হুমায়ুন আজাদ এবং কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ
সাহিত্যে অথবা একাডেমিয়ায় কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ নতুন কোন ঘটনা নয়। খ্যাতির মোহে যেমন অনেক বড় বড় কুতুব কুম্ভীলকবৃত্তিতে হাত মকশো করেন, তেমনি কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দেখে নেয়ারও একটি প্রবণতা রয়েছে। অর্থাৎ কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগেরও অনেক সময় রাজনৈতিক মাত্রা বিদ্যমান থাকে।
হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে আনা কুম্ভীলকবৃত্তির অভিযোগ অনেকগুলো হলেও আমি মূলত আমার পাঠ অভিজ্ঞতার মধ্যে যেই লেখাগুলো রয়েছে সেগুলোর দিকেই দৃষ্টি দিব। এই কারনে বাংলা একাডেমী এককালে প্রকাশিত তার বইটি সম্পর্কে আমি বিশেষ মন্তব্য করছি না। কারন সেই বইটি এবং যে বই থেকে চুরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে, তার কোনটিই আমি পড়িনি। পশ্চিমবঙ্গের যে অধ্যাপক অভিযোগ এনে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেই অধ্যাপকের কোন লেখার সাথেও আমি পরিচিত নই।
তার সেই প্রবন্ধটিও আমি পড়ি নাই। কিন্তু দুইটি যাচাইযোগ্য কথা এই সম্পর্কে বলা হয়েছে। প্রথমত বলা হয়েছে বাংলা একাডেমী বইটি বাজার থেকে প্রত্যাহার করেছিল। দ্বিতীয়ত পশ্চিমবঙ্গের অধ্যাপকের প্রকাশিত প্রবন্ধটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেটিও বলা হয়েছে। এই দুইটি বিষয় যাচাই করা সম্ভব। সুতরাং কোন সিদ্ধান্তে আসতে হলে এই দুটি তথ্য যাচাই করাই যথেষ্ট। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে এই অভিযোগটি মিথ্যা হবার সম্ভাবনা কম। একটি প্রকাশনীর বাজার থেকে বই তুলে নেওয়া খুবই দৃশ্যমান একটি ঘটনা। কেউ যদি মিথ্যা অভিযোগ করার চেষ্টা করে থাকে তাহলে এইভাবে গল্প ফাদার সম্ভাবনা কম।
আমার কথাবার্তা প্রধানত “নারী” এবং “আমার অবিশ্বাস” এ সীমাবদ্ধ থাকবে। এর কারন এই বইদুইটি এবং যে বইগুলো থেকে এগুলোকে চুরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় সেই বইগুলো আমার পড়া আছে।
নারী দিয়েই শুরু করা যাক।
আহমদ ছফার একটি বক্তব্য আছে যেখানে তিনি বোঝাতে চাইছেন “নারী” বোভেয়ারের “সেকেণ্ড সেক্স” এর নকল। এর চেয়ে ভুল কথা আসলে কিছুই হতে পারে না। বোভোয়ার ছিলেন সার্ত্রের যুগের মানুষ। অস্তিত্ববাদ দ্বারা প্রভাবিত। তিনি সেকেণ্ড সেক্স লিখেছেনও ঐ যুগে। তিনি প্রধানত প্রথম যুগের নারীবাদী তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। প্রথমযুগের নারীবাদী তাত্ত্বিকদের সাথে ফ্রয়েডিয়ান মনোবিশ্লেষকদের দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল না। সেকেণ্ড সেক্সও এই লাইনে লেখা। এই কারণে সেকেণ্ড সেক্স মূলত দার্শনিক। সমাজতন্ত্র দ্বারা বেশ খানিকটা প্রভাবিত। নারীর যৌনস্বাধীনতা সম্পর্কিত বয়ান সেকারণেই তুলনামূলকভাবে কম।
অন্যদিকে সেকেণ্ড ওয়েভ নারীবাদের মূল জায়গাটাই ছিল নারীর যৌন স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তারা মনে করতেন এর মাধ্যমেই পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফাটল ধরবে এবং নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে।
তাদের ডিসকোর্সে তাই “ক্লিটোরিস” এর অত্যাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তারা অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মাস্টারস এবং জনসন এর মত অন্যান্য সেক্সোলজিস্ট এর গবেষণা থেকে তথ্য আহরণ করে দেখিয়ে দেন নারীর যৌনতার কেন্দ্র হচ্ছে ক্লিটোরিস। যেহেতু ক্লিটোরিস এর মাধ্যমে পুলক পাওয়ার জন্যে ইন্টারকোর্স বাধ্যতামূলক নয়, সেই কারনে তারা নারীকে যৌনতার ক্ষেত্রে স্বাধীন দাবী করেন।
যারা “নারী” পড়েছেন, তারা অবশ্যই খেয়াল করেছেন, হুমায়ুন আজাদও একই লাইনেই কথাবার্তা বলেছেন।
হুমায়ুন আজাদ মূলত সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টদের লেখালিখি থেকেই তার মুল রসদ জোগাড় করেছেন। এদের মধ্যে অবশ্যই মিলেট অন্যতম প্রধান। কিন্তু “নারী” বইটি এদের কারও কোন বইয়েরই হুবুহু নকল নয়। তবে এখানে নতুন তেমন কিছু নেই। বিশেষত তিনি সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টদের ঠিকঠাক সাইট করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি যদিও বইশেষে একটা গ্রন্থতালিকা দিয়েছেন, কিন্তু মূল লেখায় বিশেষ সাইটেশন নেই। কিছু সাইটেশন আছে রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিমের লেখা থেকে। কিন্তু তার বই যে মূল অংশ অর্থাৎ সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টদের কাজকর্মের কমেন্টারি, সেখানে তার সাইটেশনের ব্যর্থতা আসলেই দুঃখজনক। পশ্চিমা স্কলারশীপের স্ট্যাণ্ডার্ডে তার বিরুদ্ধে প্লেগারিজমের অভিযোগ আসত। কারণ ভূমিকা এবং গ্রন্থতালিকায় বইয়ের নাম উল্লেখ করা স্কলারলি বইপত্র-আর্টিকেলের জন্যে যথেষ্ট নয়। কোন মতামতগুলো লেখকের নিজের আর কোনগুলো তিনি অন্যদের থেকে নিয়েছেন, এর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করার দায় লেখকের আছে।
অন্যের লেখার কমেন্টারি করা কিন্তু দোষের নয়। অনেকেই করেন। কিন্তু খুব সাবধানে সেখানে সাইট করতে হয়, যাতে কোনটি লেখকের মন্তব্য আর কোনটি অরিজিন্যাল উতসের মন্তব্য সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য তৈরি হয়। সলিমুল্লাহ খানের প্রচুর লেখা আছে যেখানে তিনি অন্যের লেখা রিভিউ-কমেন্টারী করেছেন। যেমন তিনি তালাল আসাদের তিনটি বক্তৃতার কমেন্টারি করেছেন। কিন্তু তিনি খুব সাবধানে সাইট করেছেন। এই কারণে তার প্রতি কোন অভিযোগ করা সম্ভব না।
“আমার অবিশ্বাস” এর প্রণোদনা রাসেলের “হোয়াই আই এম নট এ ক্রিশ্চিয়ান” এবং ইবন ওয়ার্কের “হোয়াই আই এম নট এ মুসলিম” থেকে এসেছে এটা বলাই যেতে পারে। কিন্তু এটি কোনভাবেই এই দুই বই এর কোনটারই মত নয়। রাসেলের বইটা আসলে মূলত ফিলসফিক্যাল। এখানে বিভিন্ন পদের লেখা সংকলিত হয়েছে। যেমন ক্যাথলিক প্রীস্টের সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে ডিবেইট, ক্রাইস্টের মোরালিটি ইত্যাদি। রাসেলের বইতে ইসলাম ধর্মের তেমন কোন উল্লেখ নেই। শুধু নবীর নাম একবার দুইবার উল্লেখ করা আছে। সাহিত্য সম্পর্কেও কোন আলোচনা নেই। অন্যদিকে হুমায়ন আজাদের বই এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত। সাহিত্য নিয়েও বেশ বড় একটি অংশ আছে। সাহিত্যের অংশটিকে আমরা মৌলিক হিসেবে নিতে পারি। কারন সাহিত্য নিয়ে তেমন কোন আলোচনা রাসেল কিংবা ওয়ার্ক কারো বইতেই নেই। ওয়ার্কের বইতে ইসলামের “প্যাগান” অরিজিন সংক্রান্ত একটি লম্বা অধ্যায় আছে। হুমায়ুন আজাদ একই ইস্যুতে যে তথ্য গুলো উল্লেখ করেছেন তার অনেকগুলোই সেই অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হুমায়ন আজাদ অন্য কোন উতস হতেও এই তথ্যগুলো জানতে পারতেন। এখানে প্রসঙ্গত “অয়ার্কের” বইটা তেমন কোন আহমরি নতুন স্কলারশীপ ছিল না। দুনিয়ার বিভিন্ন লেখার বিভিন্ন ধরনের মতামত ওয়ার্ক সাহেব দেদারছে নিজের বইতে গ্রহন করেছেন। ওয়ার্কের প্রধান ক্রাইটেরিয়া ছিল “তথ্যগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে যাচ্ছে কিনা?”। যদি যেয়ে থাকে তাহলেই সেগুলোকে তার বইতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই নির্বিচার টেকনিক ব্যবহার করার কারণে অনেক সময়ই পরস্পরবিরোধী তথ্য বইতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ দুইটি মতামত যারা একজন আরেকজনকে নাকচ করে, কিন্তু তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উভয় তথ্যই ইসলামের বিপক্ষে যায়, ওয়ার্ক উভয় তথ্যকেই যায়গা দিয়েছেন। অর্থাৎ ওয়ার্কের নিজের কোন তাত্ত্বিক কাঠামো ছিল না। ওয়ার্কের কাজকর্ম তাই খুবই নিম্নমানের স্কলারশীপ। কিন্তু ওয়ার্ক সাইট করতে ব্যর্থ হননি। যেইটা হুমায়ুন আজাদ “আমার অবিশ্বাস”-এও মোটাদাগে ব্যর্থ।
“শিল্পকলার বিমানবিকরণ” , “The dehumanization of art” এর ভাবানুবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। এই প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা সবচেয়ে শক্তিশালী। এ বিষয়ে আমি বেশি কিছু বলতে চাই না। প্রবন্ধ দুইটি পাশাপাশি পড়লেই বিষয়টি চোখে পরে। হুমায়ন আজাদ কোথাও উল্লেখ করেননি তিনি অনুবাদ করছেন। আগের দুই ক্ষেত্রে তাকে কিছু বেনিফিট অফ ডাউট দেয়া গেলেও, এই ক্ষেত্রে কিছুই ছাড় দেয়া সম্ভব নয়। হুমায়ন আজাদ পশ্চিমের পুজা করতেন। কিন্তু পশ্চিমে এই ধরনের কাজ করলে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরী চলে যেত।
শেষ কথা–
হুমায়ুন আজাদকে অনেকে মনে করেন তিনি ” সময়ের আগে জন্মেছিলেন”। এর চেয়ে ভূল আর কিছুই হতে পারে না। তিনি বরং সময়ের চেয়ে অনেক বেশী পিছিয়ে ছিলেন। আমরা নিজেরাই অনেকে এত বেশি পিছিয়ে যে হুমায়ুন আজাদকে আমাদের অনেকের কাছে মনে হয় অনেক অগ্রসর। হুমায়ুন আজাদের প্রতি এই পূজা আসলে আমাদের অজ্ঞতার প্রমাণ।
কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।
সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্ট আন্দোলন সত্তরের দশকের শেষে এসে বিপদে পরে যায়। কারণ, ব্ল্যাক এক্টিভিস্টদের লেখালিখির (যেমন বেল হুকস) মাধ্যমে প্রমান হয় সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিজম আসলে “হোয়াইট মিডলক্লাস” মহিলাদের আন্দোলন। সমাজের প্রান্তিক মেয়েরা, যেমন কালো কিংবা দরিদ্র মেয়েদের সমস্যার কোন রিপ্রেজেন্টেশন এই আন্দোলনে নেই। যদিও এই আন্দোলনের অনেকেই বামপন্থা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু নতুন যুগের বামপন্থী তাত্ত্বিকদের চোখে ধরা পরে এই আন্দোলনের “এলিটিস্ট” এবং “বর্ণবাদী” ন্যারেটিভের অস্তিত্ব। যে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলোর ভিত্তিতে সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টরা বিভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, সেগুলোরও নানা পরিবর্তন ঘটে।
১৯৮২ সালের একটি সম্মেলনে এই আন্দোলনের মৃত্যু ঘটে।(এই বইটা দেখা যেতে পারে এই সম্পর্কে –Desiring Revolution: Second-Wave Feminism and the Rewriting of American Sexual Thought, 1920 to 1982) নব্বইয়ের দশকে এসে উত্থান ঘটে থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজমের। এর সবচেয়ে রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজ হচ্ছে নাওমি উলফের দ্যা বিউটি মিথ । থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে তারা শরীরের চেয়ে সমাজ এবং প্রতিষ্ঠানের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। মিডিয়া-শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হতে বলে। প্রধানত পোস্টমডার্ন চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়াতে থার্ড ওয়েভ ফেমিনিজম সেকেণ্ড ওয়েভ থেকে ডিসটিংক্টটিভলি আলাদা।
হুমায়ুন আজাদ “নারী” শীর্ষক বই লিখতেছেন নব্বইয়ের দশকে। অথচ তিনি ১৯৭০ এর পরে এক পাও আগাইতে পারেন নাই এই বিষয়ে। তিনি সেকেণ্ড ওয়েভ এর ক্রিটিসিজম উল্লেখ করতে পারেন নাই। থার্ড ওয়েভ সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারেন না। বৈজ্ঞানিক গবেষণার নতুন তথ্যগুলোও উল্লেখ করতে পারেন নাই(সেকেণ্ড ওয়েভ ফেমিনিস্টরা ভ্যাজাইনাকে যেইভাবে নেগেট করতেন, সেইটা পুরাপুরি সত্য না) । তাইলে উনি কিভাবে সময়ের থেকে এগিয়ে থাকেন সেইটা আমার মাথায় ধরে না।
ধর্ম এবং রাজনীতি সম্পর্কে তার মতামতও মূলত ম্যালথাস আর জন স্টুয়ার্ট মিলের যুগে আটকে আছে। পশ্চিমকে পূজা করার প্রবণতা বিংশ শতকে এসে অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু হুমায়ুন আজাদ পুরাতন কলোনিয়াল মানসিকতায় আটকে আছেন।
তিনি ভিন্ন সময়ে জন্মেছেন এইটা সত্য। আশি-নব্বইয়ের দশকে পশ্চিম এবং তার জ্ঞানকাণ্ড সম্পর্কে এতটা আনুগত্য রাখা কঠিন বিষয়। তারপরও তিনি রেখেছেন। তার জন্মানো উচিত ছিল সিপাহী বিদ্রোহের আগের কলকাতায়।
হ্যা-সেই সময়কার কলকাতাই তারজন্যে সবচেয়ে চমৎকার সময়। ডিরোজিও এর শিষ্য ইয়ং বেঙ্গলরা তখন ব্রিটিশ হওনের প্রবল চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ধনীর দুলাল কতগুলো উন্নাসিক ছাত্র গরীব পুরোহিতের টিকি কেটে নেওয়াটাই প্রগতি মনে করতেন। মাংস খেয়ে ব্রাহ্মণের দিকে হাড্ডি ছুড়ে মারাটাকেই মনে করতেন এনলাইটেনমেন্ট।
হুমায়ুন আজাদ বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক হওনেরও যোগ্য নন। বিদ্যাসাগর গ্রামীণ এবং দরিদ্র ভারতের সাথে একাত্নতা অনুভব করতেন। বিদ্যাসাগর একরোখা ছিলেন সত্যি, কিন্তু এরোগ্যান্ট ছিলেন না। তিনি তার প্রতিপক্ষদের বাতিল করে দিতেন না। তাদের সাথে তাদের টার্মে বিতর্ক করার ইচ্ছা এবং যোগত্যা তার ছিল। তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে ধর্মগ্রন্থ পড়েছেন। শাস্ত্র পড়েছেন। শাস্ত্র ঘেঁটে ভিন্ন বয়ান উদ্ধার করেছেন। তিনি নাকচের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না।
অন্যদিকে হুমায়ুন আজাদের পুরো ডিসকোর্সই হাড়ে হাড়ে এলিটিস্ট। তিনি “গরীবের সৌন্দর্য” নামে অতি কুৎসিত একটি কবিতা রচনা করেছিলেন।
এছাড়া বিভিন্ন সাক্ষাতকারে তিনি নিজের কথাসাহিত্য সম্পর্কে নিজেই প্রশংসা করতেন। নিজের উপন্যাসগুলোকে শ্রেষ্ট জ্ঞান করতেন। কিন্তু তিনি খুবই নিম্নমানের উপন্যাস লিখেছেন। তার উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই “খুবই নিশ্চিত” ধরনের। তাদের মধ্যে vulnerability খুব অল্পই আছে। আধুনিক উপন্যাসে মানুষের এইসব দুর্বলতার সন্ধান করা হয়। সেগুলো তার উপন্যাসে অনুপস্থিত। অধিকাংশ চরিত্র যে আসলে তার নিজের চরিত্রের আদলে তৈরি সেটি আর বলে দিতে হয় না।
তার উপন্যাসও সেই হিসেবে ভুল সময়ের উপন্যাস। উপন্যাসের নামে প্যাম্ফলেট রচনা ছিল সপ্তদশ শতকের ইউরোপের কাজ। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে ঐসময়েই বেশি ফিট করেন।
তবে তিনি চমৎকার কিছু কবিতা লিখেছেন। শিশুসাহিত্যে তিনি আসলেই অনবদ্য। তার প্রতিটি শিশুসাহিত্য বাচ্চাকাচ্চাদের দেয়া উচিত। লাল নীল দীপাবলি , কিংবা কতো নদী সরোবরে, অথবা আব্বুকে মনে পরে, প্রতিটি শিশু কিশোরের পড়া উচিত। তাদের অভিভাবকদের রাজনৈতিক এলাইনমেন্ট যাই হোক না কেন। আমার কথাকে বিশ্বাস করতে পারেন, তার শিশুসাহিত্যগুলো আসলেই নির্মল।
হুমায়ুন আজাদ তার প্রতিভাকে অপচয় করেছেন। তিনি তার ইগোর ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যে তার প্রতিভার একটি বিশাল অংশ ব্যয় করেছেন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপকের যে মান, সেটি যদি বিবেচনা করা হয়, তাইলে আসলে তাকে বেশি নিন্দা করার কোন মানেই থাকে না। তবে তাকে পূজার প্রবণতাও শেষ বেলায় আমাদের অজ্ঞতারই ফলাফল।
::সংশোধন::
শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ আমি পড়েছি হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধের একটি সংকলন থেকে। ওখানে এই ভূমিকাটি আমি দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। বাসায় গিয়ে বই খুলে দেখতে হবে। যাই হোক, Ahmed Lipu এর সৌজন্যে শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ এবং অন্যান্য প্রবন্ধ বই থেকে ভূমিকা পাওয়া গেল —
খুব ভালো হতো যদি এ-দীর্ঘ রচনাটির একটি বিশ্বস্ত অনুবাদ প্রকাশ করা যেত , কিন্তু সে-উদ্যমের বিশেষ অভাব আমার । তাই এখানে আমি অর্তেগার বক্তব্য-ব্যাখ্যার সারাংশ লিপিবদ্ধ ক’রেই তৃপ্তি পেতে চাই । এ-সারাংশও হবে আমার রুচি-অনুসারী , হয়তো অর্তেগার ব্যক্তিগতভাবে প্রিয় অনেক অংশ বাদ প’ড়ে যাবে , এবং কোথাও কোথাও প্রবল হয়ে উঠবে আমার নিজেরই ব্যাখ্যা । [ হুমায়ুন আজাদ , শিল্পকলার বিমানবিকীকরন ও অন্যান্য প্রবন্ধ , ‘ শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ‘ , দ্বিতীয় মুদ্রণ , ঢাকা , আগামী প্রকাশনী ,২০০৫ , পৃ . ১১ ]
সুতরাং শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ সম্পর্কে আমি আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করলাম। এবং আমার অসতর্কতার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।–লেখক
Latest posts by আরিফ হোসেন (see all)
- অন লিব্রেলিজম - মে 12, 2023
- পাওয়ার অ্যান্ড পপুলার সভারিনিটি - অক্টোবর 18, 2021
- অন ডেবট ট্রাপস অ্যান্ড লিবারালিজম (On Debt Traps and Liberalism) - অক্টোবর 1, 2021