে হিস্ট্রিকাল ইভেন্টগুলাতে এনগেইজ থাকা একজন মানুশের বয়ান, যেইটা হিস্ট্রিকাল রেফারেন্স হিসাবে ফুল-প্রুফ ঘটনা না হইলেও একটা রেফারেন্সিয়াল পয়েন্ট, যেই কারনে উনার কথাগুলা সারফেইস লেভেলে থাকা, যাচাই কইরা দেখাটা হিস্ট্রির একটা কাজ

আরেকটা ঘটনা হইতেছে, পাকিস্তান আমলের বেশিরভাগ ঘটনাই আমাদের আলাপে এখনো ট্যাবু হয়া আছে যেন এইগুলা নিয়া কথা বলা যাবে না! কিনতু বাংলাদেশের হিস্ট্রি জানতে ও বুঝতে হইলে তো ইমিডিয়েট পাস্টের দিকেই তো আমাদেরকে তাকাইতে হবে সবচে আগে…

তোো এই জিনিসটা আমরা অনেকেই জানি যে, বাংলা হরফ চেইঞ্জ করার একটা কথা পাকিস্তান আমলে সরকারি-জায়গা থিকা উঠছিল, তো ঘটনাটা কি রকম ছিল – তার একটা ব্যাখ্যা রাখছেন সৈয়দ আলী আহসান, উনার বই থিকা সেই অংশটা ছাপাইতেছি আমরা এইখানে

লিপি বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে

…এখন আমরা হরফ পরিবর্তনের কথা বলি না। ভাষা পরিবর্তনের প্রশ্নই ওঠে না। তবু পাকিস্তানে এই পরিবর্তনের প্রশ্ন উঠেছিল, কিন্তু তা কখনই কোন আন্দোলনে রূপ নেয়নি। যাঁরা পরিবর্তনের কথা বলেছিলেন, তাঁরা ছিলেন সরকারী কর্মকর্তা এবং সেক্ষেত্রে সরকার পক্ষের সকলেই যে পরিবর্তনের কথা বলছিলেন তা-ও নয়। আমি এখানে ভাষার কথাটা বলব না। লিপি সংক্রান্ত উদ্ভট প্রস্তাবনার কথাই তুলব।

তৎকালীন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে আরবী লিপি প্রচলিত ছিল। সিন্ধী এবং উর্দু দুই-ই লিখিত হত আরবী বা ফারসী হরফে। পশতুও লিখিত হত আরবী হরফে। লোকভাষা হিসেবে পাঞ্জাবে কোন নির্দিষ্ট লিপি ছিল না। শিখরা গুরুমুখী হরফে পাঞ্জাবী লিখতেন এবং মুসলমান ফারসী হরফে। এক কথায়, পশ্চিম পাকিস্তানের সব ক’টি ভাষার জন্য একটি মাত্র বর্ণমালা ছিল এবং তা ছিল আরবী। সমগ্র পাকিস্তানের জন্য তখন ছিল-বাংলা ভাষার জন্য বাংলা হরফ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষার জন্য আরবী হরফ। এই হরফের পরিবর্তনের কথা সরকারীভাবে কখনও নির্দেশিত হয়নি। এ নিয়ে শুধু সরকারীভাবে আলোচনার সূত্রপাত করা হয়েছিল।

এই আলোচনাটির সূত্রপাত করেছিলেন মরহুম ফজলুর রহমান। তিনি ঢাকার অধিবাসী ছিলেন, কোন ভাষায় তাঁর ভাল দখল ছিল না। এহেন ব্যক্তি আরবী হরফে বাংলা লিখবার একটি প্রস্তাব করেন। ফজলুর রহমান তখন পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ১৯৪৮ সালের জুন কি জুলাই মাসে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকায় তাঁর বন্ধু মওলা মিয়ার বাসায় অবস্থান করেন। সেখানে একদিন তিনি আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করেন। আলোচনায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হর্তেন: ফজলে আহমদ করিম ফজলী-তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব, ওসমান গণী-তিনি ছিলেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন, কবি জসীমউদ্‌দীন এবং আমি। সভায় পাকিস্তানের তথ্য দফতরের একজন কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। চট্টগ্রামের হুরুফুল কোরআন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এক বৃদ্ধ মৌলভী সাহেবও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমরা জানতাম না, কেন আমাদের ডাকা হয়েছে। আলোচনার সূত্রপাতে ফজলুর রহমান সাহেব সভা আহবানের কারণ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, ‘প্রচুর রক্তপাতের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান পেয়েছি, এই পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রাখা এবং বিপদ থেকে মুক্ত রাখা আমাদের কর্তব্য। যেহেতু ভারতবর্ষ থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি, সুতরাং ভারতের কাজ পাকিস্তানকে গ্রাস করা। পশ্চিম পাকিস্তান যেহেতু একটি বিরাট অঞ্চল তাই সেদিকে তাদের দৃষ্টি পড়বে না, তাদের দৃষ্টি পড়বে পূর্ব পাকিস্তানের উপর। তারা যে সৈন্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান দখল করবে তা নয়, তারা নিজেদের সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং সমাজের প্রভাব বলয়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে আনবার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে বাংলাভাষা তাদেরকে বিরাট সাহায্য করবে। পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বাংলা, আমাদের ভাষাও বাংলা। এই বাংলা ভাষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশ যত সহজে সম্ভবপর, অন্য কিছুতে তা সম্ভব নয়। আমাদের ভিন্ন ভাষা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু ভাষা যেহেতু অভিন্ন, সুতরাং ভাষার প্রকৃতি যদি আমরা পরিবর্তন করতে পারি, তাহলে অতি সহজে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমবঙ্গের কবল থেকে রক্ষা করতে পারব। সেই জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, আমাদের বাংলা ভাষার লিখন পদ্ধতির আমরা পরিবর্তন ঘটাব। এই পরিবর্তন ঠিক মত করতে পারলে আমাদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সেজন্য বাংলা ভাষার জন্য আরবী বর্ণমালার প্রবর্তন করতে চাই।’

আমরা ফজলুর রহমানের এই বক্তৃতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। প্রস্তারের অসারতা এবং অবাস্তবতা এত প্রকট ছিল যে, আমরা সকলেই কিছুক্ষণ পর্যন্ত হতভম্ব হয়ে বসেছিলাম। আমাদের চুপ করে থাকতে দেখে ফজলুর রহমান সাহেব চট্টগ্রামের হুরুফুল কোরআন সমিতির মৌলভী সাহেবকে আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন। মৌলভী সাহেব আরবী হরফে ছাপা একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা আমাদের সামনে পেশ করলেন। তিনি বললেন যে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই পত্রিকাটিকে চালিয়ে আসছেন। বিভিন্ন মাদ্রাসায় এই পত্রিকার অনেক পাঠক আছে। মৌলভী সাহেবের পর ফজলুর রহমান সাহেব একটি তথ্য পেশ করলেন যে, এক সময় নাকি আরবী হরফে বাংলা লিখিত হত। কিছু পুরনো বাংলা পুঁথি পাওয়া গেছে যেগুলো আরবী হরফে লিখিত হয়েছে।

আলোচনা এই পর্যন্ত যখন এগিয়েছে তখন শহীদুল্লাহ সাহেব সভায় প্রবেশ করলেন। এ পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে তা সংক্ষেপে তাঁকে বোঝানো হল। সব কথা শুনে শহীদুল্লাহ সাহেব মন্তব্য করলেন, ‘ভাষাবিদ হিসেবে আমার বক্তব্য হচ্ছে, ‘বাংলা বর্ণমালা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন এবং ধ্বনিসঙ্গত বর্ণমালা। অন্য কোন বর্ণমালার দ্বারা বাংলা ভাষার ধ্বনিকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা যায় না। যেহেতু এ বর্ণমালা ত্রুটিপূর্ণ নয়, সুতরাং এর পরিবর্তন করার কোন যুক্তি নেই। দ্বিতীয়তঃ অনেক ধ্বনি আরবী বর্ণমালার সাহায্যে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। ফারসী ভাষায় আরবী বর্ণমালা গ্রহণ করা হয়েছে সত্য, কিন্তু সংশোধন করে গ্রহণ করতে হয়েছে। কয়েকটি ধ্বনির জন্য বাধ্য হয়ে ফারসীতে পে, চে ইত্যাদি বর্ণলিপির উদ্ভাবন করতে হয়েছে।

পাকিস্তান শব্দটি আরবীতে লেখা যায় না, লেখা হয় ‘বাকিস্তান’। এটুকু বলে তিনি চট্টগ্রামের মৌলভী সাহেবের ‘হুরুফুল কোরআন’ পত্রিকার একটি সংখ্যা হাতে তুলে নিলেন। কিছুক্ষণ. চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘এখানে সব শব্দ ভুল লেখা হয়েছে। বিশ্বাসকে লেখা হয়েছে ‘খে শিন তাসদীদ আলিফ এবং শিন’ দিয়ে-এটা বাংলাতে লিখলে দাঁড়ায় ‘বিশ্শাশ’। অর্থাৎ বাংলা ‘বিশ্বাস’ শব্দের বানানটি আরবীতে তিনি ভুলতে পারেন নি।’ জনাব ফজলুর রহমান তখন বললেন, ‘আরবী বর্ণমালার কি কি সংশোধন প্রয়োজন, তা-কি আপনি করে দিতে পারবেন?’ শহীদুল্লাহ সাহেব বললেন, ‘ভাষাবিদ হিসেবে আমি ত্রুটিগুলো দেখিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আরবী হরফে লেখা আমি সমর্থন করি না।’ এ সময় কবি জসীমউদ্দীন বলে উঠলেন, ‘আমার কবিতার বই কলকাতায় বেশ চলে, আরবী হরফে লিখলে আমার বই আর সেদেশে চলবে না। তাছাড়া আরবী হরফে আমার ছন্দও ঠিক রাখা যাবে না।’

এ নিয়ে সেদিন আর বিশেষ আলোচনা হয়নি। আমি কোন কথা বলিনি। প্রস্তাবের অন্তঃসারশূন্যতা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। এটা যে কোনদিনই বাস্তবায়িত হতে পারে না-এটা কল্পনা করা কারও পক্ষে অসম্ভব ছিল না। একমাত্র ওসমান গণি সাহেব রোমান হরফের পক্ষে কিছু বলবার চেষ্টা করেছিলেন। এ আলোচনার আর অগ্রগতি হয় নি। কিন্তু কিছুদিন পর পাকিস্তান ইতিহাস সম্মেলনে এ বিষয়টি আবার নতুন করে উত্থাপিত হয়। এই সম্মেলনে ফজলুর রহমান সভাপতি ছিলেন। বিখ্যাত, ভারতীয় আলেম এবং পণ্ডিত হযরত সৈয়দ সুলায়মান নাদভী প্রধান অতিথি ছিলেন। প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি যে অভিভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে অনেক আপত্তিকর কথা ছিল। তিনি বাংলা হরফের বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ‘বাংলা হরফের সঙ্গে হিন্দুদের দেবীর নামের যোগ আছে। সুতরাং এই হরফ পরিবর্তন করা বাঞ্ছনীয়।’ সকাল বেলা কার্জন হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের শেষে শহীদুল্লাহ সাহেব সাংবাদিকদের কাছে নাদভী সাহেবের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। ইতিমধ্যে নাদভী সাহেবের বক্তব্যের কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মহলে প্রচার হয়। বিকেল তিনটার সময় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে নাদভী সাহেবের গাড়ি যখন কার্জন হলে প্রবেশ করছে তখন একদল ছাত্র গাড়ি ঘিরে ফেলে এবং নাদভী সাহেবকে গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে মাটিতে নামিয়ে আনে। ছাত্রদের চাপে নাদভী সাহেব তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। সন্ধ্যার পর কবি জসীমউদ্দীনের ফুলবাড়িয়ার বাসায় ফজলুর রহমান সাহেব আসেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর মযহারুল হক ছিলেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ছিলেন, অধ্যাপক সফিউল্লাহ ছিলেন, আমিও ছিলাম। ফজলুর রহমান সাহেব সুলায়মান নাদভীর অসম্মানের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং সেজন্যে প্রক্টর মযহারুল হককে দায়ী করেন। ঘটনাটি এখানেই শেষ হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু ফজলুর রহমানের জন্য শেষ হল না। করাচী পৌঁছে আরবী বর্ণমালার সংশোধনের প্রস্তাব দিয়ে সরকারীভাবে শহীদুল্লাহ সাহেবকে একটি পত্র দেন। এই পত্রটি কি করে যেন কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় ছাপা হয় এবং পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে সমালোচনা করা হয়। তখন পাকিস্তান সরকার ‘শিক্ষা উপদেষ্টা কাউন্সিল’ বলে একটি কাউন্সিল গঠন করেছিল। সে বছরই সম্ভবতঃ নভেম্বর মাসে উক্ত কাউন্সিলের বৈঠক ঢাকায় বসেছিল। বিকেল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডঃ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসগৃহে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। উক্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা ডঃ মাহমুদ হাসান ডঃ শহীদুল্লাহ সাহেবকে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং তাঁর শেরওয়ানীর কলার চেপে ধরে তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে আখ্যায়িত করেন। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের জন্য শহীদুল্লাহ সাহেবকে দোষী সাব্যস্ত করেই এই অভিযোগ করা হয়।

চট্টগ্রামের হুরুফুল কোরআন সোসাইটির মৌলভী সাহেবের নাম এখন আমার পড়ছে, তাঁর নাম ছিল মৌলভী জুলফিকার। তাঁকে সরকারী ভাতা দেয়া হতে থাকে এবং আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে এককালীন কিছু টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। জনসাধারণের সঙ্গে ফজলুর রহমানের কোন সংযোগ ছিল না। তাঁর একটি মূর্খতা এবং গোঁয়ার্তুমি ছিল। তাঁর বোঝা উচিত ছিল, কেউ তাঁকে সমর্থন করছে না, পাকিস্তান সরকারের অন্য কোন মন্ত্রী তাকে সমর্থন করে কোনও বিবৃতি দেননি। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে ফজলুর রহমান অব্যাহতি পেয়েছেন এবং তাঁকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

আরবী হরফে বাংলা লেখার এই অপচেষ্টা বিশেষভাবে দানা বাঁধতে পারেনি। তবে কবি গোলাম মোস্তফা তার ‘নওবাহার’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘আরবী বর্ণমালা সকল বর্ণমালার জননী’ বলে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকেন। এই প্রবন্ধও লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। গোলাম মোস্তফা অবশ্য আরবী হরফে বাংলা লেখার কথা বলেন নি, আরবী হরফের গুণগান করেছিলেন মাত্র।

আরবী বর্ণমালার সাহায্যে বাংলা লিখবার বিকল্প চেষ্টা শুরুতেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ নিয়ে পরে আর কেউ উচ্চবাচ্য করেন নি। কিন্তু এখনও মাঝে মাঝে আমাকে লাঞ্ছিত এবং অপমান করবার জন্য কেউ কেউ মিথ্যা বলে থাকেন যে, আমি নাকি এককালে আরবী বর্ণমালার সমর্থক ছিলাম। আমার সাহিত্যকর্ম সকলের কাছেই উন্মুক্ত এবং সুস্পষ্ট। আমার বিভিন্ন অভিভাষণের কথা সকলেই জানেন। আমার কোন লেখা থেকে অথবা কোন উক্তি থেকে এ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেন নি যে, আমি আরবী হরফে বাংলা লেখার সমর্থন করেছিলাম। দুর্বৃত্তের চাতুরীর অভাব হয় না। সুতরাং, যাঁরা দুর্বৃত্ত তারা মিথ্যাকে বারবার উচ্চারণ করে সত্যকে আড়াল করতে চায়। আমি সত্যকে আড়াল করতে চাই না। জীবনে কোন মুহূর্তে মিথ্যার বেসাতি আমি করিনি। যারা নির্ভেজাল মিথ্যাচারী তাদের বিকারগ্রস্ততার জন্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমাদের জাতির আজ অসহায় অবস্থা। সত্যকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এই অসহায় অবস্থা দূর করা সম্ভব।

পাকিস্তানের সূত্রপাতে আরবী ভাষার প্রয়োগ নিয়ে কিছু বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। তার মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল আগা খানের বিবৃতি। ‘পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হবে’ এই ঘোষণা-শুনে আগা খান বলেছিলেন যে ইসলামিক রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন ইসলামী ভাষা অর্থাৎ আরবী। আগা খানের বিবৃতি তখন অনেকেই সমর্থন করেছিলেন। ডঃ শহীদুল্লাহও সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু এটা কোন আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় নি। আরবীর সপক্ষে এ সমস্ত বিবৃতির কোন প্রতিবাদও তখন কেউ করেনি। সকলে ধরে নিয়েছিল, এটা নেহায়েতই একটি স্বপ্ন-বিভ্রম। এ নিয়ে আলোচনা করা নিরর্থক।

লিপি পরিবর্তন যখন কোনক্রমেই গৃহীত হল না এবং ‘অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ বলে বর্জিত হল তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের প্রস্তাব করলেন। মওলানা আকরম খাঁ-কে সভাপতি করে বর্ণমালা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। এই সংস্কার কমিটিতে ছিলেন-অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, আবুল হাসনাত, ওসমান গণি। যদ্দুর মনে পড়ে, ডঃ শহীদুল্লাহকে এই কমিটিতে রাখবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে মতদ্বৈধতা সৃষ্টি হওয়ায় তিনি এই কমিটিতে কাজ করেন নি। এই কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হয় নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইলবন্দী হয়ে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে। দেখা গেল যে, বাংলা বর্ণমালার সংস্কারের প্রয়োজন থাকলেও কেউ এর সংস্কারের পক্ষপাতি নয়। যেহেতু লিপিকরণ প্রথা যেভাবে চলে আসছে তা জনসাধারণ সহজেই মান্য করে রেখেছে, তাই পরিবর্তনের কথা কেউ ভাবতে চায়নি। অনেক পরে, বাংলা একাডেমী বানান সংস্কার নিয়ে একটি একাডেমিক এক্সারসাইজ করেছিল, কিন্তু তা কার্যকর করার কথা তারা ভাবেনি।

কতকগুলো কারণে আরবী হরফে বাংলা লেখা একটি হাস্যকর উদ্যোগে পর্যবসিত হয়েছিল। প্রথম কথা হচ্ছে, এটা ছিল মরহুম ফজলুর রহমানের মস্তিস্কপ্রসূত এফটি শিশু এবং ফজলুর রহমানের মস্তিস্কে সারবস্তু কিছু আছে কিনা তা নিয়ে সকলের সংশয় ছিল। দ্বিতীয়তঃ ফজলুর রহমানের এই প্রস্তাবনায় পাকিস্তান সরকার মৌন ছিল-প্রকাশ্যে সমর্থনও করেনি, বিরোধিতাও করেনি। তিনি একা একা এ নিয়ে বেশ কিছু লক্ষ-ঝক্ষ করেছিলেন, কিন্তু কোনরূপ কার্যকর ভূমিকা নির্মাণ করতে সক্ষম হননি। এ আন্দোলনটি চালু রাখবার জন্য কয়েকজন অবাঙালীকে তিনি নিয়োগ করেছিলেন, কিন্তু তারা এই কাজের পিছনে কোন উদ্যম প্রয়োগ করতে পারেননি। যাদের ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তারা হচ্ছেন: মওলানা আবদুর রহমান বেখুদ, ফজলে আহমদ করিম ফজলী এবং ডঃ আনদালিব শাদানী। এরা মাঝে মাঝে বৈঠকে মিলিত হতেন, কিছু ভাতা পেতেন এবং সরকারী পয়সায় চা পান করতেন। এ ব্যাপারে মওলানা বেখুদ অনেক পরে আমার কাছে একদিন গল্প করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেখুন, আমরা জানতাম যে এগুলো করে কিছু হবে না, তবু কিছু অর্থ লাভের বিনিময়ে ফজলুর রহমানের খামখেয়ালীতে যোগ দিয়েছিলাম।’

বাংলা ভাষা বিশ্বয়করভাবে সজীব এবং বাংলা লিপির প্রচলনও আনন্দিতরূপে সর্বজনগ্রাহ্য। তাই কোন প্রতিবন্ধকতাই এই ভাষা ও লিপির অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে পারেনি। লিপির পরিবর্তনের পরিকল্পনা হাস্যকরভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ভাষার প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমরা আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রবল প্রতিবাদ করেছিলাম এবং অশুভ শক্তি আমাদের প্রতিবাদের সম্মুখে সংকটাপন্ন হয়েছিল। সেই ভাষা আন্দোলন পরবর্তীতে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে পরিণত হয় এবং স্বাধীনতার যাত্রাপথকে উন্মুক্ত করে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →