শেষ খুতবা (১৯৭৬) – আবদুল হামিদ খান ভাসানী Featured

[১৯৭৬ সালের ২৮শে নভেম্বরে মক্কায় হজ্জ্বে মওলানা ভাসানী’র এই খুতবা পড়ার কথা ছিল। ১৮ই নভেম্বর হজ্জ্বের জন্য ঢাকা ছাড়ার কথা ছিল উনার। কিন্তু ১৭ই নভেম্বর সন্ধ্যায় মওলানা ভাসানী মারা যান। পরে উনার এই লেখা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্ট কমিটির চেয়ারম্যান বজলুস সাত্তার ও অন্যতম সদস্য মওলানা মুহিউদ্দিন খান আরবী ভাষায় অনুবাদ কইরা লিফলেট হিসাবে হাজীদের কাছে বিতরণ করেন। ১৯৭৭ সালের ৭ই মে, হক-কথা পত্রিকায় এই লেখা ছাপানো হয়।]
॥ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ৷৷
প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
আজকের এই মহান দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা হইতে একই মহান উদ্দেশ্যে, একই পোষাকে একই তৌহিদের তারানা মুখে, আল্লাহর একত্ববাদের মহিমা প্রচারার্থে তাঁরই ডাকে সাড়া দিতে আজ আমরা এখানে সমবেত হইয়াছি। আজ সর্বত্র সবারই মুখে একই ধ্বনি উচ্চারিত হইতেছে, “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” অর্থাৎ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ এবং যাবতীয় প্রশংসা তাঁহারই।
আজ আর আমাদের মধ্যে আরবী, আজমী, সাদা কাল, প্রাচ্য প্রতীচ্যের কোন ভেদাভেদ নাই। আজকের এই মহান দিনে সব রকমের ভেদাভেদ ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়াছে। আমরা সবাই এক রব্বুল আলামীনের বান্দা আর তিনিই আমাদর সকলের কর্তব্য ও দায়িত্ব পবিত্র কোরআনে নিরূপণ করিয়াছেন : ইন্নামাল মুমেনুনা ইখওয়াতুন ফাসলেহু বায়না আখাওয়াইকুম ।
ভাইসব,
গত দুই শতাব্দীর শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার ও উৎপীড়নের কালোরাত্রি পাড়ি দিয়া আজ আমরা এক নূতন দিনের সুবেহ সাদেক প্রত্যক্ষ করিতেছি। এখন আমরা আর ইহুদী, হুনুদী ও নাসারাদের শাসিত পরমুখাপেক্ষী সম্প্রদায় নই ।
মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তি যদিও তওহীদ, তথাপি ইসলামের শত্রুদের ষড়যন্ত্রে ১৯১৭ সনে খেলাফতের বিলুপ্তির পর খেলাফতের ভৌগোলিক ভিত্তিতে বিশ্বে যে ৪৬টি স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের উদ্ভব হইয়াছে তাহাদের সীমারেখার ভিতর অবস্থিত আল্লাহ প্রদত্ত তেল ও খনিজ সম্পদের বদৌলতে বর্তমান দুনিয়ার সম্পদের সিংহ ভাগ আজ মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। এই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠা করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের নেতৃত্ব মুসলমানদিগকেই নিতে হইবে। তাই মুসলিম জাহানকে নতুন দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হইয়া মানুষে মানুষে সবরকম অসাম্য ও অনৈক্যের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর চূর্ণ বিচুর্ণ করিয়া সকল রকম শোষণ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটাইয়া সারা দুনিয়াতে শান্তি স্থাপনের জন্য রাব্বুল রবুবিয়াতের আদর্শে প্রকৃত সাম্যবাদ কায়েম করিতে হইবে।
ভাইসব,
আমি মুসলিম জাহান ও সারাবিশ্বের বিগত এক শতাব্দির উত্থান-পতনের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমি দেখিয়াছি মরক্কোর বীর নেতা সৈদ আবদুল করিমের অপূর্ব আত্মত্যাগের ঘটনা এবং প্যালেস্টাইনীদের বীরত্বপূর্ণ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা মুফতি আমীন আল হুসায়নীর ইহুদী বিরোধী জেহাদ, ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সউদ পরিবারের গৌরবময় সংগ্রামের ধারাবাহিকতা, মেহেদী সুদানীর অসীম বীরত্ব এবং খেলাফত আন্দোলনের সৈনিক আল্লামা জামাল উদ্দীন আফগানী, মোহাম্মদ আলী জওহর প্রমুখ অগ্নিপুরুষদের বিশ্বব্যাপী ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও কালজয়ী আন্দোলনের গৌরবময় ভূমিকা। এই সব অগ্রপথিকদের সংগ্রামী ইতিহাস হইতে আজ আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে। ইহুদীবাদের জঘন্য হামলায় আমরা আমাদের প্রথম কেবলা হারাইয়াছি। লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী ভাইবোন তাহাদের ঘরবাড়ী হইতে বিতাড়িত হইয়া পথে প্রান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। সাইপ্রাস, ইরিত্রিয়া, কাশ্মীর, ফিলিপাইন, লেবাননে শত্রুদের হিংস্র থাবা প্রসারিত রহিয়াছে। মুসলিম জাহানের এই জ্বলন্ত সমস্যাগুলির সমাধানে আর কালবিলম্ব না করিয়া আমাদিগকে ঝাপাইয়া পড়িতে হইবে। মুসলিম সমাজকে আল্লাহ পাক বেশুমার সম্পদ দান করিয়াছেন। তাই আমার আবেদন যে সমস্ত ভাইদের সম্পদ আছে তারা বিত্তহীনদের উন্নয়নে সহযোগিতা করুন; যাহাদের অর্থ নাই অথচ সামর্থ আছে তাহাদের হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া আগাইয়া চলুন। আল্লাহর দেওয়া সম্পদে আল্লাহর মখলুকের শরিকানার স্বীকৃতি দিয়া মুসলিম মিল্লাতকে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী করুন। জনসংখ্যার ভিত্তিতে একদিকে আমরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশের অধিবাসী, অন্যদিকে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘনবসতিপূর্ণ ও দরিদ্রতম আমাদের দেশ বাংলাদেশ। আমাদের উপর চলিতেছে প্রতিবেশী প্রবল পরাক্রান্ত দেশ ভারতের জঘন্য শত্রুতা এবং উপর্যুপরি হামলা। ব্রাহ্মণ্য সম্প্রসারণবাদী শাসক-গোষ্ঠীর সুদূর প্রসারী মতলব হইলে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করিয়া সিকিমের ন্যায় একটি আশ্রিত রাজ্যে পরিণত করা। এই কুমতলবের বশবর্তী বাংলাদেশের উপর প্রবাহিত আস্তর্জাতিক নদী গঙ্গা’র উপর বাঁধিয়া তাহারা আমাদেরকে শুকাইয়া মারিতে চাহিতেছে। এই দুরভিসন্ধির কারণে আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক নদীর উপর বাঁধ বাঁধিয়া আমাদের দেশটাকে মরুভূমিতে পরিণত করিতে প্রচেষ্টা চালাইতেছে। আমাদের পৌনে দুই হাজার মাইল সীমান্তে বিগত এক বৎসরে তের শত ষাটটি হামলা চালাইয়াছে। তাহারা আমাদের ক্ষেতের ফসল, পশু সম্পদ ও নিরীহ গ্রামবাসীর যথাসর্বস্ব লুন্ঠন করিয়া নিতেছে এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করিতেছে। বাংলাদেশের এই কঠিন সমস্যায় মুসলিম জাহানের ভাইবোনেরা যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ না করেন আমাদের জানমাল ও সম্মানের হেফাজতে আগাইয়া না আসেন তাহা হইলে নিঃসন্দেহে আপনাদিগকে আল্লাহ রাববুল আলামীনের নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে এবং খোদা না করুক মুসলিম বিশ্বের এক বৃহৎ অংশকে পুনরার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইতে হইবে।
মুমেন মুসলমান ভাইসব!
আমি বিশ্বাস করি একমাত্র জেহাদের মাধ্যমেই প্রথম কেবলা উদ্ধার হইতে পারে। জেহাদের মাধ্যমেই দুনিয়ার সকল মজলুম মুসলমান ভাইবোনের মুক্তির দিন আসিবে, জেহাদের মাধ্যমেই আপনারা দুনিয়ার বুকে মাথা তুলিয় দাঁড়াইতে পারেন। এই জেহাদের জন্য প্রয়োজন হইবে দুনিয়ার সকল মুসলমানের মধ্যে সীসায়- ঢালা-দেয়ালের মজবুত ঐক্য ও সমন্বিত শক্তি গড়িয়া তোলা। আসুন আজ আমরা আল্লাহর ঘরের ‘পার্শ্বে দাঁড়াইয়া শপথ করিঃ ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের কর্তব্য পালন করিতে আমরা আর গাফলতী করিব না।
আল্লাহ আমাদের সহায় । নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়াফাতহুন ক্বারীব ।
…
লেখাটা “রাখে আল্লা, মারে কে” বইয়ে ছাপানো হইছে। বইটা এই লিংক থিকা কিনতে পারবেন: https://www.rokomari.com/book/274831/rakhe-allah-mare-ke
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- শেষ খুতবা (১৯৭৬) – আবদুল হামিদ খান ভাসানী - এপ্রিল 14, 2025
- আমার জীবন দর্শন – আমাদের শক্তির উৎসঃ কোরান ও রসূল (মাহবুব-উল আলম) - এপ্রিল 3, 2025
- ‘মুখ ও মুখোশ’ বানানের কথা – আবদুল জব্বার খান - মার্চ 25, 2025