[পাকিসতান আমলে দুইটা ফ্রি-ফেয়ার ইলেকশন হইছিল, একটা ১৯৫৪ সালে, এবং আরেকটা ১৯৭০ সালে। ১৯৫৪ সালের ইলেকশনে খেলাফতে রাব্বানী পার্টি থিকা ইলেকশন করছিলেন গল্পকার শাহেদ আলী।
খেলাফতে রব্বানী পার্টির মেইন লিডার ছিলেন আবুল হাশিম (ব্রিটিশ আমলে যিনি মুসলিম লিগের সভাপতি ছিলেন, বাংলা-প্রদেশের)। মুসলিম লিগ থিকা বাইর হয়া আইসা এই দল বানাইছিলেন উনি, এবং উনি ছিলেন মুসলিম-লিগ বিরোধি যুক্তফ্রন্ট তৈরি করার একজন কারিগর, থিওরেটিকালি এবং পলিটিকালি; কিনতু শেষে তাদেরকেই যুক্তফ্রন্টে রাখা হয় নাই। ১০টা সিটে রব্বানী পার্টি ইলেকশন করছিল, শাহেদ আলী ছিলেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের কেনডিটেট।
উনার ইলেকশন করার কাহিনি উনার মুখেই শুনেন। উনার “জীবন কথা” বই থিকা নেয়া হইছে নিচের কথাগুলা।]
১৯৫৩ সাল। আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করছি। একবার ছুটিতে ঢাকায় এসেছি। তখন নির্বাচনের খুব তোড়জোড় চলছে। আল্লামা আবুল হাশিম সারা পূর্ব পাকিস্তান ট্যুর করেন। সে-সময় মোমেনশাহীতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমমনা বিরোধী দলগুলো যুক্তফ্রন্ট গঠনের ডাক দেয়। মুহূর্তে রাজনীতির অঙ্গনে এক প্রচণ্ড চাঞ্চল্যকর অবস্থা শুরু হয়ে গেল। আমি রব্বানী পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, যার প্রেসিডিয়ামের সদস্য ছিলেন জনাব আবুল হাশিম। (রব্বানী পার্টি: খেলাফতে রব্বানী পার্টি, প্রতিষ্ঠাকাল: সেপ্টেম্বর ১৯৫৩।) তাঁর সঙ্গে দেখা করলে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি রংপুর যাবার সময় আমার একটা চিঠি নিয়ে যেয়ো। ওখানে আমার ঘনিষ্ঠ একজন নামকরা উকিল আছে। আবু হোসেন সরকার। আমাদের আন্দোলনের জন্য তাঁকে আমাদের একান্ত দরকার। তাঁকে বুঝিয়ে বলবে, উত্তরবঙ্গে তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে না। শেরেবাংলারও একই কথা।’
আমি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ফিরে পরদিন সকালে জনাব আবু হোসেন সরকারের সঙ্গে দেখা করি। দীর্ঘদেহী জনাব আবু হোসেন সরকার। তাঁর গোলাকৃতি মস্ত বড়ো মাথায় ঘন কাঁচাপাকা চুল। দাড়ি-গোঁফ কামানো মজবুত স্বাস্থ্য।
সরকার সাহেব আমাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে নম্রকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার পরিচয়? কোনো কেস আছে?’
আমি আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, ‘আমি কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক। আমি জনাব আবুল হাশিমের একটা চিঠি এবং শেরেবাংলার একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।’ এ-কথা বলার পর আমি আবুল হাশিমের চিঠিখানা সরকার সাহেবের অনিচ্ছুক হাতে তুলে দিলাম। তিনি চিঠি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আবুল হাশিম এবং শেরেবাংলাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন, তাঁরা আমাকে স্মরণ করেছেন বলে। এককালে রাজনীতি করলেও আমি এখন আর রাজনীতি করি না। আমি দুঃখিত।’
আমি সরকার সাহেবের এই নিরুত্তাপ সংক্ষিপ্ত জবাবে হতাশ হয়ে পড়লাম। সরকার সাহেব বললেন, ‘আসুন, বসুন, চা খান। আপনি কেবল শিক্ষকতাই করেন, না রাজনীতিও করেন?’
বললাম, ‘এখন পর্যন্ত অধ্যাপনাতেই আছি। আর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে পারি না। আমরা আপনাকে মুসলিম লীগ শাহির বিরুদ্ধে এই সংগ্রামে সামনের সারিতে পেতে চাই।’ আমি ও সরকার সাহেব মুখোমুখি বসলাম। তিনি বললেন, ‘দেখুন, বয়স হয়েছে, জীবনে অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, জেলও কেটেছি। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। ওকালতি করে দুটো পয়সা আয় করি। আমাকে রোজ পঞ্চাশটি মুখে ভাত তুলে দিতে হয়। সুতরাং রাজনীতি করা আমার আর সাজে না।’
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, ‘আপনার মুখে এ-কথা শুনব, আশা করিনি। আপনার পরিবারকে আপনি পঞ্চাশ জনের একটি পরিবার মনে কেন করছেন? দেশবাসী মনে করে পাঁচ কোটি মানুষ নিয়ে আপনার পরিবার। এই পাঁচ কোটি মানুষের মুখে আপনি ভাত তুলে দেবেন। আপনার কাছে এই তো দেশবাসীর ঢাবি।’
এবার সরকার সাহেবের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠল। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমাকে কিছু ভাবতে দিন। আমি কিছু দিনের মধ্যেই ঢাকা যাচ্ছি। তখন আমি শেরেবাংলা ও হাশিম সাহেবের সঙ্গে আলাপ করব।’ কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তফ্রন্ট গড়ে উঠল। আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে। জনাব আবুল হাশিম সাহেব দাবি করলেন, কেবল সমমনা ইসলামবিশ্বাসী দলগুলো নিয়েই যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে। কিন্তু বামপন্থিরা দাবি করল তাদেরও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। শেষ পর্যন্ত খেলাফতে রব্বানী পার্টিকে বাইরে রেখেই শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হলো যুক্তফ্রন্ট। খেলাফতে রব্বানী পার্টি দাবি করেছিল দশটি আসন, যেসব আসনে যুক্তফ্রন্ট নমিনি দেবে না। অন্যসব আসনে রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্ট নমিনিদের পক্ষে কাজ করবে। সেই দাবিও গৃহীত হলো না। খেলাফতে রব্বানী পার্টি বাধ্য হয়ে দশটি আসনে তাদের নিজস্ব নমিনির নাম ঘোষণা করে।
আমি তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। আমার কাছে টেলিগ্রাম গেল। আমাকে আমার জেলা সিলেটের ১ নম্বর আসনে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ নিয়ে গঠিত ছিল এই বিশাল নির্বাচনী এলাকা। নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সময় প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সময়ে আমার ওপর এই নির্দেশ আমার কাছে বজ্রপাতের মতো মনে হলো। আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে ১৯৫১ সালে। এর পর থেকে আমি প্রথমে বগুড়া কলেজে ও পরে কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেছি। আমার নির্বাচনী এলাকায় বলতে গেলে আমাকে কেউ চেনে না। আমিও সুনামগঞ্জের দু-একজন লোক ছাড়া আর কাউকে চিনি না। আমার নির্বাচনী এলাকায় তাদের কোনো পরিচিতিও নেই।
সুনামগঞ্জের একজন জাঁদরেল সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী, যিনি সাবেক আসামের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য ছিলেন এককালে, এখন পেয়েছেন যুক্তফ্রন্টের টিকিট। প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির সিটিং সদস্য জনাব আবদুল খালেক আহমেদ পেয়েছেন মুসলিম লীগের টিকিট। দুজনেই এলাকায় সুপরিচিত। এই এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা তাঁদের সমর্থক ও কর্মী। এই অবস্থায় আমি আমার নমিনেশন নিয়ে মহাসংকটে পড়লাম। এলাকার প্রভাবশালী লোকেরা আমাকে চেনে না। কারণ আমার জীবন কেটেছে বাইরে-বাইরে। ১৯৪৭-এর নির্বাচনে এবং রেফারেন্ডামের সময়ে আমি এলাকায় কাজ করেছি। রেফারেন্ডামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, জিন্নাত আলী প্রমুখ আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। কিন্তু নির্বাচন এবং রেফারেন্ডামের পরে আমি এলাকা ছেড়ে চলে আসি। এলাকার কোনো লোকের সঙ্গেই আমার দৃঢ় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে কে আমার পক্ষে কাজ করবে? কেন্দ্রেও আমার কোনো লোকজন নেই যে ওখানে গিয়ে তারা কাজ করবে। এলাকায় কেবল একজন লোক আছে, নাম হাফেজ আবদুর রহিম। তাকে কোথায় পাব? কী করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করব? আমার শ্বশুর সাহেব ঢাকায় থাকেন, আমার স্ত্রীও ঢাকায় থাকেন। আমি এ-ব্যাপারে তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি।
অধ্যাপক গোলাম আযম ও কবি মোফাখখারুল ইসলাম কারমাইকেল কলেজে ছিলেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সোজা সুনামগঞ্জ রওয়ানা হলাম। সোজা মানে-ট্রেনে রংপুর থেকে গাইবান্ধা হয়ে বাহাদুরাবাদ ফেরি পার হয়ে ময়মনসিংহ; ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে আখাউড়া, সেখান থেকে ট্রেনে সিলেট, সিলেট থেকে বাসে চড়ে সুনামগঞ্জ। এই পথ পাড়ি দিতে তখন বিরাট-বিরাট ফেরিঘাট ছিল অনেকগুলো। এভাবে কোনোমতে গিয়ে সুনামগঞ্জ গিয়ে পৌঁছলাম। রাত পোহালে একটিমাত্র দিন থাকবে নমিনেশন সাবমিট করার। তার মানে এক দিনে আমার নমিনেশন সাবমিট করতে হবে। ভেবেচিন্তে সুনামগঞ্জের মাহবুব ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তাঁর আসল নাম মির্জা গোলাম সামদানী। শুনলাম, কেবল আমার এলাকারই রেজিস্টার্ড ভোটারই নমিনেশন পেপারে প্রস্তাবক এবং সমর্থক হতে পারে। কিন্তু সুনামগঞ্জ শহরে আমি কোথায় পাব আমার এলাকার ভোটার? সুনামগঞ্জ থেকে তাহেরপুর এবং ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ এখান থেকে অনেক দূর। এলাকায় যাওয়া-আসা করতে হয় নদীপথে নৌকা করে। তখন ইঞ্জিনবোট বলতে কিছুই ছিল না। তাহিরপুরের একজন লোক আমার পরিচিত। প্রভাবশালী একজন লোক। সম্ভবত সেকান্দার আলী ছিল তার নাম। তাঁকে বললাম, ‘আপনি আমার একটা নমিনেশন পেপারে প্রপোজার হন।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি আবদুল খালেক সাহবেকে কথা দিয়ে ফেলেছি তাঁর প্রপোজার হব। আমি দুঃখিত।’
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আগামী কালের মধ্যে নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। ভাবলাম, গয়নাঘাটে গিয়ে দেখি, যে-সময় নৌকা ছাড়বে সে-সময় আমাদের এলাকার কোনো লোক পাই কি না। গয়নাঘাটে গিয়ে পেলাম লক্ষ্মীছড়ির হোসেন বখতকে। হোসেন বখত রাজনৈতিক কর্মী। গণতন্ত্রী দলের ওয়ার্কার। আমার পেরেশানি দেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার প্রফেসর সাব, এত চিন্তিত কেন? কাউকে খুঁজছেন?’
আমি তাঁকে খুব সংক্ষেপে আমার অবস্থাটা বুঝিয়ে বললাম। শুনে তাঁর কিছুটা সহানুভূতি হলো। একটা নৌকা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই নৌকায় আপনার এলাকার একজন কর্মীলোক যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ আগেই নৌকায় তাঁর বিছানা তোলা হয়েছে। একটু অপেক্ষা করুন, এক্ষুনি ওই লোক এসে পড়বে।’ সূর্য ডোবার আগেই সেই লোক এসে হাজির গয়নার ঘাটে। হোসেন বখত বললেন, ‘একে চেনেন? আপনার এলাকার লোক, অধ্যাপক শাহেদ আলী। নির্বাচনের জন্য আপনাদের এলাকায় নমিনেশন পেয়েছেন। কালকের মধ্যেই নমিনেশন পেপার সাবমিট করতে হবে। তার জন্য দরকার আপনার এলাকার ভোটার, যারা প্রপোজ করবে এবং সাপোর্ট করবে। দেখেন আপনি কিছু করতে পারেন কি না।’
সেই লোক একজন তরুণ দীর্ঘদেহী দৃঢ় অভিব্যক্তির মানুষ, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। তিনি বললেন, ‘আমি একজন প্রপোজার হতেই পারি, কিন্তু আরেকজন কোথায় পাব?’ এরপর একটু চুপ করে থেকে কপালে আঙুলের টোকা দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমাদের এলাকার কয়েকটি যুবক এখানে একটা ট্রেনিঙে এসেছে। ওরা প্রত্যেকেই ভোটার। দেখি এদের নিয়ে আসতে পারি কি না।’ তিনি আমার ঠিকানা জেনে নিলেন এবং সন্ধ্যার পরই চার জন যুবককে নিয়ে হাজির হলেন। এভাবে নমিনেশন পেপার সাবমিট করার সংকট থেকে পরিত্রাণ পেলাম। আমি তখন সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেছিলাম আল্লাহর ওপর। বুঝতে পারলাম, তাঁর ইচ্ছেতেই সকল জটিলতার গিটগুলো খুলে যাচ্ছে। Continue reading →