গদ্য কবিতা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
মনু যখন আমারে বঙ্কিমের এই গদ্য কবিতাগুলার কথা বললেন তখন আমিও চমকাইলাম; ‘ও’ লিখার মানে হইলো যে, আরো অনেকেই চমকাইবেন বইলা আমার ধারণা। এখন পর্যন্ত বাংলা কবিতার হিস্ট্রি যেইভাবে আছে, সেইখানে প্রথম আধুনিক গদ্য কবিতা লিখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,i অথচ উনি এই কাম করার অনেক আগেই বঙ্কিম গদ্য কবিতা লিখছেন, আর পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগে (এরচে কম টাইম গ্যাপ হওয়ার কথা না) বই ছাপানোর সময় জিনিসটা নিয়া স্পষ্টভাবে বইলা গেছেন।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
তারপরও উনার গদ্য কবিতা এবং গদ্য কবিতা বিষয়ে উনার কথাগুলারে যে ইগনোর করা যাইতেছে, এর একটা কারণ হইলো কবি না হয়া আপনি কখনোই কবিতা লিখতে পারেন না; ফার্স্টে কবি হওয়াটা জরুরি। কবি কেমনে হইবেন? দুয়েকটা কবিতা তো ধরেন লিখলেনই, এইটা সবাই-ই লেখে, সবাই বলতে যারা কলেজ-ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছেন। কবিতা লেখাটাই কবি হওয়ার ঘটনা না। তাইলে বঙ্কিম’রে নিতে কোন সমস্যা হইতো না। সমস্যাটা হইলো যে, উনি তো কবি না!
কবি হইলো এমন একটা অথরিটি যিনি কবিতা লেখার বাইরেও সার্টেন নলেজ অ্যাচিভ করছেন থ্রু উনার লাইফ-স্টাইল এবং উনি যা বলেন সেই বলাটা এক ধরণের ইনটিউটিভ নলেজ হিসাবে রেসপেক্ট করা যায়, করতে পারেন উনার ভক্ত বা অ্যাডমায়ারার যারা। এইভাবে কবি একটা সোশ্যাল আইডেন্টিটি হিসাবে অ্যাক্ট করেন। আপনি একজন এন্টারপ্রেনার, সাংবাদিক, ব্যাংকের ম্যানেজার, আইটি কনসালটেন্ট, ইউনিভার্সিটি বা কলেজের টিচার – এইরকম পেশায় থাকতেই পারেন, আবার একইসাথে কবিও হইতে পারেন; কিন্তু গল্প-লেখক, নভেল-রাইটার, কলামিস্ট, অনুবাদক হওয়ার সাথে সাথে যদি কবি না হইতে পারেন, তাইলে আপনার কবিতা নিয়া যে কোন আলাপরেই পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। বঙ্কিমের গদ্য কবিতা নিয়া এই জিনিস ঘটছে।
এই অ্যাটিটুড কতোটা ঠিক বা ভুল তার চাইতে বড় জিনিস হইলো এইটা এগজিস্টিং রিয়ালিটি। আর এই রিয়ালিটি’র সেন্টার পয়েন্ট খালি ‘মানুষ’ না, বরং মানুষ হিসাবে একটা আইডেন্টিটিরে অ্যাচিভ করা; যে এই এই জিনিস না থাকলে আপনি ‘মানুষ’ না এবং একইভাবে এই এই জিনিস না থাকলে আপনি ‘কবি’ না; যেই কারণে মানবতা বলেন আর কবিতা-ই বলেন খুবই লিমিটেড একটা এরিয়ার ভিতর ফাংশন করতে থাকে। আর এই লিমিটগুলা এমনভাবে এমবেডেড যে, বলাও লাগে না।
এখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’রে কবি বইলা মাইনা নিলে এইসব ঝামেলা হওয়ার কথা না। জাস্ট ভাবতেছিলাম, উনারে কবি না মাইনাও উনার গদ্য কবিতা’রে নেয়াটা পসিবল কিনা?
কবিতাগুলি ‘কবিতাপুস্তক’ বই থিকা নেয়া হইছে। বইটার প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। প্রথমে বিজ্ঞাপনের লেখা ও পরে কবিতা তিনটা রাখা হইলো।
ই. হা.
____________________________
বিজ্ঞাপনii
যে কয়টি ক্ষুদ্র কবিতা, এই কবিতাপুস্তকে সন্নিবেশিত হইল, প্রায় সকল গুলিই বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হইয়াছিল। একটি – “জলে ফুল” ভ্রমরে প্রকাশিত হয়। বাল্যরচনা দুইটি কবিতা, বাল্যকালেই পুস্তকাকারে প্রচারিত হইয়াছিল।
বাঙ্গালা সাহিত্যের আর যে কিছু অভাব থাকুক, গীতিকাব্যরে অভাব নাই। বিদ্যাপতির সময় হইতে আজি পর্য্যন্ত, বাঙ্গালি কবিরা গীতকাব্যের বৃষ্টি করিয়া আসিতেছেন। এমনস্থলে, এই কয় খানি সামান্য গীতিকাব্য পুনর্মুদ্রিত করিয়া বোধ হয় জনসাধারণের কেবল বিরক্তিই জন্মাইতেছি। এ মহাসমুদ্র শিশিরবিন্দুনিষেকের প্রয়োজন ছিল না। আমারও ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা ছিল না বলিয়াই এত দিন এ সকল পুনর্মুদ্রিত করি নাই।
তবে কেন এখন এ দুষ্কর্মে প্রবৃত্ত হইলাম? একদা বঙ্গদর্শন আপিসে এক পত্র আসিল – তাহাতে কোন মহাত্মা লিখিতেছেন যে, বঙ্গদর্শনে যে সকল কবিতা প্রকাশ হইয়াছিল, তাহার মধ্যে কতকগুলি পুনর্মুদ্রিত হয় নাই। তিনি সেই সকল পুনর্মুদ্রিত করিতে চাহেন। অন্যে মনে করিবেন, যে রহস্য মন্দ নহে। আমি ভাবিলাম, এই বেলা আপনার পথ দেখা ভাল, নহিলে কোন দিন কাহার হাতে মারা পড়িব। সেই জন্য পাঠককে এ যন্ত্রণা দিলাম। বিশেষ, যাহা প্রচারিত হইয়াছে, ভাল হউক মন্দ হউক, তাহার পুনঃপ্রচারে নূতন পাপ কিছুই নাই। অনেক প্রকার রচনা সাধারণসমীপস্থ করিয়া আমি অনেক অপরাধে অপরাধী হইয়াছি; শত অপরাধের যদি মার্জ্জনা হইয়া থাকে তবে আর একটি অপরাধেরও মার্জ্জনা হইতে পারে।
কবিতাপুস্তকের ভিতর তিনটা গদ্য প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হইয়াছে। কেন হইল, আমাকে জিজ্ঞাসা করিলে আমি ভাল করিয়া বুঝাইতে পারিব না। তবে, এক্ষণে যে রীতি প্রচলিত আছে, যে কবিতা পদ্যেই লিখিতে হইবে, তাহা সঙ্গত কি না, আমার সন্দেহ আছে। ভরসা করি অনেকেই জানেন যে কেবল পদ্যই কবিতা নহে। আমার বিশ্বাস আছে, যে অনেক স্থানে পদ্যের অপেক্ষা গদ্য কবিতার উপযোগী। বিষয় বিশেষে পদ্য, কবিতার উপযোগী হইতে পারে, কিন্তু অনেকস্থানে গদ্যের ব্যবহারই ভাল। যে স্থানে ভাষা ভাবের গৌরবে আপনা আপনি ছন্দে বিন্যস্থ হইতে চাহে, কেবল সেই স্থানেই পদ্য ব্যবহার্য্য। নহিলে কেবল কবিনাম কিনিবার জন্য ছন্দ মিলাইত বসা এক প্রকার সং সাজিতে বসা। কবিতার গদ্যের উপযোগিতার উদাহারণ স্বরূপ তিনটি গদ্য কবিতা এই পুস্তকে সন্নিবেশিত করিলাম। অনেকে বলিবেন, এই গদ্যে কোন কবিত্ব নাই – ইহা কবিতাই নহে। সে কথায় আমার আপত্তি নাই। আমার উত্তর যে এই গদ্য যেরূপ কবিত্বশূন্য আমার পদ্যও তদ্রূপ। অতএব তুলনায় কোন ব্যাঘাত হইবে না।
অন্য কবিতাগুলি সম্বন্ধে যাহাই হউক যে দুইটি বাল্যরচনা ইহাতে সন্নিবেশিত করিয়াছি তাহার কোন মার্জ্জনা নাই। ঐ কবিতাদ্বয়ের কোন গুণ নাই। ইহা নীরস, দুরূহ, এবং বালকসুলভ অসার কথায় পরিপূর্ণ। যখন আমি কালেজের ছাত্র তখন উহা প্রথম প্রচারিত হয়। পড়িয়া উহার দুরূহতা দেখিয়া, আমার একজন অধ্যাপক বলিয়াছিলেন, “ও গুলি হিয়ালি।” অধ্যাপক মহাশয় অন্যায় কথা বলেন নাই। ঐ প্রথম সংস্করণ এখন আর পাওয়া যায় না – – অনেক কাপি আমি স্বয়ং নষ্ট করিয়াছিলাম। এক্ষণে আমার অনেকগুলি বন্ধু, আমার প্রতি স্নেহবশতঃ ঐ বাল্য রচনা দেখিতে কৌতূহলী। তাঁহাদিগের তৃপ্ত্যার্থই এই দুইটী কবিতা পুনর্মুদ্রিত হইল।
——————-
মেঘ।
আমি বৃষ্টি করিব না। কেন বৃষ্টি করিব? বৃষ্টি করিয়া আমার কি সুখ? বৃষ্টি করিলে তোমাদের সুখ আছে। তোমাদের সুখে আমার প্রয়োজন কি?
দেখ, আমার কি যন্ত্রণা নাই? এই দারুণ বিদ্যুদগ্নি আমি অহরহ হৃদয়ে ধারণ করিতেছি। আমার হৃদয়ে সেই সুহাসিনীর উদয় দেখিয়া তোমাদের চক্ষু আনন্দিত হয়, কিন্তু ইহার স্পর্শ মাত্রে, তোমরা দগ্ধ হও। সেই অগ্নি আমি হৃদয়ে ধরি। আমি ভিন্ন কাহার সাধ্য এ আগুন হৃদয়ে ধারণ করে?
দেখ, বায়ু আমাকে সর্ব্বদা অস্থির করিতেছে। বায়ু দিগবিদিগ বোধ নাই, সকল দিক হইতে বহিতেছে। আমি জলভারগুরু, তাই বায়ু আমাকে উড়াইতে পারে না।
তোমরা ভয় করিও না, আমি এখনই বৃষ্টি করিতেছি – পৃথিবী শস্যশালিনী হইবে। আমার পূজা দিও।
আমার গর্জ্জন অতি ভয়ানক – তোমরা ভয় পাইও না। আমি যখন মন্দগম্ভীরে গর্জ্জন করি, বৃক্ষপত্র সকল কম্পিত করিয়া, শিখিকুলকে নাচাইয়া, মৃদু গম্ভীর গর্জ্জন করি, তখন ইন্দ্রের হৃদয়ে মন্দার মালা দুলিয়া উঠে, নন্দসনুশির্ষকে শিখিপুচ্ছ কাঁপিয়া উঠে, পর্ব্বত গুহায় মুখয়া প্রতিধ্বনি হাসিয়া উঠে। আর বৃত্র নিপাত কালে, বজ্র সহায় হইয়া যে গর্জ্জন করিয়াছিলাম সে গর্জ্জন শুনিতে চাহিও না – ভয় পাইবে।
বৃষ্টি করিব বৈকি? দেখ কত নবযূথিকা-দাম, আমার জলকণার আশায় উর্দ্ধমুখী হইয়া আছে। তাহাদিগের শুভ্র, সুবাসিত, বদনমন্ডলে স্বচ্ছ্ব বারিনিসেক, আমি না করিলে কে করে?
বৃষ্টি করিব বৈকি? দেখ, তটিনী কুলের দেহের এখনও পুষ্টি হয় নাই। তাহার যে আমার প্রেরিত বারি রাশি প্রাপ্ত হইয়া, পরিপূর্ণ হৃদয়ে, হাসিয়া হাসিয়া, নাচিয়া নাচিয়া, কল কল শব্দে উভয় কূল প্রতিহত করিয়া, অনন্ত সাগরাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, ইহা দেখিয়া কাহার না বর্ষিতে সাধ করে?
আমি বৃষ্টি করিব না। দেখ, ঐ পাপিষ্ঠা স্ত্রীলোক, আমারই প্রেরিত বারি, নদী হইতে কলসী পূরিয়া তুলিয়া লইয়া যাইতেছে, এবং “পোড়া দেবতা একটু ধরণ করে না” বলিয়া আমাকেই গালি দিতেছে। আমি বৃষ্টি করিব না।
দেখ, কৃষকের ঘরে জল পড়িতেছে বলিয়া আমায় গালি দিতেছে। নহিলে সে কৃষক কেন? আমার জল না পাইলে তাহার চাস হইত না – আমি তাহার জীবন দাতা। ভদ্র, আমি বৃষ্টি করিব না।
সেই কথাটি মনে পড়িল,
মন্দং মন্দং নুদতি পবনশ্চানুকূলো যথা ত্বা? বামশ্চায়ং নদতি মধুরশ্চাতকস্তে সগর্ব্বঃ
কালিদাসাদি যেখানে আমার স্তাবক সেখানে আমি বৃষ্টি করিব না কেন?
আমার ভাষা শেলি বুঝিয়াছিল, যখন বলি I bring fresh showers for the thirsting flowers; তখন সে গম্ভীরা বাণীর মর্ম্ম শেলি নহিলে কে বুঝিবে? কেন জান? সে আমার মত হৃদয়ে বিদ্যুৎ দগ্নি বহে। প্রতিভাই তাহার বিদ্যুৎ!
আমি অতি ভয়ঙ্কর। যখন অন্ধকারে কৃষ্ণকরাল রূপ ধারণ করি, তখন আমার ভ্রূকুটি কে সহিতে পারে? এই আমার হৃদয়ে কালাগ্নি বিদ্যুৎ, তখন পলকে পলকে ঝলসিতে থাকে। আমার নিঃশ্বাসে, স্থাবর জঙ্গম উড়িতে থাকে, আমার রবে ব্রক্ষ্মণ্ড কম্পিত হয়।
আবার আমি কেমন মনোরম! যখন পশ্চিম গগনে, সন্ধ্যাকালে লোহিত ভাস্কারাঙ্কে বিহার করিয়া স্বর্ণতরঙ্গের উপর স্বর্ণ-তরঙ্গ বিক্ষিপ্ত করি, তখন কে না আমায় দেখিয়া ভুলে? জ্যোৎস্না পরিস্লুত আকাশে মন্দ পবনে আরোহণ করিয়া, কেমন মনোমোহন মূর্ত্তি ধরিয়া আমি বিচরণ করি। শুন, পৃথিবীবাসীগণ! আমি বড় সুন্দর, তোমরা আমাকে সুন্দর বলিও।
আর একটা কথা আছে, তাহা বলা হইলেই, আমি বৃষ্টি করিতে যাই। পৃথিবীতলে একটা গুণবতী কামিনী আছে, সে আমার মনোহরণ করিয়াছে। সে পর্ব্বত গুহায় বাস করে, তাহার নাম প্রতিধ্বনি। আমার সাড়া পাইলেই সে আসিয়া আমার সঙ্গে আলাপ করে। বোধ হয় আমায় ভাল বাসে। আমিও তাহার আলাপে মুগ্ধ হইয়াছি। তোমরা কেহ সম্বন্ধ করিয়া আমার সঙ্গে তাহার বিবাহ দিতে পার?
বৃষ্টি।
চল নামি – আষাঢ় আসিয়াছে – চল নামি।
আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃষ্টি বিন্দু, একা এক জনে যূথিকাকলির শুষ্ক মুখও ধুইতে পারি না – মল্লিকার ক্ষুদ্র হৃদয় ভরিতে পারি না। কিন্তু আমরা সহস্র সহস্র, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি, – মনে করিলে পৃথিবী ভাসাই। ক্ষুদ্র কে?
দেখ, যে একা, সেই ক্ষুদ্র, সেই সামান্য। যাহার ঐক্য নাই, সেই তুচ্ছ। দেখ, ভাই সকল, কেহ একা নামিও না – অর্দ্ধপথে ঐ প্রচন্ড রবির কিরণে শুকাইয়া যাইবে – চল, সহস্রে, সহস্রে, লক্ষে, লক্ষে, অর্ব্বুদে, অর্ব্বুদে, এই বিশোষিতা পৃথিবী ভাসাইব।
পৃথিবী ভাসাইব। পর্ব্বতের মাথায় চড়িয়া তাহার গলা ধরিয়া, বুকে পা দিয়া, পৃথিবীতে নামিব; নির্ঝরপথে স্ফাটিক হইয়া বাহির হইব। নদী-কুলের শূন্যহৃদয় ভরাইয়া, তাহাদিগকে রূপের বসন পরাইয়া, মহাকল্লোলে ভীমবাদ্য বাজাইয়া, তরঙ্গের উপর তরঙ্গ মারিয়া, মহারঙ্গে ক্রীড়া করিব। এসো, সবে নামি।
কে যুদ্ধ দিবে – বায়ু। ইস্! বায়ুর ঘাড়ে চড়িয়া দেশ দেশান্তর বেড়াইব। আমাদের এ বর্ষাযুদ্ধে, বায়ু ঘোড়া মাত্র; তাহার সাহায্য পাইলে, স্থলে জলে এক করি। তাহার সাহায্য পাইলে বড় বড় গ্রাম, অট্রালিকা, পোত মুখে করিয়া ধুইয়া লইয়া যাই। তাহার ঘাড়ে চড়িয়া, জানালা দিয়া লোকের ঘরে ঢুকি। যুবতীর যত্ননির্ম্মিত শয্যা ভিজাইয়া দিই – সুষুপ্তসুন্দরীর গায়ের উপর গা ঢালি। বায়ু! বায়ু ত আমাদের গোলাম।
দেখ ভাই, কেহ একা নামিও না – ঐক্যেই বল, নহিলে আমরা কেহ নই। চল – আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টি বিন্দু – কিন্তু পৃথিবী রাখিব; শস্যক্ষেত্রে শস্য জন্মাইব – মনুষ্য বাঁচিবে। নদীতে নৌকা চালাইব – মনুষ্যের বাণিজ্য বাঁচিবে। তৃণ লতা বৃক্ষাদির পুষ্টি করিব – পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বাঁচিবে। আমরা ক্ষুদ্র বৃষ্টি বিন্দু – আমাদের সমান কে? আমরাই সংসার রাখি।
তবে আয়, ডেকে ডেকে, হেঁকে হেঁকে, নবনীল কাদম্বিনি! বৃষ্টিকুলপ্রসূতি! আয় মা দিঙ্মণ্ডলব্যাপিনি, সৌরতেজঃসংহারিণি! এসো ভাগিনি সুচারুহাসিনি চঞ্চলে! বৃষ্টিকুলমুখ আলো কর! আমরা ডেকে ডেকে, হেসে হেসে, নেচে নেচে, ভূতলে নামি। তুমি বক্রমর্ম্মভেদী বজ্র, তুমিও ডাক না – এ উৎসবে তোমার মত বাজনা কে? তুমিও ভূতলে পড়িবে? পড়, কিন্তু কেবল গর্ব্বোন্নতের মস্তকের উপর পড়িও। এই ক্ষুদ্র পরোপকারী শস্যমধ্যে পড়িও না – আমরা তাহাদের বাঁচাইতে যাইতেছি। ভাঙ্গ ত এই পর্ব্বত শৃঙ্গ ভাঙ্গ; পোড়াও ত ঐ উচ্চ দেবালয়চূড়া পোড়াও। ক্ষুদ্রকে কিছু বলিও না – আমরা ক্ষুদ্র – ক্ষুদ্রের জন্য আমাদের বড় ব্যথা।
দেখ, দেখ, আমাদের দেখিয়া পৃথিবীর আহ্লাদ দেখ! গাছপালা মাথা নাড়িতেছে – নদী দুলিতেছে, ধান্যক্ষেত্র মাথা নাড়াইয়া প্রণাম করিতেছে – চাসা চসিতেছে – ছেলে ভিজিতেছে – কেবল বেনে বউ আমসী ও আমসত্ত্ব লইয়া পলাইতেছে। মর্ পাপিষ্ঠা! দুই একখানা রেখে যা না – আমরা খাব। দে মাগির কাপড় ভিজিয়ে দে!
আমরা জাতিতে জল, কিন্তু রঙ্গ রস জানি। লোকের চাল ফুটা করিয়া ঘরে উকি মারি – দম্পতীর গৃহে ছাদ ফুটা করিয়া টু দিই। যে পথে সুন্দর বৌ জলের কলসী লইয়া যাইবে, সেই পথে পিছল করিয়া রাখি। মল্লিকার মধু ধুইয়া লইয়া গিয়া, ভ্রমরের অন্ন মারি। মুড়ি মুড়কির দোকান দেখিল প্রায় ফলার মাখিয়া দিয়া যাই। রামী চাকরাণী কাপড় শুকাইতে দিলে, প্রায় তাহার কাজ বাড়াইয়া রাখি। ভন্ড বামুনের জন্য আচমনীয় যাইতেছে দেখিলে, তাহার জাত মারি। আমরা কি কম পাত্র! তোমরা সবাই বল – আমরা রসিক।
তা যাক্ – আমাদের বল দেখ। দেখ পর্ব্বত, কন্দর, দেশ প্রদেশ, ধুইয়া লইয়া, নূতন দেশ নিন্মার্ণ করিব। বিশীর্ণা সূত্রাকারা তটিনীকে, কূলপ্লাবিনী দেশমজ্জিনী অনন্তদেহধারিণী অনন্ততরঙ্গিণী জলরাক্ষসী করিব। কোন দেশের মানুষ রাখিব – কোন দেশের মানুষ মারিব – কত জাহাজ বহিব, কত জাহাজ ডুবাইব – পৃথিবী জলময় করিব – অথচ আমরা কি ক্ষুদ্র! আমাদের মত ক্ষুদ্র কে? আমাদের মত বলবান্ কে!
খদ্যোত।
খদ্যোত যে কেন আমাদিগের উপহাসের স্থল, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। বোধ হয় চন্দ্র সূর্য্যাদি বৃহৎ আলোকধার সংসারে আছে বলিয়াই জোনাকির এত অপমান। যেখানেই অল্পগুণ-বিশিষ্ট ব্যক্তিকে উপহাস করিতে হইবে, সেই খানেই বক্তা বা লেখক জোনাকির আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু আমি দেখিতে পাই যে জোনাকির অল্প হউক অধিক হউক কিছু আলো আছে – কই আমাদের ত কিছুই নাই। এই অন্ধকারে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া কাহার পথ আলো করিলাম? কে আমাকে দেখিয়া, অন্ধকারে, দুস্তরে, প্রান্তরে, দুর্দ্দিনে, বিপদে, বিপাকে, বলিয়াছে, এসো ভাই, চল চল, ঐ দেখ আলো জ্বলিতেছে, চল ঐ আলো দেখিয়া পথ চল? অন্ধকার! এ পৃথিবী ভাই বড় অন্ধকার! পথ চলিতে পারি না। যখন চন্দ্র সূর্য্য থাকে, তখন পথ চলি – নহিলে পারি না। তারাগণ আকাশে উঠিয়া, কিছু আলো করে বটে, কিন্তু দুর্দ্দিনে ত তাহাদের দেখিতে পাই না। চন্দ্রসূর্য্যও সুদিনে-দুর্দ্দিনে, দুঃসময়ে, যখন মেঘের ঘটা, বিদ্যুতের ছটা, একে রাত্রি, তাহাতে ঘোর বর্ষা, তখন কেহ না। মনুষ্যনর্ম্মিত যন্ত্রের ন্যায় তাহারাও বলে – “Hora non numero nisi serences!” কেবল তুমি খদ্যোত, – ক্ষুদ্র, হীনভাস, ঘৃণিত, সহজে হন্য, সর্ব্বদা হত – তুমিই সেই অন্ধকার দুর্দ্দিনে বর্ষাবৃষ্টিতে দেখা দাও। তুমিই অন্ধকারে আলো। আমি তোমাকে ভাল বাসি।
আমি তোমায় ভাল বাসি, কেন না, তোমার অল্প, অতি অল্প, আলো আছে – আমিও মনে করি আমারও অল্প, অতি অল্প, আলো আছে – তুমিও অন্ধকারে, আমিও ভাই, ঘোর অন্ধকারে। অন্ধকারে সুখ নাই কি? তুমিও অনেক অন্ধকারে বেড়াইয়াছ – তুমি বল দেখি? যখন নিশীথমেঘে জগৎ আচ্ছন্ন, বর্ষা হইতেছে ছাড়িতেছে, ছাড়িতেছে হইতেছে; চন্দ্র নাই, তারা নাই, আকাশের নীলিমা নাই, পৃথিবীর দীপ নাই – প্রস্ফূটিত কুসুমের শোভা পর্য্যন্ত নাই – কেবল অন্ধকার, অন্ধকার! কেবল অন্ধকার আছে – আর তুমি আছ – তখন, বল দেখি, অন্ধকারে কি সুখ নাই? সেই তপ্ত রৌদ্রপ্রদীপ্ত কর্কশ স্পর্শপীড়িত, কঠোর শব্দে শব্দায়মান অসহ্য সংসারের পরিবর্ত্তে, সংসার আর তুমি! জগতে অন্ধকার; আর মুদিত কামিনীকুসুম জলনিসেক-তরুণায়িত বৃক্ষের পাতায় পাতায় তুমি! বল দেখি ভাই, সুখ আছে কি না?
আমি ত বলি আছে। নহিলে কি সাহসে, তুমি ঐ বন্যান্ধকারে, আমি এই সামাজিক অন্ধকারে, এই ঘোর দুর্দ্দিনে ক্ষুদ্র আলোকে আলোকিত করিতে চেষ্টা করিতাম? আছে – অন্ধকারে মাতিয়া আমোদ আছে। কেহ দেখিবে না – অন্ধকারে তুমি জ্বলিবে – আর অন্ধকারে আমি জ্বলিব; অনেক জ্বালায় জ্বলিব। জীবনের তাৎপর্য্য বুঝিতে অতি কঠিন – অতি গূঢ়, অতি ভয়ঙ্কর – ক্ষুদ্র হইয়া তুমি কেন জ্বল, ক্ষুদ্র হইয়া আমি কেন জ্বলি? তুমি ভাব কি? আমি ভাবি। তুমি যদি না ভাব, তুমি সুখী। আমি ভাবি – আমি অসুখী। তুমিও কীট – আমিও কীট, ক্ষুদ্রাধিক ক্ষুদ্র কীট – তুমি সুখী, – কোন্ পাপে আমি অসুখী? তুমি ভাব কি? তুমি কেন জগৎসবিতা সূর্য্য হইলে না, এককালীন আকাশ ও সমুদ্রের শোভা যে সুধাকর, কেন তাই হইলে না – কেন গ্রহ উপগ্রহ ধূমকেতু নীহারিকা, – কিছু না হইয়া কেবল জোনাকি হইলে, ভাব কি? যিনি, এ সকল সৃজন করিয়াছেন, যিনিই উহাদিগকে আলোক দিয়াছেন, তিনিই তোমাকে আলোক দিয়াছেন – তিনি একের বেলা বড় ছাঁদে – অন্যের বেলা ছোট ছাঁদে, গড়িলেন কেন? অন্ধকারে, এত বেড়াইলে, ভাবিয়া কিছু পাইয়াছ কি?
তুমি ভাব না ভাব, আমি ভাবি। আমি ভাবিয়া স্থির করিয়াছি, যে বিধাতা তোমায় আমায় কেবল অন্ধকার রাত্রের জন্য পাঠাইয়াছেন। আলো একই – তোমার আলো ও সূর্য্যের – উভয়ই জগদীশ্বরপ্রেরিত – তবে তুমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য, আমি কেবল বর্ষার রাত্রের জন্য। এসো কাঁদি।
এসো কাঁদি – বর্ষার সঙ্গে, তোমার আমার সঙ্গে নিত্য সম্বন্ধ কেন? আলোকময়, নক্ষত্রপ্রোজ্জ্বল বসন্তগগনে তোমার আমার স্থান নাই কেন? বসন্ত, চন্দ্রের জন্য সুখীর জন্য, নিশ্চিন্তের জন্য; – বর্ষা তোমার জন্য, দুঃখীর জন্য, আমার জন্য। সেই জন্য কাঁদিতে চাহিতেছিলাম – কিন্তু কাঁদিব না। যিনি তোমার আমার জন্য এই সংসার অন্ধকারময় করিয়াছেন, কাঁদিয়া তাঁহাকে দোষ দিব না। যদি অন্ধকারের সঙ্গে তোমার আমার নিত্য সম্বন্ধই তাঁহার ইচ্ছা, আইস অন্ধকারই ভাল বাসি। আইস, নবীন নীল কাদম্বিনী দেখিয়া, এই অনন্ত অসংখ্য জগন্ময় ভাষণ বিশ্বমন্ডলের করাল ছায়া অনুভূত করি; মেঘর্জ্জন শুনিয়া, সর্ব্বধ্বংসকারী কালের অবিশ্রান্ত গর্জ্জন স্মরণ করি; – বিদ্দ্যুদ্দাম দেখিয়া, কালের কটাক্ষ মনে করি। মনে করি, এই সংসার ভয়ঙ্কর, ক্ষণিক, – তুমি আমি ক্ষণিক, বর্ষার জন্যই প্রেরিত হইয়াছিলাম; কাঁদিবার কথা নাই। আইস নীরবে, জ্বলিতে জ্বলিতে, অনেক জ্বালায় জ্বলিতে জ্বলিতে, সকল সহ্য করি।
নহিলে, আইস, মরি। তুমি দীপালোক বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মর, আমি আশারূপ প্রবল প্রোজ্জ্বল মহাদীপ বেড়িয়া বেড়িয়া পুড়িয়া মরি। দীপালোকে তোমার কি মোহিনী আছে জানি না – আশার আলোকে আমার যে মোহিনী আছে, তাহা জানি। এ আলোকে কতবার ঝাঁপ দিয়া পড়িলাম, কতবার পুড়িলাম, কিন্তু মরিলাম না। এ মোহিনী কি আমি জানি। জ্যোতিষ্মান্ হইয়া এ সংসারে আলো বিতরণ করিব – বড় সাধ; কিন্তু হায়! আমরা খদ্যোত! এ আলোকে কিছুই আলোকিত হইবে না। কাজ নাই। তুমি ঐ বকুলকুঞ্জকিসলয়কৃত অন্ধকার মধ্যে, তোমার ক্ষুদ্র আলোক নিবাও, আমিও জলে হউক, স্থলে হউক, রোগে হউক, দুঃখে হউক, এ ক্ষুদ্র দীপ নিবাই।
মনুষ্য-খদ্যোত।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়
Latest posts by বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (see all)
- পাঠ্যপুস্তক: সহজ রচনা শিক্ষা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় - জানুয়ারি 3, 2022
- বঙ্গদর্শনের পত্রসূচনা - অক্টোবর 2, 2020
- বঙ্কিম’স এডভাইস - জুলাই 13, 2017