Main menu

এডিটোরিয়াল: ‘উইন্টার ইজ কামিং’

একটা মাকড়শা তার বাচ্চাদের গুতা দিতেছে বারবার, বাচ্চাগুলার তুমুল খিদা, তবু শুরুতে মশকরাই ভাবলো বুঝি! কিন্তু মা মাকড়শা থামে না, আরো জোরে থাপ্পড় দিতে থাকে, ব্যথা পায় বাচ্চাগুলা–এমন চলতে চলতে বাচ্চাগুলার ভিতর কিলার ইন্সটিংকট জাইগা ওঠে, তারা শবাই তখন এক লগে ঝাপাইয়া পড়ে মায়ের উপর, মায়ের গতর ফুটা কইরা ঢুইকা জায় ভিতরে, বেশুমার ব্যথা লইয়া মরতে থাকে মা–ছুইছাইডেও ব্যথা তো লাগে… পালায় না, মারার চেশ্টাও করে না বাচ্চাদের, নিজেরে খাওয়াইয়া ফেলে পুরা… এই বাচ্চাদের পয়লা শিকার তাহাদের মা, শিকারের ছবক পাইলো এইভাবে, এখন থিকা পারবে নারাজ শিকার ধরতেও! মাকে খাইয়া ফেলা তাই জরুর দরকারি ছবক ঐ বাচ্চাগুলার।
মাকে খাইয়া ফেলার পরে ভরপেট বাচ্চাগুলার কেমন লাগতেছে? জানি না আমি 🙁 !

তবে জানি, মানুশের ইতিহাশে অমন ঘটনা ততো ঠিক না ঘটলেও কতগুলা ঘটনারে ঐভাবে কদ্দুর বুঝতে পারি হয়তো!

পুরাতনের লগে নতুনের একটা নেছেছারি জুদ্ধ হয় পেরায়ই, পুরাতন জদি খুব নাছোড় হয়, আকড়ে থাকতে চায়, পেরায়ই ভায়োলেন্স হয় তখন! বাদশাহি মছনদ লইয়া অমন কায়কারবার ইতিহাশে বেশুমার আছে। কিন্তু পুরাতন জদি ছাড়তে রাজি হয়, খুবই পিরিতির ভিতর দিয়া, পিছফুল দরদি তরিকায় ঘটনাগুলা ঘটতে পারে। ইতিহাশে ডেমোক্রেছি খুব শম্ভব এই অর্থে টেরান্জিশনকে পিছফুল করার একটা কায়দা।

তো, এই আলাপটা পাড়ছি দুয়েকদিনের ভিতর ঘটতে জাওয়া একটা জলশা/মশলিশের ব্যাপারে। ভাববৈঠকি-১৩ নামে ঐ মজলিশ বশবে ঢাকার পরিবাগে, শেইখানে ভাশার ব্যাপারে অনেক আলাপ হবে।

ইতিহাশের এমন একটা টাইমে এমন একটা মজলিশের জরুরত কেমনে ঘটলো, শেইটাই ভাবতেছিলাম এবং শেই ভাবনার শুরুতেই পেরায় বেহুদা ঐ কথাগুলা পেশ করলাম!

গত কয় বছরে বাংলা ভাশা লেখা এবং বুলিতে এমন একটা দশায় হাজির হইছে জেইখানে কোন বাংলাটা পুরাতন, কোন খোশাটা ছাইড়া বাইরায়া জাইতেছে শাপটা, শেইটা বেশ কিলিয়ার হইয়া উঠছে! ছোশাল মিডিয়া থিকা নাটক-ছিনামা-গান, এফএম রেডিও, তরজমা থিকা অরিজিনাল ফিকশন-কেচ্ছা-কাহিনি, ইতিহাশ-রাজনিতি-ভাবের আলাপ–শবখানেই বোরিং একটা পুরাতন বাংলার ছেন্স পয়দা হইছে, হালের জেনারেশন তাদের বলনে-লেখনে [এরা হয়তো ইংরাজি মিডিয়ামে পড়ে, তাই কেলাছিক বাংলা কেতাবের বদলে বাংলাটা শিখতেছে ডাইরেক শমাজ থিকা] একটা নয়া বাংলা পেশ করতেছে, জেইটা আশলে নয়া না, ডাইরেক শমাজ থিকা লওয়া, কলোনিয়াল কলিকাতার ছিলছিলার বাইরের একটা বাংলা, জেইটা রাধারমন-চন্ডিদাশ-হাছন রাজা-শা আবদুল করিম-মোমেনশাহি গিতের ভাব আর ভংগিমার কাছের একটা বাংলা!
এতে কেলাছিকের আরাম হারাম হইয়া গেছে, তারা নয়া বাংলার এই ফর্মেশনের দশার নাম দিছে এনার্কি! ঐ এনার্কি ঠেকাইতে আমাদের বাহানা পার্লামেন্টে আইন পাশ করার চেশ্টার কথাও শুনছি আমরা! Continue reading

দি ওভাল পোর্ট্রেইট – এডগার এলান পো

যে প্রাসাদটাতে আমার খানসামা প্রায় জোর কইরাই আমারে নিয়া ঢুকলো—আমার জখমি দশার কারণে খোলা বাতাসে থাকতে না দিয়া—সেইটা ছিল বিষাদ আর রাজকীয়তার এক মিশেল যা বহুকাল ধইরা অ্যাপেনাইন পাহাড়ের সামনে মাথা নিচু কইরা দাঁড়ায়ে আছে নির্ঘাত। চোখের দেখায় এইটারে দেইখা মনে হইতেসিল খুব অল্পদিন আগে এবং সাময়িকভাবে এই বাড়িটা কেউ ছাইড়া চইলা গেসে। সবচেয়ে ছোট ও কম আসবাবপত্রওয়ালা একটা ঘরে আমরা ঠাঁই নিলাম। দালানটার খুব চিপা এক গম্বুজের কাছে ছিল ঘরটা। ঘরটার সাজ-সজ্জা ছিল খুবই দামি, তবু মলিন আর বহু পুরানো। দেয়ালে ঝুলানো ছিল পরদা ও তাতে আঁকা ছিল বহু জমিদারি নিশানা ও অস্ত্র-বর্মওয়ালা পুরস্কার, তার সাথে ছিল একটু অস্বাভাবিকরকমের অনেকগুলা আধুনিক পেইন্টিং যার ফ্রেম ছিল দামি সোনালি আরবীয় নকশায় কাঁটা। এই ছবিগুলা কেবল দেয়াল থেকে সোজাসুজি ঝুলানো ছিল না, বরং বাড়িটার উদ্ভট নকশার কারণে আরো নানারকম পেরেকের মাধ্যমে ঝুলায়ে রাখা লাগসিল। এই ছবিগুলার দিকে তাকায়ে শুরুতেই আমি এমন এক ধন্ধে পইড়া গেলাম যে তাদের প্রতি আমার আগ্রহ বাইড়া গেল। তাই আমি পেদ্রোরে বললাম ঘরের ভারি ঝাপগুলা নামায়ে দিতে যেহেতু ততক্ষণে রাত হয়ে গেসে—আর আমার বিছানার মাথায় থাকা মোমবাতিটা জ্বালায়ে দিতে—আর তারপর বিছানা পর্যন্ত ছড়ায়ে থালা বিশাল কালো ঝালরওয়ালা পরদাগুলারে দুই পাশে টাইনা দিতে। এইসব আমি করাইলাম যাতে শান্তিতে বইসা, যদি ঘুমাইতে নাও পারি, যেন অন্তত ছবিগুলারে আরো গভীরভাবে খুটায়ে দেখতে পারি। বিছানার পাশেই একটা ছোট্ট বই পাওয়া গেল, যেইখানে ছবিগুলার ব্যাখ্যা দেয়া ছিল।

অনেক—অনেকক্ষণ ধইরা আমি পড়লাম—এবং মগ্ন, নিমগ্নভাবে আমি তাকায়ে থাকলাম ছবিগুলার দিকে। দ্রুত ও অসাধারণভাবে পার হয়ে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আর হাজির হইলো গভীর মধ্যরাত। এমন জায়গায় মোমবাতিদানিটা রাখা ছিল যে আমার বিরক্ত লাগতেসিল, তাই খানসামার ঘুম না ভাঙায়ে আমি নিজেই খানিকটা কসরত কইরা হাত বাড়াইলাম, আর এমনভাবে বসাইলাম যাতে বইটার উপর সরাসরি আলো পড়ে।

কিন্তু এর ফলে যা হইলো তা ছিল পুরাপুরি আন্দাজের বাইরে। এতগুলা মোমবাতির আলোয় (কেননা মোমবাতি ছিল অনেকগুলা) আমার চোখের সামনে ফুইটা উঠলো ঘরের এমন এক কোণ যা বিছানার এক পায়ার ছায়ায় এতক্ষণ ঢাকা পইড়া ছিল। সেই আলোয় আমি দেখতে পাইলাম একটা ছবি যা এর আগে আমার নজর এড়ায়ে গেসিল। চোখেমুখে সদ্য নারীত্ব ফুইটা ওঠা এক মেয়ের ছবি ছিল ওইটা। খুব তাড়াহুড়ায় একবার নজর ফেললাম ছবিটার উপর, তারপর চোখ বুইজা ফেললাম। এইটা আমি কেন করলাম তা প্রথমে আমি নিজেও বুইঝা উঠতে পারি নাই। চোখের পাতা এইরকম বোজা থাকতে থাকতেই আমি এমনটা করার কারণ ভাবতে থাকলাম। একটু ভাবার সময় বের করার জন্যই হুজুগে তা কইরা বসছিলাম আমি—নিশ্চিত হইতে যে আমার নজর আমারে ধোঁকা দেয় নাই—নিজের কল্পনায় লাগাম লাগায়ে শান্ত ও নিশ্চিতভাবে আরো একবার তাকানোর জন্য প্রস্তুত করতেসিলাম নিজেরে। আর কয়েক পলক পরেই আমি আরো স্থিরভাবে চোখ ফেললাম ছবিটায়। Continue reading

একটা নভেলের জন্ম একটা কবিতা দিয়া শুরু হয় – গুন্টার গ্রাস

This entry is part 27 of 28 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

এই ইন্টারভিউটা যখন আমি অনুবাদ করতে বসি তখন গুন্টার গ্রাস সম্বন্ধে আমার জ্ঞান বিসিএস প্রিলিমিনারি পর্যন্ত। দ্য টিন ড্রাম বইয়ের লেখক কে? গুন্টার গ্রাস। এরপর আর কোনো কিছু না জেনেই যখন বইটা পড়া শুরু করলাম, প্রথম চাপ্টারে পুলিশের ধাওয়া থেকে পালাইতে আর্সোনিস্ট কালিয়াইচেক যখন আনা ব্রনস্কির স্কার্টের নিচে আশ্রয় নিলো, তখন অদ্ভুত আনন্দে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, গ্রাস কি মার্কেজ পড়ে এ জিনিস লেখতে বসছিলো? প্যারাগ্রাফসম সেন্টেন্স, এবজার্ড হিউমার, ফুলানো ফাঁপানো লিরিকাল প্রোজ, সঙ্গে সকল ট্যাবুকে তাচ্ছিল্য করা একটা ইঁচড়ে পাকা হাসি। দ্য টিন ড্রাম পড়ে যে আমার মার্কেজের কথা মনে পড়ে গেছে তার কারণ ম্যাজিক রিয়ালিজম না। গ্রাসকে যে ‘ইউরোপিয়ান ম্যাজিক রিয়ালিজম’-এর এক প্রধান হোতা হিসাবে সাব্যস্ত করা হয় তা জানতে আমার আরো সময় লেগে গেছে। (বাই দ্য ওয়ে মার্কেজ মার্কেজ হওয়ার আগে গ্রাস গ্রাস হয়ে গেছেন। দ্য টিন ড্রাম এর প্রকাশকাল ১৯৫৯-এ, সলিটিউড ১৯৬৭-এ।) স্কার্টের নিচে ঢুকে পড়ার ঘটনাকে যে আমি ‘মার্কেজ’ বলে আইডেন্টিফাই করছি তার কারণ ছিলো একে অতীত বর্ণনার এক বিশেষ টেকনিক হিসাবে দেখা, যে টেকনিক অতীতকে মহিমান্বিতভাবে বর্ণনা করার যে চল আছে তাকে ইউনিকভাবে ডাইভার্ট করতে পারছে, যে ধরণের ন্যারেটিভ আমরা দেখতে পাই রুশদি ও বুলগাকভে।

এদের মধ্যে আমরা যা কমন পাই তা হলো, ‘অফিশিয়াল হিস্টোরি’ বা জনরা হিসাবেই ‘হিস্টোরি’র এক ধরণের প্যারোডি তৈরি করা, যেই প্যারোডি ইতিহাসের প্রচ্ছন্ন বিষয়গুলি নিয়া কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই কথা বলতে পারে। গ্রাস তার এই ইন্টারভিউতে জানাচ্ছেন, পোস্ট-ওয়ার জার্মান সোসাইটিতে নাৎসি পিরিয়ড নিয়া আলাপ করা এক ধরণের ট্যাবু ছিলো, যে ট্যাবু পরবর্তীতে নানা ধরণের ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিছে। (এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য ও সেগুলা যেধরণের একপাক্ষিক ও সীমিত এক্সপেরিয়েন্স অফার করে তার কথা চিন্তা করতে পারি।) যুদ্ধের পর গ্রুপ-৪৭ নামে রাইটার ক্রিটিকদের যে গ্রুপ তৈরি হয়, এবং গ্রাস যে গ্রুপের অংশ ছিলেন, তাদের প্রধান কাজ ছিলো এমন সাহিত্য ভাষা উদ্ভাবন করা যা ওই ট্যাবুকে ভাঙতে পারে। এভাবে চিন্তা করলে গ্রাসের সাহিত্যকে এক ধরণের ‘অথেনটিক এক্সপেরিয়েন্স’ বা ‘কলম তুলে নেওয়া’ ধরণের সাহিত্য হিসাবেও দেখা যাইতে পারে। গ্রাসের যাপিত জীবন রিডারকে সে ধরণের এক রিডিং-এ যাওয়ার দিকেই প্ররোচিত করে। ভার্সাই চুক্তির ক্ষত বহন করা জার্মানিতে বড় হওয়া, টিএনএইজ থাকতে নাৎসিদের প্রতি সমর্থন, জার্মান আর্মিতে সার্ভ করা, যুদ্ধের পর ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে স্কাল্পটিং ও পেইন্টিং শেখা, ষাটের দশকে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে ক্যাম্পেইন করা, এনভাইরনমেন্টাল ইস্যু নিয়া তার কর্নসার্ন, সত্তুর ও আশির দশকে ইন্ডিয়া ট্রাভেল, জার্মান রি-ইউনিফিকেশনের বিরোধিতা — এসব বায়োগ্রাফিকাল ডিটেইল তার কাজে কেবল পার্সোনাল ইন্টেগ্রিটি যুক্ত করে তা না, ব্যক্তিকে সমষ্টির সঙ্গেও একাকার করে দেয়। গ্রাসকে মার্কেজের সঙ্গে তুলনা করার আরেকটা সুবিধা হলো, শুধু সাহিত্যিক হিসাবেই না, যার যার জমিনে তারা যে কালচারাল আইকনে পরিণত হইছেন, তাও মাথায় রাখা।

কিন্তু কেবল বায়োগ্রাফি ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকান্ড নির্ভর ইন্টারপ্রিটেশন সমস্যাজনক হতে পারে। প্রথমত এইটা ইন্টারপ্রিটেশনের স্কোপকে কেবল একধরণের ‘বাস্তবিকতা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারে, দ্বিতীয়ত এরকম ইন্টারপ্রিটেশন গ্রাসের কাজকে তার রাজনৈতিক পজিশন, সোশাল এক্টিভিজম এবং তিনি যে পাবলিক পারসোনা তৈরি করছেন শুধু তার জাস্টিফিকেশনে ব্যবহার করতে পারে। এ ধরণের সীমাবদ্ধতা উতরানোর একটা উপায় হলো, আর্টকে সব কিছুর উপরে একটা ‘এস্থেটিক কনস্ট্রাক্ট’ হিসাবে দেখা। ইন্টারভিউতে গ্রাস তার এস্থেটিক কনসার্নের কথা নানান ভাবে জানান দিচ্ছেন। ফিকশনে ‘মিথ্যা’ বলার গুরুত্ব, তার প্রথম দিককার বইগুলাকে তার একটা বিশেষ ‘পলিটিকাল’ ফেইজের প্রোডাক্ট হিসাবে দেখা, ফিকশন-ননফিকশন ক্যাটাগরিগুলার সাথে তার সম্পর্ক, নভেলকে জনরা হিসাবে কিভাবে দেখেন, তার কোন কোন নভেলে ফরমাল ইনোভেশন আছে, কোনগুলা ফর্মের দিক দিয়া পিউর, ড্রয়িং কিভাবে তার রাইটিংকে সাপ্লিমেন্ট করে, প্রোজ কবিতা ও ড্রয়িং কিভাবে তার লেখায় সম-অধিকার পায় বা আদও পায় কী না, যে মিশ্র সময়কালকে উনি Vergegenkunft বলেন তা কিভাবে নতুন পার্সপেক্টিভ তৈরি করতেছে, এনথ্রোপসেন্ট্রিক ন্যারেটিভ থেকে বের হয়ে বইয়ের কেন্দ্রে প্রানীদের রাখা, কিংবা কোন জার্মান ট্র্যাডিশন ও অন্যান্য লিটারেরি সোর্স গ্রাসকে আকৃতি দিছে ইত্যাদি সব কিছুই এ ধরণের এস্থেটিক কনসার্নের বিষয়বস্তু। আল্টিমেটলি ইন্টারপ্রিটেশনের গুরুত্বটা এখানে সবার উপরে থাকতেছে টেক্সটের উপর। Continue reading

বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক

This entry is part 18 of 22 in the series লেখার ভাষা

[বাংলা একাডেমি’র ‘ভাষা, শ্রেণি ও সমাজ’ নামে একটা সেমিনারে প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ১৯৮৫ সালে এই কথাগুলা বলছিলেন। পরে ‘জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক স্মারক গ্রন্থ’ বইয়ে এইটা ছাপানো হইছে। তো, যে কোন ওরাল বলা-বাংলা যখন রিটেন ফরমেটে আসে তখন এক ধরনের ‘শুদ্ধিকরন’ বা ‘প্রমিতকর’ ঘটে নরমালি, যেহেতু নানান সো‍র্স থিকা আমরা জানি যে আবদুর রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা এতোটা ‘শুদ্ধ’ আছিল না, এইখানেও এই জিনিস ঘটার কথা বইলা সনদেহ করতে পারি আমরা…]

সভাপতি সাহেব এবং বন্ধুবর্গ,

আমাকে বসে বলার অনুমতি দেওয়ায় আমি নিতান্ত অনুগৃহীত। প্রধান অতিথি করার জন্য নয়, প্রধান অতিথি করা তো এখন রেওয়াজ হয়ে গেছে, কী কারণে করা হয় জানি না। ভাষা, শ্রেণি এবং সমাজ কোনোটা সম্বন্ধেই আমার এমন কিছু বলার নেই যা সভা করে বলা প্রয়োজন। দুটো-একটা নিতান্ত সাধারণ কথা ছাড়া আর কিছুই বলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

ভাষা সবচেয়ে পুরনো, সাহিত্য কিংবা ব্যাকরণের সঙ্গে তুলনা করলে। দ্বিতীয়ত, ভাষা একেবারেই সর্বজনীন, ক্ষুদ্রতম মানুষও এই ভাষার পরিপুষ্টিতে অংশীদার। সাহিত্য, ব্যাকরণ তো নয়ই, দুটোর একটাও এই ধরনের কিছু না। সাহিত্য সব সময়ই, একেবারে আরম্ভের যুগে, পুরোহিতদের কাজ ছিল এবং পরেও নিতান্তই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে গড়ে উঠেছে, লোকসাহিত্যের কথা স্মরণ রাখলেও। এই যে মুষ্টিমেয় লোকসংখ্যা, যাঁরা সাহিত্য কিংবা ব্যাকরণ রচনা করেছেন এঁদের প্রথম কন্ডিশন ছিল কিছু পরিশ্রম না করে জীবনধারণের ক্ষমতা থাকা অর্থাৎ বদরুদ্দীন উমর কিংবা মার্কসিস্টরা যাকে বলবেন এক্সপ্লয়টিং ক্লাস। মার্কস কিংবা লেনিন প্রোলেটারিয়েট ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের অবদান প্রোলেটারিয়েট মুভমেন্টে অবিসংবাদিত। সাহিত্যেও অনেক সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন, যাঁরা সমস্ত মানুষের কথাই বলেছেন। কিন্তু সব সময়ই তাঁরা একটা ছোট শ্রেণি থেকে এসেছেন।

ভাষা সম্বন্ধে কৌতূহল, সাহিত্য অনেক পরে আসা সত্ত্বেও, সাহিত্য সম্বন্ধে কৌতূহলের অনেক পরে এসেছে দেড়শো দুশো বছর হবে। অনেক আগে গ্রিক আমলে হয়তো সামান্য কিছু লেখাপড়া হয়েছে ভাষা সম্বন্ধে, সংস্কৃতেও কিছু হয়েছে। কিন্তু মোটের ওপর গত দেড় হাজার বছর পর্যন্ত সাহিত্য সম্বন্ধে যতটা কৌতূহল দেখা গেছে ভাষা সম্বন্ধে তার একশ ভাগের এক ভাগও হয়নি। এখনো আমরা ভাষা সম্বন্ধে যা জানি তা খুব বেশি কিছু না। ভাষা কীভাবে উদ্ভূত হয়, ভাষা কীভাবে বর্ধিত হয় কিংবা ভাষার অন্যান্য বিশিষ্টতা এ সম্বন্ধে একেবারেই প্রাথমিক যুগে। কিন্তু ভাষা সম্বন্ধে কৌতূহলের দুটো যে দিক, পণ্ডিতি কৌতূহল – যেগুলো ব্যাকরণবিদ কিংবা সুনীতিবাবু কিংবা ড. শহীদুল্লাহ্ কিংবা চমস্কিদের। এছাড়াও আরেকটা কৌতূহলের কারণ আছে – সেটা আমি শিক্ষা-বিভাগের সঙ্গে জড়িত থাকায় আমার কৌতূহলটি। পঞ্চাশ বছর শিক্ষকতার ফল-জ্ঞানে এই একটিমাত্র নিশ্চিত যে, মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া শিক্ষা-ব্যবস্থা কখনোই পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষত আমাদের দেশে।

আমাদের দেশে সাধারণত ইংরেজি ভাষা শেখার জন্য চৌদ্দ, পনের, ষোল অথবা বছর কুড়ি নিই। দুনিয়ার কোনো দেশে বিদেশি ভাষা শেখার জন্য এবং এইরকম ইনকমপ্লিটেন্ট নলেজ একোয়ার করার জন্য এত সময় দেওয়া হয় না। পনের বা বিশ বছর পরেও যে ইংরেজি আমাদের শেখা হয় যেসব দেশে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলে সেসব দেশে গেলে বোঝা যায় যে এই শেখাটা কত অসম্পূর্ণ। এই অসম্পূর্ণ জ্ঞানের ভিত্তিতে শিক্ষক এবং ছাত্র মিলে যে অবস্থার সৃষ্টি করেন এটা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উল্লেখ্য নয়। শুধু এইমাত্র কারণে আমি মনে করি যে, বাংলা ভাষা ছাড়া, মাতৃভাষা ছাড়া, শিক্ষার বাহন আর কিছুই হতে পারে না। Continue reading

ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

[৩১/১২/১৯৪৮ সালে পূব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন, ঢাকা অধিবেশনে মূল সভাপতির ভাষনের সিলেক্টেড অংশ।]

স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বাধীন নাগরিক রূপে আজ আমাদের প্রয়োজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্যে আমরা আজাদ পাক-নাগরিক গঠনের উপযুক্ত প্রয়োজনীয় বিষয়ের অনুশীলন চাই। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি জাতীয় সাহিতা ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা ক’রে যশস্বী হতে পারে নি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার দিকেই পারস্য আরব কর্ত্তৃক বিজিত হয়েছিল, পারস্য আরবের ধর্ম্ম নিয়েছিল, আরবী সাহিত্যেরও চর্চা ক’রেছিল। কিন্তু তাঁর নিজের সাহিত্য ছাড়ে নি। তাই রুদাগী, ফিরদৌসী, নিযামী, সাদী, হাবিব, উর্ফি, খাকানী, বুআলী সীনা, গাযালী, খ’য়্যাম প্রমুখ কবি, ভাবুক, সুফী ও দার্শনিক লেখকগণের রচনায় পারস্য সাহিতা গৌরব-সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের চর্চ্চা আমাদের মধ্যে আজ নুতন নয়। বাংলা দেশ যখন দিল্লীর অধীনতা-নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে গৌড়ে এক স্বাধীন সুলতানত প্রতিষ্ঠা করে, তখন থেকেই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনোযোগ পড়ে। ইউসুফ শাহ, হোসেন শাহ, নসরত শাহ্, ফীরোয শাহ, নিযাম শাহ শুর, ছুটীখাঁ, পরাগল খাঁ প্রভৃতি রাজা ও রাজপুরুষগণ বাংলা সাহিত্যের উৎসাহদাতা ছিলেন। হিন্দু কবিবা মুক্তকণ্ঠে তাঁদের যশ কীর্ত্তন ক’রে গেছেন। কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এক গৌড়েশ্বর। তাঁর প্রশংসায় কবি বলেছেন-

“পঞ্চ গৌড় চাপিয়া গৌড়েশ্বর রাজা।
গৌড়েশ্বর পুজা কৈলে গুণের হয় পূজা।”

এই গৌড়েশ্বর খুব সম্ভবতঃ রাজা গণেশ নন। কিন্তু তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্‌। রাজা গণেশের রাজত্বকাল অল্প এবং অশান্তিপূর্ণ ছিল। আমরা তাকে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকরূপে কোথাও দেখি না। অন্যপক্ষে জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্‌, দীর্ঘকাল শান্তিতে রাজত্ব করেন (১৪১৯-১৪৩১ খ্রীঃ)। তিনি ভরত মল্লিককে নানা উপহার সহ বৃহস্পতি ও রায়মুকুট এই দুই উপাধি দিয়েছিলেন। কৃত্তিবাস স্বধৰ্ম্মত্যাগী ব’লে বোধ হয় এই গৌড়েশ্বরের নাম উল্লেখ করেন নি।

কবীন্দ্র পরমেশ্বর সুলতান খালাউদ্দীন হোসেন শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কলিযুগ অবতার গুণের আধার
পৃথিবী ভরিয়া যার যশের বিস্তার।
সুলতান আলাউদ্দিন প্রভু গৌড়েশ্বর
এ তিন ভুবনে যাঁর যশের প্রসার।”

শ্রীকর নন্দী নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“নসরত শাহ, নামে তথি অধিরাজ।
রাম সম প্রজ্য পালে করে রাজ-কাজ।”

কবি শেখর এই নসরত শাহের প্রশংসায় বলেছেন-

“কবিশেখর ভণ অপরূপ রূপ দেখি
রায় নসরত শাহ, ভঙ্গলি কমলমুখী।”

(মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান হিন্দু অপেক্ষা কম নয়।) পল্লীগীতিকায় মুসলমানের দান অতি মহৎ। কলিকাতা বিশ্ববিজ্ঞালয়ের অর্থ-সাহায্যে জেঠসহোদরকল্প পরলোকগত দীনেশচন্দ্র সেনের আগ্রহে ও উৎসাহে যে গাথাগুলি সংগৃহীত হয়েছে, তা ছাড়া আরও বহু পল্লী-কবিতা পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববঙ্গের সরকার কি এদিকে মনোযোগ দিবেন? এই পল্লীকাব্য সম্বন্ধে দীনেশবাবু বলেছেন “এই বিরাট সাহিত্যের সূচনা আমি যেদিন পাইয়াছিলাম, সেদিন আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। আমি সেদিন দেশ-মাতৃকার মোহিনীমূর্ত্তি দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলাম, আমাদের বাংলা ভাষার শক্তি ও প্রসার দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিলাম এবং হিন্দু ও মুসলমানের যে যুগলরূপ দেখিয়াছিলাম – তাহাতে চক্ষু জুড়াইয়া গিয়াছিল।” এ পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যলয় ৪৫টি পল্লীগাথা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে ২৩টি মুসলমান কবির রচিত। Continue reading

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →