Main menu

সমর সেনের কয়েকটা কবিতা

[pullquote][AWD_comments][/pullquote]বাংলা-পুঁথি সংগ্রাহক শ্রীদীনেশচন্দ্র সেনের নাতি সমর সেনের (১৯১৬ – ১৯৮৭) কবিতার সিগনিফিকেন্স মেইনলি দুইটা। এক হইলো, বাংলাভাষায় কবিতার জন্য নির্ধারিত ছন্দগুলাতে তিনি কবিতা লিখেন নাই (এর লাইগা তিনি সম্ভবত এখনো হাততালি পান); অল্প কয়েকটা যা লিখছেন, সেইগুলারে পরে আর কবিতা বইলা তাঁর বইয়ে জায়গা দেন নাই। তিনি নিজে কোন সময় দাবি না করলেও এইরকমের কবিতার ছন্দরে গদ্যছন্দ বইলা মানা হইছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এইরকম লিখছেন আগে। এই প্রাকটিসের ভিতর দিয়া সমর সেন গদ্যছন্দরে আপহোল্ড করেন নাই, হইতে পারে মাত্রা-গোণা ছন্দরে ইগনোরই করতে চাইছেন খালি; এইভাবে যে, যখন আপনি কবিতা লিখতেছেন, তখন আলাদা কইরা ছন্দে লেখা বা না-লিখাটা আসলে কিছু মিন করে না। তবে শেষ পর্যন্ত ‘মাত্রা-গোণা ছন্দ’ জিনিসটারে ইগনোর ত করাই যায় নাই বরং অন্যান্য ছন্দ ছাড়াও গদ্যছন্দে কয়েকটা কবিতা লেখাটাও ফরজ হিসাবে নাজিল হয়া গেছে, পরবর্তী কবিদের উপ্রে।

আরেকটা ব্যাপার হইলো, তিরিশেরদশকের কবি জীবনানন্দ দাশ গোপনে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতা লিখতে পারলেও, সমর সেন গ্রাম-বাংলা নিয়া কবিতা লিখার সাহস কখনোই করতে পারেন নাই (এর লাইগা হাততালি পান নাই উনি)।

বিভিন্ন সময়ে (১৯৩৪ – ১৯৪৬) লিখা উনার কয়েকটা কবিতা এইখানে রাখা হইলো।

__________________________________________

মেঘদূত।। উর্বশী।। এবার ফিরাও মোরে।। একটি কবিতা।। কয়েকটি মৃত্যু।। জয় হিন্দ।।

___________________________________________

 

মেঘদূত

পাশের ঘরে
একটি মেয়ে ছেলে ভুলানোর ছড়া গাইছে,
সে ক্লান্ত সুর
ঝরে যাওয়া পাতার মতো হাওয়ায় ভাসছে,
আর মাঝে মাঝে আগুন জ্বলছে
অন্ধকার আকাশের বনে।

বৃষ্টির আগে ঝড়, বৃষ্টির পরে বন্যা। বর্ষাকালে,
অনেক দেশে যখন অজস্রজলে ঘড়বাড়ি ভাঙবে,
ভাসবে মূক পশু আর মুখর মানুষ,
শহরের রাস্তায় যখন
সদলবলে গাইবে দুর্ভিক্ষের স্বেচ্ছাসেবক,
তোমার মনে তখন মিলনের বিলাস
ফিরে তুমি যাবে বিবাহিত প্রেমিকের কাছে।
হে ম্লান মেয়ে, প্রেমে কী আনন্দ পাও,
কী আনন্দ পাও সন্তানধারণে?

উর্বশী

তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিম্বা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,
হে ক্লান্ত উর্বশী,
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে
উর্বর মেয়েরা আসে;
কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধিত ক্লান্তি,
কত দীর্ঘশ্বাস,
কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,
আরো কত দিন!

 

এবার ফিরাও মোরে

পড়ন্ত রোদে নগর লাল হল।
বহুদূর দেশে
পাহাড়ের ছায়া প্রান্তরে পড়ে;
সন্ধ্যার অন্ধকারে অন্ধ নদীর
মদির ক্লান্ত টান।

মেমননের স্তব্ধ মূর্তি
রাত্রি হয়ে এল শেষ
এবার ফিরাও মোরে।

 

একটি কবিতা

সন্ধ্যার ট্রেন আকাশে ধোঁয়ার স্তম্ভ আঁকে,
ভারি লাল চাঁদ আসর জমায়;
বহু আশাভঙ্গে ফেঁপেছে মন,
বয়স তো হল, আর কেন ভীমরতি,
প্রভুহীন কুকুরের মতো আর কতোকাল।
আপন চর্চায় শুধু শূন্য ফানুস ফাঁসে,
বিধি হলে বাম
আপনি বাঁচালে বাপের নাম
সে দিন নেই।
চাপা সূর্যের ভ্রূকুটি আকাশ ছিন্ন ক’রে
সবুজ গাছে কালো কাকে সকাল আনে;
সারাদিন আপন মনে মনের উকুন বাছা,
লোকালয়ের খেয়াঘাটে অর্থহীন এ আত্মম্ভরী গান।

 

কয়েকটি মৃত্যু


তার মুখে সূর্যের কাঁচা সোনা,
মনে তার নতুন অরণ্যের স্বাদ
তাই সবি ভালো লাগে।
প্রেমের ব্যাপারে দিব্যি বেপরোয়া
সরম নেই।
আর একটি গুণ –
ছেলেপিলে চায় না মোটেই।
পুন্নামের মুখে মস্ত তুড়ি মেরে
স্বচ্ছন্দে চলে যায় দাম্পত্য জীবন।

অবশেষে ঠকঠকে বুড়ি হয়ে মারা গেল,
সংসার খালি;
দূর ছাই, কিছু ভালো লাগে না,
সঙ্গীহীণ বুড়ো ভাবে সন্ধ্যায়:
সমাজ বদলেছে অনেক, নিরুপায়,
নইলে হে হরি,
এ বয়সে মন্দ লাগত না আর একটি কিশোরী।


চলেছি সমুদ্রে পথে;
বিস্তীর্ণ বালি, হলুদ বালি,
হাতে কাজ নেই, মন খালি,
শূন্য মেঘের ফালি।
চায়ের দোকানে কতদিন পয়সা খসিয়েছ,
কত ধার নিয়েছ, শোধ দিতে গিয়েছ ভুলে,
কত বই চুপি চুপি অক্লান্ত মেরেছ,
প্রায় শূন্য আলমারি।

আজ মৃত্যু সে সব কথা মনে আনে
হলুদ বালির পথে।


বৃষ্টিতে মাজা নীল শূন্য;
জানি, করাল অভিশাপে
এ বস্তের বাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে;
আমাদের এ টুকরো প্রেম, কৃষ্ণচূড়া দিন,
এ বাসরঘর,
শ্মশান কুরুক্ষেত্রে শকুনের কোলাহলে
মোলায়েম বাঁশির মতো।

এ কথা একদিন তুমি বলেছিলে।
তারপর তুমি চলে গেলে যমলোকে;
মড়াপোড়া ধোঁয়ায় সারাদিন জ্বলেছে চোখ,
ফিরেছি শ্মশান ছেড়ে স্নান সেরে; দেখেছি,
পথেঘাটে স্বচ্ছন্দে চলে বর্বর জীবন,
অশোক, নির্লজ্জ;
বৃষ্টির পরে নীল শূন্য; রক্তঝরা কৃষ্ণচূড়া।

তারপর চায়ের দোকানে ব’সে সহসা ভেবেছি;
আজকাল ঘরে ঘরে সমাজধার্মিক অনেক,
মুখে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার বুলি,
মনে রোমান্টিক বুলবুলের অবিরত গান,
তুমি ছিলে তারি একজন।
এ অধমও তারি একজন।
সুতরাং শোক বৃথা; মরে তুমি হয়তো বেঁচেছ,
আমরা বাঁচিনি,
আমাদের বসন্তবাগান ভেসে যাবে রক্তস্রোতে,
আরো কত বল হরি হরি বোলে, দারুণ জোয়ারে।

 

জয় হিন্দ

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মালিকের ফের বেঁধেছে ঘাঁটি;
বৈষ্ণবী বিনয়ে ইংরেজ বসেছে বর্মায়,
ফরাসীরা প্রত্যাগত ইন্দোচীনে,
গোলন্দাজহীন ওলন্দাজ ঘোরে যবদ্বীপে।
ভারতের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়।

বম্বেতে দিন রেখে গেল বারুদের গন্ধ;
রাস্তায় রক্তের ছিটে।
বন্দুকের খর শব্দ থামলে শহরে
বিপ্লবী নেতারা জমে বক্তৃতার মাঠে,
সর্দারের ধমকে পার্কের রেলিং কাঁপে,
হয়তো কৃত পাপের লজ্জা জাগে
মর্গে জমা দুশো সত্তরটা লাসে।
ধোঁকায় জব্দ জাহাজেরা বন্দরে স্তব্ধ,
মাঝে মাঝে উদ্যত সঙীন, সাম্রাজ্যের উদ্ধত প্রতীক।

আমাদের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়,
মন্ত্রীসভার বিলিতী দূতেরা আগতপ্রায়
জয় হিন্দ।

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

সমর সেন

সমর সেন (১৯১৬ - ১৯৮৭): কবি, সাংবাদিক, অনুবাদক। ছাপা হওয়া কবিতার বই - কয়েকটি কবিতা (১৯৩৭), গ্রহণ (১৯৪০), নানাকথা (১৯৪২), খোলা চিঠি (১৯৪৩) এবং তিন পুরুষ (১৯৪৪)।
Avatar photo

Latest posts by সমর সেন (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →