Main menu

ভ্যালুগুলা না থাকলে আপনি আর্টিস্ট হইতে পারবেন না। আর্টিস্টরা কোনো শূন্য জায়গায় থাকে না। – অমৃতা প্রিতম Featured

[অমৃতা প্রিতমের এই ইন্টারভিউটা রমা ঝা নিছিলেন ১৯৮১ সালে। ইনডিয়ান লিটারেচার পত্রিকায় ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ইস্যুতে ছাপা হইছিল।]

রমা ঝা: অমৃতা, আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমনে হইলো? আমি জানি যে এই প্রশ্ন আপনারে বহুবার করা হইসে, কিন্তু কোনো শিল্পীরে জানার জন্যে এইটাই মনে হয় সবচেয়ে ভালো প্রশ্ন। আমি পার্টিশনের আগের পাঞ্জাবে একজন কবি হিসাবে আপনার শুরুর কথাটা কইতেসি। আমার মনে হয়, ওই সময়ের পাঞ্জাবের কনজারভেটিভ কালচারে আপনিই একমাত্র নারী কবি? আপনারে কবিতা লিখতে উৎসাহ দিসে কোন বিষয়টা?

অমৃতা প্রিতম: লেখালেখিটা আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। আমি ছোটবেলাও লেখকদের মাঝেই বাইড়া উঠসি। আমার বাবা নিজেই একজন কবি। উনি সারা রাত ধইরা কবিতা লিখত আর সারাদিন ঘুমাইত। এইটাই উনার প্রতিদিনের লেখার রুটিন ছিল। আমার যখন মাত্র সাড়ে দশ বছর বয়স, তখন মা মারা যায়। তাই বাবা যখন সারাদিন ঘুমাইত, আর আমার কোনো ভাইবোনও ছিল না— আমার একলাই থাকতে হইত। একলা একলা কী আর করব, নিজেরে বইপুস্তকের মাঝে ডুবায়া রাখতাম। আমাদের বাসাভর্তি অনেক বই ছিল।

রমা: কীরকম বই?

অমৃতা: হয় ধর্মীয় বই, আর নয় ইন্ডিয়ান মিথের।

রমা: আপনার প্রথম পড়া বইগুলা কি পাঞ্জাবি, মানে গুরুমুখী ভাষায় ছিল?

অমৃতা: হ্যাঁ, এইরকমই…

রমা: ইংলিশ বইয়ের দেখা কবে পাইলেন?

অমৃতা: ওইটা অনেক পরে।

রমা: আপনার ছোটবেলায় পড়া লেখকদের কয়েকজনের নাম কইতে পারেন?

অমৃতা: যদ্দূর মনে পড়ে, ক্লাসিক্যাল পাঞ্জাবি কবিতার একটা কালেকশন ছিল। ওইটাতে শেখ ফরিদ, শাহ হুসেইন, ওয়ারিস শাহ, পিলু আর হাশেমের লেখাগুলাই সবার আগে পড়সিলাম। আর মিথোলজির বইগুলা সব সংস্কৃত থিকা পাঞ্জাবিতে অনুবাদ করা হইসিল। সবই হাতেলেখা। আমার বাবা বিভিন্ন পণ্ডিতের কাছ থিকা বইগুলা ধার করতেন, এরপর লোক রাইখা ওইগুলা কপি করাইতেন। আমার মনে আছে, বিকালবেলা আমাদের বাসায়…(উনি মনে করতেসিলেন)…এই লেখাগুলা নকল করার সময়, লাল-কালো রঙের কালিতে তখন দারুণ ক্যালিগ্রাফিও আঁকা হইত।

রমা: এইটা কই? গ্রামে? আপনার বাবা কি জমিদার ছিলেন?

অমৃতা: না না, এইটা গ্রামে না। এইটা লাহোর শহরের কথা। আমার বাবা বেশ ভালো বড়লোকই ছিল। জায়গিরদার পরিবার থিকা আসা। বেশ সামন্তবাদী ঘরানার। কিন্তু লাহোরে উনি বেশ বড় একটা বাড়ি বানাইসিলেন। তবে, (মনে হইলো, উনি উনার পরিবারের কোনো গোপন কথা কইতে যাইতেসেন) আমার বাবা কিন্তু চৌদ্দ বছর বয়সে ঘর ছাইড়া সন্ন্যাসী হইসিল— বালক সাধু আরকি। আর ওই সাধু থাকা অবস্থাতেই উনি আমার মায়ের প্রেমে পড়লেন। এইভাবেই কবি হয়ে উঠলেন।

রমা: খুবই মজার ব্যাপার তো। কিন্তু আপনি যে কইলেন আপনার মায়ের মৃত্যু আর আপনার বাবার লেখালেখিতে মইজা থাকার জন্যই আপনি একলা হয়া গেসিলেন। তাইলে কি এই একলাপন কাটাইবার জন্যই আপনি লেখালেখিতে আসলেন?

অমৃতা: হ্যাঁ, ওইরকমই। আসলে আমার একলা সময়টা কাটানোর জন্যই লেখালেখির শুরু। কিন্তু আমার বাবার হাতও ছিল। উনার জন্যই এইসব শুরু হয়। আমারে উনি বিভিন্ন মাত্রা, ছন্দের ব্যবহার এইসব শিখাইছিলেন।

রমা: আপনার কি অনেক কম বয়সে বিয়া হয়?

