(বই থেকে) মুহাম্মদ ইউনুস – আনিসুজ্জামান

[আনিসুজ্জামানের (১৯৩৭ – ২০২০) লেখা বিপুলা পৃথিবী (২০১৫) বইয়ের ২৬৩ – ২৬৫ নাম্বার পেইজ থিকা নেয়া]
ইউনূস যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পল্লী-উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুইন-উদ-দীন আহমদ খান। ইউনূস এসে এই প্রকল্পের ভার নেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষজনদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়-সম্প্রদায়ের একটা যোগাযোগ ঘটানো। আসল অভিপ্রায়-দুদিকের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচানো, উন্নয়নের ছোঁয়া গ্রামে পৌঁছে দেওয়া। ১৯৭৫-এ বিদেশ থেকে ফিরে আমি তার সম্পর্কে অবহিত হলাম। কৃষির উন্নয়নের জন্যে এই প্রকল্পে কাজ হচ্ছিল, সেই সঙ্গে সাক্ষরতা-অভিযানও চলছিল। আমাদের বিভাগের মনিরুজ্জামান সাক্ষরতার বিষয়ে প্রকল্পের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। এক-আধদিন আমাকেও সে নিয়ে যায় এ-বিষয়ে কর্মীদের কাছে কিছু বলতে। ইউনূস প্রথম থেকেই কিছু উৎসর্গীকৃত সহযোগী পেয়েছিলেন। তাঁর বিভাগেরই শিক্ষক লতিফি তাঁদের মধ্যে প্রধান। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে থেকেও তিনি কর্মী বেছে নিয়েছিলেন। ইউনূসের প্রতি তাঁদের আনুগত্য ছিল প্রশ্নহীন, তাদেরকে ইউনূস প্রেরণা দিয়েছিলেন অন্তহীন।
পরের ধাপে ইউনুস প্রতিষ্ঠা করলেন ‘নবযুগ’ খামারের-তেভাগার নীতি অনুসরণ করে। এ-সম্পর্কে আমি খুব বেশি জানার সুযোগ পাইনি। তবে এ-প্রকল্প যে সফল হয়েছিল, তা বোঝা গিয়েছিল ১৯৭৮ সালে নবযুগ রাষ্ট্রপতি-পুরস্কার পাওয়ায়।
কিন্তু ইউনূস এতে তৃপ্ত হননি। আশপাশের অতি দরিদ্র মানুষদের দুরবস্থা তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন। নবযুগ দিয়ে তাদের কষ্ট লাঘব করা যাচ্ছিল না। সরেজমিনে দেখেশুনে তিনি উপলব্ধি করেন, কিছু অর্থ ঋণস্বরূপ পেলে এরা মহাজনদের কবল থেকে মুক্ত হতে পারে, নিজের মতো উপার্জন করতে পারে। নিজের থেকে কিছু মহিলাকে ঋণ দিয়ে যে-পরীক্ষা তিনি করেছিলেন, তা সফল হয়েছিল। ফলে ইউনূস গেলেন রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়-এদের জন্যে ঋণ পাওয়া যায় কি না, তা দেখতে। তারা বললো, ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই, আছে আঞ্চলিক দপ্তরের। সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-সন্নিহিত জোবরা গ্রামের জন্য কিছু ঋণ পাওয়া গেল। সেই ঋণ বিতরণ করেই সূচনা হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচির।
এই উদ্যোগে পরে ইউনূস সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছিলেন দুজনের কাছ থেকে-তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এ কে গঙ্গোপাধ্যায় আর বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এ এম আনিসুজ্জামান। তখনই কথা উঠেছিল, জোবরায় গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প সফল হয়েছে-কারণ, ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের সন্তান, তাঁর জোবরা গ্রাম একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন এলাকা। সুতরাং ঋণগ্রহীতারা একরকম বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকে। বাংলাদেশের অন্যত্র এ-প্রকল্প সফল হবে কি না, সন্দেহ।
ইউনূস তাঁদেরকেই বলেছিলেন জায়গা ঠিক করে দিতে। তিনি দেখাবেন যে, সেখানেও তাঁর প্রকল্প সফল করা সম্ভবপর। তাঁরা নির্বাচন করেছিলেন টাঙ্গাইল। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শাখায় এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হবে। আর তাঁর সহকর্মীরা জোবরায় এবং আশপাশের গ্রামীণ ব্যাংক চালিয়ে যাবেন।
এই প্রস্তাব মেনে নিয়েই ইউনূস চলে যান টাঙ্গাইলে। যদিও তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে গেলেন, সবটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, এ তাঁর অগস্ত্য-যাত্রা। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আর ফিরছেন না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পাহাড়-চূড়ায় যে বাড়িতে আমি কিছুকাল ছিলাম, পরে ইউনূস ছিলেন সে-বাড়িতে। ইউনূস-দম্পতির সঙ্গে দেখা করতে সেখানে গিয়েছি। একরাতে ওঁরাও এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। বোধহয় বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল বলে মোমবাতির আলো জ্বেলে আমরা বসেছিলাম টেবিল ঘিরে।
ইউনূস তাঁর প্রকল্পের কথা বলছিলেন উৎসাহ আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। তখনই মনে হয়েছিল, প্রথাগত শিক্ষকতার মধ্যে তিনি আর আবদ্ধ রইবেন না।
তারপর মনিকার জন্ম হলো, শিশুসন্তানকে নিয়ে ভেরা মার্কিন দেশে ফিরে গেলেন। ইউনূস একাগ্রচিত্তে লেগে রইলেন তাঁর কাজে। তখনো তার এই খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, প্রতিপত্তি হয়নি। তখনো তিনি অনিশ্চিত পথের যাত্রী।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- ‘মুখ ও মুখোশ’ বানানের কথা – আবদুল জব্বার খান - মার্চ 25, 2025
- (বই থেকে) মুহাম্মদ ইউনুস – আনিসুজ্জামান - মার্চ 15, 2025
- বুদ্ধিজীবীর মুখে ছাই – মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮ – ১৯৮১) - মার্চ 14, 2025