শাহেদ আলীর গল্প – ঐ যে নীল আকাশ
- বাংলা ক্ল্যাসিক। দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া।
- সুলতানার স্বপ্ন – রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
- বাংলাদেশি ফিকশন: গালিভরের সফরনামা – আবুল মনসুর আহমদ
- বাংলাদেশি ফিকশন: অগ্নিগিরি – কাজী নজরুল ইসলাম
- বাংলাদেশি ফিকশন: নেড়ে – সৈয়দ মুজতবা আলী
- শাহেদ আলীর গল্প – ঐ যে নীল আকাশ
- বই থেকে: একটি নীল বোতাম – হুমায়ূন আহমেদ
- ফিকশন: দেশ নাই
- ফিকশন: দোস্তি
[pullquote][AWD_comments][/pullquote] যদিও ১৯৫৩ সালে (জিব্রাইলের ডানা বইটাতে) ছাপা হইছিল গল্পটা, তারপরও শাহেদ আলীর গল্প পড়লে আপনার এখনকার কাসেম বিন আবুবকর-এর উপন্যাসের কথা মনে হইতে পারবে; কারণ এই গল্পে নায়িকা নামাজ পড়ে এবং পড়ার আগে ও পরে দেবরের লগে ফ্লার্ট করে। নায়কও খুশি হইলে ভাবীরে পায়ে ধইরা সালাম করার কথা ভাবে। আমাদের বাংলা-গল্পের যে সাহিত্যিক রিয়ালিটি সেইখানে এইটা একদিক দিয়া ত ‘সাম্প্রদায়িক’, আরেকদিক দিয়া খুবই ফানি এবং নৈতিকভাবে খুবই ‘অসৎ’ একটা জিনিস যে, যে নামাজ পড়ে সে/শে আবার কেমনে ফ্লার্ট করে!
তারপরও ভাবীরে মরা-ই লাগে কারণ তিনি সুন্দরী অনেক এবং বুদ্ধিও খারাপ না, ফিউচার প্রেডিক্ট করতে পারেন। এইটা তারে লোনলি কইরা রাখে, সিজোফ্রেনিয়াক বানায়া ফেলে; কারণ আমাদের অ্যাভারেজ পোয়েটিক মেন্টালিটি কখনোই জাগতিক বিউটিরে নিতে রাজি হইতে পারে না; তারে মরা লাগেই। তবে নষ্টনীড়ের বৌদি’র চাইতে ভাবী’র মরাটা মেবি একদিক দিয়া বেটার। বাঁইচা থাকা বা মইরা যাওয়ার লাইগা জামাই বা দেবরের প্রেমের উপ্রে তারে ডিপেন্ড করতে হয় নাই।
আর ভাষা তো একটা পলিটিক্যাল জিনিস। অনেক অনেক ‘ইসলামী’ শব্দ থাকার পরেও শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’রে বাংলাভাষায় নেয়া গেছিলো গরিব-টাইপ ব্যাপার ছিলো বইলা, যেইটারে সমাজতন্ত্রের ড্রিমে কনভার্ট কইরা পড়া যাইতো। এখন এই খামাখা রোমাণ্টিকতারেও প্রগতি প্রকাশনের চেঙ্গিস আইতমাকভের ‘জমিলা’র সতীন ভাইবা পড়তে পারেন, কিন্তু ‘বর্তন’ ‘কু’কাফ’ ‘মউৎ’ ‘পুশিদা’ শব্দগুলা একরকম ডির্স্টাবই করবো আপনারে।
——————
ইস্কুল ছিলো ফুফুদের গাঁয়- আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে। হেমন্তে আমরা ইস্কুলে যাই হেঁটে- বন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে ছোটাছুটি করে ইস্কুলে যেতে কী ভালই না লাগতো। বর্ষায় মাঠ-ঘাট ডুবে যেতো, বড় বড় ঢেউ উঠতো দু-গায়েঁর মাঝে। ঢেউ-এ আছাড় খেতে খেতে এগোতে আমাদের ছোট নৌকায় ক্লাস শেষে প্রাইয় ফুফুদের বাড়ি হয়ে আসি। মাঝে মাঝে ফুফুর কাছে থেকে যাই।
একদিন ফুফুদের বাড়ি গিয়ে আটকা পড়ে গেলাম, ফুফু কিছুতেই ছাড়লেন না। শেলেট পেন্সিল আর বর্ণবোধের বইখানি যত্ন করে তাকের উপর রেখে দিলেন, তারপর চীনামাটির বর্তনে দুধ-দই দিয়ে আমাকে খেতে দিলেন।
রাতটা ছিল ভারী চমৎকার-পুঞ্জ পুঞ্জ মোলায়েম জোছনায় ঝলোমলো ! বাইরে অনেকক্ষণ ছুটাছুটি করে শুতে গেছি- হঠাাৎ নীল রঙ্গের শাড়ী আর নীল রেশমী চুড়ি পরা একটি মেয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়ালো। ওর মুখের দিকে চেয়েই আমি শরমে চোখ ফিরিয়ে নিলাম- অতো সুন্দর অথচ অতো অপরিচিত!
মেয়েটি একবার ফুফুকে বলল- চাচী আম্মা, ও আজ আমার কাছেই থাকবে! তারপর একটু নুয়ে সে আমার হাত দুটি ধরে টানতে শুরু করে। ভয়ে বুক আমার দুরু দুরু করে উঠলো আমি আরো সেঁধিয়ে যেতে থাকি ফুফুকে বুকের ভেতর।
ফুফু মৃদু হেসে বললেন- না গো বউ, সিদু আমার ভীতু। ও তোমার কাছে যাবে না। মেয়েটি কেমন এক ধরনের মিষ্টি হাসিতে কলকল করে উঠলো-মনে হলো, পাথরের উপর দিয়ে ঝরনার পানি যেন ঝরে পড়ল ঝর ঝর করে। বলল- আমি কি রাক্ষস- খোক্ষস যে আমাকে ভয় পাবে?- বলে সে নীল শাড়ীর ভেতর থেকে শুভ্র গোলগাল হাত দুটি বার করে টেনে আমাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়।
ফুফুও হেসে ফেললেন এবার – যা না সিদু, ভয়ের কি আছে? ও তো তোর ভাবী!
আমার লজ্জা ভয় ও সংকোচ খানিকটা কেটে গেছে এরিমধ্যে। মেয়েটি তাহলে পর নয়- আমার ভাবী; আর ভাবীই যখন, লজ্জা- সংকোচ কিসের? ভাবী তার হাত দুটি এগিয়ে দিয়েছিলো আমাকে কোলে নেবার জন্যে। আমি কিন্তু হেঁটেই চল্লাম। রোজ দেড় মাইল হেঁটে এসে ইস্কুলে পড়ি- আমার কি কোলে ওঠা সাজে? ভাবী আমাকে হাত ধরে তার ঘরে নিয়ে গেল।
ঝকঝকে তকতকে একখানি ঘর। দামি দামি আসবাবপত্র সাজানো- গোছানো। একদিক একটা পালঙ্কের উপর বিছানা পাতা- তাতে দুটি বালিশ। ভাবী বলল- যাও ঘুমাও গিয়ে- আমি নামাজটা সেরে নিই।
দ’চোখ ঘুমে এমনিতেই ভরে আসছিল। ভাবীর নির্দেশ পেয়ে যেন বেঁচে গেলাম। কুচিমুচি হয়ে শুয়ে পড়লাম পালঙ্কের উপর।
হঠাৎ একবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মাথার কাছে লন্ঠনটা তখনো জ্বলছে। দেখলাম, অদ্ভুত চোখ দুটি চেয়ে মেলে আছে আমার দিকে- ঠোঁটে অর্ধস্ফুট হাসির কচি কচি কুঁড়ি। আমার চোখ মুখে ভাবি হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কী মধুর মেলায়েত তার পাশে! সেই স্পর্শের ভেতর দিয়ে তার অগাধ মমতা যেন গলে পড়েছে আমার সর্বাঙ্গে।
আমাকে চোখ খুলতে দেখেই ভাবী হেসে ফেলে- কী গো সিধু ভাইয়া, তোমার ভাই নেই বাড়িতে- তোমাকে আনলাম পাহারা দেবে বলে! আর তুমি কিনা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ- ভাবী একটু মৃদু ধাক্কা দেয় আমাকে- উঠে বসোতো সিধু ভাইয়া; দোরে বসে বসে দুটো আম খাও, আর ওই লাঠি নিয়ে আমাকে পাহারা দাও। ভাবী বেড়ার সাথে দাঁড় করানো বাঁশের লাঠিটা দেখিয়ে দেয়। কিন্তু ভাবী তো একটা জ্যান্ত মানুষ। আম খেতে খেতে ভাবীকে পাহারা দেবো এ কেমন কথা? তবু আমাকে উঠে বসতে হলো। সাহস সঞ্চয় করে বেশ গম্ভীর ভাবেই একবার জিজ্ঞেস করে বসলাম- চোর বুঝি আপনাকে চুরি করতে আসে ভাবী?
হাসতে হাসতে ভাবী এবার ভেঙ্গে পড়ে- আমার মুখ টিপে দিয়ে বলে- আপনি না গো সিদু ভাইয়া, ‘আপনি’ না! আমাকে ‘তুমি’ করেই বলবে। তারপর একটু প্রেমে রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে উঠে- যা হোক তোমার সোনা- মুখের কথাতো একটা শুনলাম! চোর এলেও আর ভয় নেই। চলো ঘুমাই গিয়ে- তোমার গন্ধ পেলেই ওরা জান নিয়ে পালাবে।
শুয়ে শুয়ে ভাবী অনেকক্ষণ পাখার হাওয়া করলো- হাত বুলিয়ে দিলো আমার মাথায়, মুখে পিঠে! তারপর বড়বড় চোখ দুটি একবার আমার মুখের উপর তুলে ধরে। জিজ্ঞেস করলো- তুমি অতো শরমাও কেন সিদু ভাইয়া? আমি না তোমার ভাবী- রাঙা ভাবী। কই চটপট কথা বলবে- তা না, খালি মুখ লোকাবার চেষ্টা করছো।
– আমি যে তোমাকে চিনি না ভাবী – মুখের দিকে চেয়ে থেকেই করুণ স্বরে জবাব দিই-তোমাকে তো আমি কোন দিন দেখিনি!
-আজ তো চিনলে? ভাবীর ঠোট থেকে সমস্ত মুখে একটু খানি মোলায়েম হাসি ছড়ানো- রোজই তোমাকে দেখি, চাচী আম্মার কাছে আসতে, আমার কাছে তো আসে না! একটু থেমে আমার চিবুক ধরে নাড়া দেয় ভাবী – একন থেকে কিন্তু রোজ তুমি আমাকে দেখে যাবে কেমন? তোমার কপালের দিকে চেয়ে আমার কি মনে হয় জানো? তুমি খু-উ-ব বড় হবে- অনেক লেখাপড়া শিখবে! একটু থেমে ভাবী আবার জিজ্ঞেস করে- আচ্ছা তোমার আসল নামটা কি, সিদু ভাই?
ভাবীর মুখের দিকে চেয়ে জবাব দিলাম- নঈম।
– তুমি দেখছ তাহলে আমার মিতা- হা হো করে হেসে ওঠে ভাবী- আমার নাম যে নঈমা!
– হু, গাল ফুলিয়ে আমি বললাম- তুমি ঢঙ করছো ভাবী!
– ঢঙ নাগো সিদু বাইয়া, ঢঙ না, স্নেহে উদ্বেল হয়ে উঠলো ভাবী সত্যি আমার নাম নঈমা! চাচী আম্মাকে জিজ্ঞেস করেই দেখো না!
আমি চুপ করে রয়েছি। ভাবী তার সুন্দর সুঁচালো আঙ্গুলগুলি মোলায়েম করে আমার মাথার চুলে চালাতে থাকে। প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম আমি- এমন সময়ে ভাবী বলে উঠলো – ও মিতা, তোমার মাথায় ফোলা ওটা কী?
চুপ করে রইলাম অনেকক্ষণ- মনে করবার চেষ্টা করলাম, কেন মাথা ফুলেছে আমার।ধীরে ধীরে সব কিছু মনে পড়লো, আর মনে পড়তেই চোখে দর দর করে পানি এসে পড়লো-মাষ্টার সাব না ওয়াহেদকে বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন- ভুল করছে দেখে আমি বলে দিয়েছিলাম। তাতেই রেগে গিয়ে মাষ্টার সাব বাড়ি মারলেন- শেলেট দিয়ে গো ভাবী, ঠাস করে বাড়ি মারলেন মাথায়।
আমার কথাও কন্ঠস্বরে যেন ভাবীর মাথায়ও বাড়ি মারছিল। প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে ভাবী তাই নাকি? ছেলে মানুুষ, অমন করে মারতে হয় বুঝি! দেখো তো কেমন টাট্টি র্সত্রারীর মতো ফুলে গেছে মাথাটা! টের পেলাম ভাবী রেগে উঠেছে মাষ্টারের বিরুদ্ধে- দাঁড়াও, কালই আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি। অমন করে আর ছেলে মানুষকে না মারে!
ভাবীর বুকের কাছে শুয়ে তার অন্তরের ছোঁয়া পাই আমার হৃদয়ে। অন্ধকার রাতে মৃদু বাতাসের মতো ভাবীর মমতা যেন আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভাবীর শরীরে পাচ্ছিলাম একটা গোলাপী সুরভি, তাতেই আমার মনটা ভরে উঠেছিল। সেদিন বাবী আর কী কী বলেছিল কিছুই মনে নেই- শুধু এইটুকু মনে আছে, ভাবীর বিস্ময়কর চোখ দুটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তার যাদুভরা চাহনি আমার দুচোখে এনে দিয়েছিল মধুর ঘুম- সেই যাদু – যা আছে কু’ কাফে, নীল পরীদের চোখে!
মাষ্টার তাদের বাড়িতেই থাকিতেন। পরদিন সত্যি সত্যি ভাবী বেড়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব কটা কড়া কথা শুনিয়ে দিলো। এর সুফলও ফলেছিল- মাস্টার আর কখনো অযথা হাত তোলেননি আমার উপর।
এর পর ভাবীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। ভাবীকে দেখা দিয়ে আসতে হতো- নইলে ভাবী রাগ করতো, অভিমানে মুখ ভারী করে থাকত। এখন আমি বুঝতে পারি, ভাবীর রাগটা ও ছিলো সুন্দর, উপভোগ্য। কারণ, রাগ তো নয়, রাগের ভানই করতো ভাবী। আসলে ভাবী রাগ করতেই জানতো না; এ ছিল তার স্বভাবের একেবারে বাইরে।
কিন্তু অইটুকুতেই কাবু হয়ে পড়তাম; অসহায় বোধ করতাম। আমার করুণ অবস্থা দেখে ভাবী শুধু হাসতো- খই, মুড়ি কিংবা কোন ফলমূল আমার পকেটে গুঁজে দিয়ে বলতে তোমার উপর খু-উ-ব রেগেছি সিদু ভাইয়া- বলতে বলতে ভাবীর রাঙা মুখ খানিতে গাম্ভীর্য ফিকে হয়ে আসতো- তবে হ্যাঁ, এক শর্তে আমরা রাগ ভাঙ্গতে পারে।
আমি জানতে চাইতাম, ভাবীর শর্তটা কী।
ভাবী বলতো- আজ তোমাকে এখানে থাকতে হবে।
অবুঝ কচি বয়সে আমার, তুর সেই বয়সেই মনের গভীর উপলব্ধি করেছিলাম-ভাবির সান্নিধ্যে কেমন যেন একটা অনির্বচনীয় মাধুর্য আছে। মাধুর্যের সেই জান্নাত থেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসিত হতে মন চাইতো না। সানন্দে আমি ভাবীর কাছে থেকে যেতাম।
ভাবীর সৌন্দর্যের যেমন তুলনা নেই, তেমনি তার স্নেহ-মমতাও অপরিমেয়। আমাকে কত স্নেহই যে ভাবী করতো!
আগে ফুফুর কথায় থাকতাম, এখন ভাবী আমাকে বন্দী করতে লাগলো তার নীল আচঁল দিয়ে। রাতের বেলা সকল কাজ সেরে ভাবী আমাকে নিয়ে বসতো- বলতো, তোমার উপর কি আমি রাগ করতে পারি মিতা? আসলে তোমাকে আটকাবার জন্যেই রাগের কথা তুলেছিলাম।
‘মিতা’ সিদু ভাইয়া’ যখন যা মুখে আসতো ভাবী বলতো, তারপর বই খুলে আমার আগামী কালের পড়া বলে দিতো। তার পাঠশালার বিদ্যেটাকে কাজে লাগাতে আমাকে গিয়ে! তারপর শুরু করতো রূপকথার কাহিনী- শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
একদিন পাঠশালার পড়া শেষ হলো। বৃত্তি পেয়ে পাস করলাম দশ বছর বয়সে। এরি মধ্যে ভাবী আমাকে ডেকে পাঠালো। হাতে যেন আসমান পেলো ভাবী। আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠে বলল- আজ ছাড়ছিনা সিদু ভাইয়া, তোমার সাথে অ-নে-ক কথা!
-কিন্তু ভাবী, আমি বললাম, কাল যে আমার মাইনর ইস্কুলে ভর্তি হবার তারিখ!
– সেজন্যই তো তোমাকে থাকতে বরছি, মাথাটা একটু কাঁত করে ভাবী উচ্চারণ করে।
সুতরাং থেকে যেতেই হলো। হৃদয়ের হাতে যেখানে কর্তৃত্ব, যুক্তিতর্ক সেখানে আচল। সাধারণত ভাবী রান্না-বান্না করতো না, একাজ করতো দুটি ঝি, আর তার তদারক করতো ভাবীর ছোট জা উকিলের মা। আজ ভাবী নিজেই অনেক কিছু রাঁধলো আমার জন্যে। পাতিল থেকে নামলো দই, আর একটি বাক্স থেকে বার করলো চিনি, খেজুরের গুড় ইত্যাদি।
এসব দেখে-ফুফু হাসলেন- আর আমি তো আবাক ! আমার জন্য এতো করেছে ভাবী, কিন্তু আমি কতটুকুই বা খেতে পারি!
তবু, সাধ্যিমতো খেতে হলো। ভাবী পাশে বসে এটা-ওটা তুলে দেয় আমার পাতে, আর বলে- খেতে বসে কোনদিন শরমাবে না সিদু ভাইয়া, ঠকতে হবে।
ভাবী বলেছিল, আমার সঙ্গে তার অনেক কথা, কিন্তু কার্যত কোন কথাই হলো না। কেমন যে মনমরা হয়ে ছিল ভাবী। পরদিন বিদায়ের বেলা ভাবী আমাকে বলল- তুমি অনেক বড় হবে সিদু ভাইয়া; তাই বলে আমাদের কিন্তু ভুলে যেয়ো না। বাড়ি এলেই দেখে যেয়ো, কেমন?
আমি ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম- কথাগুলি উচ্চারণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই তার কালো চোখ দুটি ভরে আসে পানিতে আর ঠোঁট দুটি নড়ে ওঠে। এই দোয়ার জন্যেই বুঝি ভাবী ডেকেছিল! ভাবীর করুন মুখের দিকে চেয়ে থাকতেই হঠাৎ আমার চোখে পড়ে গেল তার রুপ- এমন সুন্দর, এমনি শুচিস্নাত, কমনীয় আমার ভাবী। নীল শাড়িটা লতিয়ে লতিয়ে উঠেছে তরি অগ্নিবর্ণ দেহটাকে। পুষ্ট সুডৌল হাত দুটিতে তার চারটা করে নীল রঙের রেশমী চুড়ি- একটা নীল পাথর বসানো নাক-ফুল তার তীক্ষ্ণ নাকে। মুখ তার হাত একটা রক্তিম শুভ্রতায় ঝলমলে করেছে।
ভাবীর দিকে আমি চেয়েছিলাম অপলক দৃষ্টিতে- আমার চোখের পাতা এক সময়ে সজল হয়ে এলো। ভাবীর সাহচর্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমি-ভাবতেই বুকটা ব্যথায় মর মর করে উঠলো।
ভাবী তার নীল আচলের অগ্রভাগ দিয়ে আমার চোখ মুছে দিলো, বলল- মন দিয়ে পড়াশোনা করো মিতা- আদর পাবে সকলের। একটু থেমে আবার শুরু করে- বিদেশে যাচ্ছে, সাবধানে থেকো সিদু ভাইয়া পাঞ্জেগানা নামাজ ছেড়োনা কখনো।
ভাবী তখন কুড়ি- একুশ বছরের তরুণী। কোন সন্তান হয়নি তার। অদ্ভুত তার রঙ আর গড়ন। তার অনিন্দ্য সুন্দর চেহারাখানি আমার মনের পর্দায় মুদ্রিত হয়ে রইল! মিষ্টি হেসে সেদিন ভাবী বিদায় দিয়েছিল আমাকে।
দুরের এক মাইনর ইস্কুলের ছাত্র আমি। ছুটিতে বাড়ি আসি- বাড়ি এলেই বেড়াতে যাই ভাবীদের ওখানে।
একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম, জামাল ভাইকে প্রায় কখনো বাড়ি পেতাম না। ভাবীদের নিয়ে তিনশ মণি এক নৌকা করে ও দেশ বিদেশ ধান,পাট, সর্ষে ইত্যাদির কারবার করতো। মাসে দু’চার দিনের বেশি তার বাড়ি থাকা হতো না। যদিও বা কখনো তার সাক্ষাৎ পেতাম, দেখতাম – বাইরের ঘরে বসে কাগজ, কলম নিয়ে ও টাকা-পয়সা হিসাব করছে… করছেই। এও লক্ষ্য করেছিলাম, ভাবীকে অত্যন্ত সমীহ করে চলে জামাল ভাই।
ভাবীর ঘরে সাধারণত অন্য কেউ আসতো না – দেবর দুটি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করতো, – সে শ্রদ্ধার মধ্যে ভয়ের ভাগই ছিল বেশি – তাই, পারতপক্ষে ওরা তার কাছ ঘেঁষতো না। শ্বশুর নেই – শাশুড়ী তাকে স্নেহ করেন নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি – তাই, তার স্বভাবের কোন বৈচিত্র্যই তাঁর কাছে ধরা পড়তো না – স্নেহে এমনি অন্ধ ছিলেন তিনি। প্রকান্ড ছিল তাদের অবস্থা – বাড়ির বড় ছেলের বউ বলে ভাবী ছিল সকলের স্নেহ ভালবাসার পাত্রী-রূপে আর গুণে সকলের মন জয় করেছিল। এজন্য নানাদিক দিয়েই সুবিধা ছিল তার।
আনন্দের উৎসে অবগাহন করার জন্য আমি লালায়িত হয়ে উঠতাম। আমাকে পেয়ে ভাবী উচ্ছ্বাসে-আবেগে অধীর হয়ে অধীর হয়ে উঠতো – তার স্নেহ-মমতার ডালি উজার করে ঢেলে দিতো, তবু যেন তার তৃপ্তি মিটতো না। অনেক দিনের যত্ন-সঞ্চিত স্নেহ ভালবাসাকে একদিনে ঢেলে দিয়েও যেন শেষ করে উঠতে পারতো না ভাবী। মাঝে মাঝে শার্ট-প্যান্ট কিনিয়ে এনে বাক্সয় ভরে রেখে দিতো – আমি গেলেই তার মনের মতো করে আমারে পরাতো, তারপর আমাকে পাশে বসিয়ে থুৎনিতে ধরে বলতো! নাদুস-নুদুস সিদু ভাইয়া, তার জন্য আনবো রাঙা মাইয়া।
লজ্জায় আমি রাঙা হয়ে উঠতাম। ভাবী আমার বিয়ের কথা ভাবছে এখনি! মাথা নিচু করে বসে থাকতাম চুপ করে।
হেসে হেসে আবার ভাবী বলতো – না গো সিদু ভাইয়া, বিয়ে তোমার অতো জলদি হবে না। এমনিতে লোভালাম আর কি! তোমার জন্য কখন বউ আনবো জানো? – সেই যখন লেখাপড়া শেষ করে দেশোজাড়া নাম কিনে বাড়ি ফিরবে – তখন!
কেন জানি, শুরু থেকেই আমার সম্বন্ধে ভাবীর ধারণা ছিল খুব উঁচু। আমি তার কারণ জানতাম না, অথচ মনে মনে আমার ভয় হতো – সত্যি কি আমি এতো লেখাপড়া শিখতে পারবো? – ভাবীর উচ্চ আকাঙ্খা কি আমাকে দিয়ে পূরণ হবে?
মাঝে মাঝে প্রশ্ন করতাম – সত্যি আমি এতো বড় হবো ভাবী?
– সত্যি গো মিতা, সত্যি – ভাবী আমার দু’কাঁধ ধরে নেড়ে দিয়ে বলতো – তোমার চোখ আর কপাল দেখেই আমি বলতে পারি – অনেক লেখাপড়া আর মান-ইজ্জত রয়েছে তোমার নসিবে!
– তা হলে তুমি নজ্জুম, একদিন আমি বলেছিলাম। কথাটা আব্বার কাছে শেখা। বুঝতে না পেরে ভাবী জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
– মানে, গণকঠাকুরাণী! অর্থটা বুঝিয়ে বললাম এবার।
– হুই, এক অদ্ভুত ভঙ্গী করে হাসতে হাসতে ভাবী সায় দেয়।
– আমি গণকের এৎবার করি না – মুরুব্বিয়ানা ঢঙে বললাম – করলে ঈমান নষ্ট হয়!
– বেশ তো কথা শিখেছো সিদু ভাইয়া, আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলাতে লাগলো ভাবী, আর তার প্রতিটি আঙুলের ডগা বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো তার মমতার বিগলিত ধারা – তাতে আমি সিক্ত হয়ে উঠলাম।
ভাবীর ঠোঁটে তখনো হাসি – সে হাসি তার চোখে, গালে আর কপালে বিস্তৃত। বিস্ময়কর ভাবীর হাস্য-দীপ্ত মুখ, মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি তাকিয়েছিলাম তার অপূর্ব সুন্দর মুখখানার দিকে।
আমার চোখের উপর তার দৃষ্টি রেখে ভাবী বললো আর কোন গণকের কথা কবো না । কিন্তু ভাইয়া আমার কথা বিশ্বাস করো, অনেক সুফল পাবে। একটু থেমে হেসে উঠলো – তুমি জানো না বুঝি, আমি সুলেমানী খেতাব পেয়েছি।
ভাবী রহস্যচ্ছলেই কথাগুলো বলেছিল। কিন্তু কি জানি কেন, ভাবীর প্রত্যেকটি কথাকেই সত্য বলে মেনে নেয়ার জন্য মন আমার তৈরি থাকতো। বিনা প্রশ্নে আর কথা মেনে নিতে পারলেই আমি যেন বেঁচে যেতাম।
এতদিন ছিলাম শিশু। সেই শিশুর চোখ দিয়ে শুধু পৃথিবীর ছবিই নিতাম। আর সীমাহীন বৈচিত্র্যে ধরা পড়তো। কিন্তু এখন আমার চোখ আর মন শৈশবের আচ্ছন্নতা কাটিয়ে এসে দাঁড়ালো এক নবজন্মের দ্বারদেশে। আমি এখন আবিষ্কারক – আবিষ্কারের দৃষ্টি দিয়ে ভাবীর দিকে তাকাতে শুরু করি ভাবীর দিকে। আচার-আচরণে, রঙে-চেহারায় ভাবীকে নতুন মনে হলো আর মনে হলো তার মধ্যে যেন বৈচিত্র্যের অন্ত নেই। অথচ এখন বুঝতে পারি আমাদের পরিচয়ের প্রথম মুহূর্তগুলোতেও ঠিক এমনিভাবেই ছিল ভাবী। কিন্তু তখন এভাবে দেখাবার মন আর চোখ আমার ছিল না। সেদিন শিশুর মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আজকের বিচিত্রার মধ্যে যে মমতাময়ীকেই শুধু দেখেছি।
তখন মাইনর স্কুলে পড়ি, ষষ্ঠ শ্রেণীতে।
গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি এসেছি। এক বিকালে বেড়াতে যাই ফুফুদের ওখানে। ফুফুর সঙ্গে করে ভাবীর ঘরে গেলাম। ভাবী জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছে মাগরেবের । তার পাশেই মাটিতে একটি কচি মেয়ে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করছে – চিৎকার করছে হয়তো দুধের জন্যই।
ভাবীর যে মেয়ে হয়েছে আমি জানতাম না। হাতে একটা টোপলা ছিল। খাটিয়ার উপর রেখে দিয়ে মেয়েটিকে কোলে নিলাম চুপ করবার জন্য। লুণ্ঠনের আলোতে ধরে দেখতে চেষ্টা করি দেখতে কেমন হয়েছে মেয়েটি।
নামাজ শেষ হলো জায়নামাজটা তুলে রেখে ভাবী অনেক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার দিকে, মুখে তার মৃদু হাসি। আমার দৃষ্টিও ভাবীর চোখের উপর – অস্পষ্ট আলোতেও আমি দেখতে পেলাম, গাঙচিলের চোখে আর ভুরু জোড়ার মতো ভাবীর সুন্দর চোখ ভুরু – সেই গাঙচিল, নীল আসমানে যে ভেসে বেড়ায় নীল সাগরে ছায়া পড়ে আর পানিতে যে ছোঁ দেয়।
দৃষ্টি নিচু করে নিলাম আমি।
আমার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভাবীর চিরদিনের অভ্যাস। সুন্দর সুগঠিত আঙ্গুলগুলি অতি মোলায়েম করে ভাবী চালিয়ে নিতে থাকে আমার ছোট চুলের উপর দিয়ে। একবার বললো – বেশ তো বড়-সড়ো হয়ে পড়েছো সিদু ভাইয়া, একবছরে অনেকখানি বেড়ে গেছো। একটু থেমে মেয়েটিকে আমার কোল থেকে নিজের কোলে নেয়। তারপর হো হো করে হেসে ওঠে। একটা মেয়ে হলো আমার – আমিই কি কম বদলে গেছি – এক বছরে।
ভাবী কথা বলল হেসে হেসে অথচ কেন যেন একটা প্রচ্ছন্ন তিক্ততার আমেজ তার কথায়। এই প্রথমবারের মত। একটু নৈরাশ্যের সুরও যেন। কিন্তু কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। ভাবীকে সালাম করবার জন্য একবার নুয়ে পড়ি। মন যেন বলছিল, ভাবীকে যদি সালাম করে আমার ভালোবাসা না জানালাম তো সংসারে আর সালাম করবে কাকে।
কিন্তু ভাবী চট করে আমার হাত ধরে ফেলে – না গো সিধু ভাইয়া সালামের দরকার নেই । অমনি বেঁচে থাকো। আমার মাথায় যতো চুল, ততো বছর হায়াত দরাজ হোক তোমার।
সেই পুরনো আর্শিবাদ। অনেক আত্মীয়ার কাছ থেকেই এ দোয়া আমি পেয়েছি, পেয়েছি অজস্র বার। হেসে প্রশ্ন করলাম – এই পুরনো কথাটা বুঝি তোমরা খুব ভাল পার ভাবী?
– কোনটা গো সিদু ভাইয়া? ভাবী রহস্যময় হয়ে ওঠে।
– এই যে চুলের গর্ব – যত চুল ততো বছর হায়াৎ।
ভাবী এবার শব্দ করে হেসে উঠে – ঠিক বলেছো। চুলের গর্ব গুনতিতে তো মেয়ে-পুরুষের চুল কমবেশি হবে না, তবু মেয়েরাই খালি এই দোয়া করে – পুরুষেরা করে না; তার কারণ মেয়েদের চুল লম্বা। চুলের গর্বে গণিত ভুলে যায় ওরা – কি বোকাই না এই মেয়ে জাতটা!
ভাবী তখনো হাসছে।
মুখে গাম্ভীর্যের একটা ছায়া বিস্তার করে বললাম – তুমি তো দোয়াই করলে ভাবী আমার দুর্গতির কথা একটুও ভাবলে না। তোমার মাথায় যতো চুল, ততো বছর আমার হায়াৎ বাপ-দাদার আশি বছর হয়েছে – এতেই তিনজনে ধরে তাঁকে উঠাতে হয় বিছানা থেকে। রাতদিন শুধু কাঁদেন আর কাঁদেন – কেম মউৎ হয়না। একটু থেমে আরো গম্ভীর হয়ে উঠিঃ দুশমনা ছাড়া আর অমন দোয়া কেউ করতে পারে না ভাবী। তুমি আমার দুশমন উহ – বুড়া হয়ে বেঁচে থাকতে কত কষ্ট।
– দূর পাগল এক ঝলক হাসিতে ভাবী উচ্চকিত হয়ে ওঠে। গাঙচিলের চোখ দুটি তার ফরফরাসের মতো ঝলসে ওটে। সেই আবছা আলোতে আমি স্পষ্টই দেখলাম, ঝলসে উঠেছে ভাবীর চোখ দুটি – মানুষ মরতে চায় না, তাই না এ দোয়া। নইলে আমি নিজের জন্য কি চাই, জানো সিদু ভাইয়া? ভাবী একটু থামলো – রোজ নামাজ পড়ে মোনাজাত করি, যৌবন থাকতেই যেন আমার মউত হয়। এই রূপ, আমার দেহ আমার কাছে এতো প্রিয় – সিদু ভাইয়া!
কথগুলি ঠিক বুঝতে পারলাম না – অথচ, তার কণ্ঠস্বর আর স্বাপ্নিকতায় কেমন যেন অভিভূত হয়ে পড়লাম। অদ্ভুত এক আন্তরিকতায় আবহাওয়াটা ভারী হয়ে ওঠে।
কোন কথাই না পেয়ে একবার বললাম – আসল কথাই জিজ্ঞেস করিনি ভাবী, তুমি আছো কেমন?
এতক্ষণ ভাবী দাড়িয়ে ছিল, এবার বসে পড়লো আমার পাশে। তারপর সন্ধানী দৃষ্টির আলো ফেলে সে আমার মুখের দিকে তাকাতে থাকে। সেই দৃষ্টির প্রখরতায় আমি সংকুচিত হয়ে উঠি। মাথা এমনিতে আমার নিচু হয়ে এলো।
– তোমার বুদ্ধি-সুদ্ধি কম সিদু ভাইয়া, ভাবীর ধারালো ঠোঁটে ছুরির মতো একটু করুণ হাসি চিক চিক করে উঠলো। – নইলে, আমাকে দেখেই বুঝতে পারতে, আমি কেমন আছি।
ভাবীর স্বরে কিছুটা পার্থক্য ধরতে পারছিলাম, তবু ভাবী আমার কাছে অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য।
– বুঝতে পারলে না, সিদু ভাইয়া? ভাবী আবার শুরু করে – মেয়েটাকে জম্ম দিয়ে অবধি মনটা খারাপ হয়ে গেছে।
– কিন্তু কেনো, ভাবী? আমার মধ্যে বিস্ময় এবং জিজ্ঞাসা একই সঙ্গে প্রবল হয়ে ওঠে।
সীমাহীন নৈরাশ্যে পুঞ্জিভূত হয়ে ওঠে ভাবীর কণ্ঠস্বর – প্রায় এক যুগে একটি মেয়ে হলো আমার – রক্ত মাংস চুষে যে মেয়ে হলো, সে হলো কিনা এত বদসুরৎ। পেটুকের মত ও আমাকে দশ মাস খেয়েছে – কিন্তু পেলো না আমার কিছুই। জানো সিদু ভাইয়া – এর জন্য লজ্জায় আমি মুখ দেখাতে পারি না। – ভাবীর কণ্ঠ থেকে সমগ্র পুঞ্জিত নৈরাশ্য ও বেদনা যেন এবার ঝরে পড়ে – আমি অতো সুন্দর, আর আমার মেয়ে – আমার মেয়ে, – আমার মেয়ে, অসহায় ব্যর্থতায় আরো করুণ হয়ে ওঠে ভাবী – মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে, গলা টিপে মেরে ফেলি। বিশ্রী কিছু আমি দেখতে পারিনে, অসুন্দর সব কিছু আমার দু’চোখের বিষ।
এক ঝলকে আমি ভাবীর সমস্ত ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে নেই। আশ্চর্য রকমের সুন্দর মনে হলো ঘরটা। ভাবী সুন্দর বলেই না তার ঘর সুন্দর, এই সংসার সুন্দর। সব কিছুই শিল্পীর কুশলতার সঙ্গে এমন করে সাজানো-গোছানো যে, চোখ বুলিয়ে একটা পরম শান্তি মেলে।
– আমার সব কথা আজ বুঝবে না সিদু ভাইয়া, বুঝবার বয়স তোমার হয়নি, এক বিচিত্র রহস্যময় স্বরে ভাবী শুরু করে, তার মনের সব গ্রন্থি যেন খুলে গেছে আজ – তবু তোমাকে তো কিছু লুকাতে পারি না – সব কিছু খুলে বলতেই হবে। একটু থেমে – সুন্দরকে আমি ভালবাসি সিদু ভাইয়া, সুন্দর সব কিছুর উপর আমার দারুণ লোভ। তোমাকে যে অতো ভালবাসি, তার কারণ তুমি সুন্দর।
লজ্জায়-শরমে আমাকে মাথা নিচু করতে হলো। এদিকে ভাবী বলেই চলেছে – আমি তো বলি, দুনিয়াটা কেন সুন্দর হবে না? বদসুরৎ কেন থাকবে? সব মেয়েই কেন সুন্দর হবে না আমার মতো? সব পুরুষ কেন হবে না ইউসুফের মতো?
– তোমার মতো না জুলেখার মতো? ভাবী? ভাবীর ভুল সংশোধনের চেষ্টা করি।
– জুলেখা কি আমার চেয়েও সুন্দরী ছিল? – মোটেই না সিদু ভাইয়া, মোটেই না। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করে ভাবী, এ সব পুঁথিওয়ালাদের তৈরি কথা, বানানো কথা।
ভাবী যেমন দুর্লভ সৌন্দর্যের অধিকারিণী, তেমনি তার রূপের অহংকার। সেই সময় লুণ্ঠনের মোলায়েম আলোতে ভাবীর পাশাপাশি বসে কথাগুলি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি, বুঝবার বয়স তখনো হয়নি। আমি শুধু চুপ করে শুনছিলাম ভাবীর কথাগুলি, আর নেহায়েৎ দায়ে পড়ে জবাব দিচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। ভাবী আপন মনে বকেই যাচ্ছিল।
বহুক্ষণ পর আমি বললাম – ভাবী, আমার খিদে পেয়েছে।
– তাই তো সিদু ভাইয়া – ভাবীও যেন এতক্ষণে ফিরে আসে তার সাংসারিক অস্তিত্বে – আমার তো খেয়ালই ছিল না, দেখো তো, মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে।
মেয়েটিকে শুইয়ে রেখে ভাবী ফিডারের বোঁটা ওর মুখে ঢুকিয়ে দেয়। কাঁদছিল তবু তাকে বুকের দুধ দিল না ভাবী। পিঠে থাবা দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার ফিরে এলো। – একটু সবুর করতে হবে মিতা, ভাবী বলল – উকিলের মাকে বলে এলাম, তাড়াতাড়ি করতে।
তারপর, আমার পাশে বসে ভাবী আমার আঙুলগুলি দেখতে থাকে। আমার ডান হাতটা নিয়ে নাড়া চাড়া করতে করতে বলে – সিদু ভাইয়া, তোমার আঙুলগুলি তো ভারি চমৎকার।
চমৎকার না ছাই, – ভাবীর হাতের দিকে চেয়ে বলি – তোমার আঙুলের কাছে আমার আঙুলও আঙুল নাকি। একটু থেমে ভাবীর মুখের উপর চোখ রেখে বললাম – ভাবী। তুমি তো চেয়েই দেখলে না! তোমার জন্য কি এনেছি। তারপর, টোপলাটা খুলে জিনিসগুলি তুলে দেই। ভাবীর হাতে – শাড়ী, ব্লাউজ, সাবান আর কয়েকটা চুড়ি। বললাম – তুমি নীল রঙ ভালোবাসো ভাবী, তোমার জন্য তাই নীল রঙের জিনিসই কিনেছি।
ভাবী কিছুক্ষণ স্তব্ধ বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো – তারপর, আনন্দে আবেগে আলুলায়িত হয়ে পড়লো, আর তাতে করেই যেন তার সৌন্দর্য হঠাৎ খুলে গেল, শত বার স্ফুরিত হলো – দেহ হয়ে উঠলো এক অব্যক্ত সঙ্গীতের সুর। ভাবী দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আমাকে – আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরে ভাবি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে – সিদু ভাইয়া, আমাকে তুমি এতো ভালোবাসো যে, আমার মনের রঙ পর্যন্ত তুমি জানো!
মুখ তুলে দেখি – ভাবীর চোখ টলমল করছে। আশ্চর্য – ভাবী কাঁদছে।
ভাবীর এই আকস্মিক উচ্ছ্বাসে আমি আভিভূত হযে পড়ি – চমকিত হই। আর মনে হলো ভাবী কেমন যেন দুর্বোধ্য, রহস্যময়ী।
অনেকদিন পর জেনেছিলাম – নীল রঙ শুধু ভাবীর মনের রঙ নয়, এ তার কল্পনার রঙ, আকাশের রঙে রাঙানো জীবনের উদারতার রঙ, বিশালতার রঙ। এই রঙেই তার সারা জীবন ছিল এক আকাশমুখী আকাঙ্খায় বিভোর। আকাশের রঙের অঞ্জন যে চোখে-মুখে পড়লো না, সে কি পারলো, পারলো কি তার জড় অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে উঠতে? – কোন দিনই পারলো না! জিনিসগুলি আমি আব্বার টাকায় কিনিনি। মনে কেমন যেন একটা ধারণা জম্মেছিল। ভাবী আমার এত আপন যে তার জন্য আব্বার টাকায় জিনিস কিনলে তাকে অপমানই করা হবে। তাই তিন মাসের বৃত্তি টাকা জমিয়ে জিনিসগুলি কিনেছিলাম।
পালঙ্কের ওপাশে গিয়ে ভাবী শাড়ি, ব্লাউজ ও চুড়ি পরে। তারপর, ষোড়শী তরুণীর মতো স্মিত হেসে আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমি চেয়ে আছি ভাবীর দিকে। কে বলবে, ওর বিয়ে হয়েছে – বিয়ের পর এক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে? – তার উপর, ও একটি সন্তানের মা?
ভাবী মুখে হাসির ঝিলিক লেগেই ছিল। বলল- তোমার জিনিস, তোমাকেই তো পরে দেখাতে হবে সকলের আগে – তাই না সিদু ভাইয়া তোমার চোখ দিয়ে আজ দেখো – নীল পোশাকে কেন সুন্দর দেখায় আমাকে।
কথাগুলি ভাবী বলেছিল, আর এক অদ্ভুত চাপা হাসিতে ঝিলিক দিয়ে উঠছিল তার দুটি কালো চোখ।
ভাবীর হাসিটা লক্ষ্য করতে গিয়েই আমার নজরে পড়লো ঠোঁট দুটির উপর। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ভাবীর ছোট ছোট দাঁতগুলি ঝলমল করছে। সুন্দর মসৃণ মুক্তার পাঁতি যেন।
বললাম – ভাবী, তুমি কত সুন্দর!
জবাবে ভাবী শুধু মুখ টিপে হাসলো।
এরপর বহুদিন আর ভাবীর সঙ্গে দেখা হয়নি। পড়াশুনায় একটু বেশি করেই মন দিয়েছিলাম। ছুটিতে প্রায়ই বাড়ি আসি না। এলেও দু’একদিন থেকেই আবার ফিরে যাই। শহরে, প্রবল ইচ্ছা সত্বেও দেখা করি না ভাবীর সাথে। মনে হতো, ভাবীর সাথে দেখা করতে হলে বিপুল অবসর দরকার – এত তাড়াহুড়ার মধ্যে দেখা হলে দুঃখ পাবার সম্ভাবনাই বেশি।
ম্যাট্রিকের টেষ্ট দিয়ে যখন বাড়ি আসি ভাবীকে দেখার জন্য ওদের ওখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা হলো না – ভাবী তখন তার বাপের বাড়িতে নাইওর। জামাল ভাই অবশ্য বাড়ি ছিল, হেসে হেসে বলেছিল – সিদু, তোমার এবারকার আসাটা একেবারে মাঠেই মারা গেল।
আমিও হেসে জবাব দিই, সত্যি ভাই-সাব, ভাবীকে ছাড়া আপনাদের সংসারটিই অন্ধকার – ভাবীই এ বাড়ির রোশনি।
জামাল ভাই হেসে সায় দেয়। আমার আর ভাবীর অন্তরঙ্গতাকে জামাল ভাই উপভোগই করে, যেমন করে লোকে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে নদী প্রবাহকে।
প্রবেশিকায় বৃত্তি পেয়ে যে বছর কলেজে ঢুকি সে বছরই গ্রীষ্মের ছুটিতে আবার ভাবীর সাথে দেখা। আবারও ভাবীর কোলে দেখলাম, একটা কচি ছেলে, ভাবীর দ্বিতীয় সন্তান । আশ্চর্য, এ সন্তানটিও তার মনঃপুত নয়। ছেলেটি দেখতে শুনতে তেমন সুন্দর হয়নি, তার শরীর সুষ্ঠ সুগঠিত নয়।
সাক্ষাতের প্রথম মুহুর্তেই ভাবীর দিকে সন্ধানী দৃষ্টি মেলে চাইলাম – ভাবী যেন আরো সুন্দর হয়েছে। এতটুকু বেড়েছে কিংবা ভেঙেছে কোথাও, মনে হলো না মোটেই। তার একচুল আগেকার বয়সেই ভাবী থেমে গেছে – থেকে গেছে!
– এতোদিনে বুঝি মনে পড়লো, সিদু ভাইয়া! ভাবীর আর্দ্র কণ্ঠে সীমাহীন অভিযোগ পুঞ্জিত হয়ে ওঠে।
– আমাকে ভুল বোঝো না ভাবী, আমি মিনতি করি, তোমাকে ভুলে যাবো, সত্যি তুমি ভাবতে পারো? এ ক’বছর প্রায় বাড়িতেই আসিনি। তোমারই তো হুকুম লেখাপড়ায় যেন মন দিই। পড়ার যা চাপ আজকাল। তবু একবার খুঁজে গেছি তোমাকে – তুমি বাড়ি ছিলে না। একটু থেমে আবার বলি – কি মনে হয়েছিল, জানো ভাবী? তুমি নেই, এই সংসারটা যেন অন্ধকার। এ বাড়ির আনন্দ আর রোশনি হচ্ছে তুমি।
দেখলাম, ভাবী হাসছে।
বললাম – তুমি হাসছো ভাবী? এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না আমি।
কোন কিছু না বলে ভাবী আমার মুখের উপর তার চোখের আলো ফেললো। চেয়ে রইলো অনেকক্ষণ, একদৃষ্টে। আমি কিছুটা সংকুচিত হই – তারপর, ভাবীর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করি, কি দেখছো ভাবী?
– আজকাল বুঝি খুব ক্ষুর চালাও সিদু – ভাইয়া?
হঠাৎ আমার দাড়ি গোঁফের উপর তোমার নজর পড়লো যে, রসিকতায় হার মানতে রাজি নই – মেয়ে দৃষ্টি বুঝি!
সত্যি । ভাবী হেসে ওঠে, ও দুটি জিনিস পুরুষদের নিশানা কিনা। এতদিনে তাহলে তুমি পুরুষ হলে।
– এর আগে বুঝি ছিলাম না?
– তোমাকে পুরুষ মনে করারও কোন কারণ ছিল না। ভাবীকে হারানো মুশকিল।
– তাহলে, তুমি আর আমি এতদিন এক জাতই ছিলাম? কথায় কথায় আমরা দুজনেই যে হালকা রসিকতায় এসে উত্তীর্ণ হয়েছি, জানতেই পারিনি।
– অবশ্যি, ভাবী ছদ্ম গাম্ভীর্যে মনোরম হয়ে ওঠে – কথাটা খুবই সত্যি। সিদু ভাইয়া।
– তাহলে তো দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে হয়, – আমি আরো হালকা হয়ে উঠি,আল্লাহ আমার আগের অবস্থায়ই ফিরিয়ে দিন – ভাবীর সাথে আমি এক জাত হয়েই থাকতে চাই।
– না সে হবে না, ভাবী জোর দিয়ে বলে, এখন থেকে মনে রেখো আমরা দুজাতের মানুষ – আমি মেয়ে, তুমি পুরুষ!
– সুতরাং ফাঁক রেখে চলতে হবে, তাই না! এতক্ষণে যেন একটা খাঁটি কথা খুঁজে পেলাম, তা যাই হোক, তোমার নসিহৎ, কুর্ণিশ করবো। তবে এও বলে রাখছি, মাঝে মাঝে ভুলেও যেতে পারি – কারণ, তুমি মেয়ে, আমি পুরুষ, আর আমরা দুজনেই আবার মানুষ।
ভাবী এবার কলহাস্যে ভেঙে পড়ে – একটা স্নিগ্ধ হাসির লাবণ্য মেখে তার মুখখানা ঝলমল করে উঠলো – উচ্ছ্বাসের উদ্ভিন্নতায় সে মুখ আশ্চর্য রকম কমনীয়, হাসতে হাসতেই ভাবী বলল না! আর পারা যাচ্ছে না! তুমি তো শুধু দাড়ি – গোঁফেই ক্ষুর চালাও না – তোমার জিবের আগায়ও ধার দিয়েছো জব্বর! যেন নাপিতের ক্ষুরের ধার। তারপর একটু থেমে এক ঝলকে ভাবী প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দেয় – আচ্ছা, তুমি আছো কেমন, সিদু ভাইয়া।
– তোমার আজো বুদ্ধি-সুদ্ধি কিচ্ছু হলো না – হাসি চেপে রেখে আমি ভাবীর মুখের দিকে চেয়ে বলি – নইলে দেখতে পেতে, মনের দিক দিয়ে আমি বিলকুল এক শ’জাদা। একটু থেমে বললাম – বাইরে তো তোমাকেও ভালই দেখছি, – সেই একযুগ আগের রাঙা ভাবীটি! – কিন্তু তোমার মনের খবর কি, ভাবী?
– বদলা নিলে বুঝি? দুষ্টু তো কম নও! ভাবীর কণ্ঠ থেকে অসহায় বেদনা ঝরে পড়ে। – তা নাও, কিন্তু আমার মনের কথা! – একটু থেমে বলে, সে তুমি জিজ্ঞেস করো না সিদু ভাইয়া, আমার মতো হতভাগী কেউ নেই – কেউ নেই! বলতে বলতে ভাবী এক অদ্ভুত চাপা কান্নায় করুণ হয়ে ওঠে – তার সুন্দর চেহারাটার উপর যেন সহসা একটা কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে ভাবী, তারপর আপনা থেকেই বলে ওঠে – তোমার কাছে কিছুই লুকাবার নেই সিদু ভাইয়া, ছেলেটা আমার মন একদম ভেঙে দিয়েছে! যা আমি চাইনি, তেমনি ছেলে এলো আমার পেটে। মাঝে মাঝে রাগ হয় আল্লাহর উপর – আমার রূপের অহংকার ভাঙবার জন্যেই যেন তাঁর এই চালাকি।
আমি চুপ করে আছি। ভাবীর দিকে চেয়ে মনে হচ্ছিলো, হালকা ভাবেই ভাবী কথা বলছে – কিন্তু তা নয়, একথা এসেছে গভীর থেকে, ভাবীর সত্তার শিকড়ে শিকড়ে বেদনার ঘূর্ণিঝড় তুলে। হৃদয় মন্থন করে বেদনায় বিধূর হয়ে যে- কথা আসে, এ সেই কথা। – আর তারই জন্য দেখলাম, ভাবীর, চোখ অশ্রুসজল – দু’ফোটা পানি চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে চোখের নিচেই থেমে গেছে – যেন স্বচ্ছ দুটি মুক্তদানা! – জানালার ফাঁক দিয়ে আসন্ন সন্ধ্যার রক্তিমতা তারই উপর পড়ে চকচক করে উঠছে।
ভাবী যেন দিব্যি দেখতে পাচ্ছে – এক শিল্পী তারই নিজের গড়া মূর্তির সৌন্দর্যে ঈর্ষান্বিত সে তার অপরূপ সৃষ্টির সৌন্দর্য নষ্ট করতে – তাকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চেষ্টা করছে – হিংস্রতার বর্বরতায় শিল্পী তার নিজের সৃষ্টির বিরুদ্ধেই ক্ষেপে গেছে!
দুদিন ছিলাম ভাবীদের বাড়িতে – আর তাতেই সুযোগ পেয়ে গেলাম ভাবীর হাবভাব চলাফেরা লক্ষ্য করবার। বাজ পাখির চোখের মত আমার চোখ তখন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে সেই তীক্ষ্ণ চোখে ভাবীর জীবনের সূক্ষতম পার্থক্যটুকুও ধরা পড়লো।
দেখলাম, ভাবী যেন একটু আনমনা, একটু আলেগোছে, এই সংসার থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন কিছুটা উদাসীন এক নারী, মন যার সদাই উড়ো উড়ো, চোখ যার বন্যতায় গহন অরণ্যানীর স্বপ্ন আনে।
কিছু বুঝতে পারলাম না, কেন এমন হলো? ভাবী নিজে যা আমাকে বলে না সে বিষয়ে ঔসুক্য প্রকাশ করবার স্বভাব আমার নেই। মনে হলো, এ যেন ভাবীর একান্তই পুশিদা। একান্তই গোপনীয় কথা – একটা উজ্জ্বল হাসি-খুশির আবরণে যা ঢাকা।
সন্তান সন্বন্ধে ভাবীর অভিযোগ ছিল তার কথা নিজেই খুলে বলেছিল ভাবী। স্পষ্টতঃ এ অভিযোগের চাইতে আরো গভীর কিছু রয়েছে তার উদাসীনতার অন্তরালে!
তবু ভাবী যতবার আমার সামনে এলো, যতবার কথা বলল প্রত্যেকবারই আমি তাকে পেলাম পূর্বকারই চেহারায়! – সেই নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, নীল পাথর-বসানো নাকফুল আর নীল ব্লাউজ। আজকাল ভাবী চোখে নীল সুরমাও মাখে, আল্লাহর নূরের তাজল্লিতে তূর পাহাড় পুড়ে যে নীল তৈরি হয়েছিল সেই নীল। ভাবীর যেন ধারণা, সংসারে অনেক নীলের মধ্যে পাহাড়ও নীল – সেই নীলের পরশ পেতে হলে সুরমা মাখা দরকার।
এই সব নীলে ঘিরে কি আশ্চর্যই না দেখাতো ভাবীকে।
ভাবীর অভিনয়দক্ষতা অপূর্ব। দুঃখ আর ব্যাথা যত তীব্রই হোক, আমার সামনে এলে ভাবী ঝলমলিয়ে ওঠে, উচ্চকিত উচ্ছলতায় কলকলিয়ে ওঠে, আর তারি আড়ালে সে লুকিয়ে থাক তার গোপন ব্যাথাটুকু। ভুলেও ভাবী কখনো নিজের দুঃখ নিয়ে আমাকে কষ্ট দিতে চায়না।
সেবার আশ্বিন মাস। বি.এ. পাস করে বাড়ি এসেছি। এ ক’বছরেও ভাবীর সাথে দেখা হয়নি। ধীরে ধীরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি, আর সেই রাজনীতির তাগিদ মেটাতে গিয়ে কোন ছুটিতে বাড়ি আসতে পারিনি, রাজনীতিতে আব্বা উৎসাহই দিতেন, কিন্তু আম্মা অতসব বোঝেন না, তাই বাড়ি না আসার জন্য তিনি রীতিমতো চটেছিলেন আমার উপর।
অবশ্যি রাগ এক সময় ভাঙলো – আর তাঁর রাগ মিটাতেই আমি ফুফুদের ওখানে রওনা হই। আমার পাসের খবর সবাই শুনেছে। তাই ফুফুদের সংসারে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার আমার কদর ভয়ানক। বি.এ. পাশ করে ফেরেশতা টেরেশতা গোছের কিছু একটা হয়ে পড়েছি – এমনি ওদের ধারণা।
ভাবীদের বাড়িতে যখন পৌছালাম, জামাল ভাই তখন তৈরি হয়েছে চাল-বোঝাই নৌকা ছেড়ে দেবার জন্য। ভবীরা ইতিমধ্যেই নৌকায় উঠে পড়েছে। জামাল ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, তোমার ভাবীর উপর নজর রেখো তো সিদু। ওর ভাব-সাব দেখে আমার কেমন যেন ভয় হচ্ছে!
এক সময় জামাল ভাই নৌকা ছেড়ে দিলো।
ভাবীর ঘরে গিয়ে দেখি – একটা পাটিতে নীল কাপড় বিছিয়ে চারদিকে পেরেক গেড়ে টানা দিয়ে ভাবী কাঁথ সেলাই করছে, ঠিক সেলাই করছে না, ছুঁচে নীল সুতা পরিয়ে ছুঁচটি হাতে নিয়ে উপর দিকে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে রয়েছে, অদ্ভুত চোখ মেলে চেয়েই রয়েছে সম্মোহিতের মতো, স্বপ্নে পাওয়ার মতো। মনেই হলো না ভাবী এ জগতে আছে!
কৌতুহল ঠেলে ওঠে আমার ভেতরে – ভাবী কি দেখছো? – কি দেখছে এত তম্ময় হয়ে? আমিও উপর দিকে চাইলাম, – কয়েকটা নীল ছিকা ছাড়িয়ে আমার দৃষ্টি উঠলো আরো উপরে – দেখলাম, একটা ভ্রমর উড়ছে কড়ি কাঠটার কাছে, গাঢ় নীল ভ্রমর, ঝকঝকে নীল ভ্রমর আর তার পাখার আঘাতে ভ্রমরের চার পাশের হাওয়াটুকুও নীলায়িত হয়ে উঠেছে।
ভাবীর চোখ তারই উপর নিবদ্ধ! আস্তে আস্তে আমি উচ্চারণ করি – ভাবী।
ভাবী হঠাৎ একটু কেঁপে গেল, ঘাড় বাঁকিয়ে চাইলো আমার দিকে। চোখে চোখ পড়তেই আমি হেসে ফেলি। একটু যেন অপ্রস্তুত হলো ভাবী। কিন্তু সে মুহুর্তের জন্যই । এক ঝলকেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আবার সে ঝলমলিয়ে ওঠে – ঢেউ এর মতো আন্দোলিত হয় আবেগে উচ্ছ্বাসে। স্মিত হেসে বলল – তোমাকে কিন্তু ভারী মানিয়েছে পোশাকটায়।
আমার পরণে বাদামী রঙের ভরা প্যান্ট, আর গায়ে ডোরাকাট শার্টের উপর নীল কোর্ট। ভাবীর দিকে চেয়েই আমি বলি, এ তারিফটা কি আমার কোটের জন্য করলে ভাবী?
ভাবী আবার মৃদু হাসলো। তারপর উঠে পড়লো বিছানো কাপড় গুটিয়ে – কাঁথা সেলাই আর হল না।
নীল শাড়ি তার ছিলই। ভাবী উঠে আমার কাছে এসে বসলো। তারপর রহস্য করে বলল – বলেছিলাম না আমি, সুলেমানী কিতাব পেয়েছি! কথা তো ফললো সিদু ভাইয়া! বি.এ. পাশ করেছো, এবার বড় দেখে একটা চাকরি-বাকরি যোগাড় করো।
– এ তোমার বাংলাদেশের মেয়ে নয় ভাবী – চিবিয়ে চিবিয়ে বলি, ভাবীর মুখের দিকে চেয়ে, চাকরির বাজার বকের বাজার নয়।
– তাই নাকি? ভাবী অসহায়তার ভান করে – কিন্তু লোকে তো তাই বলে।
– বলতে দাও ওদের। আমি জানি বি.এ. পাসের জন্য চাকরি না থাক, আছে বিয়ে। আমার একটা বউ জোগাড় করে দাওনা, শিগগির – ভাবীর কাছে রহস্যময় হয়ে উঠতে চেষ্টা করি।
ভাবী আমার মুখের দিকে চাইলো। তার কাচা কাচা মুখটাতে কিছু ঘাম – সেই মুক্তার রেণুর মতো ঘামের নিচে উদ্বিগ্ন হাসি যেন উঁকি দিচ্ছে – মনে মনে তোমার জন্য বউ খুঁজছি অনেকদিন, কিন্তু পাই কই। ভাবী অন্তরঙ্গতায় মধুর হয়ে ওঠে – তুমি যেমন সুন্দর, তেমনি একটা বৌ তো চাই তোমার। ভাবী একটু থামে, তারপর আরো আন্তরিক হয়ে ওঠে – সত্যি সিদু ভাইয়া, ঠিক আমার মতো একটা মেয়ে যদি পেতাম তোমার জন্য।
– অতো অহংকার ভালো নয় ভাবী, আমি কঠোর হবার ভান করি।
এ কি অহংকার হলো? ভাবী হো হো করে হেসে ওঠে – আমার রূপ আছে আমি বলবো না, আমি রূপবতী। সত্য বলা কি অহংকার?
আমি চুপ করে যাই। সত্যি ভাবীর রূপ আছে বলেই না রূপের অহংকার। আর অহংকারও এ নয় – এ তার নিজের রূপ সম্বন্ধে সচেতনতা। এই অদ্ভুত রূপের জন্য অনেকে মনে করে ভাবী পরী কিংবা জ্বিন, এ দুয়ের একটা হবেই। মানুষের রূপ নিয়ে মানুষের ঘরে জম্মই গ্রহণ করছে শুধু তার স্বভাব রয়ে গেছে পূর্ব জীবনের!
একবার প্রশ্ন করলাম, – তুমি বুড়া হবে না ভাবি? ষোলো বছর আগে তোমাকে যেমন দেখেছি, কি তাজ্জব, আজো তুমি তেমনি তরুণীই রয়ে গেছে।
– সত্যি সিদু ভাইয়া, ভাবীর স্বর এবার গম্ভীর হয়ে উঠে, নিজেই তাজ্জব হই যে আমি ভাঙছিনা, বদলাচ্ছিনা – এই যৌবন কেমন করে রাখলাম? যৌবন তো কচু পাতার পানি – একটু বাতাসেই ঝড়ে পড়ে। কত ভঙ্গুর এই দেহ আর যৌবন। এদেরই আমি ধরে রেখেছি। কিসের জোরে, বুঝতেই পারি না। একটু থেমে বলল, আমি বুড়া হবো না সিদু ভাইয়া, বুড়া হতে চাই না – বুড়া হবার আগেই আমি হাসতে হাসতে চোখ বুজবো।
অনেক কথা-বার্তার পর জানলাম, ভাবীর মেয়েটি মারা গেছে। ছেলেটিও তার আদর না পেয়ে আশ্রয় নিয়েছে গিয়ে দাদীর কোলে। ভাবীর কাছে বেশি ঘেঁষে না, আর তাতেই ভাবী যেন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।
তবু মনের গভীরে ভাবী অসুখী। কেন অসুখী ভাবী তা বলল না। মনস্তত্ত্বের বিচারে আমার বুদ্ধি আচ্ছন্নই হলো শুধু রহস্যে রয়ে গেল অভেদ্য।
ভাবী আমাকে তার ঘরে নিজে পরিবেশন করে খাওয়ালো। খেতে খেতে একবার বলি, পাড়াগাঁয়ে অজানা অচেনা পড়ে রইলে ভাবী, কেউ তোমাকে জানলো না, বুঝলো না। হতো তোমা জম্ম শহরে শিক্ষিত পরিবারে, কত লেখাপড়া তুমি শিখতে – আর কত বড় হতে তুমি। রূপ আর বিদ্যার জন্য দেশজোড়া নাম হতো তোমার।
ভাবী কাছেই দাঁড়িয়েছিল। হেসে বলল – তাতে কি সিদু ভাইয়া। তুমি এতো লেখাপড়া জানো, – আমি যখন থাকবো না, তুমি লিখে জানিয়ে দিয়ো যে এমনি একজন ভাবী ছিল তোমার।
ভাবী হাসলো বটে, কিন্তু মনে হলো কান্নার চেয়েও সে হাসি করুণ।
ভাবীদের বাড়িতে ক’দিন রইলাম।
ভাবীর উদাসীনতা আরো বেড়ে গেছে – ভয়ংকর রকমের আনমনা হয়ে উঠেছে ভাবী। আড়ালে আবডালে লুকিয়ে আমি লক্ষ্য করি তার এই উদাসীনতা, এই সংসার – বৈরাগ্য।
কিন্তু আমার সামনে যতবারই এলো, ভাবীকে পেলাম তার স্বাভাবিক সত্তায়, সতর্কবস্থায় এতটুকু ক্রুটি হয় না কখনো। তার ক্ষণে-এক ক্ষণে আরেক ভাব এ বাড়ির অনেকেরই সন্দেহের কারণ হয়ে উঠেছে।
বাড়ির পেছনেই দীঘি, – ভাবী মাঝে মাঝে কলস নিয়ে দীঘিতে যায়, শখ করেই অবশ্যি যায়, আর কলস ছেড়ে দিয়ে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে! তারপর দৃষ্টি নামিয়ে আনে দীঘির পানিতে, যে পানিতে পড়েছে নীল আকাশের ছায়া! হঠাৎ কাউকে দেখলেই চকিতে ছুটে আসে বাড়িতে।
তবু আকাশ আর পানি নিয়ে ভাবী রোজই মগ্ন হয়ে রইলো এক বেদনা-বিধূর স্বাপ্নিকতায়। কখনো বা ও জানালার পাশে বসে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে, নয়তো একটা নীল পাখির দিকে – চেয়ে থাকতে থাকতেই চোখ ফিরিয়ে নেয় নিজের উপর, তারপর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে নিজের দিকে, ডুবে রয় নিজের মধ্যে। বাইরের জগতের অস্তিত্ব তখন মনের মানচিত্র থেকে মুছে যায়।
একটা দুরূহ রহস্যের পীড়নে আমার মন ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে। বিচিত্র একটা ধারণা হলো ভাবী সম্বন্ধে: পোষমানা পাখির যেন হঠাৎ মনে হলো তার পূর্ব জীবনের কথা, তার মুক্ত জীবনের কথা, আর তাতেই তার দুধকলায় এলো অতৃপ্তি।
আমি আরো লক্ষ্য করলাম, ভাবী মাঝে মাঝে চুপি চুপি আপন মনে কাঁদে।
আশ্বিন মাসে রোজাও পড়েছিল।
আমি ভাবীদের কাছারি ঘরে ঘুমাই, পালঙ্কের ওপর শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি ভাবীর কথা কেন এমন হলো ভাবীর?
অনেকগুলো চাকর-বাকর নিচে পড়ে থাকে। কাজ করে রাতের বেলা ওরা বাড়ি আসে রাতেই আবার বেরিয়ে যায়।
একরাতে সেহেরী-ভোজনটা বেশ সকাল সকালই সারা হলো। শুয়ে শুয়ে গরম লাগছে। তাই একবার বেরিয়ে পড়ি দীঘির দিকে। পানির উপরকার হাওয়ায় ঠান্ডা করা যাবে শরীরটা।
ভোর হবার তখন অনেক বাকি। আকাশে চাঁদ নেই, তুব শরতের নির্মোঘ নীল আকাশ তারায় তারায় বিচিত্র অস্পষ্ট আলো পড়ছে পৃথিবীতে আর তারই আবছা আলোতে স্বপ্নময়, রহস্যময় দেখাচ্ছে সব কিছু।
তারার আলোয় আমি নেমে পড়ি ঘাটের দিকে – তারপর বিস্ময়ে চমকিত হই, হাঁটু পানিতে দাঁড়ানো নারীমূর্তি দেখে। সহস্র বাজপাখির চোখ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। হয়তো বা নিশায় প্রাণীর চোখের মতো নতুন আলোকে দেখা দিল আমার চোখে। আমি আরো গভীর হয়ে চেয়ে দেখি, – এ আর কেউ নয়, ভাবী! পরণে তার নীল শাড়িটা আছেই, আর তার চারপাশে উড়ছে অজস্র জোনাকি, একেকটা নিবু নিবু আলোর টুকরো – হাওয়ায় ওড়ানো স্ফুলিঙ্গ। শিউরে ওঠা তরল অন্ধকারে,নৃত্য-পরা জোনাকিপুঞ্জের মাঝখানে ভাবীকে কেমন যেন অপার্থিব মনে হচ্ছে।
ঘাটের কাছেই পূর্বদিকে কয়েকটা উঁচু উঁচু গাছ – ভাবী ঘাটে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে নিচের দিকে চাইছে, তারপর মাথা তুলে পূর্ব দিকে চেয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে কি যেন খুঁজছে উৎসুক অধীরতায় কি যেন অনুসন্ধান করছে।
পা টিপে টিপে আমি ভাবীর একেবারে কাছটিতে গিয়ে দাঁড়াই। ভাবী তখনো তার নিজের স্বপ্নেই বিভোর। তার মাথায় কাপড় নেই। অতি ধীরে ধীরে ডান হাত বাড়িয়ে আলতো করে আমি স্পর্শ করি ভাবীর কাঁধ, ডাকি -ভাবী।
চকিতে ভাবী আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো, একটু যেন কেঁপে উঠলো ভাবী -একটু শিহরিত হলো। এভাবে ধরা পড়ে যাবে, এ যেন আশাই করেনি ভাবী। টের পেলাম, ভাবীও আমার দিকে চেয়ে একটু বিস্ময় বোধ করেছে, হয়তো তাজ্জব হয়েছে আমার গোয়েন্দাগিরিতে। একটু লজ্জাও হলো তার।
তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে ভাবী বলল – শুয়ে শুয়ে বড় গরম লাগছিলো সিদু ভাইয়া তাই ঘাটের দিকে এলাম। রাতটা ভারী ভালো লাগছে।
এ পর্যন্ত ভাবীর অভিনয়। এর আগে একদিন ভাবীকে গভীর রাতে সাঁতার কাটতে দেখেছি দীঘির পানিতে – আকাশের দিকে চেয়ে চিৎ হয়ে সেদিন অনেকক্ষণ ভেসেছিল পানির উপর। ভাবী আবার সহসা আনমনা হয়ে পড়ে। ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে নির্দেশ করে, তারপর মৃদূ গুঞ্জনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে – দেখো সিদু ভাইয়া, কেমন ঝলমল করছে তারাগুলো, কেমন লুকোচুরি খেলছে পাতার আড়ালে। টলমলে পানিতে যেন মুখ দেখছে ওরা – কেমন জীবন্ত – হাসি হাসি মানুষে মুখ।
ভাবীর ডান কাঁধে হাত রেখে, তার মাথার কাছে মাথা নিয়ে আমিও উপর দিকে – চাই – ভাবীর সুগন্ধি চুলে পরশ করলো আমার ডান গাল, আমার দৃষ্টি তার উঁচানো হাত বেয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে গিয়ে পৌঁছায় তারকালোকের শূন্যতায়।
ভাবীর কথাই ঠিক, একেকটা মস্তবড়ো তারা আকাশে দপদপ করছে; শুধু দপদপ করছে না, যেন তারকালোকের রাজকুমারীদের মজলিস বসেছে একেকটা জায়গায়। অনাদিকালের লক্ষ্যে এই তারাগুলো। এদের চোখের নিচে দিয়ে চলেছে লক্ষ কোটি বছরের মানুষের মিছিল। এই পৃথিবীর ধুলোবালির মানুষের জীবনের ক্ষণিকতা নিয়ে হয়তো ওরা হাস্য-রহস্যে মশগুল। কেউ হ্সাছে, কেউ নাচছে, কেউবা চুপ করে আছে – আর মাঝে মাঝে পাতার আড়ালে লুকিয়ে কৌতুহলি দৃষ্টি মেলে চাইছে আমাদের দিকে, আর সেই কৌতুহলী রাঙামুখ কেমন দেখায় পানিতে তাই দেখছে।
– কিন্তু তুমি খুঁজছিলে কি ভাবী? নেশা কাটিয়ে ওঠে বহুক্ষণ পর আমি প্রশ্ন করি।
– একটা তারা, সিদু ভাইয়া, একটা তারা – এতো আস্তে অথচ এতো আবেগভরে ভাবী উচ্চারণ করলো যে, আমার চমক লেগে গেলো, মনে হলো ভাবী যেন স্বপ্নে কথা কয়ে উঠলো – স্বপ্নের অতল থেকে যেন কথার বুদবুদ উঠলো চেতনার সমতলে – এই তারাগুলির মধ্যে একটা তারা আছে, যার নাম জোহরা! জোহরাকেই আমি খুঁজছি, কতোদিন ধরে খুঁজছি।
ভাবী মর্মন্তুদ হয়ে ওঠে এবার – সেই আবছা আলোকেও আমি স্পষ্টই ধরতে পারলাম। ভারী চোখের পাপড়ি-পাতা অশ্রুতে সিক্ত হয়ে উঠেছে। ভাবী আবার বলে – জোহরা ছিল রূপবতী, সারে-জাহানে কেউ সুন্দরী ছিল না তার মতো। হারুত-মারুত, দুই ফিরিশতা পর্যন্ত মজে গিয়েছিল তার রূপে। শেষে আল্লাহ তাকে তারা বানিয়ে আসমানে ঝুলিয়ে দিলেন। জোহরার রঙ নাকি নীল। এবার আমার ডান হাত ধরে আমার মুখের দিকে করুণ মিনতিতে ভেঙে পড়ে ভাবী – কতদিন ধরে খুঁজছি জোহরাকে। আজো তার খোঁজ পেলাম না। তুমি অতো লেখাপড়া জানো – তুমি আমাকে দেখাবে সিদু ভাইয়া, কোন তারাটি জোহরা।
নীলের উৎস তাহলে এখানেই?
ভয় হলো আমার। জোহরাকে কেন খুঁজছে, ভাবী? জোহরার সঙ্গে তার সই-অলা করবার সাধ হয়েছে কি? সাধ হয়েছে কি জোহরার পাশে তার নিজের ঠাঁইটুকু করে নেবার? নীল আকাশে পৃথিবীর মানব যাত্রীদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে জোহরার মতো অনন্তকাল ঝুলে থাকবার স্বপ্ন বুঝি ভাবী ছোটকাল থেকেই দেখছে। আর এই স্বপ্নে তার মন বিভোর বলেই কি ভাবী নীলরঙ দিয়ে কেবলি নিজেকে সাজাচ্ছে আর তৈরি হচ্ছে!
এখানেও ভাবী বাঁচিয়ে রেখেছে তার অসহ্য রূপের অহংকারঃ জোহরা আর ভাবী। – ভাবী, ধরা গলায় বললাম, ঘরে চলো এখন।
ভাবী যেন একটু নিরাশ হলো, কিন্তু কিছুই বললো না। মুখ ভার করে উঠে এলো বাড়ির দিকে। আমিও ফিরে গিয়ে কাছারি ঘরে শুয়ে পড়ি। ভাবীর জবিনের রহস্য অনেক খানিই যেন আজ উদঘাটিত হয়ে গেছে আমার কাছে – আর তাতেই আমার ভয় হতে লাগলো।
দুদিন ভাবী একটু মন মরা হয়ে রইলো, আমার সামনে এলো না। তৃতীয় দিনে কিন্তু আবার ঝলমল করে উঠলো আপন স্বাভাবিকতায় । ওই দিনই আমি বিদায় নিই ভাবীর কাছ থেকে।
ভাবী যে গাইতে জানে, তা জানতাম না। তার দেহটাই যেন একটা সপ্তস্বরা বীণাযন্ত্র তার মীড়ে মীড়ে ঘুমিয়ে আছে কত সুর, কত রাগিণী! তার সামান্য একটা কথায়, সামান্য একটু অঙ্গ সঞ্চালনে জেগে উঠতে দেখেছি সেই সুপ্ত সুরের মুর্ছনাকে, সেই ঘুমন্ত সঙ্গীতের আনন্দ-কোলাহলকে।
আজ আমাকে বিদায় দিতে গিয়ে ভাবী যখন সত্যি সত্যিই গাইলো, হেসে হেসেই যখন গুনগুণিয়ে উঠলো -ওগো, কিশোর বেলার প্রিয় সাথী ভুলে যেয়ো না – মনে হলো আসমান আর পৃথিবী যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে অপূর্ব এক বেদনায়; আমাদের ঘিরে সে বেদনার কল্লোল জাগছে এবং মুহুর্তের মধ্যেই যেন আমি বিচ্ছেদের অশ্রু-সমুদ্রের ওপারে নির্বাসিত হয়ে গেছি!
বহুক্ষণ পর, নিজের মধ্যে থেকেই যেন নিজে জেগে উঠলাম আবার -জড়িত গলায় বললাম – এ গান তুমি কোথয় শিখলে ভাবী?
– শুনেছিলাম কলের গানে, মনের মধ্যে গাঁথা ছিল তোমার জন্য -সহজ ভাবে জবাব দেয় ভাবী, ভাবলাম, যদি কোনদিন সুযোগ পাই, তোমাকে শোনাবো, ভারি ভাল লেগেছিল গানটা।
– কিন্তু এই মনে রেখো’, ‘ভুলে যেয়ো না’ – এসব কথা আমার মোটেই লাগে না। সীমাহীন অভিমান উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে আমার কণ্ঠে, – আমি যেন তোমাকে ভুলে যাচ্ছি আর কি! একটু থেমে বলি, আসলে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না ভাবী।
ভাবী এর জবাবে কিছু বলল না, শুধু একটু স্মিত হাসিতে তার মুখখানা করুণ হয়ে উঠলো।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
প্রায় মাসেক পর। এক সুন্দর প্রভাতে খবর পেলাম, ভাবী পানিতে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করেছে।
কিছু ভাবতে পারলাম না – শুধু মনে হলো, ঝলোমলো প্রভাতেই সারা পৃথিবী জুড়ে বর্ষা সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে এবং সেই অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে একাকী কেঁদে কেঁদে চলেছে এক মানবী, যার হাসিতে হাসি ফুটতো এই পৃথিবীতে, যার চোখের পরশে স্নিগ্ধতা আসতো এর লতায় অরণ্যে।
ভাবীকে শেষ দেখার জন্য আমি ছুটে যাই।
দারোগা যখন আমাকে নিয়ে ভাবীর দেহ পরীক্ষা করছে, তখনো ভাবীর পরাণ রয়েছে। নীল শাড়ি আর হাতে নীল রেশমি চুড়ি, চোখে নীল সুরমা, বাঁ হাতের একটা আঙুলে নীল আংটি, আর নাকে সেই নীল পাথর বসানো নাক-ফুলটি। – গুচ্ছ গুচ্ছ চুলগুলি ভাগ করা একটি নীল ফিতা দিয়ে। – আরো আশ্চর্য, ভাবীর চোখ দুটির বিস্ময়কর দৃষ্টি তখনো নিবদ্ধ রয়েছে নীল আকাশের দিকে।
দারোগা জিজ্ঞেস করলো – সবই যে নীল রঙের দেখছি!
– নীল রঙ খুব পছন্দ করতো, আমি বললাম, স্বর আমার কান্নায় ভারী হয়ে আসে। দারোগা লক্ষ্য করলে দেখতে পেতো, আমার চোখে অশ্রুর জোয়ার উচ্ছ্বসিত। তাড়াতাড়ি আমি রুমাল দিয়ে মুছে নিই চোখ দুটি।
– মেয়েটির কি বিয়ে হয়েছিল? দারোগা আবার প্রশ্ন করে।
– হ্যাঁ প্রায় কুড়ি বছর আগে, সংক্ষিপ্ত উত্তর দেই।
– কত বছর আগে? দারোগার কণ্ঠে অপরিমাণ অবিশ্বাস।
– প্রায় কুড়ি বছর আগে – দারোগার কানের সন্দেহ ভঞ্জন করবার জন্য আরো স্পষ্ট করে এবার বলি।
বিষ্ময় বিমূঢ় দারোগা শুধু বলল – অদ্ভুত!
বহু বছর চলে গেছে এর পর।
আমি জাহাজে বড়ে চাকরি করি। স্থল ছেড়ে পানির উপরই আমার জীবন-তরী ভাসিয়ে দিয়েছি – ভাসিয়ে দিয়েছি অথৈ সমুদ্রের বুকে। কেউ জানে না, কেন আমি জাহাজে চাকরি নিলাম, কেন পানিতে ভাসলাম।
এখন আমি দিনের চব্বিশটা ঘন্টাই নীল পোশাক পরে কাটাই। মাথার উপর সব সময়ই দেখতে পাই নির্মল নীল আকাশ আর নিচে নীল পানি – মহাসাগরের অগাধ নীল পানি। সেই নীল পানিতে ছায়া ফেলে মাঝে মাঝে বেড়ায় সামুদ্রিক পাখি, ঘন নীল পাখি।
আমার চোখ ভরে মন রাঙিয়ে কল্পনা আচ্ছন্ন করে কেবল নীল আর নীল -মুখর তরঙ্গায়িত নীল।
এই অথৈ নীলের মধ্যে আমি যেন ভাবীকে খুঁজে পাই।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024