অমৃতা: হ্যাঁ। চার বছর বয়সে আমার বিয়ার কথা পাকা হয় আর পনেরোতে বিয়া হয়া যায়।

রমা: বিয়ের পর সংসার নিয়াই ব্যস্ত ছিলেন না? কত রকম জিনিসপাতি থাকে না? বিয়ের পর সতেরো বছর বয়সেই আপনার প্রথম কবিতার বই বাইর হইলো। এইটা নিয়া কিছু কইবেন?

অমৃতা: হ্যাঁ আমি আমার পরিবারের দেখভাল নিয়া ভালোই ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু লেখার সুড়সুড়িটা সবসময় একই ছিল। বরং সময়ের সাথে আরো বাড়সে।

রমা: আপনার কবিতার ফার্স্ট কালেকশন কোনটা?

অমৃতা: পাত্থার গিটে (মার্বেল স্টোনস)। এইটা পার্টিশনের আগে ছাপসিল। লামিয়া ওয়াতন (লং ওয়েস) আমার সেকেন্ড কালেকশন, এইটাতে পার্টিশন নিয়া কবিতা আছে।

রমা: ওই সময়ে আপনি মনে হয় একমাত্র পাঞ্জাবি লেখিকা ছিলেন? আপনার সমসাময়িক কবি কারা?

অমৃতা: আমার সময়ের লেখকদের মাঝে সাদত হাসান মান্টো, রাজেন্দর সিং বেদী আর কৃষাণ চন্দরের নাম কইতে হয়। তবে এরা সবাই গদ্যে লিখতেন। মান্টো আর চন্দর বেশিরভাগ উর্দুতে লিখতেন, দুইজনেই ছোট গল্প লেখক ছিলেন।

রমা: আপনার কবিতা নিয়া কিছু কন।

অমৃতা: নাগমণি নামের আমার আরেকটা কবিতার কালেকশন আছে।

রমা: আমি ভাবসিলাম আপনি এখন যে জার্নালটা এডিট করতেসেন, ওইটার নাম নাগমণি?

অমৃতা: হ্যাঁ, কিন্তু আমার একটা কালেকশনও আছে এই নামে।

রমা: আমি আপনার ‘কাগাজ তে ক্যানভাস’ নিয়া জানতে চাই। যেইটার জন্য আপনি ১৯৮১-তে Jnanpith অ্যাওয়ার্ড পাইসিলেন। এইটা কি আপনার লেটেস্ট?

অমৃতা: না, এইটা লেটেস্ট না। আসলে কাগাজ তে ক্যানভাস দশ বছর আগে লেখা হইসিল। ওইটার পর আমি আর কোনো কালেকশন ছাপি নাই। কিছু বাছাই করা লেখা বাইরইসে, কিন্তু কালেকশন বাইর হয় নাই।

রমা: এই অ্যাওয়ার্ড উইনিং বইটা কী নিয়া? এইটা সৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়া, লেখালেখির নিজস্ব প্রক্রিয়াটা— এইটাই কি বইটার থিম? লেখালেখি আর ছবি আঁকা, দুইটাই?

অমৃতা: এইটারে আমি আমার জীবন দেখার তরিকা কইতে চাই, জীবনের একটা ছবি।

রমা: আপনি কবি হিসাবে অনেক সফল। কবিতার জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারও পাইসেন। কবিতা থিকা ফিকশনে আসলেন কেন?

অমৃতা: আমি কবিতা থিকা ফিকশনে আসি নাই। আমি দুই ফর্মেই লেখি। হ্যাঁ তবে এখন গদ্যটা বেশি লিখতেসি। মাঝে মাঝে কবিতা লিখি।

রমা: আপনি কি আপনার কবিতা আর নভেলগুলারে আলাদা জগত হিসাবে দেখেন?

অমৃতা: অনেক সময় লেখার সাবজেক্টই ওইটার ফর্ম ঠিক কইরা দেয় আমার জন্য। যেমন কিছুদিন আগে আমি সাতটা পার্টে একটা লম্বা ন্যারেটিভ কবিতা লিখসি— আদি রচনা, আদি পুস্তক, আদি চিত্র, আদি সঙ্গীত, আদি ধর্ম, আদি কাবিলা আর আদি ল।

রমা: আদি, মানে শুরু।

অমৃতা: হ্যাঁ, বেদেরও আগের শুরু।

রমা: আপনি এইসব ফর্ম বর্ণনা করতে গিয়া মানসিকভাবে ওই যুগটায় চইলা গেসিলেন? দিন দিন আপনি কি আরো বেশি পিওর ফ্যান্টাসি থিকা লেখালেখিটা করতেসেন?

অমৃতা: আপনি মনে হয় ঠিকই কইসেন। তবে দেখেন, এইসব…মানে এই বেদ, আইনের প্রথম বই, প্রথম রাগ— এইসব কিন্তু অনেক পরে আসছে। আমি মনের মধ্যে এমনভাবে ঘুইরা বেড়াই, যাতে এইসবেরও আগের সময়টা ধরতে পারি…প্রথম সৃষ্টি, ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, কসমস। আমি আসলে এইগুলা সবই ঘোরের মাথায় লিখসি।

রমা: আপনি কি কোনোভাবে ইন্ডিয়ান কালচারাল হেরিটেজের আদি মূল্যগুলা খুঁজতেসেন?

অমৃতা: না, আমি খালি ভারতীয় সভ্যতার শুরুর আগের সময়টা নিয়া কথা কইতেসি (না, হবে?) — প্রাগৈতিহাসিক সময়টা।

রমা: আপনার প্রথম নভেল ‘ডক্টর দেব’ ১৯৪৯ সালে বাইর হইল, মানে পার্টিশনের দুই বছর পরে। আপনার নভেলের উপর কি ওইভাবে পার্টিশনের প্রভাব খুঁইজা পান?

অমৃতা: হ্যাঁ, পাঞ্জাবে পার্টিশনের অভিজ্ঞতাটা ভেতর নাড়ায়া দেয়ার মতোই ছিল। আমি লাহোররে পুড়তে দেখসি। মহিলাদের অবস্থা, তাদের ভোগান্তি আর ধইরা নিয়া যাওয়ার খবরগুলা ভয়ঙ্কর ছিল।

রমা: আপনি কি এইসব দাঙ্গা, মহিলাদের দুর্দশা সামনে থিকা দেখসেন?

অমৃতা: হ্যাঁ, ওই সময়টাতে আমার বড় বাচ্চাটা আমার পেটে। ডাক্তারের পরামর্শে আমরা দেরাদুনে আসছিলাম। ওই সময়েই আমার সাথে মৃণালিনী সারাভাই আর শাহ নাওয়াজ খানের দেখা হয়। মৃণালিনী সারাভাই আমারে মহিলাদের দুরবস্থার কাহিনী শুনাইতেন। ‘ডক্টর দেব’ আর ‘পিঞ্জর’ এই দুইটাতেই পার্টিশনের আলাপ আছে। আমার ‘আজ আখান ওয়ারিস শাহ নান’ কবিতাটাও পার্টিশনের উপরেই লেখা। এইটা পাকিস্তানে বেশ জনপ্রিয় হইসিল।

রমা: আপনার কবিতায় থাকা ওইসব আইডিয়ালের জাল থিকা মোহভঙ্গ হওনের পরুই কি টানা দুইটা নভেল লিইখা ফালাইলেন?

অমৃতা: না, ঠিক তা না। আসলে নভেলে আমি আরো বড় একটা ক্যানভাস পাইলাম। ‘ডক্টর দেব’ বইটাতে প্রেমিক নিয়া আমার একটা ইমেজ আছে। একটা আইডিয়ালিস্ট, প্রচণ্ড শুদ্ধ একটা মানুষ।

রমা: আপনি যেমনে ডক্টর দেবরে বর্ণনা করলেন, চরিত্রটারে অনেকটা গান্ধীবাদী মনে হয়।

অমৃতা: না, গান্ধীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই।

রমা: কিন্তু আপনি এইমাত্র আপনার চরিত্রের যে গুণগুলা কইলেন, এগুলা তো গান্ধীবাদী বৈশিষ্ট্যই।

অমৃতা: দেব আসলে নতুন ভারতের নতুন আদর্শগুলা নিয়া তৈরি একটা চরিত্র।

রমা: তাইলে আপনি আপনার কবিতা আর নভেলে নতুন আদর্শ তৈরি করতেসেন?

অমৃতা: হ্যাঁ, কারণ ওই ভ্যালুগুলা না থাকলে আপনি আর্টিস্ট হইতে পারবেন না। আর্টিস্টরা কোনো শূন্য জায়গায় থাকে না। পুরান আদর্শগুলা যখন বস্তাপচা হয়া যায়, তখন আর্টিস্টরাই নতুন নতুন মূল্যবোধের জন্ম দেয়।

রমা: আপনি তো অনেক ঘুরাফিরা করসেন। আপনার প্রথম বিদেশের সফর কোনটা ছিল, জানতে পারি? আর কেমনেই বা হইসিল?

অমৃতা: ১৯৬১ সালে আমি প্রথম ইন্ডিয়ার বাইরে যাই। রাশিয়াতে একটা রাইটার্স কনফারেন্সে গেসিলাম।

রমা: গত বছর আপনি বুলগেরিয়াতে আরেকটা লিটারেরি কনফারেন্সে গেসিলেন। ওইখানে আপনারে নিকোলা ভাপতাসারোভ সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হইসে। ওইখানে তো অনেক লেখিকার সাথে দেখা হইসে নিশ্চই। ইউরোপের লেখিকাদের নিয়া আপনার কী ভাবনা?

অমৃতা: আমার সাথে এদের বেশ কয়েকজনের দেখা হইসে, অনেকরে নিয়া আমি একসাথে তরজমার কাজটাজও করসি। উনারা খুব বেশি আলাদা না। ইউরোপিয়ান কাজের মধ্যে আমি প্রথমবার তরজমার চেষ্টা করসিলাম উজবেকিস্তানের জুলফিয়া খাতুনের কবিতা নিয়া।

রমা: আপনি কি কোনো পুরুষ লেখকের কাজ তরজমা করসেন?

অমৃতা: আমার রিসেন্ট তরজমাটায় বুলগেরিয়ান লেখকদের পনেরোটা ছোটগল্প আছে। বইটার নাম দিসি ‘স্টেয়ারকেস’। এর মধ্যে সব গল্পই পুরুষ লেখকদের।

রমা: মহিলাদের নিয়া আপনার ভাবনাটা কী? নারী স্বাধীনতা নিয়াই বা কী ভাবেন আপনি?

অমৃতা: নারী স্বাধীনতা পুরুষদের স্বাধীনতা থিকা আলাদা কিছু না। মহিলাদের মতোই পুরুষরাও একইভাবে মানসিক দাস। পুরুষরা এখনো নারীদেরকে একটা আলাদা সত্তা হিসাবে, সমান সমান অংশীদার হিসাবে বন্ধু কইরা পায় নাই। পুরুষ আর মহিলারা এখনো দুইটা আলাদা, স্বাধীন মানুষ হিসাবে একে অন্যের সামনে আসে নাই। পুরুষ আর মহিলারা যদি টাকা-পয়সার দিক দিয়া স্বাধীন না হয়, তাইলে তারা ভালোবাসবে কেমনে? নারীর ভালোবাসাটা বেশিরভাগ সময় আসে ইনসিকিউরিটি থিকা। কিন্তু ভালবাসা তো অন্য একটা মানুষের প্রতি ভালোলাগা, তার সঙ্গের আকাঙ্ক্ষা থিকা আসা উচিত। অর্থনৈতিক দাসত্বের কারণে ভালোবাসার বিষয়টাতেই বাধা চইলা আসছে। আসলে নারী স্বাধীনতা মানে শুধু তাগো অধিকারের লিগা চিল্লায়া স্লোগান দেয়া না। অন্তত আমি এই ধরনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না। আমার কাছে নারীর স্বাধীনতা মানে হইসে তার পুরা ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক উন্নয়ন। যাতে তার আলাদা কইরা স্বাধীনতা কারো কাছ থিকা চাওন না লাগে। সে যাতে নিজেই সেইটা অর্জন কইরা নিতে পারে।

রমা: আপনার ‘কাড়ি ধুপ কা সাফার’ বইয়ে শুনছি মেয়েদের নিয়া কথাবার্তা আছে। এইটা নিয়া কিছু কইবেন?

অমৃতা: এইটা একটা গদ্য বই। বিশ্বের বিভিন্ন মহিলা কবিদেরকে নিয়া…ঋগবেদের সময় থিকা শুরু কইরা এখন পর্যন্ত যারা আছে।

রমা: নারীর জগতটা তো আপনার কাছে নতুন কিছু না। এই মহিলারা কারা, আর এদের কাজ নিয়াই বা আগ্রহী হইলেন কেন?

অমৃতা: এই বিষয়টাতে আমার রিসার্চ থিকা বুঝতে পারসি যে বেদ লেখার কাজে অন্তত সাতাইশ জন মহিলা কাজ করসেন।

রমা: এদের কয়েকজনের নাম কইবেন?

অমৃতা: যেমন ধরেন লোপামুদ্রা, রাত্রিসূর্যা— এরা।

রমা: এইটা তো একটা জেনারেল রিসার্চের কাজ। আপনি কি এই রিসার্চের উপরে ভিত্তি কইরা, এই ব্যক্তিগুলারে নিয়া কোনো নভেলের কাজ করসেন?

অমৃতা: হ্যাঁ, আমার ‘তিসরি আঁখ’ বইটা এম এন রয়ের একজন অনুসারীর জীবন নিয়া। এইটাতে ভারতের স্বাধীনতার আগের সময়টাতে ফোকাস করা হইসে। মেইন চরিত্রটার রাশিয়া ভ্রমণ নিয়া, পথে যত ভোগান্তি হইসে— এইসব নিয়া কাহিনীটা। আমি রেকর্ডটারে ঠিকঠাক রাখতে চাইসি। এইটা পুরাটাই হিস্টোরিক্যাল রেকর্ডের বই।

রমা: আমরা কি তাইলে এইটারে ইতিহাসের বই হিসাবেই ধরব?

অমৃতা: না না, এইটা ইতিহাসের বই না ঠিক। আমি ইতিহাসটারেই নভেলের আকার দিসি। এইটারে আপনি বায়োগ্রাফিক্যাল নভেল কইতে পারেন।

রমা: আপনার লেখা এই একটাই কি বায়োগ্রাফিক্যাল নভেল?

অমৃতা: এই জনরাতে এইটাই লিখসি। নভেলটার নাম ‘বুলাওয়া’। এইটা ফয়েজ নামের এক পেইন্টারের জীবন নিয়া লেখা। আমি সব নাম, জায়গার নাম, ঘটনা – সবই আসলটা রাখসি। আর আপনি তো জানেনই, আমার ‘রাসিদি টিকেট’ (রেভিনিউ স্টাম্প) একেবারে অটোবায়োগ্রাফিক্যাল কাজ।

রমা: আপনার নভেলের থিমগুলা বেশিরভাগ কীরকম হয়? আপনার কবিতাগুলা থিকা আলাদা?

অমৃতা: না, আমার থিমগুলা আপনি হয়তো খেয়াল কইরা থাকবেন, কমবেশি একই থাকে। আর আমার থিম হইসে মানুষের সম্পর্ক। বিশেষ কইরা নারী-পুরুষের সম্পর্ক। শুধু লেখার জনরা অনুযায়ী তাদের প্রতি ট্রিটমেন্টটা পাল্টায় যায় লেখার সময়। যেমন নভেলে অবশ্যই একটা বড় রেঞ্জ নিয়া কাজ করতে হয়। আর কোনো কোনো সময় একই থিমের হয়তো একটু আলাদা ট্রিটমেন্টের দরকার হয়, কোন বিষয়ে ফোকাস করতেসি – সেটার উপর ভিত্তি কইরা। যেমন ধরেন আমার শুরুর দিকের গল্পগুলা – ‘যাত্রী’ গল্পটা একটা বাচ্চারে নিয়া, যারে তার মায়ের মানতের জন্য এক সাধুর হাতে তুইলা দেয়া হয়। মানে ওই মা-টা মানত করসিল যে বাচ্চাটা বাঁইচা গেলে সে ভগবানরে দিয়া দিবে। তো এই গল্পটা ওই ছেলের কনশাসনেসের মাধ্যমে লেখা হইসে। অন্য কারো চয়েসের কারণে তার যে ভিকটিম হইতে হইলো, এইজন্য তার যে রাগ সেইটা উইঠা আসছে। আমার নভেলগুলাতে আমি প্রেমের থিম নিয়া যখন কাজ করি, তখন সেইটা কিন্তু বিচ্ছিন্ন প্রেম হয় না – বরং জীবনের বিভিন্ন দিকের সাথে জুইড়া থাকা প্রেম নিয়াই হয়।

রমা: ইন্ডিয়ার পাঠকমহলে আপনার নভেলগুলা অনেক জনপ্রিয়। বেশ রুচিসম্পন্ন মানুষজনই পইড়া থাকেন। আপনি নভেল লেখার সময় কোন ধরনের পাঠকরে মাথায় রাইখা লেখেন?

অমৃতা: আমি আসলে কোনো নির্দিষ্ট ধরনের পাঠকরে মাথায় ধইরা লেখি না। আমার শুধু কী কইতে হইব, আর সেইটা কত ভালোভাবে কইতে হইব – এইটা নিয়াই চিন্তা থাকে। আমি আমার নিজের সেটিসফেকশনের জন্য লেখি। তবে আমার ভাল্লাগে, যখন পাঠকরাও আমার লেখা বইগুলা পইড়া মজা পায়। কিন্তু বেসিক্যালি আমি লেখার বিষয়বস্তু আর ওই বিষয় নিয়া আমার নিজের ভাবনাচিন্তাটা পরিষ্কার রাখতে পছন্দ করি।

রমা: কোনো পরিস্থিতি বা চরিত্র কি আপনারে নভেলিস্ট হইয়া উঠতে উস্কানি দেয়?

অমৃতা: কখনো কখনো হয়তো কোনো পরিস্থিতি একটা পার্টিকুলার নভেলের জন্য উৎসাহ দিয়া থাকে। যেমন আমার ‘শাহ দি কাঞ্জারি’ (শাহ’স প্রস্টিটিউট) নামের ছোটগল্পটা দুইটা আলাদা সামাজিক অবস্থানে থাকা দুইজন মহিলার সামনাসামনি হওয়ার একটা ঘটনা থিকা লেখা। একজন বাঈজী, আর আরেকজন ওই শাহের বউ। এই মুখামুখি হওয়ার বিষয়টা শাহের নিজের পোলার বিয়ার অনুষ্ঠানে ঘটে। এইটা ওই দুই মহিলার মনস্তত্ত্বের আশয়-বিষয় নিয়া একটা গল্প। একজন ওই শাহের রক্ষিতা, আরেকজন ওর বউ। দুই ধরনের সামাজিক জায়গা থিকা দেখা যায়, এদের একজন সমাজে সম্মান পাইতেসে আর অন্যজন কোনোরকম সম্মান ছাড়া নিজের সৌন্দর্য আর অল্প বয়সের সময়টার মজা নিতেসে। এই বিষয়টাও ইন্টারেস্টিং যে এরা দুইজনই কেমনে দুইজনরে অপমান করার চেষ্টা করে। আমি চল্লিশের দশকের সময়টাতে ইন্ডিয়ান সোসাইটির বিভিন্ন সামাজিক ট্যাবুর কারণে ওই বাঈজীর বিভিন্ন ভোগান্তিই তুইলা ধরতে চাইসিলাম। তাই এই গল্পটা একদম আসল মানুষজন, আসল পরিস্থিতির উপর ভিত্তি কইরাই লেখা। কিন্তু কোনো কোনো সময় আবার একটা আইডিয়া মাথায় আসে, এরপর আমি এইটারে একটা কাঠামো দেই- এরপর একটা গল্প বা নভেল লেইখা ফালাই।

রমা: সময়ের সাথে সাথে আপনি মনে হয় আপনার নভেলগুলাতে কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়ার একটা কাঠামো আনতে গিয়া আরো বেশি পৌরাণিক গল্পগুলার রেফারেন্স দিতেসেন। ‘তেরওয়ান সুরাজ’ (দ্য থার্টিনথ সান) বইটাতে আপনি মহাভারতের মিথ তুইলা আনছেন। তেরো নাম্বার সূর্য, মানে মানুষের বুদ্ধি হইসে মহাভারতের বারোটা সূর্যের পরে যোগ করা আরেকটা সূর্য। একইসাথে আপনার ইংলিশে লেখা কিছুদিন আগের একটা নভেল আছে, ‘ফোরটি নাইন ডেইস’- এইটাতেও একটা নির্দিষ্ট মিথের আলাপ আছে। ওই মিথটা কেমন?

অমৃতা: একটা তিবেতিয়ান ফিলোসফি আছে যে মানুষ মরার পরে আর আবার জন্মানোর আগে তার আত্মাটা ৪৯ দিনের জন্য একটা শূন্যস্থানে হাকে। আর এই সময়টাতে সে তিনটা কায়া পাল্টায়। এই কায়াগুলা হইসে ধরম কায়া, সম্ভোগ কায়া আর নির্মাণ কায়া। প্রথম কায়াতে আত্মার কাঠামোটা শুধু বাতাস আর আগুন দিয়া তৈরি, দ্বিতীয়টাতে শরীরটা মৃতরা পায়া যায় আর তারা নিজেদের কাছের মানুষদের সাথে আবার যোগাযোগ করতে পারে। আর তিন নম্বর কায়া, মানে নির্মাণে আত্মাটা আবার এই পৃথিবীতে নতুন কইরা জন্মায়।

রমা: আপনার অন্যান্য নভেলের মতো এইটাও নারী-পুরুষের মধ্যকার প্যাশনেট প্রেমের গল্প। কিন্তু অন্যগুলাতে যা নাই, তা হইসে এই নভেলটাতে এই দেশের সামাজিক আর রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর একটা ধারাভাষ্য আছে। আমি কি ঠিক কইলাম?

অমৃতা: একভাবে ঠিকই কইসেন।

রমা: এইজন্যই কি আপনি এই মিথটারেই তুইলা ধরসেন, যেটা আবার একজন আর্টিস্টের সাথে যুক্ত?

অমৃতা: হ্যাঁ, ঠিক।

রমা: আপনি যে ‘ফোরটি নাইন ডেইস’-এর প্রোটাগনিস্ট হিসাবে সঞ্জয় নামের একজন লেখকরে বাইছা নিসেন, এইটা কি নিজে আর্টিস্ট হওয়ার কারণে করা হইতে পারে?

অমৃতা: আসলে একজন আর্টিস্ট হিসাবে, বিশেষ কইরা একজন লেখক হিসাবে সঞ্জয় যা দেখসে – সেইটা নিয়া লেখার একটা তাগিদ তার মধ্যে কাজ করে। সঞ্জয় তার ডেলিরিয়ামের সময় যা যা দেখসে, সে ফোরটি নাইন ডেইসে সেটাই লিখসে।

রমা: হ্যাঁ, সঞ্জয়ের লেখা বইটারও নাম ফোরটি নাইন ডেইস। আপনার নিজের অভিজ্ঞতাগুলা মনে হয় আপনার প্রোটাগনিস্টের সাথে অনেকটা মিইলা গেসে। এইটা কি কোনোভাবে অটোবায়োগ্রাফিকাল নাকি? আমি এইজন্য জিগাইতেসি যে আমার মনে হয় সঞ্জয় আসলে আপনারই একটা রূপান্তরিত ইমেজ। আপনি নাগমণি নামের যে মাসিক জার্নালটা এডিট করেন, ছাপেন— ওইটার কিছু ছাপও মনে হয় নভেলটাতে চইলা আসছে।

অমৃতা: আমার মধ্যেও আমার আশপাশে যা দেখি, সেইটা লেইখা ফালানোর তাগিদ কাজ করে। ইমরোজ মজা কইরা বলে, “অমৃতা, তুমি যখন মইরা যাবা, তুমি তো ঈশ্বররেও প্রশ্ন করবা যে সে এমনে দুনিয়াটা কেন বানাইলো।”

রমা: আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দিলেন না। (আমি একটু জোর করলাম)

অমৃতা: ওহ, অটোবায়োগ্রাফিকাল কি না? আসলে (উনি কনফেস করতেসেন) এইটা সত্যি। সঞ্জয়ের স্রষ্টা হিসাবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার আদর্শগুলাও সঞ্জয়ের কাছে ট্রান্সফার হয়া গেসে। কিন্তু এইটা গল্পের জন্য জরুরি ছিল যে সঞ্জয় তার আশপাশে যা দেখবে, সেইটা লিখবে। কিন্তু আমার কইতেই হইব যে নভেলের শিরিন চরিত্রটার মধ্যে আমার অভিজ্ঞতাটা বেশি আছে। প্রেম নিয়া ওর ধ্যান-ধারণা আমার মতোই।

রমা: হ্যাঁ, শিরিনের চরিত্রটাও বেশ ইনটেন্স। সে নিজের প্রেমিকের ক্রিয়েটিভ চিন্তা-ভাবনা ভাগ কইরা নিতে পারে। সে আপনার আগের লেখা নাজুক, অতি রোমান্টিসাইজড নারীদের থিকা আলাদা। সে যখন গল্পের মধ্যে ঢুকে, তখনই যেন পুরা বিষয়টার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়া নেয়। একেবারে আপনার মতোই সেলফ-এডুকেটেড। সে কী করতে চায়, তা নিয়া একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট মানুষ হিসাবে তার স্বচ্ছ ধারণা আছে। যেমনে সে সঞ্জয়ের সাথে যৌথ উদ্যোগ নিয়া প্রেসের সেট-আপ করে, একেবারে পাকা ব্যবসায়ী একটা চরিত্র!

অমৃতা: হ্যাঁ ঠিকই কইসেন। ও আমার অন্য নারী চরিত্রগুলা থিকা বেশ আলাদা।

রমা: এখন আমারে বলেন তো অমৃতা, আপনি কি আসলেই লোয়ার ক্লাস মহিলাদের মধ্যে হওয়া মারামারি সামনে থিকা দেখসেন – যেমনটা আপনি বারকাতে আর নেহমাতে কিংবা ফোরটি নাইন ডেইসে করিম মিয়ার দুই বউর মধ্যের মারামারির কথা কইসেন? আপনার সাথে কি আসলেই জামাল চাচার মতো কারো কখনো দেখা হইসে? নতুন দিল্লির এই শহরতলীর ঘটা বিভিন্ন ঘটনা জীবনের অনেক কাছের বইলা মনে হয়, আপনার অন্য নভেলগুলা থিকা যা অনেকটা আলাদাও।

অমৃতা: আমি একেবারে কল্পনা থিকা কিছু লিখতে পারি না। আমার চরিত্রগুলা সবসময়েই আসল মানুষজন থিকা আসছে। যাদের সাথে আমার দেখা হইসে, কথা হইসে। এইটা আমার লেখালেখির একটা জরুরি অংশ। এইটা অন্য কথা যে এইসব চরিত্রের মাঝখানের কেমিক্যাল মিকচারটা আমার নিজের দেয়া। পার্টিশনের আগের পাঞ্জাবে আমি এই নভেলে লেখা জীবনটা কাছ থিকা দেখার সুযোগ পাইসি। এইটা বলা মুশকিল যে কোন অভিজ্ঞতার সাথে কোন কল্পনাটা মিইশা শেষমেশ কোন চেহারা ধরসে!

রমা: টেকনিকের দিক দিয়া ফোরটি নাইন ডেইস প্রায় সাররিয়েলিস্ট, বিশেষ কইরা নভেলটার প্রথম অর্ধেক – সঞ্জয়ের ডেলিরিয়ামের কথাটা কইতেসি আরকি। মিতারে নিয়া ওর অবসেশন শেষ হওয়ার আগে সঞ্জয়ের সাইকিতে ঢুইকা থাকা বিভিন্ন ইমেজরে দেখা যায়। এইটা কি আপনার নিজের পেইন্টার হওয়ার কারণে বা ইমরোজের পেইন্টিং স্টাইলের কারণে আসছে? নীল, ধূসর হলদেটে সবুজ আর লালের বিভিন্ন ঝলকানিগুলারে কেমনে আনলেন? নীল সবুজ আর ধূসর হলুদ কি তাইলে সঞ্জয়ের অতীত? আর মাঝে মাঝে আসা লাল রঙটা ওর জীবনের নতুন শুরু? একটা নতুন প্যাশন?

অমৃতা: না, আমি কখনো পেইন্টার ছিলাম না। আর এর সাথে ইমরোজের পেইন্টিংয়ের স্টাইলেরও কোনো সম্পর্ক নাই। আসলে ফোর্টি নাইন ডেইসের ফিলোসফিটাই এমন যে রঙের বিষয়টা আইসা যায়। আত্মার যে তিনটা স্টেজের কথা আমি বললাম, তার সাথে এইটার যোগাযোগ আছে। আমি ইয়ুং আর ফ্রয়েড পড়সি। হইতে পারে ইয়ুংয়ের এনালাইসিস পড়ার জন্যও ফোরটি নাইন ডেইসের লেখায় একটা প্রভাব পড়সে। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল সঞ্জয়ের মনের ভিতরের সাইকিক রিয়েলিটিটারে তুইলা আনা। তবে আমার এইটা জাইনা বেশ মজা লাগসে যে এই রংগুলা থিকা আপনি বুঝতে পারসেন যে সঞ্জয়ের অতীত আর বর্তমান কোনো না কোনোভাবে তার ভবিষ্যতরেও দেখায়া দিতেসে।

রমা: এই নভেলটা লিখার সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য নিয়া আপনার মাথায় কোনো ম্যাসেজ মাথায় ছিল?

অমৃতা: হ্যাঁ, তা তো ছিলই। কিন্তু স্লোগানের মতো কইরা না। আসলে সবকিছুই চিল্লায়া কইতে হয় না। এই ম্যাসেজটা অনেক বেশি সূক্ষ্মভাবে দেয়া হইসে আর এই ঐক্যের একটা সম্ভাবনারেও দেখায়া দিসে – যে আমাদের কালচারের দুইটা সমান্তরাল ধারা হইসে হিন্দু আর মুসলিম। তারা চাইলেই খুব আরামসে কোনো ঝামেলা ছাড়া সমান্তরালভাবে জীবনটা কাটায়া দিতে পারে।

রমা: এইটা অনেক আশ্চর্য লাগে যে আপনার বইগুলা বেশিরভাগই পাঞ্জাবে নিষিদ্ধ হইসে, কিন্তু আপনার পাঠকরাও আবার পাঞ্জাবি ভাষাতেই সেইটা পড়তেসে। এইটা আপনার কেমন লাগে?

অমৃতা: লেখালেখির ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আমার মাঝে একটা প্রতিক্রিয়া আসছিল যে আমি যদি আমার লোকজনের কাছেই না পৌঁছাইতে পারি, তাইলে এই ভাষায় লিইখা লাভ কী। আমি নিজেরে কইসিলাম, “আর পাঞ্জাবিতে লেখালেখি না।” কিন্তু পরে যখন ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলাম, আমার মাঝে থাকা রাইটারটা ঠিক করলো যে যতই যা হয়া যাক না কেন, আমি আমার মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় লিখতে পারব না। এইটাই আমারে আমার মাটির সাথে, আমার আশপাশের সমাজের সাথে মিশায়া দেয়। আমি আসলে আমার পুরাটাই পাঞ্জাবি ভাষার কাছে সঁইপা দিসি।

রমা: আপনার ‘অন্নদাতা’ (ব্রেডউইনার) কবিতাটা নিয়া একটা কন্ট্রোভার্সি হইসিল।

অমৃতা: হ্যাঁ, ওইটাও নিষিদ্ধ করা হয়। গুরু নানকের ৫০০তম জন্মদিনে কিছু লোক আমার কাছে আইসা কইলো গুরু নানকের উপর একটা এপিক লিখতে। আমি না কইরা দিলাম। আমি ঠিক করসিলাম আমি কখনো কারো কথায় কিছু লিখব না। আমি গুরু নানক নিয়া লিখব, কিন্তু সেইটা একেবারেই আমার নিজের ইচ্ছায়।

রমা: আমি জানতাম না যে আপনি এত ধার্মিক।

অমৃতা: আমি আসলে ধর্মের ঊর্ধ্বে, এইটা কইতে পারেন। কিন্তু আমি গুরু নানকরে নিয়া ‘নাউ সাপনে’ (নাইন ড্রিমস) নামে একটা কবিতা লিখসিলাম। এই লেখাটা বাংলা আর ইংলিশে তরজমার জন্য বাছাই করা হইসিল। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার এইটাই যে পাঞ্জাব সরকার আমার ‘চক নাম্বার ৩৬’টাও (অ্যা লাইন ইন দ্য ওয়াটার) ব্যান কইরা দিসে। তারা ভাবসে এইটা মনে হয় পর্নোগ্রাফিক।

রমা: এইটা হয়তো এই কারণে যে আপনি আপনার চলনে বলনে কোনোরকম ধর্মীয় সিম্বল রাখেন নাই।

অমৃতা: (হাসতে হাসতে কইলেন) হ্যাঁ, হইতে পারে আমার সিগারেট খাওয়া আর ছোট চুলের কারণে। কিন্তু মনের মধ্যে গুমরায়া উঠা কষ্টটা কি আর কেউ দেখে।

(অনেকবার নিষিদ্ধ হওয়ার পরও যার লেখাগুলা পাঞ্জাবের মান শতগুণ বাড়াইসে, সেই অমৃতা প্রীতম নিজেই নিজের লেখা পছন্দের কবিতা থিকা দুইটা লাইন আওড়াইলেন – যেন নিজেরেই পইড়া শুনাইলেন –

‘পারছাভান নু পাকড়ান ভালিয়ো
ছাতি ভিচ বালদি আগ দা পারছাভান নাহি হুন্দা।’

(‘যারা ছায়ার পিছনে ছুইটা বেড়ায়
এরা কেউ কি আর মনের ভিতরে দাউ দাউ করা—
ওই আগুনের ছায়াটারে ধরতে পারে!’)

অমৃতা প্রিতমের কবিতা পড়তে পারেন এই পোস্টে

The following two tabs change content below.
Avatar photo

অনিন্দিতা চৌধুরী

জন্ম ১৯৯৭ সালের ২রা মার্চ, সিলেটে। গদ্য-পদ্য দুইটাতেই নিজের মতো কইরা কলম চালায়া যাইতে ভালোবাসেন। অনুবাদ আর উর্দু সাহিত্যে বিশেষ আগ্রহ আছে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
জীবিকার জন্য একটা চাকরি করি। তবে পড়তে ও লেখতে ভালবাসি। স্পেশালি পাঠক আমি। যা লেখার ফেসবুকেই লেখি। গদ্যই প্রিয়। কিন্তু কোন এক ফাঁকে গত বছর একটা কবিতার বই বের হইছে।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →