শৈত্যস্বর
[pullquote][AWD_comments][/pullquote] বর্তমান নাগরিক-আন্দোলনের সময়ে নগরে বইসা যে মফস্বলরে কল্পনা করা যায়, মফস্বলের সেই নগর-কল্পনার একটা উদাহারণ হিসাবে তানিম কবির-এর এই গল্প পড়া যাইতে পারে (এবং অবশ্যই আরো অন্যান্যভাবে)।
______________________________________
বছর দুই আগে ট্রাংক রোডে উত্তমের দোকানে, সন্ধ্যাবেলার ওই ছাতিম গাছটার নিচে বইসা যেরকম লাগতো, পৃথিবীতে আবার সেরকম লাগা শুরু হইছে আমার। এরকম লাগতে থাকার সমস্যাগুলারে ব্যাখ্যা করা মুশকিল, তারচেয়েও বেশি মুশকিল এই লাগতে থাকারে ঝাইড়া ফেলা। বড় ধরনের একটা ঝাঁকি খাওয়া ছাড়া লাগতে থাকাটা কেমন লাইগাই থাকে গায়ে। গায়েরে আর গা বইলা চিনা যায় না তখন, ভাবনাগুলার থেকে, চিন্তাগুলার থেকে সে তখন আলাদা আরেক নড়নচড়নে শিথিল হইয়া থাকে সারাক্ষণ। কেন এরকমের হইতেই থাকে দুয়েক বছরান্তরে, বুঝতে পাই না। শুধু টের পাই যে, বিকাল হইতেছে, আর তেরছা রোদের এক পৃথিবীতে আমার আবার সেরকম লাগতেছে।
তখন সবুজ প্রেসের মেশিন ঘরে গিয়া বসতাম, বিকট শব্দে নেতাকর্মীদের পোস্টার আর মিষ্টির প্যাকেটের লেভেল ছাপা হইতো সেখানে। সাধনদা খুব ব্যস্ত থাকতো মেশিন রুমে, একটাই দৃশ্যে তারে এতবার দেখছি জীবনে যে, পৃথিবীতে আর কোনো দৃশ্যে তারে খাপ খাওয়াইতে পারি নাই। উপরতলার পেস্টিং রুম থেকে প্রস্তুতকৃত নতুন কিছু প্লেট নিয়া সাধনদা নিচে নাইমা আসতেছে, দৃশ্যটা ছিল এই। আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের ওই মেশিন রুমটায় তারে ঘাড় গুঁজা কইরা ঢুকতে হইতো, আর ঢুইকাই ঘাড় ঝাড়া দিয়া বইলা উঠতো, ওমা! আপনে কতক্ষণ? আমি যতক্ষণ, ঠিক ততক্ষণের কাছাকাছি একটা সময় তারে বলতাম। আর সে তখন ফিরিস্তি দিত, কেন কী কারণে তারে এতক্ষণ পেস্টিং রুমে আটকাইয়া থাকতে হইছিল। যারফলে আমারে এই একলা একলা বইসা থাকতে হইলো। প্রায়ই দেখা যাইতো কালাচান মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, কিংবা ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন, কিংবা সাপ্তাহিক আলোকধারাই আমার ওইসব সঙ্গহীন মুহূর্তের জন্য দায়ী হইয়া অপরাধীর ভঙ্গিতে ছাপায় উঠতেছে।
কম পাথরের রেললাইনে ৫০ কিলোমিটার স্পিডে চলতে থাকা কোনো মেইল ট্রেনের শব্দে ওই মেশিনটা আবার ঘুরতে শুরু করলে আমার ওইধরনের লাগাটা একটু কইমা আসতো। ফোর কালারের ওইসব ছাপায় চাইরটা প্লেট বদলাইতে হইতো, আর তখন কিছুক্ষণের জন্য থাইমা থাকতো মেশিনটা। ওই থাইমা থাকারে মনে হইতো যাত্রাবিরতি, যেন কোনো অল্পব্যস্ত স্টেশনে আইসা ট্রেনটা থামলো আর ট্রেনের জানালা দিয়া মাথা বাইর কইরা সাধনদা দুইটা সিদ্ধ ডিম কিন্যা একটা আমার হাতে ধরাইয়া দিলো। যেন আমরা ডিম খাইয়া শেষ করার আগেই ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করতো। আর সাধনদা কীসব যেন বলতে থাকতো, ট্রেনের শব্দে সেসবের কিছু বুঝতে পাইতাম না জন্য তার প্রতিটা অভিব্যক্তিতে ফাঁকা সমর্থন দিয়া যাইতাম। আর ছাপার মেশিনে প্লেট বদলের সময় গল্পের পুরাই অপ্রাসঙ্গিক কোনো মধ্যবর্তী অংশে আইসা হাবুডুবু খাইতাম, দেখা যাইতো তার গল্পের চরিত্ররা এমন একটা অবস্থায় আইসা ঠেকছে যে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করার জন্য সে তখন আমার কাছে পরামর্শ চাইতেছে ‘এখন কি পার্টিটা ধরমু, নাকি না?’ আমার পৃথিবীটা তখন থমকাইয়া যাইতো, বুঝতাম না ঠিক কী বলা উচিৎ, যেখানে আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতেছে একটা পার্টির ভবিষ্যত!
লম্বা হুইসেল দিয়া ট্রেনটা আবার চলতে শুরু করলে স্বস্তি হইতো, কেউই আর কারো কথা শুনতে পাইতাম না তখন, হাত নাইড়া নাইড়া চোখ ছোট বড় কইরা ফাঁকা এক্সপ্রেশান দিতাম আর ফাঁকা এক্সপ্রেশানগুলা থেকেই সাধনদা তার সিদ্ধান্তগুলা নিতো। আমিও তার সাথে অনেক কিছু শেয়ার করতাম, জানি সেও সেসবের কিছুই শুনতে পাইতো না। তবু তার বহু বিব্রত মতামত আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্তের সহায়ক হইয়া ছিল। সেসব তো বছর দুই আগের কথা, তখনো পৈতৃক জেলা শহরে থাকি। হাতের কাছেই তবু সবুজ প্রেস, আর ম্যানেজার সাধন দাশ আমার বন্ধু।
কিন্তু এখন তো ঢাকায় আইসা পড়ছি, প্রেসের চাকরি ছাইড়া সাধনদাও চইলা গেছে দুবাই। এরমধ্যেই কি না আবার সেইরকম লাগতে শুরু করলো আমার! বিশেষত আজকে সন্ধ্যায় যখন একলা একলা বইসা ছিলাম ছবির হাটে, দুলাল ভাইয়ের চায়ের দোকানে, তখন মনে হইলো একটা কাঁটাচামচ বাঁকাইয়া দেওয়া দরকার। কিংবা খানিকটা দূর থেকে দৌড়াইয়া গিয়া পেপসির একটা খালি ক্যানে সজোর আঘাত করা বড় প্রয়োজন। পুরানা পল্টনের প্রেস পাড়ায় যাবো কি না ভাবতেছিলাম আমি, তখন মিতু আইসা বসলো পাশে। বললো, মোটা হইয়া যাইতেছি, ডায়েট করা দরকার। সেও নাকি করছে। আর বললো জাতিসংঘের সাথে কম্প্রোমাইজ করা চলে, কিন্তু লোকাল প্রোডাকশন হাউজগুলার সাথে কিছুতেই না। আমিও মাইনা নিলাম, যেহেতু যুক্তি ছিল কথায়, আর মার্জিত সাজগোজে ওরে খুব সুন্দর লাগতেছিল।
বইসা বইসা বোরড হওয়ার চাইতে আমরা বরং হাঁটতে নিছিলাম। মিতুরে অনেক নারী নারী লাগে এমনিতেই, আর আমারে আরেকটু আস্তে হাঁটার রিক্যুয়েস্ট কইরা সে যখন বললো তার নারীত্বজনিত সমস্যা চলতেছে, তখন মনে হইলো আমার চলতে থাকা সমস্যার কথাও তারে বইলা ফেলা যায়। অবশ্য আমারটা দ্বিবাৎসরিক! তবু বলতে শুরু কইরা টের পাইতেছিলাম হাত নাইড়া নাইড়া আমি কেবল চোখই ছোটবড় কইরা যাইতেছি, স্বরশূন্য এক আলাপের ভঙ্গি আমার গায়ের উপর দিয়া দৌড়াইতেছে। মিতু কি একটু ঘাবড়াইয়া যায় এ দৌড়াদৌড়ি দেইখা? আমারে ধাক্কা দিয়া কয়, আরে আপনার কী হইছে! যত যা হইছে, বুঝি যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরেই হইছে কিংবা হইতেছিল। আর আমি কাঁপানো হাতে গলা টিইপা ধইরা তারে কামড়াইতে উদ্যত হই, বাট সে ঠোঁট আগাইয়া দিয়া চুমু দিতে নাকি নিতে শুরু করলে সবুজ প্রেসের মেশিনটা সশব্দে ঘুরতে থাকে আবার। মিতু কি কালাচানের মিষ্টি খান, কিংবা কি আপনি আর্টিক্যাল লেখেন সাপ্তাহিক আলোকধারায়, নাকি আপনি ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচন করেন? ওই যে বললাম একটাই দৃশ্যে জীবনে এতবার দেখছি তারে যে, আর কোনো দৃশ্যে খাপ খাওয়াইতে পারি নাই। ঘাড় গুঁজা কইরা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরের মেশিনরুমে নাইমা আসতেছে সাধনদা, দৃশ্যটা ছিল এই। কিন্তু তার ঘাড় এত ফর্সা ছিল কি? আমি ঘাড় মটকাইতে উদ্যত হই, আর মিতু ঠোঁট বাড়াইয়া সাধনদারে সেফ করতে থাকে।
পরে চা খাইতে খাইতে আমরা গিয়া ছাতিম গাছের নিচে দাঁড়াই, জাতিসংঘের নিকট কী চাইতেছিলাম আমরা? আমি শান্তি মিশন, আর মিতু চাইতেছিল যোগ্য কম্প্রোমাইজ। তীব্র সমস্যার মধ্যে এখন বৃষ্টি নাইমা আসলে, আমরা কি ভিজবো নাকি পালাইয়া যাবো? আকাশের বিদ্যুৎ চমকাইয়া চায়ের কাপে নাইমা আসে, লোকেরা সব দৌড়াইতেছেন নিরাপত্তা অভিমুখে। এক দঙ্গল দৌড়ের ভিতর থেকে মিতুর প্রেমিক বাইর হইয়া আইসা তারে ছিনাইয়া নিয়া যাওয়ার পরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়। চায়ের বিল দিয়া ভিজতে ভিজতে রিকশায় উইঠা, আর ভিজতে ভিজতেই বাসায় ফিরা আসতে আসতে শেষে কমলাপুর স্টেশনে ঢুইকা পড়তেছিলাম আমি। কোথাও যাইতে চাইতেছিলাম হয়তো, ত্রিশালে? কনকশ্রী, নাকি ভৈরব? ট্রেন চলতে শুরু করলে প্রায় যাত্রীশূন্য ওই কামড়ার একটা শোভন সিটে গিয়া শুইয়া পড়তেছিলাম আমি, আর গায়ে জইমা থাকা বৃষ্টির পানিতে একটু একটু শীত লাগতেছিল আমার। কিন্তু যেহেতু বড় ধরনের একটা ঝাঁকি খাওয়া ছাড়া এই লাগতে থাকাটা কেমন লাইগাই থাকবে গায়ে, এবং গায়েরে আর গা বইলা চিনা যাবে না তখন, ভাবনাগুলার থেকে, চিন্তাগুলার থেকে যেহেতু সে তখন আলাদা আরেক নড়নচড়নে শিথিল হইয়া থাকবে, ফলে, চলতে থাকা ট্রেনের দোদুল্যতায় আলগা হইয়া ঘুমাইয়া যাইতেছিলাম আমি।
Latest posts by তানিম কবির (see all)
- মধুরোড / তানিম কবির - জুলাই 11, 2015
- বইমেলা ২০১৫ এর বই: সকলই সকল – তানিম কবির। - জানুয়ারি 28, 2015
- শৈত্যস্বর - নভেম্বর 4, 2013