আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (১)
[pullquote][AWD_comments][/pullquote]বিনোদিনী দাসী তাঁর ‘আমার কথা’ বইটা পাবলিশ করেন বাংলা ১৩১৯ সালে। এক বছর পরেই কিছু জিনিস ইনকরপোরেট কইরা সেইটার নতুন ভার্সন ছাপান। পত্র-ভারতী থিকা ছাপানো দেবজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বিনোদিনী রচনাসমগ্র” (২০১৪) এবং সুবর্ণরেখা থিকা নির্মাল্য আচার্য় সম্পাদিত “বিনোদিনী দাসী: আমার কথা ও অন্যান্য রচনা” (১৯৬৯) বই দুইটাতে এই টেক্সটটা পাওয়া যায়।
একটা সময়ে (১৮৭৪ – ১৮৮৬) বিনোদিনী দাসী থিয়েটারের নায়িকা হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন কলকাতা শহরে। ফিমেইল সেলিব্রেটিই বলতে হবে উনারে। কিন্তু উনার এই টেক্সট আসলে উনার অভিনয়রে একসিড কইরা গেছে। একটা তো হইতেছে – বলা, উনি যে বলতে চাইছেন উনার লাইফের ঘটনাগুলা – এইটাই একটা ঘটনা; সেকেন্ডলি যেইভাবে উনি লিখছেন – সেইখানে একটা ইথিক্যাল বাউন্ডারিরে উনি মাইনা নিতে বাধ্য হইছেন, কিন্তু মানাটা যে একটা না-মানা, সেইটা হাইড করতে রাজি হন নাই। মেমোয়ার্সে যা হয়, আপনি তো কিছু জিনিস বলবেন আর কিছু জিনিস বলবেন না (মানে, ধরেন ভুইলাই যাবেন); কিন্তু কি ঘটতেছে সেইটা তো আর ঘটনা না, ঘটনা হইলো কিভাবে আমরা বলতেছি। একটা মেইল গেইজের রিয়ালিটিতে ফিমেইল এগজিসটেন্সরে এই টেক্সটটা রিভিল কইরা ফেলে; আরে, এ তো দেখি খালি নারী-ভাবনা না!
এমনিতে টেক্সটটারে সিমপ্যাথিটিক্যালি পড়ার একটা অভ্যাস তো আছে এখন, কিন্তু এই সিমপ্যাথিটা কনটিনিউ করাটা মাঝে-মধ্যে টাফ-ই হয়া উঠে। কেন যে? এইরকম কোশ্চেন যখন আসে তখন বিষাদের বনে হারায়া না গেলে ইউরোপিয়ান ফেমিনিজমের বাইরে কি কি ভাবে আমরা নারীবাদ পাইতে পারতাম তার কিছু আসপেক্ট চোখে পড়তে পারে।
——————————-
ভূমিকা
আমার এই মর্ম্মবেদনা গাথার
আবার ভূমিকা কি?
ইহা কেবল অভাগিনীর হৃদয়-জ্বালার ছায়া! পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, সুধুই অনন্ত নিরাশা, সুধুই দুঃখময় প্রাণের কাতরতা! কিন্তু তাহা শুনিবারও লোক নাই! মনের ব্যথা জানাইবার লোক জগতে নাই-কেননা, আমি জগৎ মাঝে কলষ্কিনী, পতিতা। আমার আত্মীয় নাই, সমাজ নাই, বন্ধু নাই, বান্ধব নাই, এই পৃথিবীতে আমার বলিতে এমন কেহই নাই।
তথাপি যে সর্ব্বশক্তিমান ঈশ্বর ক্ষুদ্র ও মহৎ, জ্ঞানী ও অজ্ঞানী সকলকে সুখ দুঃখ অনুভব করিবার ক্ষমতা দিয়াছেন, তিনিই আবার আমাকে আমার কর্ম্মেচিত ফল লাভ করিবার জন্য আমার হৃদয়ে যন্ত্রণা ও সান্ত্বনা অনুভব করিবার ক্ষমতাও দিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের কথা বলিবার বা যাতনায় অস্থির হইলে সহানুভূতি দ্বারা কিঞ্চিৎ শান্ত করিবার, এমন কাহাকেও দেন নাই। কেননা আমি সমাজপতিতা, ঘৃণিতা বারনারী! লোকে আমায় কেন দয়া করিবে? কাহার নিকটেই বা প্রাণের বেদনা জানাইব; তাই কালি কলমে আাঁকিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু এখন বুঝিতেছি যে মর্ম্মান্তিক ব্যথা বুঝাইবার ভাষা নাই। মর্ম্মে মর্ম্মে পিশিয়া প্রাণের মধ্যে যে যাতনাগুলি ছুটাছুটি করিয়া বেড়ায় তাহা বাহিরে ব্যক্ত করিবার পথ মহামহোপাধ্যায় পন্ডিতগন জানেন কিনা বলিতে পারি না, কিন্তু এই বিদ্যুাবুদ্ধিহীনা, অজ্ঞানা, অধমা নারী যে কিছুই পারে নাই তাহা নিজেই মনে মনে বুঝিতেছি।
যাহা চক্ষে দেখিব বলিয়া কালি কলমে তুলিতে গিয়াছিলাম। হায়! তাহার তো কিছুই হইল না! সুধুই এতগুলি কাগজ কালি নষ্ট করিলাম। বুঝিয়াছি যে মর্ম্ম-বেদনা সুধু মনেই বুঝা যায়, তাহা বাহিরে প্রকাশ করিবার কোন উপায় নাই, তাহা বলিতেছিলাম যাহার কিছুই হইল না তাহার আবার পূর্ব্বোক্তি বা ভূমিকা কি?
উপহার
আমার আশ্রয় স্বরূপ
প্রাণময় দেবতার চরণে এই ক্ষুদ্র
উপহার
প্রানের কৃতজ্ঞতার সহিত অর্পিত হইল।
যে অনন্ত সর্ব্বশক্তিমান অজ্ঞান মহাপুরুষ ভক্তের হৃদয়ে ভগবান বলিয়া বিরাজিত হইয়া ভক্ত-হৃদয়ে পুজিত হইতেছেন, তিনি চর্ম্মচক্ষের অতীত, বর্ণনা ও জ্ঞান বুদ্ধির অতীত! সেই অব্যক্ত অচিন্ত্য মহাপুরুষ তো চিরদিনই ধারণার অতীত রহিলেন! এই ক্ষুদ্র জীবনে কখন যে তাহার সীমা নির্দ্ধারিত করিতে পারিব, সে আশাও নাই।
কিন্তু সেই অনন্ত ইচ্ছাময়ের ইচ্ছায় এই শোকসন্তপ্ত প্রাণ, এই ভগ্ন-হৃদয় যাঁহার চরণে আশ্রয় পাইয়াছে, যাঁহার অমৃতময় সান্ত্বনা-বারি দানে এ যন্ত্রণাময় পাপ প্রাণ এখনও এ দেহে রহিয়াছে; যাঁহার কৃপায় সেই আনন্দময়ী ননীর পুতলিকে পাইয়াছিলাম, এক্ষণে নিজ কর্ম্মফলে হারাইয়া এখনও জীবিত আছি!
সেই দয়াময় দেবতার চরণে, এই বেদনাজড়িত ‘আমার কথা’ সমর্পণ করিলাম! একদিন যে অমূল্য ধনে দুঃখিনীর হৃদয় পূর্ণ ছিল; এক্ষনে আর তাহা নাই! অযত্মে অনাদরে তাহা হারাইয়া ফেলিয়াছি। সুধুই জীবনে মরণে জড়িত অশ্রুবারি মাথা জ্বলন্ত স্মৃতি আছে! হে দেবতা! এই তাপিত প্রাণের অশ্রু বাহিরই উপহার লইয়া এই অভাগিনীকে চরণে স্থান দিও, আমার আর কিছুই নাই, দেব।
এই পুস্তক লেখা শেখ করিয়া যাঁহার উদ্দেশে উপরোক্ত ভূমিকা লিখিত হয়; তাঁহাকে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করি, যে “আমার জীবনী লিখিয়া আপনাকে উপহার দিব, কেমন?” তিনি তখন সহাস্য বদনে বলেন, যে “বেশ! তোমার যখন সকল ভার বোঝাগুলি বহিতেছি; তখন ও পাগলামির কালির আঁচড়গুলিও বহিব”!
যাঁহার উদ্দেশে উপরোক্ত উপহার প্রদত্ত হয় সেই দয়াময় দেবতা এক্ষণে আর হই সংসারে নাই! (চিরদিন এ সংসারে কেহ থাকে না বটে) কিন্তু স্বর্গে আছেন! স্বর্গ ও নরক, ইহজন্ম ও পরজন্ম, হিন্দু নরনারীগণ অকপট হৃদয়ে বিশ্বাস করিয়া থাকেন বোধ হয়! এ বিশ্বাসের আরও একটী কারণ ও সান্ত্বনা আছে।
কেননা! স্নেহ ও ভালবাসা বলিয়া মানব-হৃদয়ে যে আকুল আকাঙ্খা জড়িত মধুময় সুখস্পর্শ ভাবলহরী হৃদিসরোবরে সতত উত্থালিত আবেগময় ভাবে খেলিয়া বেড়ায়: সেহঢী বোধ হয় মহামায়র মোহিনী শক্তির বন্ধন স্বরূপ! মানব জীবনের প্রধান জীবনীশক্তি বলিয়া আমার মনে বিশ্বাস!
তাহাতেই বঙ্কিমবাবু মহাশয়ের নগেন্দ্রনাথ বলিয়াছিল যে “আমার সূর্য্যমুখী ঐ স্বর্গে আছে। আমার কাছে নাই, কিন্তু সে আমার স্বর্গে আছে”!
আবার সেই সন্মেহয় ভালবাসারই আকর্ষণী শক্তিতে পিক্লেলিয়ানের গেলটিয়া প্রস্তরমূর্ত্তি হইতে সজীব মূর্ক্তি হইয়া পিক্লেলিয়ানের নিকট উপস্থিত হইয়াছিলেন! আবার নিরাশায় তাড়নায় পুনঃ প্রস্তর মূর্ত্তিতে পরিণত হইলেন।
আমিও বলিতেছি যে তিনি পৃথিবীতে না থাকিলেও স্বর্গে আছেন! অবশ্যই সেইখান হইতেই সকলই দেখিতেছেন! এ হতভাগিনীর ও হৃদয় ব্যথা বুঝিতেছেন। অবশ্য যদি আমাদের হিন্দুধর্ম্ম সত্য হয়, দেবদেবী সত্য হয়, জন্ম জন্মান্তর যদি সত্য হয়!
উপহার কি?
প্রীতির কুসুম দান
সেই জন্যই আমার স্বর্গীয় প্রাণময় প্রীতির দেবতার চরণে ‘আমার কথা’ উৎসর্গ করিলাম! তাঁহার জিনিস আবার তাঁহাকেই দিলাম! তিনি যেখানেই থাকুন প্রাণের এই আকুলিত আকাক্সক্ষা, তাঁহার পবিত্র আত্মাতে স্পর্শ করিবেই! কেননা তিনি আমার নিকট সত্যে বদ্ধ, সত্যবাদীর সত্য কখনও ভঙ্গ হয় না! বিশেষতঃ যে প্রাতঃস্মরণীয় উন্নতবংশে তাঁহার জন্ম, সে বংশের বংশধর কখনও মিথ্যাবাদী হইতে পারেন না! ইহা ত্রিজগতে বিখ্যাত।
অবস্থার বিপাকে এ সংসার হইতে যাইবার সময় তিনি কথা কহিতে পারেন নাই বলিয়া, যে তিনি তাঁহার সত্য প্রতিজ্ঞা ভুলিয়া যান নাই, তাঁহার কাতর দৃষ্টি ও প্রাণের ব্যাকুলতাই তাহার প্রমান! আমি তাঁহার জীবনের শেষ মুহুত্ত পর্য্যন্ত তাঁহার চরণতলে উপস্থিত ছিলাম। কারণ, তিনি শত শতবার তাঁহার মৎস্তক স্পর্শ করাইয়া দিব্য করাইয়াছিলেন যে, আমি যেন তাঁহার মৃত্যু শর্য্যায় উপস্থিত থাকি। বোধহয় সেই সত্য রক্ষার জন্য ঈশ্বর আমায় দয়া করিয়া অযাচিতভাবে তাঁহার নিকট উপস্থিত রাখিয়া, আমার সত্য রক্ষা করিলেন।
যেস্থান আমার নিজের বলিয়া স্বাধীনভাবে থাকিতে যাইতাম, সে স্থানে অপরের দয়ার উপর নির্ভর করিয়া এই পাষাণ বক্ষে লোহার দ্বারা বদ্ধন করিয়া তাঁহার নিকট গিয়া বসিলাম। তিনি অতি কাতর ভাবে আমার মুখের দিকে বার বার চাহিতে লাগিলেন; বালিস হইতে মস্তক তুলিয়া এই পাপীয়সীর কোলের উপর মাথা রাখিয়া যেন অতি কাতরে বলিতে লাগিলেন, আমি তোমার নিকট যে সত্যবদ্ধ হইয়া আছি, তাহা সকলে জানে; যাঁহারা আমায় জানে, তাঁহারা তোমায় জানে; যাঁহারা আমায় জানে, তাঁহারা সকলে তোমায় জানে।
আমার জীবনের অংশ বরিয়া যাহাকে জানি, যে ব্যক্তি আমার পদস্পর্শ করিয়া তোমার ভারগ্রহণ করিয়াছে, যাহাকে অতি শিশুকাল হইতে আজ ৩১ বৎসর পুত্র স্নেহে আদর করিয়া আসিতেছ, সে রহিল, ধর্ম্ম রহিল!
আমা দিকে চাহেন, আর পদ্মাচক্ষু জলে পরিপূর্ণ হইয়া আইসে। তাঁহার সেই কাতর দৃষ্টি আমার বুকের ভিতর দিয়া প্রতি রক্ষশিয়ায়’ আঘাত করিতে লাগিল।
অতি কষ্টে আত্ম সম্বরণ করিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন এমন করিতেছ?’ কি কষ্ট হইতেছে? বল, একবার বল, তোমার কি যাতনা হইতেছে”? হায়! কিছুই বলিলেন না; সুধু কোলের উপর মাথা দিয়া কাতরে মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন! আমি হতভাগিনী, শেষের একটী আশ্বাসবাক্য শুনিতে পারলাম না।
যে প্রেমময় দেবতা আজ ৩১ বৎসর প্রায় শত সহস্রবার আমার নিকট ধর্ম্ম সাক্ষ্য করিয়া, দেবতা স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিয়াছিলেন যে “যদি আমার কিছুমাত্র দেবতার উপর ভক্তি ও বিশ্বাস থাকে; যদি আমি পূণ্যময় বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকি তবে তোমাক কাহারও দ্বারস্থ হইতে হইবে না। যখন এতদিন প্রায় সমস্ত জীবন, মান, অপমান, সমান করিয়া আদরে স্থান দিয়াছি, তখন তোমার শেষ জীবনে বঞ্চিত হইবে না”! কিন্তু হায় মৃত্যু! তোমার নিকট দুর্ব্বল বলবান, অধার্ম্মিক ধার্ম্মিক, জ্ঞানী অজ্ঞানী, কাহারও শক্তি নাই; তোমারই শক্তি প্রবল। আহা! হয়তো তাঁহার কত কথা বলিবার ছিল, কিছুই বলিতে পারিলেন না। কত বেদনাময় বুক লইয়া হই সংসার হইতে চলিয়া গেলেন।
জীবনে শতসহস্রবার বলিতেণ, যে “আমি তোমার আগে এ সংসার হইতে যাইবই তোমার আগে যাইতে কখনও দিব না। সুদ্ধ তুমি আমার মৃত্যুশয্যায় উপস্থিত থাকিও একটী কথা তোমায় বলিয়া যাইব”। হায়!হায়!! শেষ জীবনের মনের কথা, মনে রহিল! সেই ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী, সহৃদয় দেবতা, চন্দ্রের ন্যায় একটী মাত্র কলষ্ক রাখিয়া আমায় চির যাতনাময় সমুদ্রে ফেলিয়া চলিয়া গেলেন।
এই খন্ডে “আমার কথা’র এই পর্য্যন্ত রহিল। কিন্তু যখন আমার যাতনাময় জীবনের শেষ নাই, তখন আমার কথাও শেষ নাই। আমার নাট্য জীবনের পর ৩১ বৎসর যে দেবতার চরণে আশ্রয় লইয়া, জীবনের সার তৃতীয় অংশ যাঁহার আত্মীয় স্বজনের সহিত সমভাবে কাটাইয়াছি; যে পুন্যময় দেবতা সত্যধর্ম্মে বদ্ধ হইয়া আমায় এত দিন আশ্রয় দিয়াছিলেন, দ্বিতীয় খন্ডে আমার জীবনের সেই সুখময় অংশ ও এই শেষের দুঃখময় অংশ শেষ করিবার ইচ্ছা রহিল। হায় ভাগ্য! যে দয়াময় আত্মীয় পরিবারের সহিত সমভাবে এক সংসারের স্থান দিয়াছিলেন; যাঁহার অভাবে আজ আমি ভাগ্যহীনা জন্মদুঃখিনী-কোথায় সেই স্নেহপূর্ণ দেবহৃদয়; হায় সংসার কি পরিবর্ত্তনশীল এখন মনে হইতেছে।
“যতপতেঃ ক্ক গতা মথুরাপরী
রঘুপতেঃ ক্ক গতোত্তরকোশলা।
ইতি বিচিন্ত্য কুরুম্ব মনঃ স্থিরং
ন সদিদং জগদাদিত্যবধারয়।।’
নিবেদন
অধীনার নিবেদন i
আমার শিক্ষাগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের অনুরোধে এই আত্মকাহিনী লিখিয়া যখন তাঁহাকে দেখিতে দিই, তিনি দেখিয়া শুনিয়া যেখানে যেরূপ ভাবভঙ্গীতে গড়িতে হইবে উপদেশ দিয়া বলেন যে, “তোমার সরলভাবে লিখিত সাদা ভাষায় যে সৌন্দর্য্য আছে, কাটাকুটি করিয়া পরিবর্ত্তন করিলে তাহা নষ্ট হইবে। তুমি যেমন লিখিয়াছ, তেমনি ছাপাইয়া দাও। আমি তোমার পুস্তকের একটি ভূমিকা লিখিয়া দিব।” একটি ভূমিকা লিখিয়া ও দিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা আমার মনের মতন হয় নাই। iiলেখা অবশ্য খুব ভালই হইয়াছিল; আমার মনের মতন না হইবার কারন, তাহাতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ ছিল না। আমি সেকথা বলাতে তিনি বলিয়াছিলেন যে, “সত্য যদি অপ্রিয় ও কটু হয়, তাহা সকল সময়ে প্রকাশ করা উচিত নয়।” উদারতা সংসারে আমাদের ন্যায় রমণীগণের মনে অভিমান করিবার স্থল অতি বিরল। এইজন্য যাঁহারা স্বভাবের উদারতা গুণে আমাদিগকে স্নেহের প্রশ্রয় দেন, তাঁহাদের উপর আমরাও বিস্তর অত্যাচার করিয়া থাকি। একে রমণী অদুরদর্শিনী, তাহাতে সে সময় অভিমানে আমার হৃদয় পূর্ণ; গিরিশবাবু মহাশয়ের রূগ্ন শয্যা ভূলিয়া, তাঁহার রোগ যন্ত্রণা ভূলিয়া, সত্য ঘটনা সকল উল্লেখ কিরয়া আর একটি ভূমিকা লিখিয়া দিবার জন্য আমি তাঁহাকে ধরিয়া বসিলাম। তিনিও তাহা লিখিয়া দিতে স্বীকার করিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম যে, আমার শিক্ষাগুরু ও সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা যদি সকল ঘটনা ভূমিকায় উল্লেখ না করেন, তাহা হইলে, আমার আত্মকাহিনী লেখা অসম্পূর্ণ হইবে। শীঘ্র ভূমিকা লিখিয়া দিবার জন্য আমি তাঁহাকে ত্বরা দিতে লাগিলাম। স্নেহময় গুরুদেব আমায় বলিলেন, “তোমার ভূমিকা লিখিয়া না দিয়া আমি মিরব না।” রঙ্গালয়ে আমি গিরিশবাবু মহাশয়ের দক্ষিণহস্তরূপ ছিলাম। তাঁহার প্রথমা ও প্রধানা ছাত্রী বলিয়া একসময়ে নাট্যজগতে আমার গৌরব ছিল। আমার অতি তুচ্ছ আবদার রাখিবার জন্য তিনি ব্যস্ত হইতেন। কিন্তু এখন সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই! আমার মান অভিমান রাখিবার দুইজন ব্যক্তি ছিলেন, একজন বিদ্যায় প্রতিভায়, উচ্চ সম্মানে পরিপূর্ণ, অন্যজন ধনে।
মানে যশে গৌরবে সর্ব্বোচ্চে স্থানের অধিকারী। এক্ষণে তাঁহারা কেহই আর এ সংসারে নাই। আমার তুচ্ছ আবদার রক্ষা করিবার জন্য বঙ্গের গারিক গিরিশবাবু আর ফিরিয়া আসিবেন না। ভূমিকা লিখিয়া না দিয়া মবি না’ বলিয়া তিনি আমাকে যে আশ্বাস দিয়াছিলেন, আমার অদৃষ্টে তাহা ঘটিল না। মনে করিয়াছিলাম, তাঁহার পুনর্ব্বা-লিখিত ভূমিকা লেখা অসম্পূর্ণ রাখিয়া আমায় শিখাইয়া গেলেন যে সংসারের সকল সাধ সম্পূর্ণ হইবার নয়।
সম্পূর্ণত হইবার নহে, তবে যাহা আছে, তাহা লোপ পায় কেন? আমি গিরিশবাবু মহাশয়ের পুব্বলিখিত ভূমিকাটি অন্বেষণ কিরতে গিয়া গুনিলাম যে, গিরিশবাবুর শেষ বয়সের নিত্যসঙ্গী পুজনীয় শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় তাহা যত্ম করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছেন। সেটি তাঁহার নিকট হইতে ফিরাইয়া লইয়া আমার ক্ষুদ্র কাহিনীর সহিত গাঁথিয়া দিলাম। আমার শিক্ষাগুরু মাননীয় গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের উৎসাহে ও বিশেষ অনুরোধে লিপিবদ্ধ হইয়া আমার আত্মকাহিনী প্রকাশিত হইল। কিন্তু তিনি আজ কোথায়? হায়-সংসার! সত্যই তুমি কিছুই পূর্ণ কর না! এ ক্ষুদ্র কাহিনী যে স্বহস্তে তাঁহার চরণে উপহার দিব, সে সাধটুকুও পূর্ণ হইল না।
বিনীতা
শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী
বাল্য-জীবন
অঙ্কুর
১ম পত্র।
১লা শ্রাবন। ১৩১৬ সাল।
মহাশয়!
বহু দিবস গত হইল, সে বহুদিনের কথা, তখন মহাশয়ের নিকট হইতে এরূপ অজ্ঞাতভাবে জীবন লুক্কায়িত ছিল না। সে সময় মহাশয়, বারবার কতবার আমাকে বলিয়াছেন যে, “ঈশ্বর বিনা কারণে জীবের সৃষ্টি করেন না, সকলেই ঈশ্বরের কার্য্য করিতে এ সংসারে আসে, সকলেই তাঁহার কার্য্য করে; আবার কার্য্য শেষ হইলে দেহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায়।” আপনার এই কথাগুলি আমি কতবার আলোচনা করিয়াছি; কিন্তু আমি তো আমার জীবন দিয়া বুঝিতে পারিলাম না যে আমার ন্যায় হীন ব্যক্তির দ্বারা ঈশ্বরের কি কার্য্য হইয়াছে, আমি তাঁর কি কার্য্য করিয়াছি, এবং কি কার্য্যই বা করিতেছি; আর যদি তাহাই হয় তবে এতদিন কার্য্য করিয়াও কি কার্য্যরে অবসান হইল না? আজীবন যাহা করিলাম, ইহাই কি ঈশ্বরের কার্য্য? এরূপ হীন কার্য্য কি ঈশ্বরের?
বার বার আমার অশান্ত হৃদয় জিজ্ঞাসা করে, “কৈ সংসারে আমার কার্য্য কৈ?” এই তো সংসারের পান্থশালা হইতে বিদায় লইবার সময় নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিল! তবে এতদিন আমি কি করিলাম? কি সান্ত্বনা বুকে লইয়া এ সংসার হইতে বিদায় লইব! আমি কি সম্বল লইয়া মহাপথের পথিক হইব! মহাশয় অনেক বিষয়ে আমাকে উপদেশ প্রদান করিয়াছেন, আমায় বুঝাইয়া দিন, যে ঈশ্বরের কোন কার্য্যে আমি ছিলাম ও আছি এবং থাকিব।
অনুগৃহিতা
২য় পত্র
৭ই শ্রাবণ।
মহাশয়!
মরুভূমে পতিত পথিকের তৃষ্ণায় আকুল প্রাণ যেমন দুরে সুশীতল সরোবর দর্শনে তৃপ্তি পায়; সেইরূপ মহাশয়ের আশা-বাক্যে আমার প্রাণের কোণে আবার আশায় আলোক দেখা দিতেছে। কিন্তু যে ঈশ্বরের জগতপূর্ণ নাম, কোথায় যে ঈশ্বর? কোথায় সেই দমায়ম? তিনি আমার মত পাপী তাপীকে দয়া করেন? আপনি লিখিয়াছেন, “কি কার্য্যে সংসারে আছি, তাহা জানিবার আমাদের অধিকার নাই। তিনি তো জানিবেনই! কিন্তু আমার কি হইল? আমার যে জ্বালা সেই জ্বালাই আছে, যে শূন্যতা সেই শূন্যতাই! আমার কি হইল? আমার সান্ত্বনার জন্য কি রাখিলেন? শেষ অবলম্বন একটি মধুময়ী কন্যা দিয়াছিলেন আমি তো তাহা চাহি নাই, তিনিই দিয়াছিলেন তবে কেন কাড়িয়া লইলেন? শুনেছিলাম দেবতার দান ফুরায় না! তার কি এই প্রমান? না অভাগিনীর ভাগ্য? হয়! ভাগ্যই যদি এত বলবান, তবে তিনি পতিতপাবন নাম ধরিয়াছেন কেন? দুর্ভাগা না হইলে কেন আকিঞ্চন করিব, কেন এত কাঁদিব! যে জন ভক্তি ও সাধনের অধিকারী সে তো জোর করিয়া লয়! প্রহাদ ধ্রুব প্রভৃতি আর আর ভক্তগণ তো জোর করিয়া লইয়াছেন। আমার মত অধম, যদি চিরযাতনার বোঝা বহিয়া অনন্ত নরকে গেল, তবে তাঁহার পতিতপাবন নাম কোথায় রহিল?
আপনি লিখিয়াছেন- “তোমার জীবনে অনেক কার্য্য হইয়াছে, তুমি রঙ্গালয় হইতে শত শত ব্যক্তির হৃদয়ে আনন্দ প্রদান করিয়াছ। অভিনয় স্খলে তোমার অদ্ভুত শক্তি দ্বারা যেরূপ বহু নাটকের চরিত্র প্রস্ফুটিত করিয়াছ, তাহা সামান্য কায্য নয়। আমার চৈতন্যলীলায়” চৈতন্য সাজিয়া বহুলোকের হৃদয়ে ভক্তির উচ্ছ্বাস তুলিয়াছ ও অনেক বৈষ্ণবের আশীর্ব্বাদ লাভ করিয়াছ। সামান্য ভাগ্যে কেহ এরূপ কার্য্যরে অধিকারী হয় না। যে সকল চরিত্র অভিনয় করিয়া তুমি প্রস্ফুটিত করিয়াছিলে সে সকল চরিত্র গভীর ধ্যান ব্যতীত উপলব্ধি করা যায় না। যদিছ তাহার ফল অদ্যবধি দেখিতে পাও নাই, সে তোমার দোষে নয় অবস্থায় পড়িয়া, এবং তোমার অনুতাপের দ্বারা প্রকাশ পাইতেছে যে অচিরে সেই ফলে অধিকারী হইবে।”
মহাশয় বলিতেছেন-দর্শকের মনোঞ্জন করিয়াছি। দর্শক কি আমার অন্তর দেখিতে পাইতেন! কৃষ্ণ নাম করিবার সুবিধা পাইয়া কার্য্যকালে, অন্তরে বাহিরে কত আকুল প্রাণে ডাকিয়াছিলাম! দর্শক কি তাহা দেখিয়াছেন? তবে কেন একমাত্র আশার প্রদীপ নিবিয়া যাইল? আর অনুতাপ! দর্শক কি তাহা দেখিয়াছেন? তবে কেন একমাত্র আশার প্রদীপ নিবিয়া যাইল? আর অনুতাপ! সমস্ত জীবনই তো অনুতাপে গেল। পদে পদে তো অনুতপ্ত হইয়াছি, জীবন যদি সংশোধন করিবার উপায় থাকিত, তাহা হইলে অনুতাপের ফল বুঝিতে পারিতাম। কিন্তু অনুতাপের কি ফল ফলিয়াছে? এখনও তো স্রোতে মগ্ন তৃণ প্রায় ভাসিয়া যাইতেছি। তবে আপনি কাহাকে অনুতাপ বলেন জানি না। এই যে হৃদয় জোড়া যাতনার বোঝা লইয়া তাঁর বিশ্বব্যাপী দরজায় পড়িয়া আছি কেন দয়া পাই না। আর ডাকিব না, আর কাঁদিব না বলেও যে “হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ” হৃদয়ের নিভূত কোন হইতে যাহাকে ডাকিতেছি, কোথায় সে হরি?
বাল্যকাল হইতে কত সাধ, কত বাসনা, কত সরল সৎপ্রবৃত্তিকালের কোলে ডুবিয়া গিয়াছে, কেমন করিয়া বলিব? কৃষ্ণ নাম স্মরণ করিয়া, জগৎ সুন্দর জগদীশ্বরের দিকে যে বাসনা সৎপথে ছুটিতে চাহিত, তখনি মোহজাল জড়িত মন তাহাকে চোরাবালির মোহে ডুবাইয়া দিয়াছে। যখন জোর করিয়া উঠিতে আগ্রহ হইত, কিন্তু চোরাবালিতে পড়িয়া ডুবিয়া গিয়া, জোর করিয়া উঠিতে গেলে যেমন বালির বোঝা সব চারিদিকে হইতে আর উপরে আসিয়া পড়িয়া তাহাকে পাতালে ডুবাইয়া দেয়, আমার দুর্ব্বল বাসনাকেও তেমনি মোহ-ঘোর আসিয়া চাপিয়া ধরিয়াছে। বলহীন বাসনা আশ্রয় পায় নাই, ডুবিয়া গিয়াছে। চোরাবালিতে পড়িয়া পুতে যাওয়ার ন্যায় ছট্ফট্ করিতে করিতে ডুবিয়া গিয়াছে! কিন্তু এখন তাই আমার ক্ষুদ্র বৃদ্ধিতে বুঝিতে পারিতেছি যে বাসনা প্রবৃত্তি উপরে ছুটিতে চায়। কে যেন ঘাড় ধরিয়া ডবাইয়া দেয়, তাহা তো বুঝিতে পারি না। তখন কত কাতরে কাঁদি, তবু ডুবি! শক্তিহীন দুর্ব্বল বলিয়াই ডুবি। বলিতে গেলে অনেক বলিতে হয়! মহাশয় মনের আবেগে কত কথা আসিয়া পড়িতেছে। যাহার দিকে চাহিয়া, যাহাকে বড় আপনার করিয়া বড়ই নাথ হইয়া চরণ ধরিয়া আপনার করিতে যাই, তবু দুরে বহুদুরে পড়িয়া থাকি! অধিক বলিয়া বিরক্ত করিব না, এক্ষনে বিদায় হই।
অভাগিনী।
৩য় পত্র
মহাশয়!
পূর্ব্বের অবস্থা যাহাই থাকুন, উপস্থিত অবস্থায় কি কার্য্যে আছি! রুগ্ণ, অথর্ব্ব, ভবিষ্যৎ আশা শূন্য, দিনযামিনী এক ভাবেই যাইতেছে, কোনরূপ উৎসাহ নাই। রোগশোকের তীব্র কশাঘাত, নিরূৎসাহের জড়তায় আচ্ছন্ন হইয়া অপরিবর্ত্তিত স্রোত চলিতেছে। আহার, নিদ্রা ও দুশ্চিন্তা, প্রতিদিনের ছবি একদিনে পাওয়া যায়, আজ একরূপ কাল অন্যরূপ কোনই পরিবর্ত্তন নাই। কেবল মাত্র প্রভেদ এই কখন কখন রোগের যন্ত্রণা বৃদ্ধি সদা সর্ব্বক্ষণ অস্বস্তি! কেহ যতœ করিয়া উপশমের চেষ্টা করিলে, সান্ত্বনা বাক্যে আশ্বস্ত হইতে বলিলে মনে মনে হাসি পায়! কারণ তাঁহারা এই বলিয়া আশ্বাস দেন, বলেন “সুস্থ্য হইয়া থাক কোনরূপ চিন্তা করিও না।” আমি ভাবি তাঁহারা আমার অবস্থা বোঝেন না। তাঁহারা বোঝেন না যে যদি চেষ্টা করিয়া সুস্থ্য থাকা সম্ভব হইত; সে চেষ্টা শত সহস্ররূপে হইয়াছে, এবং তাঁহাদের বলার অপেক্ষা থাকিত না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি য তাঁহারা আমার মতন ভাগ্যহীনা লোকের স্বরূপ অবস্থা না বোঝেন। কারণ এরূপ অবস্থায় না ঠেকিয়া কেহ বুঝিতে পারে না। সততই মনে হয় যে এই আশাশূন্য দুশ্চিন্তায় সদা সর্ব্বদা মগ্ন থাকাই কি ঈশ্বরের কার্য্য? সর্ব্বদাই বলি ভগবান আর কতকাল। দুঃখের অবসান না হউক অন্ততঃ স্মৃতি জলন্ত যাতনা হইতে নিস্তার পাইয়া মান্তি লাভ করি। সে যন্ত্রণা অতি তীব্র। বিনীত ভাবে আপনাকে জিজ্ঞাস করিতেছি যে, এইরূপ জরাজীর্ণ দেহ লইয়া অবসন্ন ভাবে সংসারের এক কোণে পড়িয়া থাকিয়া কি আপনার মত ঈশ্বরের কার্য্য হইতেছে?
৪র্থ পত্র
মহাশয়!
আপনাকে যখন দুঃখের কথা জানাইা পত্র লিখিত, পত্রের উত্তরে আপনার সান্ত্বনা বাক্যে আশার ক্ষীণ আলোক হৃদয়ে দেখা দেয়! কিন্তু সে ক্ষণিক-মেঘাচ্ছন্ন রজনীতে বিদ্যুৎ ঝলকের ন্যায়। আপনি তো জানেন আমার তমোময় হৃদয়ের আলোক স্বরূপ একটী কন্যা অযাচিত রূপে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, সে কন্যাটী নাই। এক্ষণে আমার গাঢ়তমাচ্ছন্ন হৃদয় গাঢ়তর তিমিরে ডুবিয়াছে। যত প্রকারে সান্ত্বনা আবিনার চেষ্টা পাই সকল বিফল। “ঈশ্বর দয়া কর” “হরি দয়া কর” বারবার বলি সত্য, কিন্তু হৃদয়ের অভ্যন্তরে দেখিতে পাই যে আমার সেই প্রাণ প্রতিমার জন্য আমি লালায়িত। যেমন দিক নির্ণয় যন্ত্রের সূচিকা উত্তরাভিমুখে থাকে, আমারও মন সেইরূপ সেই হারানিধিকে লক্ষ্য করিয়া আছে। যিনি মাতার বেদনা না, তিনি আমার বেদনা সম্পূর্ণ উপলব্ধি করিতে পারিবেন না। কন্যার জন্ম হইতে মরণ পর্য্যন্ত প্রত্যেক ঘটনা আমার মানস দর্পণে প্রতিফলিত হইয়া আছে। এ অবস্থায় শান্তি কোথায়? সততই মনে হয়, আমি কি এই দারুন যন্ত্রণা ভোগের জন্য সৃষ্টি হইয়াছি! আপনার নীতিগর্ভ বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিলে হয়তো বা শান্তিলাভ করিতে পারিতাম। কিন্তু সে বিশ্বাস আমার কোথায়? বাল্যকাল হইতে সংসারচক্রে পড়িয়া অবিশ্বাস করিতে শিখিয়াছি, এই অবিশ্বাসের জন্য আমার অভিভাবক, সাংসারিক অবস্থা ও আমি নিজে দায়ী! কিন্তু দায়িত্ব অর্পন করিয়া ফল কি? অবিশ্বাস অবিশ্বাসই আছে। অবস্থায় পড়িয়া যে দিকে মনের গতি, তাহার বিপরীত দিকে চিরদিনই চালিত হইয়াছে। এই বিপরীত যুদ্ধে শরীর-মন জর্জ্জরীভূত। বলিয়াছি আমার হৃদয় সেই স্নেহ-প্রতিমার দিকে দিবারাত্র রহিয়াছে। তাহার আলোচনা দুঃখময়, কিন্তু সেই আলোচনাই আমার সুখ! হতাশ্বাসপূর্ণ সন্তান-হারা হৃদয়ে আর অপর সুখ নাই। অবিশ্বাসের মূল কিরূপ দৃঢ় হইয়া অন্তরে বসিয়াছে, তাহা আমার জীবনের ঘটনাবলি শুনিলে বুঝিতে পারিবেন। আপনি বলেন, আমার আজীবন বৃত্তান্ত গুনিলে, আমি যে ঈশ্বরে কার্য্যে সৃষ্ট হইয়াছি, তাহা বুঝাইয়া দিবেন। আমিও আমার আদ্যেপান্ত ঘটনাগুলি বিবৃত করিব। যদি কৃপা করিয়া শুনেন, বুঝিতে পারিবেন অবিশ্বাস কিরূপে দৃঢ়ীভূত হইয়াছে এবং তাহার উচ্ছেদ অসম্ভব! শান্তির মূল বিশ্বাস, হয়ত বুঝিতে পারি, কিন্তু সেই বিশ্বাস কোথায়? আমার প্রতি আপনার অশেষ স্নেহ, এই নিমিত্ত সাহস করিয়া আদ্যেপান্ত বলিতেছি। কৃপা করিয়া শুনুন! শুনিতে শুনিতে যদি বিরক্তি জন্মায় পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিবেন। শুনিবেন কি?
মহাশয় আপনি আমার ক্ষুদ্র জীবনী শুনিতে ইচ্ছা করিয়াছেন। ইহা আমার পক্ষে সামান্য শ্নাঘার বিষয় নয়। আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিতেছি দয়া করিয়া শুনিলে কৃতার্থ হইব এবং আপনার ন্যায় মহৎ লোকের নিকট হৃদয়ের বোঝা নামাইয়া এ দুর্ব্বিসহ হৃদয়ভাবে কতকটা লাঘব করিব।
বিনোদিনী দাসী
Latest posts by বিনোদিনী দাসী (see all)
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৫) - জানুয়ারি 21, 2017
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৪) - সেপ্টেম্বর 11, 2016
- আমার কথা – বিনোদিনী দাসী। (৩) - জুলাই 21, 2016