মধুরোড / তানিম কবির
গল্প হইতাছে বলে টের পাওয়া যায়, পোলা গল্পেরা হইতাছে। পোলা গল্পদের পড়তে মাইয়াদের আরাম লাগে না প্রায়ই।
এইগুলারে পোলা গল্প বলার কারণ, পড়তে আরাম না লাগার জন্য ফেমিনিস্ট হওয়া লাগে না, খারাপ মাইয়াও হওয়া লাগে না–মাইয়া হওয়াই এনাফ।
একটা সময় আছিল যখন ধলা গল্প লেখা হইতো, লেখা হইতো খ্রিস্টান বা হিন্দু বা মোসলমান গল্প; কালা মাত্রই ধলা মানুষের লেখায় আরামের উপায় পাইতো না, মোসলমানের গল্পে হিন্দুর আরাম আছিল না। সেই দিন আর নাই; অন্য রেস বা রিলিজিয়নের প্রতি ঘেন্না থাকলেও লেখকেরা এখন কনসাসলি লুকাইয়া ফেলার ট্রাই করেন। রেসিজম বা কমিউনালিজমে ডিনায়্যাল এমনি ইউনিভার্সাল হইয়া উঠছে লেখকদের মাঝে। চিন্তাজগতে মার্ক্সিজমও এমনি মোড়ল হইয়া উঠছে যে কট্টর ক্যাপিটালিস্টরেও লেবারফ্রেন্ডলি ডিজগাইজের ভিতর থাকতে হয়।
এইগুলি প্যাট্রিয়াকিরে ততো শত্রুজ্ঞান করে নাই বলে টাইম লাগে নাই বেশি, ১০০/২০০ বছরেই অমন ডমিন্যেন্স পাওয়া গেছে; ফেমিনিজমের একটু বেশি টাইম লাগবে মে বি, গল্পদের সেক্সিস্ট না হওয়াটা লেখক সমাজের একটা কমনসেন্স হইয়া উঠতে বাকি এখনো। পোলাবাদের বাংলায় সেক্সিস্ট হওয়াটাই সেক্সি এখনো।
– র.ক.
—————————————–
শিখার সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হয়নি। ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম একপ্রকার খামখেয়ালি থেকে। খুঁজে পেয়েছিলাম কিভাবে সেটা বলি। তাহলেই হারিয়ে ফেলার গল্পটাও বলা হয়ে যাবে: [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
স্থান কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন। সময়টা এই শতাব্দীর শুরুর দিক। চট্টগ্রামগামী একটা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। এর আগে, সকালবেলা চট্টগ্রাম থেকে বাল্যবন্ধু শম্ভুকে বিদায় দিতে স্টেশনে এসে আবেগে এমনই অভিভূত হয়েছিলাম যে, ট্রেন ছেড়ে দিলেও আর নামতে পারি নি। বন্ধু বড় চাকরি পেয়ে ঢাকা চলে যাচ্ছে। একবাক্যে ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, ওর অনুপস্থিতিতে চট্টগ্রাম শহরটা আমার কাছে কেবলই একটা বড় থাকার জায়গা ছাড়া আর কিছুই না। বন্ধুকে বিদায় দিতে দিতে কুমিল্লা পর্যন্ত চলে আসি। এবার ফেরার পালা। কুমিল্লা স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি চট্টগ্রাম ফেরার একটা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। মাইকে ঘোষণা আসে, কাঙ্ক্ষিত ট্রেন অন্তত দুইঘণ্টা বিলম্বে কুমিল্লা পৌঁছুবে। ভাবি কোনওভাবে এই দুইঘণ্টা সময় পার করে দিতে হবে।
তখন এদিক ওদিক তাকাতেই, খুব সহজেই আমি শিখাকে পেয়ে ফেলি। লিকলিকে লম্বা একটা ব্যাপার। দুই পাশে বোচকা বোচকা দুটো ব্যাগ। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, দুটো ব্যাগের নিচে ওর দুটো পা গুঁজে রাখা। অর্থাৎ ভাবছে, বাতাসে উড়ে যেতে পারে, তাই ব্যাগের সঙ্গে আটকে রাখছে নিজেকে। ওর কাছে গিয়ে সত্যতা যাচাই করতে চাই। তার আগে নিশ্চিৎ হয়ে নেওয়া দরকার, কাছেপিঠেই হঠাৎ আবির্ভূত হবার মতো কোনো গার্জেন থাকতে পারে কিনা ওর। পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো, নেই। ও একা। হাসিমুখে ওর সামনে পৌঁছাই। বলি, “আপনি কি ব্যাগের সঙ্গে নিজেকে আটকে রেখেছেন? যাতে উড়ে না যান?” শিখা ভ্রু কুঁচকায়, ঠোঁট দুটো গোল করে বিরক্তি আর তার থেকে উৎপন্ন প্রতিক্রিয়া ঝাড়ার পূর্ব মুহূর্তেই আমি হাল ধরে ফেলি, বলি, “আমাকে চিনতে পারছেন? আপনি বড়ুয়ার বোন না?”
আর তাতে, পূর্ব পরিচিত ভেবে করে ফেলা রসিকতার দোষটা মুহূর্তেই অর্ধেকে নেমে আসে। শিথিল হয়ে আসে কপালের ভাঁজ, ভ্রুগুলো ফিরে পায় পুরনো অবস্থান। শিখা বলে, “ওহ, আপনি বোধয় ভুল করছেন। আমি বড়ুয়ার বোন না।” আর তখনই মুখ ফস্কে বেড়িয়ে আসে, “তাহলে আপনি কার বোন? আপনার ভাই ডেঞ্জারাস কেউ নয় তো?” প্রথমে বুঝতে না পারার চাহনি এবং পরপরই বুঝতে পেরে, গিলে ফেলা বিস্ফোরণটাকে উগড়ে দেয় শিখা, “আপনি আমার সঙ্গে ফাজলামো করছেন!” আমি বলি, “কই! না তো! মাফ করবেন। ট্রেন দুই ঘণ্টা লেট। নানা ধরনের নাটক করেই এখন সময় পার করতে হবে।” বলেই ওকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে, যেখানে আগে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানে ফিরে আসি।
পেছনে তাকিয়ে বুঝতে পারি, আমার পিছু পিছু তেড়ে আসার উদ্যোগ নিয়ে আটকে রাখা পায়ের, একইসঙ্গে অপ্রস্তুত এবং হতোদ্যম যাত্রায় একটা আত্মঘাতী ফাউল হয়ে গেছে। শিখা প্লাটফর্মে পড়ে গেছে, আর আমার দিকে রাগী রাগী চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমি দৌড়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিই, টেনে তুলতে চেয়ে। কিন্তু আমার চোখে, প্লাটফর্ম থেকে সংগ্রহ করা একমুঠো ধুলোবালি ছুড়ে মারে সে। আর ইংরেজিতে যাচ্ছেতাই গালাগাল করতে থাকে। মুহূর্তেই চারপাশে গোল হয়ে উৎসাহী লোকজনের ভিড় জমে যায়। পালোয়ানের মতো দেখতে এক লোক, দেখেই মনে হয় শহরে কোথাও এর একটা ভাতের হোটেল আছে, সেই লোক শিখার কাছে জানতে চায়, “ঘটনা কী আপা?” আর ওতেই প্রায় ঠোঁট বাঁকানো কান্নাকান্না চোখে ও আমার দিকে হাত উঁচিয়ে দেয়। আর দেখে কে, লোকজনের মার তো খেতেই হয়, উপরন্তু জিআরপি থেকে পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়।
জীবনে প্রথম পুলিশের ডাণ্ডার বাড়ি খেতে হয়। তারপর অন্ধকার স্যাঁতসেতে একটা রুমে আমাকে রাখা হয়। বলা হয়, বড়বাবু আসলে আমার কেসটা নিয়ে আলোচনা করা হবে। রুমের ভিতরে চুপচাপ এককোণে বসে থেকে আমি নিজেকে দোষারোপ করতে থাকি। কী দরকার ছিল এসব করার? শিট। তখনই রুমের দরজা খোলা হয় আর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় অফিস রুমে। সেখানে অনেকগুলো পুলিশের সঙ্গে শিখাও বসে আছে। ডাণ্ডা হাতে এক পুলিশ আমাকে বলে, “উনি আপনার ব্যাপারে লিখিত কোনও অভিযোগ দিতে চান না। আপনি যেতে পারেন।” তবে সাবধান করে, এ ধরনের ঘটনা যেন আর না হয়। মেনে নিয়ে আমি বের হয়ে আসি, আর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, যেন শিখাও বের হয়ে এসে আমার সঙ্গে মৃদু রাবীন্দ্রিক পায়ে আবার প্লাটফর্মে ফিরবে!
ও বের হয়ে এসে ঝড়ের গতিতে আমাকে পার হয়ে প্লাটফর্মের দিকে যেতে থাকে। আর আমি বুঝতে পারি, স্টার্ট হলো বলেই যে গল্পটা চলতেও থাকবে, এমন কোনও বাঁধাধরা হিসেব নেই। আমিও একা একা, তবে অতটা দ্রুত পায়ে নয়, প্লাটফর্মে পৌঁছাই। শিখার কাছে গিয়ে বলি, “আমি সরি।” শিখার তাতে কিছু এসে যায় না। বরং আমার প্রতি তার একটাই অনুরোধ, যেন দূরত্ব বজায় রাখি। সুতরাং, আমি ফিরে আসি, যথাস্থানে।
এরমধ্যে চট্টগামগামী নয়, অথচ নোয়াখালীগামী একটা ট্রেন স্টেশনে এসে দাঁড়ায়। আর আমাকে বিহ্বল করে দিয়ে সেই ট্রেনে উঠে পড়ে শিখা। আমার মনে হতে থাকে, ওর সঙ্গে কখনওই আর দেখা হবে না আমার! কেন জানি না, ঠিক হয়ে যাওয়া ভবিতব্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসি। নিজেকেই শোনাই, আমি যদি চাই চিরদিনই দেখা হতে থাকবে, এটা আমার চাওয়া না-চাওয়ার ব্যাপার। এর বাইরে কিছুই না। ফলে, ট্রেনটা যখন ছাড়ে, টানতে থাকা সিগারেটটাকে শেষ হবার সময় দিয়ে খানিকটা গতি তুলে ফেলা চলতি ট্রেনটায় গিয়ে লটকে পড়ি আমি।
একদম শেষের দিকের একটা বগির দরজায় লটকেছিলাম। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তাকিয়ে বুঝি, এটা একটা প্রথম শ্রেণির বগি। দরজায় ধাক্কা দিতে থাকি। বলতে থাকি, “কেউ শুনছেন? দরজাটা খুলবেন প্লিজ?” কিন্তু অনেকক্ষণ পর্যন্ত কেউ দরজা খোলে না। হাতল ধরে ঝুলে থাকতে থাকতে যখন প্রায় ক্লান্ত, কয়েকজন পুলিশ সদস্য আর দুজন টিকেট চেকার এসে নিজেদের প্রয়োজনেই দরজা খুলে আমাকে আবিষ্কার করে। আবিষ্কার পরবর্তী ধাপেই তারা আমার কাছে টিকেট চেয়ে বসে। আর সেটা আমার না থাকায় চোখের পলকেই হাতকড়া পরিয়ে আমাকে নিয়ে পুরো দলটা ট্রেনের অভ্যন্তরে টহল দিতে শুরু করে। আকটকৃত আসামী হিসেবে পুনরায় শিখার সঙ্গে দেখা হয়। দলটা ওর কাছেও টিকেট চাইতে থামে। আর ও, বিস্মিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ব্যাগ হাতড়ে টিকেট খুঁজতে থাকে। আমি ওকে বলি, “শুধু আপনাকে সরি বলার জন্য এ ট্রেনে উঠেছি। আমার এ ট্রেনে ওঠার কথা ছিল না।” শিখা জানতে চায়, “আপনার এই দশা কেন?” বলি, “অনির্ধারিত যাত্রা, তাই টিকেটও করা হয়নি, টিকেট না কাটার শাস্তি।” শিখা চেকার ও পুলিশ সদস্য বেষ্টিত দলটিকে কিভাবে কিভাবে অনুরোধ করে যেন আমাকে ছাড়িয়ে নেয়।
ফাঁকাই ছিল ট্রেন উপকূল এক্সপ্রেস। মুক্তি পেতে না পেতেই আমি শিখার পাশের খালি সিটটায় গিয়ে বসে পড়ি। শিখাকে বলি, “জীবনে কখনও আমি পুলিশের খপ্পরে পড়ি নি, আজ আপনার জন্য একবার নয়, গুনে গুনে দুইবার আমাকে পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হতে হলো।” শিখা বলে, “তো? এতে আমার কি কোনো দোষ ছিল? নিজের দোষে নিজে শাস্তি পেয়েছেন।” ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে আমি বলি, “দেখুন, আমার ট্রেনটা দুই ঘণ্টা লেট। এখন সময় কাটানোর জন্য আমাকে তো কিছু একটা করতে হবে, নাকি? আমি গিয়ে আপনার সঙ্গে ভাব করতে চাইলাম। আপনিও ভাব করে নিলেই হয়ে যেত! রাশিয়ায় হলে কী হতো জানেন? ব্যাপারটাকে দুই পক্ষই এনজয় করত। ওরা খুব রসিক জাতি। আর আমরা কেমন আনকালচারড খ্যাত জাতি সেটা তো আপনাকে দিয়েই বোঝা গেল।”
অপমানে বিহ্বল হয়ে গিয়ে বিহ্বলতাপরবর্তী অ্যাকশনের ব্যাপারে হালকা হোমওয়ার্ক করে নিয়ে ও আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। খামচি দিয়ে, ঘুষি দিয়ে, চড় থাপ্পড় দিয়ে ও আমার শার্টের একটা বোতাম ছিঁড়ে ফেলে। আমার হাতে বসিয়ে দেয় নখের গভীর আঁচড়, ওখান থেকে রক্ত বেরুতে থাকে। রক্ত বেরিয়ে আসার দুই সেকেন্ড আগে আঁচড়ের ফাঁক দিয়ে সাদা মাংসের ঝিলিক দেখে শিখা প্রায় অজ্ঞান হয়ে যায় আর কি। নিজ রক্তপাত ভুলে ওকে চেতনায় ফেরানোর চেষ্টা চালাতে হয়। ফাঁকা বগিতে, অনেক দূরে দূরে বসা যাত্রীদের কেউই রোমহর্ষক এই দৃশ্যটা দেখে তো না-ই, আর ঘটনার প্রায় একই বরাবর সময়ে ট্রেনটাও এত দীর্ঘ একটা হুইসেল দেয় যে, চিৎকার চেঁচামেচিগুলোও তার তলে চাপা পড়ে যায়। আর হিসেব করে দেখলে, সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছিল আমার জন্য।
শিখাকে ধরে জানালার পাশে বসিয়ে দিই। ভাবি, জানালা দিয়ে আসা বাতাস যদি ওকে সুস্থ করে তোলে। কিন্তু সিনেমার দৃশ্যের মতো, একটা কিছু দেখে যে সত্যিই কেউ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে, সেটা ওই দৃশ্য না দেখলে আমি কখনওই বিশ্বাস করতাম না। সিনেমারই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে আমি বোতল থেকে কয়েক আজলা পানি নিয়ে ওর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিই। আর তাতে সিনেমার মতোই ফল হয়। শিখা ঝাপটা দিয়ে সোজা হয়ে বসে। আমি ভাবছিলাম, এ পদ্ধতিটা কাজ না করলে, প্রয়োজনে জ্ঞান ফেরানোর জন্য মুখে মুখ রেখে টান মেরে পানি বের করে আনার পদ্ধতিটাও কাজে লাগাব। সেই পরিশ্রমটা আর করতে হয় না জন্য খানিকটা ফুরফুরে দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাই। সৌজন্যমূলক হাসি দিই।
শিখাও ঠিক সিনেমারই স্টাইলে ব্যাগ থেকে একটা ওড়না বের করে ওটা দিয়ে আমার হাত বেঁধে দেয়। সৌভাগ্যক্রমে ওর ব্যাগে স্যাভলনও ছিল। বাঁধবার আগে ওটা দিয়ে আঁচড় দেওয়া জায়গাটা ড্রেসিং করে নেয়। বাঁধতে বাঁধতেই পুরো গল্পটা ও যেভাবে বুঝেছে, সেভাবে আমাকে শোনায়, “মানে হলো আপনি আপনার বন্ধুকে বিদায় দিতে স্টেশনে এসে, ট্রেন থেকে সময়মতো নামতে পারেন নি, আর অ্যাকসিডেন্টলি কুমিল্লা এসে পড়েন। সেখানে আপনার ট্রেন মহানগর পূরবী আসতে দুই ঘণ্টা দেরি হবে জন্য আপনি আসেন আমার সঙ্গে নাটক করে সময় কাটাতে। তারপর তো যা হওয়ার তাই হয়, আর ফাইনালি আপনি আমার সামনে বসে আছেন। এই তো?”
এই না হলেও কাছাকাছি কিছু একটা বলতে পেরেছে সুলভ প্রশ্রয়ের হাসি দিই আমি। শিখা আবার বলে, “তাহলে আপনি চট্টগ্রাম ফিরবেন কী করে?”
আমি বলি, “লাকসাম স্টেশনে নেমে যাব। লাকসাম থেকে মহানগর পূরবীতে উঠব।”
কিন্তু শিখা আমাকে দুঃখের সঙ্গে জানায়, “পূরবী তো লাকসাম স্টেশনে থামে না। স্টপেজ নেই।”
এরপর, এই রুটে নিয়মিত যাতায়াতকারী শিখা আমাকে, কিভাবে চট্টগ্রাম পৌঁছুতে পারব সেই সম্মন্ধে বলে। “আপনি লাকসামে নেমে যাবেন ঠিক আছে। কিন্তু চট্টগ্রামে ফেরার ট্রেন পেতে পেতে বিকেল বা সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ওই সময়ে আমি কী কী ট্রেন পাব, সেগুলোর নামও মুখস্থ বলে দেয়। আমি জানতে চাই, “আর আপনি? এ ট্রেন তো নোয়াখালী যাবে?”
“হ্যাঁ। কিন্তু আমি চাঁদপুর যাব। ঠিক চাঁদপুরও না, চাঁদপুরের কয়েক স্টেশন আগে, মধুরোড স্টেশন। লাকসামে নেমে আমাকেও ট্রেন চেঞ্জ করতে হবে।”
“বাহ ভালোই হলো, তাহলে তো আপনাকেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?”
“বেশিক্ষণ না। প্রায় একই সময়ে সাগরিকা এক্সপ্রেসও লাকসাম পৌঁছায়।”
“সাগরিকা.. অর্থাৎ যেই ট্রেন চাঁদপুর যাবে?”
“হ্যাঁ।”
আমি বলি, “বাহ, আপনার তো ট্রেন সম্পর্কে ব্যাপক জানাশোনা।”
সম্মানিত বোধ করার বদলে ব্যাপারটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ও বলে, “ধুর। নিয়মিত যাওয়া আসা করলে এটুকু জানাশোনা সবারই হয়ে যায়।”
আমিও ভেবে দেখি, তা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। চট্টগ্রামেই তো, এই যে এত এত টাউন সার্ভিস, ঠিকই তো মনে থাকে, কোনটা কোথায় যায়। এক্ষেত্রেও হয়ত সেরকমই কোনও ব্যাপার। কিন্তু সেই ভাবনায় দাড়ি বসানোর আগেই কৌতূহলী হতে হয়, লাকসামের আগেই কোনও একটা স্টেশনে ট্রেনটার থেমে পড়বার ঘটনায়। জানালা দিয়ে মাথা বের করে স্টেশনের নামটা পড়তে চেষ্টা করি। শিখা আগ বাড়িয়ে বলে দেয়, “লালমাই স্টেশন। অন্যকোনো ট্রেনের সঙ্গে ক্রসিং পড়েছে।” আমি বলি, “বাহ, যেকোন যাত্রাবিরতি আমার খুব পছন্দ।”
“নাটক করবার সুযোগ তৈরি হয় বলে?”
“হাঃ হাঃ আপনি ভাবছেন ওরকম করে বেড়ানোই আমার কাজ। অথচ আজই প্রথম আমি এ ধরনের কোনো কাণ্ড ঘটাতে গেছি। সেটা ঘটাতে গিয়ে কী ধরাটা যে খেয়েছি, আপনি তো তার রাজসাক্ষী!”
“আসলে, আমারও যেটা বলবার আছে, তা হলো, আমিও সরি। বুঝতে পারিনি সবাই এতটা ক্ষেপে যাবে!”
‘ইটস ওকে ইটস ওকে’ বলে আমি সিগারেট জ্বালাই। আর তাতে বেশ দূরে বসে থাকা একটা ফ্যামিলি আপত্তি জানায়। ফলে, সিগারেট নিয়ে আমাকে লালমাই স্টেশনে নামতে হয়। প্লাটফর্মে নেমে শিখার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। যেন আমরা একসঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি, এমন একটা ভাব করে ধোঁয়া ছেড়ে ওকে জিগ্যেস করি, “গরম তো অনেক, কোল্ড ড্রিংকস খাবেন নাকি?”
শিখাও একমত হয়, “হ্যাঁ, বেশ গরম।”
স্টেশনের বাইরে ছোট স্টেশনারি দোকানে গিয়ে আমি কোক কিংবা স্প্রাইট অথবা সেভেন আপ দিতে বলি। দোকানদার জানায়, এসবের কোনওটাই তার দোকানে নেই। তার দোকানে পাওয়া যাবে শুধু ফিজ আপ। আশেপাশে আর কোনও দোকান দেখতে না পেয়ে দুটো ফিজ আপই কিনে আনতে হয়। শিখাকে একটা দিতেই সে বলে, “ফিজ আপ ছাড়া আর কিছু ছিল না, তাই না?”
আমি খুবই অবাক হয়ে যাই। বলি, “হ্যাঁ, কিন্তু সেটা আপনি কী করে জানলেন?”
আবার, প্রশ্নটা করেই মনে হয়, বোকার মতো প্রশ্ন এটা। ‘অন্যকিছু থাকলে কেউ কি আর ফিজ আপ আনে’ টাইপের একটা সহজ জায়গা থেকেই ও কথাটা বলতে পারে। কিন্তু শিখা বলে, “আমি খেয়াল করেছি, গ্রামের ছোট ছোট দোকানগুলোতে কোক সেভেন আপের বদলে, ফিজ আপ-আর সি কোলা এসব বেশি পাওয়া যায়।”
“বাহ! আপনি ফেলুদা নাকি?”
“হিঃ হিঃ একদম না। আসলে খুব সোজা হিসেব, আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কোক পেপসির চেয়ে দেশিয় কোল্ড ড্রিংকস কোম্পানিগুলো বাকিতে মাল দেয় বেশি। আর গ্রামের ছোট দোকানগুলোর সে ব্যবস্থাতেই বেশি সুবিধা।”
রীতিমত চমকে উঠি। সহজ সরল এবং যতটা অবলা একে ভাবা হয়েছিল প্রথমে, তা তো এ নয়-ই, উল্টো এখন তো সন্দেহ হচ্ছে এ আমার চেয়েও বেশি শার্প! “সত্যিই আপনার তুলনা নেই।” প্রশংসা করি আমি। শিখা লজ্জা পায়। বলে, “আপনি খুব অদ্ভুত। একটা ভবঘুরে ব্যাপার আছে আপনার মধ্যে।” এতে আমিও লজ্জা পাই, আর তা হয়ত এ কারণে যে, আজকের দিনটা বাদ দিলে ভবঘুরেপনার ছিটেফোঁটাও কখনওই আমার মধ্যে ছিল না।
যথাযথ ক্রসিং সমাপ্ত হলে ট্রেনটা আবারও চলতে থাকে। ইতোমধ্যে আমাদের মধ্যে একপ্রকারের ভাব ভালো-লাগা হয়ে গেছে বলা যায়। ও আমাকে চানাচুর মুড়ি কিনে খাওয়ায়। নিজেও খায়। কিন্তু একতরফাভাবে ব্যাপারটা এত ঝাল ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনেই আমরা জিভ বের করে পরস্পরের দিকে মুখ হা করে তাকিয়ে থাকি। আর আবিষ্কার করি, কারো কাছে পানি নেই। যেটুকু ছিল, সেটা শিখার জ্ঞান ফেরানোর কাজে ব্যবহার হয়ে গেছে। “ইশ কেন যে ন্যাকামি করে অজ্ঞান হতে গিয়েছিলাম!” আফসোস করে ও। আমি অভয় দিয়ে বলি, “দাঁড়ান, আমি খাবার বগিতে গিয়ে দেখি পাই কিনা।”
বলেই হাঁটতে শুরু করি। করিডোর দিয়ে একের পর এক বগি পার হয়ে খাবার বগিতে পৌঁছাই। সবগুলো পানির বোতল বিক্রি হয়ে গেছে। বিমর্ষ ভঙ্গিতে ফিরে আসতে গিয়ে একটা বগি পার হওয়ার সময় দেখি, সিটে পানির বোতল রেখে একজন লোক টয়লেটের দিকে যাচ্ছে। সিটের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকটাকে টয়লেটে ঢুকবার সময় দিই। আর ঢুকে পড়তেই পানির বোতলটা চুরি করে দ্রুত পায়ে হেঁটে শিখার কাছে চলে আসি।
কৃতজ্ঞ ঢোকে শিখা পানি খায়। বোতল এগিয়ে আমাকেও খেতে দেয়। কিন্তু আমি কিছুতেই ওই পানি খেতে চাই না। বুঝতে পারে না শিখা, বলে, “কেন, সমস্যা কী?”
বলি, “অন্যের মুখ দেওয়া পানি আমি খাই না।”
ভীষণ অপমানিত হয় শিখা। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, “আমি মোটেও মুখ লাগিয়ে খাই নি। ওটা আমার অভ্যেসে নেই।”
কী বুঝতে গিয়ে কী বুঝল, আমি হায়হায় করি। বলি, “আরে আপনি না, আপনি না, বোতলটা যার, ওই কেরানি টাইপের লোকটা তো মুখ লাগাতে পারে।”
“মানে? বোতলটা কার!”
“ওহো.. মানে, বলব?” শিওর হয়ে নিই।
“অবশ্যই! না বলবেন কেন?”
আমি পুরো ঘটনাটা ওকে খুলে বলি। আর এতে ও, ওই লোকের ঠোঁট ছোঁয়ানো পানি কিনা এটা, সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র বাক্যালাপ না করে, বরং এই বিষয়ে অবাক হয়ে থাকে যে, কিভাবে আমি ট্রেন থেকে একজনের পানির বোতল চুরি করে নিয়ে আসতে পারলাম! এরপর লাকসাম পর্যন্ত যেতে পথে আমাদের মধ্যে আর উল্লেখ করার মতো কোনও কথা হয় না। দুজনেই মুখোমুখি দুটো জানালার সিটে বসে কনুইয়ের ওপর থুতি ফেলে রাখি।
লাকসাম পৌঁছানোর পর বোচকা সাইজের দুটো ব্যাগ দুই হাতে নিয়ে ও নামতে নেয়। আমি অনুরোধ করি, “একটা ব্যাগ আমাকে দিন।” ও দিতে চায় না। আমি বলি, “নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি চোর বা ছিনতাইকারী না, আপনার ব্যাগ নিয়ে পালাব না।” এতে কাজ হতে লাগে, একটা ব্যাগ ও আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতেও শেষ মুহূর্তে ফিরিয়ে নেয়। বলে, “আপনি চোর না? পানির বোতল আমি চুরি করেছি?” আমি ব্যাগটা টান মেরে ছিনিয়ে নিই। ওকে ফলো করে নামি আর নেমে ওর পিছু পিছু প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে থাকি।
“আপনি এখানেই থাকুন। আমি টিকেট কাউন্টারে যাব।” হঠাৎ থেমে গিয়ে শিখা বলে।
“আমিও যাব চলুন, আমাকেও তো টিকেট করতে হবে।” উপযুক্ত কারণসহ ব্যাখ্যা করি।
ও আবারও হাঁটতে শুরু করে। দেখাদেখি আমিও। ওভারব্রিজের নিচে এসে বলে, “আসেন আগে চা খাই।”
বেঞ্চিতে মাঝখানে একটা ব্যাগ এবং মেঝেতে মাঝখানে অপর আরেকটা ব্যাগ আমাদের পাশাপাশি বসে থাকার মধ্যে একটা অস্থায়ী দেয়াল তৈরি করে রাখে।
শিখা বলে, “বাড়ি যাওয়ার সময় প্রত্যেকবারই এই দোকানে বসে চা খাই।”
বলি, “ফেরার সময় খান না?”
হাসে, যেন জানত এরকম প্রশ্ন আসতে পারে। বলে, “না। ফেরার সময় বাসে যাই।”
আমি বুঝি, গল্পের ভুলগুলো ও এভয়েড করে চলে। কাউন্টারে গিয়ে দেখি পুরুষদের লাইনে অনেক ভিড়। তাই শিখাকে অনুরোধ করি, নিজের টিকেটের সঙ্গে যেন আমারটাও করে নিয়ে আসে। মধুরোড ও চট্টগ্রামগামী দুটো ট্রেনের দুটো টিকেট কিনে ফেলবার খুব কাছাকাছি যখন পৌঁছে যায় ও, চেঁচিয়ে বলি, “দুটোই মধুরোডের নিন।”
থমকে যায় শিখা। সামলে নিয়ে চিৎকার দিয়ে জানতে চায়, “আর য়ু শিওর?”
আমি হাত দিয়ে ইশারা করি, “হানড্রেড পাসেন্ট।”
“ইশ জানেন, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!”
“কী?” শিখার অবিশ্বাসের জায়গাটা জানতে চেয়ে জিগ্যেস করি।
“এই যে আপনিও মধুরোড যাবেন।”
“আপনি খুশি হয়েছেন?”
“অদ্ভুত তো! খুশি হওয়ার কী আছে? ইন্টারেস্টিং লাগছে ব্যাপারটা।”
অর্থাৎ যেন এখনও তার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। আর এটা যে একটা ভনিতা, তা ভালোই বুঝতে পেরে আমি বলি, “আচ্ছা, এটা মনে হয় ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার আসলে চট্টগ্রাম ফেরা দরকার।”
“সেটা আপনার সিদ্ধান্ত। দরকার হলে অবশ্যই যাবেন।” কেয়ারলেস ভঙ্গিতে ও বলে।
আমিও কবুল করে নিই। ওকে বসতে বলে কাউন্টারের দিকে রওনা দিই, টিকেট চেঞ্জ করার জন্য। ও এপ্রিশিয়েট করে। “যাক, আপনার সুমতি হলো!” আমার অসহ্য লাগে। বুঝতে পারি না, এটা ন্যাকামো, নাকি আসলেই ব্যাপারটা এমনই গুরুত্বহীন? কাউন্টারে গিয়ে অযথাই কিছুক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট চেঞ্জ না করেই ফেরত আসি। শিখা জানতে চায়, “চেঞ্জ করলেন?”
বলি, “হ্যাঁ।”
“গুড। শোনেন, আপনি জুলভার্নের বই পড়েছেন?” অন্যপ্রসঙ্গে ড্রাইভ দিতে চায়।
“জুলভার্ন কে? কোন জুলভার্ন, বাচ্চাদের জন্য বই লিখত যে?”
ও আর আলাপটা চালিয়ে নিতে চায় না। “বাদ দিন। আপনি মনে হচ্ছে কোনও কারণে আমার ওপর বিরক্ত।” অনুমানটাকে আমি হেসে উড়িয়ে দিই, “আরে না না! বলুন না, জুলভার্নের কী হলো শেষে?”
“আমি কি আপনাকে জুলভার্নের গল্প শোনাচ্ছিলাম নাকি যে শেষের প্রসঙ্গ আসবে!”
“এ কী! আপনি তো প্রচণ্ড রেগে আছেন আমার ওপর”..
“মোটেই না, এটাকে রাগ বলে না, বিরক্তি বলে। আপনি অসহ্য। দূর হন।”
রাগে কাঁপতে থাকে শিখা। আর অপ্রস্তুত থাকায় স্টেশনে ঢুকতে থাকা সাগরিকা এক্সপ্রেসের একটা হুইসেলে চমকে উঠে পড়ে যেতে নেয়। নাটকীয়ভাবে ওকে ধরে ফেলি। ঝাপটা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেয় ও। আর প্রমাণ করতে চায়, মোটেই ও পড়ে যাচ্ছিল না, আমি ওরকম ভেবে নেওয়ার ভান করে মূলত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছি। যদিও বাক্য গঠন করে কথাটা ও বলে না। কিন্তু চোখে ওরকমই একটা ঘৃণা মেশানো দৃষ্টি মেলে রাখে। আমি “ভালো থাকবেন” বলে চলে যেতে নিই। ও থামায়। বলে, “আপনিও ভালো থাকবেন। আমার ট্রেন এসে গেছে। আমি যাচ্ছি।” স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে শিখা। তাহলে, যেরকম সন্দেহ করছিলাম, সেরকম কিছু ভাবছিল না ও। অর্থাৎ নির্দোষ ভাবেই নিয়েছে ধরে ফেলার ব্যাপারটা। অথচ আমি কি পুরোপুরি নির্দোষ ছিলাম?
ফলে, পুনরায় একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে ওর সঙ্গে ট্রেন পর্যন্ত যাই। এ ট্রেনটাও ফাঁকা। প্লাটফর্ম ঘেষা একটা জানালার পাশে গিয়ে বসে পড়ে ও। আমি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ব্যাগটা ওর হাতে তুলে দিই। ও বলে, “চাইলে ভেতরে এসেও বসতে পারেন। ইঞ্জিন রিভার্স করবে। সময় লাগবে।” আমি ভেতরে গিয়ে ওর পাশে বসে পড়ি। এবার আর মাঝখানে ব্যাগ থাকে না হয়ত এ কারণে যে, আমি ট্রেনে উঠবার আগেই ওগুলো মাথার উপরে ব্যাগ রাখার নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেছে। ওর গায়ের গন্ধটা প্রথম থেকেই আমার আক্ষরিকভাবেই কোথায় যেন আগেও পেয়েছি বলে মনে হচ্ছিল। ওকে সেটা বলি। রেগে যাওয়ার বদলে ফিক করে হেসে দেয়। “আমার গায়ের গন্ধও নেওয়া হয়ে গেছে!”
আমি জিভ কামড়ে ধরি, “ছিঃ ছিঃ ওভাবে বলি নি আমি। আমি খুব সরল জায়গা থেকে বলছি।”
প্রদর্শিত সারল্যে ও বিশ্বাস স্থাপন করে কিনা কে জানে, কিন্তু মেনে অন্তত নেয়, যেন তর্কের খাতিরে। আর জিগ্যেস করে, “কোথায় আগে কোথায় পেয়েছেন, মনে করতে পারেন?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। একটু সময় দিলে পারব।” বলে বেশ জোরে ওর গা থেকে শ্বাস টেনে নেওয়ার ভঙ্গি করি। ভয় পেয়ে ও বুকে থুতু ছিটায়। বলি, “বাদাম আর সর্ষে একত্রে পিষে ফেললে যেই ঘ্রাণটা হয়, অনেকটাই ওই ঘ্রাণ। তবে এখন এর সঙ্গে এসে মিশেছে আপনার থুতুর ঘ্রাণ।”
শিখা বোধহয় মেনে নিয়েছে আমি এ ধরনের কথাবার্তা বলব। তাই আগের মতো প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ না করে এবার ও সুন্দর করে হাসে। জানায়, ইঞ্জিন রিভার্স করা হয়ে গেছে, যেকোন সময় ট্রেন ছাড়বে। এ কথা শুনে আমিও তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ি। আবারও প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ওকে বিদায় দেব বলে ট্রেন ছাড়ার অপেক্ষা করি। ও বলে, “ঠিকঠাক মতো বাড়ি পৌঁছায়েন। পথে আর বেশি ঝামেলা না করলেই ভালো।” আমিও একমত হই, “হ্যাঁ, সবাই যে আপনার মতো ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে উঠবে এমন তো নাও হতে পারে!” ও খুবই মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হাসে। ট্রেন হুইসেল দেয়, আর পেছনে তাকিয়ে দেখি একদম শেষের বগির দরজায় দাঁড়িয়ে গার্ড সবুজ পতাকা নাড়ছে। চাকা গড়াতে শুরু করে। জানালার ফ্রেমসহ শিখা চোখের আড়ালে চলে যায়। আমার মনে হয়, ওর সঙ্গে কখনওই আর দেখা হবে না আমার!
তারপর, কিছুক্ষণ আগেই সবুজ পতাকা নাড়তে থাকা গার্ডের সামনে গিয়ে নাজিল হই। গার্ড আমাকে ধমকাতে থাকে, “অ্যাঁই! এটা গার্ডের বগি। সামনে যাত্রীবাহী বগিতে যান!” তাকে বোঝাতে সক্ষম হই, “এখন আর সেটা করা সম্ভব না। কারণ ট্রেনের গতি বেড়ে গেছে।” আর প্রতিশ্রুতি দিই, “পরের স্টেশনে গিয়েই আমি যাত্রীবাহী বগিতে উঠে পড়ব।” এতে করে সে আমাকে একটা টুলবক্সের ওপর বসতে দেয়।
পরের স্টেশন চিতশী। নিতান্তই গ্রামের মধ্যে নাক গলিয়ে বসে থাকা একটা অর্ধেক ব্যস্ত স্টেশন। গার্ডের বগি থেকে নেমে শিখার বগির দিকে হাঁটতে থাকি। বলে রাখা ভালো, আগের ট্রেনটার মতো এ ট্রেনে বগির ভেতর দিয়ে চলাচল করার ব্যবস্থা নেই। বগি চেঞ্জ করতে হলে, নেমে প্লাটফর্ম ধরে হেঁটে গিয়েই কাঙ্ক্ষিত বগিতে উঠতে হয়। শিখার জানালার সামনে গিয়ে নাটকীয়ভাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। ও একটুও অবাক না হয়ে খালি পানির বোতলটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “ওই যে টিউবওয়েল। পানি ভরে নিয়ে আসুন।” বাধ্য ছেলের মতো বিশাল এক কড়ই গাছের নিচে গিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা টিউবওয়েল থেকে পানি ভরে বোতলটাসহ শিখার বগিতে এসে উঠি। শিখা আমাকে ওয়েলকাম করে। “আসুন আসুন, আপনার অপেক্ষাই তো করছিলাম!”
“মানে?” ভ্যাবাচ্যাকা জিগ্যাসা আমার।
“মানে হলো সত্যিই ট্রেনে না ওঠার মতো মনের জোর যে আপনার নেই, সেটা বুঝতে এতদিন লাগে না।”
“বাপরে! কতদিন? এই তো কয়েকটা ঘণ্টা”…
শিখা গাল বেগুনি করে হাসে। আমি শিহরিত হই!
“এবার? আপনি চট্টগ্রাম যাবেন কী করে?”
“জানি না তো। চাঁদপুর থেকে কোনও ট্রেন নেই?”
“আছে। এ ট্রেনটাই আছে। এটা চাঁদপুরে গিয়ে চল্লিশ মিনিট রেস্ট নিয়ে ইঞ্জিন রিভার্স করে আবার চট্টগ্রাম ফিরবে।”
আমি পুনরায় ওর ট্রেন বিষয়ক জানাশোনায় মুগ্ধ হই। জিগ্যেস করি, “আর আপনি নেমে যাবেন তার ঠিক দুয়েক স্টেশন আগের মধুরোড স্টেশনে?”
“হ্যাঁ।”
কাঙ্গালের মতো জিগ্যেস করে বসি, “আচ্ছা এখান থেকে মধুরোড যেতে তো অনেক সময় লাগবে? নাকি দুম করে পৌঁছে যাবে?”
“কোনটা হলে আপনার সুবিধা?” চোর ধরার স্বরে জিগ্যেস করে শিখা।
আমি ধরা পড়ে অনুতপ্ত বালকের মতো বলি, “আমি চাই এ ট্রেন কখনওই মধুরোড না পৌঁছাক।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা আপনার নাম কী? আমি স্নিগ্ধাতুন শিখা।”
আমি কোনও কারণ ছাড়াই একটা ফেইক নাম বলি, “মধু সেনগুপ্ত।”
“অ্যাহ! মধুরোড যাচ্ছেন বলে?” সন্দেহ পোষণ করে শিখা।
আমিও স্বীকার করি, “হ্যাঁ।”
ও আর বেশি ঘাটায় না, যেন সত্যি নাম যদি আমি না-ই বলতে চাই, সেক্ষেত্রে তার অত দায় নেই সেধে এসে বারবার জিগ্যেস করার। বরং আমাকে মধু বলেই ডাকতে শুরু করে ও। “বুঝলেন মধু, আমিও আসলে আপনারই মতো। শুধু আপনি না জন্য অন্যকেউ।”
“ইশ কী সুন্দর কথা!”
“মধু আমি খুব অবাক হয়েছি, আপনি সর্ষে আর বাদামের গন্ধের ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন।”
“কারণ ব্যাপারটা আপনিও টের পান।”
“হুঁ।”
“অস্বাভাবিক না। লৌকিক।”
“সেটা জানি। তবে না জানার অ্যাডভান্টেজও আমি নিতে পারি।”
আমার মনে হয় শিখা বেশি সাহসী হয়ে যাচ্ছে। ওকে থামানো দরকার। বলি, “গান শুনবেন? আমি কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারি!”
ও হেসে সম্মতি দেয়। আমি গাই :
“আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে
নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী শর্তে, আমরা সবাই রাজা”
তারপর গাই :
“ও ভাই দেখে যা কত ফুল তুলেছি
তুই আয় রে কাছে আয় আমি তোকে সাজিয়ে দি”
আনন্দে ও সহ ট্রেনের অন্য যাত্রীরাও হাততালি দিতে শুরু করে। একেবারে কোণার দিক থেকে প্রশ্ন করে, “ভাই এগুলা রবীন্দ্রসংগীত না?” বলি, “হ্যাঁ, এগুলো রবীন্দ্রসংগীত।” ফলে একই ব্যক্তি এবার রিক্যুয়েস্ট করে, “তাহলে ওই রবীন্দ্রসংগীতটা শোনাবেন, ওই যে হেমন্তের গাওয়া?”
“হেমন্তের গাওয়া কোনটা? না বললে বুঝব কী করে!”
শিখা জিগ্যেস করে, “কোনটা ভাই, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে?”
হৈ হৈ করে ওঠে লোকটা। “হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইটাই।”
কিন্তু আমার সন্দেহ হয়, আসলেই এই লোক আলাদা করে কোনও রবীন্দ্রসংগীত জানে কিনা। ফলে ঘোষণা দিই, “না, এ গান আমি পারি না। অন্য গান বলেন।”
তখন, অনেকগুলো সিট ফাঁকা থাকা সত্ত্বেও দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক বৃদ্ধ বলে, “খোরশেদ আলমের একটা গান গাও বাবা।” আমি শিখার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাই। “খোরশেদ আলমটা কে? উনার কোনও গানের খবর জানেন?”
“হ্যাঁ জানি। সত্তরের দশকের প্লেব্যাক সিঙ্গার।”
“একটা গান বলেন তো!” আমি উৎসাহ পাই।
“ওই যে, আছে না?
ছবি যেন শুধু ছবি নয় আজ যেন তাই মনে হয়
এ যেন গো দুটি মনের কথা বিনিময়”…
তারপর আরো খানিকটা ও গেয়ে শোনায়। আমার মনে নেই জন্য সবটা লিখতে পারলাম না। এতে ওই বৃদ্ধ খুশি হয়। তবে শিখাকে সাবধান করে দেয়, “পুরুষদের গাওয়া গান মেয়েদের গাওয়া ঠিক না। তুমি গাইবা রুনা লায়লা সাবিনা ইয়াসমিনদের গান।” শিখা মাথা নেড়ে বৃদ্ধের পরামর্শ আমলে নেয়। আর আমার গানের গলার অনেক সুনাম করে। “আপনার তো নিয়মিত গান গাওয়া উচিৎ!”
“গাইব না হয়, অসুবিধা কী!”
“হ্যাঁ, গাইয়েন।” বলে শিখা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আমি একটা ম্যাজিক দেখানোর কথা বলে ওর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করি। “একটা ম্যাজিট দেখবেন?”
“ম্যাজিক! দেখান!” ম্যাজিকের পাল্লায় পড়ে ওর শিশুরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
“দেখুন। এই যে এটা ট্রেনের ফ্যান।” শিখা তাকায়। বলে, “হ্যাঁ, ফ্যান।”
“এবার এদিকেই তাকিয়ে থেকে ওদিকে ফিরুন। দেখুন, একটা ফ্যান!”
“হ্যাঁ, এদিকে তাকিয়ে থেকে ওদিকে ফিরেও একটা ফ্যান”…
“এবার দুই দিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে এইদিকে তাকান। আর দেখুন, একটা ফ্যান!”
বলা বাহুল্য, একই সময় তিনদিকে তাকিয়ে তিনটা ফ্যান দেখে শিখা অভিভূত হয়। এভাবে গানে ম্যাজিকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তায় ট্রেন একসময় মধুরোড স্টেশনে পৌঁছে।
ট্রেন থেকে নেমে শিখা বাইরে দিয়ে আমার জানালার কাছে আসে। আমার হাতে ওর বোচকা সাইজের ব্যাগ দুটো। এখুনি হস্তান্তর করতে হবে। ট্রেন ছাড়ার আগেই। ছোটখাট গ্রামীণ স্টেশনগুলো যেমন হয়, এটাও তেমনি একটা বিশেষত্বহীন স্টেশন, শুধু নামটার মধ্যে একটা ব্যাপার রয়েছে, যা খুব আয়োজন করে টের পেতে হয়। মধুরোড। মনে হয় কোথাও যেন এর একটা সাহিত্যিক মূল্য আছে। প্লাটফর্ম না থাকায় জানালার সমান উঁচু হওয়া সম্ভব হয় না শিখার পক্ষে, ফলে উপরের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় ও, প্রথম ব্যাগটা হস্তান্তর করে দিই। দ্বিতীয় ব্যাগটা জানালার বাইরে নিয়েই তাকিয়ে দেখি শিখা প্রথম ব্যাগটাই ফেরত দিতে চেয়ে হাত উঁচু করে রেখেছে। “রাখুন ওটা, এটা ধরুন। জলদি করুন। লাইন ক্লিয়ার!” বলে ব্যাগটা পুনরায় আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মাত্রই চলতে শুরু করা ট্রেনে, রীতিমত দক্ষতার সহিত, উঠে পড়ে ও।
আর লজ্জিত মুখে এগিয়ে আসে। বলে, “ট্রেনটা চাঁদপুর থেকে রিভার্স হয়ে আবার এইদিক দিয়েই তো যাবে।”
আমি চোরাহাসি সহকারে বলি, “হুঁম। তখন নামতে পারবেন এ ব্যাপারে নিশ্চিত তো?”
আর এর জবাবে ও ‘ভালো কইছো মামা’ টাইপের একটা উচ্ছ্বসিত হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিংবা কে জানে, হয়ত ব্যাপারটা সেরকমই ছিল ওর কাছে। কিন্তু তবুও, আমি ঠিকই, এমনই এক ভুবনজয়ী হাসি দিই যে, সব পাওয়ার পরের প্রতিযোগিতাহীন বিনয় এসে ভর করে তাতে। শিখা বলে, “আসুন না, দরজায় গিয়ে দাঁড়াই।”
দাঁড়িয়ে, মুহূর্তের মধ্যেই পেছন ছুটে যাওয়া একটা গাছের পাতায় থাবা দিয়ে বসি। অথচ আমি জানতাম না, এতে মুঠোয় চলে আসবে উক্ত গাছের পাতায় আটকে থাকা দোমড়ানো মোচড়ানো এক টুকরো কাগজ। আর আমার হাত থেকে সেটা কেড়ে নেবে শিখা। খুলে দেখবে সেখানে লেখা, ‘মাত্র ৫শ’ টাকায় জাদু শিখুন!’ আমরা ভেবে দেখি, কলিকালে বিজ্ঞাপনযন্ত্রের যে প্রাণ গজাবে না, কোথাও এমন লেখা দেখি নি। অর্থাৎ গজাতে পারে। “পারে কিসের? গজিয়েছে! এই যে আমার হাতে!!” শিখা হাসতে হাসতে মরতে নেয়। কিন্তু যেহেতু পড়তে নেয় না, আমিও আর ধরতে যেতে পারি না। কিন্তু এটা ঠিক, আমার অনুমান যদি ভুল না হয়, ততক্ষণে শিখা ভালোই প্রেমে পড়ে গেছে আমার। আর আমি পড়েছিলাম কিনা? সেটা পরে বুঝেছি। যাই হোক, আমরা চাঁদপুর পৌঁছাই।
এখানে চল্লিশ মিনিট সময় পাই আমরা। ট্রেন থেকে নেমেই দুজন দুটো বোচকা সাইজের ব্যাগ নিয়ে স্টেশনের কাছেই, পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া, এ তিন নদীর মোহনা দেখতে যাই। বড় বড় সিমেন্টে বানানো পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট। চৌকোণো একেকটা পাথর অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা ছোট মাজার ছিল ঘাটে, তারপাশে ছোট একটা টং দোকান। আমরা চা খাই। শিখাকে জিগ্যেস করি, “আগে কখনও এসেছেন এখানে?” শিখা এমন একটা ভাব করে যে, ‘এই ব্যাটা এতদিন পর আইসা কী বলে!’ চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলে, “বাড়ির এত কাছে, আর আসব না? প্রায়ই আসি।” আমি ‘তা ঠিক’ সুলভ একটা অঙ্গভঙ্গি করে, ভেতরে ভেতরে বাক্যটাকে গুছিয়ে নিয়ে বলি, “কাপলদের জন্য তো দারুণ জায়গা। আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?” প্রশ্নের ভেতরকার উদ্দেশ্য হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে শিখা হাসে। বলে, “সেরকম অভিজ্ঞতা আজকেই প্রথম বললে কি খুশি হবেন, নাকি চেপে যাবেন?”
“অর্থাৎ এর মাঝামাঝি কিছু হতে পারে না?”
“মনে তো হয় না। নাকি পারে?” অদৃশ্য ভ্রু নাড়িয়ে জিগ্যেস করে।
আমি প্রসঙ্গ ঘুরাই একটা আসতে থাকা লঞ্চের দিকে ইঙ্গিত করে। বলি, “ধরুন চোখের সামনে দেখলেন লঞ্চটা ডুবে যাচ্ছে। কী করবেন?”
চিন্তায় পড়ে যায়। “কী যে করব.. আসলে, কিছু তো করার নেই মনে হয়”…
প্রশ্নটা আমার দিকে ফিরিয়ে দেয়, “আপনি কী করতেন?”
“কিছুই না। মনে হয় আরেক কাপ চা না খেয়েই ট্রেনে উঠে বসতাম।”
“এখন খাবেন আরেক কাপ চা? কয়টা বাজল?”
“সময় আছে, খান। আর না থাকলেই কী!”
“অ্যাহ! ঠেঙাবে!”
“হায়হায়, কে?”
“মা। খুব শাসন করে।”
“আহারে”…
“মোটেও না! মা খুব ভালো।” বলে উঠে দাঁড়ায়। মাজারের কাছাকাছি গিয়ে আবার ফিরে আসে।
“কী দেখলেন?”
“মাজারের গন্ধ নিলাম। এ মাজারের গন্ধটা, আমার দাদীর চাবানো পানের গন্ধের মতো। আমি হাতে করে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসতাম। হাতের মধ্যে একটুখানি চাবানো পান এমনই অল্প গরম হয়ে থাকত যে সুড়সুড়ি লাগত।”
“আপনার দেখার চোখ তো অসাধারণ। আপনার গল্প লেখা উচিৎ।” বলি আমি। আসলে এই কথাটা তখন সময় কাউকে সুন্দর করে কথা বলতে দেখলেই আমি বলতাম। বিশেষত মেয়েদের। আমি দেখেছি, এ ধরনের প্রশংসায় তাদের মধ্যে এমন এক ধরনের কোমলতা আসে, যা লিখতে পারত সত্ত্বেও না লিখে একটা সাদামাটা জীবন পার করে দেওয়ার ত্যাগে মহিমান্বিত।
কিন্তু শিখা বলে বসে, “লিখি তো!”
“সত্যি!?”
“হুঁম।”
“কোথাও ছাপা টাপা হয়?” জিগ্যেস করি।
“না, কোথাও ছাপতে দিই নি কখনও।”
আমি চট্টগ্রামে আমার দুয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর ভরসায় বলে বসি, “আমাকে দেবেন। আমি পত্রিকায় ছাপিয়ে দেব।”
“থাকুক! লোক না হাসুক। আর চলেন চলেন! ট্রেন ছাড়বে তো!”
বিল মিটিয়ে উঠে পড়ি। খুব কাছাকাছি হর্ন দিয়ে চলে যায় ওই লঞ্চটা। যেটার ডুবে যাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছিল। “সামনেই ঘাট। ওখানে থামবে।” যেন মনের কথা বুঝতে পারে, এমন আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে শিখা ওয়াকিবহাল করে আমাকে।
চাঁদপুর থেকে পুনরায় মধুরোড ফিরবার সময়টাতে আমাদের মধ্যে আর তেমন কোনও কথা হয় না। দুজনেই মুখ ভার করে মুখোমুখি দুটো জানালায় বসে থাকি। ও একবার বলে, “আচ্ছা একটা কথা”…
ভ্রু খাড়া করে আগ্রহ মেলি, “কী?”
“ওহ! এখন তো মনে পড়ছে না। বাদ দিন।”
“আচ্ছা।” বলে বাদ দিই। কিন্তু সম্ভবত ও তখন আমার ফোন নাম্বার চাইতে বা নিজেরটা দিতে চেয়ে কথাটা শুরু করে। কিন্তু আটকে গেল কেন? নিজে বলবে না? চায়, যেন আমি বলি?
“পরের স্টপেজই তো মধুরোড?” জানতে চাই ওর কাছে।
“হ্যাঁ!” বলে চমকে ওঠে।
আমি সাবধান করে দিই, “দেখো, যেহেতু আমি শিওর না, আমার শিওর হওয়া দরকার।”
আপনি থেকে তুমির অধপতনটা টের পায় না ও। বলে, “রিস্ক নিলেই হয়!”
আমার কাছে কেমন বিশ্রী ন্যাকা ন্যাকা লাগে কথাটা। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলি, “ব্যাগ নামাই, ট্রেন মনে হয় স্টেশনে ঢুকছে।”
“কী!” ভূতগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকে। আবার, স্বাভাবিক হয়। ট্রেন থামে। ও লম্বা পায়ে হেঁটে চলে যায়। নিচে নেমে, আমার জানালার কাছে আসে। আমি ওর ব্যাগ দুটো ওকে বুঝিয়ে দিই। ট্রেন ছাড়ে। আমরা কিন্তু এরপর আর কোনও কথা বলি নি কেউ। হাত নাড়ানাড়ির আদিখ্যেতায়ও যাই নি। শুধু ট্রেন ছেড়ে অনেক দূর চলে যাওয়ার পরও ওকে আমি একই জায়গায় একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।
এরকমই করুণ আর হতাশাজনক ছিল গল্পটা।
Latest posts by তানিম কবির (see all)
- মধুরোড / তানিম কবির - জুলাই 11, 2015
- বইমেলা ২০১৫ এর বই: সকলই সকল – তানিম কবির। - জানুয়ারি 28, 2015
- শৈত্যস্বর - নভেম্বর 4, 2013