Main menu

পাঠ্যপুস্তক: সহজ রচনা শিক্ষা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

জীবনের শেষদিকে আইসা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দুইটা পাঠ্যপুস্তক লেখছিলেন। একটা হইতেছে “সহজ ইংরেজি শিক্ষা”; যেইটা কোন কপি এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। আরেকটা হইতেছে “সহজ রচনা শিক্ষা”। অইটারও আদি-কপি নাই, উনি মারা যাওয়ার পরে কয়েকটা এডিশন ছাপা হইছিল। এর মধ্যে ১৮৯৮ সালে ছাপা হওয়া ফোর্থ এডিশন’টা বঙ্কিম রচনাবলী’তে পাওয়া যায়। অই লেখাটাই কিছু অংশ বাদ দিয়া [যেই উদাহারণগুলা খুববেশি রিলিভেন্ট না আর] এইখানে ছাপাইতেছি আমরা।

২.
উনার লেখা খুবই লজিক্যাল, এবং এখনো পড়লে বুঝতে পারার কথা। একটা সাবজেক্ট নিয়া লেখতে গেলে কেমনে লেখবেন সেইটা চাইরটা চ্যাপ্টারে বলছেন উনি। সবচে জরুরি ব্যাপার হইতেছে, কিছু জিনিসের যে কিছু নিয়ম আছে বা থাকাটা ভালো, আর কিছু জিনিস যে নিয়মের মধ্যে আনতে গেলে ঝামেলার – এই আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা উনার খুব ভালোভাবে ছিল। এইটা এখনকার দিনেও পাই না আমরা তেমন। 

আর উনার সব নিয়ম যে এখনকার দিনে ভ্যালিড – অইটা মাইনা নেয়ার মতো বাধ্য স্টুডেন্ট হওয়াটাও ঠিক হবে না, কিন্তু উনার সাজেশনগুলা ইন্টারেস্টিং একটা রিডিং হইতে পারে, এখনো। এই জায়গা থিকা লেখাটা শেয়ার করতেছি আমরা।  

এডিটর, বাছবিচার
… … …


উপক্রমণিকা

আমরা যাহা মনে করি, তাহা লােকের কাছে প্রকাশ করিতে হইলে, হয় মুখে মুখে বলি, নয় লিখিয়া প্রকাশ করি। মুখে মুখে বলিলে, লােকে তাহাকে কথােপকথন, বা অবস্থাবিশেষে বক্তৃতা বলে। লিখিয়া প্রকাশ করিতে হইলে, চিঠি, সংবাদপত্র, পুস্তক ইত্যাদিতে প্রকাশ করা যায়।

কিন্তু মুখেই বলি, আর লিখিয়াই বলি, বলিবার সময়ে কথাগুলি একট, সাজাইয়া লইতে হয়। সাজাইয়া না বলিলে, হয়ত তুমি যাহাকে বলিতেছ, সে তােমার সকল কথা বুঝিতে পারিবে না, নয়ত সে কথাগুলি গ্রাহ্য করবে না। এই সাজানকে রচনা বলে।

রচনা অতি সহজ। মুখে মুখে কহিবার সময়েও আমরা সাজাইয়া কথা কই, তাহা না করিলে কেহ আমাদের কথা বুঝিতে পারিত না। অতএব যে মুখে মুখে কথােপকথন করিতে পারে, লিখিতে জানিলে সেও অবশ্য লিখিত রচনা করিতে পারে। তবে সকল কাজই অভ্যাসাধীন। মৌখিক রচনায় সকলেরই অভ্যাস আছে। লিখিত রচনায় যাহাদের অভ্যাস নাই, তাহাদিগকে অভ্যাস করিতে হইবে। সেই অভ্যাস করাইবার জন্য এই পুস্তকের প্রথম অধ্যায় লিখিলাম।

আর মৌখিক রচনার সঙ্গে লিখিত রচনার একট, প্রভেদ এই আছে যে, লিখিত রচনার কতকগুলি নিয়ম আছে; সে নিয়মগুলি মৌখিক রচনায় বড় মানা যায় না, না মানিলেও বিশেষ ক্ষতি নাই, কিন্তু লিখিত রচনায় না মানিলেই নয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে সেই নিয়মগুলি বুঝাইব। তৃতীয় অধ্যায়ে রচনা শিখাইব।

প্রথম অধ্যায়: রচনা অভ্যাস

প্রথম পাঠ

রাম খাইতেছে। পাখী উড়িতেছে। হরি পীড়িত হইয়াছে। মানুষ মরিয়া যায়। এইগুলিকে এক একটি বাক্য, উক্তি, বা পদ বলা যায়।

“রাম খাইতেছে”—এই বাক্যে কাহার কথা বলা যাইতেছে? রামের কথা। অতএব রাম এই বাক্যের “বিষয়”।

“পাখী উড়িতেছে”-কাহার কথা বলিতেছি? পাখীর কথা। “হরি পীড়িত হইয়াছে— কাহার কথা বলিতেছি ? হরির কথা। “মানুষ মরিয়া যায়”-কাহার কথা বলিতেছি ? মানুষের কথা। পাখী, হরি, মানুষ ইহারা ঐ ঐ বাক্যের বিষয়।

“রাম খাইতেছে” এখানে রামের কথা বলিতেছি বটে, কিন্তু রামের কি কথা বলিতেছি ? সে “খাইতেছে”—তাহার খাবার কথা বলিতেছি। “খাইতেছে”“হইল বক্তব্য।

“পাখী উড়িতেছে।” “উড়িতেছে” বক্তব্য। “ঘদ, পীড়িত হইয়াছে।” পীড়া এখানে বক্তব্য। “মানুষ মরিয়া যায়। মরা এখানে বক্তব্য।

অতএব সকল বাক্যে, দুইটি বস্তু থাকে; একটি বিষয়” আর একটি বক্তব্য”।

এই দুইটিই না থাকিলে বাক্য বলা সম্পূর্ণ হয় না। শুধু, “গােরু,” বলিলে, তুমি বুঝিতে পারিবে না যে, আমার বলিবার কথা কি। কিন্তু “গােরু চরিতেছে” বলিলেই তুমি বুঝিতে পারিলে। বাক্য সম্পূর্ণ হইল। শুধ, “ভাসিতেছে” বলিলে তুমি বুঝিতে পার না যে, আমার বলিবার ইচ্ছা কি। তুমি জিজ্ঞাসা করিবে, কি ভাসিতেছে ? কিন্তু যদি বলি যে, “কুম্ভীর ভাসিতেছে” বা “নৌকা ভাসিতেছে” বাক্য সম্পূর্ণ হইল–তুমি বুঝিতে পারিলে।

দ্বিতীয় পাঠ

কখন কখন বিষয়ের কোন গণ কি দোষ আগে লিখিয়া তার পর বক্তব্য লিখিতে হয়। যেমন “সুন্দর পাখী উড়িতেছে।” “দুঃখী হরি পীড়িত হইয়াছে।” এখানে, পাখীটির একটি গুণ যে, সে সুন্দর; ইহা বলা হইল। হরির একটি দোষ যে, সে দুঃখী; ইহা বলা হইল। এগুলিকে বিশেষণ বলে। “সুন্দর” “দুঃখী” এই দুটি বিশেষণ। যাহার বিশেষণ, তাহাকে বিশেষ্য বলে। “পাখী” “হরি” ইহারা বিশেষ্য।

বিশেষণ উপযুক্ত হইতে পারে, অনুপযুক্তও হইতে পারে। উপযুক্ত বিশেষণ, যেমন, ফলবান, বক্ষ। নিৰ্ম্মল আকাশ। বলবান, মনুষ্য।।

বেগবতী নদী। অনুপযুক্ত বিশেষণ, যেমন, নিম্মল বৃক্ষ। ফলবান, মনুষ্য। বেগবান, আকাশ। এইগুলি অনুপযুক্ত। বৃক্ষের সমলতা বা নিম্মলতা নাই, এই জন্য নিম্মল বৃক্ষ বলা যায় । মানুষে কোন ফল ফলে না, এই জন্য ফলবান মনুষ্য বলা যায় না। আকাশের বেগ নাই, এজন্য বেগবান আকাশ বলা যায় না। যে বিশেষণ উপযুক্ত তাহাই লিখিবে, যাহা অনুপযুক্ত তাহা লিখিও না।

তৃতীয় পাঠ

“ফলবান, বক্ষ”, “বলবান, পরষ”, “নির্মল আকাশ”, “বেগবতী নদী” বলিলে বাক্য সম্পূণ হইল না। “ফলবান, বৃক্ষ” সম্বন্ধে কি বলিতেছ? “বলবান, পুরুষ” সম্বন্ধে কি বলিতে চাও? এখানে ফলবান বৃক্ষ”, “বলবান, পরষ” বিষয়; কিন্তু বক্তব্য কই? বক্তব্য লিখিলে তবে বাক্য সম্পূর্ণ হইবে। যেমন, ফলবান বক্ষ কাটিও না। নির্মল আকাশ দেখিতে সুন্দর। | বলবান, পরয সাহসী হয়। বেগবতী নদী বহিতেছে।

ফলবান, বক্ষ,” “বলবান, পরষ” বলিলে বাক্য সম্পূর্ণ হয় না বটে, কিন্তু যদি বলি “বক্ষ ফলবান,” “মনুষ্য বলবান, তাহা হইলে বাক্য সম্পূর্ণ হয়। তাহার কারণ সহজে বুঝিতে পারিবে। “ফলবান বক্ষ” বলিলে, “ফলবান বৃক্ষ”ই বিষয় হইল, বক্তব্য নাই। কিন্তু “বক্ষ ফলবান” বলিলে বক্ষ বিষয় হইলফলবত্ত্বা তাহার বক্তব্য। “বক্ষ ফলবান” এ কথায় এই বুঝায় যে, বক্ষে ফল হয়। মানুষ বলবান” বলিলে বুঝাইবে, “মানুষের বল আছে।”

দেখ, দুই রকমে এক বক্তব্য প্রকাশ করা যায়। যথা, বৃক্ষ ফলবান। মনুষ্য বলবান। বক্ষে ফল হয়।

মানুষের বল আছে । আকাশ নির্মল।
নদী বেগবতী। আকাশের নিশ্মলতা আছে।
নদীর বেগ আছে। আকাশ নিৰ্ম্মল হইয়াছে।

“আছে” “হয়” “হইয়াছে” এইগলিকে ক্রিয়া বলে। যাহাতে একটা কাজ বুঝায়, কিম্বা অবস্থান্তরপ্রাপ্তি বুঝায়, তাহাকেই ক্রিয়া বলে। ধরিল, থাকিল, যাইল, শয়ন করিল, ভক্ষণ করিল, নিবেদন করিল—এ সব ক্রিয়া।

অতএব বক্তব্য দুই প্রকারে প্রকাশ করা যায়, এক প্রকার বিশেষণ দ্বারা, যেমন “বক্ষ ফলবান”; আর এক প্রকার ক্রিয়া দ্বারা, যেমন—“বক্ষে ফল হয়।”

চতুর্থ পাঠ

বিশেষণের আবার বিশেষণ হয়, যেমন অতিশয় ভারী। প্রচণ্ড তেজস্বী। প্রগাঢ় অন্ধকার। ইহাতে বিশেষ্য যােগ করা যায়; যথা অতিশয় ভারী লােহা। প্রচণ্ড তেজস্বী অগ্নি। প্রগাঢ় অন্ধকার রাত্রি। অথবা, লােহা অতিশয় ভারী। সয্য প্রচণ্ড তেজস্বী। বর্ষার রাত্রি প্রগাঢ় অন্ধকার। আবার ক্রিয়ারও বিশেষণ আছে, যেমন মদ, হাসিতেছে। দারুণ জলিতেছে। শীঘ্ন যাইতেছে। ভালরুপে মেরামত করিতেছে।

পঞ্চম পাঠ

এখন বিষয়, বক্তব্য, বিশেষণ, ক্রিয়ার বিশেষণ, এই সকল লইয়া বাক্যরচনা করিতে শিখ। একটা বিষয় লও। “রাক্ষস”। বক্তব্য-তাহার বিনাশবাক্য এইরপে লিখিতে হইবে। | “রাক্ষস বিনষ্ট হইল।” এখন বিশেষণ যােগ কর। প্রথম বিষয়ের বিশেষণ লেখ। “পাপিঠ রাক্ষসেরা বিনষ্ট হইল।” তার পর ক্রিয়ার বিশেষণ লেখ। “পাপিষ্ঠ রাক্ষসেরা নিঃশেষে বিনষ্ট হইল।” তার পর ইচ্ছা করিলে, “পাপিঠে” বিশেষণের বিশেষণ দিতে পার। “চিরপাপিষ্ঠ রাক্ষসেরা নিঃশেষে বিনষ্ট হইল।”

যষ্ঠ পাঠ

কখন কখন বাক্য সম্পূর্ণ হইলেও, আরও কিছুর আকাঙ্ক্ষা থাকে। “চিরপাপিষ্ঠ রাক্ষসেরা নিঃশেষে বিনষ্ট হইল” এই বাক্যটি সম্পূর্ণ বটে, কিন্তু ইহাতে কিছু, আকাক্ষা রহিল। কৰ্ম্ম আছে কিন্তু কৰ্ত্তা নাই। রাক্ষসেরা বিনষ্ট হইল, আমরা জানিতেছি; কিন্তু কে তাহাদের বিনষ্টকারী, তাহা জানিতে পারিতেছি না। অতএব আকাঙ্ক্ষা পূরণ কর। যথা “বানরের দ্বারা চিরপাপিষ্ঠ রাক্ষসেরা নিঃশেষে বিনষ্ট হইল।” আবার বানরের বিশেষণ দিতে পার।

অষ্টম পাঠ

অনেক বালককে প্রবন্ধ লিখিতে বলিলে তাহারা খুজিয়া পায় না যে, কি লিখিতে হইবে। যদি বলা যায় যে, অশ্ব সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লেখ; তাহারা খজিয়া পায় না যে, অশ্ব সম্বন্ধে কি প্রবন্ধ লিখিবে। এই সকল বালকের সাহায্য জন্য কতকগুলি যুক্তি বলিয়া দিতেছি।

১। প্রথমে বিষয়টি কি তাহা বর্ণনা করিবে।

২। তার পর তাহার জাতিভেদ বা প্রকারভেদ বা সে সম্বন্ধে মতভেদ থাকিলে তাহা বুঝাইবে।

৩। তাহার দোষগণের বা কার্যের বিচার করিবে।

৪। কিসে সেই বিষয়ে মনুষ্যের উপকার বা উন্নতি হইতে পারে, তাহার বিচার করিবে।

অশ্বের উদাহরণে ইহা বুঝাইতেছি।

১। বর্ণনা অশ্ব চতুষ্পদ জন্তু বিশেষ।

২। জাতিভেদ অশ্ব অনেক জাতীয় আছে যথা আরবী, কালী, তুরকী, ওয়েলর, টাট ইত্যাদি।

৩। গণ দোষ বিচার অশ্ব, পশজাতি মধ্যে বিশেষ বলবান ও দ্রুতগামী। অশ্বের আরও গুণ এই যে, অশ্ব সহজে মনুষ্যের বশ হয়। এজন্য মানুষ অশ্ব হইতে অনেক উপকার পায়।

৪। উপকার। মনুষ্য অশ্বকে বশ করিয়া তাহার পণ্ঠে আরােহণ পৰ্ব্বক যথেচ্ছা ভ্রমণ করে। যে পথ অনেক বিলম্বে যাইতে হইত, অথবা শ্ৰমাধিক্যবশতঃ যাওয়াই যাইত না, অশ্বের সাহায্যে তাহা অল্প সময়ে যাওয়া যায়। মনুষ্য গাড়ি প্রস্তুত করিয়া, তাহাতে অশ্বযােজন করিয়া, সুখে আসীন হইয়া বিচরণ করে। যুদ্ধকালে অশ্ব, যােদ্ধার বিশেষ সহায় । ইহা ভিন্ন অনেক দেশে অশ্বের দ্বারা ভারবহন ও হলাকর্ষণ কার্যও নির্বাহ হয়।

এই যে উদাহরণ দেওয়া গেল, ইহা সংক্ষিপ্ত। ইচ্ছা কবৃিলে ইহার সম্প্রসারণ করতে পার। যথা, বর্ণনায়—“অশ্ব চতুষ্পদ জন্তু বিশেষ” লেখা গিয়াছে। কিন্তু চতুষ্পদ জন্তু, কেহ মাংসাহারী, কেহ উদ্ভিজ্জাহারী, কেহ উভয়াহারী। অতএব অশ্ব ইহার কোন শ্রেণীভুক্ত, তাহা লেখা উচিত। যথা—

“অশ্ব উদ্ভিজ্জ মাত্র খায়, মাংস খায় না।” কিন্তু আরও অনেক চতুষ্পদ আছে যে, তাহারা কেবল উদ্ভিজ্জ খায়। যথা, গােমহিষাদি। অতএব আরও বিশেষ করিয়া লিখিতে পার যে, “যে সকল চতুষ্পদ উদ্ভিজ্জাহারী, তাহাদের মধ্যে কতকগুলির শব্দ আছে, কতকগুলির শব্দ নাই। অশ্ব দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে।”

এইরুপ আরও সম্প্রসারণ করা যায়। এইরুপে (২) জাতিভেদ, (৩) দোষ-গুণ, (৪) উপকার – এ সকলেরও সম্প্রসারণ করা যায়।

ইহাও স্মরণ রাখিবে যে, সকল বিষয়েই প্রবন্ধকে ঐরপ চারি ভাগে বিভক্ত করা যায় না। কখন কোনটি ছাড়িয়া দিতে হয়। যথা, চন্দ্র সর্যের জাতিভেদ নাই–উহা ছাড়িয়া দিবে; তবে চন্দ্ৰ সৰ্য সম্বন্ধে লােকের মতভেদ আছে, পার ত, তাহা লিখিবে। আর এই চারিটি ভাগ ছাড়া আর যাহা কিছু, বক্তব্য লিখিতে চাও তাহাতে আপত্তি নাই। বিশেষ কোন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখিতে গেলে পৰ্ব্বগামী লেখকদিগের মত সকলন করা প্রথা আছে; আবশ্যক মতে তাহা করিতে পার। ভাল বুঝিলে তাহার প্রতিবাদ করিতে পার।

দ্বিতীয় অধ্যায়

প্রথম পাঠ

বিশুদ্ধ রচনার চারিটি গুণ বিশেষ করিয়া শিখিতে হইবে। এই চারিটির নাম (১) বিশুদ্ধি, (২) অর্থব্যক্তি, (৩) প্রাঞ্জলতা, (৪) অলঙ্কার।

প্রথমে বিশুদ্ধি। রচনার ভাষা শুদ্ধ না হইলে সব নষ্ট হইল। বিশুদ্ধির প্রতি সর্বাগ্রে মনােযােগ করিতে হইবে। বিশদ্ধি সৰ্ব্বপ্রধান গুণ। যাহা বিশুদ্ধ নহে, তাহা অশুদ্ধ। কি হইলে রচনা অশুদ্ধ হয়, তাহা বুঝিলেই, বিশুদ্ধি কি তাহা বুঝিবে।

পৰ্বেই বলিয়াছি যে মৌখিক রচনা যেরপ, লিখিত রচনাও সেইরপ; তবে কিছু প্রভেদ আছে। লিখিত রচনা কতকগুলি নিয়মের অধীন, মৌখিক রচনা সে সব নিয়মের অধীন নয়। অথবা অধীন হইলেও মৌখিক রচনায় সে সকল নিয়ম লঙ্ঘনে দোষ ধরা যায় না। লিখিত রচনায় যে সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলে দোষ ধরিতে হয়, সেই সকল নিয়ম লঙ্ঘিত হইলেই রচনা অশুদ্ধ হইল। সেই সকল দোষের কথা এখন লিখিতেছি।

১। বর্ণাশদ্ধি। মখে সকলেই বলে, “পষ্ট” “মেগ” “শপত” “শট” “বাঁদ” “ দল” “নেত্য” কিন্তু লিখিতে হইবে “পষ্ট, মেঘ, শপথ, শঠ, বাঁধ, দল, নত্য।”

২। সংক্ষিপ্ত। মুখে বলি, “কোরে” “কচ্চি” “করব” “কলম” “কচ্ছিলম” কিন্তু লিখিতে হইবে, “করিয়া” “করিতেছি” “করিব” “করিলাম” “করিতেছিলাম” ইত্যাদি।

৩। প্রাদেশিকতা। বাঙ্গালার কোন প্রদেশের লােকে বলে, “কলম”, কোন প্রদেশে, “কল্লেম”, কোথাও, “কল্লাম”, কোথাও “ক”। কোন প্রদেশবিশেষেরই ভাষা ব্যবহার করা হইবে না;~ যাহা লিখিত ভাষায় চিরপ্রচলিত, তাহাই ব্যবহৃত হইবে।

অন্যান্য স্থানের অপেক্ষা রাজধানীর ভাষাই সমধিক পরিচিত। অতএব রাজধানীর ভদ্র সমাজে যে ভাষা চলিত তাহা লিখিত রচনায় ব্যবহৃত হইতে পারে। কোন দেশে বলে “ছড়ি” কোন দেশে বলে “নড়ি”। “ছড়ি” কলিকাতার ভদ্রসমাজে চলিত। উহা ব্যবহৃত হইতে পারে।

লগি” “লগা” “চৈড়–ইহার মধ্যে লগিই কলিকাতায় চলিত, উহাই ব্যবহৃত হইতে পারে। অপর দুইটি ব্যবহৃত হইতে পারে না।

৪। গ্রাম্যতা। কেবল ইতর লােক বা গ্রাম্য লােকের মধ্যে যে সকল শব্দ প্রচলিত, তাহা ব্যবহৃত হইতে পারে না। “কৌশল্যার পাে রাম,” “দশরথের বেটা লক্ষণ,” এ সকল বাক্য গ্রামাত-দোষে দুষ্ট।

নাটক ও উপন্যাস গ্রন্থে, যে স্থানে কথােপকথন লিখিত হইতেছে, সেখানে এই চারিটি দোষ অর্থাৎ বর্ণাশদ্ধি, সংক্ষিপ্ত, প্রাদেশিকতা ও গ্রামাতা থাকিলে দোষ ধরা যায় না। কেন না মৌখিক রচনা এ সকল নিয়মের অধীন নহে বলিয়াছি। কথােপকথন মৌখিক রচনা মাত্র। কবিতা রচনাতেও অনেক স্থানে এ সকল নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়।

৫। ব্যাকরণ-দোষ। রচনায় ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি বজায় রাখিতে হইবে। ব্যাকরণের সকল নিয়মগুলি এখানে লেখা যাইতে পারে না তাহা হইলে এইখানে একখানি ব্যাকরণের গ্রন্থ লিখিতে হয়। কিন্তু উদাহরণস্বরপ দুই একটা সাধারণ নিয়ম বুঝাইয়া দেওয়া যাইতেছে।

সন্ধি। সংস্কৃতের নিয়ম, সন্ধির যােগ্য দুইটি বর্ণ একত্রে থাকিলে সকল স্থানেই সন্ধি হইবে। কিন্তু বাঙ্গালার নিয়ম তাহা নহে, বাঙ্গালার সমাস ব্যতীত সন্ধি হয় না। যে দুইটি শব্দে সমাস হয় না, সে দুইটি শব্দে সন্ধিও হইবে না।

সহজ উদাহরণ;—“সঃ অস্তিঃ, সংস্কৃতে, “সােহস্তি” হইবে; কিন্তু বাঙ্গালায় “তিনি আছেন” “তিন্যাছেন” হইবে না। “অঙ্গলি” উখিত” এই দুইটি শব্দ সংস্কৃতে যে অবস্থায় থাকুক না কেন, মধ্যে আর কিছু না থাকিলে, “অঙ্গলখিত হইয়া যাইবে, কিন্তু বাঙ্গালায় যদি বলি, “তিনি অঙ্গলি উথিত করিলেন,” সে স্থলে “তিনি অঙ্গলথিত করিলেন,” এরপ কখনই লিখিতে পারিব না। কেন না এখানে সমাস নাই।

বাঙ্গালায় সন্ধির দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, সংস্কৃতে ও অসংস্কৃতে কখন সন্ধি হইবে না। “আমার অঙ্গলি” বলিতে হইবে, “আমারাঙ্গলি” হয় না। সন্ধি করিতে হইলে, “মমাঙ্গলি” বলিবে, সেও ভাল বাঙ্গালা হয় না—কেন না সমাস নাই। “মড়াহারী পক্ষী” বলা যায় না; “শবাহারী” বলিতে হইবে। “গাধাকৃত পশ” বলা যায় না; “গর্দভাকৃত” বলিতে হইবে। সকলেই “মনান্তর” বলে, কিন্তু ইহা অশুদ্ধ। কেন না “মন” বাঙ্গালা শব্দ; সংস্কৃত মনস, প্রথমায় মনঃ, এজন্য, “মনােদঃখ”, “মনােরথ শুদ্ধ।

তৃতীয় নিয়ম। যদি দুইটি শব্দই অসংস্কৃত হয়, তবে কখনই সন্ধি হইবে না। যথা, “পাকা আতা” সন্ধি হয় না।

সমাস। সমাসেরও নিয়ম ঐরপ; সংস্কৃতে এবং অসংস্কৃতে সমাস হয় না। যেমন, “মহকুমাধ্যক্ষ”; “উকীলাগ্রগণ্য”; “মােক্তারাদি” এ সকল অশদ্ধ। অথচ এরপ অশদ্ধি এখন সচরাচর দেখা যায়।

উভয় শব্দ সংস্কৃত হইলেও সমাস করা না করা লেখকের ইচ্ছাধীন। “অধরের অমত” বলিতে পার, অথবা “অধরামত” বলিতে পার। “অধরামত” বলিলে সমাস হইল, “অধরের অমত” বলিলে সমাস হইল না। সন্ধি করা না করাও লেখকের ইচ্ছাধীন। কেহ লেখেন “অধরামত”, কেহ লেখেন “অধর অমত”।

বাঙ্গালায় সন্ধি সমাসের বাহুল্য ভাল নহে। সহজ রচনায় উহা যত কম হয়, তত ভাল।

প্রত্যয়। প্রত্যয় সম্বন্ধে সংস্কৃতের যে নিয়ম, বাঙ্গালা রচনায় সংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহারকালে সেই সকল বজায় রাখিতে হইবে। “সৌজন্যতা” “ঐক্যতা” এ সকল অশদ্ধ। “সৌজন্য” ‘ঐক্য” এইরূপ হইবে।

সংস্কৃত শব্দের পরে অসংস্কৃত প্রত্যয় ব্যবহার হইতে পারে না। “মখামি” বলা যায় না, কেন না “মখ” সংস্কৃত শব্দ, “মি” সংস্কৃত প্রত্যয় নহে; “মখতা” বলিতে হইবে। “অহম্মখ” সংস্কৃত শব্দ; এজন্য “আহাম্মখি” অশদ্ধ, “অহম্মখতা” বলিতে হইবে।

শ্রীত্ব। সংস্কৃতে এই নিয়ম আছে যে, বিশেষ্য যে লিঙ্গান্ত হইবে, বিশেষণও সেই লিঙ্গান্ত হইবে। যথা, সুন্দরী বালিকা, সুন্দর বালক; বেগবান, নদ, বেগবতী নদী।

বাঙ্গালায় এই নিয়মের অনবত্তীর্ণ হওয়া লেখকের ইচ্ছাধীন। অনেকেই সুন্দরী বালিকা লেখেন; কিন্তু সুন্দর বালিকাও বলা যায়। বিশেষতঃ বিশেষণ বিশেষ্যের পরে থাকিলে ইহাতে কোন দোষই হয় না। যথা, এই বালিকাটি বড় সুন্দর। “রামের স্ত্রী বড় মুখর।” অনেক সময়ে বিশেষণ শ্রীলিঙ্গান্ত হইলে বড় কদর্য শনায়। যথা, “রামের মা উত্তমা পাচিকা” এখানে “উত্তম পাচিকা” বলিতে হইবে।

বাঙ্গালা রচনায় শ্রীত্ব সম্বন্ধে কয়েকটি নিয়ম প্রবল;~~

১। প্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে পুংলিঙ্গান্ত রাখিতে পার। যেমন সুন্দর বালিকা, উর্বর ভূমি। কিন্তু পুংলিঙ্গান্ত বা ক্লীবলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে কখন স্ত্রীলিঙ্গান্ত করিতে পার না। “পঞ্চমী দিবস” “মহতী কার্য” “সবিস্তৃতা জনপদ” এ সকল অশুদ্ধ।

২। স্ত্রীলিঙ্গান্ত বিশেষ্যের বিশেষণকে ইচ্ছামত স্ত্রীলিঙ্গান্ত না করিলে, না করিতে পার; কিন্তু যদি কতকগুলি বিশেষণ থাকে আর তাহার একটিকে স্ত্রীলিঙ্গান্ত কর, তবে আর সকলগুলিকেও শ্রীলিঙ্গান্ত করিতে হইবে। “সুন্দর বালিকা” বলিতে পার, কিন্তু “সুসজ্জিতা সুন্দর বালিকা” বলিতে পার না, “সুসজ্জিতা সুন্দরী বালিকা” বলিতে হইবে। “প্রখর নদী’ বলিতে পার, কিন্তু “কুলপ্লাবিনী প্রখর নদী” বলিতে পার না; এখানে “প্রখরা”
বলিতে হইবেশেষণ হইলে ভিন্ন “একটী কৌী

৩। বিশেষণ হইলে সংস্কৃত শব্দই স্ত্রীলিঙ্গান্ত হয়, অসংস্কৃত বিশেষণ শ্রীলিঙ্গান্ত হয় । যথা “একটা বড় বাঘিনী” ভিন্ন “একটা বড় বাঘিনী” বলা যায় না; “ঢেঙ্গা মেয়ে” ব্যতীত “ঢেঙ্গী মেয়ে” বলা যায় না। “ফটা কৌড়ি,” “ফটী কৌড়ি” নহে। হিন্দীর নিয়ম বিপরীত। হিন্দীতে “ফটী কৌড়ি” বলিতে হইবে।

৪। অসংস্কৃত শব্দের লিঙ্গান্ত বিশেষণ ভাল শোনায় না। “গর্ভবতী মেয়ে” না বলিয়া “গর্ভবতী কন্যা” বলাই ভাল। “সশীলা বউ” না বলিয়া “সশীল বউ” বা “সুশীলা বধ” বলা উচিত। “মুখরা চাকরাণী” না বলিয়া “মুখরা দাসী” বলিব।

কারক। সকল বাক্যে কত্তা ও কর্ম যেন নির্দিষ্ট থাকে। বাঙ্গালায় এ বিষয়ে ভূল সৰ্ব্বদা হয়। “আমাকে মারিয়াছে।” কৈ মারিয়াছে তাহার ঠিক নাই। “বুঝি দেশে রহিতে দিল না।” কে রহিতে দিল না তাহার ঠিক নাই।

দ্বিতীয় পাঠ

অর্থব্যক্তি
তােমার যাহা বলিবার প্রয়ােজন, রচনায় তাহা যদি প্রকাশ করিতে না পারিলে, তবে রচনা বৃথা হইল। অর্থব্যক্তির বিশেষ কোন নিয়ম নাই, তবে দুই একটা সঙ্কেত আছে।

যে কথাটিতে তােমার কাজ হইবে, সেই কথাটি ব্যবহার করিবে। তাহা শুনিতে ভাল নয়, কি বিদেশী কথা, এরপ আপত্তি গ্রাহ্য করিও না। এক সময়ে লেখকদিগের প্রতিজ্ঞা ছিল যে, সংস্কৃতমূলক শব্দ ভিন্ন অন্য কোন শব্দ ব্যবহার করিবে না। কিন্তু এখনকার উৎকৃষ্ট লেখকেরা প্রায়ই এ নিয়ম ত্যাগ করিয়াছেন। যে কথাটিতে মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তাঁহারা সেই কথাই ব্যবহার করেন।

একটি উদাহরণ দিতেছি। তুমি কোন আদালতের ইশতিহারের কথা লিখিতেছ। আদালত হইতে যে সকল আজ্ঞা, সকলের জানিবার জন্য প্রচারিত হয়, তাহাকে ইশতিহার বলে। ইহার আর একটি নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন সংস্কৃত শব্দ, ইশতিহার বৈদেশিক শব্দ, এজন্য অনেকে “বিজ্ঞাপন” শব্দ ব্যবহার করিতে চাহিবেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনের একট, দোষ আছে, তাহার অনেক অর্থ হইয়া উঠিয়াছে। গ্রন্থকত্ত গ্রন্থ লিখিয়া গ্রন্থের পরিচয় জন্য প্রথম যে ভূমিকা লেখেন তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। দোকানদার আপনার জিনিস বিক্রয়ের জন্য খবরের কাগজে বা অন্যত্র যে খবর লেখে, তাহার নাম “বিজ্ঞাপন”। সভা কি রাজকশ্মচারীর রিপাের্টের নাম “বিজ্ঞাপন”। “বিজ্ঞাপন” শব্দের এইরপ গােলযােগ আছে। এস্থলে, আমি ইশতিহার শব্দই ব্যবহার করিব। কেন না, ইহার অর্থ সকলেই বুঝে, লৌকিক ব্যবহার আছে। অথেরও কোন গােল নাই।

দ্বিতীয় সঙ্কেত এই যে, যদি এমন কোন শব্দই না পাইলাম যে তাহাতে আমার মনের ভাব ঠিক ব্যক্ত হয়, তবে যেটি উহারই মধ্যে ভাল, সেইটি ব্যবহার করিব। ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া অর্থ বুঝাইয়া দিব। দেখ, “জাতি” শব্দ নানাথ। প্রথম, জাতি (Caste) অর্থে হিন্দুসমাজের জাতি; যেমন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈবত্ত ইত্যাদি। দ্বিতীয়, জাতি অর্থে দেশবিশেষের মনুষ্য (Nation) ; যেমন ইংরেজজাতি, ফরাসীজাতি, চীনজাতি। তৃতীয়, জাতি অর্থে মনুষ্যবংশ (Race); যেমন আর্যজাতি, সমীয়জাতি, তুরাণীজাতি ইত্যাদি। চতুর্থ, জাতি অর্থে কোন দেশের মনুষ্যদিগের শ্রেণীবিশেষ মাত্র (Tribe); যেমন, য়িহুদায় দশজাতি ছিল। পঞ্চম, নানাজাতি পক্ষী’, ‘ কুরের জাতি (Species) বলিলে যে অর্থ বুঝায়, তাই। ইহার মধ্যে কোনও অর্থ প্রকাশ করিতে গেলে, জাতি ভিন্ন বাঙ্গালায় অন্য শব্দ নাই। এস্থলে জাতি শব্দই ব্যবহার করিতে হইবে। কিন্তু ব্যবহার করিয়া তাহার পরিভাষা করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবে যে, কোন অর্থে ‘জাতি’ শব্দ ব্যবহার করা যাইতেছে। বুঝাইয়া দিয়া, উপরে যেমন দেওয়া গেল, সেইরুপ উদাহরণ দিলে আরও ভাল হয়।

তৃতীয় পাঠ

প্রাঞ্জলতা।

প্রাঞ্জলতা রচনার বড় গুণ। তুমি যাহা লিখিবে, লােকে পড়িবামাত্র যেন তাহা বুঝিতে পারে। যাহা লিখিলে, লােকে যদি তাহা না বুঝিতে পারিল, তবে লেখা ব্যথা। কিন্তু অনেক লেখক এ কথা মনে রাখেন না। কতকগুলি নিয়ম, আর কতকগুলি কৌশল মনে রাখিলে রচনা খুব প্রাঞ্জল করা যায়। দুই রকমই বলিয়া দিতেছি।

১। একটি বস্তুর অনেকগুলি নাম থাকিতে পারে, যেমন আগুনের নাম অগ্নি, হােশন অথবা হতভুক, অনল, বৈশ্বানর, বায়সখা ইত্যাদি। এখন, আগুনের কথা লিখতে গেলে ইহার মধ্যে কোন নামটি ব্যবহার করিব? যেটি সবাই জানে, অর্থাৎ আগন বা অগ্নি। যদি বলি, “হতভুক, সাহাযয্য বাপীয় যন্ত্র সঞ্চালিত হয়, তবে অধিকাংশ বাঙ্গালী আমার কথা বুঝিবে না। যদি বলি যে, “অগ্নির সাহায্যে বাষ্পীয় যন্ত্র চলে” সকলেই বুঝিবে। |

২। অনর্থক কতকগলা সংস্কৃত শব্দ লইয়া সন্ধি সমাসের আড়ম্বর করিও না–অনেকে বুঝিতে পারে না। যদি বলি, “মীনক্ষোভাকুল কুবলয়” তােমরা কেহ কি সহজে বুঝিবে ?
আর যদি বলি, “মাছের তাড়নে যে পন্ম কাঁপিতেছে,” তবে কে না বুঝিবে ?

৩। অনর্থক কথা বাড়াইও না। অল্প কথায় কাজ হইলে, বেশী কথার প্রয়ােজন কি ? “এবম্বিধ বিবিধ প্রকার ভয়াবহ ব্যাপারের বশীভূত হইয়া, যখন সূর্যদেব পৰ্বগগনে অধিষ্ঠান করিয়া পথিবীতে স্বীয় কিরণমালা প্রেরণ করিলেন, তখন আমি সেই স্থান পরিত্যাগ পৰ্ব্বক অন্যত্র গমন করিলাম।” এরপ না বলিয়া যদি বলি, “এইরপ অনেক বিষয়ে ভয় পাইয়া, যখন সৰ্য্য উঠিল তখন আমি সেস্থান হইতে চলিয়া গেলাম,” তবে অর্থের কোন ক্ষতি হয় না, অথচ সকলে সহজে বুঝিতে পারে।

৪। জটিল বাক্য রচনা করিও না। অনেকগুলি বাক্য একত্র জড়িত করা হইলে বাক্য জটিল হয়। যেখানে বাক্য জটিল হইয়া আসিবে, সেখানে জটিল বাক্যটি ভাঙ্গিয়া ছােট ছােট সরল বাক্যে সাজাইবে। উদাহরণ দেখঃ “দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের যেরপ শােচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে পল্লীগ্রাম যে জলহীন হইবে, এবং তদ্ধেতুক যে কৃষিকার্যের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে, এরপ অনুমান করিয়াও অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি তাহার প্রতিবিধানে যত্ন করেন না, দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

এই বাক্য অতি জটিল। সহজে বুঝা যায় না। কিন্তু ছােট ছােট বাক্যে ইহাকে বিভক্ত করিয়া লইলে কত সহজ হয় দেখ। “দিন দিন পল্লীগ্রাম সকলের শােচনীয় অবস্থা দাঁড়াইতেছে। যেরপ শােচনীয় অবস্থায় দাঁড়াইতেছে, তাহাতে অল্পকাল মধ্যে অনেক পল্লীগ্রাম জলহীন হইবে। পল্লীগ্রাম সকল জলহীন হইলে কৃষিকাষের বিশেষ ব্যাঘাত ঘটিবে। অনেক দেশহিতৈষী ব্যক্তি ইহা অনুমান করিয়াছেন। কিন্তু অনুমান করিয়াও তাঁহারা ইহার প্রতিবিধানের যত্ন করেন না। ইহা দেখিয়া আমরা বড় দুঃখিত হইয়াছি।”

একটি বাক্যের স্থানে ছয়টি হইয়াছে। কিন্তু বুঝিবার আর কোন কষ্ট নাই।

৫। উদাহরণ। যেখানে স্থল কথাটা বুঝিতে কঠিন, সেখানে উদাহরণ প্রয়ােগে বড় পরিষ্কার হয়। এই গ্রন্মে সকল কথার উদাহরণ দেওয়া গিয়াছে, সুতরাং উদাহরণের আর পথক উদাহরণ দিবার প্রয়ােজন নাই।

৬। সম্প্রসারণ। স্থল বাক্যটি বড় সংক্ষিপ্ত হইলে অনেক সময়ে বুঝিবার কষ্ট হয়। এমন স্থলে সম্প্রসারণ করিবে। অশ্বের উদাহরণ পৰ্ব্বে প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে দিয়াছি; তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে। “অশ্ব, শহীন উদ্ভিদভােজী চতুষ্পদ বিশেষ।” ইহাতে অনেক কথা বুঝিবার কষ্ট আছে। যাহা যাহা বুঝিবার কষ্ট, তাহা প্রথম অধ্যায়ে সপ্তম পাঠে সম্প্রসারিত বাক্যগুলিতে পরিষ্কার হইয়াছে। আর এক প্রকারের উদাহরণ দেখ।

মনে কর, এ বৎসর বষ্টি কম হইয়াছে। লােকে বলে “উন বর্ষায় দননা শীত।” অর্থাৎ যে বার বষ্টি কম হয় সে বার শীত বেশী হয়। মনে কর, তুমি সে কথা জান না। এমন অবস্থায় ভাদ্র মাসে তােমাকে যদি কেহ বলে, “এ বৎসর শীত বেশী হইবে, তাহা হইলে তুমি তাহার কথার মর্ম কিছু বুঝিতে পারিবে না, হয়ত তাহাকে পাগল মনে করিবে। কিন্তু সে যদি নিজ বাক্যের সম্প্রসারণ করিয়া বলে, “যে যে বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, সেই সেই বৎসর বেশী শীত হইয়াছে দেখা গিয়াছে। এ বৎসর কম বর্ষা হইয়াছে, অতএব এ বৎসর বেশী শীত হইবে।” তাহা হইলে বুঝিবার কষ্ট থাকে না।

ন্যায়শাস্ত্রে ইহাকে “অবয়ব” বলে। ন্যায়শাস্ত্রে অবয়বের এইরপ উদাহরণ দেয়, যথা “পতে আগুন লাগিয়াছে, কেন না পর্বতে ধয়াে দেখিতেছি।” যেখানে যেখানে ধয়াে দেখা গিয়াছে, সেইখানে সেইখানে আগন দেখা গিয়াছে। এই পৰ্ব্বতে ধয়া দেখা যাইতেছে, অতএব ইহাতে আগুন লাগিয়াছে। অনেক সময়ে এইরপ লিখিলে রচনা বড় পরিষ্কার হয়।

চতুর্থ পাঠ

অলঙ্কার।
অলঙ্কার ধারণ করিলে যেমন মনুষ্যের শােভা বৃদ্ধি পায়, অলঙ্কার ধারণ করিলে রচনারও সেইরুপ শােভা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অলঙ্কার প্রয়ােগ বড় কঠিন। আর, সকল প্রকার রচনায় অলঙ্কারের সমাবেশ করা যায় না; বিশেষ, যাহারা প্রথম রচনা করিতে শিখে, তাহাদিগের পক্ষে অলঙ্কার প্রয়ােগ বিধেয় নহে। অতএব অলঙ্কার সম্বন্ধে কিছু লেখা গেল না।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়

ঔপন্যাসিক, ইতিহাসবিদ, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মবেত্তা, সাংবাদিক, সিভিল সার্ভেন্ট। জন্ম ১৮৩৮, নৈহাটির কাঁটালপাড়া গ্রামে; মরণ ১৮৯৪, কোলকাতায়। বিয়া দুইটা; ধর্মে হিন্দু।
Avatar photo

Latest posts by বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →